বিষপুকুরের মুক্তিলাভ
সহেলী রায়
দীপক ভেবেছিলেন সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তাই তীর্ণাকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সকালবেলা প্রিন্সিপাল আর হস্টেলের
রেসিডেন্স ডাক্তার ডক্টর দেবরায়ের সঙ্গে কথা
বলার পর থেকেই মনটা বিচলিত হয়ে আছে।
তবে কি দীপক নিজেই ভুল ছিলেন? এতদিন তীর্ণার মা
সঞ্চিতা যা করে এসেছেন সেটাই
ঠিক? কে ভুল কে ঠিক কিচ্ছু হিসেব মিলছে না দীপকের। দীপক মজুমদার, তীর্ণা মজুমদারের বাবা।
মনের মধ্যে বড্ড টানাপোড়েন এই মুহূর্তে। তবু তীর্ণার মাকে এখনি কিছু জানাতে
চাইলেন না। বেশি
দূরের রাস্তা তো নয়। কলকাতা
থেকে মাত্র তিন ঘন্টা। রাজবাঁধ। এখানেই সুবর্ণ রায় ইন্সটিটিউশনের ক্লাস
সিক্সের ছাত্রী তীর্ণা। স্কুল
হস্টেলে থাকে তীর্ণা, সিক্সেই ভর্তি হয়েছে এখানে। যখন ফোন এসেছিল তখন দীপক অফিসেই
ছিলেন। ডালহৌসির কাছেই তীর্ণার বাবার অফিস। প্রথমে দুশ্চিন্তায় কোনও সিদ্ধান্ত
নিতে পারছিলেন না। তারপর নেট থেকে ভলভো বাসের টিকিট করে বেরিয়ে পড়েন। বাস
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতেই চওড়া রাস্তার দু’পাশে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে
মন শান্ত হওয়া উচিত ছিল দীপকবাবুর। কিন্তু তেমনটা অনুভব করছেন না তিনি। ভীষণ উথাল-পাথাল চলছে মনের ভেতর।
“দীপকবাবু, তীর্ণার
অ্যাপ্লিকেশন ফর্মে আপনি ওর কোনও রোগের কথা লেখেননি। তবু জিজ্ঞেস করছি ওর কি কোনও
সাইকোলজিক্যাল সমস্যা আছে?”
প্রশ্নটা প্রিন্সিপাল
ম্যাডাম করলেও ডক্টর দেবরায়ের চোখেও একই প্রশ্ন ফুটে উঠেছে।
“নাহ, তেমন কখনও চোখে পড়েনি ম্যাডাম। তবে ওর মা মানে আমার
ওয়াইফ সঞ্চিতা নিয়মিত ওষুধ খান। ওঁর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। তবে
এখন ভালো।”
“কোন ডাক্তার দেখেন ওঁকে?” এবার
ডক্টর দেবরায়ই প্রশ্ন করলেন।
“ডক্টর সৌমিত্র সেন।”
“ওহ! উনি
তো এখন দেশের সেরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। আমরা একই কলেজের।”
“হ্যাঁ, তবে সঞ্চিতার
রোগটা একটু অদ্ভুত। যাই হোক, তীর্ণা?”
“সব বলছি আপনাকে খুলে, তার
আগে আপনি চাইলে ওর সঙ্গে
একবার দেখা করে আসতে পারেন।”
দীপকের মনটা ছটফট করছিল
সত্যিই তীর্ণাকে দেখার জন্য। অনুমতি পেয়েই উঠে পড়লেন তিনি।
২
তীর্ণা আজ আবার দাদুর ঘরে।
মায়ের ঘরে ডাক্তারবাবু এসেছেন। কী
যে হয় মায়ের মাঝে মাঝে বোঝে না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তীর্ণাকে দাদুর ঘরে নিয়ে আসা হয়।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলেই টের পায় তীর্ণা, পাশের ঘরে কিছু শোরগোল চলছে। এখন ও ক্লাস থ্রি।
গুটি গুটি পায়ে মায়ের
ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সে।
“সঞ্চিতা, তীর্ণা তো তোমার
মেয়ে, তাকে নিয়ে বার বার এসব কল্পনা কর কেন তুমি?” বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
“উফ, এক কথা বলো না বার বার। কিচ্ছু কল্পনা নয়,
আমি স্পষ্ট দেখেছি, আগেও দেখেছি, কাল রাতেও দেখলাম, তীর্ণার কোমর থেকে মাছের মতো
হয়ে গেল, খাট থেকে গড়িয়ে নেমে ও বাথরুমের জলভর্তি বাথটাবে ছটফট করতে থাকে। ওর চোখে
খুব করুণ আর্তি। কিছু যেন বলতে চায়। বলে না। বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ এই দুটো
রঙিন মাছের আঁশ,” মা কেঁদে
কেঁদে বলছে এসব। ডাক্তারকাকু বেরিয়ে আসে বাবার সঙ্গে ঘর থেকে। তীর্ণা পর্দার পেছনে
লুকিয়ে থাকে।
“এত বড়ো মাছের আঁশ
কোত্থেকে এল? বেশ একটা আঁশটে গন্ধও।”
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না
ডক্টর সেন। কাজকর্ম সেরে আমার একটু ঘুমোতে
দেরি হয়। তবে
একবার ঘুম এসে গেলে আমি খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। প্রতিবারই সঞ্চিতার
চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে। তখন দেখি তীর্ণা আর সঞ্চিতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে।
তীর্ণাকে হয়তো রাতে বাথরুমে নিয়ে যায় সঞ্চিতা, এরকমই মনে হয়। কিন্তু তীর্ণা এসে সোজা শুয়ে পড়ে আর পড়ামাত্রই
ঘুমিয়ে পড়ে, যেন ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হেঁটে এল। সঞ্চিতা ওর পেছন পেছন চীৎকার
কান্নাকাটি করতে করতে আসে। তারপর ভয়ের চোটে খাটের তলায় ঢুকে বলতে থাকে ও তীর্ণা
নয়। আঁশগুলো দেখায় আমায়। আমি আগেরগুলো ফেলে দিয়েছিলাম।”
বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শোনে
তীর্ণা। এসব কোনোকিছু রাতে ঘটেছে বলে ও মনে করতে পারে না। তবে ওর মাথার চুলগুলো
ভিজে। মা কি ওকে
ভোরবেলা স্নান করিয়েছে? কিছু মনে করতে পারে না তীর্ণা।
“ম্যাডাম কি খুব
সুপারন্যাচারাল গল্পের বই বা সিনেমা পড়েন বা দেখেন?”
“না, এসবের নেশা নেই।
সারাদিন সংসারের কাজকর্ম, তীর্ণার দেখাশোনা। সময়ও পায় না। রঙ করা মাছের আঁশ হয়তো
ওয়ার্ক এডুকেশনের স্টেশনারি দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। পর পর এরকম বেশ কয়েকবার হবার
পর সঞ্চিতা তো একা বাড়ি থেকে বেরোয়ই না। আর বেরোলেও এরকম যুক্তিহীন গল্প বানিয়ে
অদ্ভুত আচরণ করবে কেন? তীর্ণা তো আমাদের প্রাণ,” বাবাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। তীর্ণার খুব
খারাপ লাগছে।
“চিন্তা করবেন না, মিস্টার
মজুমদার। মানুষের মন বড়ো বিচিত্র। কে কোন মুহূর্তে কী ভাবছে, বা কী চলছে মনের অন্দরে তার কূলকিনারা
পাওয়া মুশকিল। আমরা নানা ক্লু দেখে তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করি আর তা
থামাবার উপায় বাতলে দি।
আমিও তেমন এক চেষ্টাতেই আছি। এক্ষুনি কোনও কারণ না পেলেও মাছ ধরার একটা চেষ্টা তো করবই। আপনি ক’দিন
ছুটি নিয়ে ওঁর সঙ্গে
থাকুন। উনি একটু ভালো বোধ করলে আমার চেম্বারে আনুন। কয়েকটা সিটিং লাগবে, কথা বলে
মনটাকে বাইরে বের করে আনতে হবে।”
তীর্ণার খুব ঘুম পাচ্ছে,
যেন সারারাত জেগে আছে সে। মায়ের যেদিনই এরকম অসুখ করে সেদিনই তীর্ণার খুব ঘুম পায়।
৩
তীর্ণা স্নান সেরে হস্টেলে
ওদের বিল্ডিং-এর পেছনের করিডরে এসে দাঁড়াল। আজ সবাই স্কুল গেলেও প্রিন্সিপাল
ম্যাডাম ওকে স্কুল যেতে মানা করেছেন।
পেছনেই তিনশো বছরের পুরোনো সুবর্ণ রায়ের জমিদার বাড়ি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সামনে বিশাল পুকুর। মেঘের ছায়া পড়ে নীল টলমলে জল। এখানে এসে ওর অনেক বন্ধু হয়েছে।
থাকতে বেশ ভালোই লাগছে এখানে। সব চাইতে
ভালো লাগে এই জমিদারবাড়ি। এই পেছনের করিডরে কেউ আসে না সচরাচর। তীর্ণাও কাল রাতেই
প্রথম এসেছিল। ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ যেন
ওকে ডাকছে। ওরা চারজন থাকে একটা ঘরে। বাকিরা ঘুমোচ্ছিল। তীর্ণা সবার কাছে গিয়ে
গিয়ে দেখল, কে ডাকল। মনে হল শব্দটা রুমের বাইরে থেকে আসছে। এই রুমে একজন ক্লিনিং
স্টাফ সন্ধ্যা মাসি শোয়, সেই রোজ সকালে উঠে দরজা খুলে দেয়। সন্ধ্যা মাসিও নাক
ডাকছে। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় তীর্ণা। একটু টান দিতেই ছিটকিনিটা আপনে আপ নেমে এল।
বাইরে করিডরে ঝুলন্ত বাল্বগুলি প্রবল হাওয়ায় দুলছে। তীর্ণা পর পর রুমগুলো পেরিয়ে
সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখল, সিঁড়ি দিয়ে না নেমে অন্যদিক দিয়ে একটা রাস্তা ঘুরে গেছে।
ওদিকেই পা বাড়াল তীর্ণা। এদিকটাতে ঘন অন্ধকার। তীর্ণা আন্দাজে এগোতে লাগল। লম্বা
করিডর। সম্ভবত হস্টেলের পেছনদিক। খোলা ব্যালকনি। তীর্না ব্যালকনিতে ভর দিয়ে দাঁড়াল
খানিকক্ষণ।
হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে দিওয়ালির রোশনাই-এর মতো ঝলমল করে উঠল এই জমিদার বাড়ি। প্রচুর
আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়িটা। সমস্ত আলোর ছায়া পড়েছে পুকুরের গভীর জলে। তীর্ণার
চোখ জুড়িয়ে আসে।
“তীর্ণা?”
“বাবা তুমি? কখন এলে?”
বাবাকে খুব উদ্বিগ্ন
দেখাচ্ছে। সঙ্গে ম্যাডাম আর হস্টেলের ডাক্তারবাবু।
“তোমায়
এদিকের রাস্তাটা কে বলে দিল তীর্ণা?” খুব
শান্তস্বরে জানতে চাইলেন ম্যাডাম।
“কেউ
ডেকেছিল, তবে তাকে আর দেখতে পাইনি।”
তীর্ণা দেখল বাবা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
একটু ভয়ও পেয়েছেন। মায়ের বার বার অসুখ হলে বাবা যেমন ভয় পান তেমনই লাগছে বাবাকে।
বাবাকে প্রায়ই অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়। মা এত ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন যে
ডক্টর সেন আর বাবা সিদ্ধান্ত নেন তীর্ণাকে কিছুদিন মায়ের থেকে দূরে থাকতে হবে, তাই
এই সুবর্ণ রায় ইন্সটিটিউশনে আসা। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য মন কেমন করলেও, এখানকার
পরিবেশে মন খারাপ কেটে গেছে তীর্ণার। তীর্ণা আর ওর মায়ের ঘরে রঙিন মাছের আঁশ পাওয়া
যেত যেখানে সেখানে। আঁশটে গন্ধ বেরুত
ঘর থেকে। বাবার সঙ্গে সঙ্গে
ডক্টর সেনও খুব চিন্তায় পড়েছিলেন।
“তীর্ণা, তুমি রুমে এসে
বাবার সঙ্গে কথা বল।
আমরা আবার পরে আসব। আর কেউ ডাকলেও এদিকটায় এসো না কখনও।”
৪
“মারমেইড?”
ডক্টর দেবরায়ের মেডিকেল
কলেজের দু’বছরের সিনিয়র ডক্টর সৌমিত্র সেন হাজির দীপকবাবুর ডাকে রাজবাঁধে। এমন
একটা ঘটনা ডক্টর সেনের ডাক্তারি জীবনে প্রথম। তাই সমস্ত কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন রাজবাঁধে। কৌতূহলী দেবরায়ের প্রশ্নে নিজেও খুব
চিন্তিত তিনি।
“ঠিক জানি না রে। এতদিন তো জানতাম, মারমেইড বা মৎস্যকন্যা বিদেশী
লোকমুখে প্রচলিত গল্প। নর্থ সিরিয়া বা ওরকম কোথাও কোনও এক দেবী, তাঁর ভালোবাসার মানুষকে হত্যা
করার দুঃখে মারমেইডের রূপ ধারণ করেছিলেন, তারপর থেকেই এ নিয়ে নানা গল্প, সিনেমা চলে আসছে। সঞ্চিতাদেবীর চোখকে জাস্ট ইলিউশন ভেবে
উড়িয়ে দিচ্ছিলাম, কিন্তু
মাছের আঁশ,
আঁশটে গন্ধ এগুলো
খুব ভাবাচ্ছিল। তারপর
আজ দীপকবাবুর গলা শুনে ছুটে আসতে বাধ্য হলাম।”
“ভালো করেছ সৌমিত্রদা। আমাদের এখানে স্কুল শুরু হয় সকাল ছ’টা বেজে পঞ্চাশ মিনিটে। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ক্লিনিং স্টাফেরা
রুমের দরজা খোলে। আজ
সন্ধ্যা মাসি সবাইকে জাগাতে গিয়ে দেখে তীর্ণা তার বিছানায় নেই, বাথরুমেও নেই অথচ ঘরের দরজা
ভেতর থেকেই বন্ধ। যখন
কোনোদিকে তীর্ণাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তখন আমরা ডিসিশন নিই হস্টেলের পেছন
দিকে দেখার। সিঁড়ির পাশে তালা দেওয়া কোলাপসিবল
গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় তীর্ণা গেটের ওপারে, হাঁ করে তাকিয়ে আছে সামনের জমিদারবাড়ির
দিকে। ওখানে
কিছু রঙিন মাছের আঁশও পাওয়া গেছে। ও বলছে ওকে কেউ ডেকে নিয়ে গেছে ওখানে। কিন্তু বন্ধ দরজা আর তালা দেওয়া কোলাপসিবল
গেট পেরিয়ে ও পৌঁছাল কী করে ওখানে? গত কুড়ি বছরে কেউ কখনও যায়নি ওদিকটায়। চাবিটাও সম্ভবত ট্রাস্টি মেম্বার বংশীধারীবাবুর
কাছে আছে। গেটের
তালা ভেঙে ওকে নিয়ে আসা হয় রুমে। ঘুমোচ্ছিল। ওর বাবা আসার পর ওকে আবার একই জায়গায়
পেলাম আমরা। তবে
এখন গেট খোলা ছিল।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসঘরে তীর্ণার বাবা, ডক্টর সেন, ডক্টর দেবরায় আর ম্যাডাম গভীর
চিন্তায় ডুবে আছেন।
“ঐ জমিদারবাড়ি সম্বন্ধে আমায় কিছু বলতে পারবি তোরা?” ডক্টর সেন প্রশ্ন ছুঁড়লেন। ম্যাডাম উদ্যোগী হলেন উত্তর দিতে।
“সুবর্ণ রায় জমিদার হলেও মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন, লেখালেখিও করতেন। উপকারীও ছিলেন। বিপদে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। হৈ-হুল্লোড় করে দিব্যি চলছিল
জমিদারি। হঠাৎ
একদিন রাতে বাড়িতে
ডাকাত পড়ে। তখন
গড়জঙ্গলের ডাকাতরা খুব শক্তিশালী ছিল। জমিদারবাড়ির প্রধান ফটকে তারা একটা
প্রকান্ড তালা ঝুলিয়ে দেয়, যাতে কোনও লোক বাইরে বেরোতে না পারে। সাঙ্ঘাতিক লুটপাঠ চলে ভেতরে। ডাকাতরা ভোররাতে ফিরে
গেলেও ফটকের
তালা যেমনকার তেমনই থেকে যায়। বহু লোকজন ডেকে সেই তালা ভাঙার চেষ্টা
করা হয়, তবে সকলেই অসফল হয়। আর সব
চাইতে আশ্চর্যের
ব্যাপার, যে-ই ঐ তালা ভাঙার চেষ্টা করেছে তারই মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে কোনও
না কোনওভাবে। সুবর্ণ
রায় পরে অন্য একটি ফটক তৈরি করান। আমাদের হস্টেলের পেছনদিকে
ঐ মেইন ফটকটিই
দেখা যায় যাতে এখনও তালা লাগানো আছে। সুবর্ণ রায়ের হৈচৈতে তৎকালীন আইনি
ব্যবস্থায় ডাকাত দলের সর্দার ধরা পড়ে বহুদিন পরে। এরপর সুবর্ণ রায়ের পরের বংশধরেরা
এ জমিদারি চালাতে থাকে, এখনকার বংশধর সূর্য রায়ের বাবা প্রতাপ রায় এই স্কুল
বাড়িটি বানান বছর কুড়ি আগে। তার আগেই অবশ্য ওঁরা এ
তল্লাট ছেড়ে কলকাতায় চলে যান সবাই। স্কুলের ট্রাস্টি গঠন হয়। সূর্য রায় এখন বিদেশে থাকেন। প্রতাপ রায় আট বছর আগে মারা গেছেন। আমরা সূর্য স্যারকে মেইল করেছি পুরো
ঘটনা জানিয়ে। উনি
সব চেয়ে পুরোনো ট্রাস্টি বংশীধারীবাবুকে আসতে বলেছেন স্কুলে। গাড়ি চলে গেছে ওঁকে আনতে, বর্ধমান থেকে। নব্বই বছর বয়স ওঁর। শরীরও
ভালো নয়। উনি
যদি কিছু হেল্প করতে পারেন।”
ম্যাডাম একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলেন। বংশীধারীবাবু আসার আগে একবার তীর্ণার
সঙ্গে কথা বলা দরকার মনে হল ডক্টর সেনের।
“তুমি কাল গেলে কী করে ওখানে
তীর্ণা?”
“কেউ ডাকছিল তো।”
“নিশির ডাক? কল অফ দ্য
নাইট স্পিরিট,” ডক্টর দেবরায় স্বগতোক্তি করলেন।
“কোলাপসিবল গেট পেরোলে
কী করে?” প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কৌতূহলী
চোখ।
“কোনও গেট তো তখন দেখিনি
ম্যাম।”
“বেশ তারপর কী
হল বল,” ডক্টর সেন জানতে চাইলেন।
“আমি পুকুরে নামলাম।
বাড়িটা টুনিবাল্ব দিয়ে সাজানো ছিল। প্রচুর লোকজন। আমি সাঁতার কাটতে কাটতে দেখছিলাম
সব। তারপর আর মনে নেই, ঘুম পাচ্ছে খুব।”
তীর্ণাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন
দিয়ে উঠলেন ওঁরা।
৫
“মেয়েটি বানিয়ে বানিয়ে
গল্প বলছে তোমাদের, আর তাই জন্য আমায় টেনে আনলে এতদূর?”
বংশীধারীবাবু
বেশ বিরক্ত।
“আমারও মনে হয় তীর্ণা
এতদিন সঞ্চিতার কাছাকাছি থেকে এসব রূপকথা শিখেছে,” দীপকবাবুও মুখ খুললেন
এতক্ষণে।
“কিন্তু মাছের আঁশ? বন্ধ
কোলাপসিবল গেট পেরোনো? না না জট কিছুতেই খুলছে না,” ডক্টর সেন গম্ভীর হলেন।
“তীর্ণাদিদি উঠে পড়েছে
ম্যাডাম। কী একটা দেখাবে বলছে আপনাদের।”
সন্ধ্যা মাসি হন্তদন্ত হয়ে বলে, তীর্ণাকে ডেকে আনতে
গেল। তীর্ণা আস্তে আস্তে জিনিসটা টেবিলের উপর রাখল। কেউ অতটা অবাক না হলেও বংশীধারীবাবু চমকে উঠলেন।
“এটা তুমি পেলে কোথায়?”
“পুকুরে।”
সুবর্ণ রায় ডাকাত সর্দারকে ডাকলেন। ফটকের তালা খুলে দেবার
জন্য অনুনয়-বিনয় করলেন, বদলে তার শাস্তি মকুবও
করবেন কথা দিলেন। ডাকাত সর্দার জানাল, তাড়াহুড়োতে চাবি পুকুরে পড়ে যায়। তবে ও তালা
চাবি গড়জঙ্গলের ডাকাতে কালী মন্দিরের এক তান্ত্রিক বাবার তৈরি, মন্ত্র পড়া।
তান্ত্রিক বাবা সর্দারকে এই তালাচাবি দিয়ে বলেছিলেন কোনও পাপকাজে ব্যবহার করলে
ক্ষতি হবে। সুবর্ণ রায় সর্দারকেই নামালেন পুকুরে চাবি খুঁজতে। বেশ খানিকক্ষণ
পরে ভেসে উঠল সর্দারের মৃতদেহ। ডাকাতির কাজে মন্ত্রপূত তালাচাবি ব্যবহার করার
জন্য শাস্তি পেল সর্দার। এরপর আর কোনও চেষ্টা করেননি তিনি। এমনকি ও পুকুর কারও
ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ ছিল। পুকুরের নাম দেওয়া হয় ‘বিষপুকুর’।
বংশীধারীবাবু টেবিলের উপর চাবিটার দিকে তাকিয়ে তার
ঠাকুরদার কাছে শোনা গল্পটা আরেকবার মানসচক্ষে
দেখতে পেলেন
যেন। রূপোর চাবি, হুবহু সর্দার যেমন বিবরণ দিয়েছিলেন সুবর্ণ রায়কে ঠিক তেমনই।
বংশপরম্পরায় এ গল্প শুনে আসছেন বংশীধারীবাবুরা, আজ স্বচক্ষে সাক্ষাৎ
মিলবে ভাবতে পারছেন না।
“দীপকবাবু, আমি এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারব না, হয়তো পৃথিবীর কেউই পারবে
না। আমাদের মনোরোগ বিভাগে এর কোনও হদিশ নেই। তবে অনেক গবেষণা
চলছে। আমার মনে হয় তীর্ণা আপনাদের কাছেই থাক। আর
সঞ্চিতাদেবীকে জানিয়ে দিন উনি এতদিন যা যা দেখেছেন, সব সত্যি। তাহলেই ওঁর ভয়
কেটে যাবে। আমার এর বেশি কিছু বলার নেই।”
ডক্টর সেন ফিরে যাচ্ছেন। বংশীধারীবাবুর হালকা লাগছে
মন। বিষপুকুর তবে মুক্তি পেল। গাড়ি ভাড়া
করে তীর্ণাকে নিয়ে ফিরছেন দীপকবাবুও। তীর্ণার চোখে জল। ঐ ছোট্ট বাথটাবে সে আর আঁটে
না। পুকুরটা ঢের ভালো ছিল। তীর্ণার ভীষণ জল ভালো লাগে। সমুদ্রের ঢেউ-এ ডুবে বসে
থাকতে ভালো লাগে।
বিষপুকুরের সমস্ত গরল পান করে তীর্ণা এগোচ্ছে
বাবার কোলের কাছে বসে।
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
Khub sundar lekha... ekdom onno rokom ekta golpo...
ReplyDeleteDaruun lekha
ReplyDeleteখুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম। সায়েন্স ফিকশান? সাইকোলজিক্যাল ? বেশ সাসপেন্স। সহেলী, ব্রাভো
ReplyDeleteKhub shundor lekha. Tobe ektu oshomapto laglo..
ReplyDelete