গল্পের ম্যাজিক:: এক রাতের আশ্রয় - সুমন মিশ্র


এক রাতের আশ্রয়
সুমন মিশ্র

এক

‘বাবু আপনার চা দরজার বাইরে থেকে সুখলাল হাঁক দিল। খাটের উপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল অনিন্দ্য, সামান্য ঘুমের ছোঁয়া সবে লেগেছে দুই চোখে, এমন সময় সুখলালের ডাকে সেটা ভেঙ্গে গেল। ঘুমের আর দোষ কী, খাটাখাটনি তো কম হয়নি, কতটা জার্নি, তারপর আবার এই দুর্যোগ। কোথায় আশ্রয় পাবে সেই চিন্তাও ছিলশারীরিক মানসিক কম হ্যাপা তো পোয়াতে হয়নি সারাদিনআলস্যি নিয়ে বিছানায় উঠে বসল সে। ঘরটার চারপাশে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। খাসা ঘরখানাব্রিটিশ আমলের আসবাবে ভর্তি। পুরোনো আমলের পালঙ্ক। ঘরের চার কোনায় চারটে তেপায়া টেবিল, তার উপর ফুলদানিতে টাটকা ফুল রাখা। দেওয়ালে বড়ো বড়ো পোরট্রেট ঝুলছে। আর একদিকের দেওয়ালে একটা হরি আর দুটো বাঘের মাথা ঝোলানো, সঙ্গে একটা পুরোনো আমলের দেওয়াল ঘড়িঘরের ছাদ বেশ উঁচু, কড়িকাঠ থেকে নেমে এসেছে পুরোনো আমলের একটা ঢকঢকে পাখাএই বাংলোটায় রাত কাটানোর মধ্যে একটা অভিজাত ব্যাপার আছে।
বাংলোর ঠিক পিছনেই একটা সাজানো লন আছে বলে শুনেছে বাংলোর মালিকের কাছ থেকে, তবে অন্ধকারে এখন তা বোঝা যাবে না। তার উপর বাইরে চলছে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। লনের গা ঘেঁষেই বয়ে চলেছে গঙ্গা। গঙ্গার দিকে ঘরের যে দেওয়াল তাতে বিশাল বিশাল তিনটে বাতায়ন। বন্ধ জানালার মধ্য দিয়েও বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জানালাগুলো বাতাসের ধাক্কায় ঠক ঠক শব্দ করে কাঁপছে, ভয় হচ্ছে জানালার কাচগুলো ঝনঝনিয়ে ভেঙ্গে না পড়েবৃষ্টির জলে জানালার কাচ ঝাপসা, বাইরেটা অস্পষ্ট, ভালো বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে অন্ধকারের বুক চিরে দেখা দিচ্ছে বিদ্যুৎ ঝলক, ক্ষণিকের জন্য সেই আলোয় লনটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কী ভীষণ সে দৃশ্য! লনের বড়ো গাছগুলো পাগলের মতো দুলছে। হাওয়ার বেগে একবার এদিকে নুইয়ে পড়ছে তো আর একবার অন্যদিকে। জানালাটা একটু ফাঁক করল অনিন্দ্য, গঙ্গা রীতিমতো ফুঁসছে।

