স্বভাবভূত
সুস্মিতা কুণ্ডু
শীতের ভর দুপুরে, নরমগরম
রোদ্দুরের মৌতাত মেখে, পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতে
যে মন্দ লাগছে না যুধাজিৎ বাবুর, তা ওঁর ওই গুনগুনিয়ে গান
ধরা দেখে বিলক্ষণই বোঝা যাচ্ছে। শুরুর দিকে মেজাজটা খিঁচড়ে থাকলেও এখন বেশ উত্তুরে
বাতাসের মতো ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আর ফুরফুরে লাগছে। তবে পেটের ভেতরে একটা চিনচিনে
যন্ত্রণা কেমন যেন পাকস্থলির দেওয়ালে দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে চলেছে। শিগগিরই এর একটা
বন্দোবস্ত করতে হবে। আসলে সক্কাল সক্কাল এমন কাণ্ডটি ঘটল যে অমন সাদা সাদা ফুলকো
ফুলকো লুচির দিস্তে, আর কালোজিরে দেওয়া আলুচচ্চড়ির
মায়া ত্যাগ করে বেরোতেই হল।
সকালের ঘটনাটা মনে পড়তেই কেমন গা-টা
শিরশিরিয়ে উঠল যুধাজিৎ বাবুর। কী করে এমনটা হল ভেবে ফের কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলেন দুঁদে উকিলমশাই।
ব্যাপারখানা হয়েছে কী, সকালে জলখাবারের লুচির
থালাটা সামনে এগিয়ে দিতে দিতে গিন্নি মোলায়েম গলায় শুধিয়েছিলেন, “হ্যাঁ
গো, আজ সন্ধেয় তো মিঃ বটব্যালের বাড়িতে পার্টি। যদি এ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে তোমার
দেওয়া হিরের নেকলেসটা পরে যাই, তাহলে কি বেশি বাড়াবাড়ি
হয়ে যাবে?”
উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ করে কী হল কী জানি
যুধাজিৎ বাবুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “বাড়াবাড়ির
কী আছে, ও তো আর সত্যি সত্যিই দশ লাখ টাকার হিরের নেকলেস নয়, মোটে
দশ হাজারের আমেরিকান ডায়মন্ডের নেকলেস...”
এই অবধি বলেই মুখে হাতচাপা দিয়েছেন, কিন্তু
ততক্ষণে যা ড্যামেজ হওয়ার হয়েই গেছে। নদীর ওপর ড্যাম ভেঙে জলরাশি ধেয়ে আসার মতো
রাশি রাশি বাক্যবাণ ধেয়ে আসতে লাগল ওঁর দিকে। বলাই বাহুল্য গিন্নির গলাধাক্কা ছাড়া
আর কিছুই সকালে গলা দিয়ে নামেনি, লুচি তো অনেক দূরের কথা।
বলতে চেয়েছিলেন গিন্নির মন জোগানোর মতো কিছু কথা, তা
না, বলে ফেললেন বা বলা ভালো বোম ফেললেন অন্য কথা বলে। তারপর থেকে যাই বলার চেষ্টা
করছেন শুধু সত্যি কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গতিক সুবিধের নয় দেখে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে আসার পর, পাড়ার পার্কটার গেটের
বাইরের ঘুপচি দোকানটায় চা খেতে গিয়েও গোল বাঁধালেন। দোকানের মালিক শুধু জিজ্ঞাসা
করেছিল, “স্যার দুটো বিস্কুট দেব না কি সঙ্গে?”
তার উত্তরেও তিনি বলে ফেললেন, “ওগুলো
মানুষে খাওয়ার বিস্কুট? কতদিনের বাসি তার নেই ঠিক, কুকুরকে
দিলেও তো ছোঁবে না...”
বলেই মুশকো চেহারার দোকানির লাল লাল চোখের
দিকে আর বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে সাহস পাননি। পাঁচ টাকার কয়েনটা ঠং করে কাউন্টারে রেখে
দিয়ে সটান পার্কের গেটের দিকে পা বাড়িয়েছেন।
তখন থেকেই পার্কের কেঠো বেঞ্চে বসে, শুয়ে, আধশোয়া
হয়ে, ভেবে চলেছেন অদ্ভুত এই কাণ্ডকারখানাটা নিয়ে। এ ভাবে দুমদাম
সত্যি কথা বলে ফেললে তো কোর্টে আর দেখতে হবে না! দু’দিনেই
সব মক্কেল টাকা ফেরত নিয়ে অন্য উকিলের দ্বারস্থ হবে। বেজায় চিন্তায় খিদের কথাটাও
প্রায় ভুলতে বসেছেন যুধাজিৎ বাবু। রেগেমেগে বলেই বসলেন, “ধুত্তোর
নিকুচি করেছে!”
এমন সময় কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় কে একজন কথা বলে
উঠল, “বড্ড গোলমেলে লাগছে তাই না?”
চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখলেন, কিন্তু
আশেপাশে কেউ নেই। বেশ খানিকটা দূরে আরেকটা বেঞ্চে শুধু আরেকজন ভদ্রলোক বসে আছেন।
মাথা মুখ সব রংচটা লাল মাঙ্কি ক্যাপে ঢাকা। নির্ঘাত বেজায় শীতকাতুরে লোক হবে।
কিন্তু কথাটা কে বলল তাহলে?
“এই
যে আমি, আমি বললুম স্যার।”
“কে
রে বাবা? ভূত-টুত নাকি?”
মাথা তুলে ওপরের গাছগুলোর দিকে তাকালেন
যুধাজিৎবাবু, কোনও কঙ্কালের ঠ্যাং ঝুলছে
না তো!
“আরে
ভয় পাবেন না! আপনি যেরকম ভূত ভাবছেন
আমায়, আমি ঠিক সেরকম মানুষ-মরা ভূত নই। আমি হলুম গিয়ে স্বভাবভূত।”
“অ্যাঁ!
সেটা আবার কী নতুন প্রজাতির ভূত রে বাবা। তা তুমি মানে আপনি আমার ঘাড়ে ভর করলেন
কেন? আর আপনাকে দেখতেই বা পাচ্ছি না কেন?”
“তুমিটাই
বেশ লাগছে, ওটাই চলুক না। তা ভূতেদের দেখা যায় বুঝি? এই
আপনার উকিলে বুদ্ধি!”
“আহা,
সে চোখের দেখা যদি নাও দেখা যায়, অনুভূতি তো হয় নাকি? আর
আপনারা... ইয়ে মানে... তোমরা তো বিকটদর্শন মূর্তি ধরে লোকজনকে ভয় দেখাও, ওটাই
তো তোমাদের কাজ বলে জানি। তাহলে?”
“বললুম
না আপনাকে, ওগুলো মানুষের ভূত, আমি হলুম গিয়ে স্বভাবভূত।
আমরা ঘাড়ে ভরও করি না আর ঘাড় মটকাইও না। আমরা ভর করি ব্রেনে। এই যেমন আমি আপনার
ব্রেনে ভর করেছি বলে আপনি ভড়ভড় করে সব সত্যি কথা বলতে শুরু করেছেন।”
“ম্
মানে বুঝলাম না! সে আবার কেমনধারা ভূত? আর
আমার সত্যি বলার সঙ্গে ভূতের ভর করার কী সম্পর্ক হে? আর
এরকম অদৃশ্য হয়েই বা কথা বলছ কেন বাপু তুমি?
সামনে এসে দাঁড়াও তো দেখি কত বড়ো ভূত তুমি! এই
যুধাজিৎ মুকুজ্জে যেমন তেমন উকিল নয়, বুঝলে?
সব ক’টা
পরীক্ষায় অত্যন্ত নিপুণভাবে টুকলি করে পাশ...
ইরক্ ফের সেই সত্যি বলে
ফেলচি যে... রাম রাম রাম রাম...”
“রামকে
ডেকে কিসস্যু লাভ হবে না যুধোবাবু। চাইলেও মিথ্যে বলতে পারবেন না আপনি। আমি, এই
সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ভর করেছি আপনার ওপর,
বুঝলেন?”
“য্
য্ যুধিষ্ঠির!!”
“হুমমম,
সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!”
“কিন্তু
সে তো কথার কথা লোকে বলে...”
ভয়ে আর বিস্ময়ে চোখদুটো ছানাবড়ার রূপ নিতে
শুরু করে উকিলমশায়ের।
“কথার
কথা নয় যুধোবাবু, কথার কথা নয়। এই আমি যেমন
হলুম গিয়ে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, তেমনি আমাদের দলে আরও
রয়েছে, গৌরি সেন, নন্দ ঘোষ, হরিদাস
পাল, হরি ঘোষ। আমরা হলুম গিয়ে ওই যে, স্বভাবভূত।”
উকিলমশায়ের মুখে আর বাক্য সরে না। তিনি মাথার
ভেতর থেকে ভেসে আসতে থাকা স্বভাবভূতের কথাগুলো গিলতে থাকেন।
“আমাদের
স্বভাবভূতেদের একটা অর্গানাইজেশন আছে,
বুঝলেন! ‘দ্য
গ্রেট স্বভৌতিক অরগানাইজেশন ফর ইমপ্রুভিং হিউম্যান বিহেভিয়ার’!”
“অ্যাঁ!
ক্ ক্ কী?”
“একটু খটোমটো লাগল, নয়? বুঝিয়ে
বলছি। আমি, গৌরি, হরি, আমরা
সবাই হলাম ওই অর্গানাইজেশনের সদস্য। আমাদের কাজ হল উলটো স্বভাবের একটা মানুষ খুঁজে
বার করা, তারপর তার ব্রেনে ঢুকে গিয়ে তার স্বভাব অভ্যেসগুলো উলটেপালটে
দেওয়া। যার তার ব্রেনে আবার আমরা ঢুকতে পারব না। পারফেক্ট ম্যাচ হওয়া চাই, ঠিক
যেমন আপনাদের মানুষদের ব্লাড গ্রুপ একদম মিলিয়ে তবে এর রক্ত ওর শরীরে দেওয়া যায়, তেমনি।
এই যেমন আপনি, জ্ঞান হওয়া ইস্তক আপনি
কখনও সত্যি কথা বলেননি। তাই আমার সঙ্গে জব্বর ম্যাচ জমল আপনার! সঙ্গে
সঙ্গে ঢুকলুম আপনার মুণ্ডুতে, আর দেখুন কেমন হড়হড়িয়ে সব
সত্যি কথা বলছেন আপনি।”
“আর
যদি ম্যাচ না হয় তাহলে বেরিয়ে যাবে আমার মাথা থেকে?” কোনও
মতে শুকনো গলায় বলে উঠলেন যুধাজিৎ বাবু।
“ম্যাচ
না হলে আমরা অবশ্য বেশিদিন সেই মানুষের মস্তিষ্কে থাকতে পারি না বটে। তখন আবার
আমাদের অর্গানাইজেশন থেকে অন্য মানুষের সন্ধানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কী জানেন,
এভাবে এর ওর তার মুণ্ডুতে দু’দিন অন্তর ঢোকা বেরোনো বড্ড কষ্টকর। আফটার অল আমরা
স্বভাবভূতেরাও তো একটু শান্তি চাই রে বাবা। তাই অনেক খুঁজে খুঁজে আমি, গৌরী
আর নন্দ তিন বন্ধু মিলে পারফেক্ট তিনটে মানুষের সন্ধান পেয়েছি। তারপর আমরা আমাদের
অর্গানাইজেশন ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। আর ওদের হয়ে ভূতের বেগার খাটতে পারব না। আমরা
এবার একটু মস্তি করব, মজা করব। আপনাদের ব্রেনেই
আমরা চিরস্থায়ী আস্তানা গাড়ব।”
“অ্যাঁ!
তার মানে তুমি আমার মাথা থেকে নামবে না?
সত্যি কথা বলার ভূত আমার
মাথা থেকে না নামলে যে আমার পসার জলে যাবে!” ডুকরে কেঁদে ওঠেন
উকিলবাবু।
“ঐ
দেখুন, এই বুড়ো বয়সে ভরদুপুরে পার্কের বেঞ্চে বসে বসে কাঁদলে লোকে
যে সত্যি সত্যি ভাববে ভূতে ভর করেছে। আপনি তো তাও ঢের ভালো আছেন মশাই। সামনের ঐ
বেঞ্চে মাঙ্কিক্যাপ পরে বসে থাকা ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন? গগনেন্দ্র
গড়গড়ি।”
গগনেন্দ্র গড়গড়ি যুধাজিৎ
বাবুর পাড়াতেই থাকেন। যুধাজিৎ বাবুর ঝাঁ চকচকে দোতলা বাড়িটা টপকে গলির ভেতর আরও চারটে
বাড়ি ছেড়ে বাঁয়ে একতলা বাড়িটা ওঁর। সমস্ত বাড়ির দেওয়াল পলেস্তারা খসা, ইয়া
লম্বা লম্বা বট অশ্বত্থ গাছ সব বেরিয়ে আকাশপথে উর্দ্ধগামী হতে শুরু করেছে, শ্যাওলার
ছোপ ছোপ। বাজারে গেলেই গড়গড়িকে দেখতে পাওয়া যায় বাজারওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করতে।
কোনও ফেরিওয়ালা, সেলসম্যান, ইনসিওরেন্সের
লোক গড়গড়ির ভয়ে যুধাজিৎবাবুদের গলিতে ঢোকে না।
সকাল বিকেল গড়গড়িগিন্নির বিলাপের চোটে কাক চিল নেড়ি কুকুররাও টাটা বাই বাই করে
পাড়া ছেড়েছে।
অসম্ভব কিপটে ভদ্রলোক এই গগনেন্দ্র গড়গড়ি। কী
যে চাকরি করেন কেউ জানে না। কেউ বলে আদতে ওঁর অনেক পৈতৃক সম্পত্তি গ্রামে, কিন্তু
ইচ্ছে করে এখানে থাকেন ওরকম দৈন্যদশায়। চেয়েচিন্তে ধার বাকিতে সংসার চালান, যাতে
কাউকে পয়সা না দিতে হয়। আর কক্ষণও কাউকে ধারের টাকা শোধ করেন না।
“অ্যাঁ! গড়গড়িমশাই
এরকম বাঁদর সেজে বসে রয়েছেন কেন এখানে?” আর্তনাদের মতো শোনায়
কথাটা যুধাজিৎবাবুর গলায়।
মাথার ভেতরের আওয়াজটা বলে ওঠে, “ঐ
যে গৌরি সেনের কাণ্ড! আর কী! সবাইকে
পাড়া ছাড়া করে এবার নিজেই পাড়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন গড়গড়িবাবু।”
“কিন্তু
কেন? আর গৌরি সেন কে?
সে এখানে কোত্থেকে এল?”
মাথার ভেতরের কণ্ঠটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে
উঠল। তারপর বলল, “সাধে বলে ঢেঁকি সগ্গে
গেলেও ধান ভাঙে! উকিলি জেরাটা ভোলেননি এত
ভয়েও। দাঁড়ান খোলসা করেই বলি। এই আপনি যুধাজিৎ মুকুজ্জে যেমন মিথ্যুক চূড়ামণি, তাই
আমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির আপনার মাথায় ঘর বেঁধেছি। তেমনি গগনেন্দ্র গড়গড়ি কৃপণ
শিরোমণি, তাই গৌরি সেন বাসা করেছে ওর মাথায়। ‘লাগে টাকা, দেবে
গৌরি সেন’ শোনেননি মশাই?”
মাথার মধ্যে ঘিলুটা যেন জগঝম্প করছে বলে মনে
হচ্ছে যুধাজিৎ বাবুর। কোনওমতে বেঞ্চ থেকে উঠে টুকটুক করে এগিয়ে গেলেন ওই সামনের
বেঞ্চটার দিকে। লোকটার মুখ এমন মাঙ্কি ক্যাপে ঢাকা, আদৌ
গড়গড়িমশাই কিনা সন্দেহ হচ্ছে। কাছে গিয়ে কাঁধে আলতো টোকা দিয়ে ডাকলেন, “কে
গড়গড়িমশাই না কি?”
বলামাত্র মাঙ্কি ক্যাপ পরা লোকটা মাঙ্কির
থেকেও বেশি ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে উঠে বলে উঠল, “কে
কী কোতায়? না না একেনে গড়গড়া হুঁকো অম্বুরি কেউ থাকে নাকো। আমি হলুম
গিয়ে ইয়ে মানে ওই মানে...”
গলাখানা শুনে যুধাজিৎবাবু একশো ভাগ নিশ্চিত
হয়ে গেলেন যে ইনিই গড়গড়িবাবু বটে। দিবারাত্রি গড়গড়িগিন্নির সঙ্গে চেঁচামেচি লেগেই থাকে কিনা। সবটাই
কানে আসে মুকুজ্জে কত্তাগিন্নিরও।
“ভয়
পাবেন না গড়গড়িমশাই। আমিও আপনার মতোই ভুক্তভোগী। আমার রোগের নাম সত্যবাদী
যুধিষ্ঠির আর আপনারটা গৌরি সেন।”
“আপনি
ক্ কী করে জানলেন গৌরি সেনের কতা!! তকন থেকে মাতার ভেতর গৌরি
সেন, স্বভাবভূত না কে জানি মশাই, কতা বলেই যাচ্চে। জানেন
মুকুজ্জেমশাই, আমি কী করেচি? যত পাওনাদার ছিল সক্কলকে
ডেকে ডেকে পয়সা মিটিয়ে দিয়েচি, তায় আবার সুদ সমেত। পাড়ার ওই উচ্চিংড়ে কেলাবে মশাই
পাঁচ পাঁচটা হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে এসেচি চড়ুইভাতির জন্য। একবারটি ভেবে দেকুন
দেকি। বলতে লজ্জা নেই তল্লাটে সব লোকের কাছেই আমার অল্প বিস্তর দেনা রয়েচে, যার
সাতেই দেকা হচ্চে তাকে পয়সা ফেরত দিয়ে দিচ্চি মশাই। এই যো, এই
যো আপনার কাচেই তো সেদিন বাজারে বাহান্নটা টাকা ধার নিলুম। ধরুন দেকি টাকাটা, নইলে
মাথার মদ্দে লোকটা বকবক করেই চলেচে। আহ্ কী আপদ্।”
“সেই
ভয়েই আপনি পার্কে বসে বুঝি?”
“আর
কোতা যাই বলুন তো। গিন্নি আগের দিন শাড়ি কেনার জন্য তিন হাজার টাকা চেয়েছিল। তাকে
খেঁকিয়ে মানা করেচি, অথচ আজ সকাল থেকে হেথা হোথা খোলামকুচির মতো টাকা ওড়াচ্চি দেখে
তিনি গালাগালির ঝুলি উপুড় করে আমায় বিদেয় করেচেন ঘর থেকে। তার ওপর এই পায়ে পায়ে
পাওনাদার। পার্কের চে’ নিরাপদ জায়গা তো আর
পাচ্চিনে উকিলবাবু।”
বেশ চিন্তায় পড়লেন উকিলবাবু। এই
স্বভাবভূতেদের পাল্লায় পড়ে জীবনটাই যে নরক হয়ে গেল। ওদিকে মাথার মধ্যে ফিসফাস চলছে, “আমি
আর গৌরি, বুঝলেন মুকুজ্জে মশাই, এই পার্মানেন্টলিই আপনার
আর গড়িগড়িমশায়ের মাথায় বডি ফেললুম। বারবার এই মুণ্ডু বদলাতে কি ভালো লাগে বলুন?”
যুধাজিৎবাবু মুখে বললেন, “হ্যাঁ
তা তো বটেই, তা তো বটেই, যুধিষ্ঠিরবাবু!”
মনে মনে অন্য একটা চিন্তা ভাঁজতে লাগলেন।
মাথার ঘিলুতে বাস করলেও স্বভাবভূতেরা ওই নির্দিষ্ট স্বভাবের বাইরের আর অন্য কোনও
চিন্তাভাবনা আঁচ করতে বা কন্ট্রোল করতে পারে বলে মনে হয় না।
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন, “তা
বাপু যুধিষ্ঠির, ভায়া গৌরি! একটা
কথা বলি তোমাদের। চিরতরেই যখন তোমরা আমাদের মাথায় ঠাঁই নেবে ভেবেছ তখন আমরাও যাতে
ঠাঁইনাড়া না হই সেই সুযোগটুকু তো তোমাদের দিতেই হবে আমাদের, তাই
না? বুঝতেই পারছ আমাদের গিন্নিরা বেজায় রেগে আছেন। তাঁদের
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঘরে ফেরার ব্যবস্থাটুকু তো আমাদের করতে হবে। তোমাদের কথা যদি ওঁদের
সত্যি সত্যি বলি তাহলে তো কিছুতেই ওঁরা প্রত্যয় যাবেন না, বিশেষ
করে আমার গিন্নিটি। উকিলের সংসার করে করে তাঁর বুদ্ধিটিও বেশ শান দেওয়া হয়ে গেছে কিনা
অ্যাদ্দিনে। কাজেই বেশ জমাট একটা মিথ্যের জাল বুনে গিন্নিদেরকে তাইতে জড়াতে পারলে
তবেই আমরা ফের ঘরে ঠাঁই পাব আর তোমরাও নিশ্চিন্তে আমাদের মাথায় ঘর করে পারবে।”
“কথাটা
অবশ্য মন্দ বলেননি আপনি উকিলমশায়। তবে কী করবেন আপনি ভাবছেন?” বেশ
চিন্তিত শোনায় মাথার ভেতরে যুধিষ্ঠিরকে।
“ওসব
তুমি ভেবো না, আমি ঠিক গিন্নিকে বোকা
বানিয়ে ফেলব। কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। তুমি যদি আমার মাথায় ভর করে থাক তাহলে তো
আমি সত্য বই মিথ্যে বলতে পারব না। তাহলে গিন্নিকে বোঝাবটা কী করে? যদি
ঘন্টাখানেকের জন্য তুমি আমার মাথা থেকে বেরিয়ে একটু এদিক সেদিক ঘুরে আস তাহলে আমি
চেষ্টা করার সুযোগ পাই।”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর যুধিষ্ঠির বলল, “বেশ
তবে ওই কথাই রইল। আপনি তবে ঘন্টাখানেক বাদে পার্কে ফিরে আসুন আমি অপেক্ষা করছি। আর
হ্যাঁ, আসার সময় আপনার ছেলেটিকেও সঙ্গে আনতে ভুলবেন না।”
থতোমতো খেয়ে যুধাজিৎ বাবু বলে উঠলেন, “ক্
ক্ কেন?”
“হেঁ
হেঁ হেঁ! উকিলবাবু আপনার ছেলেটি নিজের দোষ পরের ঘাড়ে চাপাতে ভারি পটু
কিনা। এতদিন আপনার পকেটের যত খুচরো পয়সা চুরির জন্য মানদা মাসিকে দোষ দিয়েছেন, সেগুলো
আসলে... হেঁ হেঁ হেঁ! আরও
অনেক আছে, কালে কালে নিজেই সব দোষ ঘাড় পেতে স্বীকার করবে দেখবেন’খন... হেঁ হেঁ হেঁ...”
যুধাজিৎবাবু মনের রাগ মনে চেপে বললেন, “আমার
নন্টের কুবুদ্ধিতে ভরা ঘিলুই তাহলে তোমাদের নন্দ ঘোষের নতুন ঠিকানা। তাই না?”
বেশি আর কথা না বাড়িয়ে গড়গড়িমশাইকে বসতে বলে, সত্যবাদী
যুধিষ্ঠিরকে ঘাড় থেকে নামিয়ে, পার্কের বাইরে বেরোলেন
যুধাজিৎবাবু। চায়ের দোকানের মুশকো লোকটার নজর বাঁচিয়ে সোজা ছুটলেন বাড়ির দিকে।
ঢোকার মুখেই দেখা হল ছেলের সঙ্গে। বাপকে দেখেই হাউমাউ করে উঠল, “বাবা
গো! সেদিন তোমার স্টাডিরুমে যে কাগজপত্রের ওপর জলের গ্লাস উলটেছিল, সেটা
হুলো করেনি, আমি করেছি। আর পরশু মায়ের
আলমারির ঐ খয়েরি বেনারসিটা, যেটা মা ছাদে রোদে দিয়েছিল, ওটা
যে ফুটো ফুটো হয়ে গেছিল, সেটাও টমির দোষ নয়,
আমিই...”
এই অবধি বলেই ছেলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মনে মনে দাঁত কিড়মিড়োলেন, “যত
দোষ নন্দ ঘোষ...”
মুখে ছেলেকে বললেন, “অ্যাই
নন্টে, সোজা পার্কে যা,
গিয়ে দেখ গড়গড়িমশাই বেঞ্চে
বসে রয়েছেন। ওঁর কাছে গিয়ে বসে থাক। খবরদার অন্য কিছু বুদ্ধি খাটাবি না।”
তারপর বাড়িতে ঢুকে মধুমালতি দেবীকে টানতে
টানতে সোজা ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে খিল দিলেন।
* * *
বেশ ঘন্টাখানেক পর পার্কে ফিরে দেখেন যুধাজিৎ, গড়গড়িমশাই
আর নন্টে জবুথবু হয়ে চুপটি করে বসে রয়েছেন বেঞ্চে। ওদের পাশে গিয়ে বসলেন।
বসামাত্রই মাথার মধ্যে আওয়াজ পেলেন, “কথা
রাখলেন তাহলে, ফিরে এলেন। ক’ঘন্টা
আমি মাথায় ভর করেছিলুম তাইতেই কী উন্নতি আপনার দেখুন। সত্যি কথা বলছেন, কথা
দিয়ে কথা রাখছেন। এইটেই চায় তো আমাদের অর্গানাইজেশন। মানুষ তার স্বভাবের উলটো পিঠটাও
দেখুক, ভালো মন্দ বিচার করুক তারপর।”
“তা
এত মহৎ উদ্দেশ্য যখন, তখন তুমি সেই অর্গানাইজেশন
ছাড়লে কেন যুধিষ্ঠির?”
“আরে
স্বভাবভূত বলে কি চিরকাল মানুষের স্বভাবই শুধরে বেড়াব নাকি? আমাদেরও
তো ইচ্ছে হয় ফূর্তি-টুর্তি করতে নাকি?”
এমন সময় হঠাৎ গড়গড়িবাবু বলে উঠলেন, “ও
কী, ও কী! আমার গিন্নি আবার এমন ভরদুপুরে পার্কে আসছেন কেন? সঙ্গে
কে? ও উকিলমশাই আপনার গিন্নিও যে সঙ্গে আছেন।”
“এই
যে সব বলে বুঝিয়ে এলুম, তাই বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে
আসছেন ওঁরা আমাদের। তা বাছা যুধিষ্ঠির গৌরি আর নন্দ, তিন
বন্ধু মিলে আমাদের তল্লাটেই পাকাপাকি থাকার জন্য রেডি হও তবে।”
মাথার ভেতর থেকে যুধিষ্ঠির কিছু বলার আগেই, উকিলগিন্নি
মধুমালতী বাজখাঁই কণ্ঠে হাঁক পাড়লেন, “কই
যুধোর ব্যাটা! শিগগির এই পোড়ারমুখো উকিলটার
মাথা থেকে বেরো বলছি! অর্গানাইজেশনকে ধোঁকা দিয়ে
ফুর্তি করতে আসা হয়েচে? আমি হলুম গিয়ে ধনঞ্জয়... প্রহারেণ ধনঞ্জয়। আর এই হ’ল গিয়ে আমার সঙ্গী...”
“বৃন্দাবন... কিলিয়ে বৃন্দাবন!” পাশ থেকে বলে ওঠেন
গড়গড়িগিন্নি।
দাঁতে দাঁতে চিবিয়ে বলে চলেন মধুমালতী
মুকুজ্জে, “এর আগে কখনও স্বভাবভূতেদের অর্গানাইজেশনে
এরকম শয়তানি কেউ করেনি। তোদের তিনমূর্তিকে ধরবার জন্য তাই স্পেশালি আমাদের দু’জনকে
অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে। শিগগির এই তিনটে মানুষের মাথা থেকে বেরিয়ে বড়োসাহেবের কাছে
সব বলে ক্ষমা চা। নইলে তোদেরই একদিন কী আমাদের একদিন।”
যুধাজিৎবাবু মাথার মধ্যে টের পাচ্ছেন
সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ভয়ে কাঁপছে।
মধুমালতী ফের খেঁকিয়ে ওঠেন, “কী
হল, বল আর কখনও এরকম করবি? নিজেদের কাজ ঠিক করে করবি? আর
পালানোর, ফাঁকি দেওয়ার প্ল্যান করবি?”
যুধাজিৎবাবু অনুভব করেন, মাথাটা
হালকা লাগছে। কে যেন একটা “না না না!”
বলে চিৎকার করতে করতে মাথা
থেকে বেরিয়ে গেল মনে হল। তাও একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন, “ও
গড়গড়িমশাই, বাহাত্তর টাকা যে পেতুম মশাই আপনার কাছে...”
“ইয়ে,
মানে তাই বুঝি... কাল বাজারে দেখা হলে না হয়...” বলেই গিন্নিকে বগলদাবা করে গগনেন্দ্র গড়গড়ি পার্কের বাইরে পাড়ি দিলেন।
নাহ্... গেছে মনে হচ্ছে স্বভাবভূতগুলো।
দিব্যি মিথ্যে করে বাহান্নকে বাহাত্তর বললেন,
আর গড়গড়িও টাকা না দিয়ে চম্পট দিল।
গিন্নি আর ছেলের দিকে ফিরে একগাল হেসে বললেন, “চলো
ঘরে ফেরা যাক। দারুণ অভিনয় করেছ তুমি গিন্নি। ঠিক যেমনটি শিখিয়েছিলুম একদম সেইরকম।
সত্যি বলছি এবার থেকে তোমায় আর ঢপ দেব না মোট্টে। তোমার খয়েরি বেনারসিটা নন্টে
ছিঁড়ে দিয়েছে না? আমি তোমায় নতুন বেনারসি...”
নন্টে ওমনি হাঁ হাঁ করে উঠল, “বাবা
ওটা আমি নয় তো, টমি...”
মধুমালতী দেবী রে রে করে উঠলেন, “তবে
রে... দাও তো দেখি বাঁদরটাকে ধরে ঘা কতক!”
যুধাজিৎবাবু নন্টের কানটা বেশটি করে মুলতে
গিয়েও থেমে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘স্বভাবভূতগুলো জ্বালাতন
করলেও একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে। কোনওরকম বদ অভ্যাস বা কুস্বভাব মানুষকে ভালো কিছু
দেয় না। আখেরে ভোগান্তিই বাড়ায়। তাই নিজেদেরকে শুধরে নিলে পরে আর এইসব সমস্যায়
পড়তে হয় না। নাহ্, এবার থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে নন্টের সামনে খারাপ উদাহরণ খাড়া
না করে, বরং ভালো স্বভাবের শিক্ষা দিতে হবে ওকে।’
_____
ছবিঃ সুকান্ত মন্ডল
দারুন
ReplyDeleteঅনেক অনেক থ্যাংক ইউ গো - সুস্মিতা
DeleteAladarokom ..
ReplyDeleteKhub sundor..
অসংখ্য ধন্যবাদ রইল ☺️
Deleteদারুণ লাগল। সত্যের জয়।
ReplyDeleteখুব ভালো
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDeleteঅলৌকিকের এইটাও একটা বেশ হাস্যরসাত্মক দিক যখন মানুষ এইভাবেও অতিপ্রাকৃত শক্তির সংস্পর্শে আসে আর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় যখন মিথ্যা কথনে অভ্যস্ত মানুষ সত্য ছাড়া বলতেই পারছে না । সেস্টা অ খুব ভালো আমি তো প্রতে পড়তে এইটা ভাবছিলাম এই গল্প তাহলে ল্যান্ডিং কিভাবে করবে? অতিপ্রাকৃত সক্তিদের ব্যাপারস্যাপার আমাদের মতো এইটা দেখেও স্বস্তি।
ReplyDelete