ঠাম্মির
বিয়ের গয়নাগাটি
জয়তী মুখোপাধ্যায়
।। পর্ব ১ ।।
।। পর্ব ২ ।।
_____
জয়তী মুখোপাধ্যায়
বিজয়া দশমীর
দুপুরেই খোয়া গেল ঠাম্মির বিয়ের গয়নাগাটিগুলো। বুম্বা, মিঠি, রোরো, কুঁড়ির
ঠাম্মি হাঁই হাঁই করে ভুলভাল কথা, যেমন
পদ্মপিসিকে বালাপোশগুলো রোদে দিতে গিয়ে “বালুসাইগুলো একটু ছাদে বিছিয়ে দিস তো
পদ্ম” বলবেন, হাউমাউ
করে হাসবেন... এসবই তো স্বাভাবিক। সে জায়গায় কী না ঠিক মা-দুগ্গা চলে যাওয়ার
সময়টায় তাঁর মুখে আঁধার ছাইল। প্রদীপের আলোয় চোখের কোনায় ঠলঠলে জল ধরে রেখে পানের
পাতায় মায়ের গাল সেঁকলেন ঠাম্মি। পদ্মপিসিকে কাছে বসিয়ে সারাটা সন্ধে ফ্যাঁচফোঁচ
করে নাক টানলেন। বুম্বা, মিঠি, রোরো, কুঁড়ির
মায়েরা বহু সাধ্য-সাধনা করেও মুখে একদানা খাবার তোলাতে পারল না। ঠাম্মির মুখে
শুধুই এক রা,
"ওগুলো আমার বিয়ের গয়না ছিল বৌমা। আমার মরা বাপ-মায়ের শেষ
স্মৃতি। তোমরা আমাকে খেতে বল কোন আক্কেলে?"
মায়েরা বিফল
হলে বাবারা হাল ধরে। তারাও হার মেনে ফিরে যায়।
দাদুন
ব্যাপারখানা সামাল দিতে এসে ঠাম্মির ঝাঁঝের মুখে পড়েন, "খুব তো শখের
গোয়েন্দা গপ্পো লেখ। আর আজ যে দেখি লিখিয়ের ঘরেই চোর
সেঁধিয়ে সর্বস্ব নিয়ে চম্পট দিল। কই, দেখি এবারে মুরোদখানা একবার! ধরে আনো
বলছি যেখান থেকে পারো, কেড়ে এনে আমার বাপ-মায়ের দেয়া ধন আমার সামনে হাজির কর। আর
তা যদি না পার,
তবে তোমার ওই লেখার কলমখানা কুসুমগোড়ের জলে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে মায়া
কোরো না,
বুঝলে?"
ঠাম্মির
অভিযোগের সামনে দাদুন কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। বার দুয়েক গলা খাঁকারি
দেন। খাঁকারিই সার। স্বর ফোটে কই? দাদুনের এই ল্যাজেগোবরে দশার জন্য
বুম্বারা মোটেই তৈরি ছিল না। পুজোর দিন ক'টা বেশ
হুড়মুড়িয়ে আমোদ করে পেরুল বটে, কিন্তু দশমীর দুপুর থেকে সে যে আরেক
চেহারা নেবে তা কে-ই বা জানত? এদিকে ঠাম্মির রাগ-অভিমান হওয়ার
মধ্যে তারা কোনও দোষও খুঁজে পাচ্ছে না। আহা রে! সত্যিই তো! ঠাম্মির বাবা-মায়ের
দেওয়া গিফট বলে কথা! হতচ্ছাড়া চোরটা এটা উচিত কাজ করল না। এভাবে একটা ভালোমানুষকে
কাঁদানো'টা
কি ঠিক?
