ডক্টর হুবার্ডের ডায়রি
কুশল চট্টোপাধ্যায়
* * *
* * *
ডক্টর হুবার্ডের ডায়রি
কুশল চট্টোপাধ্যায়
[সারকথাঃ হঠাৎ করেই বিশ্ব জুড়ে এক অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে, লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিখ্যাত বায়োকেমিস্ট ডক্টর এইচ জে হুবার্ড বিগত পনেরো দিন ধরে দক্ষিণ আমেরিকায় তাঁর সাও-পাওলোর বাড়ি থেকে নিখোঁজ। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার বাড়ির বাইরে থেকে নয়, বাড়ির ভেতরে নিজের ল্যাবরেটরি থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন তিনি। বহু খুঁজেও তাঁর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। তাঁর ছেলে বিখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম হুবার্ড তাঁর একটা ডায়রি খুঁজে পান তাঁর বাবার ল্যাবরেটরি থেকে। চামড়া বাঁধানো বেশ মোটা কালো রঙের একটা ডায়রি। কী লেখা আছে ওই ডায়রিতে? ড. হুবার্ডই বা গেলেন কোথায়?]
উইলিয়াম হুবার্ডের কথাঃ আমার বাবা প্রখ্যাত বায়োকেমিস্ট ডক্টর এইচ জে হুবার্ডের দৌলতে জীবনে এমন অনেক অত্যাশ্চর্য জিনিস দেখেছি বা শুনেছি যা ইতিপূর্বে অন্য কারোর দেখার বা শোনার সৌভাগ্য হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। তবে ঐ পর্যন্তই, দেখে বা শুনে আনন্দ পেতাম, বন্ধুদের কাছে সে সব গল্পও করতাম। শুনতে শুনতে ওদের বিস্মিত হতবাক দৃষ্টি দেখে নিজেরও কেমন যেন একটা গর্ব অনুভব হত, কিন্তু তা বলে বাবার সে সমস্ত কাজ কোনোদিনই আমাকে তাঁর মতো হওয়ার জন্য প্রভাবিত করতে পারেনি, কেন তা বলতে পারব না। বাবা অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন আমাকে তাঁর নিজের মতো করে গড়ে তুলতে, কিন্তু বলা বাহুল্য তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অঙ্কের ভীতি সেই ছোটোবেলা থেকে শুরু করে কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়া করে বেরিয়েছে আমাকে। আজ পর্যন্ত কোনোদিন কেমিস্ট্রির একটা ফর্মুলাও পুরোপুরি সঠিক লিখতে পেরেছি বলে আমার মনে পড়ে না। জিনতত্ত্বের চেকারবোর্ড বানাতে গিয়ে প্রকট ও প্রচ্ছন্নের গোলকধাঁধায় পড়ে কতবার যে ঘামতে ঘামতে ওয়াশরুমে গেছি তার হিসাব নেই, আর ফিজিক্সের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমার মতো অপদার্থের নিরেট মস্তিষ্ক যে ফিজিক্সের মতো সূক্ষ্ম
পদার্থের জন্য নয় সেটা বোঝাটাই আমার জীবনের একটা আবিষ্কার বলা যেতে পারে। বাবা হয়তো এতে দুঃখ পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কখনও এ নিয়ে তাঁকে অন্য কারও কাছে খেদ প্রকাশ করতে দেখিনি। সাহিত্য জিনিসটা বরাবরই টানত আমাকে। স্কুলে থাকতেই সাও-পাওলোর ছোটোখাটো শিশুপত্রিকাগুলোতে টুকটাক লেখালিখি করতাম, পুরস্কারও পেয়েছিলাম বেশ কিছু। বাবাকে সেগুলো দেখাতে তিনি এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে বলবার নয়। একবার তো আনন্দের চোটে মস্ত একটা পার্টিই অ্যারেঞ্জ করে ফেলেছিলেন, আমন্ত্রিত ছিলেন পৃথিবীর তাবড় তাবড় সব বিজ্ঞানীরা। ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেছিলাম সেদিন, ইচ্ছা করছিল বাড়ি থেকে ছুটে পালাই কিন্তু তখন নিতান্তই ছোটো আমি। হারিয়ে যাবার ভয় তো ছিলই আর তার সঙ্গে ছিল যাদুকর বার্গাল্ডের ভয়। তাঁকে কখনও দেখিনি, তবে আমার পরিচারিকা মেরি ক্লিটনের মুখে শুনেছি রাস্তার ওধারের উপত্যকার পাশে দেবদারু বনের ভিতর পাহাড়ের পাদদেশের এক গুহায় সে বাস করে। ছোটো ছেলেমেয়েদের দেখতে পেলেই নাকি তুলে নিয়ে গিয়ে গিনিপিগ বানিয়ে দেয়। বড়ো হবার পর বহুবার সেখানে গেছি কিন্তু বাস্তবিক যাদুকর বা তার গুহা কোনোটাই নজরে পড়েনি আজ পর্যন্ত।
আমাদের বাড়িটা মূল শহর থেকে অনেকটাই ভিতরে। এত বড়ো একজন বিজ্ঞানী হওয়া
সত্ত্বেও বাবা যে কেন শহর ছেড়ে এত দূরে বাড়িটা করেছিলেন তা আমার অজানা। কেবল অনুমান করতে পারি যে নিভৃতে গবেষণা করবেন বলেই হয়তো শহরের কোলাহল থেকে অব্যাহতি পেতে এখানে চলে এসেছিলেন বাবা। শহর থেকে দূরে হলেও আমার কিন্তু বেশ লাগত জায়গাটা। ছোট্ট একটা টিলার ওপরে আমাদের বাড়িটা, তার চার পাশে অনেকখানি অংশ জুড়ে ফুলের বাগান। প্রায় সারাটা বছরই বিভিন্ন মরশুমি ফুল, বাহারি অর্কিড এবং ক্যাকটাসের সমারোহ লেগে থাকত। উদ্ভিদবিজ্ঞানে আনাড়ি হলেও বাগান করার মূল উৎসাহটা ছিল আমারই, বাবা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনিয়ে দিতেন। আমাদের বাড়ির আশেপাশে কুড়ি-তিরিশ গজের মধ্যে কোনও বাড়ি ছিল না, তাই আমারও তেমন কোনও খেলা করার সঙ্গী ছিল না বা সেই অর্থে খেলাধুলো করিনি কখনও। যেটুকু হত তা স্কুলে। পড়াশোনা এবং স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা পুরোটাই কেটে যেত আমার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা বাগানে প্রজাপতিদের পেছনে ঘুরে। এক এক সময় খুব ইচ্ছে করত, মনে হত সেই বিস্তীর্ণ সবুজ গালিচায় মোড়া উপত্যকা যেন আমাকে ডাকছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই
ক্লিটনের সাবধান বাণী মনে পড়ে যেত। সকাল বেলায় যখন গ্রাম্য মেষপালকেরা ভেড়ার পাল নিয়ে সেই উপত্যকায় চরাতে যেত আমি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। তুলোর বলের মতো ভেড়াগুলোকে দেখে আমার মেঘেদের কথা মনে পড়ে যেত, মনে হত যেন মেঘের দল আকাশ ছেড়ে সেই উপত্যকায় নেমে এসেছে ঘাস খাবে বলে।
বাবা সারাটা দিন তাঁর ল্যাবরেটরিতে ব্যস্ত থাকলেও রাত্রে খাবার পর আমাকে নিয়ে ছাদে বেড়াতে যেতেন। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বুকে জেগে থাকা নক্ষত্ররাজির প্রত্যেকটিকে আলাদা করে চিনতে শিখিয়েছিলেন বাবাই। বাবার কাছেই শুনেছিলাম কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডলের মতো নক্ষত্রমন্ডলের বাকি সদস্যদের গল্প। একটা উজ্বল নক্ষত্রকে দেখিয়ে বাবা বলেছিলেন সেটা নাকি আমার মা। পরে অবশ্য জেনেছিলাম সেটা ধ্রুবতারা। বাবা বলতেন এই মহাবিশ্বে রহস্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা ওই মহাকাশ। আমরা যেটুকু জানি তা তার প্রকৃত আয়তনের তুলনায় অতি নগণ্য। যেদিন সেই সব রহস্যের উন্মোচন হবে সেদিন পৃথিবীর অভিধান থেকে ‘রহস্য’ কথাটাই হয়তো মুছে যাবে। আমাকে একটা দূরবিন কিনে দিয়েছিলেন বাবা। যেদিন কাজের চাপে বাবা আসতে পারতেন না সেদিন দূরবিনটা নিয়ে আমি একাই চলে আসতাম ছাদে, চোখ লাগিয়ে বসে থাকতাম আকাশের দিকে তাকিয়ে। বাবা থাকলে অবশ্য তার দরকার হত না। বাবা নিজেই যেন ছিলেন আমার দূরবীক্ষণ যন্ত্র। কী নিপুণ দক্ষতায় শুধুমাত্র গল্পের মধ্য দিয়ে যেন আবহমন্ডলের প্রতিটি স্তর অতিক্রম করে আমাকে নিয়ে যেতেন সুদূর মহাকাশের বুকে। নেশা হয়ে গিয়েছিল একটা, রাত্রে খাবার পর কিছুটা সময় সেই বিস্তীর্ণ রহস্যময় জ্যোতির্মণ্ডলের নিচে দাঁড়িয়ে ব্রহ্মান্ডের আদিম রহস্যের গন্ধ না নিলে যেন কিছুতেই ঘুম আসতে চাইত না। অভ্যেসটা রয়ে গিয়েছে আজও...
একবার এই মহাকাশ নিয়ে একটা কবিতা লিখে শুনিয়েছিলাম বাবাকে, বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “দেখিস তুই একদিন অনেক বড়ো সাহিত্যিক হবি, আমি হয়তো তখন থাকব না, কিন্তু তুই মিলিয়ে নিস আমার কথা।” বড়ো সাহিত্যিক হতে পেরেছি কিনা জানি না তবে জীবনের উনচল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে এসে আজ আমার পেশা এবং প্যাশন দুটোই এক হয়ে গেছে। শুধু সাও-পাওলো কিংবা দক্ষিণ আমেরিকাতেই নয়, তার বাইরেও বিভিন্ন দেশে আমার বই সমাদৃত। পুরস্কার ও সম্মানের তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তবে আমার সব থেকে বড়ো প্রাপ্তি যে বাবা আমার এই সাফল্য দেখে গেছেন।
আমার শেষ কথাটার যে একটাই মানে হতে পারে তা বোধকরি সকলেই অনুধাবন করতে পারছেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল গতকাল পর্যন্ত এ কথাটার মানেটা অন্তত আমার কাছে একটু অন্যরকম ছিল। আজ সকালের পর...
নাহ! বড্ড বেশিই জটিল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। বাবার ডায়রিটা পড়ার পর থেকেই নিজের মনের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। কতগুলো প্রশ্ন বার বার মনের আনাচকানাচ থেকে উঁকি দিচ্ছে। একটা চাপা অস্বস্তি অনুভব করছি মনের ভেতরে। ডায়রিটা এখনও পুরোটা পড়ে উঠতে পারিনি, যতই পড়ছি মনের ভেতরে জট যেন ততই ঘনীভূত হচ্ছে। তবে কি বাবা সত্যিই...
পরদিন।
কাল সারারাত ধরে ডায়রিটা পড়ে শেষ করেছি। যা বুঝেছি তা এ মুহূর্তে লিখে বোঝাবার সাধ্য আমার নেই। তাছাড়া এ মুহূর্তে আমার মানসিক অবস্থা যে কি তা একমাত্র আমিই জানি। অত্যাশ্চর্য হয়েছি বললেও কম বলা হবে, সঠিক কোনও বিশেষণ এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না আমার। তবে আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীতে প্রত্যেকের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বর্তিত। বাবা ডায়রিতে যা লিখে রেখে গেছেন তা বিচার করবার যোগ্যতা আমার নেই। তাই কেবলমাত্র আমার অনুমানটুকুর ওপর ভিত্তি করে এ কাহিনির সারার্থ রচনা করতে আমি আগ্রহী নই। ডায়রির কয়েকটা অংশ সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে আমি এখানে তুলে দিলাম। আপনারা যে যার চিন্তাশক্তি দিয়ে তার মর্মার্থ বিচার করুন। তবে এটুকু বলতে পারি যে পরিশেষে একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে।
আর একটা কথা, সারাটা জীবন সাহিত্যের পেছনে ছুটেও বাবার ডায়রিটা পড়ার পর সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে বড্ড নগণ্য বলে মনে হচ্ছে। কী অপূর্ব লেখনী! এমন একজন বিজ্ঞানী অথচ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের জটিলতামুক্ত সহজ সরল ভাষায় লেখা প্রাত্যহিক দিনলিপি... এমনকি ল্যাবরেটরিতে কাটানো সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কিংবা নিজস্ব বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও সাহিত্যরস থেকে বঞ্চিত হননি। শুধুমাত্র শেষের দিকের লেখাগুলোই যা সামান্য ছন্নছাড়া... হাতের লেখাতেও অস্থিরতার ছাপ সুস্পষ্ট। তবে কি আগেই আন্দাজ করেছিলেন বাবা?
সাহিত্যের নিরিখে যদি বিচার করা হয় তবে এ কাহিনির শ্রেষ্ঠত্বের পূর্ণ দাবিদার আমার বাবা ডক্টর এইচ জে হুবার্ড, আমার লেখাটুকু এ কাহিনির সূচায়ক বা ভূমিকা মাত্র।
১২ মার্চ ১৯৬৪, রাত্রি ৯.৩০ মিনিট
আমার সুদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক জীবনের আজ এক বিশেষ দিন। আমার গবেষণা যে সঠিক পথেই এগোচ্ছে তার প্রমাণ গতরাত্রেই পেয়েছি। যদি সম্পূর্ণ ভাবে সফল হতে পারি তবে আমার বিশ্বাস চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দিশা খুলে যাবে। জার্মানিতে আমার ডাক্তার বন্ধু ডেরেক ফ্রান্সিকো-কে এ বিষয়ে একটা চিঠি লিখব ভাবছি। আমার জীবনের প্রতিটি উত্থান পতনের এক ও অদ্বিতীয় সাক্ষী সে। গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল পেতে এখনও দু’বছর মতো সময় লাগবে। এদিকে আমার বয়সও হয়েছে, যখন তখন পরপারের ডাক আসতে পারে। অর্থ, যশ সম্মান পরোয়া করি না আমি, সারা জীবনে যতটুকু করেছি তা কেবলই মানবজাতির স্বার্থে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে। একজন শিল্পী যেমন তার নিজের সৃষ্টিকে প্রাণভরে দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করে ঠিক সেরকমই আমিও যখন দেখি আমার কাজগুলো মানুষের উপকারে আসছে তখন নিজের প্রতি নিজেই ভেতর থেকে একটা ভালো লাগা, একটা সম্মান অনুভব করি। সেটুকুই পরম পাওয়া, অর্থ-যশ এসব তো উপরি মাত্র। জীবন সায়াহ্নে এসে সর্বশক্তিমানের কাছে ইদানীং এক অন্যায় আবদার জুড়েছি, যদি কোনওক্রমে আর দুটো বছর তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তবে হয়তো HIV-র মতো মারণ ব্যাধি থেকে কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারব। এ বিষয়ে আমার গবেষণার যাবতীয়ের একটা কপিও ডেরেকের কাছে চিঠির সঙ্গে পাঠাব ভাবছি, তার মতামতটাও আমার জানা একান্ত প্রয়োজন। কোনোরকম ভ্যাকসিন ছাড়া কেবলমাত্র একটি কৃত্রিম উৎসেচকের মাধ্যেমে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা আধুনিক চিকিৎসক মহলে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার। তবে আমার ল্যাবরেটরিতে যে আমি এ বিষয়ে সাফল্য পেয়েছি তা বলাই বাহুল্য। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার আগে আরও অনেক গবেষণা বাকি আছে। তাছাড়া আরও একটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখা দরকার। পৃথিবীতে HIV-র মতো আরও বেশ কিছু ভাইরাস আছে যাদের এখনও পর্যন্ত দমন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমার বিশ্বাস এই আর্টিফিসিয়াল এনজাইমটি শধুমাত্র এইডস্ নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভাইরাসগুলির ক্ষেত্রেও সমান ফলপ্রসূ হবে। তবে এখনও পুরোটাই অনিশ্চিত। তবে যেটুকু আশার আলো দেখা গেছে তাতে করে অন্তত দু’বছরের আগে ফাইনাল কিছু বলা সম্ভব নয়। এখন ওপরওয়ালাই ভরসা, তিনি যদি আমার আবদারটি মঞ্জুর করেন তবে...
অবশ্য এতটাও চিন্তা করতাম না যদি আমার একমাত্র সন্তান উইলিয়াম আমার পাশে থাকত। আমি তাকে চেয়েছিলাম আমার মনের মতো করে গড়ে তুলতে, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছেটা বোধহয় অন্যরকম ছিল। বাবার ওপর ভর করে সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক বোধ করি এটা তিনি চাননি। উইলিয়াম নিজেই তার নিজের পথ বেছে নিয়েছে। তবে সে জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। আজ সে গোটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম, শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায়, নিজের অসামান্য লেখনীশক্তিকে সম্বল করে.. বাবা হিসেবে এ আমার গর্ব, আমার অহংকার। সত্যি কথা বলছি, আজ ওর এ হেন সাফল্যের পিছনে আমার ন্যূনতম কন্ট্রিবিউশনটুকুও নেই। কতটুকুই বা সময় দিতে পেরেছি মা-হারা ছেলেটাকে?
সারাটা জীবন শুধু বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থেকে ল্যাবরেটরিতে হাজারো যন্ত্রের মাঝে নিজেই কখন যে একটা যন্ত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছি টেরই পায়নি।
উইলিয়ামের জন্য চিন্তা করি না, কিন্তু আমার অন্যান্য সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাতে ভালো ঘুম হয় না আজকাল। আমার ল্যাবরেটরি, আমার থিওরিস্, আমার
আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতিগুলো... উইলিয়ামের মতো ওরাও যে আমারই সন্তান। আমার মৃত্যুর পর কী হবে ওদের?
অনিশ্চিত ওদের ভবিতব্য! আর কী?
লেখা থামাই।
২৪ মার্চ ১৯৬৪, সকাল ৮.৩০ মিনিট
গত পরশু ফ্রান্সিকোর টেলিগ্রাম পেয়েছি। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় গত দু’দিন আর ডায়রি লেখা হয়নি। বলা বাহুল্য আমার পাঠানো চিঠি এবং রিসার্চ পেপারের কপি দেখে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়ে সে যারপরনাই অবাক এবং আনন্দিত হয়েছে। সে বলেছে যদি সত্যিই এই কৃত্রিম এনজাইমটি মানব শরীরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সাফল্য আনতে পারে তবে গোটা বিশ্বের দরবারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে একটা নতুন পথ খুলে যাবে। এর ফলস্বরুপ বহু মুমুর্ষূ মানুষ যে নতুন জীবন ফিরে পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি অর্থাৎ HIV ব্যতীত অন্যান্য মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই উৎসেচকটির প্রয়োগ সম্পর্কেও সে আশাবাদী। তবে সেই প্রসঙ্গ টেনে টেলিগ্রামে সে আমাকে এমন কতগুলি তথ্য দিয়েছে যা আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফর্মুলার অ্যানালিসিস নিয়ে গত দু’দিন এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তার টেলিগ্রামটা ভালো করে পড়ে উঠতে পারিনি। গতকাল রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সেটা পড়ে যা বুঝলাম তাতে ব্যাপারটা নিছকই সামান্য বলে মনে হচ্ছে না। আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এমন কোনও ঘটনার কথা কখনও শুনেছি বলেও মনে করতে পারছি না। ভাবছি আজ বিস্তারিত জানতে ফ্রান্সিকোকে আবার একটা টেলিগ্রাম করব। তবে তার আগে একটু পড়াশোনা করে নেওয়া দরকার। ফ্রান্সিকোর বক্তব্য অনুযায়ী খবরের কাগজেও নাকি এ নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। আমার পরিচারক হেনরিকে বলেছি সে যেন দুপুরবেলা গত একমাসের সমস্ত খবরের কাগজ আমার ল্যাবরেটরিতে দিয়ে যায়। ব্যাপারটা আমাকে যত না ভাবাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি অবাক করেছে।
এ ব্যাপারে ফ্রান্সিকোর টেলিগ্রামের অংশটুকু এখানে তুলে দিলাম ------
“.........তোমার কথা অনুযায়ী এই এনজাইমটি HIV ছাড়া অন্যান্য মারণ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এফেক্টিভ হতে পারে শুনে খুব ভালো লাগল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গবেষণা শেষ কর, যদি কোনোপ্রকার সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে আমাকে বলতে দ্বিধা কোরো না। তুমি হয়তো ভাবছ কেন তাড়া দিচ্ছি? তবে বলি শোন। অবশ্য তুমিও হয়তো পেপারে পড়ে থাকবে ব্যাপারটা। ইদানীং আমাদের জার্মানিসহ এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে এক নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। জাপান, ইউ. কে, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এমনকি ভারতবর্ষেরও বেশ কিছু জায়গায় মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। খবর যেটুকু জেনেছি তাতে তোমাদের আমেরিকায় এখনও পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হয়নি। তবে সে জন্য নিশ্চিন্ত হবার কিছু নেই। আসল কথাটা এখনও বলিনি, সেটা হল যে সমস্ত জায়গা মিলিয়ে মোট যতজন আক্রান্ত হয়েছে তাদের কেউ কিন্তু এই মুহূর্তে ইহজগতে নেই। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে সিম্পটম শুরুর ঠিক দু’দিনের মাথায় ভিক্টিমরা মারা যাচ্ছে, অথচ মৃত্যুর আগে বা পরে শরীরে কোনও অ্যাবনর্মাল কিছুর উপস্থিতি ট্রেস করা যাচ্ছে না। মৃত্যুর ধরনটাও অতি অদ্ভুত, সিম্পটম বলতে শুধু ফিভার। প্রথমে হালকা জ্বর তারপর মডারেট থেকে হাই ফিভার, সঙ্গে ভুল বকা। মারা যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে শুরু হয় ছটফটানি। সে দৃশ্য চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না। সমস্ত শরীরটা কীসের যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ঠেলে উঠে ধনুকের মতো বেঁকে যায়। চোখে মুখে ভয়ার্ত ভাব ফুটে ওঠে আর সঙ্গে প্রবল শ্বাসকষ্ট, ব্যস। এভাবেই ঘন্টাখানেক থাকার পর মৃত্যু। তবে একটা ব্যাপার, প্রত্যেকটা কেসে মৃত্যুর পর ডেডবডিতে রোগের কারণ হতে পারে এমন কিছু না পাওয়া গেলেও কিছু অ্যাবনর্মালিটি লক্ষ করা গেছে। মৃতদেহ থেকে স্লাইভা কিংবা ব্লাডের স্যাম্পেল কালেক্ট করতে গিয়ে দেখা যায় দেয়ার ইজ নাথিং। সমস্ত শরীরের ময়শ্চার বলতে কিছু নেই। এন্ড ফাইনালি কিছু বডি পার্টস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে জানা যায় সমস্ত RBC-গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সোজা কথায় বলতে গেলে শরীরের ভেতরে রক্তে ছানা কেটে গেছে। এর কী কারণ হতে পারে বলে তোমার মনে হয় হুবার্ড? আমি শত চেষ্টা করেও কিছু ভাবতে পারছি না। তার ওপর রোগটা মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে। যতরকমভাবে সম্ভব প্রিকশন নিয়েও উই আর জাস্ট হেল্পলেস! ....”
২ এপ্রিল ১৯৬৪, সকাল ৭.০০
পরিস্থিতি যে ধীরে ধীরে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা খবরের কাগজ এবং টেলিভিশনের দৌলতে ভালোই টের পাচ্ছি। সমগ্র পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে এই মারণ রোগ। অবশ্য এ রোগ না অন্য কিছু তা জানি না তবে মানুষের বাড়ির বাইরে বেরোনো কার্যত বন্ধ। প্রচুর পরিমাণে শুকনো খাবার এবং ক্যানড্ ফুড মজুত করে রাখা হয়েছে। সে সব দিয়েই আপাতত চালাতে হচ্ছে, তবে আর কত দিন? মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে, পেটের টানে বেরোতে হচ্ছে বাইরে আর তখনই।
আমি অনেক ভেবেও এর কোনও কূলকিনারা করতে পারিনি। কোনও একটা সূত্র না পেলে...
পুরোনো সমস্ত খবরের কাগজ দেখেও ফ্রান্সিকোর কথার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর নতুন কোনও তথ্য পাইনি। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় যে যতজন আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে তাদের কেউই রিকভার করেনি। ফ্রান্সিকোর কথা মতো পূর্বের মৃত্যু এবং বর্তমানের মৃত্যুগুলোর মধ্যে কোনও তফাত নেই, সেই এক উপসর্গ, একই রকমের ছটফটানি আর তার পরেই সব শেষ। এ কি আদৌ কোনও রোগ নাকি বিষক্রিয়া? প্রকৃতির বুকে এত বিষই বা এল কোথা থেকে?
ফ্রান্সিকোকে আর টেলিগ্রাম করতে হয়নি, সে নিজেই আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিয়েছিল। গলা শুনে তাকে ভীষণ হতাশ লাগল। কথা বলে জানলাম সংক্রমণ যাতে এড়ানো যায় তার জন্য আগাগোড়া বর্ষাতির মতো স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পোষাক পরে ডাক্তারদের চিকিৎসা করতে নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান, কিন্তু তা সত্ত্বেও সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী সকলেই কোনও না কোনও ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম ফ্রান্সিকোর কথায়, সে আমার ঐ কৃত্রিম এনজাইমটার ওপর যেন একটু বেশিই ভরসা করছে। তার মতো এরকম একজন ডাক্তারের এ হেন ছেলেমানুষিতে আমার বেশ হাসিই পাচ্ছিল, কিন্তু এ সময়ে তা মনুষ্যোচিত নয় বলে চেপে গেলাম। আসলে এখন যা পরিস্থিতি তাতে করে বলতে গেলে একপ্রকার জীবন হাতে করেই কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এমত অবস্থায় এহেন ভাবনা হওয়াটা অনুচিত কিছু নয়, সকলের জীবনেরই দাম আছে। কিন্তু শুধুমাত্র ল্যাবরেটরিতে একবার মাত্র পরীক্ষা করেই তার গুণাগুণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কখনোই উচিত নয়। তাছাড়া সেটা যে HIV ছাড়া অন্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে কার্যকরী হবে সে ব্যাপারে আমি নিজেই নিশ্চিত নই সে কথা তাকে বুঝিয়ে বলাতে হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। এরপর অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল সে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। ফ্রান্সিকো আমার অতি পুরোনো বন্ধু, তার এমন অসময়ে আমি তাকে কোনও সাহায্য করতে পারছি না; এ কষ্ট আমাকে সর্বক্ষণ ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই যে আমি লিখছি, আমার কানে কিন্তু এখনও ফ্রান্সিকোর হতাশাগ্রস্ত কন্ঠস্বর বাজছে। ঠিক করেছিলাম ক’দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার গবেষণার কাজে হাত দেব, কিন্তু এখন ভাবছি আজ থেকেই শুরু করে দেব। যদিও জানি এ জিনিস ক’দিনে হবার নয়, তবুও দেখি চেষ্টা করে। যদি কিছু করতে পারি...
২ এপ্রিল ১৯৬৪, রাত্রি ১১.১৫ মিনিট
ভেবেছিলাম আজ আর ডায়রি লিখব না, কিন্তু মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে বিস্ময়কর দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছি তা এই মুহূর্তে লিখে রাখাই শ্রেয়, পরে বর্ণনা দিতে গেলে হয়তো কি দেখেছিলাম তা ভাবতে বসতে হতে পারে। আমি সাধারণত রাত্রি ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যে খেয়ে নিই, উইলিয়াম ওর কাজকর্ম লেখালিখি একেবারে শেষ করে তবে খেতে আসে, অন্তত সাড়ে দশটাতো প্রায় বেজেই যায় ওর আসতে আসতে। সে যাই হোক, আসল কথা বলি। রাতে খাবার পর ঘন্টাখানেক ছাদে হাঁটা আমার বহুদিনের অভ্যেস, সেই উইলিয়াম যখন ছোটো ছিল তখন থেকে। ওকে সঙ্গে করেই হাঁটতাম, তারা চেনাতাম, গল্প করতাম; কর্মব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনে ওটুকুই ছিল আমাদের বাবা-ছেলের নিত্যকার একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানো। অদ্ভুতভাবে আমার এই অভ্যাসটা কী করে যেন ওর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে, হয়তো বা ছোটোবেলার নিত্যদিনের অভ্যাসই এর মূলে। সব দিন যে ওর সঙ্গে দেখা হয় তেমনটা নয়, যেহেতু ও আমার পরে খায় তাই ওর আসতে আসতে আমার নিচে যাবার সময় হয়ে আসে। তবু একেকদিন বসে গল্প করি ওর সঙ্গে, নানা কথা হয়... ওর ছোটোবেলার গল্প, স্কুলের গল্প, স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনের অনেক কথা উঠে আসে আমাদের এই নিশুতি আলোচনায়। বহুবার বলেও ছেলেটাকে সংসারী করতে পারিনি, অনেক বুঝিয়েছিলাম কিন্তু...
মূল বিষয় থেকে যে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছি তা বেশ বুঝতে পারছি। তবে কিনা... সে যাই হোক, আসল কথাটা বলি। উইলিয়াম আজ ছাদে ছিল না। আমি একাই বেশ কিছুক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করার পর পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আলোটা চোখে পড়ল।
রাতের বেলায় শহরের এদিকটায় আলো খুব একটা থাকে না, কেবল বাড়িগুলোর সামনের রাস্তায় একটা করে স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলে। তাছাড়া দু’দিন হল আমার বাড়ির সামনের স্ট্রিট ল্যাম্পটা খারাপ হয়ে গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে সেটা সারানো সম্ভব হয়নি, তাছাড়া আমার বাড়ির আশেপাশে দশ গজের মধ্যে অন্য কোনও বাড়ি নেই, তাই একরাশ অন্ধকারের বুকে দাঁড়িয়ে সামনের উপত্যকার ওপাশের দেবদারু বনের ভিতর থেকে নীলাভ সবুজ আলোটা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বনের ভিতর এ আলো কীসের? আলোটা মোটেই স্থির নয়, ক্রমাগত সেটা আবর্তিত হচ্ছিল। তার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট কতগুলি খর্বাকৃতি কম্পমান ছায়া যেন হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে বলে মনে হল। কারা ওরা? প্রশ্নটা মনে হতেই আর বসে থাকতে পারলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই হুইসেল বাজার মতো একটা শব্দ হল আর তারপরই আলোটা ধীরে ধীরে দেবদারু বনের ভেতর দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। তারপর হঠাৎই চোখের নিমেষে ওপরে উঠে ছোট্ট একটা আলোর বিন্দু হয়ে অন্ধকারের বুকে মিলিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। সমগ্র ঘটনাটি ঘটতে যেটুকু সময় লাগল আমার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তা আলোর গতিবেগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি বই কম বলে মনে হল না। কিন্তু কী এমন জিনিস যা আলোর বেগের চেয়েও দ্রুত? একবার মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি, ঠিক তখনই পেঁচার ডাকে সংবিৎ ফিরে এল। রেডিয়াম বসানো হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। নাহ, আর থাকা চলে না। নিচে নেমে এলাম।
আলোটা দেখার পর থেকেই মনের মধ্যেকার অস্বস্তিটা কিছুতেই দূর করতে পারছি না। আরও একটা জিনিস ভেবে অবাক হচ্ছি যে এই ঘটনাটা আমাকে এতটাই চঞ্চল করে তুলেছে যে আমি কিছুতেই...
একটা জিনিস মনে পড়তেই ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে।
আপাতত লেখা থামালাম।
৪ এপ্রিল ১৯৬৪, সকাল ৯.০০
মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাকেই বেশি মহার্ঘ্য বলে মনে হয়। বিশেষত মানুষ যখন নিজের চোখের সামনে তার সাফল্যের স্তম্ভটাকে গোড়া শুদ্ধ উপড়ে পড়তে দেখে তখন... আমার অবস্থাটা আজ সেরকমই। সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে বললেও কম বলা হবে আর তা হয়েছে আমারই অসাবধানতায়। কেবল তাই নয়, আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে। পর পর এ হেন বিপর্যয়ে আমি যে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছি তা বলাই বাহুল্য। কাল সারাদিন ডায়রি লিখিনি, ইচ্ছেও করেনি। আজও যে খুব ইচ্ছে ছিল তেমনটা নয়, খানিকটা দায়ে পড়েই লিখছি বলা যায়। পঁচিশটা বছরের অভ্যেস, প্রাত্যহিক দিনলিপি না হলেও একসঙ্গে তিন-চারদিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কখনও বা এমনিই সাধারণ কথা.... শুরুটা মনের খেয়ালে হলেও কখন যে সেটার প্রতি নিয়মিত দায়ভার জন্মেছে তা এতদিন বুঝতেই পারিনি। যাক সেসব কথা!
পরশুদিন রাতে কিছু একটা মনে পড়াতে লেখা থামিয়েছিলাম। আসলে ওই আলোটা দেখার পর থেকেই মনটা ভীষণ অস্থির হয়েছিল, খালি মনে হচ্ছিল কী হতে পারে জিনিসটা? হঠাৎ মনে পড়ে গেল হেনরির দিয়ে যাওয়া পুরোনো খবরের কাগজগুলোর একটাতে এরকমই কিছু একটা খবর পড়েছিলাম, কিন্তু তখন ওই রোগের ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে ভালো করে সেটা লক্ষই করিনি। কাগজগুলো আমার ল্যাবরেটরিতেই ওয়েস্ট ডেস্কে রাখা ছিল, উঠে সেগুলো আনতে যেতেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। টেবিলের ওপর একটা স্পিরিট ল্যাম্প জ্বলছিল। আমার অসাবধানী ধাক্কা লেগে সেটা উলটে গিয়ে সমস্ত স্পিরিট গিয়ে পড়ল আমাদের এতদিনের গবেষণার কাগজপত্রের মূল কপিটার ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গেই...
একটাই মাত্র কপি বানিয়েছিলাম সেটার যেটা ফ্রান্সিকোকে পাঠিয়েছি। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, আমার চোখের সামনে সব পুড়ে শেষ হয়ে গেল... চোখের সামনে নিজের জ্বলন্ত চিতাকে প্রত্যক্ষ করলাম। কাগজ পোড়ার গন্ধ পেয়ে হেনরি এবং উইলিয়াম ছুটে এসে আগুন নিভিয়েছিল কিন্তু আমি সেই গন্ধ পাইনি। আমাদের সাও-পাওলোতে প্রবাসী হিন্দুদের শবদাহের জন্য একটা শ্মশান আছে। বহুবার সেখান থেকে যাতায়াতের পথে মৃতদেহ পোড়াবার কটু গন্ধ পেয়েছি। সেদিন আমার ওই ভস্মীভূত হওয়া কাগজগুলো থেকেও সেই চেনা গন্ধটা পাচ্ছিলাম।
সে কার শবের গন্ধ? আমার নাকি আমার অন্তরাত্মার। জানা নেই!
জানি আমার এই ডায়রি কেউ পড়বে না। তবুও নিজের কাছে যতটুকু জবাবদিহি করা যায় আর কী! আগেই বলেছি এ লেখা কোনও উদ্দেশ্যপ্রনোদিত নয়, আমার হাজারো খেয়ালের একটা। তাই এর প্রতি সে অর্থে দায়বদ্ধতা নেই, আবার আছেও। পঁচিশটা বছর ধরে কি কেবলই নিজের কাছে প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করব বলে লিখে চলেছি? নাহ, আমার বহু প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি এর মধ্যে দিয়ে, সেই
সব প্রশ্নের উওর যেগুলো মনের বহু গভীরে দ্বিপাক্ষিক অব্যক্ত অলিখিত কথোপকথনে কখনও পাইনি। যেমন এই মুহূর্তে একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে, আচ্ছা আমার কি মস্তিষ্ক বিকৃতি হচ্ছে? পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি? নয়তো এসব কী লিখে চলেছি উলটোপালটা?
হবেও বা, জীবনটাই তো আমার সে রাতের পর....
যাক গে! সেদিনের পর যদিও বা একটা আশা ছিল পেপারগুলো পাওয়ার, কিন্তু কাল সন্ধ্যার পর সে আশাও ঘুচেছে চিরকালের মতো। ভেবেছিলাম ফ্রান্সিকোর কাছে যে কপিটা আছে সেটা তার কাছে চেয়ে পাঠাব, প্রয়োজন হলে তাকে বলব আরেকটা কার্বন কপি বানিয়ে নিতে কিন্তু...
টেলিফোনটা কে ধরেছিল জানি না, তবে সে জানাল ফ্রান্সিকো পয়লা এপ্রিল সকালে সেই অজানা রোগে মারা গেছে। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ফ্রান্সিকো! আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ডাক্তার ডেরেক ফ্রান্সিকো আর নেই! অথচ এই কিছুদিন আগেও...
এখনও বার বার তার কথাগুলো আমার কানে বাজছে...
“বিশ্বাস করো হুবার্ড আমার ভীষণ হেল্পলেস লাগছে এই কন্ডিশনে, ইন ফ্যাক্ট এর আগে কখনও এতটা হেল্পলেস লাগেনি। প্লিজ্ তুমি একটু চেষ্টা করো... আমার বিশ্বাস তুমি পারবে, তুমিই পারবে... আমার মন বলছে তোমার এই এনজাইমটাই পারবে এ রোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে...”
শুধুই কি মানুষের জন্য? আমি জানি ফ্রান্সিকো নিজেও বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি পারিনি; আমি পারিনি তাকে বাঁচাতে...
