মহেন্দ্রলালের হিরে
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
(১)
* * *
* * *
(২)
* * *
(৩)
(৪)
(৫)
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
“এবার তো অঙ্কে ভালো নম্বর পেয়েছিস। চটপট একটা হিসেব বল তো!” খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এবার তার ওপর দিয়ে মাথাটা উঁচিয়ে একবার আমার দিকে চেয়ে নিয়ে আবার কাগজে মুখ গুঁজল অনিদা, আর আমিও একটা ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জের আশা নিয়ে নড়েচড়ে বসলাম।
আমার এখন গরমের ছুটি। গত সোমবারেই অবশ্য স্কুল খোলার কথা ছিল। কিন্তু কলকাতায় এবার যা গরম, তাতে ছুটি বেড়েছে আরও পনেরো দিন!
“পটাপট বল দেখি, সাড়ে ছয় লক্ষ ইন্টু পঁচাত্তর পয়েন্ট এক ছয় – কত হয়?”
অনিদার ভাব দেখে মনে হল দুয়ে দুয়ে কত হয়, প্রশ্নটা সেই লেভেলের! এক থেকে পাঁচ গোনারও সময় দিল না। তার মধ্যেই তাড়া দিয়ে উঠল। “বল বল, কত হয়?”
অনিদা প্রশ্ন করবে শুনে প্রথমে উৎসাহে আমার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেছিল। কিন্তু বাধ্য হয়েই আবার সোফায় শরীর এলিয়ে দিলাম। চ্যালেঞ্জ নেবার ইচ্ছেটাই নিজে থেকেই ভ্যানিশ হয়ে গেল। মুখটা তেতো তেতো লাগছিল। যেন কুড়িটা নিমপাতা একসঙ্গে চিবিয়ে ফেলেছি! আমতা আমতা মুখ নিয়ে মাথা চুলকাতে শুরু করলাম।
আমার অসহায় অবস্থাটাকে কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ তুড়ি মেরে বলল, “দেখ
তো, মনে হচ্ছে সংখ্যাটা পাঁচ কোটির কাছাকাছি কিছু একটা হবে।”
চ্যালেঞ্জের বদলে দেখলাম অনিদার পরীক্ষা নেওটাই আমার কাছে এবার সহজ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি মোবাইল ক্যালকুলেটরে হিসেব করে সাংঘাতিক আশ্চর্য হয়ে বললাম, “বাবা!”
“কেন কী হল? কত বেরোল?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
আমি মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বললাম, “চার কোটি অষ্টআশি লক্ষ চুয়ান্ন হাজার!”
“প্রায় ঠিকই বলে ফেলেছিলাম, কী বল?” আমার দিকে চেয়ে দু’বার ভুরু নাচিয়ে বলল অনিদা।
“তোমার গোয়েন্দা না হয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত ছিল।”
আমার প্রশংসাটাকে পাত্তাই দিল না অনিদা। যদিও জানি সেটা ওকে খুশিই করেছে। তবে হাবেভাবে আমাকে সেটা বুঝতে না দিয়ে আবার কাগজে মুখ ঢাকল। অসময়ে হঠাৎ এমন একটা বাউন্সার মার্কা প্রশ্ন কেন তা নিয়ে আমার তখন কৌতূহল তুঙ্গে! তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা কীসের হিসেব গো অনিদা?”
আমার প্রশ্ন শুনে অনিদা প্রথমে কাগজটা মুখের সামনে থেকে নামাল। এবার সেটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে বলল, “আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগের কথা। বর্ধমানের এক ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন মহেন্দ্রলাল দত্ত। বন্ধুর বন্ধু, আর শত্রুর যম। এই ছিল ওনার পরিচয়। সেই সময় এক আফগান ব্যবসায়ীর সঙ্গে ওনার খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। তো সেবার সেই ব্যবসায়ী বর্ধমানে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর মহেন্দ্রলাল নিজে দিনরাত ওনার সেবা করে ওনাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। নতুন জীবন পেয়ে সেই ব্যবসায়ী মহেন্দ্রলালকে তখন একটা হিরে উপহার দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর থেকেই দিন ফিরতে শুরু করল মহেন্দ্রলালের। আর তাতে উনি মনে করতে শুরু করলেন যে তার পেছনে রয়েছে ওই হিরেটা। তাই সেটা যাতে কোনও ভাবেই হাতছাড়া না হয় তার জন্য উনি হিরেটাকে বাড়ির মধ্যেই একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। অনেকেই সেই হিরেটার কথা জানলেও সেটা যে কোথায় রাখা ছিল, সেটা কেউ জানত না! ওনার মৃত্যুর পর অনেকেই হিরেটার খোঁজ করেছিল বটে, তবে কেউই সেটার নাগালের মধ্যে যেতে পারেনি। শেষে এতদিন পর, গত বুধবার কলকাতার এক প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ প্রসূন ব্যানার্জি হিরেটা খুঁজে পান। হিসেব করে দেখা গেছে, আজকের দিনে হিরেটার দাম প্রায় পাঁচ কোটি টাকা!”
“পাঁচ কোটি!” হিরের দাম শুনে আমার মুখ নিজে থেকেই হাঁ হয়ে গেল। এবার ঢোঁক গিলে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা কি বিক্রি হবে? অত দামি জিনিস কে কিনবে?” আসলে একটা হিরে যে এত দামি হতে পারে সেটা একেবারেই আমার ধারণার বাইরে।
আমার প্রশ্ন শুনে একটা একপেশে হাসি হেসে অনিদা বলল, “পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে এই টাকাটা একেবারে নস্যি। যদিও এই হিরেটা বিক্রির জন্য নয়।”
“তবে?”
“মিউজিয়ামে রাখা হবে।”
মিউজিয়ামের কথা শুনে আমি চনমনিয়ে উঠলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “আমরা দেখতে পাব?”
তাতে অনিদা হেসে বলল, “হ্যাঁ, সে ব্যবস্থাই করা হয়েছে। তবে এত দামি জিনিস তো। তাই মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছেন যে ওটা দেখতে হলে স্পেশাল পারমিশন লাগবে। অবশ্য আগামী এক থেকে তিন তারিখ সাধারণ মানুষ টিকিট কেটেই হিরেটা দেখার সুযোগ পাবেন। তবে সামনে থেকে নয়, দূর থেকে।”
“আমরা যাব না?” আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।
“নিশ্চয়ই, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে?”
“কবে যাব?” উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“দু’তারিখ, মানে সামনের শনিবার। অসুবিধে নেই তো?”
“না না,” বলে এবার সোজা হতে গিয়ে ডান হাঁটুটা সেন্টার টেবিলে একটা ধাক্কা খেল আর তাতে জলের বোতলটা মাটিতে পড়ল!
“গুড! আমরা তাহলে দুপুর দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়ব,” বলে অনিদা একবার মাটিতে পড়ে থাকা বোতলটার দিকে তাকাল। যার মানে হল, বেশি বাড়াবাড়ি না করতে বলা।
কাল অনিদার মুখে হিরেটার কথা শোনার পর থেকে আজ সারাদিন আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বলে একটা পাথর উঁকি মারছিল। থেকে থেকে সেটার রঙও বদলে যাচ্ছিল। ইতিহাসকে চোখের সামনে দেখতে পাব ভেবে আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। ওদিকে অনিদার মধ্যে অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল নেই। আমার মন যখন প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পিছিয়ে, ও তখন ব্যস্ত আজ রাতের এশিয়া কাপে ভারত শ্রীলঙ্কা ম্যাচ নিয়ে। সেটা নিয়ে অমিতদার সঙ্গে তো আবার এক প্রস্থ তর্কই হয়ে গেল।
মিউজিয়ামে শো-এর টাইম বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটা। আমরা পৌঁছোলাম মিনিট দশেক আগেই। ওদের ওপর মহলের সঙ্গে অনিদার আগে থেকেই চেনাশোনা। তাই বলা ছিল যে সবার দেখা হয়ে গেলে আমরা পাথরটা একবার সামনে থেকে দেখব। মানে শো এর পর।
হিরেটা নিয়ে যে মানুষের মনে বিরাট একটা কৌতূহল তৈরি হয়েছে তা বুঝলাম লাইনের সাইজ দেখে। আড়াইটে থেকেই লাইন পড়া শুরু হয়ে গেছিল। এবার তিনটের সময় এগোতে শুরু করল। আগেই বলেছি মিউজিয়ামের ওপরের মহলের লোকেদের সঙ্গে অনিদার চেনাশোনার কথা। তাই আমাদের আর লাইন দিতে হয়নি। যদিও একবার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে দেখে মনে হয়েছিল যে এটা সুবিধে নেওয়া হয়ে যাচ্ছে, তবে পরে মনে হল এটা এমন কিছু একটা অন্যায় নয়! হিরের তদারকিতে থাকা এসিপি গুহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে লালবাজারের ওসি রাজাদাও চলে এল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, রাজাদা অনিদার খুব ভালো বন্ধু। আমাকেও খুব ভালোবাসে।
হিরেটার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই ক’দিন চারজন সি আই ডি অফিসারকে নিয়ে একটা বিশেষ দল তৈরি হয়েছে। তাঁদের সবার সঙ্গেই আমরা পরিচয় করলাম। পার্থ মিত্র হলেন এই দলটার ক্যাপটেন। ওনাকে দেখে সি আই ডি বলে মনে হয় না। কেমন যেন প্রফেসর প্রফেসর দেখতে। শান্ত শিষ্ট। এই চেহারার মানুষকে অপরাধী ভয় পায়! যদিও জানি ওনার চেহারার থেকে মাথার দামটাই বেশি। পার্থ মিত্রর সঙ্গে আছেন কুশল রায় এবং আশীষ ঘোষ। এনাদের চেহারা নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। আর এনাদের নিচে কাজ করছেন এক জুনিয়ার অফিসার আবীর বোস। এসিপি গুহ আর রাজাদার সঙ্গে পরিচয় থাকার জন্য ওনারা আমাদের বেশ খাতির করছিলেন। জুনিয়ার হলেও এনাদের মধ্যে আমার সব থেকে বেশি মন কেড়েছিলেন আবীর। লম্বা ছিপছিপে শরীরের গড়ন। ফরসা গায়ের রং। কথাবার্তাতেও বেশ চৌখস।
এত বড়ো একটা হিরে চোখের সামনে! আলো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে ওটার মধ্য থেকে। একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সব হিরের মতোই এই হিরেটার আকারও অনেকটা প্রিজমের মতো। দেখে মনে হচ্ছিল যেন পেল্লায় বড়ো একটা লাট্টু। একটা কাচের ঘরে আরেকটা কাচের বাক্সের মধ্যে রাখা ছিল হিরেটা।
জ্যান্ত ইতিহাস চাক্ষুস করছি। কথাটা ভাবতেই সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। জিনিসটাকে সামনে থেকে দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। কিন্তু শো শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপায় নেই। আর ঠিক এই সময়তেই ঘটল একটা মজার কান্ড!
প্রদর্শনী চলছে। ঠিক এমন সময় বোঁ করে বেজে উঠল মিউজিয়ামের সাইরেনটা। হিরেটা যে কাচের ঘরে রাখা হয়েছিল, তার কোণে লাগানো লাল আলোটা বার বার জ্বলতে নিভতে শুরু করল। যার মানে হল বিপদের আশঙ্কা! স্বাভাবিকভাবেই ঘরের মধ্যে একটা হৈ হল্লা লেগে গেল। এদিকে সাইরেনের আওয়াজ শুনেই মেশিনগানধারী পুলিশ বাহিনী দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। এসিপি গুহ থেকে অন্যান্য সি আই ডি অফিসারেরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পজিশন নিয়ে নিয়েছেন। ঠিক তখন ভ্যাঁ করে একটা কান্নার আওয়াজ শুনে ডানদিকে চেয়ে আবিষ্কার করলাম বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলেকে। সে বেচারা তখন দু’হাতে চোখ ডলছে আর পাশে দাঁড়ানো তার বাবা থেকে থেকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না!” এবার ছেলেকে শাসাতে শাসাতে বললেন, “তোমাকে বলেছিলাম না যে কোনও জিনিসে হাত না দিতে? তাও তুমি কাচে হাত দিয়েছ? এরপর আর কোনোদিন আমি তোমাকে নিয়ে কোথাও যাব না।”
এসিপি গুহ তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রিভলবার পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বাচ্চাটার গাল টিপে দিয়ে বললেন, “না না। ও বাচ্চা ছেলে। ও কী করে বুঝবে? অযথা ওকে বকবেন না।”
এদিকে সবাই তখন ওর দিকে চেয়ে হাসছে দেখে বাচ্চাটা এবার লজ্জা পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মায়ের কোলে মুখ লুকাল।
বাচ্চাটার বাবার কথা শুনেই আন্দাজ করেছিলাম ঠিক কী ঘটেছিল। এবার বিষয়টা পরিষ্কার হল মিঃ গুহর কথায়। আসলে বাচ্চাটা না জেনেই ঘেরা কাচে হাত দিয়ে ফেলেছিল। যেহেতু কাচের দেয়ালে সেন্সর লাগানো রয়েছে, তাই তাতে বাচ্চাটার হাতের ছোঁয়া লাগতেই লাইট জ্বলে সাইরেনটা বেজে উঠেছিল।
শো-এর শেষে আমরা এবার কাচের ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। পাথরটা এখন আমাদের মাত্র এক হাতের মধ্যে। মিঃ গুহ এবার নিজে থেকেই হিরেটা নিয়ে অনিদার হাতে দিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ দেখার পর অনিদা এবার সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি এতক্ষণ হাঁ করে চেয়ে ছিলাম হিরেটার দিকে। এবার কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিলাম অনিদার দিকে। হিরেটা ছুঁতেই আমার সারা গায়ে কারেন্ট খেলে গেল। চোখের সামনে যেন মোগল মারাঠা যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছিলাম। ব্রিটিশরা ভারতে রাজত্ব চালাচ্ছে, সিপাহীরা বিদ্রোহ করছে, সব ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। এবার ঘোর কাটল অনিদার কথায়।
“কীরে, কী ভাবছিস?”
“না না, কিছু না।” কেউ যাতে কিছু না বুঝতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে এসিপি গুহকে ফিরিয়ে দিলাম হিরেটা।
অনিদা তখন আমার দিকে চেয়ে হেসে বলল, “এমন অ্যান্টিক জিনিস হাতে পড়লে ইতিহাসের যুগে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক!”
বুঝতে পারলাম ওর কাছে ধরা পড়ে গেছি। তাও ভাগ্য ভালো যে অন্যরা জিনিসটা বুঝতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরলাম বটে, তবে মন পড়ে রইল মিউজিয়ামে।
আজ একটা ইংরিজি ম্যাগাজিন মহেন্দ্রলালের হিরেটা নিয়ে লিখেছে। সেটার ওপর চোখ রেখে অনিদা বলল, “খুব সুন্দর হয়েছে।”
সকাল এখন প্রায় দশটা। অনিদার ঘরে বসে মহেন্দ্রলালের হিরেটা নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। এমন সময় অনিদা’দের কাজের লোক বিজুদা এসে জানাল যে দু’জন লোক অনিদার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
অসময়ে অতিথি শুনে প্রথমটায় একটু ভুরু কোঁচকাল অনিদা। এবার তারা তাদের নাম বলেছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় বিজুদা জানাল যে ওনাদের মধ্যে একজনের নাম কুশল রায়।
সঙ্গে সঙ্গে কোঁচকানো ভুরু সোজা হয়ে চোখ জোড়া কপালে উঠল অনিদার। অতিথির নাম শুনে আমিও অবাক। অনিদার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সি আই ডি অফিসার কুশল রায়?”
অনিদা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বিজুদাকে জিজ্ঞাসা করল, “আরেক জনের নাম?”
"আরেকজন হলেন গিয়ে," মাথা চুলকে বিজুদা একটু চিন্তা করে বলল, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আশীষ -”
বিজুদাকে আর “ঘোষ” বলতে না দিয়ে ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনিদা। আমার ততক্ষণে বুঝতে বাকি নেই ওনারা আর কেউ নন, সেই দুজন সি আই ডি অফিসার!
আমি তখন ভাবছি যে ওনারা হঠাৎ অনিদার কাছে কেন আসবেন, ঠিক সেই সময় অনিদা ওনাদের সঙ্গে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।
লালবাজারের গোয়েন্দারা অনিদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন জানতে পারলে পাড়ায় হই হই পড়ে যাবে। আমার কাছে অবশ্য এগুলো এখন জলভাত। কলকাতার পুলিশ কমিশনারও এখন অনিদার ঘনিষ্ঠ। অনিদা এর মধ্যে বিজুদাকে ডাকতে গেছিল। কিন্তু তার আগেই ও জানিয়ে দিয়েছে যে অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে। আসলে আমার মতো বিজুদাও এসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কুশল রায় আর আশীষ ঘোষকে বসতে দিয়ে আমার পাশের সিঙ্গল সোফাটাতে বসল অনিদা। এর মধ্যে বিজুদা ওনাদের জন্য ঠান্ডা জল দিয়ে গেছে। প্রায় এক ঢোঁকে গ্লাস শেষ করে আশীষ ঘোষ বললেন, “দেখুন মিঃ সেন, একটা বিপদে পড়ে আমরা আপনার কাছে এসেছি।”
“বিপদে পড়ে? সেটা কী রকম?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা। দু’জন সি আই ডি অফিসার বিপদে পড়ে অনিদার মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাছে এসেছেন! জিনিসটা সত্যিই অবাক হওয়ার মতোই বটে!
“কিন্তু তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে যে ব্যাপারটা আপনি গোপন রাখবেন,” বললেন আশীষ ঘোষ।
তাতে মাথাটা দু’বার সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে কুশল রায় বললেন, “এতে আমাদের মান সম্মান থেকে শুরু করে পুরো ক্যারিয়ার জড়িয়ে আছে মিঃ সেন।”
“আসলে ব্যাপারটা খুব সেন্সেটিভ,” গলা নামিয়ে বললেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা তখন ওনাদেরকে আশ্বস্ত করে বলল, “দেখুন, কী বিষয়ে আপনারা আমার সাহায্য চাইছেন, জানি না। তবে কথা দিচ্ছি, আপনাদের যদি আমাকে কোনোভাবে দরকার পড়ে, তাহলে আমি সবসময় আপনাদের সঙ্গে আছি। আর গোপনীয়তা নিয়ে কিছু ভাববেন না।”
এমন দু’জন দুঁদে গোয়েন্দাদের অনিদার কাছে কীসের সাহায্যের দরকার, সেটা তখন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করে দিয়েছে। ওনারা এর পরেও কিন্তু কিন্তু করছেন দেখে অনিদা তখন আবার ওনাদেরকে আশ্বস্ত করে বলল, “আপনারা নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।”
এতে আমি একবার ভাবলাম যে আমার সামনে থাকার জন্য মনে হয় ওনারা কিছু খুলে বলতে চাইছেন না। আমাদের অনেক ক্লায়েন্টই এমনটা করেন। আমি বয়সে ছোটো বলে অনেকে হয়তো ভরসা পান না। পরে অনিদা যখন বলে যে আমি ওর সহকারী, তখন কিছুটা হলেও কাজ হয়।
সবাই জানে যে আমি অনিদার মাসতুতো ভাই। এমনি ভাই বললে আবার ঝামেলা আছে। কারণ অনিরুদ্ধ সেন আর রণজয় বোস, আলাদা নাম বলে আমাদেরকে মানুষ ভাই বলে মেনে নেয় না। আসলে তা নয়। আমার আর অনিদার মায়েরা সেই ছেলেবেলাকার, থুড়ি, মেয়েবেলাকার বান্ধবী। আমরা আর ওরা কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মেঘমালা এপার্টমেন্টের দোতলায় পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটে থাকি। অনিদার কেসগুলো গল্পের আকারে আমিই লিখি। তাই অনিদার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন আমাকেও চেনে।
কুশল রায় আর আশীষ ঘোষ, দু’জনের মুখই তখন থমথমে। আমাদের ঘরের আবহাওয়াটা এর মধ্যেই কখন যেন গুমোট মেরে গেছে। এর মধ্যে আশীষ ঘোষের মুখ থেকে যে কথাটা বেরিয়ে এল, সেটা অনেকটা আচমকা কড়াৎ করে বাজ পড়ার মতো।
বারকয়েক ঢোঁক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় আশীষ ঘোষ বললেন, “একচুয়ালি মিঃ সেন, মহেন্দ্রলালের হিরে ইজ মিসিং!”
“হোয়াট!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠে মিঃ ঘোষের দিকে ঝুঁকে পড়ল অনিদা। ওর কপালের চারটে ভাঁজ তখন ভীষণ কড়া!
কথাটা শুনে আমার বুকে হাতুড়ি পিটতে শুরু করেছে। মনে হল যেন স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এই সকালে এমন খবর একেবারেই আশা করিনি।
“কী বলছেন আপনি?” ফ্যাসফ্যাসে গলা শুনে বুঝলাম অনিদাও তখন ঘোলা জলে।
“ইয়েস, দ্যাটস রাইট। হিরেটা চুরি হয়ে গেছে। আমাদের নাকের ডগা দিয়েই,” ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন মিঃ রায়।
“কিন্তু কী করে?” নিজেকে সামলে নিলেও চোখে মুখে এখনও উত্তেজনা ধরা পড়ছিল অনিদার। “কবে হল? কখন হল?” আবার জিজ্ঞাসা করল ও।
বিজুদা এর মধ্যে ফিস ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিঙ্কস দিয়ে গেছে। অনিদা অতিথিদের দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আমাকে ডিটেইলসে বলুন।”
উত্তরে মিঃ ঘোষ বললেন, “তার আগে একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার মিঃ সেন। যে হিরেটা কাল আপনারা দেখেছেন, সেটা আসল ছিল না।”
আবার একটা ধাক্কা! মিঃ ঘোষের কথা শুনে ফিস ফ্রাইতে কামড় মারতে গিয়ে জিভ কামড়ে ফেললাম।
অনিদার মধ্যে অবশ্য এতে কোনও হেলদোল নেই। কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুক মেরে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল, “জানি।”
“জানেন!” অনিদাকে অবাক করতে গিয়ে নিজেরাই অবাক হয়ে গেলেন দু’জন সি আই ডি অফিসার। চোখ কপালে তুলে মিঃ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী করে জানলেন?”
“পাথরটার নিচের দিকে বউবাজারের একটা দোকানের ঠিকানা লেখা ছিল মিঃ ঘোষ। সেটা আমার নজর এড়ায়নি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওটার দাম খুব বেশি হলে হাজার দুয়েক হবে,” হেসে বলল অনিদা।
“আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ মশাই!” মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন মিঃ ঘোষ।
আমার মুখ ততক্ষণে হাঁ হয়ে গেছে। শুধু রাগ উঠছে এই ভেবে যে সব জেনেশুনেও অনিদা আমাকে ব্যাপারটা জানায়নি! আর আমি নাকি ওর এসিস্ট্যান্ট! ভেতরে ভেতরে অবশ্য ওর নজরের তারিফ না করে পারছিলাম না। চোখ কান ভীষণ রকমের খাড়া করা না থাকলে এ জিনিস ধরা সম্ভব না।
অনিদা তখন জিজ্ঞাসা করল, “এবার বলুন যে আসল হিরেটা কোথায়? সেটাই কী চুরি হয়েছে?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে মিঃ ঘোষ বললেন, “আসল হিরেটাই চুরি হয়েছে। নকলটা যেমন ছিল তেমনই আছে।”
“আসলটা আপনারা কোথায় রেখেছিলেন?”
“সেটা থেকেই তো আসল ঘটনার শুরু,” বললেন মিঃ ঘোষ।
“আসলে সেদিন পার্থদা, আমি আর মিঃ ঘোষ একটা ডিসিশান নিয়েছিলাম,” বললেন মিঃ রায়।
“কী ডিসিশান?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“এমন একটা ডিসিশান, যেটা কিনা শেষমেশ আমাদের কাল হয়ে দাঁড়াল,” বললেন মিঃ ঘোষ।
কুশল রায় বলতে থাকলেন, “আপনারা হয়তো কাগজে পড়ে থাকবেন, আজকাল মুম্বইয়ের একটা গ্যাং কলকাতায় অপারেশন চালাচ্ছে। কোথা থেকে কী হয়ে যায়! তাই কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইনি। আর সেইমতো আমরা আসল হিরেটাকে নিয়ে যাই আমাদেরই অফিসের একটা গোপন জায়গায়।”
“আর তার জায়গায় নিয়ে আসেন নকল হিরেটা?”
“ঠিক তাই মিঃ সেন,” মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে মিঃ রায় বললেন, “প্রদর্শনী শেষ হয় তিন তারিখ। ঠিক ছিল তারপরই হিরেটা আসল জায়গায় ফিরিয়ে দেব। সেইমতো আমি আর আশীষ সেদিন সন্ধ্যাবেলা অফিসে যাই। কিন্তু হিরেটা যেই ঘরে ছিল, সেখানে ঢুকে প্রথমে কিছু আন্দাজ করতে পারিনি আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু এবার লকার খুলতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল! কারণ লকারে তখন হিরে নেই! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমরা। কতক্ষণ যে ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারব না, কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। যা হবার হয়ে গেছে।”
“হুম,” কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল অনিদা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “সেই সময় পার্থ মিত্র আর আবীর বোস কোথায় ছিলেন?”
“ওনারা মিউজিয়ামেই ছিলেন।”
তাতে “ও” বলে চোখ সরু করে মাটির দিকে চেয়ে রইল অনিদা।
মিঃ ঘোষ তখন বললেন, “বিশ্বাস করুন মিঃ সেন, আমরা তিনজন মিলে আজ পর্যন্ত অনেক কেস সলভ করেছি। কত খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি তার ইয়ত্তা নেই! পার্থদা, আমি আর কুশল – এই ত্রিফলাকে ভয় পায় না, এমন অপরাধী এই ভূ’ভারতে নেই। কিন্তু এই ঘটনাতে আমরা সত্যিই চাপে পড়ে গেছি। যখন দেখলাম যে লকারে হিরে নেই, সেই সময়টা যে আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। খবরটা পার্থদাকেই বা কী করে দেব মাথায় ঢুকছিল না। তবু শেষ পর্যন্ত ওনাকে জানাতে হয়েছিল। এদিকে ব্যাপারটা বাইরে চেপে রাখাও অসম্ভব। শেষমেশ গ্রেপ্তার হতেই হবে, বুঝতে পারছি। সঙ্গে চাকরি যাবার ভয় তো আছেই। তবু আপাতত কোনোরকমে চুরির ঘটনাটা লুকিয়ে রেখেছি।”
তাতে কুশল রায় বললেন, “তবে এটাও জানি যে সত্যি বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না। জানি না, ‘না করা’ চুরির দায়ে আমাদের কী সাজা পেতে হবে!”
“এতে পার্থ মিত্রর কী রিঅ্যাকশান?”
“বাড়াবাড়ি রকমের চুপচাপ হয়ে গেছেন ভদ্রলোক। কারও সঙ্গেই বেশি কথা বলছেন না। থম মেরে বসে থাকছেন সবসময়। কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে উনি এর জন্য নিজেকেই দোষি ভাবছেন। কারণ প্ল্যানটা এসেছিল ওনার মাথা থেকেই।”
“আজ আপনারা আমার কাছে এসেছেন তা উনি জানেন?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“হ্যাঁ,” মাথা ওপর-নিচ করে মিঃ রায় বললেন, “তবে এব্যাপারে উনি বিশেষ কিছু মন্তব্য করেননি।”
মিঃ ঘোষ এবার বললেন, “সবই তো শুনলেন মিঃ সেন। তাই আমাদের অনুরোধ যে এই কেসটাতে আপনি আমাদের পাশে থাকুন।”
এই ডাকসাইটে গোয়েন্দারা অনিদার সাহায্য চাইছে দেখে আমি এমনিতেই হতবাক। অনিদার দিকে চেয়েছিলাম ও কী বলে সেটা দেখার জন্য। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অনিদা এবার বলল, “আমি প্রথমেই একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আপনাদের তিনজনের কথা শুনে ভয় পায় না এমন অপরাধী নেই। অনেক জটিল কেস আপনারা সলভ করেছেন সে কথা আমার অজানা নয়। কিন্তু তার পরেও এই কেসটা নিজেরা হাতে না নিয়ে আপনারা আমার কাছে এসেছেন কেন?”
তাতে মিঃ রায় বললেন, “দেখুন মিঃ সেন, কেস যতই জটিল হোক না কেন, তাতে আমাদের ভয় নেই। কিন্তু এখানে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে নিজেদের ভুলের মাশুল আমরা আজ দিচ্ছি। ব্যাপারটা যদি কোনোরকমে জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। আমরা জানি না আসলে কে অপরাধী। আমাদের মধ্যেও কেউ হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তাই থার্ড কারও হাত পড়লে ব্যাপারটার মধ্যে একটা নিরপেক্ষতা থাকে। তাই আমরা নিজেরা এটার মধ্যে সরাসরি জড়াতে চাই না। তবে তদন্তটা গোপনে চলাটা খুব জরুরি। আপনার রেপুটেশনের কথা আমরা জানি। অনেস্টির কথাও জানি। তাই আপনার কাছে আসা।”
“হুম,” বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনিদা বলল, “কাজটা কিন্তু আপনারা বাচ্চাদের মতো করে ফেলেছেন।”
তাতে ওনারা দু’জনই চুপ মেরে গেলেন। অনিদা তখন জিজ্ঞাসা করল, “এই নকল হিরের ব্যাপারটা আপনারা তিনজন ছাড়া আর কে জানে?”
“কেউ না মিঃ সেন,” বললেন মিঃ রায়।
“আর চুরির ঘটনাটা?”
“আমরা তিনজনই।”
“ওকে,” অনিদা এবার মাথাটা বারদুয়েক সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।”
কেসটা যে অনিদা নেবে সেটা বুঝতেই পেরেছিলাম। হিরেটা চুরি হয়ে গেছে জেনে আমার মনটা ভার হয়ে গেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও আমার কাছে একটা খুশির ব্যাপার যে এমন গোয়েন্দাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনিদা কাজ করবে!
অনিদা এবার জিজ্ঞাসা করল, “হিরেটা আপনারা কোথায় রেখেছিলেন?”
“আমাদের অফিসের বারো তলার ঘরে। যেখানে আমরা তিনজন বসি। সেখানে আমাদের একটা লকার আছে। হিরেটা সেটার মধ্যেই রেখেছিলাম।”
“লকারের চাবি কার কাছে থাকত?”
“ওর কোনও চাবি নেই। নম্বরের কম্বিনেশনে লকারটা অপারেট করা হয়।”
“সেই কোড নম্বরটা কে কে জানেন?”
“আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ না। আর কিছুদিন পর পরই আমরা পুরোনো কোড বদলে নতুন কোড দিই।”
“কেন?”
“সিকিউরিটি পারপাসে। কারণ বিভিন্ন কেসের গোপনীয় তথ্যগুলো আমরা ওই লকারের ভেতরেই রাখি।”
অনিদা তখন বলল, “দেখুন, চুরি যেহেতু লকারের ভেতর থেকে হয়েছে, তাই বলা যায় যে অপরাধী কোডটা জানতে পেরে গেছিল।”
“সে তো হান্ড্রেড পারসেন্ট!” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন মিঃ ঘোষ।
“ওই ঘরে আপনারা ছাড়া আর কে কে ঢোকেন?”
“কমিশনার বা এসিপি তো ঢোকেনই, আর তাছাড়া অন্যান্য অফিসাররা এমনকি জুনিয়র অফিসারদের যাতায়াতও আছে আমাদের ঘরে। তবে বিনা পারমিশনে কেউ আসেন না।”
“আর ঘরে আপনারা না থাকলে?”
“ঘর বন্ধ থাকে।”
“চাবি?”
“তিনজনের কাছে তিনটে চাবি আছে।”
“আচ্ছা। লকারের কোডটা শেষ কবে বদলান?”
“এক তারিখ। মানে যেদিন হিরেটা লকারের মধ্যে রাখা হয়।”
“লকারের গায়ে কোনও হাতের ছাপ পাননি?”
“না। তবে অদ্ভুত একটা জিনিসের ছাপ লকারের কী বোর্ডের কী গুলোর ওপর পেয়েছি আমরা।”
“সেটা কেমন?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা। কিছু একটা নতুন তথ্য জানার আশায় আমিও উৎসুক হয়ে উঠলাম।
মিঃ ঘোষ তখন বললেন, “কী গুলোর গায়ে ডট পেনের কালির ছাপ পাওয়া গেছে।”
“ডট পেনের কালি? স্ট্রেইঞ্জ!” অনিদার কপালে তখন গোটা তিনেক ভাঁজ। এমন অদ্ভুত জিনিস শুনে আমিও অবাক। অনিদা তখন বলল, “তার
মানে অপরাধী লকার খোলার জন্য ডট পেন ব্যবহার করেছিল। যাতে হাতের ছাপ কোথাও না পাওয়া যায়!”
অনিদার কথার উত্তরে অফিসার দু’জন কিছু না বলে চুপ করে থেকে চেয়ে রইলেন। অনিদা আবার জিজ্ঞাসা করল, “ঘরে আর কিছুতে কোনও কিছুর ছাপ-টাপ পাওয়া যায়নি?”
“না”, নিচের ঠোঁট উলটে মিঃ রায় বললেন, “সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুজেছি মিঃ সেন। কিচ্ছু পাইনি।”
আমি তখন বললাম, “চোর তো গ্লাভস পরেও ঢুকতে পারে?”
কথাটা মনে হয় খুশি করল অনিদাকে। আমার কাঁধে দুটো চাপড় মেরে ও বলল, “যাতে কোনও প্রমাণ না থাকে?”
এবার মিঃ ঘোষ বললেন, “চুরিটা বেশ সাবধানেই করা হয়েছে। কারণ কালির ছাপটা ছাড়া আর কিছুই নজরে আসেনি আমাদের। ঘরে আর কোথাও কিছুই পাইনি আমরা!”
“তা তো বটেই,” মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “এর সঙ্গে একথাও পরিষ্কার যে, চোর যেই হোক না কেন, সে আপনাদের গতিবিধির ওপর সবসময় নজর রেখে গেছে।”
“তাতে কোনও সন্দেহ নেই মিঃ সেন,” মাথা নেড়ে বললেন মিঃ রায়।
“আর সে এও জানে যে তথ্য কী করে লোপাট করতে হয়,” কথাটা বলে আবার কী যেন ভাবল অনিদা। তারপর বলল, “এক্সপার্ট চোর!” এবার জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা শেষ কখন আপনারা হিরেটাকে লকারের মধ্যে দেখেছিলেন?”
“তিন তারিখ। মানে যেদিন চুরি হয় সেদিন দুপুর দুটো নাগাদ।”
“আর তারপর আপনারা ঠিক ক’টার সময় ওই ঘরে ঢোকেন?”
“এই সাতটা হবে,” বললেন মিঃ রায়।
“তার
মানে চুরিটা হয়েছে ঠিক দুপুর দুটো থেকে সাতটার মধ্যে,” বলল অনিদা।
“ঘটনার গতিক তো তাই বলছে,” বললেন মিঃ ঘোষ।
“ওই সময়টাতে আপনারা সবাই মিউজিয়ামেই ছিলেন?”
“আশীষ আর আমি তো ছিলামই। আবীরও ছিল আমাদের সঙ্গে। শুধু পার্থদা মাঝে একবার ঘণ্টাখানেকের জন্য একটা পার্সোনাল কাজে বেরিয়েছিলেন।”
“কোথায় গেছিলেন? আপনারা জানেন?”
“বললেন তো কলেজ স্ট্রিট। রায় এন্ড রায়-এর দোকানে। ছেলের জন্য নাকি বই কেনার ছিল।”
“হুম,” বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অনিদা এবার বলল, “ওকে, কাল সকালে আমি একবার আপনাদের অফিসে যেতে চাই।”
“ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম মিঃ সেন,” হেসে বললেন মিঃ রায়।
মিঃ ঘোষ তখন বললেন, “দেখবেন ব্যাপারটা যাতে পাঁচ কান না হয়।”
“না না,” মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “আমি বরঞ্চ কাল গিয়ে বলব যে আমি আমার একটা পার্সোনাল কাজে আপনাদের কাছে এসেছি।”
“সেই বরঞ্চ ভালো,” হেসে বললেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা তখন বলল, “আচ্ছা, সেই পেনের কালিটার ব্যাপারে আর কিছু জানতে পেরেছেন আপনারা?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে মিঃ রায় বললেন, “পরীক্ষা করিয়ে জানতে পেরেছি, সেটা কোনও ব্রিটিশ কম্পানির পেনের কালি।”
“ব্রিটিশ কম্পানির পেনের কালি!” অবাক হয়ে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “আপনাদের চেনাশোনা কেউ ওইরকম পেন ব্যবহার করেন?”
তাতে ওনারা কোনও উত্তর না করে একে অপরের দিকে চেয়ে নিয়ে আবার অনিদার দিকে তাকাল।
“আপনারা চুপ করে আছেন যে?” বলে দু’জনের দিকেই একবার করে চাইল অনিদা। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না ওনারা।
তাতে আমতা আমতা করে মিঃ রায় বললেন, “আসলে ওই পেনটা দিয়েই লকার খোলা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে প্রমাণ ছাড়া এতটা নিশ্চিত হওয়াটা কি উচিত?”
তাতে সোজা হয়ে বসে অনিদা বলল, “কে ব্যবহার করেন ওই পেন?”
তাতে কিন্তু কিন্তু করে মিঃ ঘোষ বললেন, “পার্থ মিত্রর ছেলে লন্ডনে থাকে। গত মাসেই ও ওনার জন্য সেখান থেকে একটা পেন এনে দিয়েছে!”
সি আই ডি অফিসারেরা চলে যেতে আমি অনিদাকে বললাম, “আচ্ছা অনিদা, আমি মানলাম যে পেন দিয়েই পাসওয়ার্ড টাইপ করা হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য তো রিফিলের ডগা দিয়ে না করে সেটা ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে নিয়ে তারপর সেটা ব্যবহার করা উচিত ছিল। আর টিপ পেন হলে রিফিলটা চেপে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। তাই না? চোর এত স্মার্ট আর এটা বুঝল না যে এতে করে ধরা পরে যাবার চান্স থাকে?”
আমার কথা শুনে খুশি হয়ে অনিদা বলল, “ভেরি গুড পয়েন্ট জয়। আর তোর কথার মানে করলে এটাই দাঁড়ায় যে চোর ইচ্ছে করেই পেনের মুখ খোলা রেখে পাসওয়ার্ড টাইপ করেছে যাতে পেনের কালিটা কী বোর্ডের কী গুলোর গায়ে লেগে যায় আর সবার সন্দেহটা মিঃ মিত্রর ওপর গিয়ে পড়ে!”
“তার মানে মিঃ মিত্র অপরাধী নন,” একটা সূত্র অন্তত বের করতে পেরেছি ভেবে ডান হাতটা মুঠো করেছি, তখন অনিদা আমার উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে বলল, “দেখা যাক। সবই প্রমাণসাপেক্ষ।”
পরের দিন সকালবেলা আমরা পৌঁছলাম সি আই ডি অফিসে। ঢোকার মুখে আমাদের আপাদমস্তক সার্চ করা হল। মিঃ রায় আর মিঃ ঘোষের কথা বলতে এবার ওনাদের সঙ্গে ইন্টারকমে যোগাযোগ করা হল।
আমরা এসে গেছি শুনে ওনারা দু'জন নিচে নেমে এলেন আমাদের ওপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার আগেই অবশ্য আমাদের ছবি আর বুড়ো আঙুলের ছাপ নিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে। যে অফিসে ঢুকছি, সেখানে এই ব্যবস্থা তো হবেই! অনিদা সে কথা আগেই বলেছিল আমাকে। অবশ্য এত করেও সিকিউরিটি গার্ডদের শান্তি হয়নি। দু’জনেরই গলায় ভিজিটরস কার্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। থেকে থেকে মনে হচ্ছিল আমরা যেন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নাম করা গুন্ডা। এই মাত্র ধরা পরেছি। এবার হাই কোর্টে তুলছে!
বারো তলার ঘরটা বেশ সুন্দর। বাইরের দিকের দেয়ালটা কাচের। আজকালকার প্রায় সব উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এই এই ব্যবস্থা। এতে বিল্ডিং-এর ওপর বেশি চাপ পড়ে না। জানালাগুলো স্লাইডিং। সেগুলোও কাচের।
ঘরের তিনদিকে তিনটে টেবিল। তার প্রতিটাতেই একটা করে ল্যাপটপ খোলা অবস্থায়। দেয়ালে ঝোলানো পৃথিবী থেকে শুরু করে ভারত বর্ষের ম্যাপ ছাড়া ঘরে প্রচুর বইও চোখে পড়ল আমাদের। বিজ্ঞান, ইতিহাস, কী নেই? অনিদাকেও এই রকম ধরনের নানা বই পড়তে দেখেছি। আসলে ওদের পেশাটাই ওদেরকে এত পড়তে বাধ্য করে। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ফেলুদা তো আবার রান্নার বইও পড়ত!
“পার্থ মিত্রকে দেখছি না?” জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
“উনি এসিপির কাছে গেছেন। এখুনি এসে পড়বেন,” বললেন মিঃ রায়।
কাচের দেয়াল হওয়ার জন্য এই ঘরের ভেতর থেকে কলকাতা শহরের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। আশেপাশে এত বড়ো আর কোনও বাড়ি না থাকার জন্য সামনের অনেকটাই খোলামেলা। বেশ কিছুটা দূরে অবশ্য একটা উঁচু বাড়ি রয়েছে। তবে সেটা আন্ডার কন্সট্রাকশন। জানালা দিয়ে একটু মুখ বাড়িয়ে ডাইনে তাকালে আবার হাওড়া ব্রিজও চোখের নাগালে চলে আসে! যদিও আবছা। যত দেখছিলাম, তত চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল! এর মধ্যেই আমাদের জন্য চিকেন বার্গার আর কোল্ড ড্রিঙ্কস চলে এসেছে। অনিদা এতটুকু সময় নষ্ট না করে বার্গারে কামড় মারল।
এর মধ্যে আমি অবশ্য আমার ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও অন করে দিয়েছি। আসলে আমরা যে তদন্তেই নামি না কেন, সব কিছু রেকর্ড করে নিই। এতে পরে হিসেব-নিকেশে সুবিধে হয়। অবশ্য এই পুরো ব্যাপারটাই গোপনে চলে। কারণ অনিদা চায় না যে ওর এই পদ্ধতি বাইরের কেউ জানুক। সুতরাং মোবাইল ক্যামেরা তার কাজ করে যেতে লাগল আর আমি আমার মাথার হার্ড ডিস্কে সব কিছু গেঁথে নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
“এটাই সেই লকার যেটা থেকে হিরেটা চুরি হয়েছিল?” অনিদার প্রশ্নে ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা লকারের দিকে চোখ গেল। বুঝলাম অনিদার প্রশ্নটা সেটা দেখেই।
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। হিরেটা ওতেই ছিল,” আচমকা পেছন থেকে একটা গলা পেয়ে পেছন ফিরে দেখি পার্থ মিত্র। আজকের মিঃ মিত্র আর সেদিনের মিঃ মিত্রর মধ্যে বিস্তর ফারাক পেলাম। ঘটনার জেরেই হয়তো ওনার চোখ-মুখ এমন শুষ্ক হয়ে রয়েছে। ঘরে ঢুকে উনি বললেন, “ঘটনার দায়টা পুরোটাই আমার। আপনি তো সবই শুনেছেন মিঃ সেন। সেদিন যদি বোকার মতো এই স্টেপটা না নিতাম, তবে নিজেও এমন ফ্যাসাদে পড়তাম না আর এই বেচারারাও এভাবে খাদের কিনারায় চলে আসত না।”
“আপনি এমন করে ভাবছেন কেন?”
“না মিঃ সেন,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঃ মিত্র বললেন, “আপনি হয়তো আরও শুনে থাকবেন যে লকারের কী বোর্ডের ওপর একটা পেনের কালির দাগ পাওয়া গেছে।”
“হ্যাঁ, শুনেছি।”
“আর এও নিশ্চয়ই জানেন যে আমার ঠিক ওই রকম একটা পেন আছে?”
“কিন্তু তাতে কিছু প্রমাণ হয় কি?”
“আর প্রমাণের কী প্রয়োজন মিঃ সেন?”
কথা শুনে বুঝলাম ভদ্রলোক কতটা মুষড়ে পরেছেন। অনিদা ওনাকে বলল, “আপনি এত বড়ো অফিসার হয়েও এমন কথা বলছেন?”
“কী করব বলুন?” হতাশ গলায় মিঃ মিত্র বললেন, “ব্যাপারটার মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে পড়লাম! ইনভেস্টিগেশনটা হয়তো আমরা নিজেরাই করতে পারতাম। কিন্তু তাতে লোক জানাজানির একটা ভয় থাকে। কারণ আমাদের গতিবিধি একটু আলাদা হলেই সেটা চোখে পড়ে যাবে।” উত্তেজিত হয়ে বললেন মিঃ মিত্র। বললেন, “আর তাছাড়া, আমিই বা একাজ করিনি তার কী প্রমাণ আছে? আমাদের লাইফটাও হয়তো এবার শেষ হয়ে যাবে! যদি চাইতাম তাহলে খুব সহজেই সাজিয়ে ফেলতে পারতাম যে হিরে মিউজিয়ামের মধ্যে থেকেই চুরি হয়েছে। কিন্তু সেটা আমরা চাই না। আমরা অপরাধীকে ধরতে চাই।”
“আমিও,” বলে অনিদা ওনার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, “সেই ব্রিটিশ পেনটা আছে আপনার সঙ্গে?”
“হ্যাঁ, ওটা আমার সঙ্গে সবসময় থাকে,” বলে পকেট থেকে পেনটা বের করে অনিদাকে দিলেন উনি। অনিদা একবার সেটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর সাদা কাগজে দু’চারটে লাইন টানল। অবশ্য জানি না কেন! এবার সেটা আমার হাতে দিয়ে লকারটার দিকে এগিয়ে গেল। এবার পকেট থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে লকারের কী বোর্ডের কী গুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
“ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবেন, কী গুলোর বেশ কয়েকটাতে এখনও কালি লেগে আছে,” পাশ থেকে বললেন মিঃ রায়।
“হুম,” কাজ করতে করতেই উত্তর দিল অনিদা।
“পেনটাতে যে কালির রিফিল ছিল, সেটা খুব ঘন। অনেক সময় কালি রিফিলের মুখে এসে জমা হয়। আর সেই সময় সেই পেন দিয়ে লিখলে একসঙ্গে অনেকটা কালি বেরিয়ে পরে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পেনটা দিয়ে যখন পাসওয়ার্ড টাইপ করা হয়েছে, তখন তার থেকে কালি বেরিয়ে কী বোর্ডে লেগে গেছে। তবে সেটা কিন্তু তখনই হয় যখন পেন বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়।”
অনিদা এবার মিঃ মিত্র’কে জিজ্ঞাসা করল যে ওই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে উনি পেনটা হাতছাড়া করেছিলেন কিনা। তাতে জোরে জোরে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে মিঃ মিত্র বললেন, “না না, কখনও না। এ পেন আমি হাত ছাড়া করি না মিঃ সেন। সবসময় সঙ্গেই রাখি”। বলে পেনটা এবার আমার কাছ থেকে নিয়ে নিজের বুক পকেটে রাখলেন মিঃ মিত্র।
“ওকে,” এবার কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে থেকে অনিদা আমাকে বলল, “আয় তো একবার বাইরে।”
আমি কোনও কথা না বলে অনিদার পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। আমাদের ঘর থেকে বেরোতে দেখে মিঃ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় চললেন মিঃ সেন?”
“এক মিনিট – আপনারা নরমালি কথা বলতে থাকুন। পারলে একটু গলা চড়িয়েই বলুন,” বলে আমাকে নিয়ে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল অনিদা। তারপর আমাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু শুনতে পারছিস?”
আমার কানে কিছুই আসছিল না। অনিদা তাই এবার দরজা ফাঁক করে মাথাটা ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা কথা চালিয়ে যাচ্ছেন তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ,” ভেতর থেকে মিঃ মিত্রর গলা পেলাম।
তখন আবার দরজাটা বন্ধ করে বাইরে এসে অনিদা আমাকে বলল, “ভালো করে দরজায় কান পাত। ওনাদের কথা শুনতে পাচ্ছিস?”
“তুমি বুঝি সন্দেহ করছ যে বাইরে থেকে কেউ ওনাদের প্ল্যান শুনে ফেলেছিল কিনা?” অনিদা কিছু না বলাতে বুঝলাম আমার প্রশ্নের উত্তর “হ্যাঁ”। কিন্তু আমার কানে কিছুই আসছিল না। দরজাটা যখন অনিদা খুলেছিল, তখন ভেতর থেকে কথার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কিন্তু বন্ধ করে দেবার পর আর কিছুই কানে আসছিল না। একবার করে ডান কান বাঁ কান দিয়ে দরজার নানা জায়গায় পেতে অনেক চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পেলাম না।
অনিদা তখন কপাল কুঁচকে নিচের ঠোঁটটা উলটে একদৃষ্টে মাটির দিকে চেয়ে থেকে বলল, “বাইরে থেকে কেউ ভেতরে কী কথা হয়েছে সেটা শোনেনি, সেটা সম্পর্কে সিওর হওয়া গেল।”
আমরা ভেতরে ঢুকতে অনিদা এবার ওনাদেরকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা এই হিরেটা নিয়ে আপনারা কোথায় কোথায় আলোচনা করেছিলেন?”
“ও ব্যাপারে আমরা বাইরে কোথাও কিছু আলোচনা করিনি মিঃ সেন। হিরেটা এখানে সরিয়ে আনা, সেটা চুরি হওয়ার ঘটনা বা আপনাদের এখানে আসার কথা, কোনও কিছুই আমরা বাইরে আলোচনা করিনি।”
অনিদা কিছু বলছে না দেখে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ভাবছ অনিদা?”
অনিদা খুব গম্ভীরভাবে বলল, “তাহলে ভেতরের খবর বাইরে বেরোল কী করে? চোর জানল কী করে যে এই ঘরের ভেতরে হিরে রয়েছে? আর তাছাড়া লকারের কোডটাই বা পেল কী করে?” এবার অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু অপরাধীর কাছে এই খবর পৌঁছেছিল। খবর এই ঘরের বাইরে গেছিল।”
“কিন্তু কী করে?” অনিদার কথা শুনে পার্থ মিত্র বললেন, “আমরা কখনও এ বিষয়ে বাইরে আলোচনা করিনি। আর ঘরে কথা বললে কোনোভাবেই তা বাইরে যায় না সেটা তো আপনি দেখলেনই।”
“হুঁ, সেটা অবশ্য ঠিক,” মাথা নেড়ে বলল অনিদা। তারপর বলল, “তবে একটা জিনিস, চুরি যখন হয়েছে, চোর ঘরে ঢুকেছিল সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। এ ঘরে ক্যামেরা লাগানো নেই?”
“হ্যাঁ আছে,” বললেন মিঃ রায়।
“গুড!” ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে একটা ঘুঁষি মেরে অনিদা বলল, “তাহলে তো চোর আমাদের হাতের মুঠোয়!”
“না মিঃ সেন,” শুকনো হাসি হেসে মিঃ ঘোষ বললেন, “এটাই তো আসল ভূতুড়ে ব্যাপার।”
“ভূতুড়ে ব্যাপার!” অবাক হয়ে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “সেটা কী রকম?”
তাতে মিঃ রায় জানালেন যে ক্যামেরা সব সময় অন থাকে। সেদিনও ছিল। কিন্তু তাতে সেই সময়ের কোনও ছবি নেই!
“সে কী!” অনিদার সঙ্গে সঙ্গে আমিও তখন বেজায় অবাক।
“তাহলে তো বলতে হয় অদৃশ্য কারও হাত রয়েছে এ কাজে!” যেন আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল অনিদা। তারপর ডানদিকের কোনার দিকে দেওয়ালের ওপরে তাকাল। সেখানেই লাগানো ছিল সিসিটিভি ক্যামেরাটা। অনিদার কথামতো এবার চুরির দিনের ফুটেজটা চালানো হল। ক্যামেরাতে দরজা আর তার বাঁ দিকের দেয়ালটা কভার হলেও কাচের দেয়ালের সবটা কভার হচ্ছিল না।
পাঁচ ঘণ্টার ফুটেজ এই মুহূর্তে দেখা সম্ভব না। তাই ওনারা সেটা অনিদাকে হার্ড ডিস্কে দিয়ে দিলেন। কখন কী দরকারে লাগে, তাই আমরা আমাদের সঙ্গে পেন ড্রাইভ থেকে শুরু করে এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক, সব রাখি। অনিদা এবার ডানদিকের দেয়ালের কাচের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। স্লাইডিং জানালাটা টেনে খুলতে হুড়মুড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঢুকল ঘরের ভেতর। এবার জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে একবার করে ডাইনে বাঁয়ে তাকাল অনিদা। তারপর জানালাটা বন্ধ করে দিল।
ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে আটটা। আমাদের এবার এখান থেকে বেরোনোর পালা। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতেই লাইট গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, কাল থেকে এই বিল্ডিং-এর জেনারেটরটাও খারাপ! তাই লিফটে নামার আর এখন কোনও উপায় নেই, সিঁড়ি ভেঙেই নামতে হবে। অবশ্য সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যতটা কষ্ট, নামতে ততটা হয় না।
নিচে নামার জন্য সবার আগে এগিয়ে গেলাম আমিই। পেছনেই ছিল অনিদা। ওর পেছন পেছন আসছিলেন তিনজন অফিসার। এবার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টর্চটা অন করতে গেছি, এমন সময় আচমকা পা হড়কে গেল অনিদার। হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবার আগেই ধরে ফেললাম ওকে। ঝট করে দেয়ালে ভর দিয়ে নিজেকে সামলে নিল অনিদা। এই অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে হড়কে পড়ে গেলে কী হত ভেবেই আমার বুক কাঁপছিল। মোবাইলের আলোর ওপর ভরসা করে আমরা বারো তলা থেকে এক তলায় নামলাম। নিচে আমাদের সঙ্গে দেখা হল আবীর বোসের। ততক্ষণে আলো এসে গেছে। আবীর বোস বললেন উনি সিগারেট কিনতে গেছিলেন। অনিদাকে দেখে বললেন, “আরে! আপনি কখন এলেন?”
“এই তো, কিছুক্ষন আগে,” হেসে বলল অনিদা।
ফেরার সময় একমনে গাড়ি চালাচ্ছিল অনিদা। চুরি হওয়া হিরে আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকজনের ব্যাপারে প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল আমার। এদিকে অনিদাও মুখে তালা লাগিয়েছে। অনেকক্ষণ উশখুশ করার পর এবার থাকতে না পেরে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “পার্থ মিত্রকে তোমার কেমন লাগল অনিদা?”
“হয় এক নম্বর ধড়িবাজ না হয় গল্পের বইয়ের কোনও এক সৎ অফিসার। আজকের দিনে দু’নম্বরটা আশা করা অন্যায়,” বলে আমার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল অনিদা।
আমি তখন আবার প্রশ্ন করলাম। “চুরি হল। অথচ ক্যামেরাতে ধরা পড়ল না! এটা হতে পারে?”
আমার কথার কোনও উত্তর দিল না অনিদা। আমি বললাম, “আচ্ছা, চোর কি শুধু দরজা দিয়েই আসতে পারে? জানালা দিয়ে নয়?”
তাতে মুচকি হেসে একবার আমার দিকে তাকাল অনিদা।
তাতে মনে হল আমার চিন্তাটা বেকার। কারণ অত উঁচুতে বারো তলার জানালা বেয়ে কে’ই বা চুরি করার সাহস করবে? অনিদা কোনও কথা বলছে না দেখে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কী ভাবছ অনিদা?”
অনিদা তখন আমাকে চমকে দিয়ে বলল, “ভাবছি, সিঁড়িতে আমাকে ধাক্কাটা মারল কে?”
“মানে!”
“পার্থ মিত্র ছিলেন সবার পেছনে। মিঃ রায় ছিলেন আমার বাঁ দিকে। আর মিঃ ঘোষ আমার ডান দিকে দু’হাতের মধ্যে হাঁটছিলেন।”
অনিদার কথা শুনে আমি তখন থ। ওকে কেউ ধাক্কা মেরেছে! অথচ আমরা কেউ কিছু বুঝতেও পারিনি!
“ধাক্কাটা মেরেছিল ডান কাঁধে। আর যত দূর মনে হয় সেটা মারা হয়েছিল বাঁ হাত দিয়ে।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী করে বুঝলে?”
“বুড়ো আঙুলের ছোঁয়ায় তাই মনে হয়েছিল,” বলে অনিদা বলল, “মিঃ রায়ের পক্ষে বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত ব্যবহার করে ও কাজ করা সম্ভব না। আর কোনও স্বাভাবিক মনের মানুষ সেটা করতেনও না। ডান হাতই ব্যবহার করতেন। আর পার্থ মিত্রর পক্ষে অত দূর থেকে আমার ধাক্কা মারা সম্ভব নয়।”
“তাহলে তো আর বাকি থাকেন আশীষ ঘোষ!” আমি অবাক হয়ে বললাম।
তাতে মুখ দিয়ে চিক করে একটা শব্দ করে অনিদা বলল, “সামান্য হলেও কাজটা ওনার পক্ষেই করা সম্ভব। কিন্তু কারণ?”
শেষ যে কথাটা অনিদা প্রশ্নের আকারে করল, সেটা ওর নিজেকেই নিজে করা। আমি অনিদার কথাগুলো হাঁ করে গিলছিলাম। এবার জিজ্ঞাসা করলাম, “সে চোর কি তাহলে মিঃ ঘোষ?”
তাতে ও হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। শুধু বলল, “ফুটেজটা দেখতে হবে।”
সকালবেলা ঘণ্টাখানেকের জন্য অনিদা আমাকে না বলে কোথায় যেন বেরিয়েছিল। এইরকম অবশ্য ও আগেও করেছে। হুট হাট করে আমাকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে। এগুলো আমার ভালো লাগে না। আমি নাকি ওর সহকারী!
দুপুরে আমরা ওর ঘরে বসে। ছটফটানিই বলে দিচ্ছিল যে এই কেসটা নিয়ে ও কতটা উত্তেজিত। সেদিনের তোলা ভিডিও আর ছবিগুলো আমরা বার বার দেখেছি। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়েনি।
“তোমার কি মনে হয় এই হিরে চুরির ব্যাপারটা এদেরই সাজানো?” অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“হতে পারে আবার নাও হতে পারে,” ছোট্ট কথায় উত্তর করল অনিদা।
“না হলে তো বলতে হয় এতে চার নম্বর কারও হাত আছে।”
“সেটাও এই মুহূর্তে ঠিক বলা যাবে না। আমাদের আরও কিছুটা এগোতে হবে।”
“এরা তিনজন তো এক সঙ্গে মিলে থাকতেও পারে?”
“উঁহু,” আমার কথায় জোরে মাথা নাড়ল অনিদা।
“এতটা সিওর হচ্ছ কী করে?”
“আরে বোকা, তাহলে তো ওরা জিনিসটা চেপেই যেত। আমাকে এ কাজ করতে দিত না।”
অনিদার কথায় ওজন ছিল। আমি কিছু না বলে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও বলল, “ঘটনার কয়েকটা পয়েন্ট আমাদের মাথায় রাখা দরকার। প্রথমেই আসি পার্থ মিত্রর কথায়। ওনার কথামতো হিরেটা মিউজিয়াম থেকে নিয়ে আসার পর সেটা চুরি হয়। এতে ভদ্রলোকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চাপে পড়ে গেছেন। উনি ভালোভাবেই জানেন এতে ওনাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এ জিনিস বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না। তাই জেনেশুনে উনি নিজের পায়ে কুড়ুল মারবেন না। তাও আবার ক্যারিয়ারের এই জায়গায় এসে। আর সত্যিই যদি ওনার চুরি করার বা করাবার মতলব থাকত, তবে চুরির দিন ওইভাবে মিউজিয়ামের বাইরে বেরিয়ে শুধু শুধু সন্দেহটা নিজের দিকে টেনে আনতেন না। তাছাড়া আমি আজ কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সত্যিই উনি সেদিন রায় এন্ড রায় থেকে চারটে বই কিনেছিলেন।”
“তাহলে তো পার্থ মিত্র নির্দোষ।”
অনিদা আমার কথার কোনও উত্তর করল না। আমি তখন বললাম, “সেক্ষেত্রে বলতে হয়, কুশল রায় বা আশীষ ঘোষের মধ্যেই কেউ একজন অপরাধী?”
“সেরকমটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখনই আমি সে ব্যাপারে সরাসরি মন্তব্য করব না।”
আমি তখন ওকে বললাম, “প্রথম পয়েন্ট হল পার্থ মিত্র নির্দোষ। দু’নম্বর পয়েন্ট হল মিঃ ঘোষ আর মিঃ রায়। যাঁদের ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাবে না। এগুলো ছাড়া আর কিছু আছে?”
অনিদা তাতে বলল, “তিন নম্বরটা হল, এনারা তিন জন ছাড়া আর কে কে আছেন যাঁরা হিরেটার কাছে যেতে পেরেছিলেন।”
“এসিপি গুহ আর জুনিয়র অফিসার আবীর বোস। কিন্তু এনারা তো পার্থ মিত্রদের প্ল্যানের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না,” অনিদাকে বললাম আমি।
তাতে অনিদা “হুঁ” বলে বারদুয়েক ওপর-নিচ মাথা নাড়ল।
আমি তখন বললাম, “তাহলে তো প্রমাণ হয়েই গেল যে আবীর বোস বা এসিপি গুহ, কেউই এর সঙ্গে জড়িয়ে নেই।”
অনিদা এর উত্তরে একটা অন্য কথা বলল। ও বলল, “কাল আবীর বোস একটা মিথ্যে কথা বলেছিলেন।”
“মিথ্যে কথা?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সেটা কী রকম?”
অনিদা তখন বলল, “কাল যখন ওনার সঙ্গে নিচে আমাদের দেখা হল, তখন উনি বলেছিলেন যে উনি সিগারেট কিনতে গেছিলেন।”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন। কিন্তু তাতে কী?” অনিদা কী বলতে চাইছে বুঝলাম না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি বলতে চাইছ উনি সিগারেট কিনতে যাননি? আর যদি নাই বা গিয়ে থাকেন, তুমি সে কথা জানলে কী করে?”
“কারণ ওনার বুটে তখন কাদার দাগ লেগে থাকতে দেখেছিলাম, যেটা ছিল কিনা টাটকা। আর ওনাদের অফিসের সামনে যে সিগারেটের দোকানগুলো রয়েছে, সেখানকার সব রাস্তাই পাকা। ঢালাই করা। অনেক বৃষ্টিতেও কাদা জমার কোনও চান্স নেই। আর কাল তো বৃষ্টিও হয়নি! তাহলে জুতোয় কাদা এক কোথা থেকে?”
“তার মানে উনি কাদা জমা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন!”
“কাদা জমা মানে – মাটির রাস্তা?”
“হ্যাঁ। আমি দেখেছি যে তেমন রাস্তা ওনাদের অফিসের ডান দিকেই আছে।”
অনিদা তাতে হেসে বলল, “গুড অবজারভেশন।”
আমি তখন চমকে উঠে বললাম, “কিন্তু আবীর বোস ওদিকে কেন গেছিলেন ওই সময়?”
“সেটা নিয়ে ভাবার এখনও সময় আসেনি। তাই পরের পয়েন্টটা নিয়ে আলোচনা করা যাক,” বলল অনিদা।
“ওকে,” আমি ঘাড় কাত করে বললাম, “তবে তাই হোক।”
অনিদা তখন বলল, “হিডেন ক্যামেরাতে কিছুই ধরা পড়েনি। অথচ হিরেটা ঘরের মধ্য থেকেই চুরি হয়েছে। তাই প্রশ্ন হল কে কাজটা করেছে। আর তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন, কী করে করেছে? আর সেটা জানতে পারলে অনেক কিছুর ওপর থেকেই ঢাকনা সরে যাবে রে জয়।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনিদা। তারপর বলল, “এই অজানা উত্তরটাই হল আমার চার নম্বর পয়েন্ট।”
প্রথম দুটো পয়েন্ট সহজেই মাথায় ঢুকেছিল। এবারে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেললাম। এত কিছুর পরেও পাঁচ শতাংশের বেশি এগোতে পারিনি আমরা। আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চিন্তাটা শূন্য থেকে শুরু হয়ে আবার শূন্যতে এসে মিলিয়ে গেল। তাই আমি একরকম হতাশ হয়েই অনিদাক জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার সন্দেহটা তাহলে কোথায় হচ্ছে?”
অনিদা তখন আমাকে বেশ হতাশ করে বলল, “সন্দেহ করতে গেলে তো শক্তপোক্ত একটা বেস লাগে। সেটাই তো পাওয়া যাচ্ছে না!”
“তাহলে এবার কী করনীয়?”
“চল, সিসি টিভির ফুটেজটা একবার দেখে নিই,” বলে অনিদা এবার হার্ড ডিস্কে করে আনা সেই পাঁচ ঘণ্টার ফুটেজটা চালিয়ে দিল।
এমন একটা পাগলাটে বোরিং কাজ আমি জীবনে করিনি। ল্যাপটপের স্ক্রিনে সি আই ডি অফিসের বারো তলার ঘরটা দেখা যাচ্ছে। সব একেবারে চুপচাপ। কিছুটি নড়ছে না। বোঝা যাচ্ছে না যে এটা স্টিল ছবি না ভিডিও। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার জোগাড়। পাঁচ মিনিটই কাটছে না, পাঁচ ঘণ্টা কী করে দেখব!
খুব কষ্ট করে দেড় ঘণ্টা দেখেই মারাত্মক কাহিল হয়ে পড়লাম আমি। চোখ খুলেই ঝিমোচ্ছি। ঠিক এমন সময় অনিদা চেঁচিয়ে উঠল, “হোল্ড অন, হোল্ড অন!” আর সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। অনিদার চিৎকারে তখন আমার ঝিমোনি উধাও।
“ব্যাক কর, ব্যাক কর,” বলে নিজেই অনিদা ফুটেজটাকে কয়েক মিনিট পিছিয়ে দিল। এবার সেটা আবার চলতে শুরু করতে দেখি ওর চোখ জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে। এবার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “দেখ!” স্পষ্ট উত্তেজনা ধরা পড়ছিল ওর গলায়।
আমি তখন ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে দেখি সিসি টিভিতে তোলা ফুটেজে ঘরের মেঝেতে লম্বা সরু একটা দাগ দেখা যাচ্ছে!
“স্লাইডিং জানালার দুটো স্লাইড বন্ধ করার পর মাঝে যে জায়গায় স্লাইড দুটো এসে মেশে, সেখানকার দুটো স্লাইডের ধারের কাঠামোগুলো সামনে পেছনে একসঙ্গে থাকে। এবার বুঝতে পারছিস?” মেঝের সরু দাগটা দেখিয়ে আমাকে অনিদা বলল, “এই দাগটা সেটারই ছায়া।”
জিনিসটা অবশ্য আমি আগেই দেখেছি। তাই বললাম, “এটা তো আগেই ছিল। এটার মধ্যে আবার কী নতুন জিনিস খুঁজে পেলে তুমি?” কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে দেখি লম্বা ছায়াটা ম্যাজিকের মতো দু’আধখানা হয়ে দু’দিকে সরতে শুরু করেছে!
অনিদা তখন চাপা গলায় বলল, “জানালাটা কেউ বাইরে থেকে খুলছে!”
আমার ততক্ষণে বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করে দিয়েছে। গলার কাছটা শুকিয়ে আসছিল। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করছি মুখোশের আড়াল থেকে আসল অপরাধীর বেরিয়ে আসার। কিন্তু হঠাৎ করে পুরো ভোঁ ভাঁ! আমাদের সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে আচমকা থেমে গেল ক্যামেরা! রাগে ঠোঁট উলটে অনিদার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা কী হল অনিদা?”
অনিদা তখন বলল, “ঠিক এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড অপেক্ষা কর। ক্যামেরা আবার চলতে শুরু করবে।”
“এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড!” আমি অবাক হয়ে বললাম, “সে আবার কী?”
“আঃ! দেখই না,” ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল অনিদা।
আর হলও তাই। ‘পজ’ হবার ঠিক এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড বাদে আবার চলতে শুরু করল ক্যামেরা! কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেঝের ওই দাগটা তখন আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে! স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা!
“এটা কী হল?” এবার বিরক্ত লাগল আমার।
“কী আবার হবে?” হেঁয়ালি করে অনিদা বলল, “যা দেখলি, তাই হল।”
“মানে?”
“মানে চোর এই দু’মিনিটের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলেছে।” বলে ল্যাপটপ থেকে এবার হার্ড ডিস্কটা খুলে নিল অনিদা।
আমি তখন বললাম, “ওকি! ওটা বের করে নিলে যে? আর দেখব না?”
অনিদা তখন সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বলল, “লাভ নেই। ক্লু বা সূত্র, যাই বল না কেন, ওই এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড!” এবার উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে তর্জনীতে ঘোরাতে শুরু করল ও। এর মানে আমি জানি। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, “এসময় চললে কোথায়?”
অনিদা তাতে বলল, “কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নে।”
“কোথায় যাব?”
“সি আই ডি অফিসে।” তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ভুরু কুঁচকে চেয়ে থেকে বলল, “ক্যামেরাটা শুধু কারেন্টেই চলে নাকি ব্যাটারিতেও চালানো যায়?”
“ব্যাটারিতে?” অনিদার কথার মানেটা আমার কাছে পরিষ্কার হল না।
ও তখন বলল, “আশা করি লক্ষ করেছিস যে ক্যামেরার সুইচটা ঘরের ভেতরেই ছিল?”
“হ্যাঁ, ক্যামেরার ঠিক নিচে।”
“তবে সেটা বন্ধ করতে হলে কাউকে না কাউকে ঘরের ভেতরে আসতেই হবে।”
“কিন্তু ভেতরে তো কাউকে দেখতে পেলাম না!”
“তার
মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে লোডশেডিং হলে তবেই একমাত্র ক্যামেরা বন্ধ করা যায়।”
আমি তখন বিরক্ত হয়ে বললাম, “ওঃ, ওই সময়তেই লাইট যেতে হল?”
“লাইট অফ ছাড়া আরও নানা ভাবে তো ক্যামেরা বন্ধ করা যায় জয়।”
আমি প্রশ্ন নিয়ে অনিদার দিকে তাকালাম। ও বলল, “কেউ যদি ইচ্ছ করে সেটা বন্ধ করে দেয়?”
কথাটা শুনে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। কারণ এটার মানে হচ্ছে, এই চুরির সঙ্গে এক জন না, অন্তত দু’জন জড়িয়ে!
অনিদা তখন বলল, “এতে একটা জিনিস অন্তত জানা গেল যে, চোর এসেছিল জানালা দিয়ে। আর তাতে আন্দাজ করা যায়, এর পেছনে বাইরের কোনও মাথা কাজ করছে না।”
“তার মানে কি কেউ এমন আছে যে এই গোয়েন্দাদের মধ্যেই কারও হয়ে কাজ করছে?”
“শেষ পর্যন্ত সেটাই না হয় রে জয়। কারণ বাইরের কারও পক্ষে এভাবে বারো তলার ঘরে ঢোকা – বলতে গেলে তো অসম্ভব, তাই না?”
রাস্তায় যেতে যেতে তিনটে বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হল।
এক, কারেন্ট যদি নিজে থেকে যায়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, বেছে বেছে ঠিক ওই সময়তেই কারেন্ট যেতে হল!
দুই, কারও সাহায্য ছাড়া চোর ওই বারো তলার ঘরে ঢুকল কী করে? সিঁড়ি ভেঙে নাকি বারো তলার কার্নিশ বেয়ে?
তিন, এবার অনিদা কিন্তু আমার সন্দেহর কথাটাই তুলল। অপরাধী কি গোয়েন্দাদেরই এক জন?
অনেকটা ইঞ্জিনিয়ারদের মতো সি আই ডি অফিসের বারো তলার ঘরটা মন দিয়ে দেখছিল অনিদা। আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চোর আসার রাস্তাটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম। এখান থেকে নিচের দিকে তাকালেই মাথাটা বোঁ বোঁ করে ওঠে। গা গুলিয়ে যায়। তাই এই পথে চোর ঢুকবে, বিশ্বাস হয় না।
জানালার পাল্লা খুলে অনিদা এবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে অনেকক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ আমার হাত ধরে টেনে আমাকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
“ওকি! চললেন কোথায়?” আমাদের এভাবে যেতে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন পার্থ মিত্র।
তাতে “আসছি” বলে অনিদা ওনার দিকে না তাকিয়ে সটান দরজা খুলে বেরিয়ে এল। এক তলায় এসে নিচ থেকে অনেকক্ষণ ধরে সি আই ডি অফিস বিল্ডিংটার দিকে চেয়ে রইল অনিদা। দেখতে দেখতে আমরা ততক্ষণে কাঁচা রাস্তাটা ধরে বাড়ির পেছন দিকে চলে এসেছি। এবার বিল্ডিং-এর পেছন দিকে কোনায় একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল অনিদার।
এবার “এটা কী” বলে ও সেটার দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন আমিও। কাছে গিয়ে দেখা গেল জিনিসটা একটা লোহার ঢাকনা! দু’জন মিলে অনেক চেষ্টা করেও এক চুল নড়াতে পারলাম না সেটাকে। একবার কান পাতলাম ঢাকনাটার ওপর। ভাবলাম যদি কিছু কানে আসে। মনে হল, ঢাকনাটার ভেতরের দিকে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। সুড়ঙ্গ কি? জানি না। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে দেখলাম। ভেতরটা ফাঁপা বলেই মনে হল।
“এটা তো সাধারণ কোনও ম্যানহোল বলে মনে হচ্ছে না অনিদা। ভেতর থেকে বন্ধ মনে হয়।”
কলকাতা শহরে এই ধরনের ম্যানহোল অনেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সারা শহরের ড্রেনগুলো এই ম্যানহোলগুলো থেকে অপারেট করা হয়। তবে আমার মনে হল না যে এটা একটা ম্যানহোল। অনিদাও মনে হল আমার মতোই ভাবছে। বলল, “মনে হচ্ছে কোনও এমারজেন্সি ডোর।”
অনিদা এবার পার্থ মিত্রকে ফোন করতে জানতে পারলাম আমাদের অনুমানই ঠিক। চোরা পথে একটা সিঁড়ি এগারো তলা থেকে নেমে এসে এই জায়গায় মিশেছে। আগুন লাগা থেকে শুরু করে আচমকা বিপদের হাত থকে বাঁচতে এই ব্যবস্থা।
“এই দেখ জয়,” অনিদা এবার হাঁটু গেড়ে বসে ঢাকনাটার চাবি দেবার জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে বলল, “এখানে ইন্টারলক সিস্টেম রয়েছে।”
আমি তখন বললাম, “তার
মানে তো এটা বাইরে ভিতরে, দুদিক থেকেই খোলা যায়?”
এতে হাসির ঝলক দেখা গেল অনিদার মুখে। এবার উঠে দাঁড়িয়ে হেঁয়ালি করে বলল, “দেবীর ব্রজে আগমন নাকি গজে, সেটা অন্তত এবারে বোঝা গেল।” তারপর আমাকে বলল, “তুই ওপরে যা।”
“আর তুমি?”
“আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে রাস্তার দিকে দৌড়ে চলে গেল অনিদা। এবার বারো তলায় উঠে ঘরে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন মিঃ রায়। “কী ভাই? কোথায় গেছিলে তোমরা?” এবার অনিদাকে দেখতে না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার দাদাটি কোথায়?”
অনিদা কোথায় গেছে আমাকে বলে যায়নি, কথাটা ওনাকে বলতে লজ্জা করছিল। এমন সময় হুড়মুড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকল অনিদা।
“৩২৯ ফর সিক্স। কোহলি আবার সেঞ্চুরি!”
এই দু’দিন আগেই এশিয়া কাপ শেষ হয়েছে। এর মধ্যেই আবার শুরু হয়ে গেছে ভারত নিউজিল্যান্ড সিরিজ। কিন্তু এমন একটা সিরিয়াস কাজের সময়তেও অনিদা খেলা নিয়ে আলোচনা করছে! পারে বটে অনিদা! ওর মুখে এমন একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনে তিনজন অফিসার একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। অনিদা অবশ্য এতে গা করল না। বলল, “নিচ থেকে যে সিঁড়িটা উঠে এসেছে, সেটা কোথায় গিয়ে মিশেছে, একবার আমাকে দেখাবেন চলুন।”
“ও সারটেইনলি,” মিঃ ঘোষ এবার আমাদের এগারো তলার সেই সিঁড়ির মুখটাতে নিয়ে গেলেন, পেছন পেছন এলেন বাকি দুই অফিসারও।
মাত্র কুড়ি মিনিট। তার মধ্যেই এই সিঁড়িটা বেয়ে নেমে নিচ থেকে ঘুরে চলে এল অনিদা। এত কম সময়ের মধ্যে এগারো তলা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে একটু হাঁপাচ্ছিল বটে, কিন্তু একেবারে ধরাশায়ী হয়নি। অনিদার এতটা দম পাওয়ার কারণ আমি জানি। সকালে উঠে নিয়মিত যোগব্যায়াম।
“নতুন কোনও সূত্র পেলে?”
আমার প্রশ্নের উত্তরে অনিদা বলল, “গোপনে যাতায়াত করার জন্য এই সিঁড়িটা খুবই হেলপফুল।” তারপর পার্থ মিত্রর দিকে চেয়ে বলল, “চোর কিন্তু এ’পথেই এসেছিল মিঃ মিত্র।”
“সে কী!” অনিদার কথা শুনে অবাক হয়ে মিঃ ঘোষ বললেন, “কী করে?”
পাশ থেকে মিঃ রায় বললেন, “কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব?”
“কেন নয়?” এবার মিঃ রায়ের দিকে ফিরল অনিদা।
“কারণ যে’ই এ রাস্তা ব্যবহার করে থাকুক তাকে তো বাইরের লোহার ঢাকনা খুলতে হবে। চাবি পাবে কোথা থেকে মিঃ সেন?” অনিদার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না পার্থ মিত্র।
আমি বললাম, “সিঁড়ি তো এগারো তলা পর্যন্ত। কিন্তু তারপর?”
অনিদা তখন হেসে বলল, “তারপর খুব সোজা। নিচ থেকে খেয়াল করিসনি? এই দেয়ালে যে কাচের স্লাইডিং জানালা আছে, তার ঠিক নিচে একটা শেড আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে সহজেই এই জানালার নাগাল পাওয়া যায়। সিঁড়িটা এগারো তলায় যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেও একটা কাচের স্লাইডিং জানালা আছে। এই জানালা আর ওই শেডটার মধ্যে ফারাক মাত্র এক হাত। জানালা থেকে সহজেই শেড-এ টপকে যাওয়া যায়। তাই এটা অনুমান করা যায় যে চোর এই পথেই বারো তলার এই ঘরে ঢুকেছিল।”
অনিদার কথা শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল। এত উঁচু তলার কার্নিশ – চোরের সাহস আছে বলতে হবে। একটা পা জানালাতে রেখে এক হাতে দেয়াল ধরে অন্য পা’টা কার্নিশে – নাঃ, ভাবা যাচ্ছে