![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjJd6c9SP6OjFvij64_KMGQaDXW1iza7vCHurjXhitVrI-UpVH__BE58YYCFfXd4M7pjR9JANO40Ep_ZQrO2HaXdnnLUr7zwwdhskpuCZC6JyAdc92nPBXKcbW1gkY0qkM-RwHpTd2ZxAd2/s640/saheli+3.jpg)
সেই অদ্ভুত মেয়েটি
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
১
সেই দিনগুলোর কথা এখনও
ভাবি। আমিই সেই অদ্ভুত মেয়ে। আমার কথাই লিখছি।
সকালের দিকে জানলার সামনে
বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। তবে সকাল বলছি কেন, সারা দিন রাত্রি আমি তো জানলার সামনেই বসে থাকি; বিছানার ওপর দুটো বালিশ পর পর রেখে বসে বা কখনও বালিশে মাথা দিয়ে গল্পের
বই পড়ি। কখনও ডায়েরি লিখি। মাঝে মাঝে লেখাপড়া থেকে চোখ তুলে জানলার দিকে তাকাই।
প্রচুর চড়াই পাখি আসে জানলায়। কাচে শব্দ করে ঠোঁট দিয়ে। খটাখট খটাখট। তবে ছাতারে পাখিগুলোই বেশি শুব্দ করে। বাকিরা আসে জল আর ছড়িয়ে থাকা বিস্কুটের
গুঁড়োর লোভে। আমি মাঝে মাঝে বিস্কুট ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিই।
শরীরটা আমার একদম ভালো নেই। বিছানা থেকে উঠতে পারি না। কোনও রকমে
ধরে ধরে বাথরুমে যাই। পা ভেঙ্গেছে একটা অ্যাক্সিডেন্টে। মাথাতেও চোট পেয়েছিলাম। হয়তো বাঁচতামই না। এখন অনেকটাই ভালো হয়ে গেলেও নিজের ফেলে আসা দিনের কথা মনে করতে পারি না। স্মৃতির বিনিময়ে জীবন
পেয়েছি। আমি একটি মেয়ে আপাতত এইটুকুই আমার পরিচয়। সোনালিদি আমায় পিউ বলে ডাকে। এই
সোনালিদির জন্যই জীবন ফিরে পেয়েছি। আমি
নাকি একটা ভাঙ্গাচোরা গাড়ির মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। সোনালিদি
নিজের গাড়িতে আমায় তুলে নেয়। এই দিদির বাড়িতেই আছি বেশ কয়েক মাস। ভীষণ স্মার্ট
ঝকঝকে চেহারার একজন মেয়ে। পুরোনো কথা মনে করতে গেলেই মাথাটা কেমন দপদপ করে ওঠে। সোনালিদি আমার খুব যত্ন
নেয়। দিদির একজন পরিচারিকা আছে, ভারতি
মাসি। মাঝে মাঝে একজন ডাক্তারবাবু এসে আমাকে দেখে যায়। ভারতি মাসি আমার খুব কেয়ার
নেয়। সোনালিদি দিনে বাড়ি থাকে, রাতে নাইট ডিউটিতে বেরোয়। এই জায়গাটা
যে কোথায় ঠিক বুঝতে পারি না। আমার তো মেমারি লস। এখানটা খুব নির্জন। সকালের দিকেই কিছু পাখি আসে, তারপর থেকে আর আসে না। দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনি আর মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। জানলা
দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু সবুজ মাঠ চোখে পড়ে। পাহাড়ের রেখা দেখা যায়। আর খুব পুরোনো আমলের একটা ক্যাসেল চোখে পড়ে। দেখলেই গা ছমছম করে। ৫টা নাগাদ দিদি
বেরিয়ে যায় অফিসে। আমার সঙ্গে দেখা করে যায়। গল্পের বই নিয়ে আসে, কখনও চকোলেট নিয়ে আসে, কখনও ফল নিয়ে আসে। ভারতি মাসি
মাঝে মাঝে সঙ্গে থাকে। দুপুরের দিকে নিজের ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট নেয়। কখনও টিভি
দেখে। আমিও বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি এক এক
সময়। ভারতি মাসি চা এনে ডাকে। সন্ধের পর থেকে আবার ঘুম পেতে থাকে। ভারতি মাসি ঘুম
থেকে উঠিয়ে দুধ বা সুপ খাওয়ায়, ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়।
২
কাল রাতে একটা অদ্ভুত
কাণ্ড হয়েছে। লিখে রাখছি। তবে এর মধ্যে কোনও রহস্য
নেই। নেহাতই কাকতালীয় ঘটনা। রাতে আমার ঘুম ভালো হয়। সন্ধের পর থেকেই ঘুম ঘুম ভাব থাকে। নানা রকম ওষুধপত্র চলছে, তাই হয়তো এমন ঘুম চলে আসে। এই রাতেও আমি ঘুমোচ্ছিলাম। প্রায় বারোটা হবে। জানলায় একটা কর্কশ কিচকিচ শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে
গেল। চোখ চলে গেল জানলায়। পর্দাটা একটু সরে গেছিল। একটা কালো বিড়ালের
মতো কিছু
জানলায় উঠে এসেছে। কাচের পাল্লাগুলো বন্ধ, তাই ও
ভেতরে আসতে পারবে না। কিন্ত দৃশ্যটা ভয়ানক ছিল। বিড়ালের থেকে জন্তুটা আকারে অনেক বড়ো। আমাকে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে দেখতে
লাগল। বিচ্ছিরিভাবে দাঁত বার করল, তারপর
একটা থাবা দিয়ে জানলার কাচে আঘাত করল। মুখ দিয়ে সে একটা কর্কশ শব্দ করেই চলেছে।
আমি চেঁচিয়ে উঠতেই জন্তুটা পালাল। রাত্তিরে ঘুম হল না। পরের দিন বিকেল সাড়ে চারটের
সময় সোনালিদি আমার ঘরে এল। বেরোবার আগে কিছুক্ষণ
আমার সঙ্গে গল্প করে যায়। দিদিকে গতকাল রাত্তিরের কথা বলতেই সে হেসে ফেলল। “আরে এখানে ভামের উৎপাত খুব। তোর ঘরের টেবিলে পাকা ফল ছিল, গন্ধ পেয়ে এসেছে নির্ঘাত।” সত্যি
টেবিলে পাকা আম ছিল। দিদিই এনে দিয়েছিল আমায়। কিন্তু এয়ারকন্ডিশন করা ঘর চারদিক
বন্ধ, ফলের গন্ধ বাইরে গেল কী করে বুঝলাম
না। এখানে অনেক কিছুই খুব অদ্ভুত। যেমন একদিন রাত্তিরে ঘরের পর্দা হাওয়ায় দুলছিল।
কিন্তু বাইরে থেকে ঘরে হাওয়া আসেই না। সব দিক আটকানো। অথচ মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে
যেন হাওয়া বইছে। বেডসাইড টেবিল মৃদু মৃদু কাঁপছিল। জলের গ্লাসের টুং টাং শব্দ আর
উইন্ড চাইম ও দুলছিল টিং টিং করে। ভূমিকম্প হচ্ছিল নিশ্চয়ই। পরের দিন ভারতিমাসিকে
বলতেই মাসি বলে উঠল, “হ্যাঁ, কাল ভূমিকম্প হয়েছিল সামান্য।” মনে হল মিথ্যে বলছে। এত সামান্য ব্যাপারে মিথ্যে বলবে!
৩
ডিয়ার ডায়েরি, তোমার সঙ্গে
আবার কথা গল্প করতে এলাম। এখন আমি অনেকটা
সুস্থ। নিজে নিজে হাঁটা চলা করতে পারি ধীরে ধীরে। সোনালিদির বাড়িটা খুব সুন্দর।
সামনে পেছনে বাগান আছে। ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করি বিকেলের দিকে। ভারতি মাসি সঙ্গে
থাকে। দিদিও আমার শরীর ভালো হচ্ছে
দেখে খুব খুশি। আমার জন্য অনেক করছে। দিদির ঘরের দেওয়ালে দুটো বড়ো বড়ো ছবি আছে দিদির মা আর বাবার।
দুজনেই অনেকদিন গত হয়েছেন। ভারতি মাসি দীর্ঘ দশ বছর দিদিকে দেখাশোনা করছে নিজের
মায়ের মতো। দিদির বয়স চব্বিশ পঁচিশের বেশি
হবে না। আমার কুড়ি চলছে। আজ আমি ডায়েরিকে সত্যি কথা বলব একটা। আমি একটা নাটক চালাচ্ছি। আসলে আমার
স্মৃতি নষ্ট হয়নি। শুধু অ্যাক্সিডেন্টের জন্য কিছুদিন মরচে ধরে গেছিল। ছেলেবেলা
থেকে আমার মা বাবা কেউ নেই। মামা-মামির
কাছে মানুষ। ওদের অত্যাচারে আর টিকতে
পারছিলাম না। একদিন মামার গাড়ি করে মামির সঙ্গে যাচ্ছিলাম রানাঘাটে এক আশ্রমে।
মামির গুরুদেবের আশ্রম। আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল সম্বন্ধ দেখানোর জন্য। গুরুদেব আমার
জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে তারা। এই সময় এই
অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে। আর এটা আমার কাছে দুর্ঘটনা নয়। ভালো ঘটনা। এর পর থেকেই আমার জীবনে খুশির হাওয়া বইতে থাকে। দিদিকে পেলাম, ভারতি মাসিকে পেলাম। এখন কত্ত বই পড়ি। বাগান করি, রান্না করি, এক কথায় আমি ভালোই আছি। তবে দিদি আমাকে বাইরে বেরোতে দেয় না। এই একটাই ব্যাপার আমার ভালো লাগে না। হয়তো ভাবে যে আমি এখনও সুস্থ হইনি, এটা কোন জায়গা বুঝতে পারি না। দিদিকে বেশি পীড়াপীড়ি করতে পারি না, যদি
দিদির মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয়। আমাকে আবার
আমার বাড়িতে ফিরে আসতে হয়!
৪
কাল দুপুরে একটা কাজ
করেছি। ভারতি মাসি ঘুমোচ্ছিল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর।
আমি বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিলাম। নিজে নিজে বাইরে সদর দরজা খুলে মোরাম বিছানো পথ
দিয়ে হেঁটে গেট পেরিয়ে বাইরে এলাম। কৃষ্ণচূড়ায় এত ফুল
এসেছে যে পাতা দেখা যাচ্ছে না। আমি হাত বাড়িয়ে নিচে পড়ে থাকা কিছু ফুল কুড়িয়ে
নিলাম। তারপর আবার সেগুলো ছুঁড়ে দিলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। কোথাও কোনও বাড়ি ঘর চোখে পড়ছে না। সবুজে সবুজ চারিদিকে। একটা দিঘিতে জল টলটল করছে। চারিদিকে শান্তি বিরাজ করছে। কোথাও কোনও গোলমাল নেই। রোদ্দুর এখানে গায়ে জ্বালা ধরায় না। বরং গায়ে শান্তির প্রলেপ মাখিয়ে দেয়। এই রকম মায়াবী রোদ্দুর আগে কখনও দেখিনি। ঘু ঘু পাখি ডেকে চলেছে একটানা। আমি
একটা বড়ো গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম। আহ কী শান্তি! চোখ বুজে গেল আরামে। হঠাৎ মনে হল কেউ আমার পিঠে হাত রেখেছে। চোখ
খুলে দেখি একজন ভদ্রমহিলা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। বেশ সুন্দরী
তিনি, পরনে লাল রঙের শাড়ি। বলল, “আমি কায়রা। তুমি সোনালিদের বাড়িতে
নতুন এসেছ না! তোমাকে ছাদ থেকে দেখি। তুমি কে হও?”
আমি ওর বোন হই। মনে মনে
ভাবছিলাম দিদির বাড়ির ছাদ থেকে তো কোনও বাড়ি ঘর
দেখা যায় না। এক সেই ভাঙা কেল্লা বা ক্যাসেল বাড়ি ছাড়া। তাও ওটা অনেক দূর। কায়রা
আমাকে কীভাবে দেখল!
কায়রা বলল, “আমার বাড়ি চল।” আমার হাত
ধরে টান দিল। বলল, “তুমি সোনালির
বোন যখন, তখন আমারও বোন। ও আমার খুব ভালো বন্ধু।” আমি সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, এমন সময়
ভারতি মাসি চলে এল। কায়রার মুখ শুকিয়ে গেল মনে হল। আমাকে দেখে ভারতি মাসি বলল, “তুমি এখানে কী করছ? তোমায় বাড়িতে কত খুঁজলাম!” কায়রার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে ভারতি মাসি আমার হাত
ধরে টানতে টানতে ফিরিয়ে আনল বাড়িতে। বলল, “অমন আর
কখনও বেরুবে না। দিদি শুনলে রাগ করবে।”
আমি বললাম, “কায়রা তো দিদির বন্ধু। গেলে কী হত?”
“তোমার
দিদি এসব পছন্দ করে না। না বলে কখনও এমন বেরুবে না।” ভারতি মাসি আর দিদিকে আমার সামনে কিছু বলেনি। কিন্তু এই জায়গাটা খুব
সুন্দর। আবহাওয়াও খুব চমৎকার। এই জায়গার নাম এখনও জানি না। বাড়িতে কোনও পেপারও আসে না। টিভিতে যে
চ্যানেলগুলো চলে তার নামগুলোও অন্য রকম। আমার পরিচিত কোনও চ্যানেল নেই। কোন সিরিয়ালও নেই। ডিসকাভারি চ্যানেলের মতো একটা চ্যানেল চলে। ভারতি মাসি এটাই দেখে। এইভাবে বাড়িতে বসে থাকতে ইচ্ছে
করে না। আমাকে কেউ কোথাও নিয়েও যায় না। কায়রার সঙ্গে একদিন দেখা করতেই হবে।
৫
কায়রার সঙ্গে একদিন ভাগ্যক্রমে
দেখা হয়ে গেল। আমি দুপুরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ভারতি মাসি দুপুরে একটু শুয়েছে।
রাস্তায় কোনও লোকজন নেই। কোনও বাড়িঘর নেই। বড়ো বড়ো গাছে ঘেরা কোনও বনপথ ধরে চলছি তো চলছি। সেই ভাঙা
কেল্লার দিকে চলেছি। খুব কাছে এসে গেছি। কায়রাকে সেই ভাঙা কেল্লা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। যেন আমারই অপেক্ষা করছিল। আমার হাত ধরে
ভেতরে নিয়ে গেল। আজ সে একটা কালো রঙের পোশাক পরে আছে। পুরোনো ক্যাসলের আদলে তৈরি একটা বাড়ি। মানে একটা দুর্গ। যেন ইতিহাস বই-এর পাতা থেকে উঠে এসেছে। কায়রা বলল, “তোমাকে আমি ছাদ থেকে আসতে দেখেছি।”
মনে মনে ভাবলাম, কায়রা নিশ্চয় দূরবিন ব্যবহার
করে। আমি ছাদে যেতে চাইলাম। কায়রা আমাকে নিয়ে গেল। অতগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠল তরতরিয়ে। আমি ক্লান্ত, কিন্তু কায়রা অভ্যস্ত। তাই সে একটুও ক্লান্ত নয়।
আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার বাড়িতে আর কে কে থাকে?”
“এখন আমি
একাই থাকি। আমার বাবা মা গেছে দিদির বাড়ি। বেশ কিছুদিন পর ফিরবে। আমি কলেজে পড়াই।
সামনে একজাম, তাই যেতে পারলাম না।”
“তোমার
দিদি কোথায় থাকে? তুমি কলেজে কী পড়াও?”
“আমার সাবজেক্ট
সাইকোলজি। দিদি ইংল্যান্ডে থাকে। তুমি কী চা খাবে, না কোল্ড কিছু?”
“এখানে
গরম ভাব নেই। তাও কোল্ড কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।”
কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর ক্যান হাতে নিয়েই কায়রা আমায় ক্যাসেল দেখিয়ে দিল। এই কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর কোম্পানিও আমার চেনা নয়। স্বাদ বেশ ভালো। মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই গেল। কায়রা অনেক গল্প বলল। একটা ঘরে অনেক
বাদুড় দেখলাম। এই ঘর মনে হয় এরা ব্যবহার করে না। আমার মনের মধ্যে অনেকদিনের জমে
থাকা প্রশ্নটা এবার করে ফেললাম, “এই
জায়গার নাম কী?”
কায়রা হেসে বলল, “সেকি! তোমার দিদির বাড়ি কোন
জায়গায় জান না?”
আমি সব খুলেই বললাম। শুধু
আমার স্মৃতি যে ফিরে এসেছে সেটা বললাম না।
কায়রা বলল, “তোমায় প্রথম দিন দেখেই বুঝে গেছি। তুমি আমাদের মতো কেউ নও।”
আমার গা ছম ছম করে উঠল।
আমাদের মতো মানে ও কী বলতে চাইছে? কায়রাকে
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “বাদ দাও
এই সব প্রসঙ্গ। এই ক্যাসেলের পেছনে বাগানে কবরখানা আছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের, দেখবে?”
আমি বললাম, “আরেকদিন হবে। আজ যাই, অনেকক্ষণ এসেছি।”
কায়রা ওর বাইকে বসিয়ে
আমাকে পৌঁছে দিল। ভারতি মাসি বারান্দায় ছিল। আমাদের দেখে এগিয়ে এল। ভাবলাম আজ খুব
বকা খাব। কিন্তু সে সব কিছুই হল না। ভারতি মাসি ডিনারের
সময় বলল, “কায়রার
থেকে দূরে থেকো। আমাকে না বলে রোজ
বেড়াতে যাও, তোমার দিদিকে এখনও বলিনি।
কারণ আমি বুঝি তোমার সব সময় বাড়ি থাকতে ভালো লাগে না।”
আমি বললাম, “কায়রার কী সমস্যা আছে?”
“এমনিতে
কিছু সমস্যা নেই। তবে ও ডাকিনী। ও উইচ। আমাদের মতো নয়। খুব সাবধান। ওর ওই বাড়ি দেখে কিছুই বুঝতে পারোনি?”
“বাড়িটা
রহস্যময় ঠিকই। কিন্তু তাই বলে ডাকিনী!”
“নিশ্চিত
করে বলতে পারব না, তবে মেয়েটি খুব ছিটিয়াল। কী সব
চর্চা করে। ওদের গোটা পরিবারটাই ডাকিনী বিদ্যার
চর্চা করে।”
কায়রা সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করার ইচ্ছে ছিল। কিন্ত মাসি আর মুখ খুলল না। চা করতে চলে গেল।
৬
দিদি আমায় একটা মোবাইল ফোন
কিনে দিয়েছিল। কায়রার সঙ্গে কিছুক্ষণ মেসেজ চালাচালি করলাম। এখানে আবার নেট ভালো চলে না। কায়রা আমাকে মেসেজে লিখেছে, তোমার
দিদির থেকে সাবধানে থেকো। সে কিন্তু মানুষ নয়। আমার কথা যদি অবিশ্বাস কর তাহলে
পস্তাবে।
আমি টাইপ করলাম, মানুষ নয় তবে কী?
উত্তর এল, নিজেই দেখে নিও।
এই রকম মেসেজ পেয়েও ভয়
পেলাম না, ভাবলাম দিদিকে আর মাসিকে ভালো করে
লক্ষ করতে হবে। এবং সেটা শুরু হবে আজ থেকেই। একটা কিছু গোলমাল যে আছে সেটা আমি
নিজেও বুঝতে পেরেছি। কোনও মানুষের রাজ্যে এত নীরবতা এত
শান্তি বিরাজ করে না। রোজ সন্ধে হলেই ঘুম পায় আমার। আজকেও যখন ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল, এক কাজ করলাম। সেফটিপিন ফুটিয়ে দিলাম আঙ্গুলে। এতে একটা কাজ হল, ঘুম ঘুম ভাবটা চলে গেল। যতবার ঘুম এসেছে এই টেকনিক প্রয়োগ করেছি। আর তাতেই
দেখতে পেলাম লুকিয়ে থাকা এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য রহস্য। রাত্তিরে বিশাল বড়ো চাঁদ উঠেছে। কুকুরগুলো বিশ্রি ভাবে
ডাকাডাকি করছে। বাগানের নারকেল গাছের
পাতার ফাঁক দিয়ে গোল থালার মতো চাঁদ
দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ বই পড়লাম। সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। জোর বাতাস বইলে
আমার খুব আনন্দ হয় আগেও লক্ষ করেছি। আজকেও খুব আনন্দ হচ্ছে। শরীরে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। জানলা খুলে দিলাম। হাওয়া এসে সব জিনিসপত্র নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
উইন্ড চাইম খুব জোরে দোল খাচ্ছে আর শব্দ হচ্ছে টিংলিং। আমি আমার পাশের ঘরে গিয়ে
লুকিয়ে রইলাম বিছানার তলায়। এটাই দিদির ঘর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘরের আলো নেভানো। ছোট্ট একটা ডিম লাইট জ্বলছে।
হাওয়ার সঙ্গে মিষ্টি লেবুফুলের গন্ধ আসছে। রাত প্রায় তিনটে হবে। কাচের জানলায় একটা
শব্দ শুনে সেই দিকে লক্ষ করলাম। একটা বিশাল আকারের বাদুড় মুখ দিয়ে জানলার পাল্লা
টেনে সরিয়ে দিল। তারপর সেটা ভেতরে ঢুকল। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মানুষের
মতো। যেন কত ক্লান্ত। আমি এত ভয়
পেয়েছি যে খাটের তলা থেকে বেরোলাম না।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল যখন, দেখলাম বিছানায় দিদি ঘুমিয়ে আছে। গায়ে একটা ব্ল্যাক নাইটি। ঠোঁটের কোণে
লালচে রক্তের ধারা। খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরে এলাম।
দিদির ঘর ভীষণ ঠাণ্ডা আর অন্ধকার।
৭
ঘর থেকে বেরিয়েই দেখলাম
সদর দরজা খোলা। ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ছুটতে ছুটতে অনেকদূর এগিয়ে গেলাম। একটা ঘন
বনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। এই জঙ্গল থেকে আর বেরোতে পারছি না। কাঁটা লেগে জামা কাপড় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত-পাও ক্ষতবিক্ষত। একটু জল পাচ্ছি না কোথাও। এখান থেকে কী ভাবে বেরোব! আবার জোর হাওয়া দিচ্ছে। গাছপালাগুলো
দুলছে। জোর ঝড় আসবে নিশ্চয়। শুকনো পাতা উড়ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক টুকরো
কালো মেঘ অনেক নিচ দিয়ে চলেছে। মেঘটা আরও নিচে নামল। এ তো মেঘ নয়। কায়রা! একটা
ঝাঁটায় বসে উড়ছে, পরনের কালো ওড়না বাতাসে দুলছে।
তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। যখন চোখ মেললাম দেখলাম দিদি, কায়রা আর ভারতি মাসি
আমার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের তিনজনেরই পরনে কালো পোশাক। চোখগুলো জ্বলছে। আগুন
জ্বলছে একদিকে। তিনজনে দুর্বোধ্য ভাষায় দুলে দুলে গান করতে শুরু করল। আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
এক বছর পর
ডিয়ার ডায়েরি, এক বছর পর
তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে। মনের কথা তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে ভালো লাগে। নানা কারণে আর হয়ে ওঠে না। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখছিলাম। প্রিন্সেপ ঘাটে বেড়াতে এসেছি। মেয়েটিকে এখানেই দেখলাম। একে দেখেই মনে হল মনের মধ্যে একটা কষ্ট
নিয়ে রয়েছে। সৎ মায়ের অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠেছে ওর কাছে। এক সময় আমিও ওর মতো অনেক কষ্ট পেয়েছি। মনে হচ্ছে ও সুইসাইড করতেই এসেছে। বা আর ক’দিনের মধ্যে করবে। এখন আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। যখন মানুষ ছিলাম, এত ক্ষমতা আমার ছিল না। ওর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। আলাপ জমাতে হবে। তারপর
ওকে আমাদের দলে নিয়ে নেব। আমার মতো একজন
আধুনিক পোশাক পরা ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার
মেয়েকে দেখে ও মুখ তুলে তাকাল। আমি হাসলাম। কথা শুরু করলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
এই মানুষের রাজ্য, এই দুঃখের জগত থেকে অনেক দূরে ওকে নিয়ে যাব। আমাদেরও তো সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। না হলে যে লুপ্ত হয়ে যাব। সেই
দিনে আমায় উইচে পরিণত করে কায়রা,
সোনালিদি আর মাসি। কায়রা আর দিদি অনেক দিনের বন্ধু। মাসিও তাই। এদের বয়স অনেক।
হাজার তো হবেই। এরা ইচ্ছেমতো যে কোনও রূপ ধারণ করতে পারে। মাঝে মাঝে একটু রক্ত না হলে এদের চলে না। তবে রক্ত
তৃষা মেটাবার জন্য শুধু পাখি বা অন্য জীবের সাহায্য নেয়। মানুষরাও তো মাংস খায়।
ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই। আমরা উইচ হলেও কারোর ক্ষতি করি না, কথায় কথায় ঝগড়া করি না,
কাউকে জোর করে দলে টানি না, নিজেদের
মতো করে বাঁচি এবং ভালো থাকি। মানুষদের থেকে আমরা অনেক, অনেক
ভালো।
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ
গা ছমছমে অভিজ্ঞতা!
ReplyDeleteসাংঘাতিক! গল্পটা প্রথম থেকে খুব টানটান লেগেছে। খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteঅন্যরকম ভালোলাগা
ReplyDeleteআমি আর জানালা খুলবো না, তিন সত্যি
ReplyDelete😱😱
ReplyDeleteasadharan
ReplyDeleteThank you thank you :)
ReplyDelete