জানি না এ গবেষণা আদৌ শেষ করতে পারব কিনা। নতুন করে সব শুরু করার মতো মানসিক পরিস্থিতিও আমার নেই এই মুহূর্তে। যদিও বা সব নতুন করে শুরু করি এবং তাতে কখনও যদি সফল হইও (পুরোটাই অনিশ্চিত) তবুও ব্যর্থতা থেকেই যাবে।
ফ্রান্সিকোর কথা না রাখতে পারার ব্যর্থতা, তাকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতা আমৃত্যু অ্যানোবিয়ামের (ঘুণপোকা) মতো আমাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাবে।
আর কী? কিছুই ভালো লাগছে না...
১৬ এপ্রিল ১৯৬৪, রাত্রি ১২.৩০ মিনিট
ব্যস্ততার কারণে গত দু’সপ্তাহ যাবৎ ডায়রি লিখতে পারিনি। কীসের ব্যস্ততা, কী বৃত্তান্ত আশা করি এসব আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হাতে সময় বড়ো কম, এখুনি হয়তো ওরা এসে পড়বে, তাই যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। আজই আমার ডায়রি লেখার শেষ দিন, আর হয়তো কোনও দিন... কাউকে বলতে পারিনি এসব কথা, এমনকি উইলিয়ামকেও না। যদি বিশ্বাস না করে! পাগল ভেবে বসে। আর বলেই বা কী হবে? পার্থিব কোনও কিছুই আমাকে ওদের আড়াল করে রাখতে পারবে না। আজ না হোক কাল, যেতে আমাকে হবেই।
তাছাড়া আমি নিজেই যখন নিজের এ হেন পরিণতিকে মেনে নিয়েছি তখন শুধু শুধু বাকিদের...
লক্ষ্যে সফল হয়েছি বটে তবে তার প্রয়োগের কৃতিত্ব আমার নয়, সে কৃতিত্ব আমার প্রয়াত ডাক্তার বন্ধু ফ্রান্সিকোর। আবিষ্কারক হয়েও নিজের প্রতি যে বিশ্বাস আমি করতে পারিনি তা করে দেখিয়েছে ফ্রান্সিকো। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে আজ আর নেই। গত রবিবার সকালবেলায় খবরের কাগজ খুলতেই চোখে পড়ে রিপোর্টটা। সমগ্র বিশ্বে এই অজানা রোগে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে। ইতিপূর্বে যত জন আক্রান্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এই প্রথম জার্মানিতে এই রোগের হাত থেকে একজন সুস্থ হয়েছেন। জনৈক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, তাঁর চিকিৎসা করছিলেন বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডেরেক ফ্রান্সিকো। ওই ব্যাক্তি বলেন মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যখন তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং শরীরের অসহ্য যন্ত্রনা কমাতে তিনি যখন শরীরটাকে শক্ত করে বাঁকাতে চেষ্টা করেন ঠিক সেই মুহূর্তে তার কেবিনে এসে ঢোকে ফ্রান্সিকো। তার কেবিনে তখন কেউ ছিল না। ফ্রান্সিকো তার অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বার করে কিছু একটা তার শরীরে ইনজেক্ট করে সেখান থেকে চলে যায়। পরমুহূর্তেই জনৈক ব্যাক্তি অনুভব করেন তার শরীর থেকে একটা গরম হাওয়া যেন বেরিয়ে যাচ্ছে। এরপর আর তার কিছু মনে নেই। পরের দু’দিন তিনি সেন্সলেস অবস্থায় স্পেশাল কেয়ারে ছিলেন। যেদিন তার জ্ঞান ফেরে সেদিনই সকালের দিকে ফ্রান্সিকো মারা যায়। এই প্রসঙ্গ টেনে প্রতিবেদক দুটো প্রশ্ন রেখেছেন -
এক, তবে কি ডক্টর ফ্রান্সিকো সবার অলক্ষ্যে এই রোগের প্রতিষেধক বা ওই জাতীয় কিছু তৈরি করে ফেলেছিলেন?
দুই, তাই যদি হবে তাহলে তিনি নিজের বেলায় কেন তার প্রয়োগ করলেন না? এমনটাতো নয় যে তিনি জানতে পারেননি যে তাঁর আবিস্কৃত ওষুধে তাঁর রোগী সেরে উঠেছেন। তাহলে?
উত্তরগুলো আমার অজানা নয়। তবে তা ব্যাখ্যা করার মতো ধৈর্য বা সময় কোনোটাই আমার কাছে নেই। আর কোনোদিন হবেও না। এক জীবনে সব কিছুর উওর কি মেলে? কিছু জিনিস না হয় অজানাই থাকল। ক্ষতি কী?
গত দু’সপ্তাহের অক্লান্ত পরিশ্রমে সমস্ত ফর্মুলা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। দু’বছরের কাজ দু’সপ্তাহে করা আর জেগে শুয়ে স্বপ্ন দেখা একই ব্যাপার। তবুও যতটুকু পারলাম করলাম, ফ্রান্সিকো তো আমাকে জয়ী করেই গেছে। ইচ্ছা ছিল একবার পরীক্ষা করে দেখবার, কিন্তু এ হেন মহাজাগতিক দুর্যোগের দরুণ এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভবপর হল না। ওরা ফর্মুলার কথা জানে না। সাবধানতার জন্য আমিও আর আলাদাভাবে তা লিপিবদ্ধ করিনি। এই ডায়রির মাঝের দু’পাতায় লুকোনো থাকল সেই ফর্মুলা। আশা করা বৃথা, তবুও কেউ যদি কখনও আমার এই ডায়রি পড়ে তবে মাঝের দুটো পাতায় যেন...
এরই মধ্যে রাতের বেলায় আরও বেশ কয়েকবার দেখেছি সেই আলোটাকে আর তার সঙ্গে তার উৎসটাকেও। যে জিনিসটা হঠাৎ মনে পড়ায় কৌতূহলের
আতিসহ্যে চরম সর্বনাশটা ঘটিয়েছিলাম তার সঙ্গে এ হেন বিশ্বব্যাপী অজানা রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক আপাত অর্থে কাকতালীয় বলে মনে হলেও আদতে তা নয়। ‘মহাজাগতিক’ কথাটির অবতারণা করার কারণ সেটাই। বেশ কিছুকাল আগে খবরের কাগজে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উল্কাপাতের কথা শোনা গিয়েছিল। অনেকে আবার রাতের আকাশে একটা নীল আলোকবিন্দুকে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিদ্যুতের বেগে ছুটে যেতেও দেখেছেন, তবে আদতে তা নিতান্তই সাধারণ উল্কাপাত বা ঐ জাতীয় কিছু নয় তার প্রমাণ গতকাল পেয়েছি। বহমান সভ্যতার বিরুদ্ধে তারই ধ্বংসের বীজ বপন করে চলেছে পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহের অধিবাসীরা। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? না হবারই কথা! আমি নিজেই বিশ্বাস করিনি প্রথমে। ভেবেছিলাম বুঝি স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু কাল রাতে...
