নীলপাখির খোঁজে
কপিলদেব সরকার
* * *
কপিলদেব সরকার
পর পর দুই রাত একই স্বপ্ন দেখল তিতিল। প্রথম
রাতে যে স্বপ্নটা, পরের
রাতেও হুবহু সেটাই। কী আশ্চর্য, না?
এরকমটা যে হতে পারে, সেটা তিতিল-কে আগেভাগেই বলে দিয়েছিল মুশকা দাদু। বেগনি
দাড়ি চুমরে চোখ মটকে গম্ভীর গলায় বলেছিল বুড়ো মুশকা,
“দ্যাখ তিলতিল, মিতিল কিন্তু আসবেই। আর
যেদিন আসবে, ঠিক
তার আগ দিয়ে তুই পর পর তিন রাত একটা মজার স্বপ্ন দেখবি।” তিতিল জানত, মিতিল এলেই তাদের অভিযান শুরু।
কী কী অ্যাডভেঞ্চারে যাবে,
কার পরে কোনটা – সে সব মুশকা দাদুর সঙ্গে শলা করে কবে থেকেই লিখে রাখছে তিতিল।
যেমন ধরা যাক, প্রথমেই যেতে হবে একটা থমথমে,
টিমটিমে জায়গায়, যেখানে চারপাশটা কালো কালো অক্ষরের মতো ঝুলকালিমাখা, আর তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে ছেঁড়া
ছেঁড়া আকাশ আর মিটমিটে তারা দেখা যায়। সেখানে
একটা গোপন কাজ আছে। মুশকা দাদু কিন্তু পই পই করে
বলে দিয়েছে – ‘যে
কাজে নামতে চলেছ, তার
একটা বড়ো শর্ত হল মন্ত্রগুপ্তি।’ পেট-পাতলা হলে চলবে না।
চারদিকে লোভীর দল ওঁত পেতে আছে। তিতিল, মিতিল, আর মুশকা দাদু – এই তিন জন ছাড়া কাকপক্ষীতেও
যেন কিছু টের না পায়। বাকিদের সামনে এই নিয়ে কথা
বলার দরকার নেই, বললেও
সাংকেতিক ভাষায়।
“কিন্তু মিতিল আসবে, তবে তো? কবে থেকেই তো বলছ এইসব,
তার তো পাত্তাই নেই”
– ঠোঁট উলটে বলেছিল তিতিল।
মুশকা দাদু তখন গম্ভীর মুখে তার থলে থেকে একটা কিছু বের করে প্রথমে
নিজের মনে বিড়বিড় করেছিল, তারপর সেটা তিতিলের হাতে দিয়ে মুঠোটা শক্ত করে বন্ধ করে দিয়ে বলেছিল, “আমি চলে যাবার পরে এইটা খুলে
দেখবি। মন দিয়ে মিতিলের কথা ভাববি, আর রাতে অবশ্যই বালিশের নিচে
মাথার ডানদিকে জিনিসটা রেখে ঘুমোতে যাবি।”
দাদু যাবার পর তিতিল মুঠো খুলে দেখল,
একটা নীল পাখির পালক। এত
ঘন নীল সে এর আগে কখনও দেখেনি।
তিতিলের সঙ্গে মুশকা দাদুর যোগাযোগটা কীভাবে হয়েছিল সেটা একটু
বলা দরকার। মিতিল-ই বা কে, তারও একটু আন্দাজ দিতেই হয়।
তিতিল যখন প্রথম এই বাড়িটায় থাকতে এল,
তখনও সে এই নাদুশনুদুশ,
বেঁটেখাটো, বেগনি-দাড়ি আর গ্যালি-দেওয়া ঢোলা ইজের পরা বুড়োটাকে চিনত না মোটেই।
বাড়িটার উত্তরে যে জংলা মতো একটু জায়গা আছে, আর বেশ ঝাঁকড়া আর মোটা বেড়ের
একটা গাছ আছে, সেখানেই
প্রথম লোকটাকে দেখে তিতিল। তিতিল
অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে দেখে লোকটা তেমনি চোখ মটকে আর বেগনি দাড়ি চুমরে তিতিলকে
বলেছিল, “আ
মোলো যা। বলি ভূত দেখছ নাকি? তিলতিল এসেছে মুশকার কাছে – এতে আশ্চর্য হবার কী আছে শুনি? এ তো হয়েই থাকে।”
তিতিল তাতে এতই ঘাবড়ে গেল, যে প্রথমটা খেয়াল করতেই ভুলে গেল কখন লোকটা তার দুই হাত নাগালের
মধ্যে চলে এসেছে।
“তু-তুমি কে?”
“সে কী? চিনতে পারছ না? আমায় দেখে কারও কথা কি মনে পড়ছে না?”
তিতিল একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“প-পড়ছে। তবে
যাদের কথা পড়ছে, তারা
কেউ সত্যি নয়।”
লোকটা এবার ফিক করে একটু হেসে ফেলল। বলল, “বল কী? অনেকের কথা একসঙ্গে মনে পড়ছে? তারা আবার নাকি সত্যি নয়? এইবার মনে হচ্ছে সত্যি তিলতিল-কেই পেয়ে গেছি।
তা বেশ, বল শুনি, কাদের কথা মনে পড়ছে আমায় দেখে?”
“আচ্ছা, তুমি আমায় চিনলে কীভাবে?
আর আমাকে তিলতিল বলছ কেন?
আমি তো তিতিল,” এতক্ষণে খানিকটা হুঁশ ফিরে পেয়ে বলে উঠল তিতিল।
বুড়ো ঠোঁট উলটে বলল, “সে হবে তোমাদের দুনিয়ায় আর সবার কাছে, আমার কাছে তুমি তিলতিল।
কারণটা পরে বলব। এবার
তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও দেখি।”
“উদো, বুধো, হিজিবিজবিজ, ককভানিয়া বুড়ো, আর সেই যে, সেই গাল-তোবড়ানো, চামড়া-কুঁচকানো, মস্ত ঝালরের মতো গোঁফওয়ালা বুড়োটা
- কী যেন নামটা? সেই যে মুশ, মুশ...’ তিতিল হুড়মুড় করে
বলে গেল। শেষ নামটা মনে করতে পারল না
বলে চোখদুটো কুঁচকে গেল তার, ঠোঁটটা ছুঁচলো হয়ে এল।
“লাগ্-লাগ্-লাগ্-লাগ্ লেগেছে-এ-এ...,” পেল্লায় একটা লম্ফ দিল বুড়ো। “শাব্বাস, আর কোনও সন্দেহ নেই, আমি ঠিক জায়গাতে এসেছি।
কী ভাগ্যি নুশকা বলল,
নীলপাখির খোঁজে পৃথিবীর অন্য কোথাও না, ঠিক যেতে হবে বাংলা দেশেই,” শেষ কথাটা বলার সময় বুড়োর
চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল যেন।
‘নুশকা’ শুনে তিতিল লাফিয়ে উঠল। “আরে! তুমি কি সেই রাশিয়ার রূপকথার
নুশকা আর মুশকা গল্পের মুশকা-বুড়ো?”
“আহা, আহা, এই না হলে তিলতিল। এবার
মিতিল-কে
পেলেই ষোলোকলা পুরো হয়। ছোঁড়া ঠিক ধরে নিয়েছে,” নিজের মনেই বলতে বলতে বার
দুয়েক বাঁই বাঁই পাক খেয়ে নেয় বেগনি-দাড়ি আর ঝোল্লা-ইজের মুশকা বুড়ো। তারপর
গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ
রে ছেলে, আমিই
সেই। আর কে কয় সত্যি নয়? দেখছিস তো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে
রয়েছি। রুশ গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা, তারপর এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তোদের
দেশে পৌঁছোনো কি চাট্টিখানি কথা? উফফ, কোমর একেবারে ধরে গিয়েছে!” বুড়ো আড়মোড়া ভাঙে। তিতিলের
আবার যেন কার কথা মনে পড়ে যায়। লোকটা
কথার ফিকির কতরকমই যে জানে!
“তুমি এখানে কেন? কবে এলে?” শুধোয় তিতিল। বুড়ো
গ্যালি-দুটো
কাঁধের ওপর ভালো করে টেনে নেয়, তারপর পশমি আস্ত্রাখান টুপিখানা কপালের উপরদিকে উঁচিয়ে বলে, “শোন দাদু, তুই তো রূপকথা অনেক পড়েছিস – তোর দেশে এখনও রূপকথা পড়ে খোকাখুকুরা
সেটা আমি জানি – তাই
আমি এখানে এসেছি। বলা ভালো তিলতিলের কাছে এসেছি।
তোর নাম তিতিল তো? কিন্তু তোর সঙ্গে আমাদের এই তিলতিলের ভীষণ মিল।
নুশকা বুড়ি আমায় তোর কথা বলেছে। দেখি, একটু এদিক পানে আয় তো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো, দোহারা গড়ন, লম্বাটে চিবুক, একমাথা উলুকঝুলুক চুল – সব মিলে যাচ্ছে।
বাঃ, ঘাড়ের কাছে দাগটাও আছে দেখছি। চমৎকার।”
“মিতিলের কথা কী বলছিলে?
মিতিল কে?” তিতিল একটু অধীর হয়ে বলে। বেলা
পড়ে আসছে, আর
মুশকা বুড়ো কাজের কথাটা না বলে খালি এ-কথা সে-কথা পেড়ে চলেছে।
“নুশকা আর আমায় যেমন চিনলি,
উদো-বুধো, হিজিবিজবিজ-এর কথাও তুললি, মিতিলকেও চিনতে পারলে তোকে একশোয় একশো দিতে পারতুম,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মুশকা-বুড়ো। “যাই
হোক, আজ
চলি। কাল এই সময়ে আবার আসিস।
এখন তো মাঝে মাঝেই দেখা হবে। রইল
মিতিল। তিলতিলকে পাওয়া গেল যখন, মিতিলকেও পেয়ে যাব নিশ্চয়ই।
এ ছাড়া নীলপাখির খোঁজ পাওয়ার আর কোনও রাস্তা নেই।”
বুড়োকে চলে যেতে দেখে তিতিল তড়িঘড়ি বলে উঠল, “আরে, কী মুশকিল! চললে কোথায়? মিতিল কে সেটা তো বলে যাবে?” নিমেষে বুড়ো আরও একবার বাঁই-বাঁই করে পাক খেয়ে নিল।
বেগনি দাড়িখানা বেশ ভালো করে চুমরে নিল। মনে
হয় ঘন দাড়ির আড়ালে একবার হাসলও। তারপর
কোমরে বাঁধা থলেখানায় সুট করে হাত ঢুকিয়ে কী একখানা হাতড়ে বের করে এনে সেটা বাড়িয়ে
দিল তিতিলের দিকে।
“নে, আজ রাতে বেশ ভালো করে পড়ে ফেল বইটা। এতে
মিতিলের কথা আছে।”
তিতিল বইটা হাতে নিয়ে দেখল। চামড়ায়
বাঁধানো, পুরোনো
একখানা বই। পড়তি আলোয় বাদামি মলাটের ওপর
সোনালি অক্ষরে নামটা দেখতে পেল – ‘নীলপাখি’ - লেখকের নাম মরিস মেটারলিঙ্ক। এ
নাম তার অচেনা। ভেতরের দুটো পাতা উলটেই মিতিল-কে দেখতে পেল তিতিল।
তারপর হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল,
কিন্তু মুশকা-বুড়োকে দেখতে পেল না।
বরফ-ঢাকা প্রান্তরে দু’পাশে পপলার আর পাইন গাছের সারি,
তার মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে এঁকেবেঁকে।
নিচে নদীর ধারে যে সবুজ ঘাসের টিলাটা,
তার ওপরেই বুড়ো আর বুড়ির ছোট্ট কুঁড়ে। মুশকা
আর নুশকা। জায়গাটা রাশিয়ার উত্তরদেশে, যেখানে ভীষণ শীতে মানুষের ভুরুগুলো
পুরু তুষারকণায় ঢেকে যায়, আর দাঁতে দাঁতে দারুণ খটখটি লেগে যায়,
আর আগুন খুব ঢিমে আঁচে জ্বলে। আগে
ওদের তল্লাটে অনেক লোকের বাস ছিল, মানুষে মানুষে মিলমিশ ছিল,
হাসি-মশকরা ছিল, আনন্দ ছিল, শীতের রাতে একজোট হয়ে আগুন-জ্বালাবার গান ছিল। বাচ্চাদের
হাসি আর গানে চতুর্দিক খুশির মরশুম হয়ে যেন ফুটত সারাটা ঋতু। মুশকা
আর নুশকা – দুই
বুড়োবুড়িকে তখন পায় কে? নাতিনাতনিদের আবদার মেটাতে কখনও তারা গল্পের ঝুলি খুলে বসছে, কখনও স্লেজগাড়ির তলা শিরীষ
কাগজ ঘষে মসৃণ করছে, আবার
কখনও লাল-লাল, গোল-গোল, চ্যাপটা-চ্যাপটা পিঠে বানাচ্ছে।
সেইসব দিনের মোলায়েম সকালগুলোয় আদুরে পাইনের বনে ঢুকলেই যে কেউ
শুনতে পেত, পাতায়
হাওয়ার শনশন শব্দ, আর
মিষ্টি পাখির ডাক। টুট-টু, টু-টুই। টুই-টু, টুট-টুই। নুশকা
আর মুশকা জানত, ঐ
হল নীলপাখিদের দল। ওরা দেখা দেয় না, তবু ওরা যতদিন আছে, যতদিন ওদের ডাক শোনা যাচ্ছে, ততদিন আনন্দও আছে।
ওরা যেদিন চলে যাবে, সেদিন থেকে মানুষের মনে শুধু লোভ আর হিংসার বাড়বাড়ন্ত হবে।
মানুষ আর রূপকথায় বিশ্বাস করবে না।
ঠিক তাই হয়েছিল। নীলপাখিরা
বিদায় নিয়েছিল একে একে। সবাই ছুট্টে এসে জিজ্ঞেস করেছিল
ওরা কোথায় গেল। মুশকা আর নুশকা সবাইকে বলেছিল, যেখানে ভালোবাসা নেই, গল্প নেই, হাসিকান্না মুক্তো হয়ে ঝরে
না, রূপকথা
সেখানে বাঁচে না, নীলপাখিরাও
সেখানে আর থাকতে পারে না। ওরা উড়ে গেছে নতুন কোনও জায়গায়।
এখন উপায় একটাই – একজোড়া নীলপাখিকে যদি এখানে আবার ফিরিয়ে আনা যায়।
“ওদের খুঁজে বের করা যায় না?” জানতে চেয়েছিল সারা গাঁ।
নুশকা-মুশকা জানত, সে বড়ো সহজ কাজ নয়। ওদের
খুঁজতে হলে আগে তাদের খুঁজে বের করতে হবে,
যারা প্রথম ওদের সন্ধানে গিয়েছিল। পথের
সুলুক ওরাই দিতে পারে। শুনে সবাই বেশ মুষড়ে পড়ল।
মুশকা আর নুশকা কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
তাছাড়া সবাই হাত গুটিয়ে নিলে চলে কী করে? তাই সেই থেকে বুড়ো মুশকা তিলতিল
আর মিতিলের সন্ধানে দিনরাত এক করে ফেলছে। কিন্তু
ইদানীং হয়েছে এক নতুন উপদ্রব। রূপকথা
পড়ে, এমন
মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায়। যদিও বা পড়ে, বিশ্বাস করে না।
খুদে খুদে ছেলেপিলের দল এখন পিঠে বস্তা বেঁধে স্কুলে যায়, আর খুব ভারী ভারী বইপত্তর সারাদিন
মুখস্থ করে। এখন পৃথিবীতে ভয়ানক বিজ্ঞানের
যুগ, অজানা
কিচ্ছু নেই। তাই খোকাখুকুরা আর কিছুতে আশ্চর্যও
হয় না। আকাশের দিকেই তাকায় না, পাখি কী করে চিনবে? মুশকা বুড়ো পড়ল মহা মুশকিলে।
তখন নুশকা বুড়ি দিল বুদ্ধিটা।
“এক কাজ কর। বাংলা
দেশে এখনও লোকে গল্প-টল্প
পড়ে। মনে হয় রূপকথা পড়তেও একেবারে
ভুলে যায়নি। সেখানে গিয়ে কিছুদিন আস্তানা
গাড়ো। ঘোরাফেরা করে দেখ ওদের পাও
কিনা।”
“বেশ তো। বাংলা
দেশের কোন তল্লাটে যাব? ওদিকটা তো আমি আবার ঠিক চিনি না।”
নুশকা শুধোল, “চেনো না? বলি কলকেতা চেন তো?”
“ইশ! সে না চিনলে চলে? আমাদের উপেন-সুকুমার-লীলার বাড়ি,” বলে জিভ কাটে মুশকা।
“তবে রাস্তা শোনো। তিব্বত - রানাঘাট - ডায়মন্ডহারবার - কলকেতা।
ঘন্টা পোয়া ঘন্টার পথ বই নয়। কলকেতায়
নেমে তারপর খোঁজ লাগাবে, বুঝেছ?”
মুশকা বুড়ো ভাবে, ভালোই তো। ঘুরে
দেখবে, কানে
শুনবে, পড়ে
বুঝবে। এই হল মন্ত্র।
পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষজনই এখন একরকম, সবারই চোখ লোভে চকচক করে।
তিলতিল - মিতিল তো আলাদা। আশা
করা যায় ওদের দেখলেই চেনা যাবে।
তাজ্জব ব্যাপার! পর পর তিন রাত্তিরই ঠিক ঐ একই স্বপ্ন দেখল তিতিল। আর
ঠিক তার পরদিন তিতিলের মাসতুতো বোন রুমকি বেড়াতে এল তিতিলদের বাড়ি।
তিতিলের চেয়ে দু’বছরের ছোটো হলে কী হবে, বেজায় স্মার্ট।
ইংরেজি বলতে পারে গটমট করে। তিতিল
রুমকিকে কী ভেবে চুপিচুপি বলেই ফেলল, “দেখ রুমি, যদি কাউকে না বলিস, তোর সঙ্গে আজ বিকেলে একটা দারুণ মজাদার লোকের দেখা করিয়ে দেব।”
রুমকি চোখ নাচিয়ে বলল,
“হাঃ, তুই আবার ক’টা মজার লোককে চিনিস?
সারাদিন তো বইতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকিস। ফেসবুকে
আয়, ইউ
উইল গেট টু নো লটস অব ফানি পিপল। জানিস
আমার ফ্রেন্ডস কতজন? মোর
দ্যান থাউজ্যান্ড।”
“ঐ নকল বন্ধু নিয়েই তুই থাক। আমি
একজন জলজ্যান্ত মজাদার মানুষের কথা বলছি রে বোকা। বলিস
তো চল নিয়ে যাই।”
“ওকে, ডান,” হেসে উঠল রুমকি, “তবে ইফ আই ফাইন্ড দিস ফেলো বোরিং,
আমি কিন্তু কালকেই বাড়ি ফিরে যাব বলে রাখলাম।”
তিতিল আনমনা হয়ে বলল,
“ফেলো নয় রে, ওল্ড ফেলো। জানি
না তোকে নিতে রাজি হবে কিনা! যা বাজে বকিস তুই।”
সেদিন বিকেলে মুশকা বুড়ো দেখা দিল না। মোটা
বেড়ের গাছটার কাছে কতক্ষণ অপেক্ষা করল ভাইবোন মিলে। তারপর
রুমকি তো ভীষণ রেগে গেল, তিতিলকে বলেই দিল, “লায়ার। নেহাৎ
তুই ফেসবুকে নেই, নইলে এক্ষুনি তোকে আনফ্রেন্ড
করতাম।” তিতিল খুব মুষড়ে পড়ল।
রাতে রুমকির ঘরে গিয়ে তিতিল বলল,
“দেখবি রুমি, এই বইটা পড়েছিস কিনা?”
“আমি বই-ফই পড়ি না। ফেসবুক
করছি। বোর করবি না,” রুমকি চোখ না তুলেই বলল।
“দেখ, এটা তোর আর আমার গল্প রে। একটুও
বোরিং না। দারুণ ইন্টারেস্টিং।
তুই তোর মোবাইলেই পড়ে নে না হয়। যদি
ভালো না লাগে, তাহলে
তুই যা চাইবি তাই পাবি, কথা দিচ্ছি।”
একটু নড়েচড়ে বসল রুমকি। “রিয়েলি? ওকে। লেট
মি সী দেন। যদিও ও বই দু’পাতার বেশি পড়লেই ঘুম
পেয়ে যাবে। দে, বইটা দিয়ে যা।”
মুশকা দাদুর বইটা তিতিল রুমকির বেডসাইড টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছে, তখন রুমকি দুষ্টু হেসে বলে
উঠল, “গল্পটা
ভালো না লাগলে তোর থেকে কী চাইব শুনে যা দাদা। তোকে
ফেসবুকে প্রোফাইল খুলতে হবে।”
মিতিলকে পাওয়া গেল শেষ অবধি!
সেদিন রাতে তিতিলের দেওয়া বইটা পড়তে শুরু করে কী যে হয়ে গেল রুমকির! এক পাতা, দু’পাতা করে এগোচ্ছে, আর কখন, কীভাবে এক মায়াবী দুনিয়ায় হারিয়ে
যেতে লাগল দু’জনে মিলে। অ্যাডভেঞ্চার।
পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে আশ্চর্য সব রহস্য। নীলপাখিদের
খুঁজে বের করা চাই। হাসি, গান, আনন্দ ফিরিয়ে আনতে হবেই পৃথিবীর
বুকে। শীতের রাতে একসঙ্গে জ্বালাতে
হবে আগুন। খুঁজতে খুঁজতে তিলতিল আর সে
হারিয়ে যেতে লাগল গহীন অরণ্যে, গাছের গহন ছায়ায়। হারিয়ে
যেতে এত আরাম, এত
আনন্দ - নীলপাখির
সন্ধানে না গেলে তার জানাই হত না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বালিশের নিচে মাথার ডানদিকে ঘন নীল একটা
পাখির পালক পেয়েছিল রুমকি। মুশকা
বুড়োর সঙ্গে তিতিল বা তার আর দেখা হয়নি। তবে
ফেসবুক প্রোফাইলে এখন তার নাম সে পালটে ফেলেছে,
রেখেছে ‘মিতিল’। তিতিলকেও
ছাড়েনি। ধরে এনেছে তাকেও ফেসবুকের অরণ্যে
– ‘তিলতিল’
তার নাম। দুজনেই নীলপাখিদের খুঁজছে, ছেঁড়া ছেঁড়া, কালো কালো অক্ষরের আনাচে কানাচে।
আর ঘন নীল পালকের নিশান এঁকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের দেয়ালে দেয়ালে।
ছবিঃ জয়িতা বিশ্বাস
ভাল লাগলো
ReplyDeleteDarun... russian upokatha and subplot hisebe Bongo... super duper Sir
ReplyDelete