বাবু আপনার চা। সুখলাল আবার হাঁক দিল।
জানালাটা বন্ধ করে সুখলালকে ভিতরে আসতে বলল অনিন্দ্য। সুখলালের বয়েস পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। রোগা, পরিশ্রমী চেহারা, নাকের নিচে ঝুলো গোঁফ, মাথার চুল সব সাদা। হাসিখুশি, তবে খুব কম কথা বলেচা-বিস্কুট টেবিলের উপর রেখেই চলে যাচ্ছিল, অনিন্দ্যই ডাকল, “আচ্ছা সুখলাল তুমি এখানে কতদিন ধরে আছ?”
সুখলাল একটা কান এঁটো করা হাসি হেসে বলল, “সে অনেক বছর হল বাবু, ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে এসেছিলাম। তারপর এখানেই থেকে গেলাম।”
“আর কে কে আছে এই বাংলোয়?”
“বাংলোর সব সময়ের লোক বলতে আমি আছি, আমার বউ লছমি আছে, রান্নার ঠাকুর শঙ্কর, ড্রাইভার রতন আছে, আর নির্মলসাব তো আছেনইএ ছাড়া যখন যেমন লোক আসে। এখন যেমন এক প্রফেসর সাব আছেন, আপনার দুটো ঘর পরেই, ভারী রাগী মানুষ, আমার তো কথা বলতেই ভয় লাগে। উনি তেমন লোকজন পছন্দ করেন না। ওঁর থেকে একটু দূরে থাকবেন।”
গায়ে পড়ে কেউ উপদেশ দিলে অনিন্দ্যর ভারী বিরক্তি লাগে, সে ভরাট গলায় বলল, “আমারও অচেনা কারও সঙ্গে আলাপ করার সময় নেই সুখলাল, তুমি এখন আসতে পার।”
আমতা আমতা করে সুখলাল কিছু বলতে যাচ্ছিল, অনিন্দ্য তাকে ইশারায় থামতে বলল, “ওটা কীসের আওয়াজ হল?” একটা বেশ জোরে আওয়াজ হয়েছে কয়েক মুহূর্ত আগে।
“ও কিছু নয় সাহাব, ঝড়ে বোধ হয় বাগানের কোনও গাছ ভেঙ্গে পড়ল। আপনি কদম চিন্তা করবেনা। রাত দশটায় ডিনার দেওয়া হবে। আমি আপনাকে ডেকে নেব।” সুখলালের ঠোঁটের কোনায় সেই পুরোনো হাসি।

দুই

লছমি বা শঙ্কর কাউকেই অনিন্দ্য এখনও দেখেনি, তবে নির্মল সরখেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনিই এই বাংলোর বর্তমান মালিক, বড়োই আময়িক মানুষ। অনিন্দ্যর সঙ্গে কতক্ষণেরই বা আলাপ, অথচ এমন কথা বলার ভঙ্গি যেন সেই কবেকার চেনাশোনা। ভদ্রলোকের কলকাতায় পুরোনো বাড়ি, বাগবাজার এলাকায়এই বাংলোটা কলকাতার কোনও এক আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের কাছ থেকে প্রায় জলের দরে কিনেছিলেন, এখন মূলত অথিতি নিবাস হিসাবেই ব্যবহার হয়। এর আশেপাশে দু’একটা ছোটো ট্যুরিস্ট স্পট আছে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাঁর মন্দ চলে নামাঝে মাঝে ফিল্ম শুটিংয়ের জন্য ভাড়াও দেওয়া হয়। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, আজ রাতে এই জায়গায় অনিন্দ্যর থাকারই কথা নয়। অনিন্দ্য চাকরি করে কলকাতার হোটেল ব্যবসায়ী বৈজুনাথ ত্রিবেদির অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে এই নবগড়ে সে এসেছিল জনৈক রাধানাথ সেনের প্রপার্টি দেখে একটা রিপোর্ট তৈরির জন্য। রাধানাথ সেন হলেন ‘এডমণ্ড বাংলোর’ মালিক। সেই বাংলোটিও গঙ্গার ধারেই, তবে সেটা সম্পূর্ণ প্রাইভেট প্রপার্টি, নির্মলবাবুর বাংলোর মতো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় না। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের পর। এক ছেলে, বিদেশে সেটলবাবাকেও নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়রাধানাথবাবুরও যেতে খুব একটা আপত্তি নেই। তবে যাওয়ার আগে এদিককার পাট একেবারেই চুকিয়ে দিতে চান। বৈজুনাথের সঙ্গে রাধানাথবাবুর কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়েছে কিন্তু চুক্তি পাকা করার আগে তিনি অনিন্দ্যকে দিয়ে পুরো ব্যাপারটা যাচাই করতে চান।
কথা ছিল সকালে একটা এগ্রিমেন্টের কাজ সেরে অনিন্দ্য রওনা দেবে কলকাতা থেকে। দুপুর-দুপুর পৌঁছে যাবে নবগড়ে। রাধানাথবাবুর গাড়ি অপেক্ষা করবে নবগড় ফেরিঘাটে। সেখান থেকে বাংলোয় গিয়ে সেদিন বিকেল আর পরদিন সকালে যতটা পারা যায় পর্যবেক্ষণ ও তথ্যসংগ্রহ করে কলকাতায় সে ফিরে আসবে। তবে কপাল খারাপ, এগ্রিমেন্টের কাজ শেষ হতে দেরি হয়ে গেল, তারপর ট্রেন লেট, বাস লেটে আসা - সব মিলিয়ে সে যখন শ্রীপুর ফেরি ঘাটে পৌঁছল ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া এই মোবাইল ফোন, চার্জ দিতে ভুলে যাওয়ায় ট্রেনে ওঠার পরপরই টি টি করে দেহ রেখেছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, সন্দেহ নেই রাধানাথবাবুর গাড়িও অপেক্ষা করতে করতে ফিরে যাবে, ওদিকে খবরটা বৈজুনাথের কানে পৌঁছলে সে অনিন্দ্যকে আস্ত রাখবে না।
এদিকে সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল, কিন্তু ফেরিতে উঠতেই চারদিক থেকে কালো মেঘ আস্তে আস্তে আকাশটা ঢেকে ফেলল। মাঝনদীতে যখন তাদের ফেরি, ঝোড়ো হাওয়া শুরু হল। উথাল-পাথাল ঢেউ উঠতে শুরু করল, নামল মুষলধারে বৃষ্টি। চারদিক বৃষ্টিতে ঝাপসা, নৌকা দুলছে, চলছে ঝড়ের তাণ্ডব। নৌকা ডুবল না এই খুব ভাগ্যি নবগড়ে নামতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য বৃষ্টিটা একটু ধরে এল। সেই ফাঁকেই অনিন্দ্য দৌড়ে ফেরিঘাটের পাশে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে গেল। কপাল মন্দ, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। রিকশা স্ট্যান্ড ফাঁকা, বাকি দোকান সব বন্ধ। চায়ের দোকানে খবর নিয়ে জানা গেল কাল রাত থেকেই মাঝেমধ্যে বৃষ্টি চলছে, তাই এমনিই দোকানপাট তেমন খোলেনি। ‘এডমণ্ড বাংলো’-র নাম দোকানি শুনেছে, তবে এই দুর্যোগের দিনে রিকশা পাওয়ার আশা নেই। মাইল দুয়েকের পথ, রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। কেউ যে যেতে রাজি হবে না সেকথা হলফ করে বলা যায়। কী আর করবে, চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে যখন আকাশ পাতাল ভাবছিল ঠিক তখনই নির্মল সরখেল কাকভেজা হয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন।
“উফফ! কী বৃষ্টি মশাই! আকাশটা যে একদম ভেঙ্গে পড়ল। আর একটু হলে তো নৌকাডুবি হয়ে মরতাম,” ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললেন।
“তা যা বলেছেন, আচ্ছা ফেঁসে গেলাম, এখন কী যে করি,” অনিন্দ্যর মনের চিন্তা গলায় ধরা পড়ল।
“তা আপনার কোথায় যাওয়া হবে?”
“এডমণ্ড বাংলো।”
“এডমণ্ড বাংলো...! খেপেছেন নাকি মশাইএই ঝড়-জলে কে নিয়ে যাবে আপনাকে ওখানে? রাস্তা তো নয়, যেন নরক। তার উপর আবার শিমুলতলার জঙ্গল আছে রাস্তায়, ক’টা গাছ যে উপড়েছে...!
“তাহলে উপায়?” অনিন্দ্যর গলা ক্রমশ মিইয়ে গেল।
“দেখুন, একটা উপায় হতে পারে... সামনেই আমার বাংলো, হোটেল হিসাবেই ব্যবহার করি। এখন অফ সিজন, একজন মাত্র গেস্ট আছেনবেশি দূর নয়, এই মাইল খানেকের পথআমার ড্রাইভার রতন আসবে গাড়ি নিয়ে। আপনার আপত্তি না থাকলে রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দিন।”
আপত্তির প্রশ্ন ছিল না। দুর্ভিক্ষের সময় রুটি খাব নাকি ভাত খাব, একথা আর কে ভাবে? গাড়িতে আলাপটা আরও জমে গেল। দুজনেই দুজনের সম্পর্কে অনেক কথাই জানলেন। হোটেলের ভাড়ার ব্যাপারটা বলায় উনি জিভ কেটে বললেন, “হেল্প করতে গিয়েও ব্যাবসা করব, অত বড়ো ব্যবসায়ী আমি নই।”

তিন

“আসতে পারি?” অপরিচিত একজন অনিন্দ্যর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথার চুল ঈষৎ কোঁকড়ানো, মাঝারি গড়ন, গায়ের রং পরিষ্কার বলা চলে।
“আসুন, ভিতরে আসুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
“আমার নাম শেখর মান্না, আপনার দুটো রুম পরেই আছি। মাফ করবেন, আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করছি বলে।”
“না না, আসুন না ভিতরে। আপনি কি প্রফেসর...?”
“সে কী! আমার পরিচয় পেয়ে গেছেন দেখছি। তা কে বলল? রতন নাকি সুখলাল?”
“আজ্ঞে সুখলাল।”
“ওঃ, তাহলে তো শুধু পরিচয় দেয়নি, কুখ্যাতিও করেছে,” ভদ্রলোক হেসে বললেন।
অনিন্দ্য ঈষৎ লজ্জিত মুখে হাসলসুখলালের উপর সত্যি এবার অনিন্দ্যর রাগ হচ্ছে, শেখরবাবু যথেষ্ট হাসিখুশি মানুষ, যেচে আলাপ করতে এসেছেন, তাঁর নামে অমন কথা। নির্ঘাত বকশিশ ঠিক মতো পায়নি।
অনিন্দ্য অন্য প্রসঙ্গে গেল, “আপনি কোন কলেজে অধ্যাপনা করেন?”
“ননিগোপাল মহাবিদ্যালয়ে, সাবজেক্ট হিস্ট্রি। তবে করি না, করতাম,” ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোনায় হাসিটা লেগেই আছে।
“করতেন বলতে? এখন আর করেন না?”
“নাহ। তবে কিনা জানেন তো, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে। আমারও সেই দশা। আগে ছাত্রদের ঠিক পথ চেনাতাম, সঠিক পরামর্শ দিতাম। এখনও কতক তাই, যাদের প্রয়োজন তাদের পরামর্শ দিই। শোনা না শোনা তাদের ব্যাপার, বলাটা আমার কাজ। এই যেমন আপনার কাছে এসেছি আজ,” ভদ্রলোক কথাগুলো বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন।
“তা আমাকেও কি পরামর্শ দিতে এসেছেন?” অনিন্দ্যর ঠোঁটের কোনা বিদ্রুপ।
কথাটা অনিন্দ্য মজা করেই বলেছিল, কিন্তু ভদ্রলোক ঝেঁঝে উঠলেন, “আপনি কি ভাবছেন আমি এই রাতে আপনার সঙ্গে মশকরা করতে এসেছি?”
“নাহ! আমি তা বলিনি শেখরবাবু, তবে কিনা আমি আপনাকে চিনি ধরুন এই মিনিট পাঁচেক হল, খামোকা আপনি আমায় পরামর্শই বা দেবেন কেন আর আমি তা শুনবই বা কেন,” অনিন্দ্য বিনীতভাবেই বলল।
“ঠিক আছে, তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। দেখুন আমি কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে এসেছিলাম। সামনে আপনার বড়ো বিপদ।”
“বিপদ? কী বিপদ? আর আপনিই বা জানলেন কী করে?”
ভদ্রলোক এবার যেটা বললেন সেটাকে অনিন্দ্যর প্রশ্নের উত্তর বলা যায় না। অনিন্দ্যকে অবাক করে দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি চিকেন স্যুপ পছন্দ করেন?”
অনিন্দ্যর সত্যি এবার বিরক্ত লাগছে, লোকটার মাথায় গণ্ডগোল আছে নির্ঘাত। ছোটোবেলায় দেখেছিল স্কুলে একজন স্যার ছিলেন, নিরুপম স্যার, রসায়নে পণ্ডিত, প্রচুর জ্ঞান। সবাই বলত পড়ে পড়ে মাথাটা গেছিল ওনার। মাঝে মাঝে কী বলতেন ঠিক থাকত না, কথার খেই হারিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন।
“বলছি পছন্দ করেন চিকেন স্যুপ?” শেখরবাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
“তা করি।”
“তার উপর এই ঝড়-জলের রাতে গরম স্যুপ, আহা জমে যাবে, কী বলেন? আজ ডিনারে শুরুতে স্যুপ আছে তো।”
“আপনি কি ডিনারের মেনু শোনাতে এসেছেন?” অনিন্দ্যর গলায় অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট।
“খাবেন না। লোভ লাগলেও খাবেন না। ওতে ঘুমের ওষুধ থাকবে যাতে আপনি আসল সময়ে পালাতে না পারেন। রাতে সজাগ থাকবেন, বিশেষ করে রাত একটায়।”
অনিন্দ্য হাঁ হয়ে গেছে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। শেখরবাবু আর কথা বাড়ালেন না, শুধু চলি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চার

লোকটার মাথার ব্যামো হয়তো আছে, কিন্তু তাই বলে তার কথাগুলো অনিন্দ্য একদম ফেলে দিতে পারল না। রাতে ডিনারে অনেক পীড়াপীড়ির পরও সে স্যুপ খেল না। নির্মলবাবু হেসে বললেন, “এ কী দাদা, আপনি ঝড়-জলে ভিজে এসেছেন বলে লছমিকে দিয়ে স্পেশালি এই স্যুপ বানালাম, আর আপনিই খাবেন না!”
অনিন্দ্য বিনীতভাবে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল। রাতে সুখলাল খাবার জল দিয়ে গেল, ভয়ে সে জলও অনিন্দ্য মুখে তুলল না। অপেক্ষা করতে লাগল ঘড়ির দিকে চেয়ে। কী বিপদ হতে পারে? শেখরবাবু কীসের কথা বলে গেছেন? তার কাছে তো দামী কিছুই নেই, তাহলে বিপদ কেন হবে?
ঘড়িতে তখন একটা বাজতে পাঁচ। বাইরে আবার ঝড় শুরু হয়েছে। অনিন্দ্যর বুকের ভিতরেও তখন গমকল চলছে। বাইরে জলের গর্জন, নদী ফুঁসছে। হঠাৎ বাড়িটা কেঁপে উঠল, সঙ্গে ব্যাপক একটা শব্দ প্রথমটায় অনিন্দ্য বুঝল না কীসের শব্দ, কিন্তু তিন মিনিট পর আবার! ভারী কিছু যেন জলে পড়লঠিক দুই মিনিট বাদে আবার। তবে এবার শুধু জোরালো শব্দই হল না, বাড়িটা ভীষণ দুলে উঠে একটু যেন কাত হয়ে গেল। অনিন্দ্য সাহস করে ঘরের জানালাটা একটু ফাঁক করল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর সেই আলোয় যা সে দেখল তাতে তার শিরদাঁড়া দিয়ে হিম স্রোত বয়ে গেল। ভাঙ্গন! গঙ্গার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। পিছনের লনটা প্রায় নেই। প্রচণ্ড স্রোত ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সেটাকে। একটু একটু করে ভেঙ্গে সেটা গঙ্গায় তলিয়ে যাচ্ছে। নদী প্রায় বাংলোকে ছুঁয়ে ফেলেছে। হয়তো বাংলোর নীচের মাটি কিছুটা নদীগর্ভে চলেও গেছে তাই বাংলোটা নদীর দিকে হেলে পড়েছে। হাতে আর কত সময়? মিনিটখানেক, নাকি তারও কম?
অনিন্দ্য ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে
“শেখরবাবু, নির্মলবাবু, সুখলাল, লছমি তোমরা কোথায়? আরে পালাও সব, নিজেদের প্রা বাঁচাও, ভাঙ্গন শুরু হয়েছে।”
কোনও সাড়াশব্দ নেই, অনিন্দ্য শেখরবাবুর রুমের দিকে পা বাড়াতেই বাংলোটা ভয়ঙ্করভাবে দুলে উঠলআর সময় নেই। অনিন্দ্য বাংলোর বাইরে বেরোনোর জন্য দৌড় লাগাল। বাংলোর বাইরে পা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অবর্ণনীয় একটা শব্দ হল, সঙ্গে একটা প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস এসে লাগল অনিন্দ্যর গায়ে। ছিটকে পড়ল সে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু দেখল, বাংলোটা প্রবল স্রোতে নীচে হারিয়ে গেল। জ্ঞান আসতেই অনিন্দ্য দেখল তার চারপাশে অনেক লোকের জটলা। ভোর হয়ে গেছে। কোন একটা দোকানের মধ্যে সে শুয়ে আছে, সারা গায়ে তার কাদা মাখা। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সে একটু জল খেল, তারপর সবাইকে আগের রাতের ঘটনাটা বিস্তৃতভাবে বলল।
ভিড়ের মধ্যে থেকেই একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন, “বেটা তুমি ঠিক বলছ? তুমি বাংলোটায় ছিলে আর সেটা ভাঙ্গনে কাল তলিয়ে গেছে?
“সত্যি বলছি চাচা, আপনারা জলদি পুলিশে খবর দিন। আমার মনে হয় না কেউ বেরোতে পেরেছে। অন্তত বডিগুলো যদি খুঁজে পাওয়া যায়।”
“তার দরকার হবে না বেটা। কাল এখানে কোনও ভাঙ্গন হয়নি।”
“কিন্তু আমি নিজে...।”
অনিন্দ্যকে ইশারায় সে থামিয়ে দিল, “ভাঙ্গন হয়েছিল বটে, তবে তা আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে। সে দিনটাও ঝড়-জলের রাত ছিল। যখন ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল সবাই তখন গভীর ঘুমে। মিনিট দশেকের মধ্যেই সব শেষ। কেউ বেরোতে পারেনিবাংলোর মালিক, চারজন কাজের লোক - সবাই মারা যায়। সঙ্গে আর একজনও মারা গেছিলেন, শোনা যায় তিনি প্রফেসর ছিলেন, বাংলোয় থাকতে এসেছিলেন। সবই কপাল। জোর বাঁচা বেঁচেছ বেটাআগেও ঝড়-জলের রাতে অনেকেই বাংলোটা দেখেছে, তাই অমন রাতে এদিকপানে লোক কম আসে। কপালের জোর আছে তোমার!
ভিড় পাতলা হয়ে যাওয়ার পর অনিন্দ্য কিছুক্ষ নদীর দিকে চেয়ে বসে থাকল। মনে মনে শুধু বলল, “শেখরবাবু, আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।”

_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী

4 comments: