নীল অক্ষর
রুমেলা দাশ
অমিয়বাবু, মানে অমিয় সরকার।
খামখেয়ালি, বেজায় অলস মানুষ। বয়স বেড়েছে। পাক ধরেছে চুলে, কলমেও। নয়
নয় করে লেখারও বয়স হয়েছে, বছর ত্রিশ কি তারও বেশি। কাজ বলতে
ওটুকুই। কম বয়সে বাবার তাড়নায় একটা মুদি দোকান খুলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু
সকাল-বিকেল দোকান খোলায় অনীহা, অনিয়মিত যাতায়াতে ব্যাবসা পাততাড়ি গোটায়। টিকে যায়
লেখার নেশা। লেখা দিয়ে রোজগার? বেজায় কষ্টের! টেনেটুনে চলে সংসার। মাঝে মধ্যে
এপাড়া ওপাড়া থেকে যেচে কেউ পড়তে এলে সেটা উপরি পাওনাই। অমিয়বাবু এতেই খুশি। এই তো
বেশ! স্ত্রী, আর তিনি মাত্র দুটি তো প্রাণী। সন্তান নেই।
দেখতে দেখতে সময় এগিয়েছে আরও খানিকটা।
আদি কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের রায় স্ট্রিটের দেড় কাঠা জমিতে দু-কামরার পৈতৃক বাড়ি
এখন শুধু খাঁ খাঁ করে। লতিকা গত হয়েছে তিন বছর হল। সকালে উঠে বাজার করার কাজও আর নেই।
নেই তেমন তাগাদাও। গিন্নি থাকাকালীন পড়শিরা গল্পের আসর বসাতে আসত। চলত টুকটাক
হাসি মশকরা। কিন্তু ইদানীং এমনতরো বেরসিক বুড়োর কাছে আর কেই বা আসবে! তবে ঘোষপাড়ার
গৌর, প্রাণবন্ধু, শিবপ্রসাদরা আসে। আসে দু-এক সম্পাদক
যাঁরা নেহাতই একটু সেকেলে ঘেঁষা। বলা যায়, অমিয়বাবুর লেখাই তাঁদের আসতে বাধ্য
করে। শিশু-কিশোর গল্পের বেশ একটা সাদাসিধে দিক তাঁর বেশ জনপ্রিয়
স্কুলপড়ুয়াদের কাছে। সেসব নিয়েই চলে আলোচনা, আবার কখনও ঘোর সমালোচনা।
তর্ক-বিতর্ক করতে ভালো না লাগলেও চুপচাপ বসে শুনে যান তিনিও।
আজ রবিবার। রুনির হোটেল থেকে
ফিরে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে! টানটান হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। আলসে একটা
অলসতা ঘুরপাক খাচ্ছে শরীর জুড়ে। বয়সটা যে বাড়ছে, এসবেই তা জানান দেয়। কিন্তু
এ সমস্ত প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। নয়তো ক্লান্তি আর আরাম মাথায় চেপে বসে
তাঁর আগামী দিনের কাজগুলোকে পণ্ড করবে।
হাতে দুটো বড়ো গল্প শেষ
করার তাড়া। সামনে বইমেলা। তাই শীত সংখ্যার চাপ কিছুটা তো রয়েইছে। কোনোমতে শরীরটাকে
টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে এলেন। হাত ভাঁজ করে ঘুম তাড়িয়ে চেয়ার টেনে বসলেন জানালার
পাশটাতে। আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলো নাক তুলে দাঁড়ালেও দক্ষিণের এ দিকটা দিয়ে আলোবাতাস
ভালোই আসে। কোনাচে রোদের লম্বা রেখা এসে পড়েছে তাঁর খোলা পাতার উপর। লিখতে শুরু করলেন।
কেমন ভ্যাপসা গন্ধ ঘরের চারপাশটায়। মনে মনে ভাবলেন, অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি
সেই কারণেই হয়তো! উঠে গিয়ে জানালা-দরজা খুলে দেবার ইচ্ছেটাও নেই। লিখতে বসার আলো তো পাওয়া
গেছে! আজকালকার লেখকরা বেশ কম্প্যাক্ট লিখছে, 'রঙিন' পত্রিকার
সম্পাদক এমনটাই বলেছে, তাই কেটেকুটে ছোটো করে আনছেন বাক্যগুলো। ষষ্ঠ
পরিচ্ছদের শেষের দিকে..... আর ঠিক তখনই একটা আবছা ছায়া। খাতার পাতার
মাঝখানটাতে। পিছনের ঝোপঝাড়টায় তেমন কোনও দীর্ঘ গাছও তো নেই যার ছায়া
পড়বে! বার দুই-তিন ছায়াটাকে এড়িয়ে খাতাটা পাতলা আলোর রেখা বরাবর
আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কই? এ ছায়া তো আরও আরও ঘন হয়ে আসছে।
প্রকট হচ্ছে। জমাট বাঁধছে। অমিয়বাবু হাত বাড়িয়ে জানালার পাল্লাটা আরও একটু ফাঁক
করতে যাবার মুহূর্তেই খাতার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। সামান্য নড়েও উঠল যেন।
সাদা পাতার একটু একটু করে গ্রাস করে টেবিল, লাগোয়া দেওয়াল..... সমগ্রটা
জুড়ে! খুব ক্ষীণ চাপা স্বর। থেমে থেমে। বারে বারে। চাপা ঘড়ঘড়ে আর্তনাদ
যেন!
ম্যা.....অ্যা......অ্যাও.......!!!
শিউরে উঠলেন অমিয়বাবু। তাঁর
চোখ চলে গেল সরাসরি জানালার ওপারে বাইরের দিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল
ঠান্ডা চোরা স্রোত। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকলেন। শুধু তাকিয়েই থাকলেন। চোখ দুটো
জ্বালা করছে ক্রমশঃ.......!
“কী মশাই! আপনি তো রাতারাতি
বিখ্যাত হয়ে গেলেন!” (হাঁক পাড়ল সুবিমল)
“কেন কী হয়েছে?” (অমিয়বাবুর
নিষ্প্রভ উত্তর)
“আপনি তো জ্যোতিষী হয়ে গেছেন!
একেবারে যা বলছেন, যা লিখছেন...!” (ভাঙা দাঁতের ফাঁকে
সুবিমলবাবু হিলহিলে হাসি দিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে)
“জ্যোতিষী! পাগল হলেন নাকি!!
কী হয়েছে বলবেন?”
“রোসো ভায়া রোসো। এত ব্যস্ততা
কীসের? দেখবেন কিছুদিন বাদেই হাত দেখাতে এমনিতেই আপনার ঘর
ভর্তি লোক চলে আসছে।”
“মেলা বকবেন না তো!”
“আরে, বকছেন তো আপনিই। মিত্তির
বাড়ির ঘটনাটা এমন হুবহু লিখলেন কী করে বলুন তো! মানে আগে থেকে কিছু জানতে
পেরেছিলেন? আপনি তো ঘরেই থাকেন! তেমন মেশেন না তো কারুর সঙ্গে!
তবে??”
“মানে?”
“মানেটা তো আপনিই জানেন!”
“ঝেড়ে কাশুন তো।”
“আরে, ঘটনার ঠিক দু-দিন আগেই তো রবিবারের
কাগজে আপনার গল্পটা বেরোল। হুবহু মিত্তিরবাড়ির ঘটনা, এমনকি নামেরও মিল। কী করে
জানলেন এসব হবে? গোয়েন্দা লাগিয়েছেন নাকি! হি...হি...,” আবারও
সুবিমল সমাদ্দারের সশব্দ হাসি।
অমিয়বাবু বিরক্তি প্রকাশ
করে বললেন, “আপনি কী বলছেন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“আহা! চটে যাচ্ছেন কেন! এই তো আজকের
কাগজের ৪ নম্বর পাতার প্রথম খবরটা পড়লেই বুঝতে পারবেন - এই দেখুন।” (ভদ্রলোক
হাতের কাগজটা এগিয়ে দিলেন)
অমিয়বাবু দেখলেন, পরপর
চারটে লাইন। সকালের রোদটা বেশ খানিকটা কড়া হয়ে উঠেছে। পিঠ জ্বালা করছে। সেই ঠান্ডা
চোরা স্রোতটা আবারও শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে শুরু করেছে! কিছুতেই আটকে রাখতে পারছেন না
নিজেকে! স্পষ্ট হয়ে উঠছে তিনটে শব্দ...
আত্মহত্যা... বিষ... মিত্তির
বাড়ির বড়ো বৌ!
আজ নিয়ে তিনটে ঘটনা। তিনটেরই
অস্বাভাবিক রকমের মিল। পাড়ায় বেরোলেই সবাই তাকায়। ছেলেছোকরার দলও টিটকিরি দিতে
শুরু করেছে। যারা কখনও জিজ্ঞেস করত ‘কী কাকু
আজ কী গল্প লিখলে?’ কিংবা ‘পুজো সংখ্যার গল্পটা কিন্তু
আমরা আগে থেকেই শুনে নেব!’ সবার সঙ্গে মিশে না গেলেও, দু-একটা ছেলেপুলের বায়নার
চোটে দিয়েও দিয়েছেন কখনও কিছু গল্প। শিশুমনের সরল আদর পেতে চেয়েছেন
অজান্তেই। হয়তো নিজের ভালোলাগা থেকেই। কিন্তু আজ! সামান্য কলম ধরার সাহসটুকু
পর্যন্ত হারিয়েছেন। নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ কোন রহস্য, এ কোন
জালে জড়িয়ে পড়ছেন তিনি! প্রতিটা মুহূর্ত এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে কাটছে! কিচ্ছু ভালো
লাগছে না।
মিত্তির বাড়ির আত্মহত্যার
ঘটনাটা নেহাত কোয়েন্সিডেন্স ধরে নিলেও, সেদিনের শর্মার দোকানের চুরি, ভাড়াটে
শাহুর ছোটো মেয়ে নিখোঁজ - সবই একের পর এক তাঁরই কলম
দিয়ে বেরিয়েছে। অথচ তিনি এগুলো কিছুই ভাবতে চাননি, লেখা তো দূরঅস্ত। তাও ঘটনার
ঠিক আগেই। যন্ত্রচালিতের মতো এক অতি অলৌকিক ঘটে চলেছে তাঁর সঙ্গে। গৌরবাবু তো
সেদিন বলেই ফেললেন, ‘এবার তো মশাই আপনাকে পুলিশে খোঁজ করবে?’ সাদামাটা
উপাদান বরাবর তাঁর লেখার রসদ। অনেক ভেবেও কিছুতে কূলকিনারা করতে পারছেন না।
ভাবতে গেলেই যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যায় মাথার শিরা-উপশিরা। চোখ বুজলেই মনে পড়ে...
দুটো নীল চোখ....
কালো একটা শরীর, আর চাপা
আর্তনাদ... ম্যা....অ্যা....অ্যা.... ও।
আর নয়। আর এভাবে চলতে দেওয়া
যায় না। সবার চোখে সন্দেহভাজন হয়ে আর যাই হোক, সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচা
যায় না। অনেক অনুরোধ করার পর পত্রিকার সম্পাদক সুযোগ
দিয়েছেন, এই শেষ গল্প। যদি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে গল্প লিখতে
পারেন, তবেই গল্প দেবেন বলেছেন এমনটাও। চরম অপমানে, সমস্ত
স্নায়ু আজ ন্যুব্জ অমিয়বাবুর। তবু পারতে যে হবেই তাঁকে। এভাবে থেমে যেতে পারে না সব কিছু। ছোটো ছোটো অনেক
ভালোবাসা যে তিনি পেয়েছেন এই লেখাকে আঁকড়ে ধরেই। তাকে তিনি কোনোভাবেই হারাতে
পারবেন না।
আর আজ!
সেই কলমই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা
করল। উপায় একটা বাতলাতেই হবে। কোনও কিছুকেই আর এ ভাবে নষ্ট হতে দিতে পারেন না
তিনি। চোখের ফাঁদে আর পা দিতে রাজি নন। আজ পারতেই হবে! নিজেকে সংযত করেছেন অনেক
কষ্টে। জানালার কপাট বন্ধ করে নিজেকে স্থির রেখেছেন। রোজদিনের
চাহনি তাঁর জীবনে যে বিপদের ঝড় বয়ে এনেছে তা বাস্তব জীবনে উন্মাদের প্রলাপ হলেও, সত্যি.....
এটাই ঘোর সত্যি। কে বিশ্বাস করবে? কেউ মানবে না, কেউ না!
নাহ, আর ভাববেন না।
চারকোনা টেবিলের সামনে এসে বসলেন।
ডান হাতে শক্ত করে কলম ধরলেন। পাতা উলটে, সাদা
পাতার খানিকটা ছেড়ে শুরু করলেন আগামী সংখ্যার গল্প। কালো অক্ষরের গায়ে গায়ে ফুটে
উঠল কয়েকটা শব্দ, কয়েকটা লাইন, কয়েকটা বাক্য। হাতের কলম
ক্রমশঃ গাঢ় থেকে গাঢ় কালি ঢেলে যাচ্ছে পাতায়। কিছুতেই থামাতে পারছেন না। সর্বনাশ!
এ কীসের ইঙ্গিত?
প্রাণপণে ডান হাতটাকে চেপে
ধরলেন বাঁ হাত দিয়ে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে খামচে ধরতে চাইছেন কলমের শেষ
বিন্দুটাকে। থামছে না, কিছুতেই থামছে না অক্ষরগুলো। লিখে চলেছে, লিখেই
চলেছে। চিৎকার করতে চেষ্টা করছেন তিনি। গলার কাছে জমাট বেঁধে আছে কষ্টটা। কিছুতেই
একটা শব্দও বেরোচ্ছে না। কী করবেন তিনি। সমস্ত শরীর ঘেমে উঠেছে। শরীরের কোনায় মিশে
যাচ্ছে বিষ, গরল বিষ। নির্বাক প্রতিবন্ধীর মতো, অসহায়
শিরদাঁড়া। সোজা হওয়ার ক্ষমতাটুকু নেই।
.......কিছুক্ষণের
মধ্যেই দরজায় অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। অমিয়বাবুর শরীরটাকে স্ট্রেচারে করে তুলে
নিয়ে যাচ্ছে পাড়ার বল্টুরা। সবাই বলাবলি করছে, হয়তো হার্ট অ্যাটাক করেছে!
অমিয়বাবু সমস্ত সংযম হারিয়ে
চিৎকার করে উঠলেন, “আমি আর পারছি না। কেউ আছো? আমাকে
বাঁচাও!”
কেউ শুনতে পারল না তাঁর কথা।
কাউকে চেষ্টা করেও ছুঁতে পারলেন না তিনি। শুধু বন্ধ জানালার ওপার থেকে তিনি শুনতে
পেলেন একটা চাপা আর্তনাদ, ক্ষীণ গভীর অথচ বারে বারে ঘন ঘন....!
ম্যাও.......ম্যা.....ও!
একটা কালো ডাক।
একটা মৃত্যুর ডাক।
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ
বাপরে এবার কলম ধরতে ভয় করবে যে!
ReplyDeleteআমার লেখা স্বার্থক
Deleteবেশ ভয়ের আবহ তৈরী হয়েছিল গল্পটা পড়তে পড়তে। ভালো লাগল।
ReplyDeleteতুমি পড়েছো জেনে ভালো লাগলো
ReplyDeleteযাক বাবা আমি কলমে গল্প লিখিনা, নাহলে বোনের পালল্লায়য় পড়ে, শেষে ওপারে😶😆
ReplyDeleteকি যে বলো দাদা!
Deleteযাক বাবা আমি কলমে গল্প লিখিনা, নাহলে বোনের পালল্লায়য় পড়ে, শেষে ওপারে😶😆
ReplyDeleteখুব ভাল হয়েছে। লেখার সুন্দর ফ্লো।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ। এভাবে মতামত দেওয়ার জন্য
Delete