বাদশাহী মর্জি
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
বাবার হইল আবার জ্বর, সারিল ঔষধে - কথাটা আমরা সবাই জানি। মাত্র ছয় শব্দের
এই লাইনটার মধ্যে লুকিয়ে আছে আস্ত একটা মোগল সাম্রাজ্য! জিনিসটা জানতে পেরে
কিডোদের চক্ষু চড়কগাছ! এটা কী করে হল?
খুব সহজ। বললেন লোকনাথ দাদু। এবার যখন আসল ব্যাপারটা খোলসা করলেন যে বাবার
থেকে বা নিয়ে হল বাবর, হল থেকে হ নিয়ে হুমায়ুন, তখন কিডোরা অঙ্কের আসল প্যাঁচটা
বুঝতে পারল। এভাবেই বাকি শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর ব্যবহার করে কিডো, দ্যুতি, রায়ান
আর রিবাই বলে উঠল - আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং
ঔরঙ্গজেব।
“একদম ঠিক,” বলে ছোটোদের মতো হাততালি দিয়ে উঠলেন লোকনাথ দাদু।
আসলে আজ সকালেই কিডোর বাবা ওর জন্য একটা ইতিহাস বই কিনে এনেছেন। হাজার বছর
পুরোনো ঘটনাগুলো পড়তে কিডোর ভারি ভালো লাগে।
আরো ভালো লাগে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর স্কেচ
দেখতে। ওগুলোর ওপর হাত বোলাতে বোলাতে কিডো ভাবে, সত্যি, কেমন ছিল এই লোকগুলো!
ইতিহাস বিষয়টা লোকনাথ দাদুরও সাংঘাতিক প্রিয়। তাই একদিনও অপেক্ষা না করে
কিডো ওর ইতিহাস বইটা নিয়ে চলে এসেছে লোকনাথ দাদুর বাড়ি। ওদের বিকেলের আড্ডায়। এই
বিকেলের আড্ডাটা ওদের মাঝেমধ্যেই বসে। প্রায় পঁয়ষট্টি পেরোনো মানুষটার তিনকুলে কেউ নেই। আত্মীয় বা বন্ধু বলতে এই চারটে খুদে বাচ্চা
আর একমাত্র কাজের লোক। সারা জীবন ধরে চাকরি হোক বা ভ্রমণ সূত্রে, ভারতের নানান
জায়গা ঘুরেছেন ভদ্রলোক। আর তার সঙ্গে সঞ্চয়
করেছেন অজস্র অভিজ্ঞতা। সেগুলোকেই
গল্পের আকারে কিডোদের সামনে তুলে ধরেন উনি। আর এই গল্প শোনার লোভেই কিডোরা থেকে
থেকে ছুটে আসে ওনার কাছে। কিডোর বাবা তো ওনাকে ওনার বহুমুখী জ্ঞানের জন্য চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া বলেন। দ্যুতির কাকা ওনাকে একালের তারিণী
খুড়ো বলে ঘোষণা করেছেন। আবার কারও কারও কাছে উনি একালের সিধুজ্যাঠা!
বইটা হাতে নিয়ে প্রথমেই বেশ কিছুক্ষণ উলটে-পালটে দেখলেন লোকনাথদাদু। তারপর কী যেন চিন্তা করে হো হো করে হেসে উঠলেন।
তা দেখে কিডোরা চারজনই ভুরু কুঁচকে একে অপরের দিকে তাকাল। চারজনেরই মনে একই প্রশ্ন, এভাবে কেন হাসছে দাদুভাই? এবার আমতা আমতা করে
দ্যুতিই প্রশ্নটা করল, “কী হয়েছে দাদুভাই?”
