গল্পের ম্যাজিক:: পূর্বাভাস - দেবব্রত দাশ


পূর্বাভাস
দেবব্রত দাশ


আগে কোনোদিন কখনও এমনটা হয়নি, মানে শৈশব-কৈশোরের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যযৌবনে প্রবেশ করেও এরকম অনুভূতি হয়নি দিগন্তের, অথচ গতবছর তিরিশের কোঠায় প্রবেশ করে হঠাৎ মনের আকাশে উদিত হওয়া দৃশ্যাবলী এবং তার পরেই বাস্তবে সে সব সত্যি হয়ে যাওয়ার কোনও ব্যাখ্যাই নেই তার কাছে।
ছোটোবেলা থেকেই দিগন্ত সত্যজিৎ রায়ের গল্পের ডাই-হার্ড ফ্যান। একটাও বাদ যায়নি। ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর সিরিজ গুলে খেয়েছে একেবারে। শুধু তাই নয়, আজ এই বয়সেও সমান উৎসাহী। শৈশব-কৈশোরে পড়া গপ্পের ঝাঁপি খুলে আজও অবসরে সে প্রবেশ করে সোনার কেল্লায়... কৈলাসে কেলেঙ্কারির পটভূমিতে কিংবা বোম্বাইয়ের বোম্বেটের শিবাজী-ক্যাসল-এ...। বারবার পড়া — সহস্রবার পড়া গল্পগুলো আজও একইভাবে তাকে আলোড়িত করে তোলে।
সত্যজিতের গল্পেই তার প্রথম পরিচয় হয় ‘টেলিপ্যাথি শব্দটার সঙ্গে। ‘প্যারা সাইকোলজি মানে ‘আধা মনস্তত্ত্ব শৈশবে-কৈশোরে দিগন্তের মনে দারুণ ছাপ ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পৌঁছে যুক্তির বাতাবরণে বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি সে। আসলে, টেলিপ্যাথি-নির্ভর গল্প পড়তে যতই ভালো লাগুক, মনের গভীরে টেলিপ্যাথির অস্তিত্ব নিয়ে তার সন্দেহ থেকেই গেছে আর এখন নিজেই যখন সে টেলিপ্যাথির খপ্পরে পড়েছে, তখন একেবারে টালমাটাল অবস্থা তার!
পরিবেশ-বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিলাভের পরেই দিগন্তের গবেষণার আঙিনায় প্রবেশ, গবেষণা শেষে ডক্টরেট-প্রাপ্তি, আর এখন সে করছে পোস্ট-ডক্টরেট রিসার্চ নানান ধরনের সাইক্লোন নিয়ে কাজ লক্ষ্য — সঠিক সময়ে সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা
ইতিমধ্যেই দেশবিদেশের নামী জার্নালগুলিতে দিগন্ত বোসের গবেষণালব্ধ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে বিশ্বময়। জ্ঞানীগুণী-মহল থেকে নানান আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান করার আমন্ত্রণ পাচ্ছে সে অহরহ।
দিগন্তের উদ্ভাবিত পদ্ধতি অবলম্বন করে কৃত্রিম উপগ্রহ-চিত্রের ঠিকঠাক বিশ্লেষণ সম্ভব হয়েছে এবং ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, সাবট্রপিক্যাল সাইক্লোন, সাইক্লোনিক স্টর্ম, এমনকী হারিকেন-টাইফুনেরও সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে আর তার ফলে প্রাণ বেঁচেছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের। এখন যে বিশেষ ধরনের ঝড় নিয়ে কাজ করছে, সেই ভয়ঙ্কর মোচড়-উৎপন্নকারী টর্নেডো-ফানেল নিয়েও সাফল্যের দোরগোড়ায় যখন পৌঁছে গেছে দিগন্ত, তখন একেবারে আচমকাই অদ্ভুত... অত্যাশ্চর্যভাবে বিপন্ন হল সে। ক্ষণে-বিক্ষণে টর্নেডোর মোচড় তার মনোজগতে। কোনও ব্যাখ্যা সে খুঁজে পাচ্ছে না। কেমন করে আর কেনই বা সে দেখতে পাচ্ছে তার দৃষ্টির আড়ালে বহু দূরের কোনও জায়গায় কী কী ঘটছে... ঘটে চলেছে কিংবা ঘটবে -- দেখছে আগেভাগে একেবারে ভিডিও-ক্লিপিং যেন! আশ্চর্য! গল্পে পড়া ‘টেলিপ্যাথি-র উৎস এখন তার মগজেন্দ্রিয়টি!
এই তো -- একমাস আগের ঘটনা... সকালে ঘুম থেকে উঠে টুথব্রাশে সবে পেস্ট লাগিয়েছে, দিগন্ত দেখতে পেল -- তাদের দেশের বাড়িতে মা নীহারকণা অসহ্য যন্ত্রণায় নুয়ে পড়ে গোঙাচ্ছেন আর দিগন্তের ছোটোভাই হেমন্ত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজে হাত লাগিয়ে স্ট্রেচার-বহনকারীকে সাহায্য করছে
ফোনে যখন হেমন্তের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল দিগন্ত, তখন হেমন্ত কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তারপর বাড়ি গিয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে অসুস্থ মাকে সুস্থ করে ঘরে ফিরিয়ে এনে তবেই দিগন্ত আবার এসেছে কলকাতায়।
সেই থেকে আতঙ্কে কাটছে প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত তার... এই কী দেখে ফেলবে -- কী অঘটনের দৃশ্য ভেসে উঠবে হঠাৎ তার চোখের সামনে! এরকম চলতে থাকলে গবেষণার কাজ তো ডকে উঠবেই। অবশ্য, ভালো কিছু এবং ভালো বা মন্দের বাইরের কিছু ঘটনার দৃশ্যও দিগন্ত গত কয়েকদিনে দেখেছে, যেমন -- বন্ধু-প্রফেসার শুভঙ্কর তার ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রায় চলে এসেছে তার গবেষণাগারের দরজায় এবং সত্যি সত্যিই পরমুহূর্তে বেজে উঠেছে ডোরবেল, দরজা খুলতেই সামনে শুভঙ্কর।
যে টেলিপ্যাথির গল্প দিগন্ত গোগ্রাসে গিলত একসময়, এখন অজান্তেই নিজে সেই ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠার পর থেকে তার জীবন একেবারে দুর্বিষহ। আসলে, খারাপ কিছু দর্শনের আশঙ্কাই তাকে পৌঁছে দিয়েছে উদ্বেগের চরম সীমায়।


সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল টেলিপ্যাথি-বিহীন অবস্থায়। তারপর হঠাৎই একদিন আবার গত মাসের মতো আশ্চর্য সব দৃশ্যাবলী চোখের সামনে একের পর এক। ছুটির দিনের দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় গড়িয়ে নিতে গিয়ে হয়তো বা চোখ লেগে গিয়ে থাকবে দিগন্তের... আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে প্রথমে মৌমাছির গুনগুন শব্দের মতন শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে, ঘরের বাইরে যেন হানা দিয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে খুদে পতঙ্গবাহিনী। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল -- না, গুনগুন বা ভনভন তো নয়, যেন অশ্বের হ্রেষাধ্বনি... না না -- তাও নয়, দুমদাম শব্দ হচ্ছে চারপাশে, না কি মিছিলনগরী কলকাতার রাজপথে অসংখ্য মানুষের হইচই-চিৎকার-কলরব? তারপরেই দর্শনেন্দ্রিয়ে প্রবল প্রতিঘাত... চোখের সামনে ভেসে উঠল মালতীপুরের বাড়ি... তার মা নীহারকণা ছুটে গিয়ে খোলা দরজার পাল্লা বন্ধের চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পরমুহূর্তেই ঘুরপাক খেতে খেতে আকাশে উঠে উড়ে যাচ্ছে খড়কুটোর মতন... চোখ বন্ধ করেও রেহাই পায় না দিগন্ত। দেখতে পায়, আরও তিনটে শরীর পাখির মতো আকাশে উড়ছে এবং কী আশ্চর্য! আঁতকে ওঠে সে। তাদের মধ্যে একজন তার ছোটোভাই হেমন্ত। অন্য দু'জন ততক্ষণে ভেসে চলে গেছে দৃষ্টি-সীমার বাইরে। কিন্তু হেমন্ত বিপুল বেগে নেমে আসছে নিচে। সে অসহায় দৃষ্টি মেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু, কী-ই বা করার আছে তার! ভয়ঙ্কর টর্নেডো তো এমনই। ধানখেত থেকে মানুষকে, রাস্তা থেকে মোটরগাড়ি... এমনকী বাসকেও উড়িয়ে নিয়ে গেছে কত জায়গায় কত কত বার!
ঝুপ করে শব্দ ভেসে এল দিগন্তের কানে। দিগন্ত দেখল, হেমন্ত পড়েছে গ্রামের কমলদিঘির জলে... ব্যস, তার পরেই চোখের সামনে থেকে সব উধাও! কোনও জাদুমন্ত্র-বলে সে ফিরে এল তার আগের অবস্থানে, মানে নিজের ঘরের বিছানায়। মাথার কাছের খোলা জানালা দিয়ে ফাল্গুনের মৃদুমন্দ বাতাস মিঠে পরশ বুলিয়ে গেল চোখেমুখে। কিন্তু সে পরশে ঠাণ্ডা হবে কেমন করে সে? নিশ্চয়ই এতক্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে তাদের মালতীপুর-গ্রাম। টেলিপ্যাথি এখন দিগন্তের কাছে অতি নির্ভরযোগ্য... কিন্তু ভয়ঙ্কর এক তথ্য-ভাণ্ডার!
দ্রুত বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা মোবাইল হাতে নিয়ে মার নাম্বার পুট করল সে। কিন্তু বারবার ‘বিপ বিপ শব্দ হতে হতে শেষটায় যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর সরব হয়ে জানাল -- আপনি যে নাম্বারে যোগাযোগ করতে চাইছেন, সেটা এই মুহূর্তে হয় ‘সুইচড অফ, না হয় রয়েছে পরিষেবা-সীমানার বাইরে।
অস্থির অস্থির করতে থাকে দিগন্তের মন, মোবাইল রেখে দিয়ে বিছানায় ফিরে এসে বসে সে আর ঠিক তখনই বেজে ওঠে ডোরবেল।
দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধু প্রফেসর শুভঙ্কর, “কী ব্যাপার! এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে দিগন্ত? শরীর খারাপ? নাকি তোর দিবানিদ্রায় বিঘ্ন ঘটালাম আমি!”
দিবানিদ্রা! বিকেল সাড়ে চারটেয়!” পালটা বিস্ময় প্রকাশ করে দিগন্ত, “আমি সাধারণত দিনে ঘুমোই না রে শুভঙ্কর, তবে আজ শুয়ে গড়িয়ে নিতে গিয়ে হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে চোখ লেগে গিয়ে থাকবে!”
না -- কেমন যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তোকে, তাই অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছি একসঙ্গে!”
সে ঠিক আছে,” জবাবে দিগন্ত বলে, “আরে বোস তুই আগে, না কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলবি!”
সোফায় বসে শুভঙ্কর বলে, “মানিকতলার মোড়ে একটা দোকানে গিয়েছিলাম ওষুধ কিনতে, ফেরার সময় ভাবলাম, তোর আস্তানায় একবার ঢুঁ মেরে যাই... আজ তো ছুটির দিন।”
তা -- বেশ করেছিস শুভঙ্কর, তুই আসায় ভালোই হয়েছে,” বলেই আবার গুটিয়ে যেতে চায় দিগন্ত। তার মনের যা অবস্থা, তাতে কারও কাছে সব কিছু খুলে বলতে পারলে অনেকটাই হালকা হতে পারত, এ কথা বুঝেও কেন যেন সঙ্কোচ এসে থামিয়ে দিচ্ছে তাকে। বন্ধু শুভঙ্করকে বলাই যায়, কিন্তু কী ভাবে নেবে ও...
দোনামনা করে দিগন্ত আর তার ভাবনার মাঝেই প্রশ্ন করে শুভঙ্কর, “কিছু বলবি আমাকে?”
হ্যাঁ -- মানে ইয়ে...” আমতা আমতা করতে থাকে দিগন্ত।
আরে -- এত দ্বিধা করছিস কেন বল তো! প্রথম দর্শনেই আমি বুঝেছি, কিছু একটা সমস্যায় পড়েছিস তুই। বলে ফ্যাল চটপট।”
দিগন্ত অন্তর্মুখী স্বভাবের, কিন্তু চাপ নেওয়ারও তো একটা সীমা আছে...! আর সে সীমা অনেকদিন আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে।


সব শুনে শুভঙ্কর বলল, “টেলিপ্যাথি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-সমর্থিত না হলেও আমি কিন্তু তোর এই আগেভাগে দেখতে পাওয়ার ব্যাপারগুলোকে স্রেফ ‘কয়েনসিডেন্স আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারছি না রে দিগন্ত। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে কত কিছুই তো রহস্যাবৃত রয়েছে আজও এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আসলে কী জানিস, যুক্তিতর্ক দিয়ে কতটুকুই বা ব্যাখ্যা করা যায়! দ্যাখ না -- বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কেমন করে হল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খাড়া করা হল যে ‘Big Bang Theory’, সেটাই যেখানে একটা ধাঁধা, আই মিন paradox, সেখানে...”
কেন! ওই থিওরিকে paradox বলছিস কেন?”
অবশ্যই বলব, তা নয়তো কী?” জোর দিয়ে বলে ওঠে শুভঙ্কর, “বিজ্ঞান বলছে, ‘Cosmic Egg’ বিস্ফোরিত হওয়া মাত্রই তৈরি হচ্ছে ‘matter’ এবং ‘anti matter’ আর এই জায়গাটাতেই আমার প্রশ্ন - ‘Cosmic Egg' এল কোথা থেকে? পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞানের জবাব - ওটাই তো শুরু Space আর Time-এর। কিন্তু তা বললে মন মানবে কেন! তার আগে... তার আগে... তারও আগে... কোথায় গিয়ে থামবি দিগন্ত? অতএব, যুক্তিতর্ক আর বুদ্ধির ওপর অপরিসীম আস্থা রাখিস না ভাই, হালে পানি পাবি না...!”
বেশ, তাহলে বলছিস, এমন যে হচ্ছে মানে -- পরে যা ঘটতে চলেছে, তা আমি দেখতে পেয়ে যাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে কিংবা আগেই, এর পেছনে কারণ না খুঁজে মেনে নেওয়াই ভালো যে, ব্যাপারটা যুক্তিবুদ্ধির বাইরের সেই বিশেষ ক্ষমতা ‘টেলিপ্যাথি, তাই তো শুভঙ্কর? কিন্তু...”
কিন্তু কী?”
আজকের দেখার পেছনে মাকে নিয়ে আমার সীমাহীন দুশ্চিন্তা দায়ী নয় তো? আসলে কী জানিস শুভঙ্কর, দুবছর আগে বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর থেকে মা ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছে। হেমন্ত সঙ্গে আছে বটে, কিন্তু সে তো সবে স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ঢুকেছে কলেজে... একেবারে ছেলেমানুষ। আর আমাদের একমাত্র বোন মঞ্জু তো গত বছর বিয়ের পরে পরেই তার স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দিয়েছে সাগরপারের দেশে।”
উড়িয়ে দেওয়া যায় না তোর কথা। তাছাড়া, তুই বলছিলি না যে, চোখ লেগে গিয়েছিল তোর... স্বপ্ন দেখিসনি তো!” শুভঙ্কর বলে, “এক কাজ কর। মাকে আর একবার ফোনে ধরবার চেষ্টা কর তো দিগন্ত।”
ঠিক বলেছিস তুই শুভঙ্কর,” বলতে বলতে সেন্টার-টেবিলের ওপর রাখা সেলফোনটা তুলে নিয়ে ‘রি-বাটন টেপে দিগন্ত। কিছু অপেক্ষার পর তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক, “রিং হচ্ছে রে শুভঙ্কর! হ্যালো? মা, তুমি কি ফোন বন্ধ রেখেছিলে?”
না - বন্ধ রাখব কেন!” নীহারকণার উত্তর ভেসে আসে অন্য প্রান্ত থেকে, “আমাদের এখানে যে মাঝেমধ্যেই নেটওয়ার্ক থাকে না, তা তো তুই জানিস!”
ঠিক আছে, তুমি ভালো আছ তো? আর হেমন্ত? ও-ও ঠিকঠাক আছে তো?”
কেন বল তো! হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছিস তুই! ও বুঝেছি, গত মাসে অসুস্থ হয়েছিলাম, সেজন্যেই? এখন একদম সুস্থ। সময়মতো ডাক্তারের দেওয়া সব ওষুধপত্র খাচ্ছি, আমাকে নিয়ে তুই একেবারে কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবি না, বুঝেছিস? যে কাজের জন্যে কলকাতায় আছিস, সে কাজ মনপ্রাণ দিয়ে কর।”
ওহ্!” হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন দিগন্ত, “ভাগ্যিস ফোনটা লেগেছিল!”
নিশ্চিন্ত হয়েছিস তো এখন?” বলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভঙ্কর, “এবার তাহলে যাই রে দিগন্ত, আমার কাছে সন্ধের সময় আসার কথা একজনের।”
এখন তো সবে সওয়া পাঁচ, চল ‘নগেন্দ্র কেবিন'-এ গিয়ে চা খাই।”

রাস্তার উলটোদিকেই উত্তর কলকাতার বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ‘নগেন্দ্র কেবিন। রবিবারের ছুটির দিন। অন্য দিনগুলোর চেয়ে ভিড় একটু কম, কারণ, স্থানীয়দের তুলনায় কলকাতার বাইরে থেকে আসা লোকজনই এখানে আসে বেশি সংখ্যায়
জুতসই টেবিল দখল করে চেয়ারে মুখোমুখি বসল দুই বন্ধু। চায়ের সঙ্গে টার-ও অর্ডার দিল দিগন্ত। দুপ্লেট ফিশ-ফ্রাই। নগেন্দ্র-কেবিনের সবচেয়ে বিখ্যাত আইটেম
দিগন্তের মনমেজাজ এখন ফুরফুরে। ভেতরে জমে থাকা দুশ্চিন্তার মেঘ পুরোপুরি কেটে গিয়ে মনের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সোনালি রোদ্দুর
আচ্ছা দিগন্ত, টর্নেডো নিয়ে তোকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব করব করেও করা হয়ে ওঠেনি...”
বেশ, কর না...কী জানতে চাস?”
টর্নেডো কি জানান না দিয়ে একেবারে দুম করে আঘাত হানতে পারে?”
ঠিক তা নয়,” বলে দিগন্ত, “আচমকা ধেয়ে আসে ঠিকই, তবে আবির্ভাবের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বজ্র-বিদ্যুৎময় পরিবেশ। তোর হয়তো জানা আছে, তবুও বলি - টর্নেডো হল প্রবল গতিতে আবর্তিত বায়ুস্তম্ভ, যার এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকে ভূপৃষ্ঠ এবং অন্য প্রান্ত থাকে বজ্রগর্ভ মেঘে। দেখে মনে হয়, মেঘ হাতির শুঁড়ের আকার নিয়ে স্পর্শ করেছে পৃথিবী-পৃষ্ঠ।”
তাহলে পূর্বাভাস জানানো এত কঠিন হচ্ছে কেন?”
কারণ, মেঘ অমন আকার নেওয়া সত্ত্বেও শেষমেশ টর্নেডো না-ও তৈরি হতে পারে।”
আশ্চর্য তো!”
আর বিপদের কারণ অন্য, মানে একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে না পড়লে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিহ্নিত করা যায় না টর্নেডোকে।”
তাই! আর একটা কথা আমায় বল তো দিগন্ত... তোর লেখাতেই যেন পড়েছি, নানারকম শব্দ শোনা যায় নাকি -- যেমন, গুনগুন... ভনভন... উচ্ছল জলরাশির শব্দ কিংবা, চলন্ত মালগাড়ির শব্দ...”
হ্যাঁ, সে তো যখন একেবারে কাছে চলে এসেছে, তখন যায় শোনা... লাভ কী তাতে? পূর্বাভাস দিতে গেলে আরো আগে বুঝতে হবে।”
বেশ, আর একটাই প্রশ্ন তোকে...”
আরে একটা কেন! যত খুশি কর, ফ্রেশ ফিলে ফ্রিজ থেকে বের করে ভেজে দিতে আরও অনেকখানি সময় নেবে এরা, তুই মন খুলে প্রশ্ন করে যা।”
যত দূর জানি, সব দেশের তুলনায় ইউ.এস.এ-তে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক টর্নেডো উৎপন্ন হয়, তাই কি?”
হ্যাঁ তাই।”
কারণটা কী?”
প্রধান কারণ, মহাদেশটির পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত কোনও বড়ো পর্বতশ্রেণী নেই, যা থাকলে উত্তর অয়নমণ্ডল আর মেরুবৃত্তীয় অঞ্চলের মধ্যে বায়ুপ্রবাহকে বাধা দিতে পারত।” একটু থেমে শুভঙ্করের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে দিগন্ত বলল, “বছরে গড়ে কত টর্নেডো হানা দেয় ইউ.এস.এ-তে ভাবতে পারিস? -- ১২০০। আর তোর মনে আছে... বেশিদিন আগের নয়, ২০১৫-র ২৬-এ ডিসেম্বরের কথা? -- ওই দিন সন্ধ্যায় উত্তর টেক্সাসের ডালাসে আর ওকলাহোমায় ঘটেছিল টর্নেডো-আউটব্রেক?”
আবছা মনে পড়ছে যেন... কাগজে পড়েছিলাম...”
কী হয়েছিল বল তো? -- একের পর এক টর্নেডো আছড়ে পড়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো বাড়ির দেওয়াল ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে!”
ক্যান্টিন-বয় দুটো প্লেট নিয়ে এসে নামিয়ে রাখল টেবিলে। গন্ধে একেবারে ম ম চারপাশ। হাত বাড়িয়ে দিগন্ত ফিশ ফ্রাই-এর এক টুকরো কাঁটাচামচে বিঁধিয়ে মুখে তোলে, “আহ্! বেড়ে বানিয়েছে রে শুভঙ্কর, খেয়ে দ্যাখ।”
শুভঙ্কর ছুরি হাতে নেওয়ার আগেই ‘নগেন্দ্র কেবিন-এর টি ভি স্ক্রিনে ফুটে ওঠা সংবাদ-শিরোনামের দিকে নজর যায় ওদের, পরমুহূর্তে সরব হয়ে ওঠে ঘোষক-কণ্ঠ -- উত্তর চব্বিশ পরগণার মালতীপুর গ্রামে আজ কিছু সময় আগে সন্ধে ছ'টা নাগাদ আঘাত হেনেছে বিধ্বংসী টর্নেডো। গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি। ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি
ঘোষক-কণ্ঠ অন্য খবরে চলে যেতেই দুই বন্ধু পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, কারও মুখেই কোনও কথা ফোটে না
-----

2 comments:

  1. একটা দারুণ গল্প। টেলিপ‍্যাথি নিয়ে এমন লেখা আরো চাই

    ReplyDelete
  2. দারুন লাগলো। গল্পচ্ছলে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য এসেছে। পড়ে খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete