নিষিদ্ধ
পৃথ্বীশ গজী
_____
ছবিঃ রাজা আক্তার
পৃথ্বীশ গজী
২০ অক্টোবর, ১৮৩০ সাল, দুপুর দুটো
“শয়তানের
অনুগামীরা জানে আমরা পুঁথিটাকে চুরি করে এই দেশে নিয়ে এসেছি। ওদের নজর আছে দেশের
সমস্ত গির্জার উপর। তারা যে কোনও সময়ে আসতে পারে এখানে। তাই এই পুঁথি থাকবে তোমার
কাছে। তুমি আর তোমার বংশধরেরা, যেভাবে বলেছি ঠিক সেইভাবেই, লুকিয়ে রাখবে একে। এটা
যে তোমার কাছে আছে, সেটা ওরা কল্পনাও করতে পারবে
না। ফলে আর কখনও জেগে উঠবে না শয়তান।”
চেহারা সাহেবদের মতো হলেও
বাংলার সঙ্গে মিশে গেছেন ফাদার জনাথন। তাঁর জন্মও এখানে। শান্ত আর নম্র এই মানুষটিকে প্রচণ্ড ভক্তি করে স্থানীয়
খ্রিষ্টানরা। তাঁর প্রতিটি কথাই যেন এক একটা আদেশ। তাই আর কোনও প্রশ্ন করল না সুবল
উইলিয়াম দাস। ফাদারের হাত থেকে পুঁথিটাকে নিয়ে নিজের ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে হাঁটা
লাগাল বাড়ির দিকে।
এই পুঁথি বড়ো ভয়ংকর। ফাদার নিজে তাকে দেখিয়েছেন বইটা যেমন জলে ভেজে
না, তেমনই ছাই হয়ে যায় না আগুনে পুড়েও।
৩০ নভেম্বর, ২০১৯, সকাল দশটা
“আবার রহস্যমৃত্যু। মৃত্যুটা বড়ো অদ্ভুত। প্রাণহীন কঙ্কাল পড়ে আছে বিছানায়। চারপাশ রক্তে মাখামাখি,
অথচ মৃতের শরীরে সামান্যতম মাংস নেই। গায়েব হয়ে গেছে যাবতীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গও। ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল রাতে। ভদ্রলোক একাই নিজের ফ্ল্যাটে থাকতেন। গতকাল রাত দশটা নাগাদ শেষবারের মতো
ফ্ল্যাটে ঢোকেন ভদ্রলোক। তারপর তাঁকে আর বেরোতে দেখেনি অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি
গার্ড। বিগত এক বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইরকম মৃত্যু ঘটেছে মোট বারোটি। সব ক’টাই ঘটেছে মাসের শেষ শনিবারে। পুলিশ এখনও দিশেহারা…”
উত্তেজিত ছেলেটা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বয়ান দিয়ে চলেছে। নাম খুব সম্ভবত ঋক। টিভিটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল অনুপম। তার ভালো লাগছে না এই ঘ্যানঘ্যান। সোফায় গা এলিয়ে
দিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল সে। নিউজওয়ালা থেকে পুলিস, সবাই খুঁজে বেড়াক খুনিকে। অনুপমের কোনও টেনশন নেই।
পুলিশের কাছে যে সামান্যতম তথ্য দিতে পারত, সেই সপ্তক তো নিজেই একটা প্রাণহীন কঙ্কালে পরিণত হয়েছিল বছর খানেক আগেই।
২৮
ডিসেম্বর, ২০১৯, রাত বারোটা
মোমবাতিটা আগেই জ্বালিয়েছিল অনুপম। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই সেটাকে হাতে নিয়ে, ঘরের আলো আর
দরজা বন্ধ করে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। ডিম্বাকৃতি আয়নাটা বেশ বড়ো। সামনে দাঁড়ালে দেখা যায় গোটা শরীর।
আয়নার উপরে দেয়ালের গায়ে সেঁটে আছে একটা টিকটিকি। মাথাটা নীচে, লেজটা উপরে। সরীসৃপটিকে মোটেও পছন্দ করে না অনুপম। মনে হয় অবাঞ্ছিত কেউ একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে তার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোর দিকে। কিন্তু বারবার ওটাকে তাড়িয়েও কোনও লাভ হয়নি। টিকটিকিটাকে উপেক্ষা করেই সে আয়নার দিকে তাকাল। আয়নার ওপারেও দাঁড়িয়ে আছে অনুপম। কালো রঙের আলখাল্লা আর টুপিটা অন্ধকারে মিশে গেলেও মোমবাতির আলোতে দেখা যাচ্ছে তার মুখখানা।
অনুপমের ভুরু দুটো স্বাভাবিকের তুলনায় একটু চওড়া। তার নিচে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। ছুঁচলো নাক আর চওড়া কপালটুকু বাদ দিয়ে মুখময় লেপটে আছে কয়েকদিনের না কাটা দাড়ি। অন্ধকারে অনুপমকে দেখলে ভয় পাবে যে কোনও দুর্বলচিত্ত মানুষ। কিন্তু ভয় শব্দটা তার অভিধানে নেই। উলটে পৃথিবীতে যা কিছু নিষিদ্ধ আর বিপদসংকুল, সে সবের প্রতি অনুপমের অমোঘ আকর্ষণ। আজও সে অদ্ভুত পোশাক পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণের জন্যেই।
বিগত
এক বছর ধরে ঘটে যাওয়া বারোটা মৃত্যুর পিছনে লুকনো রহস্যটা জানে কেবল সেই।
যে নিষিদ্ধ খেলায় অনুপম মেতে উঠেছে তার মূলে ছিল সপ্তক। ছোটোবেলায় সপ্তক ছিল অনুপমের প্রাণের বন্ধু। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে ভাটা পড়তে শুরু করে কলেজ জীবনের শুরু থেকে।
স্কুল পাশ করে মেধাবী অনুপম অ্যাডমিশন নিয়েছিল কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজে। পড়াশুনায় কখনই ভালো ছিল না সপ্তক। তার কপালে জুটেছিল সাধারণ কলেজের একটা সিট।
কলেজ জীবন থেকেই দূরত্ব
বাড়তে শুরু করেছিল দুই বন্ধুর। বয়স একটু বেড়ে যেতেই অনুপমের মতো সাফল্যের শৃঙ্গ ছুঁতে
চলা একজন মানুষের কাছ থেকে নিজেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিচ্ছিল সপ্তক। অনুপমের বাড়িতে
আসা বন্ধ করে দিয়েছিল সে। চট করে রিসিভ করতে চাইত না অনুপমের ফোনও।
অনুপম অনেক চেষ্টা করেছিল বন্ধুত্বটাকে
টিকিয়ে রাখার। কিন্তু এক হাতে তো আর তালি বাজে না! শেষ পর্যন্ত
বাধ্য হয়েই হাল ছেড়ে দিয়েছিল অনুপম। কলেজ
শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি দুই বন্ধুর। কিন্তু নিষিদ্ধের প্রতি অনুপমের আকর্ষণের কথা অজানা ছিল না সপ্তকের। সেই জন্যেই বছর খানেক আগে এক সন্ধেবেলায় সে হানা দিয়েছিল অনুপমের বাড়িতে।
বাবা-মা গত হওয়ার পর দোতলা
বাড়িটাতে একলাই থাকে অনুপম। এতদিন পর সপ্তককে দেখে অবাক হয়েছিল সে, “তুই! এতদিন পরে?”
“ভিতরে আসতে দিবি। কথা আছে।”
কেমন যেন সিরিয়াস দেখাচ্ছে
সপ্তককে! অনুরোধটা ফেলতে পারেনি অনুপম, “আয়।”
ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সপ্তক নিজেই। তারপর ড্রয়িং রুমের সোফার উপরে বসে সরাসরি ঢুকে
পড়েছিল প্রসঙ্গে, “একটা জিনিস আছে। নিষিদ্ধ। আমাদের পারিবারিক প্রপার্টি।”
সপ্তকের কথা
শুনে আরও অবাক হয়েছিল অনুপম,
“কী জিনিস?”
“একটা বই। দ্য বুক অফ ডেভিল। তুই চাইলে তোকে বিক্রি করতে পারি।”
উত্তেজনা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে সপ্তকের চোখ মুখ দিয়ে। কিন্তু ওর কথায় ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না অনুপমের। কয়েকদিন আগে ওদের স্কুলের একজন
বন্ধুর মুখেই সে শুনেছিল যে সপ্তকের অবস্থা খুব খারাপ। যে কারখানায় কাজ করত, বন্ধ
হয়ে গেছে সেটা। তাই কথাটার সত্যতা যাচাই করার জন্যে অনুপম বলেছিল,
“আচ্ছা! তোদের বাড়িতে এরকম বই আছে আগে বলিসনি তো?”
“আরে, আমি বইটার কথা জানতে পারি স্কুল ফাইনাল পাস করার পর। বাবা আমাকে বলেছিল। যতদিন বাবা বেঁচেছিল বইটা বাবার জিম্মায় ছিল। এখন আমার হাতে এসেছে। তুই চাস কিনা বল? নইলে আমি অন্য লোক দেখব। দেখ ভাই, স্পষ্ট কথা।
আমার টাকার খুব দরকার। কিন্তু যতক্ষণ ক্ষমতা আছে হাত পাততে চাই না কারুর কাছে।”
এবার একটু হলেও উৎসাহ বোধ
করেছিল অনুপম, “বইটা এনেছিস?”
“হ্যাঁ।” উত্তর দিয়েছিল সপ্তক। নিজের ব্যাকপ্যাক থেকে বার করেছিল কালো কাপড়ে মোড়া
একটা পুঁথি।
বইটা হাতে নিতেই একটা শিহরণ
খেলে গিয়েছিল অনুপমের শরীর জুড়ে। আর ঠিক তখনই তার কানে এসেছিল
সপ্তকের হাসির শব্দ, “কী ভাই? কারেন্ট লেগেছে?”
“হুঁ…” দায়সারা উত্তর দিয়েছিল অপ্রস্তুত অনুপম। তার মন বলছে একটা রহস্য আছে বইটার মধ্যে। কাপড় সরিয়ে বইটাকে বার করেছিল সে। বইটা শক্ত কালো মলাটে মোড়া। কালোর উপরে সোনালি হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘দ্য বুক অফ ডেভিল’ — যার বাংলা করলে দাঁড়ায় শয়তানের পুঁথি।
ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বোধ করছিল অনুপম। তবুও সপ্তকের দিকে তাকিয়ে নিস্পৃহভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী আছে এই বইতে?”
“আমি দেখিনি," চটজলদি উত্তর
দিয়েছিল সপ্তক, “বাবার বারণ ছিল। খালি নামটাই দেখেছি।”
সপ্তক তাড়াহুড়ো করছে। কিন্তু সময় নিচ্ছিল অনুপম। জেরা করার ভঙ্গিতেই তার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল প্রশ্নটা “বইটা কীভাবে তোর বাড়িতে এল?”
“ঠিক জানি না,” ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে সপ্তক, “তবে শুনেছি ব্রিটিশ আমলে কোনও
একজন ফাদার আমাদের এক পূর্বপুরুষকে বইটা রাখতে দিয়েছিলেন। এখন তুই নিবি কি না বল? না হলে আমি অন্য খদ্দের দেখব।”
“এক মিনিট।” বইটা খুলেছিল অনুপম। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলোই বলে দেয় বইটার বয়স নেহাত কম নয়। বইটার ভিতরে ইংরাজিতে লেখা আছে অনেক কিছু। হরফগুলো কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও পড়া যায় দিব্যি।
কয়েকটা পাতা ওলটাতেই অনুপম বুঝতে পেরেছিল এই ইংরাজি মধ্যযুগীয়। আর সবথেকে বড়ো এই বইটার ভিতরে বর্ণনা দেওয়া আছে স্বয়ং শয়তানের
— তাঁর রূপের, তাঁর
ক্ষমতার। পাতা ওলটাতে ওলটাতে শেষে এক জায়গায় এসে থেমে গিয়েছিল অনুপম। বাঁদিকের পাতার উপরে বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে — ‘কীভাবে তাঁকে আহ্বান করা হয়?’
নিষিদ্ধ পৃথিবীর দরজা যেন হঠাৎ খুলে গিয়েছিল অনুপমের সামনে। কিন্তু আরও কয়েকটা পাতা ওলটানোর পর হঠাৎ ধাক্কা খেল সে।
বইয়ের শেষ তিনটে পাতা ছেঁড়া!
“এই পাতাগুলো কোথায়?”
সপ্তককে জিজ্ঞেস করেছিল অনুপম।
এতক্ষণ বেশ মেজাজে কথা বললেও এবার ঢোঁক গিলেছিল সপ্তক,
“পুরোনো বই। যেভাবে পেয়েছি নিয়ে এসেছি। তুই চাইলে আমার বাড়ি সার্চ করে দেখতে পারিস। এই পাতাগুলো আমি লুকিয়ে রাখিনি।”
“হুম,” নিজের মনেই বলে উঠেছিল অনুপম। তার মন বলছিল সপ্তক মিথ্যা বলছে না। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অনুপম বলেছিল,
“কত দেব বল তোকে?”
“পনেরো হাজার,” গলার জোর আবার ফিরে এসেছিল সপ্তকের।
“মানে!”
মুখে একবার উষ্মা প্রকাশ করলেও
পরমুহূর্তেই নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছিল অনুপম। একদিকে যেমন বইটা হাতছাড়া করতে মন চাইছিল না তার, অন্যদিকে
তেমনই দরদাম করতেও ইচ্ছা করছিল না পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত পনেরো হাজার টাকার
ক্যাশ সে তুলে দিয়েছিল সপ্তকের হাতে।
সপ্তক চলে যেতেই বইটা খুলে বসেছিল অনুপম। প্রথম অংশটা পড়ে অবাক
হয়েছিল সে।
শয়তান
যে অসীম ক্ষমতাধর! তাঁর ক্ষমতা হার মানায় স্বয়ং ঈশ্বরকেও!
বইয়ের
এই অংশটা শেষ
করেই অনুপম চলে গিয়েছিল শেষ পার্টে, যেখানে লেখা আছে কী ভাবে আহ্বান করা হয় শয়তানকে।
ব্যাপারটা কঠিন কিছু না। কিন্তু ওই অংশের শেষ কয়েকটা লাইন নজর কেড়েছিল অনুপমের – ‘অনুগামীর আহ্বানে তিনি সাড়া দেন ইংরাজি মাসের শেষ শনিবার। রাত বারোটায়। এই বই নিজে পড়ে তাঁকে যারা আহ্বান করবে, একমাত্র তাদের
ডাকেই সাড়া দেবেন তিনি।’
এর পরের পাতাগুলোই ছেঁড়া। কিন্তু সেদিকে আর খেয়াল ছিল না অনুপমের। গরম হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তার রক্ত। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। পরদিন মানে শুক্রবার রাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই সে এসে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে।
মাসের
শেষ শনিবার
যে এসে গেছে!
তার আগেই
দিনের বেলায় অফিস ছুটি নিয়ে বাজার ঘুরে মাথার কালো হ্যাট আর আলখাল্লা জোগাড় করে ফেলেছিল অনুপম।
প্রথমদিন শয়তানকে আহ্বান করার সময় প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে
শুরু করেছিল তার শরীর। এরপর বারোবার প্রভুকে আহ্বান করা হয়ে গেলেও, আয়নার সামনে
দাঁড়ালেই প্রথম দিনের সেই অনুভূতিটা প্রতিবার নতুন করে অনুভব করে অনুপম।
আজ তেরোতম দিন। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই খাড়া হয়ে গেল অনুপমের প্রতিটি রোমকূপ। দু’হাত দিয়ে মোমবাতিটা সে তুলে ধরল মুখের সামনে। তারপর গম্ভীর গলার বলে উঠল, “Thou
may arrive. Thou may arrive. Thou may arrive.”
মন্ত্রপাঠ শেষ হওয়ার পরেই প্রতিবারের মতোই নিভে গেল মোমবাতিটা। পোড়া মোমের গন্ধ ধাক্কা মারল অনুপমের নাকে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে।
এইসময় শয়তান ভর করেন অনুপমের উপর। তার শরীরে আসতে শুরু করে অদ্ভুত সব পরিবর্তন। কিছুক্ষণের জন্য সে নিজেই হয়ে ওঠে শয়তান।
এই সময়টা বড়ো রোমাঞ্চকর অনুপমের কাছে। শিকার
যত দূরেই থাকুক না
কেন মুহূর্তের মধ্যে সে পৌঁছে যায় সেখানে।
অবশ্য কোন মানুষ তার শিকার হবে সেটা ঠিক করে দেন প্রভু নিজেই। কোনও এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে
অনুপম অনায়াসে ঢুকে পড়ে হতভাগ্য মানুষটার ঘরের মধ্যে। ঘরের মধ্যে একলাই
থাকে মানুষটা। সেই হতভাগ্যকে প্রভুর কাছে ভোগ নিবেদন করলেও তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না অনুপম নিজেও। প্রথমেই শিকারকে গলা টিপে মেরে ফেলে সে। তারপর একটু একটু করে খেয়ে ফেলে তার মাংস,
সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে। তার উদরপূর্তিতেই ক্ষুধা মেটে প্রভুরও।
বিনিময়ে অনুপমের মেলে এক নিষিদ্ধ আনন্দ আর স্বাদ গ্রহণের ছাড়পত্র।
কাজ শেষ হয়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে অনুপম আবার ফিরে আসে নিজের রুমে। কাকপক্ষীতেও টের পায় না যে একটু আগেই ঘটে গেছে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
নরখাদক অনুপম এখন জানে কাঁচা হলেও নরমাংস সব থেকে বেশি সুস্বাদু!
ইদানীং চিকেন মটন কোনোটাই আর মুখে রোচে না তার।
এই সময়ে চোখের জোর বেড়ে যায় অনুপমের। অন্ধকার যতই গাঢ় হোক না কেন সে স্পষ্ট দেখতে পায় সব কিছু। আয়নার দিকে তাকিয়ে
অনুপম নিজের পরিবর্তনগুলোর জন্যে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ দেয়াল থেকে টিকটিকিটা ডেকে উঠল টিক টিক টিক। তারপরেই অনুপমের কানে এল একটা ধাতব কণ্ঠস্বর, “আমাকে চিনতে পারছ?”
প্রথমবার প্রভু তার আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পর অনুপম শুনেছিল এই কণ্ঠস্বর। সেদিন প্রভুই ওকে বলে দিয়েছিলেন তার করণীয় কী কী। আজ আবার সেই কণ্ঠস্বর! অনুপম বলে উঠল, “প্রভু আপনি?”
“হ্যাঁ,” উত্তর দিল ধাতব কণ্ঠস্বর, “তুমি জানো পুঁথির শেষ তিনটে পাতায় কী লেখা আছে?”
প্রভু কি তাঁকে বলবেন ওই তিনটে পাতায় লুকনো রহস্যের কথা! নতুন কোনও রোমাঞ্চের দরজা কি খুলে যাবে তার জন্যে! উৎসাহিত হয়ে উঠল অনুপম, “না প্রভু।”
“তুমি জানবে। সামনে তাকাও।” আবার সেই কণ্ঠস্বর। সামনে তাকাল অনুপম। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে লেপটে থাকা টিকটিকিটা লাফ দিয়ে নেমে পড়ল তার সামনে মেঝেতে।
আয়না আর অনুপমের মাঝের দূরত্ব চার ফুট। টিকটিকিটা সেখানে পড়ার পরেই অনুপম দেখল মানুষের মতো দু’পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সরীসৃপটা। আস্তে আস্তে
লম্বায় ও চওড়ায় দু’দিকেই বড়ো হতে শুরু করেছে সেটার শরীর।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই
উচ্চতায় টিকটিকিটা ছুঁয়ে ফেলল অনুপমকে। তারপরেই হাঁ করল ওই
নোংরা সরীসৃপটা।
মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছে প্রাণীটা। গরম হাওয়ার সঙ্গে তার মুখ থেকে একদলা লালা ছিটকে বেরিয়ে এসে লেপটে
গেল
অনুপমের নাকে। হতভম্ব অনুপম সেই বিষাক্ত আর দুর্গন্ধযুক্ত লালার হাত থেকে রক্ষা
করতে
পারল না নিজেকে। সে কেবল দেখল তীক্ষ্ণ দু’পাটি দাঁতের মাঝখানে লক লক করছে
জিভটা।
মুহূর্তে শিকার ধরার ভঙ্গিতে ভিজ বার করল ওই বীভৎস প্রাণীটা। এবারও অনুপম বাঁচাতে পারল না নিজেকে। লালায়
ভেজা সেই জিভ অনুপমের গালে যেন একটা সপাটে চড় মেরে ফিরে গেল স্বস্থানে।
এর মধ্যেই
হঠাৎ খসে পড়ল ওই টিকটিকিটার লেজ। প্রায় দেড় হাত লম্বা লেজটা মেঝেতে পড়ে দু-চারবার
নড়াচড়া করার পর স্থির হয়ে গেলে একটা পচা গন্ধে ভরে উঠল ঘরখানা।
পালানো
তো অনেক দূর, প্রচণ্ড বিস্ময় আর জীবনে প্রথমবার পাওয়া
ভয়ের চোটে তখন নিজের নাকটাও চাপা দিতে ভুলে গেছে অনুপম। এদিকে ঘন কালো লোমে ঢেকে যেতে শুরু করেছে সরীসৃপটার শরীর।
ফুলে উঠছে তার নাকের পাটা। ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো লাল হয়ে জ্বলতে শুরু করছে ভাঁটার
মতো।
তার
মুখ জুড়ে ভর করছে এক জান্তব হিংস্রতা!
ক্রমশ
একটু চৌকোনা আর ছোটো হয়ে এল প্রাণীটার ধড়। চওড়া হল কাঁধ। লম্বা হতে শুরু করল হাত আর পাগুলো। সঙ্গে তখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে
তার নখগুলোর তীক্ষ্ণতা।
বদলে যাওয়া টিকটিকিটাকে দেখে চিনতে পারল অনুপম। এই রূপ তো সে প্রতি মাসের শেষ শনিবারেই দেখতে পায়, শিকারে যাওয়ার আগে।
তবে সেটা আয়নার বাইরে নয়, ভিতরে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার অনুপমের কানে এল সেই ধাতব কণ্ঠস্বর, “পুঁথিটার শেষ অংশে কী লেখা আছে তা তুমি এতক্ষণে নিশ্চয়ই
বুঝতে পেরেছ অনুপম। যে আমার জন্যে বারোটা শিকার করে, তেরো নম্বর শিকার হিসাবে আমি বেছে নিই তাকেই। মনুষ্যেতর কোনও প্রাণীর মধ্যমে গ্রহণ করি
তার মাংস।”
ভয় তো আগেই পেয়েছিল অনুপম,
কিন্তু প্রভুর কণ্ঠস্বর শুনে খালি হয়ে গেল তার বুকের ভিতরটা। শয়তানের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। সম্বিৎ ফিরতেই নিজেকে বাঁচাবার জন্য তাই পালাতে চাইল সে।
কিন্তু ততক্ষণে ভারি হয়ে গেছে তার পা দুটো। চিৎকার করে উঠতে চাইল অনুপম। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না তার।
ঠিক যেমনটা হয় অনুপমের অন্য
শিকারদের…
প্রচণ্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেল অনুপমের শরীর।
লোমশ আর তীক্ষ্ণ নখযুক্ত আঙুলগুলো পেঁচিয়ে ধরতে শুরু করেছে তার গলা। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল অনুপমের। একজোড়া চোখ
তখন নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভীষণ লোভে চকচক করছে সে দুটো।
শিকারকে শেষ করে দেওয়ার আগে ঠিক
এমন অভিব্যক্তিই তো খেলা করত অনুপমের চোখে।
সংজ্ঞা হারানোর আগের
মুহূর্তে অনুপম আবার শুনতে পেল সেই ধাতব কণ্ঠস্বর, “আমার
অনুগামীরা শেষ তিনটে পাতা ছিঁড়ে নিলেও ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি পুঁথিটাকে।
আর ওরা ভেবেছিল, বোকা আর ভিতু ভারতীয়রা কখনও আমাকে জাগাবে না।
কিন্তু ওরা দেখতে পায়নি ভবিষ্যতটাকে।”
কথাটা শেষ হতেই এক পৈশাচিক
অট্টহাসিতে ভরে উঠল অনুপমের ঘরখানা।
সেই ভয়ঙ্কর পিশাচ ততক্ষণে অনুপমের প্রাণহীন দেহটাকে
শুইয়ে দিয়েছে মাটিতে।
ধারালো নখ দিয়ে চিরতে শুরু
করেছে তার পেটের পেশী।
২৯
ডিসেম্বর, ২০১৯, রাত ন’টা
ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিল ঋক। ঋকদের
অ্যাপার্টমেন্টটা
একটা ফাঁকা গলির শেষ মাথায়। সেখানে ফার্স্ট ফ্লোরে একটা ছোট্ট
ফ্ল্যাটে একলাই থাকে ঋক।
আজ ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। তার উপর সারাদিন খাটনিও গেছে খুব। গতকাল রাতে কলকাতায় অদ্ভুত মৃত্যু ঘটে গেছে আরও
একজন মানুষের। ভদ্রলোকের নাম অনুপম মিত্র। খবরটা কভার করতে একজন সহকর্মীর সঙ্গে
যেতে হয়েছিল ঋককে।
অন্যদিন এই সময়ে তার শরীর আর
মন জুড়ে ভর করে অসম্ভব ক্লান্তি। কিন্তু আজ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঋকের মনে হল জার্নালিস্ট না
হয়ে সে যদি ওই অদ্ভুত মৃত্যুগুলোর কাণ্ডারি হত!
তাহলে…
পুলিশ, মিডিয়া হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াত তাকে।
আর সে আড়ালে বসে হাসত এদের
পণ্ডশ্রম দেখে।
কত রোমাঞ্চকর হত এই জীবন!
পুলিশ হদিশ দিতে না পারলেও
ঋকের দৃঢ় বিশ্বাস এই খুনগুলোর পিছনে আছে কোনও অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাশালী খুনি।
সাংবাদিকতার সূত্রে একটু পড়াশুনা আছে বলেই অলৌকিক ব্যাপারগুলোকে সে নিছক কুসংস্কার
বলে উড়িয়ে দিতে পারে না। পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান
দিতে পারেনি।
অ্যাপার্টমেন্টের গেটটা দেখা যাচ্ছে একটু
দূরেই। তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল ঋক। হঠাৎ পায়ের সামনে কালো কাপড়ে মোড়া কিছু পড়ে
থাকতে দেখে থমকে গেল সে।
জিনিসটাকে দেখে ভীষণ কৌতূহল
হল ঋকের। মনে হচ্ছে একটা বই রয়েছে কাপড়ের মধ্যে জড়ানো।
অবাঞ্ছিত বস্তুটাকে পিছনে
ফেলে এগিয়ে যেতে পারল না ঋক। চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিশ্চিন্ত হল সে। শীতের রাতে কেউ
দেখছে না তাকে।
আর দেরি করল না ঋক।
এক অমোঘ আকর্ষণে কাপড়ে মোড়া
বস্তুটাকে তুলে নিল নিজের হাতে…
ছবিঃ রাজা আক্তার
No comments:
Post a Comment