বিপিনবাবুর টাইম মেশিন
সাগরিকা দাস
সাগরিকা দাস
“এই
ভরদুপুরে তুমি
আবার ওইসব নিয়ে খুটুর খুটুর শুরু করলে? বলি চান খাওয়া করবে তো নাকি? বলিহারি যাই আক্কেল, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, কোথায় একটু সুস্থির হয়ে ধম্মকম্মে
মন দেবে,
তা নয় উনি চল্লেন
সায়েনটিস হতে...” বৃন্দার আচমকা চিৎকারে বাড়ির সামনের
সুপুরি গাছের মাথা থেকে গোটা দুয়েক কাক ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। সেদিকে নজর দিতে গিয়ে মানদা এক বালতি
জল ঘরের মেঝেতেই উলটে ফেলল। সে বেচারা এতক্ষণ মন দিয়ে ঘর মুছছিল। বিপিনবাবু আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার
নিজের কাজে মন দিলেন। মানদার দোষ নেই, সে বরাবরই একটু হাঁ করা, নিটপিটে প্রকৃতির। তার
ওপর এখন বয়স
বেড়েছে। এমন
হঠাৎ চেঁচামেচি শুনলে ঘাবড়ে যাওয়াই তার দস্তুর। সব জেনেও বৃন্দা মাঝে মাঝেই বিপিনবাবুর
পেছনে এমন চিৎকার করে! বৃন্দার না হয় কথায় কথায় ধর্মের বাতিক আছে, তাই বলে কোন যুক্তিতে দেশসুদ্ধ
সব্বাইকে তাই নিয়ে মেতে থাকতে হবে, সে তো বিপিনবাবুর মাথায় ঢোকে না। আর কথায় কথায় এমন বয়সের খোঁটা দেওয়া
কেন বাপু?
এক্সপেরিমেন্টের
আবার কোনো বয়স আছে নাকি? কিন্তু একথা বৃন্দাকে বোঝায় সাধ্যি কার? সুতরাং সবকিছু অগ্রাহ্য করে
বিপিনবাবু আবার তাঁর টাইম মেশিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
লম্বাটে ধরনের মেশিনের মাঝখান বরাবর বেশ বড়োসড়ো একটা ফাঁকা
জায়গা। এইটা
আসলে চালকের বসার জায়গা। সামনেই ছোটো-বড়ো বিভিন্ন মাপের কতগুলো চাকা লাগানো। চাকাগুলোর গায়ে ছোটো ছোটো ডায়ালে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত লেখা। এই ডায়ালগুলো টাইম ট্র্যাভেলের সময়
তারিখ পালটাতে কাজে লাগবে। এ বিষয়ে কল্পবিজ্ঞানের অনেক মোটা মোটা
বইপত্র, দেশ বিদেশের নানান জার্নাল
পড়ে-টড়ে এই মেশিনটা তৈরি করছেন তিনি। বিপিনবাবুর
এসব কাজকর্মের সমঝদার এ বাড়িতে একজনই আছে, রিমলি। বিপিনবাবুর একমাত্র নাতনি। বাকি যারা এ বাড়িতে থাকে তাদের মধ্যে বিপিনবাবুর কাজের
ব্যাপারে ধারণা বা উৎসাহ কোনোটাই বিশেষ নেই। ছেলে অর্ক আর বউমা শ্রী দু’জনেই
নিজেদের অফিস আর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত। আর বিপিনবাবুর স্ত্রী বৃন্দা তো বিপিনবাবুর সব কাজেই
চিরকাল ব্যাঘাত ঘটিয়ে এসেছে। এখনও তার অন্যথা হয় না। বৃন্দার
কথায়, “ওসব এক্সপেরিমেন্ট না ছাই, সব ঐ বুড়োর বুজরুকি। বুড়ো
বয়সের ভীমরতি।” অর্ক আর শ্রী অবশ্য বৃন্দার কথায় বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। ওরা
বৃন্দাকে বোঝায়, “থাক না মা, বাবা বাবার জগতে। রিটায়ার্ড
লাইফে একটা কিছু নিয়ে মেতে থাকা ভালো, বোরডম আসবে না।” বিপিনবাবু সব কিছুই শোনেন আর মুচকি হাসেন। মনে
মনে ভাবেন, “একবার এক্সপেরিমেন্টটা সাকসেসফুল
হোক। আমার ইনভেনশন নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে
ঢি-ঢি পড়ে যাবে, তখন সব ক’টা নির্বোধ আর আহাম্মকের মুখে এক সঙ্গে তালাচাবি
পড়ে যাবে।”
রিমলি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আট
বছর বয়স। ভালো ছবি আঁকে। কার্টুন আর মার্ভেলের সিনেমার অন্ধ ভক্ত। বেশ
চটপটে আর বুদ্ধিমতী। ছুটির দিনগুলোতে স্নান-খাওয়া আর হোমওয়র্কের সময়টুকু ছাড়া সারা দিন দাদুর সঙ্গেই জুড়ে থাকে। আর
এখন তো করোনার জন্য গত তিন মাস ধরে স্কুল বন্ধই। সোম
থেকে শুক্র অনলাইন ক্লাস অবশ্য হয়। তবে, আজ তো শনিবার। গেল কোথায় মেয়েটা? মানদাকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয়। থাক গে, বৃন্দার কানে গেলেই আবার চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে।
“দাদাই...” রিমলির ডাকে পেছন ফিরে তাকালেন বিপিনবাবু।
“কী
রে, এতক্ষণ ছিলিস কোথায়?” ফিসফিস করে কথা বললেন বিপিনবাবু।
“ক্লাস
করছিলাম তো,” রিমলিও ফিসফিসিয়েই উত্তর দিল।
“আজ
তো শনিবার। আজ আবার ক্লাস কীসের?”
“এক্সট্রা
কারিকুলার গো। আম্মা
হঠাৎ খেপে গেল কেন বল তো?” ফিক
করে হাসল রিমলি।
“ওটা
তোর আম্মার স্বভাব। হ্যাঁ রে দিদি, ক’টা
বাজে? তোর স্নান হয়েছে?”
“ধুত, যাচ্ছি একটু পরে। সবে
তো এগারোটা বাজে,” বলেই
টুক করে মেশিনটার মাঝখানের ফাঁকা গর্তটায় ঢুকে পড়েছে রিমলি, “আচ্ছা দাদাই, তোমার এই টাইম মেশিনটা কি ডোরেমনের টাইম মেশিনের মতো হবে?”
“ডোরেমনের
টাইম মেশিন? সেটা কী রকম দিদি? আমি তো ওটা দেখিনি।”
“এ বাবা, তুমি এটাও জান না? নবিতার পড়ার টেবিলের যে ড্রয়ার, তাতেই তো ডোরেমনের টাইম মেশিন থাকে। হ্যান্ডেলটা না অনেকটা আমাদের
গাড়ির গিয়ারের মতো দেখতে। তবে তোমারটা অনেক বেশি ভালো হচ্ছে। ওদেরটা
খুব সিম্পল। এত সুইচ-টুইচ নেইই কিছু। টাইম
চেঞ্জ করার সুইচগুলোও অন্য রকম...” কথা
বলতে বলতেই নবগুলো পট পট করে ঘোরাতে শুরু করেছে রিমলি। বিপিনবাবু
বারণ করতে যাচ্ছিলেন, তার
আগেই মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল ওঁর। আশেপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এল।
কিছুক্ষণ পরে বন্ধ চোখের পাতায়
একটা নরম আলো পড়ছে বলে মনে হল ওঁর। সঙ্গে চোখমুখে দু-চার ফোঁটা জল। চোখ
খুললেন বিপিনবাবু। চোখের সামনে একটা বড়ো সাদা পর্দা। তাতে কালো কালো ছোপ। ছোপগুলো
আবার নড়াচড়া করছে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলেন, ওটা আসলে মেঘে ভরা আকাশ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। তিনি
নিজে মাটিতে শুয়ে আছেন। উঠে বসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন। না, ঠিক মাটিতে নয়। একটা
জঙ্গলের মাঝে বড়ো বড়ো ঘাসে ঢাকা জমিতে বসে আছেন তিনি। হাত
দুয়েক দূরে রিমলিও দুই পা ছড়িয়ে জঙ্গলের ওপর থেবড়ে বসে আছে। সেও
বেশ অবাক চোখে চারদিক নিরীক্ষণ করছে। কাছে পিঠে শুধুই বড়ো বড়ো গাছ। ডান
দিকে একটা দিঘল পুকুর। ঘন সবুজ তার জল। বৃষ্টিটা
পিট পিট করে পড়ছেই। একটা মেঠো ইঁদুর, না
ছুঁচো, নাকি কাঠবেড়ালি বিপিনবাবুর পাশ
দিয়ে হুশ করে চলে গেল। তড়বড় করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লেন তিনি। রিমলিও
ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
“ও
দাদাই, এটা কোথায়? আমরা জঙ্গলে কেন গো?”
“কী
জানি দিদি! চল,একটু এগিয়ে দেখি।” গাছপালার আড়াল সরিয়ে এগিয়ে যেতেই একটা চওড়া সুরকি ঢালা পথ চোখে পড়ল। রাস্তা
একটা পাওয়া গেল বটে, তবে
সেখানে লোকজন কেউ নেই। চওড়া রাস্তার দু’পাশে শুধু বড়ো বড়ো গাছের সারি। বিপিনবাবু
রিমলির হাত নিজের মুঠোয় পুরে ঐ রাস্তা ধরেই হাঁটতে লাগলেন। বেশি
দূর যেতে হল না। উলটো দিক থেকে একটা লোক হেঁটে এদিকেই আসছে। মাঝারি
হাইট, গোলগাল চেহারা, পরনে ধুতি, খালি গায়ে সাদা একটা চাদর জড়ানো। ডান হাতে একটা কাপড়ের ঝোলা। লোকটা
হন হন করে কোনো কাজে যাচ্ছিল হয়তো, সামনে
বিপিনবাবুদের দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। অবাক চোখে কিছুক্ষণ আপাদমস্তক জরিপ করল ওদের। তারপর
বেশ নরম স্বরেই জিজ্ঞেস করল, “কে
আপনি মহাশয়? কোথা হইতে আগমন?” লোকটার বেশভূষা দেখে আর আচমকা এমন সাধু ভাষায় কথা শুনে
বিপিনবাবু একটু ঘাবড়ে গেলেন।
“ইয়ে, আমি বিপিন গাঙ্গুলি, কলকাতার গাঙ্গুলি বাগান থেকে আসছি। এটি আমার নাতনি রিমলি। আপনি... মানে... এই জায়গাটা...”
“এই
অধমের নাম সদানন্দ গড়গড়ি। কিন্তু আপনার পদবি শুনিয়া তো বাংলার বলিয়া বোধ হইতেছে
না...”
“বাঙালি
নয় মানে? কলকাতায় সাত পুরুষের বাস, আর আপনি বলছেন আমি বাঙালিই নই?”
“কলকাতা? সেটি কোন গ্রাম?”
লোকটার অবাক হওয়া দেখে বিপিনবাবু চোখ কপালে তুললেন, “কলকাতা গ্রাম!
আপনি কলকাতার নাম শোনেননি?”
“ওহ, বুঝিয়াছি। আপনি বোধ করি কলিকাতা গ্রামের
কথা বলিতেছেন।” লোকটার মুখে বোকা বোকা হাসি দেখে বিপিনবাবু এবার হাল ছেড়ে দিলেন। মনে
মনে ভাবলেন, এই লোকটা কেমন অদ্ভুত যেন। না
হয় এই রকম একটা অজ পাড়াগাঁয়ে বাস করে, তাই বলে কি পৃথিবীর কোনও খবরই রাখতে নেই? মুখে বললেন, “হ্যাঁ, তাই। তা এই জায়গাটার নাম কী দাদা?”
“এটি
বাংলাদেশের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম।”
শুনেই চোখ কপালে তুললেন বিপিনবাবু। “অ্যাঁ, একেবারে বাংলাদেশে এসে পড়েছি? এবার তো ট্রেসপাসার বলে হাজত বাস করতে হবে রে দিদি!”
বিপিনবাবুকে ভয় পেতে দেখে খুক খুক করে হাসতে লাগল রিমলি। সদানন্দ
লোকটা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
“মহাশয়
কি সংগোপনে কিছু বলিতেছেন?”
“নাহে
বাপু, কিছু গোপনে বলছি না। বলছি
আমরা তো না বুঝেই এ দেশে ঢুকে পড়েছি, তা তুমি যদি বর্ডারটা কোন দিকে একটু দেখিয়ে দাও, তবে এখনি মানে মানে কেটে পড়ি। নচেৎ নাতনিকে নিয়ে হাজত বাস করছি জানলে বৃন্দা তো আমাকে
বাড়ি থেকে খেদিয়েই দেবে। এই বয়সে বাড়িছাড়া হলে...”
“ও দাদাই, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আম্মা কী করে জানবে আমরা এখানে আছি? তোমার কাছে কি ফোন আছে?” রিমলি
পাশ থেকে ফুট কাটল।
“ও হ্যাঁ, তাও তো বটে। মোবাইলটা তো টেবিলের ওপরেই পড়ে
রয়েছে। এখন কী হবে দিদি? তোর
বাবা-মাও তো এখন বাড়িতে। আমাদের
এতক্ষণ দেখতে না পেলে তো চিন্তায় পড়ে যাবে। ও ভাই, এদিকের রাস্তাঘাট কিছু চেন-টেন?” শেষের প্রশ্নটা সদানন্দকে করা। সে
এতক্ষণ হাঁ করে ওদের কথা শুনছিল। বিপিনবাবুর ডাকে এবার নড়েচড়ে উঠল।
“মহাশয়ের
নিবাস কলিকাতা গ্রামে বলিলেন। অথচ পোশাক দেখিয়া তো বোধ হইতেছে বাংলাদেশের মানুষ নহেন। এমন
বাংলা ভাষাই বা শিখিলেন কীরূপে? আপনাদিগের
বাক্যালাপ তো কিছুই বোধগম্য হইতেছে না।”
“কেন, আমি কি হিব্রু ভাষায় কথা বলছি? আর তুমি আপদ, এই ধড়াচুড়ো পড়ে কোন ঐতিহাসিক নাটকে অভিনয় করছ শুনি, যে তখন থেকে এই দুর্বোধ্য সাধু ভাষায় বকে চলেছ?”
রেগে গেলেই বিপিনবাবুর ভেতরের সেই কড়া ইস্কুল মাস্টার জেগে ওঠে। ধ্যাতানি
খেয়ে সদানন্দ খানিক চোখ পিট পিট করল। তারপর আবার সেই একই ভাবে বলে উঠল, “মহাশয়কে এতক্ষণ সজ্জন বলিয়াই বোধ হইতেছিল। এ হেন
রুঢ় ব্যবহার আপনার নিকট আশা করি নাই। যাহা হউক, আপনি ভিনদেশি, এ গাঁয়ের
অতিথি, সঙ্গে শিশু রহিয়াছে, তদুপরি পথশ্রমে ক্লান্ত...”
“এই
দেখ, এতক্ষণ বকাই সার হল দেখি! এ তো কিছুই বোঝে না!”
বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও কোনও গবেট ছাত্র অঙ্ক বুঝতে না পারলে যেমন লাগত, এখনও বিপিনবাবুর তেমনি হতাশ লাগল। ঠাণ্ডা
মাথায় তিনি আবার বোঝাতে শুরু করলেন, “শোন, আমরা ক্লান্ত নই। তুমি
শুধু বলতে পার, এই রাস্তাটা ধরে এগোলে কোথায়
পৌঁছোনো যায় শেষ পর্যন্ত?”
“তাহা
আর এমন কঠিন কথা কী? এ তো
বাদশাহি সড়ক। সকলেই অবগত আছেন এ পথ পূর্বে সোনারগাঁ এবং পশ্চিমে দূর কাবুলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।”
“ক্ক...কাবুল? মানে আফগানিস্থান?”
“মহাশয়
কি কিছুই অবগত নহেন? এ যাবৎ
তো এ দেশে আফগান শাসনই চলিতেছে। মহাশয় কি এই মুহূর্তে অন্য কোনও দেশ হইতে আসিতেছেন? সেখানে কি এখনও কোনও হিন্দু রাজা...”
“অ্যাঁ, হিন্দু রাজা? সেরেছে, এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম
রে দিদি?” বিপিনবাবু ফিসফিস করে বললেন। এবার
তিনি বাস্তবিকই ঘাবড়ে গেছেন।
“দাদাই, ও দাদাই, আফগান শাসন মানে কী গো?” রিমলি
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
“কী
জানি! সিরাজউদ্দৌলা-টৌলা কেউ একটা হবে।” মনে
মনে ভাবলেন, চিরকাল তো অঙ্ক নিয়েই পড়ে থেকেছি। অঙ্কের মাস্টারি করে জীবনটাও কেটে গেল। ঐ ইতিহাস ব্যাপারটা বরাবরই সাল-তারিখের প্যাঁচালো জঙ্গল মনে হত। এখন
এই পাগলের পাল্লায় পড়ে কি শেষে ইতিহাস পড়তে হবে?
“সিরাজউদ্দৌলা, মানে মুর্শিদাবাদের নবাব? আমরা কি তবে মুর্শিদাবাদ চলে এসেছি? দাদাই, তোমার টাইম মেশিন তার মানে রেডি
হয়ে গেছিল? তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে
বলনি? কী মজা! কী মজা!” হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল রিমলি, "ও দাদাই, চল না হাজারদুয়ারি দেখব।"
একবার বকতে শুরু করলে এ মেয়েকে
থামানো মুশকিল। বিপিনবাবু পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। একে তো অচেনা-অজানা জায়গা, সামনের
এই মূর্তিমান, সদানন্দ গড়গড়ি না কড়কড়ি তখন থেকে বাংলাদেশ, কাবুল, আফগান-টাফগান বলে মাথার ঘিলু নাড়িয়ে
দিল। তার ওপর এই মেয়ে এখন সিরাজউদ্দৌলা আর হাজারদুয়ারি নিয়ে পড়েছে। কিন্তু
সত্যিই কি ওরা এখন মুর্শিদাবাদে এসে পড়ল নাকি? তাহলেই তো চিত্তির! সঙ্গে
টাকা-পয়সাও তো তেমন কিছু নেই। কিন্তু
এই সদানন্দ লোকটা যে একটু আগে বলল, এটা
বাংলাদেশের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম! বিপিনবাবুর
মনে পড়ল, অনেকদিন আগে অভ্রর কাছে একবার
শুনেছিলেন, মুর্শিদাবাদের কাছে কোন একটা
জায়গায় নাকি ভারত-বাংলাদেশ
বর্ডারে কোনও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা নেই। তবে কি সেখান দিয়েই সোজা বাংলাদেশে এসে পড়লেন? কিন্তু কীভাবে যে এলেন, তা তো কিছুতেই মনে পড়ছে না! ...ভেবেচিন্তে
বিপিনবাবু শেষে সামনের লোকটাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা সদানন্দ, তোমার
এই শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম কি মুর্শিদাবাদের কাছেই?”
“আজ্ঞে, সে কোন স্থান? তাহার নাম তো কখনও শুনি নাই?” সদানন্দ
লোকটা ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ করে তাকিয়ে রইল।
“অ, সে নামও শোন নাই? তবে শুনেছটা কি গোমুর্খ?” রাগের
চোটে মুখ ভেঙ্গিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন বিপিনবাবু। তবে
সবটাই করলেন মনে মনে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে সামনে পাওয়া একমাত্র মানুষটিকে চটানোর সাহস তার হল না। মুখে
বললেন, “তা তোমার কথা তো পুরো জানা হল
না? এদিকে তুমি কি কোনও কাজে যাচ্ছিলে?”
“আজ্ঞে, আমি এক্ষণে নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন করিতেছি। মহাশয়ের
চলিতে আজ্ঞা হউক। পথিমধ্যে আমরা না হয় পরিচয় বিনিময় করিব। সন্ধ্যা
প্রায় আগত। অধিক বিলম্ব করা উচিত হইবে না। নচেৎ অদ্য পুনরায় সরাই-বিশ্রামাগারে রাত্রিবাস করিতে হইবে।” লোকটা হঠাৎ তাড়াতাড়ি করে হাঁটতে
শুরু করাতে বিপিনবাবু বুঝলেন তাঁদেরও এবার চলতে হবে। লোকটাকে
ছেড়ে উলটো দিকে হাঁটার চেয়ে লোকটার সঙ্গে যাওয়াটাই ভালো মনে করলেন তিনি। লোকটার
গ্রামে পৌঁছতে পারলে অন্তত কিছু লোকজনের দেখা পাওয়া যাবে। তারপর
না হয় কলকাতা ফেরার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। চলতে চলতে সদানন্দ নিজেই আবার
বলতে শুরু করল, “আমি গড়গড়ে গ্রামের সদ্বংশীয়
কায়স্থ সন্তান। বহুকাল পূর্বে একবার গ্রামে মড়ক লাগিয়াছিল। সে
সময় আমার প্রপিতামহ গড়গড়ে গ্রাম ত্যাগ করিয়া সপরিবারে এই শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে আসিয়া
বসবাস শুরু করেন। কতক ঘর নিকটাত্মীয় সে স্থানে এখনও রহিয়াছে। কালে
কচ্চিৎ তাহাদের সহিত দেখাসাক্ষাৎ হয়। তেমনই এক আত্মীয়ের অসুস্থতার সংবাদ শুনিয়া তাহাকে দেখিতে
গিয়াছিলাম। কিন্তু আপনাদিগের পক্ষে তো অদ্য গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভবপর হইবে না। আপত্তি
না থাকিলে অদ্য রজনী এই গরিবের গৃহে বিশ্রাম লইতে পারেন।” কথাটা
শুনে বিপিনবাবু উত্তর দিতে গেলেন। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে দেখলেন তাঁর হাঁফ ধরছে। সদানন্দ
লোকটা হনহন করে হাঁটছে। ওর হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে বিপিনবাবু আর রিমলিকে
প্রায় ছুটতে হচ্ছে। রিমলির যদিও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু বিপিনবাবুর পক্ষে এই
বয়সে এত ছোটাছুটি করাটা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে বিপিনবাবু বললেন, “ইয়ে, সদানন্দ, অটো-টোটো কিছু একটা ডেকে নিলে হত না? নিদেনপক্ষে একটা রিকশাও যদি পাওয়া যায়!”
সদানন্দ থমকে দাঁড়িয়ে একটু অবাক
চোখে তাকাল। দেখে বিপিনবাবু আবার বললেন, “টাকা
পয়সা নিয়ে ভেব না। আমার কাছে যা আছে তাতে হয়ে যাবে। কাছাকাছি কোনও রিকশা স্ট্যান্ড
আছে?” অবাক ভাবটা বজায় রেখেই সদানন্দ
উত্তর দিল, “মহাশয় বড়োই আশ্চর্য প্রকৃতির। আপনাদিগের
পোশাকআশাক দেখিয়া প্রথমেই সে কথা ঠাহর হইয়াছিল। ভাষাটি
বাংলা হইলেও তাহা ঠিক সহজবোধ্য নহে। আবার হাটুরে প্রকৃতির মনুষ্য সদৃশও নহে। তদুপরি, কিছু শব্দের অর্থ তো একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকিতেছে। এক্ষণে
আবার টাকার কথা বলিতেছেন! টাকার
ব্যবহার যে নিষিদ্ধ হইয়াছে আপনি কি তাহা জানেন না?”
“টাকা
নিষিদ্ধ!” আকাশ থেকে পড়লেন বিপিনবাবু। পরক্ষণেই
কী মনে হতে পকেট হাতড়ে একটা সবুজ রঙের পাঁচশো আর দুটো বেগুনি রঙের একশো টাকার নোট বার
করে আনলেন। সদানন্দকে দেখিয়ে বললেন, “এই
টাকাগুলো নিষিদ্ধ? আজ
সকালেই পাড়ার দোকান থেকে দুধ, ডিম, পাউরুটি কিনলাম এই টাকা দিয়ে। আর
এখনই এগুলো নিষিদ্ধ হয়ে গেল? আমার
সঙ্গে চালাকি হচ্ছে?” শেষের
কথাটা একটু চেঁচিয়েই বললেন। বোঝাই যাচ্ছে, বিপিনবাবু বেশ রেগে গেছেন।
ধমক শুনে এবার আর সদানন্দ ভয়
পেল না। উলটে হা হা করে হেসে উঠে বলল, “এই বৃহদাকার রঙ্গিন কাগজগুলিকে আপনি টাকা ভ্রমে সঙ্গে করিয়া ঘুরিতেছেন? মহাশয়ের নিশ্চয়ই মস্তিস্ক বিভ্রাট ঘটিয়াছে।”
“আম্ম...ম্ম...আমার মাথা খারাপ? আমি
পাগল?” রাগের চোটে তোতলাতে শুরু করেছেন
বিপিনবাবু। সদানন্দ হাত তুলে বরাভয় মুদ্রা দেখিয়ে তাঁকে শান্ত হতে বলে নিজের ঝোলাটার মধ্যে
হাত ঢুকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হাতটা মুঠো করে ঝোলা থেকে বের করে আনল। মুঠোটা
খুলে বিপিনবাবুর সামনে মেলে ধরল। সেখানে পাশাপাশি দুটো কয়েন রাখা। দেখে
তো মনে হচ্ছে সে দুটোর একটা তামার আর একটা রূপোর। রূপোর
কয়েনটা দশ টাকার কয়েনের চেয়ে সামান্য বড়ো সাইজের। তামারটা
একটু ছোটো। কয়েনগুলোর মাঝখানে চৌকো দাগ কাটা। পুরো কয়েনের গায়ে ‘উর্দু’ না ‘আরবি’ কি একটা ভাষায় বিচিত্র ধরণের কিছু লেখা। বিপিনবাবু
চোখ সরু করে তাকিয়ে আছেন দেখে সদানন্দ বলল, “ভারতবর্ষে এখন এই মুদ্রার চলন হইয়াছে। রৌপ্য
মুদ্রাটির নাম রুপিয়া আর তাম্রটির নাম দাম। এছাড়া মোহর অর্থাৎ স্বর্ণমুদ্রারও
প্রচলন আছে। তবে তাহার মূল্য অনেক বেশি। আমার নিকট সেটি নাই।” দেখানো
হয়ে গেলেই কয়েনগুলো যত্ন করে আবার ঝোলায় ভরল সদানন্দ। বিপিনবাবু
অলক্ষ্যে মুখ বেঁকালেন। এই লোকটা হয় বদ্ধ পাগল, নয় চোর, নয়তো জালিয়াত। এই
ব্যাপারে ওঁর মনে আর কোনও সংশয় নেই। কিন্তু রাস্তার একটা হদিশ না পাওয়া পর্যন্ত লোকটার
সঙ্গ ছাড়াটাও তো মুশকিল। বিশেষত, এই রাস্তায় যতক্ষণ দ্বিতীয় কারও দেখা পাওয়া না যাচ্ছে। মুখে
বললেন, “কী জ্বালা! কয়েন দেখে আমি কী করব? তোমার গ্রাম আর কতদূর?”
“দক্ষিণ
দিকে আর মাত্র পাঁচ-ছয়
ক্রোশ যাত্রা করিলেই...”
“ক্রোশ
কি দাদাই?” নতুন শব্দ শুনেই রিমলির মাথায়
প্রশ্ন চাগাড় দিয়েছে।
“ক্রোশ? উমম... যত দূর মনে পড়ছে এক ক্রোশ মানে ২০০ মিটার।”
“মানে
জিরো পয়েন্ট টু কিলোমিটার? তার
মানে আমাদের আরও উমম... টু
হান্ড্রেড ইন্টু সিক্স, মানে
ওয়ান পয়েন্ট টু কিলোমিটার যেতে হবে?” রিমলি
মুখে মুখেই ক্যালকুলেশন করে ফেলল।
“ইয়েস,” খুশি হয়ে রিমলির পিঠ চাপড়ে দিলেন বিপিনবাবু। তারপরেই
খেয়াল হল, এই সদানন্দ লোকটা রাস্তার মাপ
বলল ক্রোশে। এই ইউনিটের চল তো বহুকাল আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে
কি তবে এখনও এই ইউনিটেই মাপজোক চলে? নাকি
এই লোকটা সত্যিই পাগল? সন্দেহ
কাটাতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি
যেখানে গিয়েছিলে, সেই
গড়গড়ে গ্রাম কতদূরে?” সদানন্দ
লোকটা রিমলির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। বিপিনবাবুর প্রশ্ন শুনে চোখ
ফেরাল।
“সঠিক
বলিতে পারি না। তবে আনুমানিক দুই শত যোজন উত্তরে হইবে। দ্বিপ্রাহরিক
বিশ্রাম বর্জন করিলে দুই দিনের পথ।” বিপিনবাবু আবার স্মৃতি হাতড়ে মনে মনে অঙ্ক কষতে লাগলেন। ১ যোজন
= ৪ ক্রোশ। তাহলে
২০০ যোজন = ৮০০ ক্রোশ। আবার
১ ক্রোশ = ০.২ কিমি। তার মানে ৮০০ ক্রোশ = ১৬০
কিলোমিটার। গাড়িতে গেলে ঘণ্টা পাঁচেক সময় লাগবে। ট্রেনে আরও কম। অথচ
লোকটা বলল দু’দিনের পথ। চমকে উঠলেন তিনি।
“তুমি
কি পুরো রাস্তা হেঁটে আসছ?”
“তাহা
ভিন্ন আর উপায় কী? পালকি
বা ঘোটক ভাড়া করিবার সাধ্য আমাদের ন্যায় সাধারণের তো নাই।”
“পালকি! ঘোটক... মানে ঘোড়া! কেলো
করেছে। ইয়ে,.. এটা কি সত্যি সত্যিই কোনও ঐতিহাসিক... মানে ঐ...”
একটা খরর খরর শব্দ কানে আসাতে
বাকি কথাটা আর বলা হল না বিপিনবাবুর। শব্দটা আসছে পেছন দিক থেকে। ক্রমশ
সেটা জোরালো হচ্ছে। কীসের আওয়াজ তা দেখার জন্য বিপিনবাবু পেছন ঘুরলেন। সদানন্দ
তাড়াতাড়ি বিপিনবাবুর হাত ধরে টেনে রাস্তার এক পাশে গাছের আড়ালে সরিয়ে নিল ওদের।
“করিতেছেন
কী! এমন আহাম্মকের ন্যায় পথের মাঝে
দাঁড়াইয়া থাকিলে তো আহত হইবেন। তাছাড়া আপনাদিগের এরূপ কিম্ভূত পোশাক দেখিলে বিদেশি
বলিয়া এখনি আটক করিবে। সঙ্গে আমাকেও নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন...”
আওয়াজের জন্য সদানন্দের বাকি
কথাগুলো আর শোনা গেল না। আচমকা এমন ধমক খেয়ে বিপিনবাবু ফ্যালফ্যাল করে একবার
নিজের শরীরের দিকে আর একবার রিমলির দিকে তাকালেন। দু’জনেরই
পরনে গোলগলা টিশার্ট আর বারমুডা, পায়ে
ঘরে পরার স্লিপার। পরক্ষণেই হাঁ করে দেখলেন, রাস্তার
ওপর দিয়ে চারটে তেজি ঘোড়া দুরন্ত গতিতে ছুটে গেল। প্রত্যেকটা
ঘোড়ার পিঠে একজন করে লোক। অদ্ভুত তাদের সাজপোশাক। মাথায়
গোলাকার ধাতব টুপি। পরনে জোব্বার মতো দেখতে গলাবন্ধ হাঁটুঝুলের জামা আর পাজামা। কোমরে
বেল্ট। তাতে লম্বা আর শক্ত একটা নল ব্যাঁকা ভাবে ঝোলানো। বুঝতে
অসুবিধে হচ্ছে না ওটা তরোয়াল বা ঐরকমই কোনও অস্ত্র। খাপে
ভরা রয়েছে।
ঘোড়াগুলো চলে যেতেই পেছনের পথে
ধুলোর একটা ঝড় বয়ে গেল যেন। আশপাশটা প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল। রিমলি
খক খক করে কাশতে শুরু করেছে দেখে বিপিনবাবু পকেট থেকে রুমালটা বের করে ওর মুখে চাপা
দিয়ে নিজের অসমাপ্ত কথাটা শেষ করলেন, “রাজা-বাদশার সময় নাকি?” ...ভয়ে, উত্তেজনায় বিপিনবাবুর গলা কেঁপে গেল।
“তাহা এমন আশ্চর্য কী? কিন্তু আপনারা ঠিক কোথা হইতে
আসিতেছেন তাহা তো ঠিক ঠাহর করিতে পারিতেছি না। এই বালিকা সামান্য পূর্বেই কোনও এক
অজ্ঞাত ভাষায় কিছু কহিতেছিল। সেটি কোন ভাষা? উর্দু বা পার্সি জাতীয় কিছু
কি?”
“না, ইংরেজি... মানে এক অন্য বিদেশি ভাষা। তবে আমরা বাঙালি, মানে বাংলাদেশেরই লোক। বহুদিন পরে দেশে ফিরছি। তাই...”
“ও দাদাই, আমরা তো ইন্ডিয়ান। তুমি বাংলাদেশী বলছ কেন?” নিজের
জি.কে বই-পড়া বিদ্যে অনুযায়ী রিমলি
তার দাদাইয়ের কথায় ভুল ধরাচ্ছিল। বিপিনবাবু তাড়াতাড়ি ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল
রেখে রিমলিকে ইশারা করে চুপ করতে বললেন। মনে মনে ভাবলেন, কোথাও কিছু একটা গোলমাল তো
নির্ঘাত হয়েছে। বলা
যায় না, হয়তো রিমলির কথাই ঠিক। গোলমালটা তাঁর টাইম মেশিনেই হয়েছিল
হয়তো! না জানি কোথায় এসে পড়েছেন! এখন বিদেশি ভেবে এই লোকটা যদি সঙ্গ
ছেড়ে দেয় তো ঝঞ্ঝাটের একশেষ হবে। তার চেয়ে কথায় কথায় এই জায়গাটার লোকেশনটা
আগে ঠিক করে জেনে নেওয়া দরকার। মুখে বললেন, “ঐ একই
তো হল। তা
ভাই সদানন্দ,
তুমি যে বাদশার
কথা বলছিলে তার নামটা কী?” সদানন্দের মুখে এতক্ষণে অবাক ভাবটা
কেটে গিয়ে একটা নিশ্চিন্ত ভাব এসেছে। বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে সে বলল, “এতক্ষণে
বুঝিলাম,
সকল কিছু আপনার
নিকট অজ্ঞাত কেন। দীর্ঘকাল স্বদেশ হইতে দূরে থাকিলে এমৎ বোধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাহা হউক আমি যথাসাধ্য আপনার কৌতূহল
প্রশমনের চেষ্টা করিতেছি। আপনি ঠিক কত বৎসর পূর্বে ভিনদেশে যাত্রা করিয়াছিলেন?”
“তা বছর পাঁচ-ছয় হবে...” পাশ
কাটানো উত্তর দিলেন বিপিনবাবু।
“আপনার স্মরণে থাকিতে পারে, মুঘল বাদশাহ বাবর, সাসারাম প্রদেশের শাসক নিযুক্ত
করিয়াছিলেন তাঁহার এক বিশ্বস্ত সেনাপতি ফরিদ খানকে।”
“বা...ব্বা...বাবোওওর!”
বাবরের নামের
শেষে অনর্থক কতগুলো ও জুড়ে দেওয়ার কারণ আর কিছুই না, বিপিনবাবু যুগপৎ অবাক হয়েছেন এবং হোঁচট
খেয়েছেন। রাস্তার
মাঝখানে একটা গর্ত ছিল। সদানন্দর কথায় মন দিতে গিয়ে সেদিকে চোখ পড়েনি ওঁর। সদানন্দ তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে বিপিনবাবুকে
ধরতে গেল। তবে
তার আর দরকার হল না। বিপিনবাবু নিজেকে সামলে নিয়েছেন। চোখ গোল গোল করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে
বললেন, “এক্কেবারে ১৫২৬?”
“১৫২৬ কী দাদাই?” রিমলি
আবার তার প্রশ্নের ঝাঁপি খুলেছে।
“ফার্স্ট ব্যাটেল অব পানিপথ। ইন দ্য ইয়ার ফিফটিন টোয়েন্টি সিক্স। পড়িসনি হিস্ট্রিতে?”
দু’দিকে মাথা নাড়ল রিমলি। তাই দেখে বিপিনবাবু বললেন, “ওহ, তাহলে নেক্সট ইয়ারে পড়াবে
হয়তো।” কাঁধ ঝাঁকালেন বিপিনবাবু।
“সে ঠিক আছে, কিন্তু বাবা যে বলে হিস্ট্রিতে
তোমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই? তাহলে এটা জানলে কেমন করে?”
চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন
করল রিমলি। বিপিনবাবুর
মনে পড়ল,
ছোটোবেলায় একবার
স্কুলে ইতিহাস ক্লাসে মাস্টারমশাই বিপিনবাবুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কবে
এবং কার কার মধ্যে হয়েছিল?” ইতিহাসে দুর্বল বিপিনবাবু যথারীতি সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। ফলে ক্লাসসুদ্ধ ছেলের সামনে জুটেছিল
কানমলা। অপমানিত
বিপিনবাবু পরে বই খুলে দেখেছিলেন ঠিক উত্তরটা। সেদিনের সেই পড়া এতদিন পরেও যে তাঁর
মনে আছে,
সেটা দেখে নিজেই
অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু
এসব কথা তো আর নাতনিকে বলা চলে না! তাই গম্ভীর মুখে বললেন, “ভালো রেজাল্ট করতে গেলে তো
সব সাবজেক্ট মন দিয়ে পড়তে হয় দিদি।”
সদানন্দ এতক্ষণ চুপ করে ওদের কথা শুনছিল। এবার সে বলল, “মহাশয়, সন তারিখের গোলমাল করিয়া ফেলিলেন
যে। এখন
নয় শত একান্ন বঙ্গাব্দ চলিতেছে।”
“বঙ্গাব্দ কী দাদাই?” নতুন
শব্দ শুনে আবার রিমলি মুখ খুলেছে।
“ওরে বাবা! এর ওপর আবার বলে বঙ্গাব্দ! আর হিসেব করতে পারছি না সদানন্দ। তুমি যা বলছিলে বলে যাও,” কাঁদো
কাঁদো শোনাল বিপিনবাবুর গলাটা। তাই দেখে রিমলি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সদানন্দ ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ করে
বলল, “না, পানিপথের যুদ্ধ বহুকাল আগেই সমাপ্ত হইয়াছে কিনা, তাহাই বলিতেছিলাম।”
“অহ, শেষ হয়ে গেছে? বাঁচা গেছে। তা এখন তাহলে কী হচ্ছে? তুমি সাসারাম না আসারাম কার
কথা বলছিলে যেন?”
“আজ্ঞে, সাসারাম। পূর্বতন পাট্টলিপুত্রের নিকট অবস্থিত
এক প্রদেশ। এক
সময় সে স্থানের জায়গিরদার ছিলেন হাসান খান শূর। তাঁরই পুত্র ফরিদ খান, পরবর্তীকালে নিজ বীরত্বগুণে
সেই অঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়োজিত হইয়াছিল, কিন্তু বাদশাহ হুমায়ূনের আমলে সেই ফরিদ খানই
বঙ্গদেশ আক্রমণ করিয়া সুলতান গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহকে পরাজিত করেন।”
“পাটলিপুত্র? মানে তো বিহার। আচ্ছা, তা এই মামুদ শাহটা আবার কে বাপু?”
“ইনি মুঘল বাদশাহ কর্তৃক নিয়োজিত
বঙ্গদেশের শাসক ছিলেন।”
“ওহ্, তারপর? তোমাদের মুঘল বাদশা কিছু বলল
না ঐ ফরিদ খানকে?”
“চৌসা নামক এক স্থলে উহাদের পরস্পরের
মধ্যে যুদ্ধ হইয়াছিল। তাহাতে ফরিদ খান জয়লাভ করে। পর
বৎসরেই কনৌজের যুদ্ধেও ফলাফল অপরিবর্তিত থাকে। তাঁহার নতুন নামকরণ হয় শের শাহ সূরি। সেই সময় হইতে দিল্লির সিংহাসনে তিনিই
আসীন। বাংলায়
এখন তাঁর নিয়োজিত শাসনকর্তা খিজির খাঁ।”
“উরিত্তারা! আমরা তবে দ্য গ্রেট শের শাহের
আমলে এসে পড়েছি!
সেই যে নিজে
হাতে বাঘ মেরেছিল!”
“আজ্ঞে, ইনি সেই তিনিই,” নিশ্চিন্ত মনে ঘাড় নাড়ল সদানন্দ। কিন্তু বিপিনবাবু পড়লেন দোলাচলে। তবে
কি সত্যিই ওঁরা শের শাহের সময়ে এসে পড়লেন? নাকি এই সদানন্দ লোকটা অতি চালাক? এসব হাবিজাবি গল্প শুনিয়ে বিপিনবাবুকে বোকা বানাচ্ছে? কিন্তু... একটু আগে রাস্তার ওপর, নিজের
চোখে যা দেখলেন, সেটাই বা অবিশ্বাস করেন কী করে? তাছাড়া এই পারিপার্শ্বিক পরিবেশও তো বেশ অন্যরকম। এই
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সুরকির পথ, সে
পথে লোকজনও বিশেষ নেই। এতক্ষণে কোনও গাড়ি, রিকশা নিদেনপক্ষে একটা সাইকেলও চোখে পড়েনি ওঁদের। ভেবেচিন্তেও
কোনও কূলকিনারা না পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আর
এইমাত্র ঘোড়ায় চড়ে যারা গেল তারা?”
“উহারা রাজপেয়াদা। নিকটেই একটি সরাইখানা আছে। সে স্থলেই হয়তো অনুসন্ধান করিতে গেল।”
“কীসের অনুসন্ধান?”
“সরাইখানাগুলি সংবাদ সংগ্রহের জন্য
সর্বাপেক্ষা উত্তম স্থান। বহিরাগত বা সন্দেহজনক কোনও ব্যক্তি আজ এখানে উপস্থিত হইয়াছিল
কিনা, এছাড়া মদ্যপান করিয়া কেহ অকারণ
হল্লা করিতেছে কিনা, ব্যাভিচারি
কোনও ব্যক্তি আশেপাশের গ্রামে বসবাস করিতেছে কিনা, ইত্যাদি প্রভৃতি।”
“ওব্বাবা, তাহলে তোমাদের
শের শাহ বেশ কড়া ধাঁচের মানুষ বল?”
“সশ্...শ্!” নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে চুপ করতে বলল সদানন্দ, “এত দুঃসাহসী হইবেন না, মহাশয়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথের উপর দাঁড়াইয়া আপনি স্বয়ং বাদশাহের নামোচ্চারণ করিতেছেন?”
“ও, আচ্ছা, ভুল হয়ে গেছে। আর করব না।” সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন বিপিনবাবু। সদানন্দ
বলল, “সত্যি বলিতে কী, বাদশাহ দিল্লিবাসী। তিনি
কেমন, তাহা আমার ন্যায় ক্ষুদ্র মনুষ্যের
পক্ষে অনুধাবন করা অসম্ভব। কিন্তু এই খিজির খাঁয়ের অশ্বারোহী বাহিনী বড়োই দুর্মতিপরায়ণ। সামান্য
কিছু অসংগত বোধ হইলেই হম্বিতম্বি করিয়া তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাইবে।"
“এই
রে, তবে আমাদের দেখতে পেলেও তো... ও দিদি চল, আমরা বরং পেছন দিকে হাঁটি।”
শেষের কথাটা বিপিনবাবু রিমলির উদ্দেশে বললেন। রিমলি থমকে দাঁড়াতেই সদানন্দ বলল,
“আপনি কি পশ্চাৎ দিকে যাইবার কথা ভাবিতেছেন? বিশেষ লাভ নাই। এ পথে প্রতি দুই ক্রোশ দূরত্বে একটি
করিয়া সরাইখানা আর বাওলি অবস্থান করিতেছে।”
“বাওলি?”
“স্নানাগার। ওরা
ঐ নামেই ডাকে।”
“ওহ? তাহলে উপায়?”
“আমিও সেই কথাই ভাবিতেছি,” একটু
চিন্তিত দেখাল সদানন্দকে। খানিক পরে আবার বলল,
“আপনি বৃদ্ধ। সঙ্গে শিশু রহিয়াছে... নিশ্চয় কোনও অসৎ ব্যক্তি নহেন? ...অর্থাৎ... আপনাকে
সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারি?”
বিপিনবাবু আগে থেকেই ঘাবড়ে ছিলেন। এখন সদানন্দের এমন চিন্তিত মুখ আর
গম্ভীর প্রশ্ন শুনে আরও ঘাবড়ে গেলেন। কোনোরকমে ঢোঁক গিলে বললেন, “না...
মানে... হ্যাঁ... মানে ইয়ে... পারো, পারো, অবশ্যই পারো।”
“তাহা হইলে আর ভয় কী? রাজপেয়াদারা যদি সম্মুখীন
হইয়া কিছু জানিতে চাহে, বলিব আপনারা আমার বিশেষ পরিচিত। কোথা হইতে আসিতেছেন জানিতে চাহিলে
সত্যই বলিবেন।”
“সত্যি
বলব? আর যদি বিশ্বাস না করে? তার চেয়ে আমি বলি কী,
এই পথ ছেড়ে আমরা যদি জঙ্গলের পথ ধরি?”
“না
না, সে অসম্ভব। কোন
উন্মাদ খাদ্য রূপে ব্যাঘ্র বা নেকড়ের সম্মুখে পতিত হইয়া নিশ্চিত মৃত্যুকে আবাহন করিবে?”
“ব্যাঘ্র! মানে বাঘ!
নেকড়ে! এই জঙ্গলে ওসব আছে নাকি?”
“শৃগাল
এবং হায়নাও রহিয়াছে। এছাড়া কালনাগিনী, শঙ্খচূড়...”
“এ..এ..এটা
কি সু...উ...উন্দরবন?” ভয়ের চোটে বিপিনবাবুর গলায় এবার
গিটকিরি লেগে যাচ্ছে।
“আঃ; তখন হইতে কী সকল অদ্ভুত স্থানের নাম করিতেছেন? একবার বলিলাম তো ইহা বাংলাদেশের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম।”
ধমক খেয়ে বিপিনবাবু এবার আমতা
আমতা করতে লাগলেন, “হ্যাঁ...তা...ইয়ে, সে তো বললে। কিন্তু
জায়গাটার ঠিকঠাক লোকেশনটা... আচ্ছা, এই রাস্তাটার নাম কী যেন বললে?”
“আজ্ঞে, বাদশাহি সড়ক। তবে
এটি লোকমুখে প্রচলিত নাম। স্বয়ং ভারত সম্রাট এটির নামকরণ করিয়াছেন সড়ক-ই-আজম।”
“অ। বাবা! এই আজম না হজম, এ তো আমার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে,” বিপিনবাবু এবার নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন। তারপর
আবার সদানন্দকে প্রশ্ন করলেন, “ইয়ে, এর আশেপাশে কোনও গ্রাম-ট্রাম?...”
“দশ-বারো ক্রোশ উত্তরে শ্রীরামপুর গ্রাম পশ্চাতে ফেলিয়া
আসিয়াছি।”
“শ্রীরামপুর? মানে হুগলি জেলার শ্রীরামপুর? রিষড়া, কোন্নগরের পরে...”
“মহাশয়
অনুগ্রহ করিয়া বারংবার অপরিচিত স্থানের নাম করিয়া আমাকে বিব্রত করিবেন না। আমার
গন্তব্য সম্বন্ধে আপনি অবহিত আছেন। আপনার ইচ্ছা হইলে সঙ্গে আসিতে পারেন। অন্যথায়...”
সদানন্দ কথাটা শেষ না করলেও
বেশ বোঝা যাচ্ছে, সে
বিপিনবাবুর ওপরে চটেছে। সদানন্দকে আর না ঘাঁটিয়ে বিপিনবাবু এবার চুপচাপ হাঁটতে
লাগলেন। এইসময় রিমলি হঠাৎ ওঁর হাত ধরে টানতে লাগল। বিপিনবাবু
ঘুরে তাকাতেই রিমলি বলল, “ও দাদাই, এই জায়গাটায় তো ইন্টারেস্টিং কিছুই নেই। বাড়ি
চল এবার। আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
বাড়ির কথায় বিপিনবাবুর টনক নড়ল। সত্যিই
তো! এবার ফিরবেন কী করে? কী করে যে এখানে এলেন সেটাই তো এখনও বুঝে উঠতে পারলেন
না! রিমলির কথাটা সদানন্দেরও কানে
গেছে হয়তো। সে ঘুরে দাঁড়াল।
“আপনি
বৃদ্ধ হইয়াছেন। তবে বড়োই বেয়াক্কেলে মানুষ। এতটুকু শিশুকে সঙ্গে লইয়াছেন অথচ খাদ্যসামগ্রী কিছু
সঙ্গে না লইয়াই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন! মৌখিক আঁক কষা শিখাইলেই কি উহার ক্ষুধা নিবৃত্ত হইবে?” নিতান্ত সাদাসিধে দেখতে সদানন্দের কাছ থেকে পর পর কয়েকবার
এমন ধমক খেয়ে বিপিনবাবু একেবারে চুপসে গেলেন। মনে
মনে ভাবলেন, “ইক্কিরে! এ যে একেবারে বৃন্দার মেল ভার্সন! কথায় কথায় ধমকায়। আর
যত রাগ ঐ অঙ্কের ওপর?”
সদানন্দ ততক্ষণে রিমলিকে কাছে
টেনে নিয়েছে, “তুমি কি ফলাহার করিবে? আমার নিকট কিছু চিঁড়া, কদলি আর গুড় আছে।” কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে রিমলি ফ্যালফ্যাল করে
একবার তার দাদাই-এর
দিকে তাকাল। পরক্ষণেই তার চোখ গেছে সামনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দে লাফিয়ে
উঠল সে। “ঐ দেখ দাদাই, কতগুলো ঘোড়া! ঐগুলোই
কি তখন আমাদের ওভারটেক করে চলে এল দাদাই?”
রিমলির কথা শুনে সামনে তাকাতেই
নজর পড়ল রাস্তার ডান পাশে একটা একতলা সাদা পাকা বাড়ি। বাড়িটার
সামনে পথের উলটোদিকে চারটে ঘোড়া খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। রিমলি
এক ছুটে সেদিকে এগিয়ে গেল। এত কাছ থেকে কোনোদিন ঘোড়া দেখেনি সে। কলকাতায়, ময়দানের পাশ দিয়ে গাড়ি করে যেতে যেতে মাঝে মাঝে ভিক্টোরিয়ার
সামনে ঘোড়ার গাড়ি দেখেছে। তবে সেগুলো এমন চকচকে তেজি ঘোড়া নয়। রিমলি
ছুটে যেতেই সদানন্দ হাঁ হাঁ করে উঠল। “বালিকাটিকে শীঘ্র নিরস্ত করুন। নচেৎ
সর্বনাশ অনিবার্য,” বলে
সে নিজেই ছুটে যেতে গেল রিমলির কাছে। ততক্ষণে অবশ্য যা হবার হয়ে গেছে।
“হোশিয়ার!” বলেই এক সেপাহি এগিয়ে এল ঘোড়ার কাছে, “কে তুমি বদতমিজ লড়কি?”
“এই, আমাকে বত্তমিজ বলছ কেন গো? আমার নাম সমাদৃতা গাঙ্গুলি। তোমার নাম কী?”
রিমলি তার রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে উঠল। ততক্ষণে আরও দু’জন সেপাহি রাস্তায়
নেমে এসেছে। তাদেরই একজন প্রশ্ন করল, “এমন
আজিব কিসিমের পোশাক পরে কোথা থেকে আসছ? সঙ্গে কে আছে তোমার?” তৃতীয়
জনের এবার নজর পড়েছে এইদিকে। সে চেঁচিয়ে উঠল, “হেইও, খবরদার। ভাগবে
না একদম। আগে বড়োহ।” সদানন্দ দু’হাত বুকের কাছে জড়ো করে সামনে এগিয়ে গেল। তার
পা দুটো তালপাতার মতো তিরতির করে কাঁপছে। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে বিপিনবাবু
নিজের হাসি লুকোলেন। সেপাইটা চোখ কুঁচকে একবার দেখল। তারপর
আবার ধমকে উঠল, “কে তুমি? এই আজিব লড়কি আর বুডঢা-টাকে নিয়ে কোথায় চললে?”
সদানন্দ মিনমিন করে উত্তর দিল, “আজ্ঞে আমি সদানন্দ গড়গড়ে। নিবাস
শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম। সে স্থানেই ফিরিতেছিলাম। পথিমধ্যে
ইহাদের সহিত সাক্ষাৎ হইল...।”
“বিলকুল
ঝুট। আমরা আজই এত্তেলা পেয়েছি, দিঘড়া
গ্রাম থেকে একটা লড়কি গায়েব হয়ে গেছে। লড়কির দুর কা রিস্তেদার এক মামা আর তার তান্ত্রিক গুরুদেব
নাকি এ কাজ করেছে। আমার তো মনে হচ্ছে তুমিই সেই লোক। আর এই বুডঢা সেই গুরুদেব।”
আচমকা এমন একটা অদ্ভুত অভিযোগে
সদানন্দ কী বলবে ভেবে পেল না। বিপিনবাবুও রকমসকম দেখে হাঁ হয়ে গেছেন। সেই
সুযোগে সেপাইটা অন্য দু’জনকে বলল, “পাকড়াও
এদের। চল খাঁ সাহেবের কাছে আজ এদের পেশ করা যাক। জরুর
কিছু ইনাম মিলবে।” হা হা করে হাসতে হাসতে দু’জন সেপাই ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অন্য
জন গেল রিমলিকে ধরতে। চট করে সেপাইটার হাতের ফাঁক গলে সরাইখানার পেছনদিকে
ছুট লাগাল রিমলি। চেঁচিয়ে বলল, “দাদাই
শিগগির এস। দৌড়োও।” জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার আগে পেছন ফিরে সেপাইটাকে জিভ ভ্যাঙাতেও ভুলল না। বিপিনবাবুও
তিন লাফে রিমলির পেছনে এসে হাজির হলেন। ওঁর মতো একজন বয়স্ক মানুষকে এভাবে লাফিয়ে উঠে ছুটতে
দেখে সদানন্দ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সেপাইগুলোও থমকে গেছে। বিপিনবাবু
মনে মনে ভাবলেন, হুঁ হুঁ বাবা, পাকড়াও বললেই হল! বিপিন গাঙ্গুলিকে পাকড়ানো অতই সোজা?
কিছুটা দৌড়োনোর পরেই বেশ হাঁফ
ধরল বিপিনবাবুর। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে রিমলিকে ডাক দিলেন, “ও দিদি, দাঁড়া একটু। আর
তো ছুটতে পারছি না।” রিমলি দাঁড়িয়ে পড়ল। সেও একটু একটু হাঁপাচ্ছে। “ও দাদাই, ওরা যদি পেছনে ঘোড়া নিয়ে তাড়া
করে?”
“এই
জঙ্গলে? অবশ্য অবিশ্বাস করারও কিছু নেই। এসব
জায়গা ওদেরই তো চেনা। তাহলে কী করি বল তো দিদি?”
ভাবতে গিয়ে বিপিনবাবুর চোখ পড়ল সামনের বড়ো গাছটার দিকে। বিশাল
বড়ো বট গাছটার নিচে একটা ইয়া বড়ো কোটর।
“আয়
দিদি, আমরা বরং এর ভেতরে বসে একটু
রেস্ট নিয়ে নিই। ওরা যদি এদিকে আসেও আমাদের দেখতে পাবে না।” ওঁরা
দু’জনে ঐ কোটরটায় ঢুকে বসলেন। আর তারপর ক্লান্তিতেই বোধহয়, বিপিনবাবুর চোখে হঠাৎই একরাশ ঘুম নেমে এল।
“বাবা, ও বাবা, বাবাআআ...” চোখ খুলে বিপিনবাবু দেখলেন তাঁর
মুখের ওপর অর্ক ঝুঁকে পড়ে তাঁকে ডাকছে। ধড়মড় করে উঠে বসতেই বৃন্দার চেনা গলাটা কানে এল। “কতবার বলেছি, এসব
বুজরুকি বন্ধ করো। তা সে কথা কানে নিলে তো? ইস, কী অবস্থা করেছে মেয়েটার! ঘেমে নেয়ে একেবারে চান করে গেছে। এই মেশিনের পেছনে সারাদিন খুটুর
খুটুর করে করে নিজের চেহারাখানা তো যা বানিয়েছে! একেবারে সাক্ষাৎ কাকতাড়ুয়া। এখন মেয়েটার খাওয়া ঘুমের বারোটা না বাজালে আর চলছে
না ওঁর।” অন্য সময় হলে এই নিয়ে ঝগড়া লেগে যেত বৃন্দার সঙ্গে, কিন্তু এখন বিপিনবাবু চারদিক
দেখেশুনে ধাতস্থ হতে লাগলেন। রিমলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বেচারা
মুখ নিচু করে ঠাকুমার কাছে চুপচাপ বকুনি খাচ্ছে। তার
মানে কি এতক্ষণ তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন? নাকি, যা ঘটছিল সব সত্যি? টাইম মেশিনটা সত্যিই কি কাজ করছে? কাল দুপুরে আর একবার ভালো করে দেখতে হবে তো ব্যাপারটা।
ওদিকে বৃন্দা তখনও বকবক করে
চলেছে। “আমি বলে দিচ্ছি খোকা, ঐ মেশিন না ঘোড়ার ডিমের বাক্স, ওটা কালই বিদেয় করবি ঘর থেকে। আর এই মেয়েটাও হয়েছে তেমন। তখন
বললাম, স্নান করে নে। উনি
তা না করে দাদাই-এর
সঙ্গে এই বাক্সের গর্তে ঢুকে ঘুমোচ্ছেন।” অর্ক ওর মাকে বলল, “মা প্লিজ। বাবাকে আগে একটু সুস্থির হতে
দাও।” তারপর বিপিনবাবুর দিকে ফিরে বলল, “আর য়ু ওকে, বাবা?” বিপিনবাবু ঢক করে ঘাড় কাত করলেন। তারপর
বললেন, “শ্রী কোথায় রে?”
“এই
তো এখানে আমি। কী বলছ বাবা?” শ্রী
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বিপিনবাবুর সামনে এগিয়ে এল।
“আচ্ছা, শ্রী, তোমার সাবজেক্ট তো হিস্ট্রি। বল তো, সড়ক-ই-আজম কি শের শাহের তৈরি করা রাস্তা?”
“হ্যাঁ
বাবা। সড়ক-ই-আজম হল আজকের গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড। সংক্ষেপে জি টি রোড।"
"ওহ্, আচ্ছা," ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লেন বিপিনবাবু। তারপরেই
আবার জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, ঐ সময়ে টাকা..
না মানে... কারেন্সির নাম কী ছিল?"
"শের শাহ তো রুপিয়া নামে নতুন কারেন্সি বাজারে চালু করেছিলেন। এছাড়াও
মোহর আর দাম…"
শ্রী কথা শেষ করার আগেই বিপিনবাবু
উত্তেজিত হয়ে বললেন, "সেগুলো
সোনার, রুপোর আর তামার ছিল। তাই
না?" হতবাক শ্রীয়ের মুখ থেকে
তখন কথা সরছে না। সে কোনোরকমে মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, তাই।" বিপিনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, ঐ কয়েনগুলোর ওপর, ওগুলো কি কাগের ঠ্যাঙ, বকের ঠ্যাঙ লেখা ছিল বল তো?" শ্রী একটু আমতা আমতা করে বলল, "বাবা, তখন তো অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ
আরবি আর ফার্সি ছিল। তেমনই কোনও ভাষায় হয়তো কয়েনের ওপর... কিন্তু আপনি হঠাৎ হিস্ট্রির ব্যাপারে... না মানে, আপনার তো এ বিষয়ে কোনও ইন্টারেষ্ট দেখিনি কখনও!”
অবাক চোখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল বৃন্দা আর অর্ক। যথারীতি
বৃন্দাই মুখ খুলল, “যাব্বাবা
আজীবন তো অঙ্ক নিয়েই সব্বাইকে জ্বালিয়েছ। আবার এখন ইতিহাস নিয়ে পড়লে কেন? উফ্, এই লোকটা না, আমাকে
পাগওওল করে দেবে।” বিপিনবাবু শুধু মুচকি হাসলেন।
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment