বিচিত্র জগৎ
মধুমিতা সেনগুপ্ত
মধুমিতা সেনগুপ্ত
মুনিয়া চোখ খুলে কিছুই
মনে করতে পারে না প্রথমে। একরাশ কিছুটা শুকনো কিছুটা আধভেজা পাতার উপর সে
শুয়ে আছে। গায়ে বেশ
ব্যথা।
উপরে খোলা আকাশ। রোদের তাপে তার জামা শুকিয়ে গেছে।
একটু পাশ ফিরতে যেতেই
কে যেন গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, “উঁহু উঁহু! একদম নড়বে
না।”
চমকে উঠে মাথা সেদিকে
ঘুরিয়ে মুনিয়া দেখে একটা প্রকান্ড কাঠবিড়ালি। তার চোখে একটা ভাঙা চশমা সরু লতা
দিয়ে মাথার সঙ্গে বাঁধা। কাঠবিড়ালি! মুনিয়ার
মনে পড়ে অনেক কিছু।
আজ সেই কোন ভোরে বাসে
চড়েছিল। মা বলেছিলেন পাহাড়ের উপরে কী একটা
মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন সবাই মিলে। মায়ের গায়ে মাথা রেখে সে সিটে বসে বসেই
ঘুমাচ্ছিল। দাদা আর বাবা ছিলেন সামনের সিটে। হঠাৎ একটা চিৎকারে তার
ঘুম ভেঙে যায়। সবাই ভীষণ চিৎকার করছিল ভয়ে। মা বললেন
ভূমিকম্প হচ্ছে। বাস থামিয়ে সবাইকে নেমে যেতে বলছিল ড্রাইভার কাকু। সবাই নামছিল হুড়মুড়
করে। সে তার মায়ের হাত ধরেছিল। বাবা দাদা আগে নেমে যান। দরজা দিয়ে তারা নামছিল, হঠাৎ
বাসের পিছনে এসে অন্য একটা বাস সজোরে ধাক্কা মারে। ওদের বাসটা সোজা খাদের দিকে গড়িয়ে যায়। বাবা
তার নাম ধরে আর দাদা মা মা বলে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। সে এক হাতে বাসের রড অন্য
হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে প্রাণপণে।
নিচে কলকল করে বয়ে
চলেছে কী একটা নদী। বাসে প্রবল আর্তনাদ। ঝাঁকুনি
খেতে খেতে গাছপালা
ভেঙে বাসটা গড়িয়ে নামছে। মা নিজের ভার রাখতে পারলেন না। একটা ফাঁকা জায়গা
আসছে দেখে নিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরে বাসের থেকে কোনাকুনি লাফ দিলেন। মা খুব ভালো
সাঁতারু। সেও মোটামুটি সাঁতার জানে। দু’জনে সোজা নদীর জলে পড়ে ডুবে যায়।
তারপর জলের স্রোতে অনেকটা দূরে চলে যায়। জলের উপরে ভেসে উঠেই দেখে কিছুটা দূরেই
বাসটি কয়েকটা গাছের মধ্যে আটকে ঝুলছে। সবাই চিৎকার করছেন আতঙ্কে। জলের ধাক্কায়
তারা দু’জনেই আবার ডুবে যায়। অনেকটা দূরে ভেসে ওঠে দু’জনে। তার মা তাকে
সজোরে ঠেলা দিয়ে তীরের দিকে ঠেলে দেন। সে একটা বড়ো পাথরের খাঁজে আটকে
যায়। মা ক্রমশই জলের স্রোতে দূরে ভেসে যান। সে কোনোমতে শ্যাওলা ধরা পাথরের উপরে
উঠে বসে।
একটু দম নিয়ে মুনিয়া
দেখে একটু পরে গিয়েই একটা ধাপের মতো অংশ। পাহাড়ি নদীটি কতটা নিচে লাফ দিচ্ছে সে
এখানে বসে আন্দাজ করতে পারে না। মায়ের চিন্তায় তার চোখে জল
আসে।
হঠাৎ তার চোখে পড়ে
একটুকরো কাঠের উপর একটা ছোট্ট কাঠবিড়ালি ছানা ভেসে যাচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে কাঠটাকে
ধরে ফেলে। ছোট্ট ছানাটাকে জল থেকে তুলে নিজের ভিজে সোয়েটার খুলে নিংড়ে নিয়ে তাই
দিয়েই ভালো করে মুছিয়ে দেয়। তারপর
অবসন্ন হয়ে শুয়ে পড়ে। বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল।
বিশালদেহী কাঠবিড়ালির
দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে মুনিয়া। পায়ের দিকে বেশ খানিকটা দূরে সেই নদী। তার
একটুও ঠান্ডা লাগছে না।
সে প্রশ্ন করে, “তুমি কে! আমায় এতটা
দূরে আনলে কী করে?”
“মানুষের এই মস্ত দোষ।
খালি প্রশ্ন করে। আমি কাঠবিড়ালি সর্দার মার্মটিনি,” বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে বলে
কাঠবিড়ালি।
“প্রশ্ন তো করবই। তুমি
কাঠবিড়ালি অথচ এত বড়ো চেহারা! তুমি কথা বলছ, বাংলাও জানো! কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে
পারছি না যে,” চোখ বড়ো বড়ো করে বলে চলে মুনিয়া।
খিক খিক শব্দে সামনের কোদাল
দাঁত দুটো দেখিয়ে কাঠবিড়ালি হেসে ওঠে। তারপর বলে, “তোমরা নিজেদের সবচেয়ে
বড়ো পন্ডিত বলে ভাব। পৃথিবীতে
মোট ক’টা
প্রাণী আছে, কীভাবে আছে তোমরা কিছুই জানো না। যেটা
তোমরা মানে বুঝতে পার না, বলে দাও সেটা হতেই পারে না। যাক গে, তুমি বাচ্চা মেয়ে, সব বললে বুঝবে না।
তোমার কি খিদে পেয়েছে?”
“হ্যাঁ। পেয়েছে। কিন্তু
এটা আমি কোথায়? আর আমার মা ..” মায়ের কথা মনে আসতেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে মুনিয়া।
“এই কাঁদবে না, একদমই কাঁদবে না।
ক্যাপ্টেন লুত্রিনি-কে পাঠানো হয়েছে তোমার মায়ের খোঁজে। আমাদের পরিবারের
সবচেয়ে ছোটো সদস্য চিম্পু-কে তুমি বাঁচিয়ে দিয়েছ। সেটা আমরা
দেখেছি, তাই তোমার মাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের,” বলে সর্দার মার্মটিনি।
“ক্যাপ্টেন লুত্রিনি!
তিনি কে?”
“ভোঁদড় সর্দার। ভীষণ
চালাক। একটু কাদা মাটি পেলে হড়কে নিমেষে আধ মাইল চলে যায়। এক দম নিয়ে ডুব সাঁতার
দিয়েও আধ মাইল চলে যেতে পারে। ও পুরো দলবল কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। আশা করি
বিকেলের মধ্যেই গুপ্তচরেরা আসল খবর এনে দেবে। চিম্পু
তোর ঠাকুমাকে বল ওকে একটু টাটকা মধু দিতে,” চোখের চশমার বাঁধন খুলে ভাঙা
চশমাটার কাচে ভাপ দেয় সর্দার, তারপর বুকের মাঝখানে ঘষে নেয় সেটা।
একটু পিছনেই কয়েকটা
সরু গাছের গুঁড়ির আড়ালে পাহাড়ের গায়ে বেশ বড়ো একটা গর্ত। দিনের
আলোতেও পরিষ্কার চোখে পড়ে না। পাহাড়ের এই ঘন জঙ্গলে ঢাকা খাদে আসবেই বা কে! সেই গর্তের ভিতর থেকে
একটি বড়ো কাঠবিড়ালি বের হয়ে এল। তার
হাতে একটা বড়ো
পাতার মধ্যে কিছু একটা। সামনে এসে মুনিয়ার হাতে পাতাটা
ধরিয়ে দেয় কাঠবিড়ালি। মুনিয়া দেখে বেশ পিৎজার মতো তিন কোনা একটি মৌচাকের অংশ।
হালকা সোনালি রঙের মধু ভর্তি খোপে খোপে। এটা মানুষ কীভাবে খায় ভেবে পেল না
মুনিয়া।
“আরে, ও তো ছোট্ট একটা মেয়ে। বুঝতে
পারছে না কীভাবে
খাবে। যাও একটা বড়ো পাতা নিয়ে এসো,”
বলে ওঠে
সর্দার।
“ওহো, মস্ত ভুল হয়ে গেছে।
দাঁড়াও আনছি,” সর্দার গিন্নি চলে যায়। ফিরে এসে একটা বড়ো পাতা পানের মতো মুড়ে মুনিয়ার হাতে
ধরিয়ে দেয়। তারপর মৌচাকের খন্ডটা দু’হাতে নিয়ে চাপ দেয়। একটা ছোট্ট
মৌমাছি ভোঁ করে বার হয়ে আসে। ভয়ে চোখ
বন্ধ করে চিৎকার দেয় মুনিয়া।
“এই! এই দুষ্টু মৌমাছি,
যাঃ। চলে গেছে। চোখ
খোলো,”
বলে সর্দার গিন্নি।
মুনিয়া চোখ খুলে দেখে
তার হাতে পাতার মধ্যে ঘন রসের মতো মধু পড়েছে বেশ খানিকটা। উপরে সাদা ফেনার মতো কী ভাসছে।
“খাও খাও, দেখবে শরীরে বল পাবে,” বলে সর্দার মার্মটিনি।
অল্প একটু মুখে দিয়েই
মুনিয়ার বেশ ভালো লাগে। সে মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। বাবা
কত মিষ্টি আনেন বাড়িতে। বাবার কথা ভেবে আবার তার কান্না আসে। আর কি সে কোনোদিন বাড়ি ফিরতে পারবে?
দাদার সঙ্গে খুনসুটি করতে পারবে? তার ঠাম্মি দাদু এই দুর্ঘটনার কথা শুনলে
কী হবে সে ভাবতে পারছে না।
“আহা রে! মেয়েটা আবার কাঁদছে। কী তোমার গুপ্তচর
বাহিনী! এতক্ষণে ওর মায়ের খোঁজটা আনতে পারল না! আমি যাই বরং খোঁজখবর করি,” মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে
সর্দার গিন্নি।
“গুপ্তচররা কীভাবে কাজ করে?” মধু খেতে খেতে প্রশ্ন
করে মুনিয়া।
“এই যে নদীটা দেখছ, এটা মাইল দুয়েক বাদেই
বাঁ দিকে ঘুরে গেছে। তারপর কিছুটা গিয়ে মোটামুটি সমতলে নেমে
গেছে। ওই অংশে বেশ কিছু নৌকো চলে। মাঝিরা ঘাটে ঘাটে নৌকো বেঁধে খবর দেওয়া নেওয়া
করে। এদিকের খবর ওদিকে যায়। তখন ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে থেকে গুপ্তচরেরা খবর শুনে নেয়। তারা চলে আসার সময় দৌড়
দেয়, তখন তোমরা দেখ ঝোপ জঙ্গল হঠাৎ নড়ে উঠল,” বুঝিয়ে বলে সর্দার।
হঠাৎ পাহাড়ের একটু উপর
থেকে ঝুপ করে কী একটা এসে পড়ল ওদের সামনে। খুব চমকে ওঠে মুনিয়া। আরে একে তো সে
চিড়িয়াখানায় দেখেছে। এ তো সজারু। কিন্তু এর চেহারা বেশ
বড়ো। নদীর ধার থেকে কিছু রঙবেরঙের পাথর কুড়িয়ে আনে
সর্দার মার্মটিনি। সজারুর সামনে পাথরগুলো রাখার পর সে আর সর্দার দাবা খেলার মতো
পাথর আগুপিছু করে কী যেন করে। তারপর সজারু জঙ্গলের দিকে চলে যায়।
কী যেন চিন্তা করে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সর্দার বলে, “নাঃ, এখনও তোমার মায়ের কোনও খবর নেই। মিলিটারি
নেমেছিল উদ্ধার কাজে। তোমরা বাসের মধ্যে থাকলে এতক্ষণে রক্ষা পেয়ে যেতে। কাল
ওরা নামবে নদীর পাড়ে তোমাদের খুঁজতে। চলো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ভিতরে যাই।”
কাল মিলিটারি আসছে
তাদের খুঁজতে। ভাবতেই ভালো লাগছে সে আবার বাড়ি ফিরতে পারবে, কিন্তু মায়ের কী হল, মা কেমন আছে, এটা না জানা অবধি তার
শান্তি নেই।
মাথাটা একটু নিচু করে
কাঠবিড়ালিদের পিছু পিছু পাহাড়ের গায়ের বড়ো গর্তের মধ্যে ঢুকতে থাকে মুনিয়া। একটা
লম্বামতো অংশ পেরিয়ে এসে ঢোকে মস্ত এক গুহার ভিতরে। এখানে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে
পারছে। গুহার চারপাশে ছোটো বড়ো মিলিয়ে প্রায় জনা
কুড়ি কাঠবিড়ালি। গুহার ছাদ থেকে এবড়োখেবড়ো কত রঙিন পাথর দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের খাঁজ
বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। সেই জল একপাশে ছোটো নালার মতো অংশে জমে আছে। সেখান
থেকে হালকা নীল আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গুহায়।
“খুব অবাক হয়েছ তো? ওই
যে জল পড়ছে ওপর থেকে ওই জল ভীষণ নোনা। ওর মধ্যে জন্মেছে একধরনের সামুদ্রিক জেলিফিস
যাদের গা থেকে ওই নীল রঙের আলো বের হচ্ছে।”
চারপাশটা হালকা নীল
আলোতে কী ভীষণ রহস্যময় লাগছিল। হঠাৎ ছোট্ট একটি কাঠবিড়ালি
তার গা বেয়ে কাঁধে উঠে এল।
“আমি চিম্পু। আমাকে
বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। চলো কিছু বাদাম আর মধু খেয়ে ঘুমিয়ে নেবে। আমরা কিন্তু পনেরো ঘন্টা ঘুমাই।”
পনেরো ঘন্টা! বাবা রে! এত ঘুম ঘুমাতে তো
মুনিয়া পারবে না। এমনিতেই তার খিদে পেয়েছে। তার উপর রাত্রে মা বা বাবার কাছে গল্প
শুনে ঘুমাতে যাওয়া অভ্যাস তার। ভাবতে ভাবতেই চিম্পু বলে ওঠে, “ওই যে উনি আমার মা।
চলো, খাবে চলো।”
একটা সমতল পাথরের উপর
অনেক ধরনের খাবার রাখা। পাশে পাতার উপর একখন্ড
মৌচাক। চিম্পুর কথামতো মুনিয়া এগিয়ে গিয়ে বসে পাথরের সামনে। চিনাবাদাম ছাড়াও আখরোট
কাজুবাদাম চিনতে পারে সে। এছাড়া ছোটো ছোটো অচেনা লাল ফল, কচি পেয়ারা, টোপা কুলও আছে। একটা
ভাঙা মাটির খুরিতে কিছুটা জল দেওয়া হয়েছে তাকে।
চারপাশের সবাই দূরে
দূরে গোল করে বসে খাওয়া সারছে। বাইরে বোধহয় সন্ধ্যা নেমেছে। গুহার ভিতরে কিন্তু
বাইরের চেয়ে অনেক কম ঠান্ডা। দুটো চিনেবাদাম তুলে মুখে দেয় মুনিয়া। তার হঠাৎ চোখে পড়ে কাজুবাদাম
আর আখরোটগুলো পাতলা প্যাকেটের ভিতরে রয়েছে। সে একটা কাজুর প্যাকেট তুলে দেখে তাতে
বিদেশি কোম্পানির লেবেল লাগানো। ভীষণ বিস্মিত হয়ে চিম্পুর দিকে তাকাতেই সে বলে ওঠে, “অবাক হলে নাকি। কত
বিদেশি পর্যটক এসে এই নদীর পাড়ে তাঁবু খাটিয়ে অনেকদিন থাকে আর কী সব যেন লেখালিখি করে।
নদীতে মাছ ধরে। ওদের সঙ্গে এরকম খাবার অনেক থাকে। অনেক সময় ওদের ব্যাগ
খোলা থাকে। বাবা-কাকারা গিয়ে এগুলো নিয়ে আসেন। আমরা ছোটোরা এসব খেতে খুব
ভালোবাসি কিনা। আচ্ছা তুমি আখরোট খেতে পারছ না? দাঁড়াও, মাকে বলি তোমাকে
আখরোট ভেঙে দিতে।”
“না না, আমি পারব,” বলে একটা আখরোট নিয়ে
দাঁতের ফাঁকে রেখে সজোরে চাপ দেয় মুনিয়া। শব্দ করে ভেঙে যায় আখরোট। চিম্পু
তার জোর দেখে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
একটু বাদেই চারপাশের
সব কাঠবিড়ালিরা নাক ডেকে ঘুমাতে থাকে। চিম্পুর পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে
মুনিয়া। সারাদিনের স্মৃতি এসে জড়ো হয় মনের পর্দায়। এত তাড়াতাড়ি তার তো ঘুমানোর অভ্যাস
নেই। একটা ছোটো পাথর নিয়ে গুহার দেয়ালে আজকের তারিখটা লেখার জন্য সামান্য
জোরে ঘষা দিতেই একটা ভয়ানক কান্ড হল। ওই সামান্য আওয়াজেই ধাড়ি কাঠবিড়ালিরা ওর
চারপাশে লাফ দিয়ে পড়ল। সাংঘাতিক হিংস্র তাদের চোখ মুখ।
সামনের দুটো দাঁত বিশ্রীভাবে বার করা যেন তারা এখুনি কামড়ে দেবে।
“ওহ মুনিয়া, তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে
দিয়েছিলে। যাও যাও সবাই ঘুমাতে যাও। ও বুঝতে পারেনি ঘুমের মধ্যেও আমরা কতটা সজাগ
থাকি। ঠিক আছে, আমি জেগে থাকছি। সবাই ঘুমিয়ে পড়ো,” বলেন চিম্পুর বাবা।
ঘটনার আকস্মিকতায়
মুনিয়া ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে যায়।
“দাদু, দাদু...” বলে চিৎকার করতে করতে
একটা বেজি এসে ঢোকে গুহায়।
সবাই তার দিকে ফিরে
চায়। সে বলতে থাকে, “এখান থেকে অনেকটা দূরে নদীর ধারের একটা পাথরের উপর একজন
মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তিনি একজন মহিলা। সে তো আমি দেখেছি। তারপর খবর পেলুম
সবাই একজন মা-কে খুঁজতে বেরিয়েছে যার ছানা নাকি আমাদের চিম্পুকে খুঁজে
পেয়েছে। আমি তখন বুঝলুম এই সেই। তখন একটা জলঢোঁড়া সাপকে মারতে ব্যস্ত ছিলুম। তারপর
দেখি একটা মেয়ে নদীর সঙ্গে সেলফি না কী বলে যেন সেটা তুলতে
ওদিক পানেই এল। কিন্তু আমি যদি কিছু বলতে যাই ভূত
ভেবে ভিরমি খাবে। তাই একটা বুদ্ধি বার করলুম। উফফ! দাঁড়াও এত কথা বলে হাঁপিয়ে গেছি।
একটু জিরিয়ে নিই।”
“এখানে থামলে কেন? বল প্লিজ আমার মায়ের কী হল?” আকুতি ঝরে পড়ে
মুনিয়ার গলায়।
“এট্টু জল দাও দেখি। ওই
তো জল।” মাটির খুরিতে রাখা অবশিষ্ট জলটা খেয়ে গোঁফ মুছে নেয় বেজি। অপ্রস্তুত হয়ে
মুনিয়া বলে, “এ মা, তুমি আমার খাওয়া জলটা
খেলে কেন?”
“তোমরা বাপু বড্ড জল
নষ্ট করা প্রাণী। আমরা এক ফোঁটা জলও নষ্ট করি না। যাক গে, তোমাকে বলে আর কী হবে। আসল
ঘটনা বলি...
এরপর করলাম কী, ছুট্টে গিয়ে মরা সাপটাকে নিয়ে মেয়েটার পায়ের উপর রেখে
দিলাম। ব্যস। সে তো চিৎকার করে লাফিয়ে
একাকার। কয়েকজন বন্ধু ছুটে আসছিল তার চিৎকার শুনে। এদিকে তার মাথার টুপিটা মাটিতে
পড়ামাত্র আমি সেটা নিয়ে ভোঁ দৌড় দিলাম। সবাই ছুটল আমার পিছনে। আমি গিয়ে পাথরের উপর
অজ্ঞান হয়ে থাকা মহিলার পাশে টুপিটা রেখে দৌড়ে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে জঙ্গলে ঢুকে
গেলাম। এবার তো সবাই বুঝল আমি এইজন্যই ওদের এদিকে নিয়ে এসেছি। ওরা পাঁচ-ছয় জন মিলে ওই মহিলাকে
উপরে নিয়ে গেল। বলল, “বেঁচে আছে। বেঁচে আছে। এখুনি হাসপাতালে দিতে হবে।
তারপর আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম, যদি কেউ ফেরে তার মুখে খবরটা
পাঠাব। তো কেউ দেখি ফিরল না। অগত্যা
আমাকেই আসতে হল। পথে একটা দাঁড়াশের সঙ্গে দেখা। সে তো যুদ্ধ
চাইছিল, কিন্তু বললাম কাল এখানেই থাকিস, আসব। দেখব তোর কত
ক্ষমতা। এখন একটা ভালো মানুষের উপকার করতে যাচ্ছি। কথা দিলাম কাল আসব। ও
ব্যাটা অনেক দুয়ো দিল, কিন্তু কাজ তো কাজই। তাই না? তাই অপমান হজম করেও চলে এলাম।”
মা বেঁচে আছেন। এই
খবরটা শোনার জন্যই সে উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল। সোয়েটারের
পকেটে একটা ক্যাডবেরি
ছিল তার মনে আছে। পকেটটাতে চেন দেওয়া। চেন খুলে
ক্যাডবেরিটা
নিয়ে সে বেজির হাতে দিয়ে বলল, “আর কিছুই নেই গো বেজি দাদা, এটাই নাও। প্রাণভরা
ভালোবাসা দিলাম। তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করে যেন অজগরও হেরে যায়, এই কামনা করি।”
“আরে না না। দূর, এটা তো আমার কর্তব্য।
তবে অজগর! নাহ ভাই! ওসব বড়োসড়ো ব্যাপার...
এত ইয়ে
মানে আমার নেই আর কী! চিম্পু, এত লোভীর মতো তাকিয়ে থাকিস না। তোকেও
দেব একটু। এদিকে আয়,” বলে বেজি দাদা।
রাত বাড়ে। সবাই আবার
ঘুমিয়ে পড়ে। মুনিয়াও ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোরবেলা ক্যাট ক্যাট
করে যান্ত্রিক আওয়াজে মুনিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সব কাঠবিড়ালি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। মুনিয়া একা
গুহার মুখের দিকে এগিয়ে যায় সবার বারণ সত্ত্বেও। ঠিকই
ভেবেছিল সে। তার খোঁজে নদীর উপরের ফাঁকা জায়গা
দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ছে। হিন্দি বাংলা আর ইংরেজিতে তার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে।
দু’দিকের পাহাড়ে জঙ্গলে ইঞ্জিনের শব্দ প্রতিফলিত হয়ে ভয়ানক
শব্দদূষণ শুরু হয়েছে, যার অভিঘাতে পাখি পশু সবাই আতঙ্কিত
হয়ে পড়েছে। এখুনি এই আপদকে নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হবে। সে দৌড়িয়ে নদীর তীরে যায়, তারপর হাত নাড়তে
নাড়তে দৌড়াতে থাকে। একটু বাদেই সে বুঝতে পারে হেলিকপ্টারের ভিতরে অনুসন্ধানকারীদের
নজরে পড়েছে সে। একটু নিচু হয়ে তার দিকে নামতে থাকে কপ্টারটি, কিন্তু একটু নামার
পরেই দু’দিকের জঙ্গলের গাছের ডাল দেখতে পেয়ে অনুসন্ধানকারীরা জানান
দড়ি নামানো হচ্ছে। সে যদি না পারে তাহলে হেলিকপ্টার থেকে কেউ নামবেন তাকে
উদ্ধার করতে।
মুনিয়া পিছনে তাকিয়ে
দেখে দূরে দূরে গাছের আড়ালে বেরিয়ে এসেছে কাঠবিড়ালি দলের কয়েকজন। সর্দার
মার্মটিনি, ঠাকুমা আর চিম্পুকে কোলে নিয়ে তার মা বাবা। মুনিয়ার চোখে জল আসে। ওরা
না থাকলে কাল রাতে ঠান্ডায় অনাহারে সে হয়তো মারা পড়ত। এক ছুটে
সে চিম্পুর কাছে গিয়ে তাকে আদর করে। চিম্পুর মায়ামাখা দুটো বড়ো বড়ো চোখে জল চিক চিক
করছে। মুনিয়া কোনোরকমে চিৎকার করে বলে, “কোনোদিন তোমাদের ভুলব
না। কাউকে বলব না তোমাদের কথা। এই
বিচিত্র জগতের কথা কোনোদিন কেউ জানবে না।”
আবার দৌড়ে ফাঁকা
জায়গায় চলে আসে মুনিয়া। একটা দড়ির আগায় একটা বেল্ট আটকানো অবস্থায় নিচের দিকে
নামাতে শুরু করেছে। দড়িটা কাছে আসার পর উদ্ধারকারীদের নির্দেশ মতো চওড়া বেল্টটা
কোমরে শক্ত করে বেঁধে নেয় মুনিয়া। এবার দড়ি গোটানো শুরু হয়। আস্তে আস্তে উপরের
দিকে উঠতে থাকে মুনিয়া। হেলিকপ্টারটা একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তাতেই
ঘটে একটা বড়ো বিপত্তি। মুনিয়া বেশ উঁচুতে উঠে গেছে তখন। একটা গাছের
ডালে মুনিয়ার পিঠের দিকে বেল্ট আর দড়ির সংযোগস্থলের জায়গাটা আটকে যায়। পিছন দিক
বলে মুনিয়া খুলতেও পারে না। গাছটাতে সেরকম পাতা নেই। শুধুই
শুকনো ডাল। মুনিয়া ঝুলতে থাকে, কিন্তু তার কিছুই করার নেই। কোমরে
টান ধরে ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
হেলিকপ্টার থেকে
দ্বিতীয় একটি দড়ি নিয়ে নিচের দিকে মাথা করে একজন প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী নামতে
থাকেন। হঠাৎ মুনিয়া টের পায় নিচের দিকে
জোরালো আলোচনা চলছে মার্মটিনি সর্দার ও দলবলের মধ্যে। এর পরেই চিম্পুর বাবা
ও মা উঠে আসে গাছে। দু’পায়ে গাছ আঁকড়ে সামনের দু’পা দিয়ে মুনিয়াকে
উপরের দিকে চাগিয়ে ধরে একজন। অন্যজন ডালে আটকানো জায়গাটা আলগা করে খুলে দেয়।
“আরে! এগুলো কী! কী অদ্ভুত দেখতে।
মেয়েটাকে আক্রমণ করছে ভেবেছিলাম, কিন্তু এরা তো দেখছি ওকে সাহায্য
করল,” হেলিকপ্টার থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় লোকটি বললেন। সহকর্মীরা
যাতে গুলি না চালিয়ে দেয় সেটা নিয়েও সাবধান করলেন।
আধঘন্টা বাদে
হেলিকপ্টারে কম্বল ঢাকা দিয়ে গরম কফি খেতে খেতে মুনিয়া জানাল ওরকম কোনও প্রাণী সে চোখেই
দেখেনি। তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবে মিথ্যাটা বলতেই হল, না হলে
এরা ওদের বাঁচতে দেবে না।
এই ঘটনার পর অনেকদিন
কেটে গেছে। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে নিয়ম মেনে। শুধু মুনিয়ার মা খেয়াল করেছেন যে কোনও ভালো জিনিস খেলেই
মুনিয়া সেই খাবারের একটা ভাগ বাড়ির পিছনের বাগানে দিয়ে আসে। আর মাঝে মাঝে
গাছপালার মধ্যে গিয়ে কীসব যেন বলে। তারপর খুব খুশি মুখ করে ঘরে ফিরে আসে।
অনেক জিজ্ঞাসা করেও
কেউ কিছু উত্তর পায় না। আর মুনিয়া খালি হাসে...।।
ছবিঃ সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment