গল্পের ম্যাজিক:: বোঝাপড়া - অনুষ্টুপ শেঠ


বোঝাপড়া
অনুষ্টুপ শেঠ
 
ঘুমটা ভাঙতেই চোখে আলো লাগল রিয়ার। ভ্রূ কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, যা ভেবেছে তাই। তার পড়ার টেবিলে কম ওয়াটের ল্যাম্পটা জ্বেলে মিলিপিসি ঘাড় গুঁজে পড়ছে। কত রাত কে জানে, এসির হাওয়ায় ঘর একদম হিম হয়ে আছে। নড়েচড়ে একটা বিরক্তির আওয়াজ করে মুখে। পিসি চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকায়, “কী রে মনা? জল খাবি?”
রিয়া শুধু হুঁবলে। পিসি উঠে গিয়ে জলের গ্লাস এনে দেয়।
তেষ্টা পেয়েছিল বটে। আধ-গ্লাস জল খেয়ে বাকিটা ফিরিয়ে দেয় পিসিকে রিয়া। তারপর শুয়ে পড়তে পড়তে বলে, “আলোটা নিভিয়ে দাও না, ঘুমোতে পারছি না!
মিলিপিসি খুব কাঁচুমাচু গলায় বলে, “আর-একটু রে সোনা, এই চ্যাপটারটা শেষ করে নিই প্লিজ। এক্ষুনি নিভিয়ে দেব, তুমি ওপাশ ফিরে শোও একটুক্ষণ।
মাথা ঝাঁকিয়ে উলটোদিক ফিরে শোয় রিয়া। উফ্, এ যে কী জ্বালা হয়েছে না!
দিব্যি ছিল রিয়া, মানে সৌমনা গোস্বামী, ক্লাস সিক্স বি, রোল নাম্বার ইলেভেন, হিরাডেল ডে স্কুল। ওদের অরণ্যবিহার বিল্ডিং থেকে হলুদ বাসে উঠলে পনেরো মিনিটে স্কুল, লাইন করে প্রেয়ার, তারপর সারাদিন ধরে ক্লাস, খেলা, লাইব্রেরি, মিউজিক, কম্পিউটার ক্লাস — আরও কত কী সেরে আবার বাসে ফেরা। তারপর স্নান করে খেয়েদেয়ে নিলেই ছুটি! তখন ও নিজের মনে ছবি আঁকে, পুতুল খেলে কিংবা কাগজ কেটে নকশা করে নিজের ঘরে বসে বসে। ট্যাবে গেমও খেলে প্রচুর, বলা বাহুল্য।
রিয়ার বাবা বা মা কেউই খুব বিরাট চাকরি করেন না। তবুও মুম্বইয়ের এমন প্রাইম জায়গায় ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে যে রিয়ার নিজস্ব একটা ঘর আছে, সেটা কি কম কথা? না, সৌরভ বা নয়না কেউই তাঁদের মেয়ের জন্য কিছু করতে কখনও পিছপা হননি। অত ভালো স্কুলটায় পড়ানোও কি সহজ ছিল নাকি!
কিন্তু গত একমাস ধরে রিয়ার সেই সাধের একার রাজত্বে ব্যাগড়া পড়েছে।
মিলিপিসি বাবার কেমন যেন কাজিন হয়। বাবাদের অরিজিনাল যে বাড়ি, বর্ধমানে, সেই বাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকে। একটা কী যেন চাকরির পরীক্ষার ফার্স্ট লেভেলে চান্স পেয়েছে, পরের লেভেলের পরীক্ষাটা এখানে, মানে মুম্বইতে। তাই তল্পিতল্পা নিয়ে এসে হাজির হয়েছে, এখানে থেকে, পড়াশুনো করে রেডি হয়ে পরীক্ষাটা দেবে।
রিয়ার বেডটা শুরু থেকেই ডাবল ছিল। আত্মীয়স্বজন এলে গেস্ট রুম হয়েই যেত। তাতে রিয়া অভ্যস্ত। কিন্তু এভাবে পুরো এক মাস ধরে কেউ সে বিছানার, সে ঘরের ভাগীদার হয়ে বসবে, এটা ওর কল্পনাতেও ছিল না।
আর মিলিপিসি এত বোরিং না! ভিতু ভিতু টাইপের। একে তো ওর সঙ্গে কিছু খেলতেই পারে না, কিছু এসব জানেই না তো খেলবে কী করে! রিয়া পোকেমন, ইউনিকর্ন বা পিজে মাস্ক নিয়ে কথা বলতে যায়, আর মিলিপিসি ড্যাবড্যাব করে খালি চেয়েই থাকে। বলে দিলেও মনে রাখতে পারে না কিচ্ছু! রিয়া বলেছিল বিকেলে খেলতে নামার সময়ে কাছের পার্কটায় বেড়িয়ে আসবে। ও বাবা, সেই যে দাদা বারণ করেছে তোমায় নিয়ে বড়ো রাস্তায় যেতে!বলে ঘাড় কাত করল, সে আর কিছুতেই সোজা করতে পারল না রিয়া। দেখতেই নরম-সরম। আসলে হেবি জিদ্দি আছে। তবে ওকে আইসক্রিম কিনে দেয়, চাইলেই। ওটুকুর জন্যই এখনো সহ্য করে যাচ্ছে রিয়া।
কিন্তু এই রাত জেগে পড়া, কী যে জ্বালাতন না এইটে! কত করে বারণ করে রিয়া, এমনকি ওর মাও কতবার বলেন, ‘এত রাত জাগিস কেন মিলি, দিনের বেলায় যতটা পারিস পড়ে নে না!পিসি শুনে খালি হাসে আর গোঁয়ারের মতো মাকে রান্নাঘরে বাসন মেজে দিতেই থাকে পড়তে না গিয়ে।
হুঁ, মাকে সত্যি খুব হেল্প করে পিসি। রান্নাঘরে যতক্ষণ মা থাকে, পিসিও ততক্ষণ। হাতে হাতে যা দরকার সব করে। আবার কনক-আন্টি কাজে না এলে ঘর ঝাড়ু-মোছাও নিজে থেকে করে দেয়। মা শুরুতে আপত্তি করত, ‘দিনের জন্য এসেছে মেয়েটা, এত কাজ করবে কেন?’ বলে। তা বাবা মাকে আড়ালে ডেকে বলেছিল, শুনে ফেলেছে রিয়া, ‘করছে করতে দাও। গাঁয়ের মেয়ে তো, ওদের খাটার অভ্যাস আছে। থাকছে, খাচ্ছে, নিজের মনে করে দুটো ঘরের কাজ না করতে দিলে ওরও প্রেস্টিজে লাগবে না
দূর! শোওয়ার নামই নেই, পিসি আবার ঘাড় ঝুঁকিয়ে বাহ্যজ্ঞানহীনের মতো বইখাতায় ডুবে গেছে দেখা যাচ্ছে।

স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা আলমারির পাশে ফেলেই বাইরের ঘরে এসে ধপাস করে বসে পড়ল রিয়া। আজ যা-তা হয়েছে ক্লাসে। কাউকে একটা বলার জন্য তর সইছিল না ওর। কিন্তু মায়ের ফিরতে এখনও আরও দু-ঘণ্টা দেরি।
মিলিপিসি আসার আগে অবধি এই সময়টা পাশের বাড়িতে যুক্তা-আন্টির ডে-কেয়ারে থাকত রিয়া। ভালো লাগত না, সত্যি বলতে কী। ছোটো ছোটো দুটো ঘরে একগাদা বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা। ডিসিপ্লিনের এদিক ওদিক হলেই কড়া বকুনি। আর সেই এক হয় ইডলি, নয় উপমা দিয়ে টিফিন। আন্টি মনে হয় আর কিছু রান্না করতেই জানে না!
সেইদিক দিয়ে পিসি এসে বেশ মজা হয়েছে। এই যে ও জামা-টামা না ছেড়েই আয়েশ করে বসেছে, এখন প্রথমে এক গ্লাস লেবু-চিনির জল আসবে। তারপর জামা ছেড়ে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে আসার পর ওর বাহারি স্টিলের প্লেটটা করে কিছু খাবার রোজ আলাদা আলাদা, ফুলকো লুচি-বেগুনভাজা, চিঁড়ের পোলাও, ডিমের পোচ, আম-কলা দিয়ে কর্নফ্লেক্সআরে, মিলিপিসি আসার আগে, টাটকা গরম রুটি আর আলু-পেঁয়াজ ভাজার মতো পাতি জিনিসও যে এত টেস্টি হয় খেতে, ও জানতই না।
নাহ্‌, ভেবে দেখল, মাকে ঘটনাটা না বলাই ভালো। রাগ করবে মনে হয় শুনলে। কিন্তু পিসিকে বলা যেতে পারে, পিসি অত খ্যাঁচম্যাচ করে না। তাই মিলিপিসি থালাটা নিয়ে আসতেই বড়ো এক চামচ চাউমিন মুখে পাঠিয়ে, এটা অবশ্য পিসি জুত করতে পারে না, কেমন যেন লেটকে যায় সব — বলতে শুরু করে দিল রিয়া।
আজ যা কান্ড হয়েছে না ক্লাসে! অঙ্কন একটা গেম নিয়ে এসেছিল বুঝলে, ব্যাগের মধ্যে। রিসেসে আমাদের বার করে দেখাচ্ছেরিসেসে ম্যামরা চলে যায় জানো তো। আমরা নিজেদের টিফিন খাই আর খেলা করি।
কীসের গেম রে? লুডোর মতো?”
উফ্‌, পিসিটা না! রিয়া একটু ঝাঁঝিয়েই ওঠে, “আরে ধ্যাত! লুডোকে আবার গেম বলে নাকি! ভিডিও গেম। ওই আমি যেমন ট্যাবে খেলি না, সেরকম। আলাদা ডিভাইস হয়, আনা যায়।
আচ্ছা আচ্ছা! এই! চাদরে খাবার ফেলিস না, এই নে কাগজটা তলায় রেখে খা।
সে সবে পাত্তা না দিয়ে রিয়া উৎসাহের সঙ্গে বলে চলে, “তো দেখছি সবাই হাতে নিয়ে নিয়ে, দিশা কী একটা বাটন টিপে ফেলেছে আর সাইলেন্ট মোড অফ হয়ে গিয়ে মিউজিক বাজতে শুরু হয়ে গেছে! অঙ্কন তক্ষুনি কেড়ে নিয়ে সেটা আবার অফ করেছিল, কিন্তু…”
খারাপ হয়ে গেল না তো?” পিসির চোখ গোল হয়ে গেছে। এত বুদ্ধু না!
না না। কিন্তু সরিতা-ম্যাম ঠিক তখন বাইরের করিডরে ছিল সে তো আমরা জানি না! শুনে ফেলেছে, আর সোজা ক্লাসে এসে চার্জ — কে কী নিয়ে এসেছ বার করো, কীসের মিউজিক শুনলাম!
পিসি ভেবুল হয়ে চেয়ে আছে দেখে দয়াপরবশ হয়ে রিয়া বুঝিয়ে দেয়, “স্কুলে আমাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইস কিছু আনা বারণ তো! ধরা পড়লে নিয়ে নেয়, গার্জেন কল হয়।
এ বাবা! তাহলে ওই অঙ্কন না কে বললি, এনেছিল কেন? অন্যায় করেছে তো! ওর গার্জেন কল হল তাহলে?”
রিয়া হই হই করে হেসে ওঠে।
তাহলে আর বলছি কী? ধরতে পারলে তো গার্জেন কল হবে! আমরা কী অত বোকা! কেউ কিছু বলল না দেখে ম্যাম এক এক করে সবার হাত আর ব্যাগ চেক করতে লাগল। আর অঙ্কন করল কী, টুক করে ওটা রাবিন্দরের ব্যাগে ফেলে দিয়ে নিজের ব্যাগ দেখাল, তারপর ম্যাম যখন কীর্তির ব্যাগ চেক করছেন তখন রাবিন্দর ওটা উমার ব্যাগে দিয়ে দিল, উমা আমার, আমি আবার অঙ্কনের ব্যাগে হাত পিছন করে লুকিয়ে লুকিয়ে। ব্যস! ম্যাম কিছুই পেল না, চলে গেল!
সে কী!বলে পিসি একদম চুপ হয়ে গেল কেমন যেন।
সাধে কী বলে, পিসিটা হেব্বি বোরিং!
কিন্তু তাই বলে রিয়া এটাও ভাবতে পারেনি যে পিসি ব্যাপারটা বাবা-মাকে বলে দেবে এমন করে।
দাদা, আমার তো খুব খারাপ লাগল শুনে, এইটুকু-টুকু বাচ্চারা টিচারকে বোকা বানানো নিয়ে গর্ব করছে, এ তো ঠিক হচ্ছে না গো! তোমরা একটু ভাবো স্কুলটা নিয়ে।
বেশ, কাজটা হয়তো ঠিক হয়নি ওদের, বাবা-মার রাগ করার মতোই হয়েছিল। কিন্তু পিসির মুখ থেকে শুনল বলেই হয়তো বাবা আর মা দুজনেই এত বেশি রেগে গেল। বাবা ওর ট্যাবটা নিয়ে নিজের আলমারিতে বন্ধ করে দিল, নেক্সট সাত দিনের জন্য বন্ধ। তার চেয়েও খারাপ, মা স্কুলে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়ে দিল। শুধুই অঙ্কন নয়, ওদের সবারই গার্জেন কল হয়ে গেল তার ফলে।
রিয়াও বুঝে নিল, ভালোমানুষ মুখ করে থাকা, বোকা বোকা কথা বলা পিসিটা আসলে ওর শত্রু। নির্ঘাত ওকে হিংসে করে, তাই ওর নামে লাগিয়ে বাবা-মার কাছে প্রিয় হচ্ছে।
এই যে একবার বুঝে গেল, তারপর থেকে আর কিছুই মুখে রুচতে চায় না ওর। বিকেলের মুচমুচে চিঁড়ে ভাজা না, নরম ফ্রেঞ্চ টোস্ট না, এমনকি পাশের সর্দারজির দোকান থেকে এনে দেওয়া ক্যাডবেরিও না। হাজার চেষ্টা করেও মিলিপিসি ওর সঙ্গে আর কথা বলার মতো জায়গায় আসতে পারল না, কোনোরকমে হুঁ-হাঁ করে কাটিয়ে দেয় রিয়া আজকাল। আর দিন গোনে, কতদিন বাদে এ যাবে, ফাইনালি।
অবশেষে পিসির পরীক্ষার সময়ও এসে গেল।
রাগে গা জ্বলে যেতে লাগল রিয়ার দেখে দেখে, বাবা অরেঞ্জ আর হরলিক্স নিয়ে আসছে আলাদা করে পিসির জন্য। মা রান্নাঘরের কাজ করতে দিচ্ছে না। যেন আর কেউ পরীক্ষা দেয় না!
ওর জন্যও মা-বাবা এমন করে? সেটা তো করবেই। ও ওদের মেয়ে, তাও ছোটো বাচ্চা। একজন বুড়ো ধাড়ির জন্য এত আদিখ্যেতা কীসের বাপু! কিন্তু একটা বোঝাপড়া করে নেওয়ার ইচ্ছে হলেও ও আর কী করবে!
এই শব্দগুলোও ও পিসির কথা শুনে শুনে শিখেছে। গাঁইয়াতো, এভাবেই কথা বলে।
রিয়া এক-একবার ভাবে, পিসির বইখাতা বা অ্যাডমিট কার্ডটা হাপিশ করে দেয়। বেশ হবে, পরদিন যখন যেতে গিয়ে খুঁজে না পাবে, কেমন জব্দ! কিন্তু তারপরেই মনে হয়, তাহলে তো পরীক্ষা শেষ হবে না, কে জানে ভাই, তাহলে হয়তো আরও এক মাস এখানে ঠাঁই গেড়ে বসে থাকবে!
দূর দূর! না, তার চেয়ে যা হোক করে আর কটা দিন কেটে গেলেই শান্তি!
কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারল না রিয়া।
পরদিন কীসের পরীক্ষা ছিল মনে নেই ওর, তবে পিসি যে সাবজেক্টটা খুব ভয় পায় সেটা বোঝা যাচ্ছিল। সন্ধেবেলা বাবা ওর সঙ্গে রোজের মতো না খেলে পিসিকে কী সব বোঝাতে বসল।
একা একা ট্যাবে বাবল শুট করতে করতে আড়চোখে রিয়া দেখল, মা শাড়ি ইস্ত্রি করে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখল। হ্যাঁ, পিসিটা হেব্বি ব্যাকডেটেড, কিছুতেই শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরতে চায় না। লোকাল ট্রেনে ওই নিয়ে যেতে হলে টের পেত নেহাত মা অফিস যাবার পথে নামিয়ে দিয়ে যায়, আর একা অটোয় চাপতে ভয় পায় বলে ফেরাটা নাকি হেঁটেই চলে আসে। পঁচিশ মিনিট হাঁটে, বাপ রে বাপ!
কিন্তু এসব মা-বাবার আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই নয়।
এই জমা রাগটা একদম আচমকা ফেটে বেরোল সেদিন রাত্রে। যথারীতি রিয়া খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেই ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু কী যেন একটা ওকে জাগিয়ে রাখল।
ওর ঘরের দরজা ঠেলে খুব নিঃসাড়ে মা ঢুকল, হাতে একটা বড়ো বাহারি কাপ। কাপটায় প্রচুর লাভ সাইনের মধ্যে একটা টুইটি আঁকা। ও নিজে পছন্দ করে, বায়না করে কিনেছিল নিজের জন্য যে বার শ্রেয়ার বার্থডে গিফট কিনতে ওই ম্যলটায় যাওয়া হয়েছিল। মা পিসির জন্য হরলিক্স বানিয়ে নিয়ে এসেছে, ওই কাপে করে!
গা কিষকিষ করছিল রিয়ার। ও যে চেয়ে আছে সেটা ওরা টের পায়নি।
কাপ টেবিলে রাখল মা। ধোঁয়া উঠছে।
তোমরা এত করছ আমার জন্য বৌদি...
পিসি চোখের জল মুছছে। কী যেন বলে উমা? বাহানা! আচ্ছে বননা!
মা পিসির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচু গলায় কী যেন বলল। ওর নিজের একজামের সময় মা ওকে হরলিক্স করে দিয়েছে এমন রাত্রে?
রিয়া ভুলে গেল, ও রাত জেগে পড়েওনি তো কখনও! তেমন বয়স হয়েছে নাকি ওদের! ভুলে গেল, মা একজামের দিন ওকে নিজে পৌঁছে দিয়ে তবে অফিস যায়, লেট মার্ক হবে জেনেও। ভুলে গেল, পিসি আসার আগে মা ঠিক এইভাবেই ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বুঝিয়েছিল, ‘গরিব মানুষ, বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে, আর কেউ নেই ওদের, চাকরিটা ওর খুব দরকার বাবু। পেয়ে গেলে বেঁচে যাবে পরিবারটা। কটা দিন তুই একটু অ্যাডজাস্ট করে নিস মা, মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকতে হয়।
সব ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রিয়া, “আমার কাপ কেন দিয়েছ মা? ওটা আমার কাপ! কেন দিয়েছ?”
দুজনেই আঁতকে উঠে ঘুরে তাকাল। পিসি একটা চুমুক দিয়েছিল কাপে, তড়িঘড়ি হাত থেকে নামিয়ে রাখল সেটা।
মা হতভম্ব হয়ে গেছে, “কী হল রিয়া? এমন করছ কেন? পিসি একটু খাচ্ছে, নিয়ে নিচ্ছে না তো! খেলই-বা?”
না, খাবে না। আমার কাপে খাবে, আমার ঘরে জিনিস নিয়ে থাকবে, রাত অবধি আমার ঘুম নষ্ট করে আলো জ্বেলে জ্বেলে পড়বে! কী, ভেবেছ কী তোমরা? এবার আমায় তাড়িয়ে দিয়ে পিসিকেই নিয়ে থাকো তাহলে!
নিজের গলাটা নিজেও চিনতে পারছিল না রিয়া। এত রাগ!
মায়ের মুখ পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল। পিসি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল, “তুমি রাগ কোরো না রিয়া, আমি তোমার কাপে খাব না আর একদম, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।
কাপটা নিয়ে পিসি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, মা কেমন কাতর গলায় ডাকল, “মিলি!
পিসি ঘুরে তাকাল, ফ্যাকাশে হাসল একটু, “ফেলে দেব না বৌদি। তোমাদের কষ্টে আনা, তুমি নিজে হাতে বানিয়ে দিলে, তায় খাবার জিনিস! আমি গ্লাসে ঢেলে নিয়ে ওর কাপ ধুয়ে রাখছি। তুমি যাও, শুয়ে পড়ো।একটু থেমে আবার বলল, “রিয়াকে বোকো না গো। সত্যিই তো, ছোটো বাচ্চা, ওর বড্ড কষ্ট হচ্ছে
পিসির চোখ ছলছল করছে।
মা চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রিয়ার দিকে আর তাকালও না। কী ভীষণ তেতো মুখে ঘুমিয়ে পড়ল রিয়া।
পরদিনের একজাম পিসির মনে হয় ভালো হয়নি বাবাকে বলছিল, বেশ কিছু ভুল হয়ে গেছে। বাবা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ল বার বার করে বলল পরদিন যে লাস্ট পেপারটা আছে সেটা যেন খুব মন দিয়ে দেয়। পিসি শাড়ির আঁচল হাতে জড়াতে জড়াতে আস্তে করে বলল, “দাদা, বলছি কী, রাত্রে পুরোটা রিভাইজ দেব একবার ভাবছি। আজ বাইরের ঘরে বইখাতা নিয়ে বসি, জানো। এমনিও ঘুম হবে না, নেহাত পেলে ওই মাদুরটা বিছিয়ে শুয়ে নেব একটু।
বাবা কালকের ঘটনা সবটাই শুনেছিল মায়ের কাছে। খুব ঠান্ডা গলায়, “সেটার কোনো দরকার নেই, যেমন রিয়ার ঘরে টেবিলে বসে পড়িস তাই পড়বিবলে এক ধমক দিয়ে উঠে গেল।
মা-বাবা-পিসি কেউই সে ভাবে আর কথা বলল না সারা সন্ধ্যা। কোথায় যেন একটা পাঁচিল উঠে গেছে ওদের সবার মধ্যে।
সে রাত্রেও রিয়ার ঘুম ভাঙল মোটামুটি ওই সময়েই। একটুক্ষণ চুপ করে দেখল। তারপর নিঃশব্দে, কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়ে উঠে গেল ঘরের বাইরে।
পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে মিলি মাথাটা নামিয়ে ছিল বইয়ের উপর। গাল বেয়ে গরম জলের ছোঁয়া লাগছিল ওর হাতে। মনটা এত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, কালকের পরীক্ষাটাও খারাপ হবে ও এখন থেকেই বুঝতে পারছিল। চেষ্টা করেও রিয়ার কালকের কথাগুলো মন থেকে যাচ্ছিল না ওর। উপায় থাকলে কি আর এভাবে অন্যের বাড়িতে, অন্যের উপর এত অসুবিধা করত ও!
ঠক করে একটা আওয়াজ হল। মাথায় একটা হাত এসে পড়ল তারপর।
বৌদি? আবার?
না, রিয়া।
খেয়ে নাও পিসি। অ-নে-ক মিষ্টি দিয়েছি।
সামনে, টেবিলে সেই টুইটি কাপে এক কাপ হরলিক্স রাখা।
রিয়ার দিকে বেকুব হয়ে চেয়ে থাকে মিলি। রিয়া কুঁকড়ে যায় একটু।
আমি যেমন পারি বানিয়েছি, ওক্কে? মাইক্রোওয়েভ চালাতে জানি তো এখন! কতটা দেয় জানি না তাই আন্দাজে... খাবে তো?”
দু-হাত বাড়িয়ে রিয়াকে বুকে আঁকড়ে নেয় মিলি। এখানে আসার পর এই প্রথম, নিঃসঙ্কোচে। জাপটে ধরে রিয়ার গায়ের পুতুল পুতুল গন্ধটা বুক ভরে টেনে নিতে নিতে বলে, “তুই বানিয়ে দিয়েছিস, আমি খাব না? কী যে বলিস! ও তো পৃথিবীর সেরা হরলিক্স হয়েছে রে!
আরও খানিকটা আদর খেয়ে, পিসিকে কালকের একজামের জন্য বেস্ট অফ লাক বলে ঘুমিয়ে পড়ে রিয়া।
ঠান্ডা হয়ে আসা, কিটকিটে মিষ্টি, নিচে পুরোটা না গোলা হরলিক্সের ডেলা লেগে থাকা কাপটা দু-হাতে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে আয়েশের একটা চুমুক দেয় মিলি। ও নিশ্চিত, কালকের পরীক্ষাটা ওর ফাটাফাটি হবে। হবেই!
_____
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল

4 comments: