গা ছমছম
জয়দীপ চক্রবর্তী
।। ১ ।।
।। ২ ।।
_____
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত
জয়দীপ চক্রবর্তী
রামরতন
প্রায় নাচার ভঙ্গিতেই বামুনহাটা হাই স্কুলের হেডমাস্টার দীপেন সরকারের কাছে এসে
জানাল, “আর আমার পক্ষে এই খন্ডহরে একা রাত কাটানো সম্ভব নয় স্যার। আপনি যাই বলুন,
এই গোলমেলে জায়গায় আমি আর এক রাত্তির কাটাতেও রাজি নই। আপনি অন্য লোক দেখুন এইবার।”
রামরতন
এই স্কুলের দারোয়ান কাম নাইট গার্ড। সরকারিভাবে স্কুলে নাইট গার্ড, দারোয়ান, সাফাই
কর্মী এইসব পদে লোক নিয়োগ হয় না। স্কুল কমিটি নিজেদের উদ্যোগে বছর তিনেক আগে
রামরতনকে কাজে বহাল করেছিল। তার পারিশ্রমিক স্কুলের নিজস্ব তহবিল থেকেই মেটাতে হয়।
রামরতন যে খুব কাজের লোক তা নয়। সত্যি বলতে কী, সে খানিক ফাঁকিবাজই বলা চলে। লোকে
বলে, মাসের অর্দ্ধেক রাতে সে স্কুলে থাকেই না। তবু তাকে রাখতে হয়েছে এইজন্যেই যে,
এত বড়ো স্কুল বিল্ডিং-এ একা রাত কাটানোর লোক পাওয়া কঠিন শুধু নয়, প্রায় অসম্ভবই। এ
ছাড়াও আরও একটা কারণ আছে। রামরতন ফাঁকিবাজ ঠিকই, কিন্তু সে বিশ্বাসী। সাহস-টাহসও
তার মন্দ না। রামরতনের মতো একজন ডাকাবুকো লোক রাত্তিরে স্কুলে থাকে, এ
কথাটা বাইরে চাউর থাকলে ছিঁচকে চুরি-টুরির হাত থেকে স্কুলটাকে রক্ষা করতে সুবিধে
হয়।
দীপেনবাবু
এই স্কুলে হেডমাস্টার হয়ে এসেছেন বছর দেড়েক। তার মধ্যে রামরতন এই কথাটা অন্তত বার
দশেক বলেছে। রামরতন মাঝে মাঝেই এ কথাটা বলে। তার ধারণা দীপেনবাবু নতুন লোক। কাজ ছেড়ে দেবার ভয়-টয় দেখিয়ে
তাঁর কাছে এই সুযোগে খানিক বেতন বাড়িয়ে নিতে সুবিধে হবে। দীপেন সরকার নতুন লোক
ঠিকই, কিন্তু ঘাগু লোক। রামরতনের ফন্দিটুকু বুঝে নিতে একটুও অসুবিধে হয়নি তাঁর।
কাজেই রামরতন কাজ ছেড়ে দেবার প্রসঙ্গে তাঁর সামনে যতই গাঁইগুঁই করুক, কোনোদিনই
বিষয়টাকে তেমন একটা আমল দেননি তিনি। কিন্তু আজকে রামরতনের কথা বলার ভঙ্গীতে এমন
একটা কিছু ছিল যে ছাত্রদের দেওয়া চাল, ডাল ছোলার হিসেবের খাতা থেকে মুখ তুলে তিনি
সটান চাইলেন রামরতনের দিকে।
দীপেনবাবুকে
মুখ তুলে চাইতে দেখে রামরতন আবার কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “স্যার আমাকে এইবার সত্যি
সত্যিই ছুটি দিন।”
“ছুটি
তো গত দেড় বছর ধরেই চাইছ আমার কাছে রামরতন। এ তো আর নতুন কথা কিছু নয়...” দীপেনবাবু
চোখ সরু করে চাইলেন তার দিকে। মেপে নিতে চাইলেন খানিক রামরতনকে।
রামরতন
এবারে প্রায় হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, “এখানে রাতে থাকলে আমি মরে যাব স্যার। ওরা
নির্ঘাত মেরে ফেলবে আমাকে...”
“কারা?”
“ওই
যারা স্কুলে দাপিয়ে বেড়ায় রাত্তিরভোর...”
“কী
বলতে চাইছ বলো দেখি রামরতন?” দীপেনবাবু শঙ্কিত গলায় বললেন, “রাতে কি
দুষ্কৃতকারীদের আনাগোনা হচ্ছে ইদানীং এই অঞ্চলে?”
“আজ্ঞে
না স্যার?”
“তাহলে?”
“রাত
বাড়লেই আমার গা ছমছম করে স্যার। গা হাত পায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আজকাল...”
“এত দিন
হত না? তুমি তো এই স্কুলে রাতে থাকছ বছর তিনেক হয়ে গেছে শুনেছি...”
“হত
না তা নয়,” রামরতন ঘাড় চুলকে বলে, “কিন্তু এমন করে তেনারা তখন দাপিয়ে বেড়াতেন না
স্কুল বাড়িতে?”
“তেনারা
মানে?”
“আপনি
কেন যে বুঝতে পারছেন না স্যার। পরিবারের সঙ্গে বাস করি। কেন তেনাদের নাম আমার মুখে
আনতে চাওয়াচ্ছেন বলুন দেখি?”
“তা
সেই তেনাদের এই দাপাদাপি কবে থেকে এমন বাড়ল রামরতন?” একটু ঠাট্টার ছলেই জিজ্ঞেস করলেন
দীপেনবাবু।
“এই
যখন থেকে ওই বিচ্ছিরি রোগ এসে দেশটাকে থমকে দিল... মানে বন্ধ হয়ে গেল সব... তারপর
ওই মারণ ঝড় এসে উলটেপালটে ভেঙে-চুরে ফেলল ইস্কুলের পুরোনো বাড়িটা... তাকিয়ে
দেখেছেন স্যার একবার, এদ্দিন ইস্কুল বন্ধ থাকার জন্যে কেমন মাঠময় লম্বা ঘাস
গজিয়েছে। আগাছা জন্মে গেছে চারদিকে...”
“তা
তো বুঝলুম,” দীপেন সরকার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়েন, “কিন্তু কথা হচ্ছে, এই দুঃসময়ে
হঠাৎ করে এসব উৎপাত কেন শুরু হল বলো তো হে?”
“সে
আমি কী জানি স্যার,” রামরতন বোকার মতো মুখ করে বলে, “কিন্তু গত ক’দিন ধরেই দেখছি রাত
নিঝুম হলেই ইস্কুল বাড়ি জুড়ে কারা যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে স্যার। বন্ধ ঘরের মধ্যে
আজকাল নিশি-ইস্কুল বসছে রোজ। পষ্ট শুনতে পাই, কালচে ঝুলের মতো অন্ধকারে মিশে থেকে কচি
কচি খোনা গলায় কারা যেন সব নিচু গলায় নামতা পড়ে, ছড়া কাটে...”
“ধ্যাৎ,”
ধমকে ওঠেন দীপেনবাবু, “বাজে কথার জায়গা পাও না। আমাকে কি ছেলেমানুষ ঠাওরেছ নাকি?
ভাবছ ভূতের ভয় দেখিয়ে আমাকে দিয়ে কাজ হাসিল করাবে?”
“কী
কাজ আর হাসিল করাব স্যার?” রামরতন কঁকিয়ে উঠে বলে।
“তুমি
কি ভাব, তোমার এই কাজ ছেড়ে দেবার গান গাইবার আড়ালে থাকা মতলব আমি বুঝি না?”
রামরতন
চুপ করে থাকে মাথা নিচু করে।
দীপেন
সরকার নরম গলায় বলেন, “বুঝি হে রামরতন, সবই বুঝি। এতদিন ধরে পৃথিবী থেমে আছে।
বাজারও বেজায় চড়েছে, অস্বীকার তো করার উপায় নেই। এই অতিমারি আর লকডাউনে কত লোকের
যে চাকরি গেল... আচ্ছা ঠিক আছে, ম্যানেজিং কমিটিতে ফেলি তোমার ব্যাপারটা। দেখছি
যদি দু-একশো টাকা বাড়িয়ে দেওয়া যায় তোমার...”
“আজ্ঞে
জান থাকলে তবে না রোজগারের চিন্তা স্যার...” রামরতন এগিয়ে এসে দীপেনবাবুর পা চেপে
ধরে দু’হাত দিয়ে, “আমায় সত্যিই এবারে ছুটি দিন স্যার...”
দীপেনবাবুর
কপালে ভাঁজ পড়ল এইবার। রামরতনের গলায় উদ্বেগটা মিথ্যে মনে হচ্ছে না। নিজে
বিজ্ঞানের শিক্ষক। ভূত প্রেতে তাঁর বিশ্বাস নেই। কিন্তু কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার-স্যাপার
যে ঘটতে চলেছে তার একটা আঁচ পাচ্ছিলেন তিনি মনে মনে।
রামরতনের
দিকে চেয়ে বললেন তিনি, “আচ্ছা তুমি এখন এসো। ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে দাও আমায়।”
“আজ
রাতে তাহলে কী করব স্যার? বিশ্বাস করুন, একা রাত্তিরে থাকতে বললে আমি কিন্তু
সত্যিই ভিরমি খেয়ে মরে পড়ে থাকব এইখানে।”
“আজ
রাতে স্কুলে ঢোকবার আগে আমার বাসায় এসো। তখন ভেবে চিন্তে একটা বুদ্ধি বের করা যাবে’খন...”
“আচ্ছা
স্যার,” বলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল রামরতন।
দীপেন
সরকার দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন আনমনে।
এই
এলাকায় বামুনহাটা হাই স্কুল বেশ নামী স্কুল। যেমন পুরোনো, তেমনি বনেদি। সেই সব
দেখেশুনেই এই স্কুল বেছে নিয়েছিলেন দীপেনবাবু। আগের স্কুল থেকে লিয়েন নিয়েছেন।
প্রথম বছরের শেষে আর এক বছরের জন্যে বাড়িয়েও নিয়েছেন লিয়েনের মেয়াদ। আসলে এই
স্কুলটা নামী যেমন, তেমনি কাজের চাপও আছে এখানে খুব। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব
খাটিয়ে কিছু লোক ব্যক্তিগত লাভের অঙ্কও কষতে শুরু করেছেন তাঁকে নতুন লোক পেয়ে।
স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের খুব একটা গুরুত্ব দিতে দীপেন সরকার রাজি নন। স্কুলের কাজে
আরও সময় দেবার জন্যে স্কুলের প্রায় পাশেই একটা এক কামরার ফ্ল্যাটও নিয়ে নিয়েছেন।
মাঝেমধ্যেই সেখানে থেকে যান। আজ যেমন থাকবেন। এই অতিমারির পরিস্থিতিতে স্কুলের
দৈনন্দিন পঠনপাঠন দীর্ঘদিন বন্ধ, কিন্তু তিনি প্রায় নিয়মিতই স্কুলে আসছেন।
প্রশাসনিক কাজকর্মের তদারকি করছেন সুষ্ঠুভাবে। নিজের কাজে সৎ ও নিষ্ঠাবান হলে
স্বাভাবিক কারণেই মানুষের কিছু শত্রু জুটে যায়। দীপেনবাবুর বার বার মনে হচ্ছিল, রামরতনকে
ভয় দেখিয়ে স্কুল থেকে সরানোর চেষ্টা সেই শত্রুতারই বহিঃপ্রকাশ নিশ্চিত। এই স্কুল
ছেড়ে আগের স্কুলে ফিরে যাবার জন্য তার নিজের হাতেও এখনও মাস ছয়েক সময় আছে।
রামরতনের পরে এই স্কুল থেকে তাড়ানোর ক্ষেত্রে তিনি নিজেই সম্ভবত টার্গেট হবেন
দুষ্টু লোকগুলোর। একা ঘরে বসে দু’দিকে মাথা নাড়লেন দীপেন সরকার। উঁহু, এত সহজে
চাপের সামনে মাথা নিচু করার মানুষ তিনি নন। কিছু বাজে লোকের ভয়ে স্কুল ছেড়ে পালিয়ে
যাবার প্রশ্নই ওঠে না কোনও। বরং আগের স্কুলে এইবার আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিগনেশন দেওয়ার
কাজটা সেরেই ফেলতে হবে।
চেয়ার
থেকে উঠে পড়লেন দীপেনবাবু। আজ রাতে রামরতনের সঙ্গে তিনি নিজেই স্কুলে আসবেন। দরকার
হলে থেকেই যাবেন রাতে। আসল সত্যিটা তাঁর নিজের চোখে দেখে নেওয়া দরকার।
বাইরে
থমথম করছে রাত্রি। আজ আকাশে চাঁদ আছে। শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসছে আকাশে। সেই
মেঘের স্তূপের ফাঁক গলে ঠিকরে আসা আলোয় স্কুল বিল্ডিংটাকে মায়াবী মনে হচ্ছে। গেটের
সামনে দাঁড়িয়ে রামরতন কেঁপে উঠল। গেটের তালা খুলতে খুলতেই ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, “কাজটা
কি ঠিক হচ্ছে স্যার?”
দীপেনবাবু
তার পিঠে আলতো চাপড় মারলেন, “ভয় কী? আমি তো সঙ্গে আছি।”
দু’জনে
মিলে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এসে নিজের ঘরেই বসলেন দীপেনবাবু। রামরতনকে বললেন, “বসো।”
গুটিসুটি
মেরে সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়ল রামরতন।
কিছুক্ষণ
দু’জনেই চুপচাপ। বাইরেও কোনও শব্দ নেই। ঘড়ির কাঁটা সরছে টিক টিক শব্দ করতে করতে।
বাইরে সমস্বরে একপাল কুকুর কেঁদে উঠল একসঙ্গে।
চেয়ারে
বসেই একেবারে যেন কুঁকড়ে গেল রামরতন। চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল।
দীপেনবাবু
একটু অস্বস্তি নিয়েই বলে উঠলেন, “কী হল রামরতন? এ তো কুকুরের ডাক...”
“এইবারেই
তো ওরা আসবে স্যার। রাতের ইস্কুল শুরু হবার ওইটেই তো ঘন্টা...” শুকনো খসখসে গলায়
বলে রামরতন।
রামরতনের
কথা শেষ হতে না হতেই বাইরে মাঠ জুড়ে যেন ঝড় উঠল। হাওয়ায় হাওয়ায় দল বেঁধে কারা
কোলাহল মিশিয়ে দিল। সেই কোলাহলের শব্দ চাপা কিন্তু স্পষ্ট।
চেয়ার
ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন দীপেনবাবু।
“স্যার
বাইরে যাবেন না। তেনাদের যাতায়াতের সময় পথে পড়ে গেলে আপনার গায়ে তেনাদের
ছায়াশরীরের বাতাস লেগে যাবে।”
“আমি
ওসব বিশ্বাস করি না।”
“আপনি
স্যার শিক্ষিত মানুষ। আপনাকে পরামর্শ দেওয়া আমার সাজে না। কিন্তু কথা হল, সব
কিছুতেই জেদ করা কি ভালো?” রামরতনের চোখে মুখে সেই ভয় ভয় ভাবটা সরে গিয়ে একটা হালকা
হাসি ফুটে উঠল, “আগেও কতবার আপনাকে বলেছি, এই স্কুল বড়ো রহস্যের জায়গা স্যার। বড়ো
মায়ার জায়গা। একবার এই ইস্কুলের মায়ায় আটকালে এখান থেকে একেবারে চলে যাওয়া বলতে
গেলে অসম্ভব...”
একটা
অন্যরকম অস্বস্তি হচ্ছে শরীরের মধ্যে। দীপেনবাবু বুঝতে পারছিলেন, জামার নিচে ঘাম
গড়াচ্ছে শিরদাঁড়া বেয়ে। সামনে বসে থাকা রামরতনকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে। তার মুখে
মিটমিটে হাসি। কী চাইছে লোকটা?
পায়ে
পায়ে এগিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন দীপেনবাবু। দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন
বাইরে স্কুলের মাঠে ঘাসের ওপরে জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে একদল শিশু দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
তারা সকলে হাসছে, খেলছে, কথা বলছে। অথচ তাদের কথা বলা, তাদের সম্মিলিত চিৎকার, সবই
যেন বাতাসের মতো মিহি...
এইসময়েই
দু-তিনজন ছায়া ছায়া মানুষ এসে দাঁড়ালেন স্কুলের লনে। দীর্ঘ দেহ তাঁদের। পরনে ধুতি,
শার্ট। আলো বেরোচ্ছে তাঁদের শরীর থেকে। চাঁদের আলোকে ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আলো।
স্কুলের মাঠে, স্কুলের বিভিন্ন ভবনের গায়ে...
দুটো
পা স্থির হয়ে গেছে। নড়তেও ভুলে গেছেন দীপেনবাবু। এ কী দেখছেন তিনি? চোখের সামনে
আলোয় ছায়ায় কাদের দেখতে পাচ্ছেন তিনি? এই মাঝ রাতে, জ্যোৎস্নায়?
জামার
বুক পকেটের মধ্যে ফোনটা বাজছে। অনেকক্ষণ ধরেই বাজছিল হয়তো। খেয়ালই হয়নি
দীপেনবাবুর। এখন ফোনটা হাতে নিলেন। স্কুলের প্রেসিডেন্ট, নিবারন ভটচাজ। হাতের ঘড়ির
দিকে তাকালেন দীপেনবাবু। রাত বারোটা বেজে কুড়ি। সামনের মাঠ ফাঁকা হয়ে গেছে। সেখানে
এখন একলা জ্যোৎস্না। খানিকটা আবেশের মধ্যে ফোন রিসিভ করলেন দীপেনবাবু। অনুচ্চ গলায়
বললেন, “হ্যাঁ স্যার, বলুন...”
“বাধ্য
হয়ে এত রাতে ফোন করলাম স্যার। কিছু মনে করবেন না। ঘুম ভাঙানোর জন্যে সরি বলে
নিচ্ছি আগেভাগেই...”
“না,
না, ঘুমোইনি। বলুন,” স্কুলে আসার কথাটা ইচ্ছে করেই চেপে গিয়ে বললেন দীপেনবাবু।
“রামরতনের
ব্যাপারটা জানেন তো?”
“কাজ
ছাড়তে চাইছে,” খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন দীপেনবাবু। মাঝরাত্তিরে এই কথাটা বলার
জন্যে ফোন করার কী দরকার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।
“কাজ
তো সে ছেড়েই দিয়েছে স্যার। চিরকালের মতো,” নিবারণ ভটচাজের গলায় বিষণ্নতা।
“মানে?”
চমকে উঠলেন দীপেনবাবু।
“আপনি
শোনেননি কিছু?”
“কী
ব্যাপার বলুন তো?”
“আজ
বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ রামরতন মারা গেল। কোভিড পজিটিভ ছিল। জ্বর আর শ্বাসকষ্ট
নিয়ে পরশুই ভর্তি হয়েছিল সরকারি হাসপাতালে। কো মর্বিডিটিও ছিল নাকি শুনছি...”
মাথা
কাজ করছে না দীপেন সরকারের। নিবারণবাবুর আর কোনও কথা কানে ঢুকছে না। দরজা দিয়ে ঘরে
ঢুকে দেখলেন, ঘর ফাঁকা। রামরতনের কোনও চিহ্ন নেই সেখানে। সিলিং ফ্যানটা সাঁই সাই
করে ঘুরছে। তাঁর টেবিলের ওপরে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রাখা একটা লম্বা কাগজ ফরফর আওয়াজ
করছে হাওয়া লেগে।
মাথা
ঝিমঝিম করছে। চোখের সামনে আবছা অন্ধকার নামছে। কোনোক্রমে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন
তিনি। মাথাটা হেলিয়ে দিলেন পিছনে। চেয়ারের ব্যাকরেস্টে। হাতে মাত্র ছ’মাস সময়। তার
মধ্যেই এই স্কুল ছেড়ে ফিরে যেতে হবে যে করেই হোক...
“সে
বড়ো খারাপ ব্যাপার হবে হে। আমাদের কাছে বড়ো অনুতাপের বিষয় হবে...” গম্ভীর গলাটা
শুনে চোখ খুললেন দীপেনবাবু। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ধুতি শার্ট পরা দীর্ঘদেহী এক
মূর্তি। চোখে চশমা। একটু আগে এঁকেও দেখেছিলেন স্কুলের লনে...
দীপেনবাবু
ভয় পেতেও ভুলে যাচ্ছেন ক্রমশ।
সেই
দীর্ঘদেহী অবয়ব হালকা হাসলেন, “ভয় পেও না। আমরা কেউ তোমার শত্রু নই।”
“আপনারা?”
ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন দীপেনবাবু।
“আমরা
তোমার অতীত। তুমি, আমি, আমরা সবাই এক অনন্ত কালখন্ডের বিভিন্ন বিন্দুতে কাজ করে
যাচ্ছি এই স্কুলের জন্যে। আমি যে সময় বিন্দুতে ছিলাম তা বর্তমান থেকে অতীতে সরে
গেছে দীপেন। এখন তোমার পালা। কিন্তু কখনও আগের সেই সময়বিন্দুকে অস্বীকার কোরো না।
মনে রেখো অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এই তিন নিয়েই সময়ের পূর্ণ বিস্তার। যে চেয়ারে এখন
তুমি বসে আছ, ওখানেই আমি বসতাম এক সময়। আর কেউ বসবে আগামীতে। আমাদের কাজ এক।
উদ্দেশ্য এক। আমরা এই স্কুলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই আমাদের কর্ম দিয়ে, আমাদের
কর্তব্য দিয়ে...”
“কিন্তু...”
“কোনও
কিন্তু নেই। রামরতনও রইল। এই স্কুল আমরা সকলেই পাহারা দিচ্ছি। দেবই। কোনও
দুষ্কৃতিরই জায়গা হবে না এখানে কোনোদিন। তুমি নিশ্চিন্ত থেকে কাজ করো। এই কথাটা
বলার জন্যেই তোমাকে এখানে আনানো। রামরতনের ওপরে রাগ কোরো না...”
ছায়ামূর্তি
মিলিয়ে গেল। দীপেন সরকার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভয়টা কেটে গেছে। মনের মধ্যেও অদ্ভুত
একটা বল পাচ্ছেন এখন। রামরতন ঠিকই বলত। বামুনহাটা বড়ো গোলমেলে স্কুল। একবার এই স্কুলটাকে ভালোবেসে
ফেললে এখান থেকে ফিরে যাওয়া সত্যিই ভারি শক্ত।
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment