শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
১
গ্রামের নাম হট্টপুর।
নিপু থাকে সেই গ্রামে বাবা-মা’র সঙ্গে। এই গ্রামে নিপুর একজন বন্ধু আছে, তিনি হলেন
হরিকাকা। তিনি নিপুকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন - গুলতি
চালানো, ঘুড়ি ওড়ানো, সাঁতার কাটা - অনেক কিছু। নিপু নিজের আনন্দ, দুঃখ সবই
হরিকাকার সঙ্গে ভাগ করে নেয়। হরিকাকারও আপন বলে দুনিয়ায় কেউ নেই। তাই নিপুকে উনি
অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেন।
২
স্কুল থেকে ফেরার পথে
প্রায় দিনই নিপু হরিকাকার কাছে যায় তার ছোট্ট চায়ের দোকানে। দুপুরের দিকে তেমন লোকজন আসে না। সেই সময় নিপু আর হরিকাকার গল্প জমে ভালো। নিপুকে আসতে দেখে হরিকাকা জিজ্ঞেস
করলেন, “কী ভাই, স্কুল ছুটি হয়ে গেল?”
“জানো কাকা, রুকুদের
বাড়িতে নাকি একটা সাপ এসেছিল কাল।”
“তাই?”
“হ্যাঁ গো। রুকুর
বাবা সেই সাপকে তাড়ায়।”
“বাবা, এই নাও
বিস্কুট।”
“আমায় এবারে বটতলার
সেই বাড়িটাতে নিয়ে যাবে না?”
“ওরে ভাই, তোমাকে
বোঝাতেই পারি না, সেই বাড়ি ভূতের। সেখানে ব্রহ্মদত্যির বাস। আমি কীভাবে তোমায় নিয়ে
যাই বল। তোমার বাবা জানতে পারলে আমায় খুব বকবেন।”
“কেউ কিছু টের পাবে না। আমরা তো দিনের বেলায় যাব।”
“ভূত দিন রাত দেখে
আসে না ভাই। তুমি এখনও ছোটো আছ। আমায় রক্ষে
কর, আমি তোমায় নিয়ে যেতে পারব নি। তার থেকে তোমাকে বরং পাখি দেখাতে নিয়ে যাব। এই শীতে সুবল বাবুর বাগানের লাগোয়া পুকুরে অনেক পরিযায়ী পাখি আসে।”
বিস্কুট চিবোতে চিবোতে
নিপু বলল, “সে যাব না হয় একদিন। এই শনিবার আমায় তুমি ভূতের বাড়ি নিয়ে চলো। দূর
থেকে দেখব। কাছে যাব না।”
হরিকাকা চিন্তায় পড়ে
গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে নিপু ছাড়ার পাত্র নয়। একদিন নিপুকে নিজেই গল্প করেছিলেন সেই
ভূতের বাড়ির কথা। বটতলা ওদের গ্রাম থেকে মাইল চারেক দূরে। সেখানকার
ভূতের বাড়ির কথা লোকের মুখে শুনেছিলেন হরিকাকা। হরিকাকা ভূত বিশ্বাস করেন না। পুরোনো বাড়ি, লোকজন থাকে না, তাই হয়তো
লোকেরা ভূতের বাড়ি নাম দিয়েছে। কিন্তু সেখানে নিপুকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর। সাপ-খোপ থাকতে পারে, জঙ্গল নিপু ভয় পেতে পারে। ওর
বাবা জানতে পারলে সত্যি হরিকাকাকে খুব বকবেন। কিন্তু কী আর করা যাবে।
৩
দালান বাড়ি, দোতলা
কিন্তু ভাঙা, জরাজীর্ণ। জঙ্গলে ভর্তি হয়ে গেছে বাড়িটাতে। বট গাছ বাসা বেঁধেছে তার আনাচে কানাচে। দেয়ালে শেওলা। লোকজন এই পথে
বিশেষ আনাগোনা করে না। জানালাগুলো ভেঙে গেছে, দরজাটাও শেষ করেছে ঘুণপোকায়। বেশ দশ
হাত দূরে একটা গাছের আড়াল থেকে নিপু আর হরিকাকা দেখছিল বাড়িটাকে। হরিকাকার সাইকেলে
বসে একরকম জোর করেই আজ সকাল সকাল চলে এসেছে নিপু।
“কই, ভূত কোথায়?”
“ভাই রে, এটা ওদের
বাড়ি। লোকে বলে এখানে তেনারা থাকেন। তাই বলে বাড়ির সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকবে নাকি
আমাদের জন্য।”
“চল না কাকা, বাড়িতে
ঢুকি।”
“নিপু, ভাই একদম নয়। আমায়
তুমি কথা দিয়েছ দূর থেকে দেখবে। ওরকম জেদ করলে আমি আর কোনও দিনও তোমার সঙ্গে কথা
বলব না, কোথাও নিয়ে যাব না,” হরিকাকা বেশ রাগ করেই বললেন কথাগুলো। নিপু ব্যাজার মুখে চুপ করে রইল। হরিকাকা কথা না বললে তার চলবে না।
“কী হচ্ছে খোঁকা? কী
দেখছ ওদিকে?”
চমকে উঠল নিপু আর
হরিকাকা। একজন লম্বা, ফরসা, মোটাসোটা মানুষ খালি গায়ে
পৈতে ঝুলিয়ে, ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের ঠিক পিছনে। মাথায় তেল চপচপে টাক। লম্বা
কান। মুখে দাড়ি গোঁফ নেই। ধবধবে সাদা একপাটি দাঁত বের করে হাসছে। কী বিচ্ছিরি
হাসিটা।
“আপনি কে?” হরিকাকা
বলে উঠলেন।
“আমি কেউ একজন। তোমরা
কারা? আর এদিক পানে কী করছ?”
“আমরা পাশের গ্রামে
থাকি।”
“ভূতের বাড়ি দেখতে
এসেছি,” ফস করে বলে দিল নিপু।
“ভূতের বাড়ি?” বলে হা
হা করে হেসে উঠল লোকটা। কী শব্দ হাসির। নিপুর কেমন গা ছমছম করে উঠল। পাশে হরিকাকার দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখটাও কেমন যেন হয়ে গেছে।
“তা ভূত দেখতে পেলে
না?” হাসি থামিয়ে লোকটা বলে উঠল।
“আমাদের তাড়া আছে,
বাড়ি ফিরতে হবে,” হরিকাকা ভুরু কুঁচকে বললেন।
“দাঁড়াও বাপু, এত তাড়া
কীসের? একটু বোসো চা, পানি খাও। তারপর না হয় যাবে,” চোখ পাকিয়ে পাকিয়ে লোকটা কথাগুলো
বলছিল।
“না না, আমরা কিছু
খাব না,” নিপু বলার আগেই হরিকাকা ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল।
“বা রে, আমার বাড়ি
প্রথমবার দেখতে এলে, কিছু খাবে না?”
“বাড়ি?” নিপু আর
হরিকাকা একসঙ্গে চমকে উঠল।
“হুম, আমার বাড়ি। ওই
যে ভাঙা বাড়িটা দেখছ ওটা আমার। আমি ওখানেই থাকি,” মাথা নেড়ে বলল লোকটা, “কী খোকা,
কিছুক্ষণ আগেই না বলছিলে বাড়ির ভিতরে যাবে, তো চলো...।”
আমতা আমতা করে নিপু বলল,
“না, মানে আমার পড়া আছে, দেরি হলে মা বকবে।”
লোকটা নিজের টাক একটু
চুলকে নিল, তারপর মিচকি হেসে বলল, “আজ কেউ বকবে না তোমাকে।”
“কিন্তু আমার দোকান
আছে। মাধবকে বসিয়ে এসেছি। আমাদের যেতে হবে,”
হরিকাকা তাড়াতাড়ি সাইকেলের স্ট্যান্ড তুলল। লোকটা কে? কোথা থেকে এল? হরিকাকা
বুঝতে পারছেন না। আবার পিছনে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনেছে। মতলব একদম ভালো ঠেকছে না
তার। ছেলেধরা হলে? চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না এখানে। কাছে-ধারে কেউ নেই।
“আরে রোসো বাপু,” বলে
ধরল লোকটা সাইকেলটা চেপে, “তোমার মাধব দোকান বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। গিয়ে লাভ
নেই।”
বাপ রে! কী শক্তি
লোকটার গায়ে। সাইকেলটা বেঁকে গেল।
খ্যাক খ্যাক করে হেসে
উঠল লোকটা।
“এসে যখন পড়েছ, একটু
গল্প করে তবেই যেতে দেব। তার আগে নয়।”
“আমরা যাব না ও বাড়িতে।”
“কেন বাপু, কী ক্ষতি
করেছি আমি? বলি আমার কি দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করতে নেই?”
হরিকাকা অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করল, “কী আবার কথা!”
ঝকঝকে দাঁতের পাটি
বের করে সেই লোকটা উওর দিল, “কেন? মনের কথা প্রাণের কথা। ভূতেদের গল্প থাকে না বুঝি?”
৪
“তবে কি তুমি ভূত?”
নিপুর প্রশ্নের উত্তর
দিল লোকটা বেশ আনমনা হয়ে, “ঠিক ভূত না। আমি হলাম গিয়ে ব্রহ্মদৈত্য, ভূতের থেকে
একটু উঁচুতে। তোমাদের মানুষের মধ্যে যেমন ভাগ আছে, কেউ বাঙালি কেউ পাঞ্জাবি,
আমাদেরও ভাগ আছে, কেউ শাঁকচুন্নি কেউ পেতনি।”
হরিকাকা হো হো করে
হেসে উঠলেন, “যত্ত সব বাজে কথা। বেলা অনেক হল, এবার আমরা চলি।”
“বাজে কথা? আমরা
মিথ্যে বলি না তোমাদের মতন,” দাঁত খিঁচিয়ে উঠল সে।
“আমরা আবার কী মিথ্যা
বললুম?”
লোকটা এবার সুর করে
বলল, “কেন, নিপুবাবু আজ মা-বাবাকে কাঠবিড়ালি দেখবে বলে এখানে এলে, আর এই তুমি,
রোজ দুধে জল মিশিয়ে ঘন চা বানানো হয়!”
আমতা আমতা করে
হরিকাকা বললেন, “তুমি তো সাংঘাতিক? পুলিশ নাকি?”
এবার সে তার লম্বা
ঠ্যাঙ ছড়িয়ে মাটিতে বসে বলল, “ইচ্ছে ছিল গো, খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হল না। এসব খবর আমি এমনিতেই পাই, কান দুটো বড়ো কিনা। আমার সঙ্গে কেউ কথা
বলে না, জানো! সবাই ভয় পায়। ঐ বাড়িতে থাকি তো, তাই। সেদিন হরেন মাস্টারকে
দেখলাম যাচ্ছে বাড়ির সামনে দিয়ে, বড্ড সাধ হল দুটো কথা বলি। ওমা, সে আমাকে দেখে কী দৌড়! যদিও দোষটা আমার।”
নিপু অবাক চোখে
জিজ্ঞাসা করল, “কী দোষ?”
“ঐ তালেগোলে নিজেকে
বেঁটে না করেই দৌড়েছিলাম গল্প করতে।”
নিপুর বড়ো মায়া হল। সত্যি তো, সে যদি ভূত হত আর সবাই যদি কথা বলা বন্ধ করে দিত তবে?
“ঠিক বলেছ নিপু ভাই,
সত্যি যদি তোমার মতন করে কেউ ভাবত! এই ব্যাটা হরিটাই যদি ভাবত!”
খিঁচিয়ে উঠলেন হরিকাকা,
“আমি আবার কী করলাম?”
বড়ো বড়ো দাঁত বের
করে লোকটা বলল, “কেন? দেখা হওয়ার পর থেকেই কেমন পালাই পালাই করছ। আমি খেয়ে ফেলব
নাকি?”
হরিকাকা উতলা হয়ে
বলল, “কী করব বল দেখি, বেলা বাড়ছে। এ ছেলেটার বাবা-মা সময়মতো না ফিরলে আমাকে
ধরবে আর এই বটতলা থেকে হট্টপুর কম রাস্তা? তার উপর তোমার জন্য সাইকেলটাও গেল! ফিরব
কী করে?”
লোকটা একগাল হাসি দিয়ে
বলল, “চিন্তা করতে হবে না। কেবল কথা দাও নিপু আর তুমি আবার আসবে?”
নিপু চট্ করে বলে উঠল,
“আসব, সত্যি কথা দিলাম।”
দেখাদেখি হরিকাকাও বললেন,
“হ্যাঁ কথা দিলাম।”
লোকটা এবার দাঁড়িয়ে
পড়ল বেশ হাসি হাসি মুখে, “বেশ বেশ। এবার তবে চোখ বন্ধ করো দু’জনে।”
“কেন?”
“নিপু ভাই, ব্রহ্মদৈত্যকে
প্রশ্ন করতে নেই। যা বলছি করো আর মনে মনে এক থেকে নয় গোনো। গোনা শেষ হলে চোখ খুলবে, কেমন?”
ঘাড় নেড়ে দুই জনেই
চোখ বুজল। এক থেকে নয় অবধি গুনে চোখ খুলতেই ফুসমন্তর, কোথায় বটতলা? কোথায় সেই
লোক? কোথায় হরিকাকা? বাড়িটাই বা কোথায়?
“নিপু, এই নিপু। বলি দুপুর গড়িয়ে গেল, ভাত খাবি না? কতক্ষণ ধরে ডাকছি, এই দাওয়ায়
বসে তুই ঝিমোচ্ছিস, খেয়েদেয়ে ঘুমো।”
মায়ের ডাকে খেতে বসল সে। কিন্তু তার মানে কি ও স্বপ্ন দেখছিল? না সব সত্যি ছিল? বিকেলে
হরিকাকার কাছে গিয়ে নিপু সব বলল লোকটার কথা, বটতলার বাড়িটার কথা। হরিকাকা হেসেই
খুন, “ভাই রে, তুমি স্বপ্ন দেখছ।”
কিন্তু স্বপ্ন এত
সত্যি হয় বুঝি? হঠাৎ নিপু প্রশ্ন করল, “আচ্ছা হরিকাকা, তোমার সাইকেল কোথায়?”
হরিকাকা একটু চিন্তা
করে বললেন, “ওটাকে দোকানে দিয়েছি, হ্যান্ডেল বেঁকে গেছিল। মাধব ভেঙ্গেছে।”
তার মানে সবটুকু
স্বপ্ন ছিল কি? না হরিকাকা সত্যি বলছেন না ভয়ের চোটে? কিন্তু নিপুকে যেতেই হবে
বটতলায় আবার। কারণ সে কথা দিয়েছে ব্রহ্মদৈত্যকে যে সে গল্প
করতে আসবে। হরিকাকা যতই ভয় পান, তাঁকে সঙ্গে করেই যাবে।।
_____
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment