ইলশেগুঁড়ি
অঙ্কন মিত্র
ই-লি-শ-মা-ছ! এক মুহূর্তের জন্য শব্দটা শুনেই মা ও মেয়ে একদম স্ট্যাচু বনে গেল। মায়ের হাত থেকে ঠং আওয়াজে সিলভারের বাটিটা মেঝেতে পড়ল। ফুটকি সবিস্ময়ে উঁকি দিল বাবার হাতে ধরা থলিটার মধ্যে। ফুটকি চোখ তুলতেই মা সপ্রশ্ন তাকালেন ওর দিকে। ফুটকি চোখ গোল-গোল করে বলল, “সত্যিই ইলিশ! চকচকে, ফরসা।
ঠিক যেন রুপোর মতো!”
ফুটকিদের ঘরে আগে কোনোদিন ইলিশমাছ এসেছে বলে ওর তো মনে পড়ে না। গতবছর শীতে হাবুলকাকুর বউভাতে ইলিশ-ভাপা খেয়েছিল, সেটাই যা মনে আছে। আসলে ফুটকিদের অবস্থা কোনোকালেই মহার্ঘ্য ইলিশমাছ খাওয়ার মতো ছিল না। ফুটকির বাবা মদনজেঠুর গ্যারেজে সামান্য মোটর-মেকানিক। মা রেল-লাইনের ওপারে সাতমহলা হাউজিং-এস্টেটের দুটো ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ করেন। ফুটকি তাই সেই কোন ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছে, ওদের সংসারে বড়ো অভাব; টেনে-টুনে চলতে হয়, বাজে খরচ করার মতো টাকা, ওদের একফোঁটাও নেই! তাই জন্যই তো সেই ক্লাস-টু-এর বয়স থেকেই ওর খেলনা বলতে একটা চোখ-কানা
পুতুল আর দুটো চাকা-ভাঙা প্লাস্টিকের গাড়ি।
ফুটকি এখন মোড়ের মাথার বাংলা-মাধ্যম গোলাপিবালা-বালিকা-বিদ্যালয়ের সপ্তম-শ্রেণির ছাত্রী। ও ইস্কুলে দিদিমণিদের খুব প্রিয়। কারণ নাচ-গান-নাটকে অ্যাকটিভ পার্টিশিপেসন-এর পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ও বরাবর ক্লাসে প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকে। কিন্তু সংসারে অভাব বলেই ওর কোনও প্রাইভেট
টিউশানি পড়বার সামর্থ নেই; নিজের পড়া নিজেই খেটেখুটে তৈরি করে প্রতিবার পরীক্ষায় বসে ফুটকি।
আজ রবিবার। ফুটকির ইস্কুল ছুটি। মায়েরও এই একটা দিন করে এক-বাড়ি কম কাজ থাকে। বাবাও কখনও-সখনও রবিবারে এক বেলা অফ্ নিয়ে নেয় গ্যারেজের কাজ থেকে।
রবিবার ওরা বাবা-মা-মেয়ে একসঙ্গে খেতে বসে দুপুরে। অন্যদিনে এমনটা হয় না। রোববার দুপুরটা তাই ফুটকির কাছে খুব স্পেশাল। মা এই একটা দিন কত কী ভালোমন্দ রান্না করে; কখনও কচু-শাকের ঝাল-ঝাল তরকারি তো কখনও লাউ দিয়ে কুচো-চিংড়ি। বাবা খেতে-খেতে কত মজার-মজার গল্প বলে, শুনে হাসতে-হাসতে পেটের খিল ছেড়ে যায় ফুটকির।
তাই বলে ইলিশমাছ! এ যে আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজ কেনবার শামিল! ইলিশমাছের কত্তো দাম; খুব কম হলে চারশ-পাঁচশ টাকার কম তো নয়ই। সেই সোনার দামের মাছ বাবা এই অবেলায় কোত্থেকে আনল? কেনই বা আনল?
তোলা-উনুনের ধোঁয়ার সামনে বসে, মায়ের ঘর্মাক্ত মুখটায় এই বিরক্তিসূচক প্রশ্নগুলোই খেলে গেল, লক্ষ করল ফুটকি। বাবা পরিস্থিতি দেখে অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল, “বাব্বা, তোরা দু’জনে মিলে এমন চোখ-মুখ করছিস যেন আমি ইলিশ নয়, একেবারে তিমি শিকার করে এনেছি!”
ফুটকি আলতো করে জিজ্ঞেস করল, “মাছটা তুমি বাজার থেকে কিনলে, বাবা?”