ওর প্রশ্ন শুনে হাসি থামিয়ে লোকনাথদাদু বললেন, “আসলে বহু বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল দিদিভাই।”
“কী ঘটনা?” চারজনেই নড়েচড়ে বসল। কারণ,
লোকনাথদাদুর এই কথাটার মানে ওরা জানে। এই ফাঁকে আরও একটা নতুন গল্প যে শুনে নেওয়া যাবে, তা বেশ বুঝতে পারছিল ওরা।
“কী ঘটনা?” নীচের ঠোঁটটা উলটে মাথাটা বার দুয়েক
ওপর-নিচ করে লোকনাথদাদু বললেন, “তাহলে চল
দাদুভাইরা, সেই ঘটনা দিয়েই আজকের বিকেলের ঘণ্টটা রাঁধা যাক।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ...” প্রায় চারজনই একসঙ্গে হামলে পড়ল লোকনাথ দাদুর ওপর। মেঝেতে পাতা শতরঞ্চির ওপর লোকনাথদাদুকে ঘিরে বসে জুল
জুল চোখে ওরা চেয়ে রইল দাদুভাইয়ের দিকে। উনি তখন ওনার ইজি চেয়ারে। এবার তাতে শরীরটাকে আরেকটু গুঁজে দিয়ে শুরু করলেন তাঁর নতুন গল্প...
আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। আমি তখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র। কলেজ ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লেখার জন্য আমার বন্ধু চিন্ময় আমার
নাম দিয়ে দিল। বিষয়, মোগল সাম্রাজ্য। তো স্বাভাবিক ভাবেই একটু পড়াশুনার দরকার হয়ে
পড়ল। আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা বাড়িতে তখন টিউশন পড়াতাম। সেদিন পড়ানো সেরে কলেজ স্ট্রিটে এসে বই কিনতে কিনতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সারাদিনের পরিশ্রমে বেশ
ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। চায়ের তেষ্টাও পেয়েছিল জমিয়ে। তাই এবার ঢুকে পড়লাম কলেজ স্কোয়ারে। একটা খালি সিট দেখে তাতে বসে চা ওয়ালার থেকে একটা বড়ো ভাঁড়ে এক ভাঁড় লাল চা নিয়ে প্রথম সুখের চুমুকটা মেরেছি, ঠিক তখন আমার পাশে
এসে বসল ইয়া লম্বা একটা লোক। পড়নে পাঠান স্যুট। মাথার কোনাওয়ালা টুপিটা দেখে বুঝলাম লোকটা মুসলমান। ওর গা থেকে ভুরভুর করে দামি আতরের
গন্ধ বেরোচ্ছিল। ভীষণ হাঁপাচ্ছিল লোকটা। এবার মাথার টুপিটা খুলে
নিজেই নিজেকে হাওয়া করতে করতে বলল, ‘অসহ্য। পারা যাচ্ছে না। নির্বোধ! বেহিসাবি! বেওকুফ!’
বুঝলাম কারও ওপর বেজায় চটে রয়েছে সে। যে জায়গাটায় বসে ছিলাম সেটা ছিল
অন্ধকার আর নির্জন। তাই লোকটার মুখটা ভালো করে
দেখতে পাচ্ছিলাম না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের দিকে এগিয়ে চলেছিল ঘড়ির কাঁটা। এর মধ্যে
লোকজনের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। প্রথমটায় বেশ ভয় ভয় করছিল। কলকাতার এখন যা অবস্থা,
খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু
পরক্ষণেই ভাবলাম, লোকটা তো তেমন কিছু করছে না, তাহলে ভয়ের কী আছে? তাছাড়া পাশেই
আমার মেস। তেমন কিছু হলে বন্ধুদের ডাকব। তখন বাছাধন চোখে সরষে
ফুল দেখবে। তাই আমার আবার ভয় কী? কথাটা ভেবে স্বাভাবিক
হবার চেষ্টা করলাম।
বিড়বিড় করতে করতে এবার আমার দিকে একবার তাকাল লোকটা। মুখ দেখতে না পেলেও
এবার একটা কেঠো হাসি হেসে সহজ হবার চেষ্টা করলাম। তাতে যেন আরও বিরক্ত হল সে। হুঁ, করে একটা শব্দ করে আরও জোরে টুপি দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করল নিজেকে। তারপর হঠাৎ আকাশের দিকে চেয়ে দু’হাত তুলে
বলল, ‘ইয়া খুদা, কার পাল্লায় ফেললে
আমাকে!’
বুঝতে পারলাম বেজায় সমস্যায় পড়েছে সে। তাই
এবার আর আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ‘আপনি কি কোনও সমস্যায় পড়েছেন?’
‘সমস্যা?’ একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল
লোকটা। তারপর বলল, ‘এমন বাবার পাল্লায় পড়েছি মশায় যে
কী বলব? আমার জিনা একেবারে হারাম করে দিল মাইরি!’
এতক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম, সমস্যার গোড়া হল বাপ ছেলের বনিবনা না হওয়া, যা কিনা চিরন্তন। কাল ছিল। আজ আছে। কালও থাকবে। কোথাও মতামতের দ্বন্দ্ব তো
কোথাও আদর্শের।
‘কী হয়েছে আপনার? আপনি একটু শান্ত হোন। চা খাবেন?’ যতটা সম্ভব মোলায়েম হবার চেষ্টা করলাম। তাতে উনি বিস্ময়ের স্বরে বললেন, ‘চা! এই
সময়ে আমি মদিরা পান করি!’
বাবা! জাতে মাতাল, তালে ঠিক! হাসিটা কোনোরকমে ভেতরেই চেপে বললাম, ‘সে
ব্যবস্থা তো এখন করা সম্ভব নয়। কিন্তু মনের কথা বলে যদি কিছুটা হালকা হতে চান তো
হতে পারেন।’
‘আর হালকা!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটা বলল,
‘বাবা আমাকে যা হালকা করার করে দিয়ে গেছে মশাই। মায়ের
স্মৃতি জীবন্ত করে রাখবে বলে কত দামি একটা বাড়ি বানিয়ে গেছে জানেন? বিদেশ থেকে
শ্বেত পাথর এনেছে কত টাকা খরচা করে। লোকজনকে তাক লাগাতে গিয়ে পকেটই একেবারে ফাঁকা
করে দিয়ে গেছে। অন্ন বস্ত্র জোগাড় করতে প্রাণ
একেবারে ওষ্ঠাগত। নিজের টুপিটাও নিজেকে সেলাই করে নিতে হচ্ছে। জমানো অর্থও শেষ। অত
বড়ো বাড়ি ভাড়া নেবার লোকও পাচ্ছি না।’
‘হুম। এ তো ভারি সমস্যা। আগে আপনাদের অনেক
টাকা ছিল বুঝি?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘ছিলই তো। ঠাকুরদা থেকে শুরু করে তাঁর পূর্বপুরুষরা অনেক মেহনত করে দৌলত কামিয়েছিলেন। আর বাবা সেগুলো দু'হাতে
উড়িয়েছেন!’ লোকটার চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে
বেরোচ্ছিল।
‘দেখুন, উনি আপনার বাবা। বাবা মা তো ওপরওয়ালারই রূপ। তাঁদের ওপর রেগে থাকাটা
ঠিক না। হয়তো উনি আপনার ভবিষ্যতের কথা মাথায়
রেখেই...’
আমার কথা শেষ না করতে দিয়ে উনি এবার তিরিক্ষি মেজাজে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। কী দুর্দান্ত মৃত্যু ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন তা যদি
জানতেন! কোথায় যাব, কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না। খালি মশাই পালিয়ে বেড়াচ্ছি!’
থাকার কথা শুনে মনে হল, লোকটা থাকে কোথায়? কথাটা তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে
বলল, ‘আর থাকা! এমন সব কাণ্ড করে রেখেছে মানুষটা যে লোকজন আমাকে দেশ ছাড়া করতে চায় মশাই!’
‘সেটা কেমন?’
‘সে কথা শুনলে আপনি পর্যন্ত আমাকে পেটাতে আসবেন।’
‘আহা, অমন ভাবছেন কেন? বলুন না,’ আমি
আবদার করে বললাম। কিন্তু লোকটার বাবার কাজকম্মের সঙ্গে আমার রেগে যাবার সম্পর্কটা যে কী, তা বুঝতে পারলাম না।
লোকটা তখন বলল, ‘কিছুদিন পশ্চিম ভারতে গিয়ে থাকতে
শুরু করেছিলাম। দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু বাদ সাধল বাবার ভীষণ মাত্রায় ধর্মপ্রেম। কেন জানি না বাবা হঠাৎ করে সবাইকে ধরে ধরে মুসলমান
হবার উপদেশ দিতে শুরু করল। প্রথম প্রথম জিনিসটা সবাই হেসে উড়িয়ে দিলেও পরে সেটা
সবার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। বন্ধুত্ব অবধি তো ঠিক আছে। কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেরা
এটা ভালোভাবে নেবে কেন বলুন তো? এ তো অন্যায় আবদার, তাই না? কিন্তু বাবা এই সহজ সত্যিটাই
বুঝতে চাইছিল না। নিজেকে হঠাৎ করে যেন হজরত মহম্মদ মনে করতে শুরু করেছিল! তাও
এভাবেই চলছিল কোনও রকমে। কিন্তু শেষে কী যেন একটা করল, তাতে পুরো হিন্দু লোকজন
ক্ষেপে উঠল আমাদের ওপর। একেবারে পাগল কুকুরের মতো তাড়া করতে শুরু করল আমাদের। পশ্চিমে আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হল না। তাই
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সেখান থেকে পাততাড়ি গোটালাম আমরা।’
এতটা বলে থামল লোকটা। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী করেছিলেন আপনার বাবা?’
তা শুনে আমতা আমতা করতে করতে লোকটা বলল, ‘ঘটনাটা সত্যি কিনা জানি না। তবে লোকমুখে
শুনেছিলাম বাবার সেই কীর্তির কথা।’
‘কোন কীর্তি?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘আসলে হয়েছিল কী,’ লোকটা বলতে শুরু করল,
‘বাবার সঙ্গে বেশ কিছু হিন্দু পণ্ডিতের পরিচয় ছিল। তাঁরা
বাবাকে শিখিয়েছিলেন যে হিন্দুরা নাকি বিশ্বাস করে, ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং! মানে খাবারের গন্ধ নাকে গেলেই নাকি অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। তো
সেটা শুনে বাবা একটা ফন্দি আঁটল। গোটা দুই গোঁড়া ব্রাহ্মণকে গল্প করবে বলে বাড়িতে ডাকল। বসার ঘরের পাশেই ছিল আমাদের রান্নাঘর।
সেখানে বাবার নির্দেশ মতো পাচকরা রান্না করছিল গরুর
মাংস। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মাংসের গন্ধ
হাওয়ায় ভেসে এসে ঢুকল ব্রাহ্মণদের নাকে। প্রথমে বেচারারা বুঝতে পারেননি গন্ধটা কীসের।
তাই তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, কী মিয়াঁ, বাড়িতে নিশ্চয়ই দারুণ কিছু রান্না হচ্ছে?
‘প্রশ্নটা সবেমাত্র ওদের মুখ থেকে বেরিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে হাততালি
দিয়ে লাফিয়ে উঠল বাবা। তা দেখে ব্রাহ্মণরা তো অবাক। ভাবলেন, বাবার হলটা কী? জিজ্ঞাসা
করতে বাবা বলল, আপনারাই বলেন যে গন্ধ শুঁকলেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়?
‘হ্যাঁ, তাতে কী? বাবার কথা শুনে অবাক হলেন ওনারা।
‘বাবা তখন বলল, আমার বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হচ্ছে বন্ধুরা! তার গন্ধই
ঢুকেছে আপনাদের নাকে। আর আপনাদের কথা মেনে নিলে বলতে হয় যে, আপনারা আজ গরুর মাংস
খেয়ে ফেলেছেন। ঘ্রাণেন
অর্ধভোজনং! তাই আপনাদের জাত গেল আজ। এখন থেকে আপনারা সবাই
মোসলমান!
‘বাবার কথা শুনে ব্রাহ্মণদের চোখে তখন আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। ভীষণভাবে
অভিশাপ দিতে দিতে সেদিন ঘর ছেড়েছিলেন ব্রাহ্মণরা। শুনেছি তারপর
থেকেই ওই অঞ্চলের লোকেরা, বিশেষ করে হিন্দুরা, বাবার চরম শত্রু হয়ে উঠেছিল।’
‘এবার
বলুন,’ ফোঁস ফোঁস করতে করতে লোকটা এবার
বলল, ‘দেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়াচ্ছ,
ভালো কথা, কিন্তু তা বলে এইভাবে? নিজের
পায়ে নিজেই কুড়োল মেরে?’
এতটা বলে থামল লোকটা। তারপর বলল, ‘এমন
বোকামো কেউ করে?’
লোকটার কথার প্রতিবাদ করলাম না বটে,
তবে এও বুঝতে পারলাম না যে সে তার বাবার এই কীর্তিটাকে সমর্থন করছে নাকি প্রতিবাদ
করছে। এদিকে বেশ
গরম লাগছিল। মাঝে হালকা হাওয়া বইছিল বটে। কিন্তু তা এখন বন্ধ। অগত্যা হাতে ধরা
ইতিহাস বইটা দিয়েই হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। লোকটার নজর এবার হঠাৎ বইটার ওপর পড়ল।
‘এটা কী বই?’ জিজ্ঞাসা করল লোকটা।
‘ইতিহাস বই,’ বললাম আমি।
‘কীসের ইতিহাস? কার ইতিহাস?’
‘মোগলদের,’ বলে বইটা এগিয়ে দিলাম লোকটার
দিকে।
‘মোগলদের!’ জানি না কেন, মোগলদের ইতিহাস
পড়ছি শুনে অবাক হয়ে লোকটা আমার হাত থেকে বইটা নিল। তারপর সেটা খুলে তার দু-চারটে পাতা উলটেপালটে দেখতে থাকল। অন্ধকারের মধ্যেও লোকটার মুখে কেমন একটা
তাচ্ছিল্যের হাসি লক্ষ্য করলাম।
‘মোগল ইতিহাস পড়ে কী লাভ?’ লোকটা
জিজ্ঞাসা করল আমায়।
‘ওদের নিয়ে একটা কাজ করছি। তাই একটু পড়তে হবে।’
‘কাজ? মোগলদের নিয়ে?’
আমার উত্তর শুনে কেন জানি না আবার অবাক হল লোকটা।
আমি তখন বললাম, ‘দেখুন, আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি। মোগলদের নিয়ে আর্টিকেল
লিখতে হবে আমাদের কলেজ ম্যাগাজিনে।’
‘ও,’ আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত কী
যেন ভাবল লোকটা। তারপর বইটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘আমি বাংলা পড়তে জানি না।’
তাই বলুন। পড়তে পারেন না বলেই অবাক হবার ভান করে মেক আপ দেবার চেষ্টা করছেন!
কথাগুলো বলতে গিয়েও ব্রেক কষলাম। লোকটা তখনও গজরে চলেছে।
‘তো আপনি কি আপনার বাবা-মায়ের
একমাত্র সন্তান?’ এবার লোকটাকে জিজ্ঞাসা
করলাম আমি।
‘না মশাই,’ মাথা নেড়ে লোকটা বলল, ‘আমরা ছিলাম চার ভাই ও এক বোন।’
‘তারা কী করেন? চাকরি বাকরি না অন্য কিছু?’
চাকরির কথা শুনেই লোকটা কেমন যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘আমরা কারও গুলামি করি না!’
‘ও আচ্ছা! তাহলে বুঝি ব্যাবসা,’ নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম আমি।
এই কথাটার কোনও উত্তর না করলেও তেমন ভাবে এবার আর চটল না লোকটা। আমি বললাম,
‘আপনার ভাইরা?’
‘বেওকুফ আছে সব।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে বললাম আমি।
তাতে সে বলল, ‘আরে মশাই, আপনাদের এইখানে আমাদের
একটা বিশাল জায়গা ছিল। এখানকার সব মালিকানা আমাদেরই ছিল। ব্যাবসার বাজারও ভালো ছিল
আমাদের। কিন্তু একবার হঠাৎ কোথা
থেকে কতগুলো লোক এল। তাদেরকে আমার মেজদাদা মাত্র অল্প ক’টা টাকার বিনিময়ে আমাদের জায়গায় ব্যাবসা করার
অনুমতি দিয়ে দিল! এবার আমাদের নিজেদের বাজারের কথা ভাবুন! একেবারে লবডঙ্কা!
নিজেদের জায়গাতেই নিজেদের বাজার চলে গেল!’
‘সেকি! কত টাকার জন্য?’
‘সামান্য কয়েক হাজার টাকা মশাই!’
‘কিন্তু কেন?’
‘কে জানে? আনন্দ ফুর্তি করার জন্যই হবে। কোনও ভালো কাজ তো করল না ওরা,’ আপশোশ করতে করতে লোকটা বলল, ‘সারা জীবন হয় শুধুমাত্র সুরা পান করল না হয় ঘুমিয়ে কাটাল। বাকি সময়টা
বত্তমিজগুলো...’
কী যেন একটা খারাপ কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল লোকটা। আমি তখন বললাম, ‘তো আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না আপনার বাবা এই রকম! উনি কি ছোটোবেলা থেকেই এমন নাকি বড়ো হয়ে...’
‘আরে ধুর!’ আমার কথা শুনে এবার প্রায় তেড়ে উঠল
লোকটা। বলল, ‘ও মানুষটা ছোটো থেকেই এই রকম। নিজের ভাইকে পগার পার করেছে স্বার্থের জন্য।’
‘পগার পার! মানে খুন!’ আমি
চমকে উঠলাম। বলে কী লোকটা? এ তো পুলিশ
কেস!
‘তাহলে আর বলছি কী?’ বলল সে।
‘আরে আস্তে বলুন!’ খুনের কথা শুনে আমি গলা নামিয়ে
বললাম, ‘শুনতে পেলে পুলিশে ধরবে যে!’
আমার কথা শুনে লোকটা এবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘কাকে ধরবে? কোথা থেকে ধরবে?’
তাতে আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন? গা
ঢাকা দিয়ে আছেন বুঝি?’
লোকটা তখন চোখ আর ভুরু একসঙ্গে নাচিয়ে
বলল, ‘শুধু গা ঢাকা নয়, পুরোটাই ঢেকে
কবরস্থানে...’
‘ওহো!’ বুঝলাম ভুল কথা বলে ফেলেছি। তাই
বললাম, ‘স্বর্গে গেছেন!’ বলে ডানহাতের তর্জনী দুবার কপালে ঠেকালাম।
আমার কথা শুনে আবার তেতে উঠল লোকটা। বলল, ‘জন্নত! না না, জাহান্নম বলুন!’
‘আহা, এমন বলেন কেন? শত হোক আপনার বাবা তো!’ আবহাওয়া ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম আমি।
তাতে মনে হয় একটু হলেও নরম হল লোকটা। বলল, ‘জানি মশাই। কিন্তু কী করব বলুন তো? এমন এমন সব কাজ করে গেছে যে বলার না।
মানছি সারা জীবন অনেক ভালো কাজও করেছে। কিন্তু সেগুলো করে নিজের বড়াই করতে ছাড়েনি কখনও। আর তাতে নজরও
লেগেছে কত লোকের।’
‘সেটা কেমন?’
‘আগেই বলেছি আমার বাবা ভীষণ মাত্রায় বেহিসেবি ছিল। দরকারে অদরকারে যেখানে
সেখানে টাকা খরচ করত। পারলে তো সে নিজের জুতো জোড়াতেও হীরে বসিয়ে রাখত! ঘর মোছার ন্যাকড়াও রুপোর জলে চুবিয়ে ঘর মুছত! তো এই খামখেয়ালিপনা থেকেই বাবা একবার একটা
চেয়ার বানিয়েছিল।’
‘চেয়ার!’ আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘সেটা কেমন?’
‘আরে বসার চেয়ার। তাতে কত রকম কারুকার্য! দেদার খরচ করল সেটার পেছনে! কারণ
জিজ্ঞাসা করতে বলল, এতে বসলে যাতে মনে হয় জন্নতে বসে আছি। আর তারপর চেয়ারটা দেখিয়ে
বলল, এটা দেখে যখন সবাই মনে মনে জ্বলবে, তখনই আমার প্রাণ জুড়োবে। কিন্তু আল্লার কী খেলা দেখুন। ঠিক তার কিছু দিনের মধ্যেই অঘটনটা ঘটল।’
‘কীসের অঘটন?’
‘আরে লোকের নজর লাগা বলে তো একটা কথা আছে নাকি? চোরদের কানে এই খবর পৌঁছতে
কতক্ষণ? সুবিধে বুঝে তারা চেয়ারটা ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে গেল। বাবা অবশ্য তখন আর
এই দুনিয়াতে নেই।’
‘খুব দুঃখজনক!’ বললাম আমি।
আমার কথা শুনে লোকটা মনে হয় দুঃখ পেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘এবার ভাবুন, ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব যখন নিয়েছি, তখন সব হ্যাপা তো
আমাকেই সইতে হবে, তাই না? যেখানে অন্য ভাইগুলো অকর্মার ঢেঁকি!’
কথা বলতে বলতে কখন যে দু’ঘণ্টা
কেটে গেছে বুঝতে পারিনি। এবার ঘড়ির দিকে চোখ যেতে চমকে উঠলাম।
সর্বনাশ! আর দেরি হলে তো মেসে
খাবার পাব না! তাই এবার ওঠার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম।
আমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। নিজেই এবার উঠে দাঁড়াল লোকটা। বলল, ‘অনেক দেরি হয়ে গেল জনাব। আজ যে
উঠতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ পেয়ে আমি বললাম, ‘আমাকেও।’
লোকটা এবার বলল, ‘আজ তাহলে আসি? নসিবে থাকলে আবার
দেখা হবে। খুদা হাফিজ।’ বলে সেলাম ঠুকল লোকটা।
উত্তরে আমি দু’হাত বুকের কাছে জোড় করলাম।
মজার ব্যাপার, আমি তখনও পর্যন্ত ভালো করে
আমার আগন্তুক বন্ধুর মুখই দেখে উঠতে পারিনি। আর কোনওদিন দেখা হবে কিনা কে জানে? না
হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তাই লোকটার মুখটা দেখার জন্য ছটফট করছিলাম। কিন্তু ওই অন্ধকারে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক
এই সময় দূর থেকে একটা লোক আমাদের দিকে হেঁটে আসছিল। হাতে
তার টর্চ। লোকটা এবার আরও কাছে আসতে তার হাতের টর্চের আলোয়
জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠল। আর তাতেই এই প্রথমবার আমার আগন্তুক বন্ধুর মুখ আমি দেখতে
পেলাম। গালে এক বিঘত লম্বা দাড়ি। টকটকে লাল গায়ের রং। যেন জেল্লা মারছে। মুখে একটা
তেজস্বী ভাব রয়েছে। শেষ পর্যন্ত টর্চের আলো আমাদের পেরিয়ে চলে যেতে এই লোকটার
মুখটাও আবার অন্ধকারের আড়ালে চলে গেল।
ওর চলে যাবার পথে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। রাত এখন প্রায় দশটা। কলেজ
স্কোয়ারে লোকজন এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে খিদেও পেয়ে গেছে বেশ। আমাকে
এবার মেসে ফিরতে হবে। মেসে ফিরে জলদি রাতের খাবার সারলাম। মাথায় ঘুরছিল আর্টিকেল
লেখার কথা। তাই বিছানায় গিয়েই সদ্য কিনে আনা ইতিহাস বইটার পাতা ওলটাতে শুরু করলাম।
একে একে বাবর থেকে শুরু করে হুমায়ুন হয়ে যখন ঔরঙ্গজেবে পৌঁছলাম, তখন বইয়ের পাতায়
ঔরঙ্গজেবের একটা স্কেচ দেখে চমকে উঠলাম। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে! কী আশ্চর্য!
শেষ পরাক্রমশালী মোগল বাদশাকে আমি যেন
কোথায় দেখেছি! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে মাথার জটটা খুলে গেল।
সর্বনাশ! সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহানের জীবনী ভালো করে পড়তে শুরু করলাম। পড়া শেষ করে যতক্ষণে ঔরঙ্গজেবে পৌঁছেছি, ততক্ষণে
মিলিয়ে নিতে পেরেছি আজকে সন্ধেবেলা সেই লোকটার বলা ঘটনাগুলোর সঙ্গে শাহজাহানের
জীবনের বেশ কয়েকটা ঘটনা।
তাজমহল তৈরি করে রাজকোষ শূন্য হয়ে যাওয়া, পশ্চিম ভারতে বিজাপুর আর
গোলকুণ্ডাতে হিন্দুদের ছল করে মুসলমান করে দেবার দরুণ ওই অঞ্চলের লোকেদের মোগল
বিদ্বেষ তৈরি হওয়া, শাহজাহানের ছোটো ছেলে
সুজার মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাতে ব্যাবসার স্বত্ব ইংরেজদের বেচে দেওয়া, নিজের ভাই খসরুকে হত্যা করা এবং তখনকার
দিনে প্রায় আট কোটি টাকা খরচ করে ময়ূর সিংহাসন তৈরি করার পর ১৭৩৯ সালে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ্-র ভারত আক্রমণ করে তা লুঠ করে নিয়ে যাওয়া - সব ঘটনাগুলো একে একে মিলিয়ে
নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই, এই না হলে বাদশাহী মর্জি!
সত্যিটা বুঝতে পেরে আমার চোখ তখন ছানাবড়া! কার সঙ্গে দেখা হল আজ সন্ধেবেলায়!
বুঝতে পেরে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। সেই রাতে তো বটেই, পর পর কত রাত যে আমি
তারপর না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তা মনে নেই। খালি মনে হত, এ কেমন অভিজ্ঞতা হল আমার!
গল্প শেষ করে এখানে থামলেন লোকনাথদাদু। কিডোরা এতক্ষণ হাঁ করে ওনার কথা
শুনছিল। ঘটনাটা শুনে ওরা এতটাই হতবাক যে চোখের পলক ফেলারও ক্ষমতা নেই ওদের। কারণ ওদের
আর বুঝতে বাকি নেই যে, লোকনাথদাদুর সঙ্গে সেদিন দেখা হয়েছিল মোগল সম্রাট স্বয়ং
ঔরঙ্গজেবের!
_____
ছবিঃ পুস্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment