পাহাড়ের বাড়ি
শ্রীজাতা গুপ্ত
১
তোয়া অনেকদিন থেকে ভাবছে স্টোররুমের ট্রাইসাইকেলটার
কাছে আরেকবার যাওয়া প্রয়োজন। জং ধরা বেলটা তিনবার বাজাতে হবে আবার। নইলে আর উপায়
নেই। আর পারা যাচ্ছে না। এত চিন্তা আর এই বয়সে নেওয়া সম্ভব না। তার মধ্যে একটা
বিশেষ চিন্তা নিয়ে ক’দিন ধরে খুব নাজেহাল অবস্থা তোয়ার। বয়স তো অনেক হল। এগারো
পেরিয়ে বারো-য় পড়বে আর কয়েকদিন বাদেই। এখনও তোয়া ঠিক করতে
পারল না বড়ো হয়ে সে কী হবে। লজ্জার বিষয়!
সে আর কত বড়ো হবে, এই
প্রশ্নও তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
তোয়া জানে, ‘বড়ো হয়ে কী হবে’, এই প্রশ্নের উত্তর তার
ইতিমধ্যে জেনে যাওয়া উচিত ছিল। সকলে তেমনই মনে করেন। নইলে বারবার তাকে একই প্রশ্ন
করেন কেন? এবারের পুজোর ছুটিতে ওরা দলবেঁধে রামপুরহাটে গিয়েছিল দেশের
বাড়ি। সেখানে বাড়ির দুর্গাপুজো। তোয়ার জেঠু,
পিসি, কাকু
ছাড়াও এমন অনেক পিসি কাকুরা এসেছিলেন যাঁদের তোয়া কোনওদিন দেখেনি। প্রত্যেকে ওকে
দেখেই বলেছেন, ‘একি তোয়া! এত
বড়ো হয়ে গেলে? কোন ক্লাস হল? কী
হতে চাও বড়ো হয়ে?’
আচ্ছা,
মানুষ তো স্বাভাবিক নিয়মেই
বড়ো হয়। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে বড়ো হয়। ওদের বারান্দার টবের চারাগাছ বড়ো হয়, পাড়ার
মোড়ে কালু-ভুলু বড়ো হয়,
তাহলে ওর বেড়ে ওঠা নিয়ে
সবার এত বিস্ময় কেন? যদিও, ওদের
বাড়ির পেছনের পুকুরটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটো হয়ে গেল। তোয়ার প্রিয় নীল সোয়েটারটা এই
শীতে আর গায়ে হল না, সেও ছোটো হয়েছে। আজকাল
তোয়ার নিজের ঘরটাও আগের চেয়ে ছোটো লাগে। তোয়ার কি দিনে দিনে ছোটো হওয়ার কথা ছিল
তবে? ছোটো হয়ে যেতে পারলে আর কেউ কোনও কঠিন প্রশ্ন করবেন না তো? এই
যেমন, বড়ো হয়ে কী হবে?
উত্তরে তোয়া হাঁ করে
তাকিয়ে থাকে। কখনও বলে, ‘জানি না!’ এই উত্তরে সবাই আরও অবাক হয়ে পড়েন। ‘সেকি! জানো
না! বাবার মতো প্রফেসর হবে?
নাকি মায়ের মতো? আর্কিটেক্ট? দাদা
দেখ কী সুন্দর কম্পিউটার পারে। তুমি কম্পিউটার পারো?’ তোয়া মুখ বেঁকায় এই সময়। পাশে মা বা বাবা থাকলে মুখ গুঁজে দেয় ওদের কোলে। তখন
ছোট্ট করে একটা বকুনি জুটে যায়। ‘কী হচ্ছে তোয়া! কথা
বলো!’
দাদাকেও জিজ্ঞাসা করেন ওঁরা। তোয়া দেখেছে, দাদা
সবসময় চটজলদি জবাব দিয়ে দেয়। কিন্তু কখনও এক জবাব দেয় না। একবার বলে ডাক্তার, একবার
সায়েন্টিস্ট, কখনও আবার ফিল্মমেকার।
সবেতেই বাহবা জোটে দাদার। একদিন তোয়া আলাদা করে দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘দাদা, বড়ো হয়ে কী হবি রে?’
দাদা ওকেও চটজলদি জবাব
দিয়েছিল, ‘দাঁড়া, আগে বড়ো হই। তারপর ভাবব।’ দাদাটাও তার মানে জানে না
আসলে। কেউই বোধ হয় জানে না তারা কী হতে চায়। না জেনেও তাদের কাছে
জবাব থাকে সবসময়ে। কিন্তু তোয়া না জেনে কিছু বলে না। না জেনে কিছু বলতে নেই, ও
জানে। তবুও, বয়স তো অনেক হল। এবার বোধ
হয় একটা উত্তর তৈরি করতে হবে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘ভেবে দেখো কী হতে চাও। যেটা মন থেকে চাইবে সেটাই হতে হবে।’
মা খুব গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘তোয়া, আগে মানুষের মতো মানুষ হও।’ খুব ঘাবড়ে যায় তোয়া। একে তো মা-বাবা ওকে ‘তুমি’
করে বললেই ওর চোখ গোল গোল হয়ে যায়। তার ওপর এত কঠিন কথা!
এইসব সময় তোয়া টুক করে ওদের স্টোররুমে যায়।
গেস্ট বাথরুমের পাশে সবুজ দরজা দেওয়া স্টোররুম। হাবিজাবি কত কী! এক
কোনায় তোয়ার ছোটোবেলার লাল টুকটুকে ট্রাইসাইকেলটা ব্যাঁকা হয়ে পড়ে আছে। কোনওরকমে
হাত বাড়িয়ে বেলটার কাছে পৌঁছে যায়। তিনবার ট্রুং ট্রুং ট্রুং বাজিয়েই ফিরে আসে।
তোয়া জানে, বেল বাজানোর দু-তিনদিনের মধ্যেই অস্থির করে তোলা সমস্যাগুলো
পালিয়ে যাবে। সমাধান পাওয়া যাবে সহজেই। ঘুমের মধ্যে, বা
খেলার মাঠে।
২
মাত্র কিছুদিন হল, মেঘ
ওর চারপাশের সবকিছু চিনতে শিখেছে। অনেকদিন পর্যন্ত চোখ খুললেই সাদা দেয়াল দেখতে
পেত। সেই দেয়ালে মাঝে মাঝে কয়েকটা মাথা উঁকি দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করত। এক একজনের এক
এক হাসি। সবাই একই সুরে বলত, ‘মেঘবাবু আজ কেমন আছ? ওই
দেখ, ঠোঁট ফুলাচ্ছে। ক্ষিদে পেয়েছে নাকি রে? দেখ
দেখ, হাসল! এই! আমাকে
দেখে হাসল।’ বলেই কেউ কেউ হঠাৎ করে তুলে নিত মেঘকে। তখন
ওর চোখের সামনে সব কেমন বাঁই বাঁই করে ঘুরে যেত। কিছুক্ষণ ধৈর্য্য ধরে থেকে ভ্যাঁ
করে কেঁদে উঠত মেঘ। আবার শুয়ে পড়ত,
সঙ্গে সঙ্গে মুখে
প্যাসিফাইয়ার। এর মধ্যেই কয়েকটা স্বর চিনে ফেলছিল। যেগুলো রোজ শুনতে পায়। দুটো মুখ
চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু, আবার অনেক মুখের মধ্যে
গুলিয়ে যাচ্ছিল। এই করেই জীবন চলছিল মেঘের। কী করে যেন হঠাৎ একদিন পিঠে বালিশ ছাড়া
বসে থাকতে শিখে গেল মেঘ। আর, ওর দুনিয়াটা বদলে গেল।
এতদিন যা যা চ্যাপটা বিকট অ্যাঙ্গেলে দেখতে অভ্যস্ত ছিল, সেদিন
থেকে সব বেশ প্রোপোর্শনেট মনে হতে লাগল। দেখতে পেল, যে
মাথাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ত ওর উপরে, তারা আসলে গোটা একটা
শরীরের সঙ্গে যুক্ত। ওর নিজের যেমন হাত-পা আছে, ওই মাথাগুলোরও তেমনই।
শুধু, সাইজে অনেক বড়ো। আর,
ওরা দাঁড়াতে পারে, হাঁটতে
পারে। মেঘ শুধু বসতে পারে।
মেঘ-এর পাশেই শুয়ে থাকে
আরেকজন। একটা নরম মতো লম্বা কান ঝোলা খরগোশ। মেঘ তার নাম দিয়েছে কানবাবু। ও যেমন
সবার মেঘবাবু, ওর তেমন কানবাবু। মেঘ মনের
সুখে খরগোশের কান কামড়ায় সারাদিন। কানবাবু কিচ্ছু বলে না। আর, যখন
খুব প্রয়োজন পড়ে, মেঘ কানবাবুর পেটে একটা
চিমটি কাটে। চিমটি নয়। আহ! চিমটি কাটলে কানবাবুর
ব্যথা লাগবে না! বুচু করে পেটটা চিপে দেয়।
যেমন সবাই মেঘকে দেখতে এসে গালটা চিপে দেয়। তখন কানবাবুর পেট থেকে ডিংডং-ডিংডং
সুর বেরোয়। আর, পেট-চেপা
খেলেই কানবাবু বুঝে যায়, মেঘের কিছু সমস্যা হচ্ছে।
কী জাদু যে জানে কানবাবু। মেঘের সমস্যা নিমেষে উধাও। এই যে কিছুদিন আগে বালিশ ছাড়া
বসতে পারছিল না, ভারি মন খারাপ ছিল মেঘের।
কানবাবুর পেটে পেটে সেই কথা বলতেই চারদিন পরে মেঘ একা একা বসতে শিখে গেল। কানবাবু
সব পারে। তাই জন্যই কানবাবুকে ছাড়া মেঘ কোথাও যেতে চায় না। সারাক্ষণ কানবাবুর কান
ধরে রাখে মুঠোর মধ্যে।
এই বসতে শেখার পর থেকেই মেঘ অনেক কিছু আরও
পরিষ্কার বুঝতে পারছে। এতদিন যেগুলো ওই সাইজের বড়ো মানুষগুলো বলত, মেঘ
ভাবত সবই গোঁগাঁ আওয়াজ। এখন দেখছে,
শব্দগুলোর মধ্যে বেশ একটা
প্যাটার্ন আছে। কিছু কিছু শব্দ চিনতেও পারছে মেঘ। ওদের মুখ থেকে শুনেই বুঝেছে, ওর
নিজের মানে ‘মেঘ।’ যেমন কানবাবুর মানে যেমন ‘কানবাবু’। একটা
চেনা মুখের মানে তার সঙ্গে থাকবে একটা চেনা গলার স্বর। একটা চেনা মুখকে, যাকে মেঘ
রোজ দেখে, সেদিন মা বলে ফেলেছিল। অমনি সেই চেনা মুখটা মেঘের মতো ভ্যাঁ করে কেঁদে
ফেলেছিল। মেঘ সেই দেখে ফ্যাক করে হেসে ফেলে, আর
মাম্মমাম্মম্মামটা আরও কেঁদে ফেলে। এই এত কিছু বুঝতে পারে না মেঘ। সেখানেই গন্ডগোল। বোঝাশোনার
ভালো প্রগ্রেস হতে হতেই হোঁচট খায় মেঘ। রোজ। তখন হতাশায় ডুবে যায়। কানবাবুর কান
কামড়ায়।
দিন দিন মেঘ দেখছে, সাইজে
বড়ো মানুষগুলোর মুখ দিয়ে যে আওয়াজ বেরোয় তার মানে বোঝার চেয়ে ওদের হাত নাড়া, মুখের
হাবভাব, ভুরু কোঁচকানো,
হাসি, এসবের
মানে বোঝা অনেক সহজ। তাই, ও নিজেও সেইভাবেই যোগাযোগ
করে মানুষগুলোর সঙ্গে। করার চেষ্টা করে। শুয়ে শুয়ে যখন দেখে মাথার উপর একটা কালো
মতো জিনিস সারাদিন ঘুরছে, হাত তুলে মেঘ দেখায়, বলে
যে ওর ওই ঘুরঘুরে জিনিসটা চাই। চাহিদা যখন চরম,
তখন হাত-পা সব বাড়িয়ে মেঘ
বলে, ‘দাও দাও, এখনই আমাকে দাও ওটা!’ মানুষগুলো খালি খিলখিল করে মেঘকে দেখে হাসে। তখন রাগ হয় মেঘের। রাগের চোটে
কুট্টি মুখখানা বেঁকে যায়। খুব গরম লাগে। চিৎকার করে মেঘ। ওরা তাও বোঝে না। তখন
জামা টেনে খুলে ফেলে, চুল ছিঁড়ে ফেলে। ভ্যাঁ করে
আবার। তখন বুঝি কেউ বুঝতে পারে অবশেষে। বলে ওঠে, ‘মেঘবাবুকে খাইয়ে দে। খুব ক্ষিদে পেয়েছে বেচারার।’ নাহ! বুঝতে
পারল না! এই হতাশায় খেতে খেতেই রণক্লান্ত মেঘ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে
উঠে কানবাবুর পেটে দু'বার বুচু। কথা বলা শিখতেই হবে, কানবাবু।
ওই বড়ো মানুষগুলোর ভাষায় কথা বলতে না পারলে ওরা কিছুই বুঝতে পারবে না মেঘ কী চায়।
৩
রাত ১২টা বাজে। সৌম্য এখনও ল্যাপটপের সামনে।
অফিসের ডেস্কে। প্রেজেন্টেশনটা শেষ না করে উঠতে পারছে না। বাকি টিম যার যার বাড়ি
থেকে কাজ করছে। সৌম্য আর ডেস্ক ছেড়ে উঠতে পারেনি। একটা কাজের মাঝে ইন্টারাপশন হলে
সেই কাজে আবার ফিরতে ও মুশকিলে পড়ে। অফিসের কাজের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে সেই
সমস্যা। গল্প লিখতে বা ফোটো-স্টোরি করতে সে সমস্যা হয় না।
অনেকদিন বাদে বাদে যখন ফিরে যায় সৌম্য,
কোনও ফেলে আসা লেখার কাছে, ছবির
ফোল্ডারে, বরং ভারি আরাম পায়। অনেকদিন বাদে চেনা বন্ধুর বাড়ি গিয়ে গা
এলিয়ে রবিবারের দুপুর কাটানোর আরাম। আহ!
কতদিন আড্ডা মারেনি সৌম্য।
কতদিন হয়ে গেল, লখনৌ-এর ফোটো স্টোরিটা
নিয়ে বসতেই পারেনি!
মোবাইল ফোনটা খুলে সেই নম্বরটায় যায় সৌম্য।
প্রথম চাকরি পেয়ে কিনেছিল ফোনটা। নতুন ফোন খুলে দেখেছিল কয়েকটা নম্বর কোম্পানি
থেকে সেভ করা আছে মোবাইলে। তার মধ্যে একটার নাম ‘হেল্প’। কৌতূহলবশত নম্বরটা ডায়াল করে। একবার রিং হয়ে
নিজে থেকেই কেটে যায়। যতবার ডায়াল করে ততবারই একবারের পর থেমে যায়
রিং। তারপর দিন যায়, সৌম্য সেই নম্বরের কথাও
ভুলে যায়। বছরখানেকের মাথায় বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। অসহায় দুশ্চিন্তায়
একদিন সৌম্য ডায়াল করল ‘হেল্প’। একবার রিং-এ কেটে যাওয়ার পর নিজের
ছেলেমানুষিতে নিজেই হেসে ফেলেছিল সে। কিন্তু, অসাধ্য
সাধন করে ঠিক তার পরের দিন বাবা মির্যাকুলাসলি সেরে ওঠেন। কমপ্লিকেশন সব কেটে
যায়। ডাক্তাররাও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সেই থেকে সৌম্য জানে, ওই
‘হেল্প’-এর একটা রিং খুব দামি। এরপর নানা সমস্যায়, প্রোমোশন
আটকে যাওয়ার চিন্তা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ইয়ার্লি
ডেডলাইন সব কিছু উতরে দিয়েছে ওই একটা রিং। নম্বরটায় আরেকবার ডায়াল করতেই হবে। এই
চাকরিটা আর করতে পারছে না সৌম্য।
ও পৃথিবী দেখতে চায়। ছবি তুলতে চায় সারা জগত
ঘুরে। আমাজনের জঙ্গলে, আফ্রিকার মরুভূমিতে, নিউ
ইয়র্কের রাস্তায়, প্যারিসের যাদুঘরে গলায়
ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে সৌম্য। আর সেইসব গল্প লিখবে। দেশবিদেশের পত্রপত্রিকার
চকচকে কাগজে ছাপা হবে সেই লেখা আর ছবি। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে এক একটা রোমাঞ্চকর
ফোটো স্টোরি। যখনই ভাবে চাকরি ছেড়ে স্বপ্নের জীবন বাঁচবে, যখনই
সে কথা কাউকে বলতে যায়, সবাই হেসে উড়িয়ে দেয়। ‘আরে, ছুটি
নিয়ে ঘুরে আয়। উইক এন্ডে বসে লেখ। এইসব শখের কাজের জন্য চাকরি ছাড়বি কেন?’ একই কথা নানা ভাবে শুনতে হয় নানা জনের কাছে। কিন্তু সৌম্য জানে ছবি শুধু শখ
নয়। লেখা শুধু টাইমপাস নয়। ওগুলোই ও সারাদিন করতে চায়। একটা নম্বর একমাত্র ওকে
পৌঁছে দিতে পারবে স্বপ্নের কাছে। কফি মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের জানলা দিয়ে অনেক
নিচে ঘুমন্ত কলকাতাকে দেখতে দেখতে স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে চায় সৌম্য।
৪
পাহাড়ের একেবারে উপরে একটা কাঠের ছোট্টো
বাড়ি। সামনে বাগান। বাগানের শেষে কাঠের দরজা,
পাশে লাল ডাকবাক্স। বাগানে
অনেক গাছ, গাছ থেকে নেমে আসা টায়ারের দোলনা, গাছের
ডালে বসা অনেক পাখি, পাখির নানা গান। বাগানের
মাঝখান দিয়ে সরু মোরাম বিছানো পথ গিয়ে থেমেছে বাড়ির বেগুনি দরজায়। যেরকম একটা বাড়ি
আমরা সবাই খুঁজি। কোথাও পাই না। তাও খুঁজি। যেরকম বাড়ির ছবি গল্পের বইয়ের পাতায়
থাকে। যে বাড়িতে ঢুকলেই মিঠে গন্ধ বেরোয়,
আভেন থেকে আসা গরম রুটি বা
মুচমুচে বিস্কিট বা মিষ্টি মিষ্টি কেকের। যে বাড়ির সব ঘরের কোনায় লাল নীল মোমবাতি
জ্বলে রোজ সন্ধ্যায়। জানলায় দরজায় কুরুশের কাজ করা জালি জালি পর্দা। দিনের বেলায়
ফুরুফুরে হাওয়ায় দোল খেয়ে পর্দারা একবার বাইরে যায়, একবার
ঘরে আসে। এই বাড়ির পাহাড়টার কোনও নাম নেই। কারণ মাটি থেকে এই পাহাড় কেউ দেখতে পায় না।
মানুষ যা দেখতে পায় না তার কোনও নাম হয় না। তার কোনও ম্যাপ হয় না। কিন্তু মানুষের
সেই না-দেখতে পাওয়া জিনিস দিব্যি বেঁচে থাকে মনের সুখে। মানুষ
জানতেও পারে না। নিচ থেকে এই পাহাড়ের দিকে তাকালে খালি মেঘ দেখা যায়, বৃষ্টি
দেখা যায়, আকাশ আর তারা দেখা যায়। পাহাড় দেখা যায় না। পাহাড়ের নাম নেই, তাই
পাহাড়ের বাড়িরও নাম নেই কোনও।
বাড়িটার বেগুনি দরজার উপর কারুর নাম নেই।
একটা উলের-কাঁটা আর একটা কুরুশ-কাঁটা আঁকা আছে। আর পাশে
আছে চকচকে একটা কলিং বেল। কলিং বেল না বাজিয়ে কেউ যদি চুপিসারে এই দরজা ঠেলে ঢুকে
পড়ে, দেখবে, বসার ঘরে জানলার ধার ঘেঁষে
বড়োসড়ো দুটো গদিওয়ালা চেয়ার পাতা, মুখোমুখি। শ্যাওলা রঙের
চেয়ার। মাঝখানে গোল টেবিলে হরেক বই আর খাতা। জানলার পর্দা ভেদ করে দিনের আলো তেরছা
হয়ে পড়েছে চেয়ারে। পর্দার নকশা ছড়িয়ে পড়েছে আলোছায়া ঘরে। আর, চেয়ারে
বসা দু’জনের উপর। একটি চেয়ারে বসে আছে এক জোড়া উল-কাঁটা।
লম্বা কাঠের উল-কাঁটার মসৃণ গা থেকে বার বার স্লিপ করে পড়ে
যাচ্ছে মোটা ফ্রেমের চশমা। উলটো চেয়ারে বসে একটি কুরুশ কাঁটা। তার টিকালো নাক, শেষে
এসে সামান্য বেঁকে গেছে। তার উপর সেট করা লাল বাহারি ফ্রেমের চশমা। দু’জনে খুব মন
দিয়ে বুনে চলেছে বিভিন্ন নকশা। একটু গুলিয়ে গেলেই টেবিলের বই খুলে মিলিয়ে নিচ্ছে ডিজাইনের
হিসাব। এই বসার ঘর পেরিয়ে বাইরে একটা লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে ছাদ থেকে ঝুলছে
রঙ বেরঙের প্যাটার্নের উল। যার বেশিরভাগ রঙের কোনও নাম নেই। কারণ, সেইসব
রঙ মানুষ কোনোদিন দেখেনি।
এই বাড়িতে কেউ কথা বলে না। সারাদিন উল বোনার
শব্দ কেবল। আর মাঝে মাঝেই ডোরবেল বেজে ওঠে। হাতের কাজ ফেলে উল-কাঁটা
বা কুরুশ-কাঁটা দরজা খুলে বুঝে নেয় কার কী সমস্যা। কেউ সমস্যায় পড়লেই
এই বাড়ির দরজার বেল বেজে ওঠে। যেমন,
তোয়ার ট্রাইসাইকেল-এর
ঘন্টি, মেঘের কানবাবুর পেটে বুচু, সৌম্যর
‘হেল্প’। সমস্যা
বুঝে তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে বারান্দা থেকে উল নিয়ে আসে উল-কাঁটা
আর কুরুশ-কাঁটা। এক এক সমস্যার এক এক রঙ। নতুন প্যাটার্ন। সেইসব
মাথায় রেখে ডিজাইন বুঝে বুনতে বসে কাঁটারা। যত বোনে তত তাড়াতাড়ি সমাধান হয়
সমস্যার। এই পাহাড়ে ওঠার কোনও রাস্তা নেই। এই বাড়িতে আসার কোনও রাস্তা নেই। কারণ, এই
বাড়ি থেকে সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সব পথ। এই বাড়ির চিমনি থেকে ওঠে রঙিন রামধনু। যার সব
রঙের নাম দেওয়া হয়নি এখনও, কারণ মানুষ এখনও সব রঙ
চিনতেই শেখেনি।
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
চমৎকার .… ভারি সুন্দর
ReplyDeleteMegh r tar kanbabu vison swt.... 😊
ReplyDeleteআহ ! অপূর্ব
ReplyDelete