রকিং চেয়ার
দেবব্রত দাশ
এক
এক রবিবারের
সকালে ডাইনিং টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে বাড়ির সবাই একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করার সময়
সন্টাইয়ের ঠাকুমা শুভলক্ষ্মী সান্যাল তাঁর বড়োছেলে মানে --- সন্টাইয়ের বাবা
নিখিলেশের উদ্দেশে বললেন, “তোর কাছে
একটা জিনিস চাইব রে বড়োখোকা... বহুদিনের শখ আমার... এনে দিবি?”
নিখিলেশ
ডিমের ওমলেটের টুকরো চামচে করে মুখে তুলতে তুলতে বলল, “বলো মা ---
কী চাও তুমি।”
“বলছি,” শুভলক্ষ্মীর
চোখমুখ শিশুদের মতোই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, “জানিস বড়ো
খোকা, বিয়ের
পর যখন তোদের এ সংসারে প্রথম এলাম, তখন থেকেই ইচ্ছেটা চেপে রেখে দিয়েছি
মনের মধ্যে,
বলা আর হয়ে ওঠেনি... আসলে, সংসারের অবস্থা সে সময় সচ্ছল ছিল না
একেবারেই। তোর বাবা বাড়ির বড়ো ছেলে আর একমাত্র রোজগেরে হওয়ার দরুন তার ওপর তখন
ভীষণ চাপ। তাই,
বলা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা কী জানিস? এখন আমার এই
তিন কুড়ি বয়েসেও শখটা মরে যায়নি। জিনিসটা হল --- রকিং চেয়ার।”
“অবাক
করলে মা!”
নিখিলেশের কণ্ঠে মৃদু অনুযোগ, “আমাকে এত বছর পরে বলছ তুমি!”
“তুইও
তো সংসারের জন্যে মুখে রক্ত তুলে কঠিন সংগ্রাম করে চলেছিস দিনের পর দিন। আজও বলতাম
না হয়তো,
কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছে!”
“ঠিক
আছে মা, এই
প্রথম তুমি কিছু চাইলে আমার কাছে, আমি... আজ তো রোববার... কাল-পরশুর
মধ্যেই এনে দেব তোমায়।”
“অনেক
দাম, তাই
না?” কিঞ্চিৎ
বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করেন শুভলক্ষ্মী, তারপর উত্তর পাওয়ার আগেই মন্তব্য
করেন, “কাল-পরশু
আনতে হবে না। এখন তো মাসের শেষ, সামনের মাসে মাইনে পেয়ে আনিস।”
“সে
ভাবনাটা আমার মা, আমার ওপরেই ছেড়ে দাও তুমি,” নিখিলেশের
অনমনীয় কণ্ঠস্বর, “মাসের শেষ তো কী হয়েছে! তোমার বড়ো খোকার আর্থিক অবস্থার ওপর
কি ভরসা নেই একটুও? এ তো সামান্য এক রকিং চেয়ার, ‘সাত রাজার
ধন এক মানিক’-ও
যদি চাইতে,
যখন বলেছি --- কাল-পরশুর মধ্যে এনে দেব, তো আনবই।”
শুভলক্ষ্মী
কাঁচুমাচু মুখ করে কোলের ওপর থেকে ‘আনন্দবাজার’-এর
বিজ্ঞাপনের পাতাটা বাড়িয়ে ধরেন নিখিলেশের দিকে, “দ্যাখ্ তো
--- দাম লেখা আছে কিনা।”
নিখিলেশ
দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, “অনেকগুলো মডেল-এর ছবি দিয়েছে এখানে, সঙ্গে
দাম। তুমি দেখে বলো মা, কোন্ রকিং চেয়ার-টা পছন্দ তোমার... ওটাই
আমি অনলাইনে আনানোর ব্যবস্থা করব।”
শুভলক্ষ্মী
সন্টাইকে উদ্দেশ করে বললেন, “দাদুভাই, ওই চেয়ারে
আমি তো আর একা একা দোল খাব না, তোদেরকে কোলে বসিয়ে দুলব... তুই
পছন্দ করে বলে দে তোর বাবাকে, তোর পছন্দই আমার পছন্দ।”
দুই
পরের দিনই
অনলাইনে অর্ডার দেওয়া রকিং চেয়ার চলে এল। বাড়ি শুদ্ধু হই হই পড়ে গেল একেবারে। সন্টাইয়ের
ছোটকা কমলেশের ছেলে ভোম্বল আর মেয়ে কুমকুম তো বটেই, মেতে উঠল
বাকি সদস্যরাও... ছোটো বড়ো সব্বাই। নিখিলেশ অফিস থেকে ফিরে তার মায়ের ঘরের
ব্যালকনিতে রকিং চেয়ারে মাকে বসে দোল খেতে দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী...? পছন্দ হয়েছে তো তোমার?”
“তা
আর বলতে! আমার চেয়েও বেশি পছন্দ হয়েছে বাড়ির সব ক’জন খুদের। এতক্ষণ তো ওরাই বসে
দোল খাচ্ছিল,
অতি কষ্টে আমি দখল নিয়েছি খানিক আগে! আমার কত দিনের শখ পূরণ করলি তুই বড়ো খোকা!
তা --- দিতে হল কত?”
“সে-খবরে
কাজ কী তোমার মা? তুমি দামের চিন্তায় মাথা ভারী না করে আদরের নাতি-নাতনিদের
নিয়ে দোল খেয়ে যাও খোশমেজাজে... ব্যস।”
এরপর
শুভলক্ষ্মীর দোতলার ঘরে খুদে তিনজনের আনাগোনা বেড়ে গেল। সকাল-বিকেল-সন্ধে
চেয়ার-দখলের লড়াই চলতে থাকে ওদের মধ্যে --- কে গিয়ে আগে বসবে ঠাম্মার কোলে।
বয়েসে
সবচেয়ে বড়ো সন্টাই। সাত পেরিয়ে আটে পড়েছে। ভোম্বল সাত আর কুমকুম চার... সে এখন
কে.জি ওয়ান,
পড়ার চাপ কম আর তাই অন্য দু'জনের তুলনায় রকিং চেয়ার-দখলের সুযোগ
তারই সবচেয়ে বেশি। অবশ্য, ছুটির দিনগুলোতে কুমকুম কোণঠাসা হয়ে
প্রায়ই তার ঠাম্মার শরণাপন্ন হয়।
এদিকে, সন্টাই
আর ভোম্বল তো মহা চিন্তায় পড়ে গেছে... সামনে দুর্গাপুজো, ওই সময়
বিলাসপুর থেকে আসবে সন্টাইয়ের মেজকা, মেজকাকিমণি আর একরত্তি খুড়তুতো ভাই
কুট্টুস। কুট্টুস সবে পাঁচ। হলে কী হবে... যা একখানা বিচ্ছু আর মারকুটে স্বভাবের
ছেলে... সন্টাইও কুট্টুসের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে সবসময়! কাজেই, ওইসময় রকিং
চেয়ার হাতছাড়া হবেই। শুভলক্ষ্মী অবশ্য ওদেরকে ভরসা জুগিয়েছেন, “কিচ্ছু
ভাবিস না তোরা,
কুট্টুসকে সামলানোর দায়িত্ব আমার।”
এক রোববার
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর তিন খুদে এসে জমিয়ে বসল তাদের ঠাম্মাকে ঘিরে। কী? ---
না, গল্প
শোনাতে হবে। সন্ধে থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে, থামার কোনো
লক্ষণই নেই। এমন রাতে গরম গরম খিচুড়ি আর সঙ্গে ডিমভাজা খেয়েছে ওরা, বাকি
শুধু গল্প। গল্প মানে --- ভূতের গল্প।
সন্টাই
শুভলক্ষ্মীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ কিন্তু ছাড়াছাড়ি নেই, তোমাকে
নতুন গল্প বলতেই হবে ঠাম্মা। আর সেটা অবশ্যই ভূতের গল্প। রাজপুত্তুর-রাজকন্যা আর
রাক্ষস-খোক্কসের গল্প নয়...”
“ওহ্!
ভূতের গল্প?”
শুভলক্ষ্মীর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি, “ভূত তো আমি
প্রায়ই দেখি... দেখি মানে দেখছি আজকাল প্রায় রোজ রাত্তিরেই... এই রকিং চেয়ারটা
আনার পর থেকে।”
“তাই
নাকি ঠাম্মা!”
তিনটে উৎসুক মুখ ছেঁকে ধরে শুভলক্ষ্মীকে চারপাশ থেকে, “কোথায় দেখেছ?”
“কোথায়
আবার, এই
রকিং চেয়ারে! বসে দুলছে, দোল খেয়েই যাচ্ছে... গত পরশুই তো
দেখলাম! রাত তখন কত হবে? --- দুটো কি
আড়াইটে। টয়লেটে গিয়েছিলাম, বেরিয়ে দেখি --- ব্যালকনির দিকের
দরজার পাল্লা খোলা। রকিং চেয়ারটা দুলছে, দুলেই চলেছে! যে বসে দোল খাচ্ছে, তার
মাথার পেছন দিকটা দেখতে পাচ্ছি। সাদা করোটি।”
“'করোটি' মানে
কী ঠাম্মা?”
জিজ্ঞেস করে ভোম্বল।
“'করোটি' মানে
--- মাথার খুলি আর কী...” শুভলক্ষ্মী বুঝিয়ে বলেন, “কঙ্কালের
ছবি দেখেছিস তো তোরা নিশ্চয়ই --- দেখিসনি?”
“দেখেছি
ঠাম্মা --- দেখেছি,” বলে ওঠে নবীনতম প্রজন্মের তিনজন সমস্বরে, “টি.ভি-তে
দেখেছি।”
“আর
কী দেখলাম জানিস?”
“কী
ঠাম্মা?”
চোখ গোল গোল করে তাকায় কুমকুম।
“চেয়ারের
দুটো হাতলে ভর দিয়ে কঙ্কাল উঠে দাঁড়াল, তারপর আস্তে আস্তে ঘুরে আমার দিকে তাকাল।”
“তোমার
ভয় করল না ঠাম্মা?” কুমকুমের গোল্লা গোল্লা চোখ আরও বড়ো হয়ে গেল।
“ভয়
করল না মানে? ---
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মেরুদণ্ড বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল হিমশীতল
শিহরন! এই দ্যাখ্ দ্যাখ্, আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে এখন!”
“তুমি
ব্যালকনির দিকের দরজার পাল্লা বন্ধ করে শোওনি ঠাম্মা?” জিজ্ঞেস করল
সন্টাই,
“ভুলে গিয়েছিলে না কি?”
“আরে
--- শোন্ই না আগে পুরোটা!” শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা, “তারপর...
সেই হাড়ের কাঠামো দুই হাতে তালি বাজিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ক্রমশ
লম্বা হতে হতে সে-হাত যখন আমাকে ছোঁয় ছোঁয়, তখন আমি
বিছানায় উঠে ঠাকুরের নাম জপতে জপতে শুয়ে পড়েছি।”
“তারপর?”
“কখন
যে অমন হাড়হিম-ভয়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি! সকালে উঠে কী দেখলাম
জানিস? -- ব্যালকনির
দিকের দরজার পাল্লা বন্ধ।”
কুমকুম আর
ভোম্বল, দু'জনেই
গুড়িসুড়ি মেরে সেঁধিয়ে গেল ঠাম্মার কোলে।
শুভলক্ষ্মী
খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, “ব্যালকনির কাছেই এই যে বেলগাছটা
রয়েছে না... ওখান থেকেই হয়তো...”
“হয়তো
কী ঠাম্মা ?”
“হয়তো
বেহ্মদত্যির ইচ্ছে হয়েছিল... বেলগাছেই থাকে তো বেহ্মদত্যি... রকিং চেয়ার দেখে দোল
খেতে নেমে এসেছিল।”
শুভলক্ষ্মীর
বলা এই গল্প তিন খুদের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির বাকি সদস্যদের কাছে। ভূত বিশ্বাস
করুক বা না
করুক, ভূতের
গল্প শুনে ভয়ের আমেজ উপভোগ করতে ছোটো বড়ো সকলেই ভালোবাসে, ভূতের
খপ্পরে পড়তে কে-ই বা চায়! কিন্তু, সেটাই ঘটল দু'দিন
পর। সন্টাইয়ের ছোটো কাকিমণি সন্ধেবাতি দিতে শুভলক্ষ্মীর ঘরে ঢুকে দ্যাখে --- তার
শাশুড়ি-মা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন আর ঠিক তাঁর পাশে রকিং চেয়ারে বসে দুলছে দীর্ঘ
এক অবয়ব,
আলো-আঁধারিতে যার মুখ দেখা যাচ্ছে না পাশ থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে কিনা
ভাবনার মাঝেই সেই অবয়বের মুণ্ডুটা একশো আশি ডিগ্রি পাক খেয়ে উলটোমুখী হয়ে কাকিমণির
মুখের দিকে যেই না চাইল, সঙ্গে সঙ্গে ভিরমি খেয়ে কাকিমণি পড়ে
গেল মেঝেয়। শব্দ শুনে টয়লেট থেকে দ্রুত বেরোলেন শুভলক্ষ্মী। তাঁর
চিৎকার-চেঁচামেচিতে সন্টাইয়ের মা ছুটে এলেন। চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরানো
হল কাকিমণির। তখনই তার মুখ থেকে জানা গেল ভয় পাওয়ার কারণ।
শুভলক্ষ্মী
বললেন, “রকিং
চেয়ার আনিয়েই দেখছি ভুল করেছি!”
“না
মা --- তাতে কোনও বিপত্তি বাধেনি, তুমি ভুল করেছ ভূতের গল্প শুনিয়ে,” মন্তব্য
করে নিখিলেশ।
“আরে
শোন্ বড়ো খোকা --- শোন্, ওটা তো গপ্প... সত্যি নয়। আমি বানিয়ে
বানিয়ে বলেছি। এমন ভাবে চেপে ধরেছিল নাতি-নাতনিরা যে... কী করতাম বল্! বানিয়ে বলতে
বাধ্য হয়েছি।”
“তুমি
সত্যিই রকিং চেয়ারে কাউকে দ্যাখোনি ঠাম্মা!” চোখ কপালে
তুলে বলে সন্টাই।
“না
দেখিনি,”
শুভলক্ষ্মী যুক্তি দিয়ে নাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, “আমি ভাবতাম, তুই
চালাক। কিন্তু তুইও বোকা বনে গেলি আর বাড়ির সক্কলকে ফলাও করে শোনালি আমার ওই
বানানো গপ্প! আর বলিহারি ছোটো বউমা তুমি, বাচ্চাদের মুখ থেকে শুনে বিশ্বাস করে
বসলে! ভূত যে নেই, আমরা সবাই জানি। তবু, ভূতের গপ্প
শুনতে চাই কেন বলো তো? --- ভয়ের আমেজ উপভোগ করব বলে। আচ্ছা সন্টাই, তুই-ই
বল, ভূত
যদি থাকবেই,
তবে সে কখনও প্রকাশ্য দিবালোকে দেখা দেয় না কেন! ছোটো বউমা, তুমি
যা দেখেছ,
তা আসলে হ্যালুসিনেশন... তোমার মনের গভীরে গেঁথে থাকা গপ্পের ভূতই বেরিয়ে এসে
কায়া ধরেছে।”
তিন
এরপর সব
ঠিকঠাক চলল। রকিং চেয়ারে নাতি-নাতনিদের নিয়ে শুভলক্ষ্মী আগের মতনই বসতে লাগলেন
সকাল-বিকেল-সন্ধে, শুধু বন্ধ হয়ে গেল ভূতের গল্প শোনানো।
দুর্গাপুজোর
সময় বিলাসপুর থেকে সন্টাইয়ের মেজকা অমলেশ সপরিবারে এসে ফিরেও গিয়েছে যথাসময়ে। রকিং
চেয়ারে এখন মাঝেমধ্যে বসছে নিখিলেশও। সাবলীল গতিতে ঘুরে চলেছে সংসারের চাকা। দেখতে
দেখতে একটা বছর পার হয়ে আবার এসেছে শ্রাবণ। আজকাল যখন নাতি-নাতনিরা বাড়ি থাকে না, তখনও
শুভলক্ষ্মী রকিং চেয়ারে বসে দোল খান, ফিরে যান তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোতে, যখন
বেঁচে ছিলেন সন্টাইয়ের দাদান। ভাবেন, মানুষটা সুখের মুখ দেখে যেতে পারল
না... কী এমন বয়েস হয়েছিল তার! সাতান্ন বছর বয়েস কি চলে যাওয়ার বয়েস? অথচ, মাত্র
তিনদিনের জ্বরে...! রক্ত-পরীক্ষায় ধরা পড়েছিল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, তখন
নাকি আর কিছুই করার ছিল না!
ভাদ্র
পেরিয়ে এল আশ্বিন। আশ্বিনের প্রথম রোববারের বিকেল। সন্টাই বসে আছে শুভলক্ষ্মীর
কোলে রকিং চেয়ারে। এ বছর বর্ষা দক্ষিণবঙ্গ থেকে যাই যাই করেও যেতে চাইছে না। দিনভর
আকাশের মুখভার। আজও সকালের দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, এখন আবার
পড়ছে টিপ টিপ করে।
কুমকুম নীচে
থেকে এসে সন্টাইকে খবর দিল, “দাদা, তোকে খেলার
জন্যে ডাকতে এসেছে ভোজকু-দা।”
সন্টাই
শুভলক্ষ্মীর কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি খেলতে যাচ্ছি ঠাম্মা।”
সাড়া না
পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী --- ঘুমিয়ে পড়লে নাকি তুমি?”
শুভলক্ষ্মী
কোনও জবাব দিলেন না। ভয় পেয়ে সন্টাই বলল, “নিশ্চয়ই শরীর খারাপ লাগছে তোমার!”
শুভলক্ষ্মীর
মুখের কষ বেয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে তখন। দেখে হাউমাউ করতে করতে ভাইবোন ছুটল মা আর
কাকিমণিকে খবর দিতে।
হাউস
ফিজিশিয়ান এসে ইঞ্জেকশন দিলেন, বললেন, “ম্যাসিভ
হার্ট-অ্যাটাক। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
কিন্তু, অ্যাম্বুল্যান্স
আসার আগেই...
পারলৌকিক
কাজকর্ম মিটে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর এক বৃষ্টিঝরা বিকেলে সন্টাই তার ঠাম্মার ঘরের
খাটে গিয়ে বসেছে। ঘুরেফিরে ঠাম্মার কথাই মনে পড়ছে তার। এমন হঠাৎ করে সব্বাইকে ছেড়ে
অসময়ে চলে গেল ঠাম্মা! খুব অভিমান হয় সন্টাইয়ের... একবারও ভাবল না --- তারা কীভাবে
থাকবে!
হঠাৎ চোখ
চলে গেল ব্যালকনির দিকে। কী আশ্চর্য! কী দেখছে সে? --- ঠাম্মা
রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে আগের মতন আর তাকে দেখতে পেয়ে মিটিমিটি হাসছে!
সন্টাই কাছে
যেতেই ঠাম্মা দু’হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে কোলে বসাল। বলল, “মনখারাপ
করিস না তুই দাদুভাই, আমি তো এ বাড়িতে তোদের সঙ্গেই আছি। আগের মতোই বসে থাকি আমার
প্রিয় এই রকিং চেয়ারে।”
অনেকদিন পরে
ঠাম্মার হাতের ছোঁয়া পেয়ে খুব ভালো লাগে সন্টাইয়ের। তার
কানের কাছে মুখ এনে ঠাম্মা বলে, “জানিস দাদুভাই, আমি
তোদেরকে যে গপ্পটা বলেছিলাম সে-রাতে, সেটা একটুও বানানো ছিল না। তোর
কাকিমণি যাতে আর ভয় না পায়, তাই বলেছিলাম --- বানানো। আর
কাকে চেয়ারে বসে দোল খেতে দেখেছিলাম জানিস?”
“কাকে
ঠাম্মা?”
“তোর
দাদান-কে।”
হঠাৎ আকাশ
ফালাফালা করে ঝলসে ওঠে বিদ্যুৎ, প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ে ধারেকাছে।
সে-শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসে সন্টাই। বসে থাকতে থাকতে কখন যে সে ঠাম্মার বিছানায়
শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতেও পারেনি।
খাট থেকে
নেমে সন্টাই এগিয়ে যায় ব্যালকনির দিকে। বিদ্যুৎ-চমকের সঙ্গে ক্রমাগত বাড়তে থাকে
ঝোড়ো হাওয়ার দাপট, সমানে দুলেই চলে ঠাম্মার রকিং চেয়ার।
_____
ছবিঃ রাজা আক্তার
Its Roking
ReplyDeleteদারুণ, যদিও প্রথমেই দাদানের কথা মাথায় এসেছিল। ডায়লগগুলো এই গল্পের সবচাইতে বড় শক্তি। সিনিয়ারদের কাছে এটিই শেখার।
ReplyDeleteRocking story
ReplyDelete