বুম্বার
দাদুন গোয়েন্দা গল্প লেখেন। দাদুনের লেখা কয়েকটা গোয়েন্দা গল্পের সংকলন আছে।
তাছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন-টেখেন। কিশোর গোয়েন্দা ‘ক্যাপ্টেন
টুবাই’ চরিত্রটি তাঁরই সৃষ্টি। খুদে পাঠকরা মুখিয়ে থাকে ক্যাপ্টেন টুবাইয়ের
পরবর্তী কার্যকলাপ পড়ার জন্য। আর বড়োদের গোয়েন্দা বলতে তাঁর ‘ক্যাপ্টেন কাকাতুয়া’-র
ব্যাপক ক্রেজ। এহেন দুঁদে লেখকের ঘরে চোর পড়াটা যতটা না দুঃখের তার চাইতে ঢের বেশি
লজ্জার। ছি ছি! লোকজন শুনলে বলবে কী? পুজোর ছুটির পরে যেদিন স্কুল খুলবে
সেদিনই তো বুম্বা, মিঠি আর রোরোকে তাদের বন্ধুরা ঘিরে ধরে দাদুনের গল্প শুনতে
চাইবে। কুঁড়ির অবশ্য সে সব সমস্যা নেই। কুঁড়ির বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করে।
হায়দরাবাদে পোস্টেড এখন। কুঁড়ি হায়দরাবাদে একটা বেসরকারি ইংরেজি স্কুলে পড়ে।
সেখানের ছেলেমেয়েরা কি আর গোয়েন্দা টুবাইকে চেনে যে কুঁড়িকে পেলেই তাকে মৌমাছির
মতো ছেঁকে ধরবে ‘গল্প শোনাও’ বলে? সমস্যাটা তাই বাকিদের, যারা
কলকাতার ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নামিদামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করে, যাদের
বন্ধুদের বাবা-মায়েরা ছোটোদের ম্যাগাজিন কিনে-টিনে দেয় এখনও। ঘাড়
দুমড়োনো পড়ার চাপের ফাঁকেফোঁকরে এইসব ম্যাগাজিনগুলো যাদের একটু হলেও রিলিফ দেয় আর
কী!
বুম্বা রোরো
মিঠিরা বেশ বুঝতে পারছে দাদুনের প্রেস্টিজে পিন ফুটিয়ে দিয়েছে কেউ। তবে, দাদুন
কি আর ছেড়ে কথা কইবেন? ক্যাপ্টেন টুবাই যাঁর কলমের একেকটা আঁচড়ের দাস তাঁর কাছে
এসব ছিঁচকে চোর-টোরগুলো নস্যি।
চিলেকোঠার
ঘরে ওরা চার জন এককাট্টা হয়েছে। ওটাই ওদের লুডো খেলা থেকে আরম্ভ করে গল্পগাছা করার
ভালো জায়গা। এককাছে হওয়ার সুযোগ তো বছরে এই একটিবারই হয়। বুম্বাদের বাবারা চার
ভাই। হরিদেবপুরের স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি অবধি পড়াশোনা করে সদর শহরের কলেজ থেকে
পাশ করে এখন চাকরিতে বেশ ভালো ভালো পদে রয়েছে চারজনেই। সবার ছোটো যে ভাই মানে
কুঁড়ির বাবা বাদে বাকিরা কলকাতার আনাচেকানাচে থাকে। চার জনের মধ্যে বুম্বা বড়ো। ক্লাস
এইট চলছে। রোরো-মিঠির ক্লাস সিক্স, আর কুঁড়ির ক্লাস টু।
হিতেন বলে
একটা কালোকুলো আদিবাসী ছেলে দাদুনের ফরমায়েশ খাটার জন্য মোতায়েন থাকে। তাকে নিয়ে
দাদুন ভারী গদগদ। তরতরিয়ে গাছে চড়ে কচি ডাব নামায়, কুসুমগোড়ের
জলে ডুবসাঁতার দিয়ে এপার-ওপার করে, মানে এককথায় হি-ম্যান, সুপার-ম্যান, ব্যাটম্যান...
সবেরই কম্বোপ্যাক। বুম্বা রোরো মিঠি কুঁড়িরা তাকেই মূল সন্দেহের তালিকায় রেখেছে
আপাতত। ওদের ধারণা এটা কোনও বাইরে থেকে আসা চোরের কাজ নয়। খুব বিশ্বস্ত লোক ছাড়া
একাজ প্রায় অসম্ভব। অতএব ওই হিতেন ব্যাটাই চোর না হয়ে যায় না। খুব তক্কে তক্কে
থাকতে হবে। ব্যাটাকে ওয়াচ করতে হবে।
ঘটনার ঠিক
দু’দিন বাদেই নিচে খাওয়াদাওয়ার পাট সেরে এসে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকেই ওরা অবাক। মেঝেতে
গোল্লা পাকিয়ে পড়ে রয়েছে একটা ঢিল মোড়ানো চিরকুট। বুম্বা ছুটে গিয়ে তুলে নিয়ে
চিরকুটটা খুলে পড়ল জোরে জোরে...
‘লোহিততনু
কুসুম পাশে তন্ডুলছায় বাস
জলের ধারে
মিলবে প্রভাতকিরণ বারোমাস।’
বুম্বা
বারকয়েক পুনরাবৃত্তি করে পড়ল। গম্ভীর মুখে বলল, "এটা ঠাম্মির
গয়নাচোরের লেখা চিঠি বলে মনে হচ্ছে।"
কুঁড়ির
মাথায় কিছুই ঢুকল না। মিঠি বলল, "বুমদাদা, আমি শুনেছি
আগেকার দিনে ডাকাতরা ডাকাতি করার আগে এ'রম চিঠি পাঠাত। গল্পবইতে পড়েছি। আমার
মনে হয় এ কোনও কবি চোর।"
"হ্যাহ, কবি
চোর! মাথামোটা কোথাকার। হয় চোর হবে, নয় কবি। কবি চোর বলে কিস্যু হয়
না।"
রোরোর
ধাতানিতে মিঠি চুপ করে গেল। কুঁড়ি বলল, "আমি মাথামোটা মানে জানি... ইডিয়ট।
তাই না বুমদাদা?"
"আহ!
তোরা থামবি?
কবিতাটায় কিছু ইনফো রয়েছে, আই মিন ক্লু। এগুলো ধরে এগোলেই চোরের
সন্ধান পাওয়া যাবে," বুম্বা বিরক্ত হয়।
"লোহিত
মানে লাল আর কুসুম মানে ফুল। তাহলে হল গিয়ে লাল ফুল। কিন্তু ওই তন্ডুল না
ভন্ডুল... ওটা কী জিনিস?" মিঠি জিজ্ঞেস করল।
"তন্ডুল
মানে আমিও জানি না। তবে তেন্ডুলকারের সঙ্গে মিল পাচ্ছি," বলেই হি হি করে হাসে
রোরো।
রোরোর মাথায়
একটা হালকা গাঁট্টা মেরে বুম্বা বলল, "তন্ডুল মানে চাল বা এখানে ধান
বলতে পারিস। চাল হল যা দিয়ে আমরা ভাত রান্না করে খাই..."
"ইডলি
দোসা উটাপ্পামও খাই বুমদাদা," কুঁড়ি উৎসাহী হয়ে ওঠে।
"ইয়েস, খাই।
আর প্রভাতকিরণ তো খুব ইজি। সকালের রোদ..."
মাথায়
গাঁট্টার জায়গাটায় হাত বুলোতে বুলোতে বুম্বাকে থামিয়ে রোরো বলে, "উফ, চোরটা
কি আমাদের সঙ্গে রিডল রিডল খেলতে চায়? এত কঠিন কঠিন বেঙ্গলির ক্লাসই বা
নিচ্ছে কেন?"
"হতেও
পারে। যাই হোক,
এটা আমার কাছে রাখি। দেখি, আর কিছু পাঠায় কি না," বলতে
বলতে বারমুডার পকেটে চিরকুটটা ভরে ফেলল বুম্বা।
সেদিনের মতো
ওরা আলোচনা থামাল।
পরদিনও
দুপুরে খেয়ে উঠে ওরা একইভাবে চিরকুট পেল। এটাতে লেখা...
‘জলের নিচে
মরণ আবার জলেই পচে সভ্য
আঁশের সুতোয়
মোড়ক জেনো অতি সহজলভ্য।’
"যাব্বাবা!
এবারে কী হবে বুমদাদা? জলে মরছে আবার জলে পচে সভ্যভদ্র হয়ে যাচ্ছে। ইয়ার্কি না কি?" রোরো
বোদ্ধার মতো মাথা চুলকোতে থাকে।
"হুমম, আবার
আঁশের সুতোয় মোড়ক। আঁশ কীসে কীসে হয় বল তো রোরো?" মিঠি যেন
রোরোর কোচিং-এর মিস।
"মাছের
হয়! আবার কার?
গোসাপেরও হতে পারে," রোরো কাঁধ ঝাঁকায়। ভাবখানা এমন যেন এত সিম্পল একটা
ব্যাপার মিঠি জানে না।
"উঁহু, এখানে
মাছের কথা আসছে না। মাছের আঁশের সুতো, আবার তাই দিয়ে মোড়ক তৈরি হবে না,"
বুম্বা চিবুক চুলকোয় বারকয়েক। কুঁড়ি চিরকুটের ঢিলটা নিয়ে খেলা করতে থাকে।
নিচের বড়ো
বারান্দায় সকলে খেতে বসেছে টানা শতরঞ্জি পেতে। দাদুন শুধু চেয়ার টেবিলে। হুইলচেয়ার
থেকে টেবিলে বসিয়ে দেওয়া হয় দাদুনকে। রোড অ্যাক্সিডেন্টে একটা পা কেটে বাদ গেছে
দাদুনের তা প্রায় বছর কুড়ি আগে। বাড়ির ছেলেরা আর বাচ্চারা আগে খাবে। ঠাম্মা মা
কাকিমা আর পদ্মপিসির দল পরে। হিতেনও খায় ছেলেদের দলের সঙ্গেই, তবে
বারান্দায় নয় বাঁধানো উঠোনে বসে। ঠাম্মি-দাদুন বহুবার বলা সত্ত্বেও সে বারান্দায়
ওঠে না। কোনও ঘরেও ঢোকে না। দাদুন আর বাবা কাকারা বসলেও হিতেনকে দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে না। ঠাম্মি হাঁক পাড়লেন, "ওরে ও মুখপোড়া হিতেন। বলি ভাত দু'টো
খেয়ে আমাদের উদ্ধার কর। তোমরা ব্যাটাছেলেরা না খেলে বৌমারা মুখে ভাত তোলে কী করে?"
দাদুন
ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,
"আআহ! কেন চিৎকার চেঁচামেচি করছ? হয়তো স্নানে
দেরি হচ্ছে। এসে পড়বে ঠিকই। আমায় একটু মোচার ঘন্টটা দাও তো বৌমা!"
রোরো নিজের
মায়ের দিকে তাকিয়ে কড়ি আঙুল উঁচিয়ে কী একটা ইশারা করতেই রোরোর মা বিরক্ত মুখে বলল, "এই
এক দোষ। খাওয়ার আগে করে আসতে পার না? এখন ভাত ফেলে রেখে উঠতেই হবে তোমাকে? যত্ত
বদভ্যাস...যাও!"
রোরো তলপেটে
হাত দিয়ে হাফপ্যান্টের নাড়া খামচে দৌড়ে গেল।
কুঁড়ি বলল, "আমি
মোচা খাই না। আমাকে পেরুগু দাও।"
"ও
কী চাইছে ছোটো বৌমা? পেরুগু কী?" ঠাম্মি কুঁড়ির আধা তেলুগু কথা বুঝতে
পারেন না।
"দই
খেতে চাইছে মা। আমি দিচ্ছি।"
আবারও
চিরকুট পাওয়া গেল একই সময়ে একইভাবে। লেখা ছিল...
‘মাতৃজ্ঞানে
পূজ্য প্রাণী। বাহ্য হতে পাই
চাইতে গেলে
গয়নাগাটি যাও সে ঠিকানায়।’
এটা খুব সহজ
মনে হল সকলের। রোরো প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছে উত্তেজনায়, "আরে এ তো
গরুর কথা বলছে। ওই যে মাতৃজ্ঞানে পূজ্য প্রাণী। ভগবতী মা মানে তো গরু।"
"হ্যাঁ, তুই
তো বুঝবিই। নিজেই গরু কী না! মিল খুঁজে পেয়েছিস তাই," খিল খিল করে হেসে সেদিন
তাকে মাথামোটা বলার শোধ তুলে নেয় মিঠি। রোরো মিঠির দিকে ভেংচি কাটে।
কুঁড়ি বলে, "দিস
ইজ ব্যাড মিঠিদিদি। রোরোদাদা ইজ নট আ কাও।"
"ছাড়
কুঁড়ি, ও
একটা পাগল। বুমদাদা এরপরে বলো, কী ক্লু পেলে?"
"মনে
হচ্ছে প্রায় সলভ করে ফেলেছি রে! গোয়ালবাড়িটা একবার বিকেলে ঘুরতে যাব বুঝলি সবাই
মিলে।"
পড়তি
দুপুরের দিকে সদর দরজায় সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ পেয়ে ছুটে গেল বুম্বা। রোরো মিঠি কুঁড়িকে
ওদের মায়েরা জোর করে থাবড়ে-থুবড়ে ঘুম পাড়িয়েছে। বুম্বা একা জেগে পুজোসংখ্যায়
দাদুনের লেখা ক্যাপ্টেন টুবাই-এর গল্পটা পড়ছিল। দাদুনের নামে রেজিস্টারড চিঠি
এসেছে। বুম্বা নিয়ে গেল দাদুনের কাছে। দাদুনেরও চোখ একটু লেগে এসেছিল। উঠে বসে
নিজের কলমটা চাইলেন। বুম্বা এগিয়ে দিল। দাদুন খচ খচ করে বাংলা হরফে সই করে দিলেন, "অম্বরীশ চট্টোপাধ্যায়"।
বেশ খুশি
খুশি মুখে বললেন, "এটা কীসের চিঠি বল তো দাদুভাই?"
"কীসের
দাদুন?"
"এবারের
পুজোসংখ্যায় লেখার জন্য ধন্যবাদ জানানো চিঠি। পত্রিকা অফিস থেকে পাঠিয়েছে। মেইল
করে দিলেও পারত যদিও। তবু হাতে লেখা চিঠির আলাদাই ইজ্জত। বুঝেছ?"
দাদুনের সই
করা কাগজটা পিওনের হাতে ফেরত দিয়ে এল বুম্বা। নিঝুম দুপুর গড়িয়ে চলল। বুম্বা
নিজেদের ঘরটা থেকে তাকিয়ে রইল পদ্মপিসির ঘরের পাশে খড়ের চালার গোয়ালঘরটার দিকে।
ক্যাপ্টেন টুবাইয়ের পাতাগুলো উড়ে উড়ে খেলা করছিল। ক্যাপ্টেন টুবাই বুম্বারই বয়সি। সে
তার স্কুলে বোমা পুঁতে রাখা দুষ্কৃতিদের ধরে দিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে এবারের
পুজোসংখ্যার গল্পে। বুম্বা পারবে না ঠাম্মির গয়নাগাটিগুলো খুঁজে এনে দিতে?
সবাইকে ডেকে
এনে বারান্দায় বসিয়েছে বুম্বারা। হিতেন যথারীতি উঠোনেই। উবু বসা। বুম্বা সবাইকে
চমকে দিয়ে বলল,
"হিতেন কাকু, তুমি কিন্তু ধরা পড়ে গেছ!"
হিতেন চমকে
চোখ তুলে চাইল বুম্বার দিকে। তারপরেই দাদুনের দিকে অপরাধীর চোখে তাকিয়ে মাথা নিচু
করে চিবুক ঠেকাল জোড়া করা হাঁটুতে।
শোরগোল পড়ে
গেল বারান্দায়। উপস্থিত সবাই যেন আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে এসে পড়েছে। এর-ওর মুখ
চাওয়াচাওয়ি করছে। কুঁড়ি হঠাৎ হাততালি দিতে লাগল, "কী মজা কী
মজা! হিতেন কাকুকে ধরে ফেলেছে বুমদাদা। হিতেন কাকু ইজ আ থিফ..."
কুঁড়ির মা
ওকে কোলে টেনে নিয়ে ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে চুপ করতে বলল। রোরো বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলল, "ডোন্ট
মাইন্ড দাদুন,
এই হিতেন কাকুকে আমার প্রথম থেকেই খুব সন্দেহ হত। কিন্তু, আমি
বলিনি। তুমি আবার খুব ভালোবাসো, তাই।" ঠোঁট উলটিয়ে কাঁধ তুলল
রোরো।
দাদুন চুপ।
ঠাম্মি চিৎকার করে কপাল চাপড়াচ্ছে, "হে চূড়ামণি, এই ছিল
তোমার মনে?
শেষে কি না আমি দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষলাম। অ্যাই হিতেন, চুপ
করে আছিস কেন রে হতভাগা? বল, বল তোর পেটে
পেটে এত কুবুদ্ধি লুকিয়ে ছিল রে! কী দিইনি তোকে আমরা? শেষে আমার
মরা বাপ-মায়ের দেয়া গয়নাগুলো!"
হিতেন জবাব
দেয় না। একভাবে মুখ নিচুতে ঝুলিয়ে রাখে। বাবা-কাকা-মা-কাকিমারা অস্বস্তি বোধ করে।
দাদুন বার দুয়েক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, "তাহলে হিতেনের ঘর সার্চ করা
হোক। করলেই গয়না পাওয়া যাবে, তাই তো না কি বুম্বা দাদুভাই?"
"না
দাদুন, হিতেন
কাকুর ঘরে কিচ্ছু নেই। কারণ চুরি তো হিতেন কাকু করেইনি।"
"সে
কী! এই যে বললে,
হিতেন ধরা পড়ে গেছে!"
"হ্যাঁ, সে
তো পড়েইছে। তবে সেটা চুরি করে নয়। চিরকুট ছুঁড়তে গিয়ে। রোরো ধরেছে।"
বুম্বার
কাকা মানে রোরোর বাবা বলল, "চিরকুট! রোরো ধরেছে? বুঝলাম
না ব্যাপারটা।"
"হ্যাঁ
গো কাকাই। রোরো ধরেছে। ইন ফ্যাক্ট আমরা চার জনেই ধরেছি। সেদিন রোরো খেতে খেতে
টয়লেটের বাহানা করে উঠে গেল। কারণ ছিল। ও বাথরুমে গিয়ে ছোটো জানলাটা দিয়ে স্পষ্ট
দেখেছে জানলার শিকের ওপরে পা রেখে হিতেন কাকু তরতরিয়ে ওপরে উঠে গেল। তাই বলে হিতেন
কাকু কিন্তু চোর নয়।"
"একবার
বলছিস ধরা পড়েছে। এদিকে চোর নয়। হেঁয়ালি ছেড়ে ঠিক করে বলবি?" বুম্বার
বাবা বিরক্তি প্রকাশ করে।
"হ্যাঁ
বাবা, বলছি।
...শোনো পদ্মপিসি, তুমি গয়নাগুলো এনে ঠাম্মিকে দাও।"
এবারে যেন
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ঠাম্মির, "ও মা গো! এ আমি কী শুনছি গো চূড়ামণি!
শেষে পদ্ম! তা হ্যাঁ রে পদ্ম, তোকে মানুষ করে বিয়ে দিলুম। ছেলেপুলে
হল না বলে ওরা তাড়িয়ে দিলে ফের নিয়ে এসে মেয়ে জ্ঞানে রেখে দিলুম কাছে, তা
কি আজকের দিন দেখব বলে রে? এই ছিল তোর মনে!” প্রায়
কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠল ঠাম্মি।
পদ্মপিসির
ঠোঁট দুটো কাঁপছে তিরতির করে। সকলের অবিশ্বাসের চোখ তার দিকে। বুম্বার বাবা বলল, “কোথায়
লুকিয়ে রেখেছ গয়নাগুলো পদ্মদি?”
পদ্মপিসির
জবাবের অপেক্ষা না করে বুম্বা বলল, “আমি বলছি। গোয়ালঘরে রাখা ঘুঁটের
বস্তায়। তাই না পদ্মপিসি?”
দাদুন বলল, “কী
করে সেটা তুমি জানলে দাদুভাই?”
“চোর
যে কবিতায় লিখে লিখে আমায় ক্লু দিয়েছে দাদুন।”
কুঁড়ির বাবা
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কবিতা! তাও আবার চোরের লেখা? পদ্মদি
কবিতা লিখতে পারে! তা কীরকম কবিতা শুনি!”
“বলছি
ছোটোকাকাই। প্রথমটা ছিল, লোহিততনু কুসুম পাশে তন্ডুলছায় বাস/
জলের ধারে মিলবে প্রভাতকিরণ বারোমাস। …দেখো, এখানে
লোহিততনু কুসুম মানে জবাফুল। আমাদের বাড়ির জবাগাছের গায়েই তন্ডুল মানে ধানের খড়ের
ছাওয়া গোয়ালঘর। আর ওদিকটা ইস্ট মানে পূর্ব। বারোমাস প্রভাতকিরণ, মানে
ঠিক সকালের রোদ পড়ে সারা বছর। আর জলের ধারেটা আরেকটা ক্লু। ও পাশেই আমাদের
কুসুমগোড়ে পুকুর।”
সকলে তাজ্জব
বনে গেল। বুম্বার বাবা কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল। রোরো বলে উঠল, “এর
পরেরটা খুব টাফ ছিল। আমার মাথায় একটুও ঢোকেনি।”
মিঠি এতক্ষণ
চুপ ছিল। কিন্তু রোরোর পা টানার এতটুকুও সুযোগ সে ছাড়ে না। বলল, “মাথায়
ঘিলুর জায়গায় পচা গোবর থাকলে আর কী ঢুকবে সেখানে? ...হি
হি।”
মিঠির মা
চোখ পাকিয়ে মিঠিকে হি হি থামাতে ইশারা করল।
বুম্বা পরের
কবিতাটা শোনাল,
জলের নিচে মরণ আবার জলেই পচে সভ্য/ আঁশের সুতোয় মোড়ক জেনো অতি সহজলভ্য। …এটায়
তোমরা লক্ষ কর,
জলের নিচে মরণ আবার জলেতেই সভ্য। এটা পাটের কথা বলছে। জলের নিচে পচানো হয় আর
তারপরেই পরিষ্কার আঁশ পাই আমরা। আর সেই আঁশের সুতো মানে সুতলি দিয়ে বস্তা তৈরি হয়।
তার মানে চটের বস্তার দিকে ইঙ্গিত করছে।”
“ওয়ান্ডারফুল!
কী বুদ্ধি রে তোর বুম্বা! দারুণ দারুণ,” মেজকাকাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল
ভাইপোর।
“থার্ডটা
বলি?”
“হ্যাঁ
হ্যাঁ, বল
বল। খুব ইন্টারেস্টিং রে!” ছোটোকাকাই উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইছে।
“মাতৃজ্ঞানে
পূজ্য প্রাণী। বাহ্য হতে পাই/ চাইতে গেলে গয়নাগাটি যাও সে ঠিকানায়। …স্পষ্ট
গরুর কথা বলেছে। গরুর বাহ্য মানে গোবর থেকে ঘুঁটে পাই। তার মানে গয়না পেতে গেলে
ঘুঁটের বস্তার মধ্যেই খুঁজতে হবে। পরপর মিলিয়ে নাও। জবাগাছ, গোয়ালঘর, ঘুঁটে
রাখার বস্তা। আর এইসব কিছুর দেখভাল কে করে? পদ্মপিসি।
তাই পদ্মপিসি জানে গয়নাগুলো ঘুঁটের বস্তায় রয়েছে।”
দাদুন এবারে
মুখ খুললেন,
“ঘুঁটের বস্তায় থাকলেই কি পদ্ম চোর? এটা কীভাবে প্রমাণ করবে?”
“প্রমাণ
করব না তো দাদুন। পদ্মপিসি যে চোরই নয়। আসলে, গয়নাগুলো
চুরিই হয়নি গো ঠাম্মি।”
“অ্যাঁ!
সে কী রে?
গয়না চুরি হয়নি! তবে কি আলমারি থেকে পাখনা মেলে গোয়ালঘরের হাওয়া খেতে গেছিল?”
“না
ঠাম্মি, ওরা
আলমারি থেকে নিজে নিজে উড়ে সেখানে যায়নি। তুমি নিজেই মনের ভুলে দশমীর সকালে
ঠাকুরদালান থেকে ফিরে আর ওগুলো খুলে আলমারিতে ভরনি। বিছানায় ফেলে রেখেছিলে। আর
সেই সুযোগই কেউ গ্রহণ করেছে।”
বুম্বার কথা
শেষ না হতেই রোরো সরব হল, “ওয়েট ওয়েট। বুমদাদা, তার
মানে পদ্মপিসিও কালপ্রিট নয় বলছ! তবে কে? তুমি জানো? আমাদের বলনি
তো!"
বুম্বা
রোরোর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দাদুনের
হুইলচেয়ারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “দাদুন, আমি তোমার
পরীক্ষায় পাশ করেছি তো? এবারে পদ্মপিসিকে বলে ঠাম্মির
গয়নাগুলো আনিয়ে দাও। আমি জানি ওগুলো তুমিই সরিয়ে রেখেছ। হিতেনকাকু আর পদ্মপিসিকে
তোমার এই কাজে সঙ্গী করে। ওরা তোমার ডাইরেকশন নিখুঁত ফলো করে গেছে। হিতেনকাকু রোজ
দুপুরে আমরা খেতে বসলেই বাথরুমের জানলার কার্নিশ বেয়ে উঠে চিলেকোঠার জানলা দিয়ে
চিরকুট ফেলত। এটা করার জন্য লাঞ্চের টাইমটাই বেস্ট ছিল। কারণ সবাই তখন নিচে থাকে।
তুমিই যে চিরকুটে কবিতা লিখতে তার প্রমাণ হল তোমার সেদিনের চিঠির কাগজে সিগনেচার।
তুমি তোমার নামের প্রথম অক্ষর লিখতে গিয়ে “অ” এর
শুঁড়টা টেনে বাকি সব অক্ষরের মাথায় ঘোমটা টেনেছিলে। কবিতাগুলোয় যতবার অ কিংবা আ
এসেছে ততবারই তুমি ওরকম ঘোমটা টেনেছ। আমি চিরকুটে খুব ভালো করে খেয়াল করেছি। আমি
সেদিনই শিওর হয়ে গেছিলাম দাদুন। একাজ তোমার ছাড়া আর কারও নয়।”
দাদুনের দু'চোখ
ছলছল করে উঠল। কোনোরকমে সামলে বুম্বার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “আমার
নতুন ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন বুম্বা। তাকে খুঁজতেই তো আমার এই এত কার্যকলাপ। বড়োখোকা, তোমার
পুত্রটি কিন্তু তুখোড় হবে। ...আমার নামটুকু রেখো তুমি বড়োদাদুভাই।”
হিতেন আর
পদ্মপিসির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। পদ্মপিসি গয়না আনতে ছুটে গেল গোয়ালবাড়ির দিকে।
ঠাম্মি হই হই করে বলে উঠলেন, “আজ সন্ধেয় মোড়ের দোকান থেকে
নাতিপুতিগুলোর জন্যে একটু গজমোতির লাড্ডু আনিস তো রে হিতেন। আমি পয়সা দেব। আর
তোমার তো ভালোই হল গো! নতুন কাপ্তেন পেয়ে গেলে। তবে আর দেরি কীসের? আরেকখানা
ডিফেক্টিভ গপ্পো লিখতে বসে যাও এই বেলা। হে চূড়ামণি!”
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
বুম্বা , রোরো , মিঠি আর কুঁড়ির ঠাম্মি , পদ্মপিসি আর বিশেষতঃ দাদুন এবং চাকর হিতেন , সবকটি চরিত্র নিজ নিজ দায়ভার লেখিকার কলমে যথোপযুক্ত বহন করে গেছে আপাময় । প্রকৃতি বর্ণনা , মনুষ্য আবেগ অনুভূতির টানাপোড়েন আর অস্ফুট, অব্যক্ত ট্র্যাজেডিক প্রেমের আখ্যান যে কলম থেকে সাবলীলভাবে বেরিয়ে আসে , সেই আঙুলেই এমন রহস্য উদ্ঘাটনের প্লট আর তার নিখুঁত সজ্জাবিন্যাসও সম্ভব !! বোধহয় প্রকৃত সাহিত্য অনুরাগ আর সৃষ্টি প্রতিভা এমনই ব্যপ্ত হয় !
ReplyDeleteধন্য লেখনী , ধন্য প্রতিভা , ধন্য সৃষ্টি ।
অকুন্ঠ আকাঙ্খ্যা আর শুভেচ্ছা রইল ।।
ধন্যবাদ
Delete