বাবা মাছের থলিটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে দু-দিকে ঘাড় নাড়ল, “না-রে-বাবা, না। সে সাধ্য কি আমার আছে? আজ গ্যারেজের পঁচিশ বচ্ছরের প্রতিষ্ঠা-দিবস কিনা, তাই মদনদা সব স্টাফেদের একটা করে ইলিশ গিফট করেছেন। মদনদার ছোটো জামাই দীঘায় মাছের ব্যাবসা করে, ওই তো সস্তায় এনে দিয়েছে।”
বাবা কথা ক’টা বলে চায়ের গেলাসে আরাম করে একটা চুমুক দিল। মা থলি থেকে ঝকঝকে ফরসা মাছটাকে বের করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, “বাবা, বেশ বড়ো সাইজ় তো, গো! পেটটা যা চওড়া, ভালোই ডিম-তেল আছে মনে হচ্ছে।”
ফুটকি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে মাছটাকে দেখছিল। ওর মনে পড়ছিল, অনেক ছোটোবেলায় ও একবার ভোলাদাদুর কোলে চেপে পাতিপুকুর ফিশ-মার্কেটে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে হরেক মাছের স্তূপের মধ্যে ইলিশও ছিল। একটা খুব জাঁদরেল গোঁফওয়ালা দোকানদার খরিদ্দারকে ঘষ ঘষ করে বঁটি দিয়ে একটা পেল্লাই সাইজের ইলিশ মাছ কেটে দিতে-দিতে বলেছিল, “দেখুন দাদা, ঠিক ক্যাটবেরির মতো টাটকা পিস্ বেরোচ্ছে সব!” ক্যাডবেরির সঙ্গে ইলিশমাছের তুলনা শুনে সেদিন খুব অবাক হয়েছিল ছোট্টো ফুটকি; তাই আজও স্মৃতিটা তার স্পষ্ট মনে আছে।
মা পরম যত্নে মাছটার আঁশ ছাড়িয়ে বঁটি দিয়ে কাটতে-কাটতে বাবার উদ্দেশে বলল, “মুড়ো বাদ দিয়ে ছ-পিস্ হচ্ছে ল্যাজাটাকে নিয়ে। এখন বলো ভাপা খাবে না বেগুন-আলু দিয়ে হলুদ-ঝোল রাঁধব?”
বাবা কথাটা শুনে হেসে ফুটকির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমার ফুটকুলি মা যেমনটা খেতে চায় তেমনই রাঁধো না!”
ফুটকি ওমনি আদরের সঙ্গে বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, একটু ঝাঁঝালো করে সরষে-ইলিশ বানাও না।”
মা তখন মশলার কৌটোটা নাড়তে-নাড়তে বলল, “এ মা! ঘরে তো একটুও সরষে নেই রে! যা না ফুটকাই, মোড়ের দোকানে একটু…”
মায়ের কথাটা শেষ হতে-না-হতেই দরজা থেকে একটা গমগমে গলা বলে উঠল, “আমি তোমাদের ফ্যামিলি-ম্যাটার দরজায় আড়ি পেতে সবটাই শুনে নিয়েছি কাকিমা। এই নাও প্যাকেটের সরষে-গুঁড়ো। আমারও এক টুকরো ইলিশ জুটবে তো তাহলে?”
কথাটা বলতে-বলতে, হই হই করে ঘরে ঢুকে এল বান্টিদা। বান্টিদা ফুটকির জাঠতুতো-দাদা। থাকে কুলতলীর গ্রামের বাড়িতে। আজ কলকাতায় চাকরির কী একটা পরীক্ষা দিতে এসে ফেরার পথে দুম্ করে ওদের বাসায় চলে এসেছে।
বান্টিদা এসে পড়ায় দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটা আরও জমে উঠল। মা সরষে-ইলিশের পাশাপাশি ইলিশের ডিম আর তেল দিয়ে একটা ফাটাফাটি চচ্চড়িও বানিয়েছিল। ইলিশের স্বাদ আর মা’র চমৎকার রান্নার গুণে ফুটকি রেকর্ড পরিমাণ ভাত খেল আজ। বান্টিদা আর বাবাও চেটেপুটে থালা প্রায় পরিষ্কার করে ফেলল। বান্টিদা হাত ধুয়ে ঢেঁকুর তুলতে-তুলতে বলল, “কাকিমা, তোমার হাতের জবাব নেহি! তুমি ‘ইলিশ-ইস্পেশাল’ নাম দিয়ে এ বার একটা রেস্টুরেন্ট খুলে ফেল। জমে যাবে একেবারে!”
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বাবা আর বান্টিদা জমিয়ে নাক ডাকাতে লাগল। ফুটকি তখন অঙ্কের বই-খাতা নিয়ে ওদের ঝুপড়ির সামনের অপরিসর বারান্দাটায় এসে বসল। ও দুপুরে কখনও ঘুমোয় না, কিন্তু উনিশের প্রশ্নমালার কয়েকটা অঙ্ক করতে-করতেই ফুটকির মনটা হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ও শুনতে পেল, মা ওদের প্রতিবেশী পাশের ঝোপড়ার কাকলি মাসিকে চাপা-গলায় বলছে, “কী আর করব বল, ঘরে চাল বাড়ন্ত। তার উপরে দেশ থেকে ভাসুরের ছেলেটা হুট্ করে এসে পড়ল। এখনও তো মাস-শেষের মাইনে পেতে প্রায় আট-দশ দিন বাকি আছে। এদিকে হাত আমার একেবারে খালি!”
কাকলি
মাসি মায়ের কথা শুনে বলল, “তাই বলে তুই সারাদিন খেটেখুটে, শেষকালে কিনা ইলিশমাছের শুকনো মুড়ো চিবিয়ে পেট ভরাবি?”
মা মলিন হেসে বলল, “ছাড়ো তো! বিকেলে বৌদির ফ্ল্যাট থেকে বাসি ভাত-তরকারি কিছু একটা চেয়ে খেয়ে নেব এখন।”
কথাগুলো শুনতে-শুনতে ফুটকির বুকটা আপনা থেকেই কেমন যেন মুচড়ে উঠল। সত্যি তো! ওরা তিনজনে হাম হাম করে ভাত-মাছ সব খেয়ে নিল, মা-ও হাসি মুখে ওদেরকে দু-পিস্ করে মাছ দিয়ে দিল। কারুর একবারও মনেই হল না, মা’র জন্য একটুও আর ভাত নেই হাঁড়িতে! নিজের প্রতি ধিক্কারে ফুটকির চোখটা ছল ছল করে উঠল। ও তখন এক-দৌড়ে ঘরে ঢুকে, ইস্কুল-ব্যাগের গোপন খাপ থেকে কয়েকটা টাকা বের করে নিঃশব্দে ছুট দিল বড়ো-রাস্তার দিকে।
ফুটকিদের রেল-কলোনির কাছেই নাটুকে-কালীর মন্দিরটা পড়ে বড়ো-রাস্তার ঠিক উপরে। ঊনবিংশ-শতকের বিখ্যাত কালীভক্ত নাট্যকার গোবর ঘোষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জাগ্রত-মন্দিরটার লোকমুখে ওই নাম হয়েছে। এই মন্দিরে বিকেল চারটে নাগাদ মায়ের ভোগ বিলি হয়। ফ্রি
ভোগ পেতে লম্বা লাইন দিতে হয়, আর তার পরিমাণও বেশ কম। কিন্তু পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে মন্দিরের কার্যালয় কাউন্টার থেকে স্পেশাল-ভোগ পাওয়া যায়। ফুটকি মায়ের দেওয়া টিফিনের পয়সা, মেলা-পার্বণের পার্বণী, বাড়তি বাস-ভাড়া – এই সব মাঝেমধ্যেই একটু-একটু করে জমিয়ে রাখত ইশকুল-ব্যাগের গোপন খাপটায়। টাকাগুলো খরচ করবার কথা কখনও ওর মনে হয়নি। আজ সেই টাকা-ক’টা দিয়েই…
ফুটকি এক-দৌড়ে মন্দির থেকে স্পেশাল-ভোগের শালপাতায় ঢাকা চাঙাড়িটা নিয়ে ঘরে ফিরে এল। তারপর মায়ের সামনে ভোগের গোল ডালাটা মেলে ধরে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, “এখনও গরম আছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।”
মা ভোগের থালাটার থেকে অবাক-দৃষ্টি তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। মায়ের তাকানোটা দেখে ফুটকির আবারও যেন খুব কান্না পেয়ে গেল।
মা অস্ফুটে বলল, “তুই আমার জন্য এই সব…” তারপর কথাটা শেষ না করেই, বুকে জড়িয়ে ধরল ফুটকিকে।
ঠিক তক্ষুণি বাইরে, নিভে আসা ভাদ্রের বিকেলে নিঃশব্দে শুরু হল বৃষ্টি।
একেই সম্ভবত বলে ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি!
_____
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment