শেষ
প্রতিশ্রুতি
রাজীবকুমার সাহা
* * *
* * *
* * *
_____
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত
রাজীবকুমার সাহা
“কই, চা-টা দাও তাড়াতাড়ি। বেলা
হয়ে যাচ্ছে যে! কাগজটা
আবার রাখলে কোথায়? দিয়ে
গেছে তো?”
গলা তুলিতেই ফটক
ঠেলিবার শব্দে সেইদিকে চোখ পড়িল মৃণালের। যতীন
আর দিগন্ত। যতীন ফটক হইতে যেন উড়িয়া আসিয়া
দরজার গোড়ায় ল্যান্ড করিয়া হাঁক পাড়িল, “বউঠান, আরো দুই কাপ।”
তারপর সোফায় শরীর
এলাইয়া দিয়া আলতো চোখ টিপিয়া জানাইল, “পাওয়া গেছে, বুঝলি? এইবারে মিস হইব না। সাইক্ষাৎ...”
মৃণালের চোখ দুটি
মুহূর্তের জন্য চকচক করিয়া উঠিয়াই ম্লান হইয়া পড়িল ফের। ভাবাবেগ
গোপন রাখিয়া বিরস মুখে বলিল, “আবার! এই তো ক’দিন আগেই এমন অখাদ্য এক জায়গায় নিয়ে গেলি যে...”
“আরে না না, ধুর, কীসের লগে কী। এইবারে
এক্কেরে খাঁটি আস্তানা। একরাইত কাটান যায় মতন জিনিসপত্র
একটা ব্যাগে গুছাইয়া ল ত দ্যাখি চটপট। হাতে
বিশেষ সময় নাই। দুইটার আগেই শিয়ালদা পৌঁইছা
যাইতে হইব।”
মৃণালের স্ত্রী
রত্না ট্রে-ভর্তি
লুচি আর ছোলার ডাল লইয়া উপস্থিত হইতেই তিন বন্ধু চোখমুখ স্বাভাবিক করিয়া ফেলিল।
রত্না হাসিয়া, “চা আসছে,” বলিয়া প্রস্থান করিতেই পুনরায় অস্থির হইয়া উঠিল মৃণাল।
হাত নাড়িয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিল,
“এভাবে হুট করে হয় নাকি?
অ্যাঁ? আপিস-কাছারি...”
যতীন পা নাচাইতে
নাচাইতে নিঃস্পৃহ জবাব দেয়, “ছুটির ব্যবস্থা কর! এর লেইগাই ত শনিবার দেইখা বাছলাম দিনটা। কাল
দুপরের মইধ্যে আবার যে যার বাড়িতে।”
“আর
রত্না?”
“সে তো শেয়ালদা যেতেই পড়বে তোর শ্বশুরবাড়ি।
পরীক্ষিত রায় লেন না?”
মুচকি হাসিয়া পথ দেখাইয়া দিল দিগন্ত।
না, শিয়ালদহ স্টেশনে তাহারা যায়
নাই। রত্নাকে দুপুরের মধ্যেই বাপের
বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া মজিলপুরে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে রাত্রি কাটাইবে বলিয়া স্তোক দিয়া
মৃণাল নিজের গাড়িতেই দুই বন্ধুকে তুলিয়া লইল। মাস
খানেকও অতিক্রান্ত হয় নাই সে একখানি সেকেন্ড হ্যান্ড মোটর কিনিয়াছে।
অ্যাডভেঞ্চার যেহেতু একটি হইতেছেই,
তবে তাহার ভরপুর আনন্দ লইবার উদ্দেশ্যে মৃণাল ট্রেন বাতিল করিয়া
নিজস্ব মোটরগাড়ির প্রস্তাব রাখিয়াছিল সকালেই। এই
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিবার মতো গোঁয়ার যতীন আর দিগন্ত নহে। ইহারা
গোঁয়ার্তুমির পরিচয় দেয় অন্যত্র। কোথায়
কোন পোড়োবাড়ি রহিয়াছে, কোন
শ্মশানে রাত কাটাইলে তেনাদের সাক্ষাৎ পাইবার সুযোগ বিলক্ষণ ー এইসব
শুধু চষিয়া বেড়ায়। যুক্তিসঙ্গত কারণও একখানি রহিয়াছে
বটে। যতীন তেনাদের উপর গবেষণা করিয়া
একখানি বই লিখিতে চায়। রীতিমতো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ।
কাজ অনেকটা আগাইয়াও গিয়াছে বটে। তবে
চতুর্দিকে নানানরকম পরোক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে পারিলেও তেনাদের সাক্ষাৎ দর্শনে অদ্যাবধি
সফল হইতে পারে নাই বেচারা। বইয়ের
পাণ্ডুলিপিও সেই কারণে অপূর্ণই রহিয়া গিয়াছে। বাধাপ্রাপ্ত
হইয়া দিনে দিনে যতীন যেন আরো বেশি ক্ষিপ্র হইয়া উঠিতেছে। কানে
হদিশ পৌঁছিবামাত্র আদাড়বাদাড়ে দুই বন্ধুকে বগলে চাপিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে।
তাহার রোজগার অল্প। প্রয়োজনও
সামান্য। দেশে বৃদ্ধা মা রহিয়াছেন।
সে ছেলে পড়াইয়া নিজের যৎসামান্য খাইখরচ মিটাইয়া যাহা অবশিষ্ট থাকে
মাকে পাঠাইয়া দেয়।
দিগন্ত বড়োলোকের
হুজুগে সন্তান। অবিবাহিত।
বাপের তেজারতি ব্যাবসায় সামান্য হাজিরা দেওয়া ব্যতীত দিনভর তেমন
কিছু কাজকর্ম থাকে না। তবে মনটি বড়োই সরল।
বাড়ির পোলাও কালিয়া অগ্রাহ্য করিয়া কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ আর সামান্য হলুদবাটা
ধোঁয়া উঠা গরম ভাতে মাখিয়া তৃপ্তি ভরিয়া খাইয়া যতীনের সহিত এক শয্যায় কত রাত্রি যে
সে কাটাইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। যতীনের
এই অদ্ভুত অন্বেষণে সর্বক্ষণের সঙ্গী সে। বাঙ্গালাদেশের
হরেকরকম ‘হন্টেড
হাউস’-এর
যাবতীয় খোঁজখবর দিগন্তই আনিয়া যতীনকে সরবরাহ করে। প্রত্যেকবারই
বন্ধুর পিঠ চাপড়াইয়া জোর গলায় বলে, “এবারে আমি তোকে ভূত দেখিয়েই ছাড়ব,
দেখে নিস যতে।”
মৃণালের মাস চারি
পূর্বে একখানি বিবাহ ঘটিয়া গেলেও অশরীরীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বিন্দুমাত্র স্তিমিত হয়
নাই এখনও। সওদাগরি আপিসে মালবাবু সে।
রত্নাকে ফাঁকি দিয়া যখন তখন যতীন আর দিগন্তের আহ্বানে সাড়া দিতে
গিয়া উপরওয়ালাকে বশে আনিতে বেশ বেগ পাইতে হয় তাহাকে।
যাহাই হউক, কলিকাতার কোলাহল হইতে মুক্তি
পাইতেই গাড়ি পূর্ণ উল্লাসে ছুটিতে আরম্ভ করিল। যতীন
একখানি পঞ্জিকা বাহির করিয়া কোলের উপরে মেলিয়া ধরিয়াছে। উল্লসিত
হইয়া বলিল, “আইজ
মিশন কিছুতেই ফেইল করব না, দেইখা নিস তোরা।”
পাশে বসা দিগন্ত
ঘাড় ফিরাইয়া চাহিতেই যতীন বিজ্ঞের মতো ব্যাখ্যা করিল,
“একে শনিবার বারবেলা, তায় অমাবস্যা। দক্ষিণে
যাত্রাও নিষিদ্ধ। এহ্, রাজযোটক এক্কেরে।
আইজ কিছু একটা...”
ব্যাখ্যা শেষ হইল
না। আচম্বিতে নিদারুণ এক ঝাঁকুনি
খাইয়া মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। মৃণাল
সজোরে ব্রেক কষিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে হঠাৎ। উইন্ড
স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলিতেই চোখে পড়িল একখানি মিশমিশে কৃষ্ণকায় বিড়াল রাস্তা পারাপার করিতেছে।
যতীন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেও দিগন্ত আর মৃণালের মুখে আশঙ্কার
কালো ছায়া পড়িল ঠিক।
সোনারপুর জংশন
পার হইতে দেরি, আচমকা
আকাশ কালো করিয়া চতুর্দিক অন্ধকার হইয়া উঠিল। বৈশাখ
মাস। অল্পক্ষণের মধ্যেই উন্মত্ত
বাতাসের সহিত বড়ো বড়ো ফোঁটায় চড় চড় করিয়া নামিল অঝোরে বৃষ্টি। যতীন
মনের আনন্দে গান ধরিল। সন্ধ্যা ঘনাইতেও আর অধিক বিলম্ব
নাই।
প্রায় আধা ঘণ্টা
তিনজনকে মোটরের ভিতরে আবদ্ধ রাখিয়া কালবৈশাখী যেমনটি আসিয়াছিল তেমনটি চলিয়াও গেল।
পথে রাখিয়া গেল শুধু থৈ থৈ জল। মৃণালের
মোটর সেই জলরাশির বুক চিরিয়া আগাইয়া যাইতে বেশ ক্লেশবোধ করিতেছিল।
মাইল তিনেক যাওয়ার
পর এক নির্জন স্থানে একখানি চায়ের গুমটি নজরে আসিতেই মৃণাল মোটর দাঁড় করাইয়া ফেলিল।
বলিল, “চ’, চা খেয়ে নেয়া যাক একটুখানি। অ্যাই
যতে, বাড়িটা
আর কতদূর রে?”
আমন্ত্রণের প্রয়োজন
ছিল না। চায়ের তৃষ্ণা যতীনেরও যথেষ্টই
পাইয়াছিল। যতীন নামিতে নামিতে উত্তর করিল, “আমি কী জানি? সন্ধান তো দিগুর কাছে।
আরও মাইল পাঁচেক না হইয়া যায় না বোধ হয়। কী
রে, দিগু?”
দিগন্ত উত্তর করিল, “সে তো হবেই।
আর একটু এগোলেই রাস্তা পাওয়া যাবে।”
দিগন্ত মোটর হইতে
নামিল না। চোখে হাতচাপা দিয়া সিটে মাথা
ফেলিয়া রাখিল। তাহার চায়ের নেশা নাই।
পথের ধারে ছিঁড়াখোঁড়া
একটুকরা পলিথিনের ছাউনির তলায় টিমটিমে কুপিবাতি জ্বালাইয়া চিমসেমতো একটি লোক চা বেচিতেছিল।
একপায়া ভাঙা একখানি টেবিলের উপর দুই-চারিটি ঘষা কাচের বয়ামে লজেন্স,
বিস্কুট এইসব রহিয়াছে দেখা যাইতেছে। দুইদিকে
দুই গাছের গুঁড়ির উপর কাঠের তক্তা ফেলিয়া বসিবার জায়গা করা হইয়াছে।
তাহাতে বসিয়া জনাকয়েক চা অনুরাগীর মধ্যে গালগল্প চলিতেছে।
মৃণাল বিস্কুট সহযোগে দুই কাপ চা বলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, মণি হালদারের বাগানবাড়িটা কতদূর
বলতে পারেন?”
বৃদ্ধ চাওয়ালা
ঘোলা চোখে একবার মুখের পানে চাহিয়াই চোখ নামাইয়া ফেলিল। তাড়াতাড়ি
বলিল, “আমি
জানি না বাবু। আমি জানি না।”
শহুরে বাবুর প্রশ্নে
অন্যান্য চা পিয়াসিদের আলোচনা থামিয়া গিয়াছিল। একজন
চোখ গোল গোল করিয়া বলিল, “কী নাম বললেন বাবু? মণি হালদার? এ-ঠিকানা আপনারা কোত্থেকে পেলেন?”
যতীন উত্তর করিল, “একজন বন্ধু দিছে।
রাইতটা ওইহানেই কাটামু ঠিক করছি। ক্যান?”
“সব্বোনাশ হয়ে যাবে বাবু। ও-বাড়ি সাংঘাতিক অভিশপ্ত।
তিন পুরুষ ধরে খালি পড়ে আছে। সবাই
জানে, ওই
বাড়িতে কারও পা পড়ুক তেনারা সেটা ভালো চোখে দেখেন না। ওটি
করবেন না, দোহাই
আপনাদের।”
মৃণালেরা কিছু
জবাব দিবার পূর্বেই ষণ্ডাগোছের একজন উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,
“এ হতে পারে না। এর
আগেও এমন দু-চারজন
এসেছিল ও-বাড়িতে
রাত কাটাবে বলে। আমরা বাধা দিয়েছি।
কিছু একটা হয়ে গেলে এ-গাঁয়েরই বদনাম শেষে। তাছাড়া
থানাপুলিশ, সে
এক মহাবিপদ। না না, আপনারা চা-টা খেয়ে ফিরে যান।
ও-বাড়িতে যাওয়া চলবে না।”
দুই বন্ধু পরস্পর
মুখ চাওয়াচাওয়ি করিয়া নিঃশব্দে মোটরে ফিরিয়া গেল। দিগন্ত
ফিসফিস করিয়া জানাইল, “খানিকটা
পিছিয়ে চল। একটা পায়ে হাঁটা শর্টকাট রাস্তা
আছে শুনেছি। দেখা যাক।
আপাতত ওই ষণ্ডাটাকে সামলে চল।”
মৃণাল জানালার শার্সি নামাইয়া
জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, কাছেপিঠে কোনো সরাইখানা বা রাতে থাকা যাবে এমন কিছু
আপনাদের সন্ধানে আছে?”
উত্তর আসিল, “মাইল তিনেক পিছিয়ে যান।
একটা বাজার পড়বে। গগন
সরকারের মুদিখানার আটচালায় রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবেন আশা করি।”
কিন্তু চাবি ঘুরাইতেই
মোটরখানি ঘড়াৎ করিয়া একবার চালু হইয়াই বন্ধ হইয়া গেল। ছয়-সাতবারের চেষ্টায়ও মৃণাল আর
তাহা সচল করিতে পারিল না। সামনের সিট হইতে ঘাড় ঘুরাইয়া
বন্ধুদের পানে হতাশ দৃষ্টি ফেলিতেই যতীন উষ্মা প্রকাশ করিল, “এ ত মহাজ্বালা দেখতাছি।
আৎকা কইরা বাদলা, তারপরে লোকজন’গ বাধা আর অহন বাহনই বিগড়াইয়া গেছে গিয়া। এহানে
বইসাই রাইত কাটাইতে হইব নাকি? পেট্রোল লইছিলি তো মিনাল?”
মৃণাল কটমট করিয়া
চাহিতেই যতীন তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আহা, রাগ করে দ্যাখো। তোর
ট্যাঙ্কি সবসময় ফুল থাকে জানি, তবুও ভুল-টুল কইরা... ভুল ত হইতেই পারে, নাকি?”
“আরে ওটা ওয়্যারিংয়ে গণ্ডগোল। কারেন্ট
পাচ্ছে না। জল ঢুকে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে
নিশ্চিত।” দিগন্ত সিটে গা এলাইয়া দিয়া
জানাইল।
“অ্যাঁ?”
“হুম। এখন ওই এগারো নম্বর গাড়িই ভরসা।
চল চল, গাড়িটা ভালো করে লক করে নে মৃণাল। যাবি
তো সে বাগানবাড়িতে?”
দিগন্তকে সামনে
রাখিয়া দুই বন্ধু পিছন পিছন চলিতে আরম্ভ করিল। আকাশে
একটিও তারা ফুটে নাই। তিন বন্ধু কেহই কাহারও মুখ
দেখিতে পাইতেছে না। শুধু নিজেদের মধ্যে অনুচ্চ
স্বরে কথাবার্তার মাধ্যমে সংযোগ রক্ষা হইতেছে। চারিদিকে
এমনই ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। মাঝে
মাঝে গাছের মাথায় পাখপাখালির ডানা ঝাপটাইবার শব্দ আর একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া অন্য
কোনো শব্দ নাই। জল আর পাঁক বাঁচাইয়া ধীরে ধীরে
হাঁটিতে হইতেছে অজানা পথে। পিচের
রাস্তা হইতে নামিয়া জঙ্গলের ভিতর দিয়া একটা আবছা পথরেখা নিশানা করিয়া হাঁটিয়া চলিল
তিনজন। এরই মধ্যে আবার গুঁড়ি গুঁড়ি
বৃষ্টি শুরু হইয়া গিয়াছে। আসিবার পথে দিয়াশলাই, মোমবাতি, টর্চ, জল আর কিছু পরিমাণ শুকনো খাবার
সবই গুছাইয়া আনিয়াছে তাহারা। কিন্তু
এই ঋতুতে মাথা বাঁচাইবার নিমিত্ত যাহা সবচাইতে প্রয়োজন তাহাই ফেলিয়া আসিয়াছে।
যতীন আর মৃণালের ধুতি-জামা ভিজিয়া সপ সপ শব্দ তুলিতেছে। দিগন্তের
অবশ্য প্যান্টুলুন পরিবার অভ্যাস। তাহার
বিশেষ অসুবিধা হইতেছে বলিয়া বোধ হইতেছে না।
সকলের শেষে হাঁটিতেছিল
মৃণাল। হঠাৎ ‘আঁক আঁক’ শব্দ করিয়া ধড়াস করিয়া পড়িয়া
গিয়া দুই পাক গড়াগড়ি খাইয়াই উঠিয়া দাঁড়াইল ফের। বিস্ফারিত
চোখ দুইটার দিকে টর্চ মারিয়া আঁতকাইয়া উঠিল যতীন। দিগন্ত
বলিল, “কী
রে, ওভাবে
পড়ে গেলি কীভাবে?”
মৃণাল থর থর করিয়া
কাঁপিতেছে। কোনোপ্রকারে বলিল, “আ-আমি পড়িনি, কে যেন পিঠে অমন বেমক্কা এক ধাক্কা মারল যে...”
“ধাক্কা! তরে খামখা ধাক্কা মারব ক্যাডায়?
আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ তো নাই। কী
রে, দিগু?”
দিগন্ত তাড়াতাড়ি বলিল, “আরে, ধাক্কা মারবে কে? অ্যাই
মৃণাল, কী বলছিস ওসব আজেবাজে কথা?”
“আমি পষ্ট টের পেলুম! মিছে কথা কইছি নাকি?” ঝাঁঝাইয়া উঠিল মৃণাল।
“আচ্ছা বাবা, চল এখন। এখানে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভিজলে নিমোনিয়া ধরবে নির্ঘাত। চল।”
একদলা পাঁক প্রলেপিত
পাম্প শু দুইখানি হাতে ঝুলাইয়া দলের মাঝে আসিয়া ঢুকিল মৃণাল।
আরও ঘণ্টাখানেক
এইভাবে হাঁটিবার পর ধীরে ধীরে জঙ্গল পাতলা হইতে শুরু করিল। তাড়াতাড়ি
দুই পা আগাইয়া গিয়া দিগন্ত আচমকা হাঁক দিল,
“যতে, টর্চটা মার তো একবার সামনের গাছটার মাথায়।
সেই গাছটাই মনে হচ্ছে যেন।”
যতীনের টর্চের
আলো অনুসরণ করিয়া দিগন্ত উৎফুল্ল হইয়া বলিল,
“হ্যাঁ, একদম ঠিক জায়গায় এসে পড়েছি। আর
খানিকটা এগিয়ে গেলেই বাড়িটা পড়বে। ওই
যে অশ্বত্থগাছটা দেখা যাচ্ছে। এটাই
ল্যান্ডমার্ক বলতে পারিস।”
দিগন্তের এই মন্তব্যে
তিনজনেরই শিথিল হইয়া আসা পায়ের পেশিগুলিতে পুনরায় শক্তির সঞ্চরণ ঘটিল।
মাটিতে চোখ রাখিয়া অশ্বত্থের শিকড়বাকড় বাঁচাইয়া পার হইবার উদ্যোগ
করিতেই ধুপ করিয়া কী যেন একটা মাটিতে পড়িল। হঠাৎ
এই অভাবনীয় ঘটনায় তিনজনেই সহসা আতঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছে। যতীনের
এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে টর্চ। কোনোক্রমে
টর্চের বোতাম খুঁজিয়া লইয়া সামনের দিকে আলো ফেলিল। কিন্তু
এইবার আওয়াজটা আসিল পিছনের দিক হইতে।
“কর্তারা কারা? ঝড়-বাদলা মাথায় নিয়ে এত রাতে এ-জঙ্গলে? কী মনে করে?” গমগমে আওয়াজের একটা বঙ্কিম সুর কর্ণগোচর হইল সহসা।
যতীন ভ্যাবাচ্যাকা
খাইয়া গলার স্বর অনুসরণ করিয়া আলো ফেলিল। ঘন
জঙ্গল ব্যতীত আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না।
মুহূর্তকাল মাত্র
সময়। এইবার গাছের ঘন ডালপালার আড়াল
হইতে কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল ফের। “ভূত-পেরেত দেখতে চান বুঝি? এসব ও-বাড়িতে কোথায় পাবেন? থাকি তো আমরা।
লাশ অবশ্য একটা পড়ে আছে হাসপাতালের মর্গে।
অপমৃত্যু। চাইলে
গিয়ে দেখে আসতে পারেন।”
মৃণাল খানিকটা সাহস যোগাইয়া
জিজ্ঞাসা করিল, “অ-অপমৃত্যু কীরকম?”
উত্তর আসিল, “লোকটা কোথাকার কেউ জানে না।
পকেটমারকে ধাওয়া করতে গিয়ে হঠাৎ লরির নিচে এসে পড়েছিল।
আজ দু’দিন হল। কেউ
খোঁজ করেনি এ যাবৎ। পড়ে আছে লাশঘরে।”
দিগন্ত এতক্ষণ
নিশ্চল দাঁড়াইয়া ছিল। শরীর খানিকটা সহজ হইয়া আসিতেই
দুই হাতে আচমকা মৃণাল আর যতীনের দুটি হাত খামচাইয়া ধরিয়া হ্যাঁচকা টান মারিয়া দৌড়াইতে
শুরু করিল। থামিল সোজা একখানি জরাজীর্ণ
ফটক ধাক্কা মারিয়া আঙিনায় পড়িয়া গিয়া। নির্জন
এই জঙ্গলে পিছনে তখনও আকাশ হইতে যেন একটা অট্টহাস্য আসিয়া কানে প্রবেশ করিতেছিল।
এই সেই ঈপ্সিত
মণি হালদারের বাগানবাড়ি! যে বাড়িতে ভূতপ্রেতের নিশ্চিত দর্শন পাইবার আশায় কলিকাতা হইতে
রওনা হইয়াছিল তিন বন্ধু। যতীনের চোখের ভাষায় নীরব প্রশ্নের
উদ্রেক হইতেই দিগন্ত একখানি রহস্যের হাসি হাসিল। ভাঙা
দরজা একটা খোলাই ছিল। তিনজনেই হুড়মুড় করিয়া ঢুকিয়া
পড়িয়া হাঁফ ছাড়িতে না ছাড়িতেই কয়খানি প্যাঁচা কি বাদুড় যেন সত্রাসে ঘরের বায়ু আন্দোলিত
করিয়া বাহির হইয়া গেল। নেতাইয়া পড়া দিয়াশলাই ঠুকিয়া
চেষ্টা করিয়া মোমবাতি জ্বালাইতেই পরিবেশটা খানিক হালকা বোধ হইল।
একে একে বোতল হইতে জল গলায় ঢালিয়া নার্ভ কিছুটা শান্ত হইল সকলের।
যতীন মুখ খুলিল, “দারুণ জায়গায় আনছস ভাই দিগু এইবার। তিনজনে
মিললা এত এত জায়গায় ঘুরলাম, আইজ অব্দি এমন ডর পাই নাই,
ক!”
মৃণাল নোংরা মেঝেতে
তখন একখানি শতরঞ্জি পাতিতেছিল। ব্যগ্রস্বরে
বলিল, “কই, খাবারদাবারগুলো বের কর এবারে! পেট চুঁইচুঁই করছে যে! তাড়াতাড়ি কর।
খাবি কখন আর?”
মিষ্টান্ন সহযোগে
পাঁউরুটিতে মনোযোগ রাখিয়া যতীন সাবধান করিল,
“রাইতে কিন্তু একজন কইরা জাইগা পাহারা দিতে হইব।
দুই ঘণ্টা কইরা পালা। কী, রাজি ত? অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই ডাইকা
দিব বাকি দুইজনেরে। আইজ হে’গ আমি দেইখাই ছাড়ুম।
রাইতে একবার না একবার হেরা আইবই,
দিগু খবর লইছে। না
রে, দিগু?”
রাত তখন ঠিক কতটা
সঠিক জানা নাই। কীসের এক খোঁচা খাইয়া যতীন ‘ভূত, ভূত, ও মা গো, ও বাবা গো, মাইরা ফালাইল গো’ বলিয়া আর্তনাদ করিয়া উঠিতেই
মৃণালের গাঢ় ঘুম কাঁচিয়া গেল। ইহাদের
মুখে ততক্ষণে খান তিনেক জোরালো টর্চের আলো আসিয়া পড়িয়াছে। চারিদিকে
কিছুই দেখা যাইতেছে না। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন আসিল, “কারা তোমরা? এখানে কী করছ?”
“আ-আপনেরা? আপনেরা কি তেনারা?” কোনোক্রমে একটি চিঁ চিঁ শব্দ বাহির হইয়া আসিল যতীনের গলা হইতে।
“থামো। কারা
তোমরা? আছ
ক’জন?”
“আমরা তিনজন। কলকাতা
থেকে আসছি। যাচ্ছিলাম মজিলপুরে।
গাড়িটা হঠাৎ বিগড়ে গেল। তারপর
ভুল করে পথ হারিয়ে...” মৃণাল কিন্তু কিন্তু করিতে লাগিল।
“ও, আচ্ছা। বড়ো
রাস্তায় পড়ে থাকা গাড়িটা তবে তোমাদের?” রুল হাতে জিজ্ঞাসা করিলেন ওসি।
“হ্যাঁ
স্যার, আপনারা দেখেছেন?”
“তা, সঙ্গী আরেকটি কই?
তিনজন বলছিলে না?”
মৃণাল আর যতীনের
এইবার হুঁশ হইল। “দিগন্ত, অ্যাই দিগু...” অনেকবার এইদিকে
সেইদিকে গলা উঠাইয়া ডাকিয়াও দিগন্তর হদিশ পাওয়া গেল না। যতীন
গলাটা খাদে নামাইয়া দাঁত খিঁচাইয়া গজগজ করিতে লাগিল,
“দেখলি দিগেটার কাণ্ডটা,
অ্যাঁ? আমাগো এইখানে ডাইকা আইনা অখন পুলিশ দেইখা ভাগলবা! পাইলেই হয় অরে একবার।”
জনাসাতেক খাকি
উর্দিধারীর প্রহরায় বনবাদাড় ঠেঙাইয়া পিচের রাস্তায় উঠিতে রীতিমতো হাঁফ ধরিয়া গেল একেকজনের।
মৃণাল বলিল, “দেখলি যতে, এই ভোরের আলোতেও বনটা কী ভয়ংকর?
আর আমরা কিনা রাতের অন্ধকারে...”
কথা শেষ হইবার পূর্বেই একজন
উর্দিধারী হাঁকিলেন, “এই
গাড়িটা তো?”
“হ্যাঁ স্যার, আমার নিজস্ব গাড়ি।” বলিয়াই
পথের পাশে গতরাতে রাখিয়া যাওয়া মোটরখানির দিকে দৌড়াইয়া গেল মৃণাল।
সব ঠিকঠাকই রহিয়াছে দেখা যাইতেছে। কেহ
কোনো অপকর্ম করে নাই। শুধু একটি ব্যাপার খেয়াল করিয়া
মৃণাল অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া পড়িল। চতুর্দিকে
একবার হতভম্ব দৃষ্টি ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল,
“আচ্ছা স্যার, ঠিক এ জায়গাটাতে একটা চায়ের দোকান ছিল না? কাল চা খেয়েছিলাম আমরা।
আজ তো কোনো নিশানাই দেখতে পাচ্ছি না। কী
রে, যতে?”
“হা হা হা, নেশা ভাং করার অভ্যেস আছে নাকি হে?”
গলা ফাটাইয়া আচমকা হাসিয়া উঠিলেন উর্দিধারী অফিসার।
বলিলেন, “এই জঙ্গলে চায়ের দোকান!
খদ্দের পাবে কোথা?”
যতীনের আপাদমস্তক
পুনরায় শিহরিয়া হইয়া উঠিল। গাড়ি
খারাপ হইয়া জঙ্গলের পথ ধরা, গাছ হইতে প্রেতের লুকাইয়া কথা বলা,
শেষরাতে পুলিশের আগমন,
দিগন্তর গা ঢাকা দেওয়া,
উপরন্তু এখন চায়ের দোকান বেপাত্তা ー ভাবিতে ভাবিতে সারা শরীর গুলাইয়া
উঠিল তাহার। পথের ধারেই বসিয়া পড়িবার উদ্যোগ
করিতে করিতে কোনোক্রমে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা কোন থানা স্যার?”
“আমরা থানা নই, ফরেস্ট গার্ড। উনি
আমাদের স্যার, ফরেস্টার
সায়েব।” একজন সিড়িঙ্গেমতো উর্দিধারী
এতক্ষণ যিনি বার্তালাপ চালাইতেছিলেন তাঁহার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।
ফরেস্টার সাহেব
জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা
রাতের অন্ধকারে বাইসন রিজার্ভড এরিয়াতে কী করছিলেন,
শুনি? দেখেশুনে তো পোচার মনে হচ্ছে না।”
“কী? রিজার্ভড ফরেস্ট? বলছেন কী? আমরা তো মণি হালদার নামে একজন জমিদারের কুঠিতে…” মৃণাল আর যতীন একই সঙ্গে লাফাইয়া
উঠিল।
কিন্তু তখনও তাহাদের
আশ্চর্য হইতে বাকি ছিল অনেক। ফরেস্টার
সায়েব এইবারে দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন, “তবে যে বলছিলেন মজিলপুরে যাচ্ছিলেন?
না, ঘরটা কোনো কুঠিবাড়ি নয়,
আমাদের স্টাফদের পাহারা দেওয়ার ঘাঁটি। ফরেস্ট
ল’তে
কিন্তু ক্রিমিনাল অফেন্স, বিনা অনুমতিতে যা করেছেন আপনারা। চাইলে
এখুনি শক্ত মামলা সাজাতে পারি আপনাদের দু’জনের নামে। আপনাদের
তৃতীয় সঙ্গীটি কোথায় গেল?”
উপায়ান্তর না দেখিয়া
যতীন কাঁদোকাঁদো হইয়া আদ্যোপান্ত খুলিয়া বলিল ফরেস্টার সায়েবের নিকট।
সায়েব চুপ করিয়া সব শুনিলেন। কতখানি
বিশ্বাস করিলেন তাহার মুখ দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই। বলিলেন, “কতটুকু সত্যি, কতটুকু মিথ্যে সেটা থানা বুঝে
নেবে। গার্ড একজন গেছে থানায় খবর
দিতে। একচুলও নড়বেন না আপনারা এখান
থেকে। তবে আপনাদের তৃতীয় জন পালিয়ে
ভালো করেনি। বন্ধুদের জমিদারবাড়িতে নিয়ে
যাবার কথা বলে এভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে বনদপ্তরের নিষিদ্ধ এলাকায় নিয়ে হাজির করাটা… আজ না হোক কাল, ধরা একদিন পড়বেই।
কদ্দিন আর পালিয়ে বেড়াবে?”
অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া
ফরেস্টার সায়েব পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা, জঙ্গলের মধ্যে কে একজন অদৃশ্য
থেকে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছিল, বলেছিলেন
না তখন? কী, যতীনবাবু?”
যতীন কিছু একটা
বলিতে গিয়া মুখ খুলিতেই একজন গার্ড সরিয়া আসিয়া নিচুস্বরে বলিল, “স্যার, এ নির্ঘাত বিশে না হয়ে যায়
না। বাইসন ধরার পাক্কা ফাঁদ ওর
মতো কেউ তৈরি করতে পারে না এ-তল্লাটে। ও
যে কোথায় কখন লুকিয়ে নিঃশব্দে কাজ সারে আমরাই ধরতে পারি না, আর এনারা তো… হে হে হে।”
এরই মধ্যে উপস্থিত
সবাইকে সচকিত করিয়া থানার গাড়িখানি আসিয়া দাঁড়াইল। মৃণাল
আর যতীন মনে মনে নিজেদের প্রাণের বন্ধু দিগন্তকে আশ মিটাইয়া গালাগাল করিতে করিতে গিয়া
গাড়িতে উঠিয়া বসিল।
থানাতে বসিয়া ওসিকে
পুনরায় একপ্রস্থ আগাগোড়া শুনাইতে হইল। এবারে
মৃণাল বর্ণনা করিল। ওসি অনেকক্ষণ ভ্রূ কুঁচকাইয়া
থাকিয়া শেষে বলিলেন, “বন্ধুর
নাম কী বললেন?”
“আজ্ঞে, দিগন্ত বসুরায়।”
ওসি উঠিয়া গিয়া
আলমারি হইতে একটা থলি বাহির করিয়া আনিয়া টেবিলে রাখিলেন। থলির
মুখখানি খুলিয়া একটি মানিব্যাগ দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,
“চিনতে পারেন কেউ?”
যতীন আর মৃণাল
মুখ চাওয়াচাওয়ি করিল। যতীন বলিল, “এমনে কি আর চিনা যায় স্যার? হাজার হাজার মানিব্যাগ আছে
এমন। এই ব্যাগ আপনে দিগন্তর বইল্যা
কইতে আছেন নাকি?”
“হুম, আমার ধারণা। আচ্ছা
খুলে দেখাচ্ছি।”
মানিব্যাগের ভিতরের
যাবতীয় জিনিস উপুড় করিতেই মুহূর্তে একখানি ছবি ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লইল মৃণাল।
যতীনও ছবির পানে দৃষ্টি ফেলিতেই আঁতকাইয়া উঠিল।
মৃণাল চিৎকার করিয়া উঠিল,
“এ ছবি তো সে-বছর পুজোয় তোলা ছবিটা!
আমরা তিনজনেই রয়েছি। এ
আপনি কোথায় পেলেন? দিগন্ত
কোথায়?”
ওসি শান্ত দৃষ্টিতে
খানিক চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “হাসপাতালে। দেখবেন
চলুন।”
হাসপাতালের ভিতরে
ঢুকিতে দেয় নাই পুলিশ। ওসির ইশারায় হাসপাতালের মূল
দালানের খানিক তফাতে একখানি ছোটো ঘরের সামনে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে মৃণাল আর যতীন।
বাস্তব অবাস্তব সবরকম সম্ভাবনা মাথায় ভিড় করিয়া তাহাদের দেহ হইতে
ক্ষুধা তৃষ্ণার অনুভূতিগুলি দূর করিয়া দিয়াছে। ঝাড়ুদার
আসিয়া লাশঘরের তালা খুলিয়া দিতেই ঝড়ের বেগে দুই বন্ধু গিয়া ঢুকিল সেই হিমঠাণ্ডা নরকে।
ওসির ইশারায় ঝাড়ুদার সিমেন্টের টেবিলের ওপর শায়িত একমাত্র লাশটার
মুখ হইতে কাপড় সরাইয়া দিতেই পার্থিব সবকিছু স্তব্ধ হইয়া গেল যেন মুহূর্তে।
লাশটার মাথার বাঁদিকটা থেঁতলাইয়া গিয়াছে। আচমকা
যতীন গলায় একটা অস্বাভাবিক শব্দ তুলিয়া মৃণালের বুকে আছড়াইয়া পড়িল।
চিৎকার করিতে লাগিল, “এ যে আমাগ দিগু রে, মিনাল! এ কী সর্বনাশ হইল? সব আমার দোষে রে মিনাল,
সব আমার কারণে।”
মৃণাল পাথর হইয়া
দাঁড়াইয়া ছিল। অনেকক্ষণ পর নিজেকে খানিক সামলাইয়া
লইয়া ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করিল, “এ কেমন করে হল স্যার?”
ওসি বলিলেন, “গত পরশু ইনি বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন
ইতিউতি। দু-চারজনের সঙ্গে আলাপও জমিয়ে
ফেলেছিলেন নাকি। মণি হালদারের জমিদার কুঠির
খোঁজ করছিলেন শুনলাম। এর মধ্যে হঠাৎ ‘পকেটমার পকেটমার’ বলে ধাওয়া করে অসাবধানে রাস্তায়
দৌড়ে উঠতেই একটা লরি এসে চাপা দেয় আচমকা। খানিক
সামনে ওই পকেটমারও অন্য আরেক গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে ঘাসে।
সে বর্তমানে হাসপাতালেই ভর্তি রয়েছে। একটা
পা ভেঙেছে।”
খানিক থেমে ওসি
পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “কিন্তু
অনেক চেষ্টা করেও আপনাদের বন্ধুর বাড়ির লোকের খোঁজ করতে পারলাম না।
কোথাও কোনো ঠিকানা খুঁজে পেলাম না। একমাত্র
পকেটমারের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মানিব্যাগটাই পাওয়া গেল। তা, এখন আপনারা যখন রয়েছেন তখন
আর চিন্তা নেই। বাড়ির ঠিকানা বলুন, খবর পাঠাচ্ছি।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাহ-সংস্কার করা যায় ততই মঙ্গল।”
দিগন্তর দাহকর্ম
সারিতে সারিতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আজীবনের
মতো এক জগদ্দল পাথর বুকে লইয়া মৃণাল আর যতীন কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিল।
সম্মুখে অন্য মোটরে দিগন্তর পিতা আর বাড়ির লোকজন সব রহিয়াছেন।
নিস্তব্ধতা ভাঙিল
মৃণালই। বলিল, “কাল রাতে আর কেউ নয়, দিগন্তই ধাক্কা মেরে বাঁচিয়েছিল
তবে আমাকে। পষ্ট বুঝতে পারছি এখন।”
যতীন পাশে বসিয়া
ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলে মৃণাল ব্যাখা করিল,
“ওই বিশে না কে এক চোরাশিকারি ফাঁদ পেতেছিল বাইসন ধরার জন্যে নির্ঘাত।
আর দিগন্ত ধাক্কা মেরে ছিটকে না ফেললে আমি ওই গর্তে পড়ে মরতাম।”
“কিন্তু হেয় শ্যাষে এমন কাণ্ড ঘটাইব জীবনেও কল্পনা করি নাই রে মিনাল।
আমারে দেওয়া কথা রাখতে গিয়া নিজের পরাণটা খুয়াইব জানলে…” যতীনের কণ্ঠ বুজিয়া আসিল।
কলিকাতার নিকট
পৌঁছিয়া মৃণাল লক্ষ করিল, যতীনের ঘাড় হেলিয়া পড়িয়াছে সিটে। মৃণাল
সস্নেহে যতীনের মুখে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া লইয়া আবার উইন্ড স্ক্রিনে চোখ রাখিল।
যতীন তখন স্বপ্ন দেখিতেছে,
তাহার স্বপ্ন পূর্ণ হইয়াছে। সে
একখানি বই লিখিয়াছে শেষ অবধি। তবে
তাহার বিষয় অন্য কিছু নহে, প্রাণপ্রিয় এক বন্ধুর বিয়োগান্ত কাহিনি।
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment