গল্পের ম্যাজিক:: শেষ প্রহর - শাশ্বত কুমার ধর


শেষ প্রহর
শাশ্বত কুমার ধর

আর কতদূর রে?জিজ্ঞেস করলাম কিংশুককে
আর আধঘন্টা মতো হবে কুলডিহা থেকে আমরা চলেছি জোড়াচুয়ার পথে কুলডিহা উড়িষ্যার একটা ছোট্ট জঙ্গল সেখানে ফরেস্ট বাংলোতে আমরা উঠেছিলাম আমরা বলতে আমরা চার জন - আমি, কিংশুক, তমাল, সোমনাথ দু’কামরার ঘর ডাইনিং স্পেস, অ্যাটাচ বাথ সবই আছে ছবির মতো পুরো বাংলোটা চারিদিকে পরিখা কেটে হাতির থেকে নিরাপদ করা হয়েছে এখানে ইলেকট্রিক লাইট নেই, সোলার লাইট আমাদের প্ল্যান ছিল বাংলোতে দু’রাত্তির কাটিয়ে বাড়ি ফেরা কিন্তু এখানকার কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে একটা নতুন প্ল্যান করা হল এই বাংলো থেকে নয় কিলোমিটার দূরে জোড়াচুয়া বলে আরও একটা বাংলো আছে, সেটা নাকি আরও গভীর অরণ্যে আরও ঘন জঙ্গল সবাই ঠিক করে এক রাতের জন্য ওই বাংলোতে থাকা যাক বাংলো বুকিং করতে অসুবিধা হল না, এই বাংলো থেকে বুকিং করে দেয়া হল এর মধ্যে কিংশুক প্রস্তাব দেয় আজকে রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত এগারোটার পর জোড়াচুয়ার বাংলোর পথে বেরিয়ে পড়া যাক একটা দারুণ রোমাঞ্চকর জঙ্গল সাফারি হবে, আমার ধারণা ছিল এতে সবাই রাজি হবে না ভুল ভাঙল প্রস্তাবটা দিতেই সবাই লাফিয়ে উঠল অতএব সেই রাত্রে আমাদের জঙ্গল সাফারি হচ্ছে
জমাট বাঁধা অন্ধকার সারা রাতের মতো একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে এত রাতে কেউ তাকে তাড়া দেবে এটা তার চিন্তারও বাইরে ছিল সুমোর হেডলাইটের আলো অতি কষ্টে তাকে কেবল রাস্তা থেকে উঠিয়ে জঙ্গলে ঠেলে ফেলে চলতে শুরু করল গাড়ি এগিয়ে যেতেই হুড়মুড় করে আবার পিছনে পথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে অন্ধকার দু’পাশে গভীর বন হেডলাইট পড়তে সেখানে থিতু হয়ে বসা অন্ধকার দুড়দাড় করে উঠে পালাচ্ছে নৈঃশব্দেরও যে একটা শব্দ আছে সেটা পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারছি গাড়ি এগিয়ে চলে চুপচাপ বসে হেডলাইটের আলোতে যতটা দেখে নেয়া যায় সেটা দেখে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করি যেন মহাপ্রলয়ের অপেক্ষায় সবাই এই বোধহয় কোনও জানোয়ার বেরিয়ে আসবে মাঝে মাঝে হাতি গাছ ভেঙ্গে রাস্তায় ফেলে রেখেছে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের ড্রাইভার মনাদা চারিদিকে দেখে নিয়ে নেমে যায় ভাঙ্গা গাছ সরিয়ে দেয় পথ থেকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয় পথ জঙ্গল আরও গভীর গাড়ির গর্জনই একমাত্র সঙ্গী, এটাই সাহস জোগাচ্ছে
মনাদা আগেই বলেছিল এই বাংলোয় কেউ থাকে না, রান্নাবান্না নিজেদের করে নিতে হবে বাংলোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয় সেটাও জানিয়েছিল বিশেষ করে এই বাংলোতে কেউ আসে না তার মূল কারণ হল নাকি এই বাংলো অভিশপ্ত ভূতুড়ে বাংলো আমাদের ভূত দেখার শখ বহুদিনের এই বাংলো অভিশপ্ত ভূতুড়ে শুনে আমাদের আরও জেদ চেপে যায় যে এই বাংলোতে গিয়ে থাকতেই হবে দেখতে হবে ভূতুড়ে বাংলোর অর্থ কী? এর মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম বাংলোর সামনে রাস্তা থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে বড়ো বড়ো গাছ আগাছা একেবারে জড়িয়ে ধরেছে বাংলোটাকে, একেবারে দম বন্ধ করা অবস্থা বহু বছর বোধহয় কেউ আসেনি মনাদা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল কড়াৎ কড়াৎ শব্দে প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্লাটা খুলল দু’কামরার বাংলো, অনেকটা কুলডিহার বাংলোর মতো মাঝে বসার জায়গা মনাদা গাড়ি থেকে জল নামিয়ে দিয়ে বার বার সাবধানবাণী শোনাল, কোনোভাবেই যেন রাতে দরজা না খুলি বলল, রাত্তিরে চেনা কেউ ডাকলেও যেন দরজা না খুলি যা দেখার এই বাংলোর ছাদ থেকে দেখতে আমরা ওর ভয় দেখে খুব হাসাহাসি করতে লাগলাম তখন মনাদা বলল,বাবু, আপনারা শহরের লোক, আপনারা এসব মানবেন না কিন্তু এ জঙ্গলে অনেক কিছু আছে যা পৃথিবীর নিয়মে চলে না
তো তুমিও থাকো” কিন্তু মনাদা কিছুতেই ভূত বাংলোতে থাকতে রাজি হল না যেন পালাতে পারলেই বাঁচে, এমনকি কোনও পয়সা কড়িও চাইল না
গাড়ি নিয়ে চলে গেল, কালকে আবার এসে আমাদের নিয়ে যাবে রাত তখন প্রায় বারোটা মনাদা গাড়ি নিয়ে চলে গেল গাড়িটা চলে যেতে, বিশেষ করে গাড়ির হেডলাইটের আলোগুলো বন্ধ হয়ে যেতে অন্ধকার যেন আরও একেবারে জাঁকিয়ে বসল প্রথম কথা বলল সোমনাথ,এটা কোথায় এলাম?”
তমাল বলল,হ্যাঁ, কীরকম গা ছমছমে
ব্যাপারটা কী?” কিংশুক বলে উঠল,ভূত দেখার এত শখ? ভূত কি কলেজ স্কোয়ারে বসে আড্ডা দেবে?”
সে তো বুঝলাম কিন্তু শোব কোথায়? থাকব কোথায়?”
শোবার কথা ছাড় এখন ছাদে চল ছাদ থেকে রাতের জঙ্গল দেখার মজাই আলাদা
চল
আমাদের সঙ্গে কয়েকটা টর্চ, কিছু মোমবাতি এসব ছিল ঘরে দুটো মোমবাতি জ্বেলে রেখে আমরা ছাদে গেলাম কোনও শব্দ নেই, নিঝুম অন্ধকার আমি কিংশুককে বললাম,কিংশুক, যতই ভুতুড়ে লাগুক রাতের এই জঙ্গলে নিয়ে আসার জন্য তোমার একটা থ্যাংকস প্রাপ্য
এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলে দেখলাম টর্চের আলো যেন কালো রাতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আকাশে চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে না, মেঘ গ্রাস করেছে চাঁদ
সোমনাথ বলল,আজকের মূর্তির ব্যাপারটা কিন্তু মজা হয়েছে
কী হয়েছে, সকালে কুলডিহা জঙ্গলের আশেপাশে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি একটা জায়গায় দেখি একটা বড়ো কাঠামো কোনও মূর্তি নেই, শুধু খড় বাঁধা কাঠামো টাইপের, আর অদ্ভুত ব্যাপার কাঠামোটার হাতে একটা ঘন্টা ঝোলানো এই মূর্তিটা দেখেই মনাদা কীরকম একটু ভয় পেয়ে গেছিল ফিসফিস করে বলেছিল, লক্ষণ ভালো নয় বাবু এ তো অপদেবতার মূর্তি এই মূর্তি এখানে কোথা থেকে এল? এই মূর্তির কাছে যে  যায় তার কপালে দুর্ভোগ আছে
আমরা সে সব পাত্তা দিইনি এমনকি কিংশুক আর সোমনাথ মূর্তির সঙ্গে কয়েকটা সেলফি তুলে নেয় ফিরে আসার সময় লক্ষ করি মূর্তির পায়ের কাছে কিছু সিঁদুর মাখানো, তার মানে এখানে নির্ঘাত পুজো হয়
তমাল বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি ভেবে দেখ এই অন্ধকারে যদি মূর্তিটা দেখতাম তাহলে কিন্তু বেশি ভয় পেয়ে যেতাম
তা বটে আমরা আসলে অন্ধকারকে ভয় পাই
যাই হোক, এখানে কোনও ভূত আছে বলে তো মনে হচ্ছে না প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল আমরা এসেছি, ভূত বাবাজি থাকলে কি একবারও সাড়া দিতেন না?”
বলতে বলতে কড়াৎ কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল
বৃষ্টি হবে নাকি? চল চল নিচে চল বৃষ্টি আসছে” বলতে বলতে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামল নিচে আসতে আসতে বৃষ্টি বাড়তে শুরু করল দেখতে দেখতে প্রবল বৃষ্টি শুরু হল জঙ্গলের মধ্যে প্রবল বৃষ্টি, যে দেখেনি সে অনুভব করতে পারবে না কী প্রলয় ঘটে চার জন একসঙ্গে বসার জায়গায় বসে আছি মাঝে মাঝে সবাইকে চমকে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আলোর ঝলক অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সেই মুহূর্তের জন্য তারপরে আবার সব অন্ধকার
হঠাৎ ঘরের মধ্যে দুম করে বেশ জোরে শব্দ হল আমরা একটু চমকে উঠলাম চার জনে আলো জ্বালিয়ে দরজার সামনে গেলাম ঘরের ভেতর আলো ফেললাম কোথাও কিচ্ছু নেই, এবার সাহস করে ঘরে ঢুকলাম তন্ন তন্ন করে চারদিকে দেখলাম কিছুই বুঝতে পারছি না একটু একটু গা ছমছম করছে সোমনাথ বলল,এই তো ভূতের উপদ্রব শুরু হল
ভূতের উপদ্রব না আরও কিছু
শব্দটা কীসের?”
এত পুরোনো বাংলো কোথাও কোনও কিছু ছিল, সেটা হয়তো পড়ে গেছে আমরা সকালে বুঝতে পারব
তমাল মাথা নাড়ল,যাই বল ব্যাপারটা ভালো দেখছি না ভূতের ব্যাপারে তমালের উৎসাহ ছিল সব থেকে কম কিংশুক, আমি আর সোমনাথ সবচেয়ে বেশি মেতে উঠেছিলা ভূতের ব্যাপারে
বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু সেই বৃষ্টির ধারার মধ্যে যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম দূরে কোথাও একটা ঘন্টা বাজছে আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম রাত প্রায় একটা বাজে এত রাতে ঘন্টার শব্দ! কিংশুক জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল,আরে না না এসব বনের আদিবাসীদের ব্যাপার ওই দেখিস না আমাদের ওখানে বাজ পড়লে অনেকে শাঁখ বাজায় এরা ঘন্টা বাজিয়ে বৃষ্টি তাড়ানোর চেষ্টা করছে
তা হলেই ভালো,” তমাল বলল আবার আমরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসলাম খানিকক্ষণ নীরবতা খানিকক্ষণ পরে আবার ঘন্টার আওয়াজ এবার যেন আরও একটু কাছে
কী ব্যাপার বল তো?” সোমনাথ বলল
কিংশুক বলল, একবার বেরিয়ে দেখলেই হয়
তমাল হঠাৎ বলল,দরজা খোলার কোনও প্রয়োজন নেই
তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
ওই মূর্তিটা নিয়ে মজা করা উচিত হয়নি ওর হাতে একটা ঘন্টা ছিল মনে আছে?”
মানে তুই বলতে চাইছিস তাহলে একটা কাঠামো ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে তাই তো?”
ইয়ার্কি কোরো না রাত একটা দেড়টা বাজে এই সময়ে এরকম গভীর জঙ্গলে ঘন্টা বাজছে এর মানে কী?”
হঠাৎ বসার জায়গার জানালাটা ঝড়ের দাপটে খুলে গেল, আর একটা দমকা হাওয়ায় মোমবাতিটা নিভে গেল কিংশুক বলল,এই রে জানালাটা বন্ধ কর সব বৃষ্টিতে ভিজে যাবে
আমি উঠে গেলাম জানালাটা বন্ধ করতে ঠিক সেই সময় একটা বাজ পড়ল বিদ্যুতের আলোতে আমি দেখতে পেলাম সেই কাঠামোটা আমাদের বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে
মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল
ভেতর থেকে কিংশুক চেঁচিয়ে উঠল,আরে জানালাটা বন্ধ করছিস না কেন?”
আমি কোনোরকমে বললাম, ওই মূর্তিটা এখানেও
কী?”
সবাই ছুটে এল জানলার কাছে সব ক’টা টর্চের আলো বাইরে গিয়ে পড়ল
কিন্তু কোথাও কিছু তো নেই! ফাঁকা
এই তমালটা ভয় পেয়ে সবার মনে ভয় ঢোকাচ্ছে,” বলতে বলতে কিংশুক জানালাগুলো বন্ধ করে দিল আমি সোফায় বসে পড়লাম আমি এত ভুল দেখলাম?!
জানালাটা বন্ধ করে ঘরে মোমবাতি জ্বালানো হল মোমবাতির আলোয় দেখলাম ঘরের মেঝেতে লাল লাল কী গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে
এগুলো কী?”
মনে হচ্ছে আবির বা সিঁদুর টাইপের কিছু
এগুলো ঘরে এল কোত্থেকে?”
ওই মূর্তির পায়ে সিঁদুর ছিল,” তমাল বলল আমরা সবাই তাকালাম তমালের দিকে
এখন একটু একটু ভয় ভয় করতে শুরু করল কিংশুক সব সাহস এনে বলল,আরে না না, ওসব কিছু না, হয়তো আগে থেকেই ছিল এতক্ষণ খেয়াল করিনি বা কোনও গাছ থেকে এসেছে সকাল হলেই বোঝা যাবে
তমাল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,এ রাতের সকাল হবে তো?”
সবাই নিজেদের দিকে তাকালাম এই প্রশ্ন সবার মনে কিছু কিছু রাত যেন বড্ড লম্বা হয় শেষ হতে চায় না এও যেন সেরকম এক অনন্ত রাত
রাত তখন প্রায় আড়াইটে, আমরা সবাই বসে আছি বসার ঘরে সেরকম আর কিছু ঘটেনি আমাদের সাহস একটু একটু ফিরে এসেছে বৃষ্টির দাপট কমে এল কিংশুক বলল,ধুর কিছুই হচ্ছে না চল একটু ছাদে যাই
এর মধ্যে ছাদে? আচ্ছা চলো
তমাল বলল,না, না, আমি যাব না
তাহলে তুই একা অন্ধকারে বসে থাক খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তমাল আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল ছাদের দরজার সামনে গিয়ে কিংশুক বলল, আরে কী হল, দরজাটা এত টাইট হয়ে গেল কী করে?” বলে বেশ খানিকক্ষণ দরজার সঙ্গে কিংশুক ধস্তাধস্তি করতে লাগল হঠাৎ তার মধ্যে আমরা শুনলাম সেই ঘন্টার আওয়াজ, এবার যেন খুব কাছে কী হল? সবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে
আচমকা দরজাটা খুলে গেল কিংশুক ছিটকে পড়ল ছাদের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল
কী হল ব্যাপারটা? সোমনাথ গায়ের জোরে দরজাটা ঠেলতে লাগল হঠাৎ নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কিংশুকের আর্তনাদ ভেসে উঠল আ আ
একবার, আরও একবার তারপর সব নিস্তব্ধ
কিংশুক, কিংশুক” আমরা দরজার এপার থেকে চিৎকার করতে লাগলাম দরজা খুলছে না ঘন্টার আওয়াজ ক্রমে কাছে আসছে হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল আমরা তিন জনে দৌড়ে এলাম কোথায় কী? এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেললাম? কিংশুক কোথায় গেল? ছাদ পুরো ফাঁকা
এখানে সোমনাথ ছাদের থেকে নিচের দিকে টর্চের আলো ফেলেছে টর্চের আলোতে দেখা যাচ্ছে কিংশুক পড়ে আছে মাটিতে দ্রুত গতিতে নিচে নেমে এলাম, দরজা খুলে দৌড়ে গেলাম বাইরে কিংশুকের শরীরটা উপুড় হয়ে পড়েছে কিংশুক, কিংশুক অনেক ডাকাডাকি করলাম কোনও সাড়া নেই সোমনাথ পালস দেখে বলল,অজ্ঞান হয়ে গেছে ভেতরে নিয়ে যাই ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দেখি বাংলোর দরজা বন্ধ ছুটে গিয়ে দরজাটা খোলার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম কিন্তু না, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে
এবার কী হবে?” সোমনাথ তমাল সবার মুখ ফ্যাকাশে
ফোনে টাওয়ার নেই যে কাউকে খবর দেব
একটাই উপায় এখান থেকে কুলডিহার বাংলোয় ফিরে যাওয়া
ফিরে যাওয়া? এই রাতে জঙ্গলে হেঁটে?”
কিছু করার নেই এখানে থাকলে কেউ বাঁচব না
কী আলতু ফালতু বলছিস,” সোমনাথ বলল
আলতু ফালতু নয় তুমি বলো কিংশুক পড়লে কী করে?”
জানি না কিন্তু হতেই পারে ছাদে কোনও জন্তু-জানোয়ার উঠেছিল তাদের তাড়াতেই হয়তো পড়ে গেছে
আর ঘন্টার আওয়াজ?” বলতে বলতে আবার সেই ঘন্টার আওয়াজ বেজে উঠল কিন্তু এবারে আওয়াজটা অন্যরকম মনে হচ্ছে, কেউ ছন্দে ছন্দে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে, তার হাতে ঘন্টা ধরা একবার মনে হচ্ছে আওয়াজটা আসছে বাংলোর ভেতর থেকে, পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে আওয়াজটা জঙ্গল থেকে আসছে তমাল বলল,এই দরজা খুলতেই হবে ভেতরে ঢুকতেই হবে
অদ্ভুতভাবে তমাল হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলোর দরজাটা খুলে গেল আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে কিংশুককে ধরাধরি করে শুইয়ে দিলাম বসার জায়গার সোফায়
তারপর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে চিৎকার করে উঠল সোমনাথ চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম দরজার সামনে যেখানে এতক্ষণ কিংশুক ছিল, সেখানে কে যেন সেই মূর্তিটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তার হাতে একটা ঘন্টা হাওয়াতে ঘন্টাটা একটু করে দুলছে আর আওয়াজ হচ্ছে হঠাৎ কেমন খেপে উঠল সোমনাথ ঘর থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ল কাঠামোটার উপরে ঘন্টাটাকে খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল বহু দূরে কাঠামোটাকে তুলে আছাড় মেরে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলল আমরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটবে কিন্তু না কিছুই ঘটল না সোমনাথ ফিরে এল হাঁপাতে হাঁপাতে,আর কখনও ঘন্টা নিয়ে আমাদের কেউ ভয় দেখাবে না
দরজাটা বন্ধ করে দিলাম তখন প্রায় সাড়ে তিনটে কিংশুকের তখনও জ্ঞান ফেরেনি একটা রাত জাগা পাখি জঙ্গলের বুক চিরে ডেকে উঠল
বাকি রাতটুকু এখানে বসেই কাটিয়ে দিই সূর্যের আলো ফুটলে একটু নিশ্চিন্ত
না না চিন্তার কিছু নেই যা ছিল ভূত-প্রেত সব নষ্ট করে দিয়েছি শুধু কিংশুকের জ্ঞানটা ফিরে আসুক
আর কোনও ঘন্টার আওয়াজ নেই কিছু নেই চারিদিকে অসীম নিস্তব্ধতা হঠাৎ এই স্তব্ধতার মধ্যে একটা শব্দ আমাদের স্নায়ুগুলোকে টান টান করে তুলল
একটা পায়ের আওয়াজ কেউ যেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে বাকিদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম কিংশুককে রেখে তিনজনে উঠলাম সিঁড়ি্র কাছে যেতেই চমকে উঠলাম
নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিংশুক দাঁড়িয়ে আছে!!
কী ব্যাপার রে? আমি ছাদে গেলাম, তারপর দরজাটা কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না তোদের কত ডাকলাম তারপর দরজা ধাক্কা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ওখানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এখন দেখলাম দরজা খোলা
আমাদের মুখ দিয়ে কোনও কথা বার হচ্ছে না কিংশুক তাকিয়ে আছে
আরে তোরা বোবা হয়ে গেলি কেন? ওরে আমি কিংশুক আমি কোন ভূত নই
কিংশুক এগিয়ে গেল সোফার দিকে আমরা নড়তে পারছি না
আরে ওটা কী?”
ঘুরে দেখলাম যেখানে একটু আগে কিংশুক শুয়েছিল সেখানে একটু পরিবর্তন হয়েছে এখন সেই জায়গায় শুয়ে আছে একটু আগে সোমনাথের টুকরো টুকরো করা কাঠামোটা
হঠাৎ তমাল চিৎকার করে উঠে দরজা খুলে দৌড় লাগাল একটু ইতস্তত করে সোমনাথও আমি দাঁড়িয়ে আছি চোখের সামনে কাঠামোটা শুয়ে আছে
কী ব্যাপার হল?” কিংশুক বলল পালাব কোন দিকে? আমার সামনে এ কে? কিংশুক না অন্য কেউ?
আমার পা কাঁপছে কোনোরকমে দরজা খুলে দৌড় শুরু করলাম এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে বুঝতে পারলাম আশেপাশের অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে আসছে অন্ধের মতো দৌড়াতে লাগলাম কতবার পড়ে গেলাম, কেটে গেল কিছু খেয়াল নেই, দৌড়াচ্ছি হঠাৎ শুনতে পেলাম ঘন্টার আওয়াজ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম – একটা, দুটো, তিনটে ঘন্টা এগিয়ে আসছে
না, শুধু ঘন্টা নয় ঘন্টাগুলো ধরে আছে তিন জন মানুষ এই তিনজনকে আমি চিনি কিংশুক, সোমনাথ, তমাল সবাই দাঁড়িয়ে হাসছে
চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল, জ্ঞান হারাবার আগে শুনতে পেলাম ঘন্টার সেই আওয়াজটা – ঢং ঢংঢং
_____

No comments:

Post a Comment