পুরো রিসার্চটা শেষ করতে না পারলেও মোটামুটি একটা স্টেবল পজিশনে আসায় মনটা বেশ হালকা লাগছিল। ফ্রান্সিকোর তৎপরতায় আমার এনজাইমটির মানবদেহের পরীক্ষামূলক সাফল্যই যে আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছে তা বলাই বাহুল্য। শুধু দুঃখের বিষয় এটাই যে তাকে ধন্যবাদটুকু জানানোর সুযোগ সে আমাকে দিল না।
অন্ধকার ছাদে বসে এসব কথাই ভাবছিলাম। মাথার ওপর আদিগন্ত বিস্তৃত রহস্যময় ব্রহ্মান্ড। এর মধ্যে যতবার সেই নীল আলোটাকে দেখেছি একটা জিনিস আমাকে বার বার অবাক করেছে। আলোটা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খুব দ্রুত মুভমেন্ট করে ঠিকই তবে তার গতিপথটা ইরেগুলার নয়। খুব ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে সেটা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাতায়াত করে। খবরের কাগজের উল্কাপাতের ঘটনা কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণের সঙ্গে আমার দেখা এই আলোটার মিল আছে ঠিকই, হয়তো
বা আমিও বাকিদের মতোই এটাকে সাধারণ উল্কাপাত বলে মনে করতাম যদি না সেদিন দেবদারু বনের ভিতর আলোটাকে দেখতাম। যদি ধরেও নেই সেটা কোনও জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড ছিল তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আলোর ভেতরের খর্বাকার ছায়াগুলো কী ছিল তাহলে?
আমার মন বলছিল এ কোনও সাধারণ ঘটনা নয়, হঠাৎ করে বিশ্বব্যাপী এ হেন মারণ রোগের আর্বিভাব... না না একটা কিছু গন্ডগোল তো আছেই। আমি কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিংবা বিরাট কিছু এক্সপেরিমেন্ট করে এত কথা বলছি না, খবরের কাগজের কয়েকটি রিপোর্ট আমার মনে এ ধারণার জন্ম দেয়। তবে কি উড়ন্ত চাকী বা ফ্লাইং সসার জাতীয় কিছু?
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটা আরও আগেই পরিস্কার হয়ে যেত। রিপোর্ট অনুযায়ী প্রথম উল্কাপাতের ঘটনাটা দেখা যায় রাশিয়ার ‘ব্লু-ভ্যালি’ নামক একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার, গ্রামে কিংবা তার আশেপাশে কোথাও কোনও উল্কাপাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ঠিক তার পাঁচ দিন পর সেখানেই প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এরপর এক মাস যাবৎ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উল্কাপাত দেখা যায় আর সঙ্গে সঙ্গে...
অনুমান করেছিলাম মাত্র, এত তাড়াতাড়ি যে সেই অনুমান সত্যি হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।
সৌরজগতের বিভিন্ন অর্বাইটালের গোলকধাঁধার কোনও একটিতে বাস ওদের। আমাদের পৃথিবীর সমগ্র আয়তনকে সহস্র কোটি বার ভাগ করেও ওদের পৃথিবীর আয়তন পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মতো মানুষদের চোখে ওদের জগৎটা কেবলই ‘শূন্য’ বই আর কিছুই নয়। বিজ্ঞানে কিংবা সভ্যতায়, মানুষের থেকে ওরা বহু বহুগুন উন্নত (ওদের তেমনটাই দাবি)। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা জিনিসের অভাব রয়ে গিয়েছে ওদের, মূলত যেটার জন্য ওদের পৃথিবীতে আসা। মস্তিষ্ক বা ব্রেন, অর্থাৎ ওদের কোনও স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। আমরা জানি যে আমাদের ব্রেন সকাল থেকে রাত অবধি আমাদের খুঁটিনাটি যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু ওদের ক্ষেত্রে তা নয়। ওরা সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্রন চার্জের ওপর নির্ভরশীল যার স্থায়িত্ব আমাদের পৃথিবীর হিসেবে মাত্র কয়েক ঘন্টা। ব্যাপারটা অনেকটা লাট্টুর মতো, যতক্ষণ গতি ততক্ষণ স্থিতি, তারপরেই...
পৃথিবীতে ওরা এসেছে ব্রেনের খোঁজে, সে কারণেই হানা দিয়েছে মানুষের শরীরের ভিতর। বাতাসের মতো স্বচ্ছ শরীর নিয়ে ওরা সর্বত্র যেতে আসতে সক্ষম। কিন্তু যতই ওরা বলুক যে ওরা মানুষের চেয়ে হাজারো গুনে উন্নত, আমি বলব - না। ব্রেন জিনিসটা মানব শরীরের কোথায় থাকে সেই সম্যক জ্ঞানটুকুই ওদের মধ্যে নেই। ওদের ধারণা মানব শরীরের শেষ তার মুখবিবরে, তার পরে আবার সেই বর্হিজগৎ-এর উন্মুক্ত দ্বার। অতএব ব্রেন যদি থাকে তবে এর মধ্যেই আছে, কারণ ওপরের অংশটা ওদের ধারণা অনুযায়ী নিতান্তই নিরেট। অতএব...
তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, যাদের সজীবতা মাত্র কিছুক্ষণের জন্য স্থায়ী তারা কীভাবে মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে? উলটে ওদেরই তো মারা যাবার কথা!
এর উত্তর এটাই হতে পারে যে এই ভিনগ্রহের প্রাণীরা মানবদেহের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের ভেতরে থাকা ইলেকট্রন শোষন করে নিজেদেরকে সজীব করে রাখে। শরীরের
আর্দ্রতা না থাকা, তীব্র থেকে তীব্রতর শ্বাসকষ্ট কিংবা রক্তে ছানা কেটে যাওয়ার মতো উপসর্গগুলো তারই নির্দেশক। যে মুহূর্তে তাদের ইলেকট্রনের ঘাটতি পড়ে সেই মুহূর্তে তারা ওই শরীর ছেড়ে অন্য শরীরে প্রবেশ করে।
আমার বানানো উৎসেচকটি হয়তো জনৈক ব্যাক্তির শরীরে অত্যাবশ্যক রাসায়নিক উপাদানগুলোকে কোনোভাবে