ভূতুড়ে ওভারব্রিজ
রম্যাণী গোস্বামী
(১)
অনেকদিন হয়ে গেল অভি আর মৌলানিতে
বেড়াতে যায় না। অভির প্রাণটা হাঁসফাঁস করতে থাকে সেই উন্মুক্ত পরিবেশে গিয়ে বুক
ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্যে। কিন্তু উপায় নেই। মাত্র ক্লাস এইটেই যা পড়ার চাপ! কলকাতার
মডার্ন অ্যাকাডেমির ছাত্র অভি পড়ার বইয়ের চাইতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ গল্পের বইতে। ওদের
বাড়ি ঢাকুরিয়া কালীবাড়ির উলটোদিকে। কাছেই
স্কুল। ঠিকঠাক স্পিডে চালালে সাইকেলে করে যেতে লাগা উচিত দশ মিনিট। ম্যাক্সিমাম
বারো। অভির সেখানে লেগে যায় পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
কেন বল তো?
রোজ স্কুলে বেরোনোর সময়
ব্যাগে ক্লাসের বইখাতার সঙ্গে সে ঠুসে ঠুসে ঢোকায় অন্তত দু’খানা গল্পের বই। বাড়ি
থেকে বেরিয়ে পাঁই-পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে সে পৌঁছে যায় চিলড্রেনস পার্কে। খুব
স্বাভাবিক ভাবেই সকাল দশটা সওয়া দশটা নাগাদ পার্ক খোলা থাকে না। তাতে কুছ পরোয়া
নেই। পার্কের পিছনের দিকটায় পাঁচিলের একজায়গায় একটু ভাঙা মতো আছে। সেখান দিয়ে
দিব্যি টপকে ভিতরে ঢুকে আরাম করে পার্কের বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়ে গোগ্রাসে শেষ করে
সে তার প্রিয় বইগুলো। তারপর হঠাৎ হুঁশ ফেরে, আর ছুটতে ছুটতে সকলের শেষে প্রেয়ার
লাইনে পৌঁছয় অভি। এইভাবে লুকিয়ে বই পড়ার কারণ হল, এইটে
ওঠার পর থেকেই ও লক্ষ করছে যে বাড়িতে ওর হাতে গল্পের বই দেখলেই মেজাজ ভয়ঙ্কর খারাপ
হয়ে যাচ্ছে মায়ের।
মামাবাড়ি এ দিক দিয়ে কিন্তু
একটা চমৎকার রিল্যাক্সেশনের জায়গা। একটা দুটো নয়, গোটা ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যাও
গল্পের বই। আরামসে বেছে নাও একটা কামরাঙা বা
লিচু বা আম গাছের পরিষ্কার তলা। তারপর হেলান দিয়ে বসে, চিত বা উপুড় হয়ে শুয়ে অথবা
হামাগুড়ি দিয়ে যেভাবে তোমার খুশি সেভাবে মজে যাও রকমারি চরিত্রদের মাঝে। কেউ খোঁজ নেওয়ার,
বকাবকি করার নেই।
অভির ক্লাসে রজত ওর বেস্ট
ফ্রেন্ড প্লাস নতুন নতুন বইয়ের জোগানদার। রজতের বাড়িতে বইয়ের শখ ওর দাদুর। ওদের টং
ঘরটা পুরো লাইব্রেরি। গতবছর পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার ঠিক আগের দিন অভি’কে
অনেকগুলো বই ধার দিয়েছিল রজত। তবে এমনি এমনি নয়। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ব্যাটাকে
দু-প্লেট ডিমের ঘুগনি, একটা কিং সাইজ মাটন রোল এবং আরও একখানা কেশর পেস্তা
আইসক্রিম খাওয়াতে হয়েছিল। অভি অবশ্য রজতের এই পুরো পেটপুজোটা শুধুই তাকিয়ে তাকিয়ে
দেখছিল না, বলাই বাহুল্য!
এবার শীত পড়তেই অভি উঠেপড়ে
লেগেছে একবার বেরিয়ে পড়ার জন্যে। রজতটাও নেই। ও কাকুর অফিসের বিরাট এক গ্রুপের সঙ্গে
গিয়েছে আন্দামানে বেড়াতে। সুতরাং দু’বেলা উঠতে বসতে ঘ্যানঘ্যান করে মায়ের কানের
পোকা নড়িয়ে দিল সে। সামনেই বড়োদিনের ছুটি। কিন্তু কারোরই নাকি সময়
হবে না। অগত্যা উপায়? কাঁদো কাঁদো মুখে অনেক কাকুতি মিনতির পর একা একাই মামাবাড়ি
যাওয়ার সম্মতি মিলল বাড়ি থেকে। কী করে যে
মিলল সে এক অন্য গল্প! যাই হোক, তৎকালে টিকিটও কাটা হয়ে গেল। অভির
তো বুকের মধ্যে লাবডুব লাবডুব শুরু হয়ে গিয়েছে উত্তেজনায়। দিন সাতেক আগে থেকে মহা
উৎসাহে ব্যাগ গোছানো পর্বও শুরু করেছে।
জামা কাপড় বেশি নেয়নি। নতুন রসদের সন্ধানে তিনবার যাদবপুর
ইউনিভার্সিটি লাগোয়া ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারাও হয়ে গেছে।
ইস! আরও একবার যেতে পারলে কত ভালো হত।
(২)
স্বপ্নটা সত্যি করে এসেই গেল
সেই দিন। মায়ের হাতে তৈরি ফ্রায়েড রাইস, আলুর দম খেয়ে সন্ধেবেলা কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে
চেপে বসল সে। বড়োদিনের ছুটিতে বহু লোকজন বাড়ি আসছে যাচ্ছে অথবা নিছক বেড়াতেই
বেরিয়েছে। গুবলু গুবলু বাচ্চা কাচ্চা আর এত্ত লাগেজ নিয়ে মা বাবা দাদু দিদুন, বড়ো বড়ো
ট্রাঙ্ক হাতে ব্যস্ত মিলিটারিরা, মাথায় বিশাল বিশাল বোঁচকা চাপিয়ে ভেন্ডাররা, কাঁধে ব্যাগ
নিয়ে এক দঙ্গল কলেজের ছাত্র ছাত্রী, রুকস্যাক পিঠে ফরেনার, স-ব মিলিয়ে
শিয়ালদা স্টেশন পুরো জমজমাট। ক্ষণে ক্ষণে মাইকে যান্ত্রিক গলায় অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে
বিভিন্ন দূরপাল্লার ট্রেনের নির্ধারিত সময়ের। গুঁতোগুঁতির
ঠেলায় প্ল্যাটফর্মের কোথাও এক জায়গায় শান্তিমতো দাঁড়ানোর জো নেই। বড্ড বিরক্ত লাগছিল
অভির। ট্রেনে উঠে জায়গা মতো বসে তবে আরাম। ট্রেন ছাড়ার
সময় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু কান্না পেয়ে গিয়েছিল বটে। তবে পরমুহূর্তেই
নিজেকে সামলে নিল সে। ছিঃ, ও না বড়ো হয়ে গিয়েছে?
রাতে একটা ঘটনা ঘটল। উত্তেজনায়
অভির মোটেই ঘুম আসছিল না ট্রেনে। তখন ক’টা বাজে? হুম, দেড়টা-টেরটা হবে। একটু আগেই
পাকুড় ছাড়িয়েছে ট্রেন। অভি মিডল বার্থে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিল। টিমটিম করে নাইট
ল্যাম্প জ্বলছে করিডরের সিলিংয়ে। এসি-র মৃদু
ঘর ঘর আওয়াজ। কামরায় পর্দাগুলো টানা। সবাই ঘুমোচ্ছে। আচমকা মনে হল ঠিক যেন ওর ঘাড়ের
কাছে কেউ একটা শীতল নিশ্বাস ফেলল। চমকে গিয়ে
ওপাশে ফিরতেই দেখতে পেল একটা অল্পবয়সি ছেলের আদল। ওর বার্থের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে
ছেলেটা। এই আবছা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ওর দুটো চোখ। আর কী ফরসা গায়ের রঙ! এই
অন্ধকারেও কেমন যেন সাদাটে। কে রে বাবা!
চোর বা পকেটমার নয়তো? মাথার কাছেই নিজের ব্যাগটা নিয়ে শুয়েছে অভি। সেটা চেপে ধরে
ধড়মড় করে উঠে বসতে বসতেই ছেলেটা দ্রুত চলে গেল করিডোর দিয়ে।
এক লাফে বার্থ থেকে নেমে একটানে
অভি খুলে ফেলল করিডরের শেষের কাচের পাল্লাটা। নাহ,
ওয়াশ বেসিনের সামনেটা খালি। কোথাও কেউ
নেই। শুধু ট্রেনের একদম বাইরের দরজাটা হয়তো হাওয়ায় খুলে গিয়েছে। অদ্ভুত তো?
ভেস্টিবিউল বন্ধ। আর তো যাওয়ার কোন পথ নেই। ছেলেটা পালাল কোথায়? অভি একহাতে টেনে
শক্ত করে বন্ধ করল ভারি লোহার দরজাটাকে। অন্যমনস্ক
হয়ে দুলতে দুলতে ফিরে আসছে কামরার দিকে, হঠাৎ ঘটাং করে একটা আওয়াজ। খুলে গিয়েছে
দরজাটা। বুকটা একটু ঢিবঢিব করে উঠলেও সাহসে ভর করে এগিয়ে গিয়ে মাথাটা ট্রেনের বাইরে
বের করে একবার এদিক ওদিক দেখল ও।
চাঁদের আবছা আলোয় ভিজে থাকা
ধানখেত, মাঠ পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। কনকনে
হাওয়ায় কেঁপে উঠল সমস্ত শরীরটা। তাড়াতাড়ি
ভিতরে ঢুকে কাঁপা হাতে জোরে বন্ধ করল অভি দরজাটা। উলটো
দিকে ঘুরেছে ফিরবে বলে, আবার সেই আওয়াজ। এবার গোটা শরীরটা ভয়ে শিরশির করে উঠল
অভির। কোনওরকমে পিছনে তাকিয়ে দেখল দরজাটা আবার হাট করে খোলা। আর দরজার ঠিক পাদানির
কাছে বসে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেই সাদা মতো ছেলেটা।
অভির গলা চিরে একটা আর্তনাদ
বেরিয়ে এল।
(৩)
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ট্রেন
নিউ মাল জংশনে ঢুকছে। উফ্, কী বিশ্রী হিজিবিজি স্বপ্ন! জানালা
দিয়ে বাইরে তাকিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল অভির। পাঁচিল ঘেরা
ছিমছাম নিরিবিলি স্টেশন চত্বর। স্টেশনের বাউন্ডারির ওপাশে ঘন শাল বনের আদল। বেশ
শীত। বাতানুকূল ট্রেনের কামরায় বুঝতে পারা যায়নি। ট্রেন থেকে নামতেই যেন হাড় ভেদ
করে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গিয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল ওর সমস্ত শরীরে। গলাবন্ধ
পুলওভারের উপরে তড়িঘড়ি হাতে ধরে থাকা জ্যাকেটটা পরে নিল সে। এমন সময় মেজমামা ওকে
দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। এই ঠাণ্ডায় বেশি লোক নেই প্ল্যাটফর্মে।
অভির হাতে মাটির খুরিতে গরম চা ধরিয়ে দিয়ে বলল মেজমামা, “তারপর অভিবাবু, রাস্তায়
ভয়-টয় পাওনি তো?”
একদম না। খামোখা ভয় পেতে যাব
কেন? - হেসে বলতে গিয়েই কথাটা গিলে ফেলল অভি।
নিউ মাল জংশন থেকে প্রায় এক
কিলোমিটার দূরে মৌলানি গ্রাম। তার পরেও হাফ কিলোমিটার মতো ভ্যানে চেপে এবড়োখেবড়ো
রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে মামাবাড়ি পৌঁছতেই তাকে নিয়ে একেবারে হইচই পড়ে গেল।
দুপুরে ভুরিভোজটা ভালোই হল। অল্প একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। গোটা বাড়িটা
চুপচাপ। ভাই বোনেরা ঘুমোচ্ছে তাদের মায়েদের
কাছে। মামারা দোকানে।
মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে
দিব্যি ফুরফুরে হয়ে গেল মেজাজটা। চারিদিক সবুজে সবুজ। পুকুরগুলোয় সার বেঁধে সাঁতার
কাটছে হাঁসেরা। কী পল্যুশন ফ্রি বাতাস। ধোঁয়া নেই, ধুলো নেই। আহ, এই জন্যেই তো আসা। ডান
দিকে বোধহয় বাজার। আশপাশ দিয়ে ছুটে চলেছে সাইকেল, ভ্যান। অভি সযত্নে ওদিকটা এড়িয়ে
গিয়ে সোজা হাঁটা দিল উত্তর দিকে। শীতের দুপুর। মিঠে রোদে একটা অপূর্ব আমেজ আছে। সামনে
এক বিশাল বটগাছ ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়ানো। সেটা
পেরিয়ে গেলে একটা উঁচু টিলা মতো রয়েছে। সেখানে উঠলে
দেখা যাচ্ছে দিঘিটা।
বেশ বড়ো দিঘি। পরিষ্কার টলটলে
জল। মাঝে মাঝে কচুরিপানা ভাসছে। ফিকে
বেগুনি রঙের ফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে। চমৎকার নির্জন জায়গা। কেউ নেই আশেপাশে। গ্র্যান্ড!
কাল থেকে এখানেই বসে প্রাণভরে বই পড়বে ও। খুশি হয়ে মাথা নেড়ে পকেট হাতড়ায় অভি। এই
যাহ্, মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে আসলে একটু ফটো তোলা যেত। একদৃষ্টে
দিঘিটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই অভির একটা প্রবল ইচ্ছে হল দিঘির জলে নামার।
বড্ড অদ্ভুত ইচ্ছে। যেন ওকে টানছে সামনের জলাশয়টা। হাতছানি
দিয়ে ডেকে ডেকে বলছে তার বুকে গা ভাসিয়ে দিতে। নামবে? নেমে দেখা যাক না? কী হবে?
বেহুঁশের মতো অভি এক পা এক পা
করে নেমে গেল জলে। প্রথমে হাঁটু জল, কোমর জল, তারপর গলা জল। কী আরাম যে লাগছে! ধীরে
ধীরে অভি আরও এগিয়ে যেতে থাকল। ওর জুতো
পরা পা দুটো ডুবে গেল কাঁদা আর পাঁকে।
একটু পরেই অভির ভেজা দেহটা ভারসাম্য
হারিয়ে ঝপাং করে পড়ে গেল জলে এবং তলিয়ে যেতে থাকল গভীরে। অন্য কেউ এ জায়গায় থাকলে
কী হত বলা মুশকিল কিন্তু অভি নিয়মিত সাঁতার কাটে ঢাকুরিয়া লেকে। মুহূর্তের মধ্যে
হুঁশ ফিরল ওর আর হাত পা নেড়ে চূড়ান্ত দক্ষতায় ও আপ্রাণ ডুব সাঁতার দিতে দিতে উপরের
দিকে নিজের শরীরটাকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
ঠিক এইসময় অভি দেখতে পেল তাকে।
দিঘির গভীর জলের তলায় ঘন ছায়া ছায়া অন্ধকারে পুরু শ্যাওলার স্তরের উপর হাঁটু ভাঁজ
করে বসে আছে ছেলেটা। দুটো হাত হাঁটুর উপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা। খালি গা, পরনে কালো
হাফ প্যান্ট। সেই ফ্যাকাসে সাদা গাত্রবর্ণ। শুধু চোখ দুটোর নিচে গাঢ় কালির পোঁচ।
ঠায় তাকিয়ে আছে অভির দিকে। সেই দুটো চোখের তীব্র দৃষ্টি অভিকে সম্মোহিত করে তুলছে
ক্রমশ। ওর পা দুটো যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠছে। দম ফুরিয়ে আসছে একটু একটু করে।
একটু বাতাসের জন্যে হাঁকুপাঁকু করছে শরীরের প্রতিটি কোষ।
একটা ঝাঁকুনি খেয়েই খেয়াল হল
যে এতক্ষণ দিঘির পাড়েই বসে আছে সে। শুকনো পুরো শরীরটা। তার মানে আদৌ জলে নামেইনি। উফ,
এমন স্বপ্ন দেখে কেউ? এখনও মনে হচ্ছে যেন স-ব সত্যি। কী যে হচ্ছে কাল থেকে! ভীষণ
জোরে শব্দ করছে হৃদপিণ্ডটা! ধাতস্ত হয়ে চারপাশে তাকাল অভি। কখন যেন বিকেল ফুরিয়ে
গিয়েছে। আবছা আঁধার নেমেছে। ঘাটে বসে দম
নিতে নিতে অভি এমন অবাক হয়ে গেল যে একটু আগের ভয়টা পর্যন্ত চলে গেল ওর।
আরে! এটা কোন জায়গা? সেই
বটগাছটাই বা গেল কোথায়? দিঘির ধারেই একটা ছোটো নিরিবিলি স্টেশন! ওদিকের
প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেনও দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের কেটলি নিয়ে চা-অলারা দৌড়োদৌড়ি করছে সেখানে। বড়ো
বড়ো দুটো ভেপার ল্যাম্প জ্বলছে। কুয়াশায় হলদে আলোগুলো কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।
মামাবাড়ির এত কাছে কোনও স্টেশন আছে সেটা তো কস্মিনকালেও শোনেনি সে। একটু হেঁটেই
ওপাশের প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার পথ হিসেবে সে দেখতে পেল ওভারব্রিজটা। অন্যমনস্ক অভি
উঠে এল ওভারব্রিজে।
বাহ, চমৎকার সিনিক বিউটি তো!
দিব্যি লাগল অভির। উপর থেকে দেখা যাচ্ছে নিচের মানুষজন, রেললাইন। আর কেউ নেই
আশেপাশে। ও এক্কেবারে একা। চারপাশে যেদিকে তাকাও খালি সারি সারি গাছ আর গাছ আলো
আঁধারে ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও হাওয়ার
দাপট এখানে অনেক বেশি। হাওয়ায় ভেসে ভেসে আসছে সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা। প্রবল
ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপার মধ্যে কেমন একটা মজা আছে না? হাঁ করে মুখ থেকে বাতাস বের
করলে মনে হচ্ছে ঠিক যেন বাবার মতো সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে ও।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অভির
চারপাশ ঢেকে গেল ছেঁড়া ছেঁড়া চাদরের মতো এক হিমশীতল জলীয় আবরণে। ধীরে ধীরে কেমন
চুপচাপ থমথমে হয়ে গেল গোটা এলাকাটা। নিচে চা-অলাদের আওয়াজ, দূরে পাখপাখালির কোলাহল
সব মিলিয়ে গিয়ে একটা কঠিন নিস্তব্ধতা গ্রাস করল সমগ্র আবহটাকে। অভি প্রথমে খেয়াল
করেনি ব্যাপারটা। খেয়াল হল কানের কাছে ঝিঁঝিঁর ডাকে। একটানা তীব্র একঘেয়ে সেই
ঝিঁঝিঁ রব। ধীরে ধীরে বাড়ছে তার তীক্ষ্ণতা। মনে
হচ্ছে কান ফেটে যাবে বুঝি সেই আওয়াজে। চমকে চারিদিকে তাকাল অভি। কুয়াশা
ভেদ করে যেটুকু দৃশ্যগোচর হল তাতে মনে হল যে গোটা স্টেশন চত্বরটা ফাঁকা। একটা
মানুষজন কিচ্ছু নেই। ঠিক যেন একটা থমথমে মৃত্যুপুরী। একমাত্র
অভি সেখানে জীবিত প্রাণী। সবচাইতে আশ্চর্য ব্যাপার যেটা সেটা হল
আস্ত ট্রেনখানাও সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গিয়েছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। সে
কী? ট্রেনের হর্ন শুনতে পেল না তো?
একটু থতোমতো খেয়ে অভি হাতড়ে
হাতড়ে এগোতে লাগল ওভারব্রিজে ওঠার সিঁড়ির মুখ লক্ষ করে। বেশিদূরে তো ছিল না। এই তো
দু’পা গেলেই। কোথায়? কোথায়? পাগলের মতো ছুটতে লাগল অভি। আতঙ্কে
তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না একফোঁটা। ঘামে ভিজে গিয়েছে শরীর। উফ, শেষ নেই কেন
এর? লম্বা টানা ওভারব্রিজটা ফুরোবে কখন? কতক্ষণ ধরে দৌড়ে চলেছে সে? ওভারব্রিজটা
ঘুরে ঘুরে ঠিক যেন একটা বৃত্তাকার টানেল তৈরি করেছে! একই রাস্তায় বারবার ঘুরেই
যাচ্ছে অভি। নামার কোনও পথ নেই। আর
পারছে না সে। হাঁফ ধরে গেছে একেবারে।
এমন সময় তার কানে এল একটা
গানের সুর। কে গাইছে এখানে গান? নাহ, গান তো নয়।
কেমন একটা সুর করে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে কেউ। ঝিঁঝিঁর ডাকটা থেমে গেল আচমকা।
কান্নার স্বরটা গ্রাস করছে এখন ওর সমস্ত বোধশক্তি। ঠকঠক
করে কাঁপছে অভির পুরো শরীর। কিন্তু কী অদম্য কৌতূহল, কী অপ্রতিরোধ্য সেই স্বরের
আকর্ষণ! ওভারব্রিজের রেলিং ধরে কোনওমতে নিজের শরীরটার ভারসাম্য রেখে একপ্রকার ঘষতে
ঘষতে অভি এগিয়ে চলল সেই কান্নার আওয়াজটা লক্ষ করে। হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছে এবার। উলটোদিকের
রেলিংয়ের উপর দুই পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে সে। সেই ছেলেটা! ওরই বয়সি হবে।
নাহ, পুরোপুরি ওর মতো নয়। এতক্ষণে
ভালো করে তাকাল অভি ছেলেটার দিকে। ওর শরীরটা যেন ঘষা কাচের মতো স্বচ্ছ এবং
অস্থায়ী। মুখ-চোখ-হাত-পায়ের আদলগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো কাচের মতো বারবার যেন ভাঙছে আর
গড়ছে। অভির আর নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওই
অবয়বটির দিকে। হাঁ করে কাঁদছে ছেলেটা। কান্নার
আওয়াজটা তীব্র হতে হতে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে এখন। অভির
মনে হল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আর তখনই রেলিং ভেঙে ছেলেটা সবসুদ্ধ পড়ে গেল নিচে!
সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল ট্রেনের হর্নের একটা তীব্র স্বর।
(৪)
সম্বিৎ যখন ফিরল, অভি নিজেকে আবিষ্কার
করল সেই বটগাছের সিমেন্টের বেদির উপরে শুয়ে থাকা অবস্থায়। মুখ
ঘাড় জলে চুপচুপে ভেজা। চারিদিকে ঝুঁকে পড়া কিছু লোকের মাথা। তার মধ্যে মেজমামার
গভীর উদ্বেগমাখা মুখটাও দেখতে পেল সে। ফুলস্লিভ শার্টে এই শীতে শরীরটা ঠকঠক করে
কেঁপে উঠতেই সবাই বলে উঠল “জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরেছে।”
“কী হয়েছিল ঠিক করে বল তো
এবার,” মেজমামার গলা গম্ভীর, “পাগলের মতো গরু খোঁজা করে খুঁজছি তোমাকে বিকেল থেকে সবাই
মিলে। এই জায়গা দিয়েও কতবার গেলাম আসলাম। তুমি
বেপাত্তা! এখন দোকানের কর্মচারীটা গিয়ে খবর দিল তুমি এখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছ!
আর বিড়বিড় করে কী বলছ এসব? কোন ছেলে? কীসের অ্যাকসিডেন্ট? আমরা তো কিছুই বুঝতে
পারছি না। কোথায় ওভারব্রিজ? কে পড়ে গেছে?”
মামার পাশের বুড়োমতো লোকটা
এবার বলে উঠল, “আমি তো আগেই বলেছি মাধব, এ হচ্ছে সারাদিন ধরে টিভিতে সিনেমা দেখার
ফল। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যা হয়েছে না! জেগে জেগেও কত কিছু যে দেখে ফেলছে!”
মেজমামা ওকে বাধা দিয়ে বলল,
“আরে না না বিশুদা, ওর নেশা গল্পের বই। টিভি সেরকম
দেখেই না।”
“ওই একই হল,” ভদ্রলোক তবু হার
মানবে না, “কলকাতায় থাকা হয় ভাগনের বললে তো? গতবছর আগস্ট মাস নাগাদ নাগেরবাজার
ফ্লাইওভারের উপর একটা ভূত দেখার গুজব রটেছিল না? একজন অল্পবয়সি বাইক আরোহী ওই
ফ্লাইওভারের উপর রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পরপরই নিশুত রাতে নাকি একটা মেল ফিগারকে
দেখা যেত মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে সমস্ত গাড়িগুলোকে আটকানোর চেষ্টা করতে। কাছে
গেলেই অদৃশ্য! ওই এলাকার লোকজন ভয়ে দিনের বেলাতেও পারলে এড়িয়ে চলত ফ্লাইওভারটা।
পেপার-টেপারে খুব লেখালেখি হয়েছিল এটা নিয়ে। আমার এক দূর
সম্পর্কের শালা আবার প্যারানরমাল রিসার্চ সোসাইটির সদস্য। তা ওরা টিমশুদ্ধ গিয়ে
ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, মোশন ডিটেক্টার আরও কী কী সব দিয়ে অনেক পরীক্ষা-টরিক্ষা
করে দেখল। কিস্যু না। ফুঁ, ভূত দেখা কি এতই সোজা ভাইটি? ওই খবরটাই তোমার ভাগনে
পড়েছিল কখনও পেপারে, মাথায় গেঁথে গিয়েছে। ওভারব্রিজ কি আর সাধে বলছে? এই অঞ্চলে
আবার কোথায় আছে হে ওভারব্রিজ?”
অভি কিছু না বলে অন্যমনস্কভাবে
তাকিয়ে থাকল নিঝুম অন্ধকারের দিকে। পাতলা
কুয়াশার চাদরে ডুবে আছে চরাচর। অভির মনের
মধ্যেও একটা ধোঁয়াশা। সবাই মিলে এখন হাঁটা শুরু করেছে মামাবাড়ির উদ্দেশে। লণ্ঠনের আলো,
অনেক লোকজনের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে কুহেলির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে একটু আগে
দেখা ওভারব্রিজটা। ভুরু কুঁচকে গভীরভাবে ভাবছে সে কিছু। কী
যেন একটা ছিল ছেলেটার কোলের উপর রাখা। উঁহু, মনে
পড়ছে না, কিছুতেই মনে পড়ছে না...।
ইতিমধ্যে লোকজনের মধ্যে শুরু
হয়ে গিয়েছে নানান অলৌকিক ঘটনার আলোচনা। হঠাৎ মোটা ফ্রেমের কালো চশমা পরা একজন
ভদ্রলোক একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন, “যদি অনুমতি পাই, একটা কথা বলতে পারি
কি? আমি গজলডোবা হাইস্কুলে পড়াই। এখানে এসেছি এক আত্মীয়ের বাড়িতে। প্রায় দশ-বারো
বছর আগেকার কথা। আমার এক ক্লাস নাইনের ছাত্র রোজ হাসিমারা থেকে লোকাল ট্রেনে
যাতায়াত করে স্কুলে যেত। বাড়ির ফিনানশিয়াল অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু গল্পের বইয়ের খুব
শখ ছিল তার জানেন? বই পেলে নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেত। তখন হাসিমারা স্টেশনে সদ্য
দুটো প্ল্যাটফর্মের মাঝে ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলছে। সেদিন ছিল স্কুলের প্রাইজ
ডিস্ট্রিবিউশন ফাংশন। বাড়ি ফেরার পথে ট্রেন লেট ছিল হয়তো, আচমকা কী শখ হল, ওই
ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে বসে বই পড়তে পড়তে...। রেলিংটা পলকা ছিল।
ভার সামলাতে না পেরে সোজা নিচে। ডাউন লোকালটা আবার তখনই আসছিল।” অতল ভাবনায় তলিয়ে
গেলেন ভদ্রলোক, “কিন্তু এই ছেলেটির পক্ষে তো জানা সম্ভব নয় অতদিন আগের সেই ঘটনার
কথা! খুব মেধাবী ছাত্র ছিল জানেন? ওর নামটা ছিল ভারি সুন্দর। এখনও
মনে আছে আমার নামটা...।”
মামাবাড়ির উঠোনের ষাট
পাওয়ারের আলোটা দেখা যাচ্ছে এতক্ষণে। অভি এখনও ফেরেনি স্বাভাবিক ছন্দে। মামিরা,
ভাই বোনেরা ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে এদিকে। বড়োমামা ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে
গিয়ে উঠোনে রাখা চেয়ারে বসাল। মামি অভিকে
ঢেকে দিল মোটা চাদরে। ওদের সঙ্গে যারা এসেছিল এতটা পথ, তারা ফিরে যাচ্ছে এবার। ধীরে
ধীরে লণ্ঠনের আলোটা বাঁশবনের ভিতর দিয়ে ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেল।
ঠিক এমন সময় হুড়মুড় করে বিস্মৃতির
আড়াল ঠেলে অভির মনে পড়ে গেল কিছু একটা। চলে
যাওয়া ভিড়টার উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল অভি, “কা-কু, ওই
ছেলেটার নামটা কী ছিল? একবার বলুন না...।”
কেউ নেই। ওরা চলে গেছে।
পাগলের মতো ছুটে ঘরের ভিতর গিয়ে অভি নিয়ে এল ওর ব্যাগটা। ব্যাগপ্যাকের চেন খুলে
ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বার করছে বইগুলো। একটা বইয়ের মলাটের উপরে এসে আটকে গেল চোখ। হ্যাঁ,
ঠিকই ধরেছে। এই তো গাঢ় বাদামির উপর সোনালি রঙে আঁকা একটা অশ্বারোহীর ছবি। কেনার পর
সবেমাত্র দুটো পাতাই পড়া হয়েছে অভির। দারুণ এগোচ্ছে গল্পটা। এই বইটাই দেখেছিল না
আজ ছেলেটার কোলে? কাঁপা কাঁপা হাতে এবার অভি উলটোল সেদিন ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের
দোকান থেকে অসম্ভব সস্তায় পেয়ে যাওয়া রহস্য-রোমাঞ্চ বইটির মলাট। প্রায় মুছে যাওয়া
নীল কালিতে লেখা রয়েছে একটি নাম এবং নামটি সত্যিই সুন্দর – অনার্য রায়। আর
তার ঠিক নিচেই লেখা আছে – নবম থেকে দশম শ্রেণীতে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির
পুরস্কার, গজলডোবা হাই স্কুল।
কলকাতায় ফিরে আসার আগে অভি
একদিন মেজোমামার সঙ্গে গিয়েছিল হাসিমারা স্টেশনে। সেই
নিঝুম সন্ধ্যায় আর একটিও লোক ছিল না ফ্লাইওভারের উপর। অভি
একা একাই গুটিগুটি পায়ে সেখানে গিয়ে ব্যাগ থেকে অনার্য নামের ছেলেটির প্রাইজ পাওয়া
বইখানা বের করে বাতাসে রেখে দিয়েছিল আলতো করে।
চলে আসতে আসতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, অদ্ভুত ব্যাপার! কোনওরকম ব্যালেন্স ছাড়াই যেন
শূন্যে ভেসে রয়েছে বইটি!
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
দারুন গল্পটা
ReplyDeleteথ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু
DeleteBhoy peye gechilam besh koyek jaigai..
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteগল্পটা খুব সুন্দর, এখন কাঞ্চনকন্যায় শুয়েই গল্পটা পড়লাম,ভীষণ ভালো লাগল। আমার বাড়ি মালবাজার, তাই আরো ভালো লাগল। তবে মৌলানী কিন্তু নিউমাল থেকে ৪০ কিমি দূরে। মৌলানীর কাছে ময়নাগুড়ি স্টেশন, বা জলপাইগুড়ি। আর হাসিমারা থেকে গজলডোবা বহু দূর। গজলডোবায় স্টেশন নেই। ওদলাবাড়ি স্টেশনে নেমে ভ্যানে, টোটোতে বা অটোতে গজল ডোবা যেতে হয়। জায়গা গুলো চিনি বলেই বললাম।
ReplyDeleteঠিক বলেছেন আপনি। পরবর্তীতে এই ধরনের ভুল আর হবে না। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
Deleteন্যারেশন খুব স্মার্ট! সেটা সম্ভব হয়েছে মেদহীন গদ্যের কল্যাণে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
DeleteBhalo laglo...bachha boro sobar i bhalo lagbe...
ReplyDeleteফিডব্যাক পেয়ে খুব ভাল লাগল
Deleteসুন্দর গল্প
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deletekhub e bhalo laglo
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteগল্পটা চমৎকার হয়েছে। আরও এমন লেখার জন্য অনেকোনেক শুভেচ্ছা রইল।
ReplyDeleteখুব খুশি হলাম ঋজুদা
Delete