মাথায় যদি আকাশ ভেঙ্গে পড়ে
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
মোট্টু
মুরগি খুঁটে খুঁটে দানা খাচ্ছিল বাপিদের উঠোনে। হঠাৎ তার মাথায় গাছ থেকে কী যেন
একটা পড়ল। আধখাওয়া ফলই হবে সম্ভবত, কিন্তু মোট্টুর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু অন্যরকম
কিনা, তাই সে ভাবল -
- “বুঝি
বা মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে! এটা নিশ্চয়ই তারই টুকরো একটা। এই সেরেছে! যদি সত্যিই
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে কি আর এভাবে মনের আনন্দে ঘুরে ঘুরে দানা খেতে পারব?
সব্বোনাশ! এখুনি খবরটা সবাইকে জানাতে হচ্ছে।”
যেমনি
ভাবা, মোট্টু ছুট্টে গেল তার প্রাণের বন্ধু পাত্তু পাতিহাঁসের কাছে। সে থাকত
বাপিদের পাশে ছোটুদের বাড়িতে। পাত্তু তাকে ওভাবে দু’পায়ে লাফাতে লাফাতে হাঁপাতে
হাঁপাতে আসতে দেখে শুধাল,
-
“ও কী মোট্টু, ও কী! তোমার হলটা কী?”
-
“আর বল কেন ভাই, উপর থেকে পড়ছে দেখ
আকাশ ভাঙ্গা চাঁই!”
-
“সে কী! ভাঙলে আকাশ খাব কী? নামলে জলে
আকাশতলে চাপেই ডুবে যাব কি?”
-
“তাই তো ভাবি, ভাবতে ভাবতে খাচ্ছি
খাবি। উপায় কিছু করতে হবে, তুমি আমার সঙ্গে যাবে?”
-
“কোথা?”
-
“ঐ যে হোথা! যেথায় থাকে রাজু
রাজহাঁস।”
-
“রাজু? তার তো বেজায় দেমাক বারোমাস!”
-
“হোক গে দেমাক। আমরা কি আর খাচ্ছি
তামাক? করব কি আর গপ্পো বসে? খবরখানা জানাই আগে, ফের দেখি তো কী করে সে!”
এই না বলে
তারা দু’জন গেল রাজু রাজহাঁসের কাছে। সে থাকত আরেকটু দূরে বঙ্কুদের বাড়িতে।
বঙ্কুরা বেশ বড়োলোক। আর রাজুও মোট্টু বা পাত্তুর মতো এলেবেলে কাউকে খুব একটা
পাত্তা দিত না, তার ওঠাবসা সব ঐ ছক্কু ছাগল আর খুরুপ্পি খরগোশের মতো হোমরাচোমরা বা
চটপটে লোকেদের সঙ্গে। তবে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার খবর শুনে সে থমকে গেল।
-
“বলিস কী রে তোরা! ভাঙলে আকাশ
হুড়মুড়িয়ে আগার থেকে গোড়া, থাকব কোথায়, বাঁচব কীসে, ভাবতে হবে যুক্তি কষে; নইলে
কপাল পোড়া।”
খানিক
ভেবে সে বলল, “একবার ছক্কু ছাগলকে গিয়ে শুধালে কেমন হয়? সে একটা বিহিত করতে পারবে
নিশ্চয়!”
মোট্টু
একটু আমতা আমতা করে বাজারে ছক্কুর বেয়াক্কেলে বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে যেসব উড়ো খবর ভেসে
বেড়ায়, সে সব বলতে যাচ্ছিল। একটু কিন্তু কিন্তু করছিল, তবে ছক্কুর প্রতি রাজুর
অগাধ আস্থায় সে ওজর আপত্তি ধোপে টিকল না। তিনজন মিলে গেল তার কাছে। ছক্কু সেই
গ্রামের মোড়ল ছগনবাবুর পোষা। সে তখন আপনমনে এক চোখ বুজে কাঁঠালপাতা চিবুচ্ছিল।
ওদের কথা শুনে বেশ একটু থতোমতো খেয়ে গিয়ে বলে বসল, “ব্যা ব্যা ব্যা ব্যাপারখানা
জটিল, একা পাই না খুঁজে দিশে। ক্যা ক্যা ক্যা কেমন হবে বললে গিয়ে খুরুপ্পি খরগোশে?”
অগত্যা
চারজনে মিলে গিয়ে প্রায় ধরনা দিল খুরুপ্পি’র কাছে। সে কারও পোষা-টোষা নয়।
বনেবাদাড়ে একাই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। লোকে বলে, একসময় নাকি কারও বাড়িতেই
থাকত সে। তারপর পালিয়ে চলে এসেছে এই গ্রামে। খুরুপ্পি একদিকে যেমন তার উপর লোকজনের
এত ভরসায় নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা মনে করল, আবার আকাশ ভাঙ্গার খবরটা পেয়ে যারপরনাই
আতঙ্কিত হল। মুখে সে কথা প্রকাশ করল না বটে, পাছে সবাই তাকে ভীতু ভাবে। খানিক থম
মেরে বসে বাকিদের মুখের দিকে চাইল। সবাই উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত। কিছু একটা সমাধানের
আশায় বসে আছে। খুরুপ্পি ঢোঁক গিলে অনেকটা নেতাদের ভাষণ দেওয়ার ঢঙে বলল, “ইয়ে, ভাই সকল,
আকাশ ভাঙে ভাঙুক, কিন্তু আমাদের এই বিপদের দিনে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। কষ্ট হবে,
তবুও কেউ ভয়ের কথা বলবে না। কবি বলেছেন, নাই নাই ভয়, হবেই হবে জয়। বল বল বল সবে,
আমাদের দাবি মানতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি...”
কার
কাছে কীসের দাবি, সে সব অবশ্য বোঝা গেল না। শ্রোতারা একটু হতাশ হল, কিন্তু এ ওর
মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতে কেউ হাত কেউ পাখনা জুড়ে তালি দিতে লাগল। গণ্যমান্য কারও
কথার শেষে এমন করাই দস্তুর কিনা, তাই।
ওরা
পাঁচজন যখন এমন আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় গভীর চিন্তামগ্ন, ঠিক তখনই সেই পথের ধারে
আগাছার ঝোপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল শুঁটকো শেয়াল। কথাবার্তা শুনে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপর মুচকি হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে এক লাফে ঝোপ থেকে বেরিয়ে তাদের সামনে এসে
দাঁড়াল। পাঁচজনেই সচকিত, সাবধানী। শুঁটকোর শয়তানি আর ধূর্ত আচরণের সঙ্গে তারা সবাই
অল্পবিস্তর পরিচিত। রাজুই মুখ খুলল প্রথমে,
-
“এই যে ভায়া শুঁটকো। কথার মাঝে কোথার
থেকে জুটলে এসে উটকো? ফল হবে না ভালো, এমনি আছি ঝুটঝামেলায়, সামনে এগোও, চল!”
-
“আহা আহা চটিস কেন! আমি কি আর শত্রু
হেন? করতে মদত তোদের কাছে এলাম, এখন যদি এমন বলিস... আচ্ছা, তবে গেলাম।”
এই
না বলে সে চলে যেতে উদ্যত হল, যদিও সত্যি সত্যি গেল না। এক পা পিছিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে
তাকিয়ে কুতকুতে চোখ দুটো পিটপিট করতে লাগল।
খুরুপ্পি দেখল, পরিস্থিতি যা, তাতে তার বুদ্ধিতে এমন সঙ্কট
থেকে উদ্ধার পাওয়া দুষ্কর। শুঁটকোর মাথায় দুর্বুদ্ধি যতই থাক, সেও তো একরকম
বুদ্ধিই! বলা যায় না, সাহায্য করলে করতেও পারে। ওকে খামোখা চটালে সেই ক্ষীণ
সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে যে! এদিকে রাজু তো প্রায় ভাগিয়েই দিচ্ছে তাকে! সেই
রাজু, যে কিনা নিজে কিছু করতে না পেরে ছক্কুকে ধরেছিল। আর সেই ছক্কু আবার সবাইকে
নিয়ে এসেছিল খুরুপ্পির কাছে। তাহলে স্পষ্টতই খুরুপ্পির মানসম্মান বাকিদের চেয়ে
বেশি। সেখানে রাজুর কথায় কীভাবে শুঁটকোকে ভাগানোর মতো এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?
এ তো খুরুপ্পিরও অপমান। না, তা তো হতে দেওয়া যায় না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খুরুপ্পি
তড়িঘড়ি গোপনে লুকিয়ে রাখা একটা আধখাওয়া টুকটুকে গাজর শুঁটকোর দিকে ঘুষ হিসেবে
বাড়িয়ে বলে,
- “আরে আরে চললে কোথা শুঁটকো ভায়া? একটু শুধু দেখাও দয়া! তুমি
যদি দাও কিছু প্ল্যান, করি তাই মৃদু ঘ্যানঘ্যান!”
শুঁটকো এমনিতে গাজর একেবারেই ভালোবাসত না। কিন্তু এইটা নিল।
কেন কে জানে। মুচকি হেসে সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে খুকখুক করে কেশে বলল,
- “বেশ বেশ বেশ বলছ যখন অ্যাত্ত করে, দেখছি না হয় চিন্তা করে।
ভাঙলে আকাশ মস্ত বিপদ, আহা! একটা কিছু হবেই তো সুরাহা। কিন্তু এমন রাস্তা জুড়ে,
কাজ কী বল জল্পনাতে? বরং সবাই আমার সাথে, চল না বসি ঐ ডেরাতে।”
শুঁটকো ইশারায় খানিক দূরে পাহাড়ের নিচে তার ঘুপচি গুহাটার
দিকে ইঙ্গিত করে। ওদিকটা বেশ নিরিবিলি। গুহার আশেপাশে গেলেই কেমন সব বিশ্রী পচা
গন্ধ পাওয়া যায়। কেউ পারতপক্ষে ওদিকে যায় না। কিন্তু এখন অবস্থা অন্যরকম। শুঁটকোর
শরণেই যখন যেতে হবে, তখন আর ইতস্তত করে কী লাভ? তা ছাড়া, আকাশ ভেঙ্গে পড়লে ঐ গুহার
ছাদটা হয়তো সবাইকে বাঁচালেও বাঁচাতে পারে। মাঠের মধ্যে দাঁড়ালে তো অবধারিত অক্কা
পেতে হবে। অগত্যা সবাই তার পিছু নেয়।
* * *
গুহার ভিতরে তখন আয়েশ করে হাড় চিবোচ্ছিল শুঁটকো। চারপাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেদার হাড়গোড়, পালক। আশেপাশে বাকি পাঁচজনের কোনও চিহ্ন নেই বলাই
বাহুল্য। গুটি গুটি পায়ে নিঃশব্দে সেখানে ঢোকে বিচ্ছু বনবিড়াল। গুহার ভিতরের
অবস্থা দেখে তার চক্ষুস্থির।
- “এ কী শুঁটকো! আমার ভাগ কই?”
- “আহ! খামোখাই কর হইচই। এত দেরি করলে চলে? খিদে পেলে খেতে
হয়, শাস্ত্রে নাহি বলে?”
- “শাস্ত্রে? বটে! এই দুর্বুদ্ধি ছিল তোর ঘটে? গাছ থেকে ফলটা
তো আমিই ফেললাম মোট্টুর মাথায়! তখন বললি খাবার সময় ভাগ দিবি, এখন গেল কোথায়?”
- “আরে বিচ্ছু, জ্বালাস নে ভাই। বড্ড খিদে পেয়েছিল, নইলে কি
খাই? ঠিক আছে পরের বার, তুইই নয় করিস সব সাবাড়।”
বিচ্ছু রাগে গোঁফ ফুলিয়ে গরগর করে উঠল। তারপর দাঁত খিঁচিয়ে
বলল, “জানি জানি জানি! তোর মহা শয়তানি! তাই তো এনেছি আজ ডেকে বোনপো’কে। উচিত
শিক্ষা সেই দিয়ে দেবে তোকে!”
বিচ্ছু’র বোনপোর নাম শুনেই “ওরে বাপ রে” বলে তড়াক করে
লাফিয়ে শুঁটকো পালাতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ‘হালুম’ করে সেই বোনপো, যার নাম ব্যাদড়া
ব্যাঘ্র, ঝাঁপিয়ে পড়ল শুঁটকোর টুঁটি লক্ষ করে, আর এক নিমেষেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।
তারপর বিচ্ছু আর ব্যাদড়া মিলে আরাম করে তার ব্যবস্থা করল।
আচ্ছা, চুপিচুপি বলি, পাত্তু, রাজু, ছক্কু আর মোট্টু, ওরা
কিন্তু মরেনি। ঐ শুঁটকোর কি আর অত ক্ষমতা আছে যে পাঁচজনকে একসঙ্গে সাবাড় করে? শুধু
বেচারা খুরুপ্পির কপালটাই মন্দ ছিল। তার নধর চেহারা আর শুঁটকোর প্রতি অতিরিক্ত
আস্থাই কাল হল। আর ঐ বিচ্ছিরি গাজর খেতে বাধ্য হওয়ায় রাগটাও তার উপরে একটু বেশিই
ছিল শুঁটকোর। বাকি চারজনকে সে লুকিয়ে রেখেছিল গুহার ভিতরেই একটা গোপন স্থানে। বেশ
অনেক দিন ধরে তাদের এক একজনকে মেরে খাওয়ার প্ল্যান ছিল তার। যাতে বিচ্ছুকে ভাগ
দিতে না হয়। কিন্তু বেশি লোভ করলে কী হয় তা তো দেখাই গেল। এদিকে ঐ চারজনেও ঘাপটি
মেরে আড়াল থেকে সব কিছু দেখেশুনে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল, কিন্তু কেউ টুঁ শব্দটি
করেনি। বিচ্ছু আর ব্যাদড়া খেয়েদেয়ে চলে যাওয়ার পর তারা আবার গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে
এসে যে যার আস্তানায় ফিরে গেছিল। তারপর থেকে তারা আর কখনও কেউ আকাশ ভেঙ্গে পড়ার ভয়
পায়নি। কারণ, তারা বুঝে গেছে, আসল ভয় তো মাটিতে!
_____
ছবিঃ লেখক
বেড়ে লেখা তো! দারুণ!
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ!
Deleteবেশ লাগলো
ReplyDelete