রহস্যময় দূরবিন
দেবদত্তা ব্যানার্জী
ফটোগ্ৰাফির শখটা আমার ছোটো থেকেই ছিল।
পার্টনারশিপে একটা হোটেলের ব্যাবসা করে পায়ের নিচের জমিটা একটু শক্ত করার ফাঁকে
শখের ফটো তোলাও চলছিল পাল্লা দিয়ে। পাখির ছবি তুলি মূলত। ধর্মতলায় একটা ক্যামেরার
দোকান থেকে একটা ভালো সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কিনেছিলাম। সস্তায় এতো ভালো ক্যামেরাটা
পাব কখনও ভাবিনি। এই দোকানটায় পুরোনো ভালো লেন্সের খোঁজে গেছিলাম একদিন। কিন্তু
পছন্দ মতো কিছুই পাচ্ছিলাম না। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ফিরেই আসছিলাম, হঠাৎ
শোকেসে রাখা একটা দূরবিন দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেক দিনের শখ এমন একটা দূরবীনের, আগামী
ট্যুরে পাখি খুঁজতে খুব কাজে দেবে। আমি প্রকৃতি দেখতে ভালোবাসি। কাউন্টারে গিয়ে
দূরবিনটা দেখতে চেয়েছিলাম একবার। টাক-মাথা লোকটা বড্ড ব্যস্ত।
আরেকজনকে ক্যামেরা দেখাচ্ছিল। আমি শোকেসটার সামনে গিয়ে দূরবিনটা ভালো করে লক্ষ্য
করছিলাম, এটাও পুরোনো। তবে দেখে দামী মনে হচ্ছিল।
“আপনি কি ওটা দেখতে চান?”
একটা একটু রিনরিনে মেয়ের গলা পেয়ে ফিরে তাকালাম। এল শেপের কাউন্টারের কোনায়
দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়স বাইশ-তেইশের একটি মেয়ে,
মনে হয় নেপালি। দেখতে বেশ
মিষ্টি। কিন্তু চোখ দুটো কেমন যেন। মুখে কোনও হাসি নেই, যা সেলসের মেয়েদের প্রথম
শর্ত।
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, “দেখতে চাই
একবার। যদি দামটা সাধ্যের মধ্যে হয় ....”
দূরবিনটা বের করে আমার হাতে দিয়ে ও বলল, “এসব
রেয়ার জিনিস, এখন আর পাওয়া যায় না।”
মেয়েটার চোখ দুটো ভারি অদ্ভুত। স্থির চাউনি, একটা
শিরশিরে অস্বস্তি পাক খাচ্ছিল শরীর জুড়ে। দাম বলল মাত্র পাঁচশো টাকা। দূরবিনটা ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে দেখে বেশ ভালো লাগল। বেশ পাওয়ারফুল মনে হল। কী মনে করে নিয়েই নিলাম দূরবিনটা।
এই দামে একটা খেলনা দূরবিনও হয় না। মেয়েটা খুশি হয়েছে মনে হল। বলল, “যত্নে রাখবেন
সার। রেয়ার পিস, সবাই পায় না এসব। এটা
আপনার জন্যই ছিল।” একটু মনে হল হাসল এবার।
বৃষ্টি ধরে গেছিল। আমিও বেরিয়ে এসেছিলাম।
মেট্রো ধরব বলে পাতাল প্রবেশ করলাম তাড়াতাড়ি। দমদমের ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি।
ফ্ল্যাটটা রাস্তার শেষ মাথায়। এই রাস্তায় একটা বড়ো বাগানবাড়ি পার করেই পর পর তিনটে
বিল্ডিং নিয়ে ছোটো একটা ক্যাম্পাস। সবাই কিনে রেখেছে। কেউ থাকে না। আমাদের
বিল্ডিং-এ দোতলায় একজোড়া বুড়ো-বুড়ি থাকে, আর চারতলায় আমি একা।
সেদিন সিঁড়ির লাইটটাও কেউ জ্বালেনি। দোতলায়
তালা, দেখলাম কেউ নেই। রাতে শোওয়ার আগে দূরবিনটা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম।
রাতেও বেশ পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। খুব দামী লেন্স বোঝা যাচ্ছে। দূরবীনের গায়ে এক
জায়গায় এম সি বলে লেখা। হয়তো মালিকের নামের অক্ষর। বারান্দার পাশের ঝাঁকড়া জারুল
গাছটায় কয়েকটা ঘুমন্ত পাখি চোখে পড়ল। দূরবিনটার লেন্সটার নাইট ভিসন মোড বেশ পাওয়ারফুল।
রাস্তার ধারের পাগলটা, কুকুরগুলো - সব দেখা
যাচ্ছিল। ঐ বাগানবাড়িটায় ফোকাস করেছিলাম। বড়ো বাড়ি, একসময়
কোনও বাবু শ্রেণীর লোকের কোঠা বাড়ি ছিল। বহুদিন ফাঁকা ছিল। তিনবছর ধরে এক বৃদ্ধ
ভদ্রলোক একাই থাকেন। রাস্তাঘাটে দু-চারবার দেখেছি। ঐ বাড়ির বাগানে একটা মেরুন অলটো
দাঁড়িয়ে ছিল। দূরবিনটা ঘোরাতে ঘোরাতে দোতলার খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি
দিয়েছিলাম। চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও আটকে গেছিল। বৃদ্ধ লোকটাকে দেওয়ালে চেপে ধরেছিল দু’জন।
আমাদের পাড়ার উঠতি মস্তান রাজু জোর করে ওনার টিপ সই নিচ্ছিল!! ও এখন প্রমোটারের ডান হাত শুনেছিলাম। সরাসরি তাকালে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, গাছের
আড়ালে ঐ জানালা ছাড়া। দূরবীনের মধ্য দিয়ে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম সবটা। এইবার
ওরা ফ্যানের সঙ্গে দড়ি ঝোলাচ্ছিল... বৃদ্ধকে লটকানোর জন্য... পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, অসহায় বৃদ্ধ কাঁপছিলেন
ভয়ে। ততক্ষণে দূরবিন ছেড়ে ফোন তুলে নিয়েছিলাম ডান হাতে। একশো ডায়াল করছিলাম, লাগছিল
না, নেটওয়ার্ক প্রবলেম তো লেগেই আছে। একটু বৃষ্টি হলেই ফোন দেহ
রাখে। দরকারের সময় এমনই হয়!! লোকাল থানার নম্বর ছিল। একবার
গেছিলাম একটা ফোন হারিয়ে ডায়রি করতে। ডায়াল করলাম। এত রাতে সেটাও কেউ তুলছে না!! দূরবিনটা হাতে নিয়ে আবার দেখতে চেষ্টা করলাম। ধুর, জানালা
বন্ধ কেন!! নিচের গাড়িটাও নেই। অথচ ঐ বাড়ি থেকে গাড়ি বার হলে সামনের
রাস্তা দিয়েই যেতে হবে!! এত তাড়াতাড়ি কী ভাবে সম্ভব
সেটা! এই তো কয়েক মিনিট আগেই ছিল। ফোন করতে করতেও আমি ওদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আগষ্ট মাস
হলেও বৃষ্টি হয়েছিল বলে বাতাসে শিরশিরে ভাব,
কিন্তু আমি ঘামছিলাম। এত
দ্রুত পর পর ঘটনাগুলো ঘটে গেছিল... কিন্তু আমি ঠিক মেলাতে
পারছিলাম না। দূরবিনটা দিয়ে আবার দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বন্ধ জানালা। একবার
ভাবলাম এগিয়ে যাই!! কিন্তু গাড়িটা কোথায় যেতে
পারে?
অনেক দূরে কোনও ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল।
মনটা বড্ড কু ডাকছিল। থানায় ফোন করে কী বলতাম জানি না। আমার মতো একটা যুবকের কথা
কেউ কী বিশ্বাস করবে? তবুও ফোনটা দু’বার হাতে
নিয়ে ডায়াল করলাম। নম্বরটা খারাপ নাকি!! কে জানে। বারান্দায় বসেই
সকাল হয়ে গেল। বোধহয় চোখটা লেগে গেছিল ভোরের দিকে। দূরবিনটা চোখে দিয়ে লাফিয়ে
উঠলাম। একি!! বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাদে
হাঁটছেন। দিব্যি সুস্থ, সবল। তবে আমি কি স্বপ্ন
দেখছিলাম রাতে!! হয়তো...
রাত জাগার ক্লান্তি আর ঠাণ্ডা বাতাসে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। এক কাপ
গরম কফি নিয়ে বসলাম। আমার ফ্ল্যাটের নিচেই একটা সবজির গাড়ি থেকে সবজি নিচ্ছেন
বৃদ্ধ। চোখাচোখি হতেই হাসলেন।
এরপর সারাদিনের ব্যস্ততায় ঘটনাটা ভুলেই
গেছিলাম। রাতে খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে ঐ বাড়ির সামনে জটলা দেখে চমকে
উঠেছিলাম যথারীতি। আমার আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে বৃদ্ধ মারা গেছিলেন। আত্মহত্যা!!
গলায় দড়ি দিয়েছেন বলছিল সবাই। ঘটনাটা আমার চোখে ভাসছিল তখনও। সবটাই আমি জানি!! কিন্তু কী করে প্রমাণ করব? কাকে বলব? কে
বিশ্বাস করবে আমার কথা? মস্তান রাজুর গাড়িটাও
দেখতে পেলাম ঢুকতে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছিলাম। রাজু বলছিল এক সপ্তাহ আগেই বৃদ্ধ
লোকটা বাড়ি ওকে বিক্রি করে দিয়েছে। ডাহা মিথ্যা কথা!! ইশ, থানায় কেন গেলাম না তখন!!
না,
কেউ বিশ্বাস করেনি আমার কথা।
একটা আঠাশ বছরের ছেলের কথার কী দাম আছে!!
থানা বলেছিল প্রমাণ আনতে।
আমার ঘর থেকে দেখেছি বললে হবে না। অবশ্য ঘটনাটা যে একদিন আগে দেখেছি তা বলিনি। আমি
নিজেও অবাক। তাই বেশি মাথা লাগাইনি আর। মনটা খচখচ করছিল শুধু। বৃদ্ধের অসহায় মুখটা
ভাসছিল খালি মনের ভেতর।
কাজের চাপে উত্তরবঙ্গ যেতে হয়েছিল দু’দিন
পরেই। একটা রিসর্ট কিনব কথা চলছিল। চারপাশে চা বাগান, চাপড়ামারির
জঙ্গল পার করে ভুটানের খুব কাছেই জায়গাটা। আদিবাসী এলাকা। শান্ত একটা নদী রয়েছে
পাশে। দূরবিনটা দিয়ে শেষ বিকেলের পাখি দেখছিলাম। আশপাশ দেখতে দেখতেই চোখে পড়েছিল
ধোঁয়ার কুণ্ডলী। একটা চার্চ পুড়ছে!!
মাঝবয়সি ফাদারকে ধরে বেঁধে
আগুন লাগিয়ে দিয়েছে তিন জন লোক!! নদীটার ওপারে চলে যাচ্ছে
লোকগুলো। মুখে কালো কাপড় বাঁধা, ছুটে যেতে গিয়ে ঘাবড়ে
গেছিলাম। কোথায় ধোঁয়া!! সামনের জঙ্গলের আড়ালে
ছোট্ট চার্চটা দাঁড়িয়ে ছিল অক্ষতভাবেই। ফাদারকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। একেই তো
দেখেছিলাম একটু আগে!! দূরবিনটার দিকে তাকিয়ে
ভাবছিলাম কী হচ্ছে এসব...।
দু-চারটে কথা বললাম ফাদারের সঙ্গে। একবার
ভাবলাম খুলে বলি সব। হয়তো উনি বুঝবেন। কিন্তু তখনই উনি একটা গাড়ি করে গ্ৰামে চলে
গেলেন কাজে। পরদিন সারাদিন কাজ করে রাতের ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরেছিলাম। বাড়ি ফিরে
সকালের পেপারের প্রথম পাতার খবর দেখে চমকে উঠলাম। আগের দিন সন্ধ্যায় কিছু জঙ্গি ঐ
চার্চ পুড়িয়ে দিয়েছিল। ফাদারকেও জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছিল ওরা। ঐ এলাকা এখন তুমুল উত্তপ্ত, গন্ডগোল
চলছে।
ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলাম এসব দেখেশুনে। ভয় পেয়ে
দূরবিনটা অফিসের ড্রয়ারে রেখেছিলাম। নিউটাউনে আমাদের পার্টনারশিপে বড়ো হোটেল
হচ্ছে। চারতলায় আমার অফিসঘর। পিছনে অনেকটা ফাঁকা জমি ঝোপঝাড়ে ভরা। তারপর কয়েকটা বড়ো
অফিস বিল্ডিং। অবশ্য দু-একজন ঐ পথে শর্টে বাসরাস্তায় যায়। সেদিন সন্ধ্যায় ড্রয়ারে
দূরবিনটা দেখে কী মনে হল!! হঠাৎ হাতে নিয়ে বাইরেটা
দেখছিলাম। পিছনের ঝোপটার কাছে দুটো লোক কিছু করছিল!! ভালো করে খেয়াল করতেই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। মুখে কিছু গুঁজে দিয়েছে। লোক দুটোকে স্পষ্ট দেখতে
পেলেও মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। একটা গাড়িতে মেয়েটাকে তুলল জোর করে। গাড়ির
নম্বরটা অবশ্য দেখতে পাইনি। ছুটে গেলে হয়তো মেয়েটা বাঁচবে!! দ্রুত নেমে পিছনে যেতে গিয়ে আমাদের বিল্ডিং-এর দুটো সিকিউরিটিকে ডেকে নিলাম।
কিন্তু কোথায় কী? ঝোপের ধারে একটা শেয়াল
আমাদের দেখে পালিয়ে গেল। কোনও গাড়ি নেই ওদিকে। এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাবে!! অফিসে বসে মন দিয়ে আগের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে মনে হল, সব যদি ঠিক হয় আগের
ঘটনা দুটো ঘটেছিল আমি দেখার চব্বিশ ঘণ্টা পরে। তাহলে পরদিন বিকেলটা খেয়াল করতে
হবে। পরদিন বিকেল চারটা থেকে উশখুশ করছি। সঠিক সময়ের পনেরো মিনিট আগেই নিচে নেমে
এসেছিলাম। ঝোপটার পাশেই যাব ভেবে এগোতেই আরশির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও আমার অফিসে এসেছিল একটা
কাজে। আরশি আমার বান্ধবী, ও জার্নালিষ্ট। ওর সঙ্গে
কেবিনে ফিরে এলাম আবার, মন পড়ে রইল ঝোপের ধারে।
আরশিকে খুলে বলতেও পারছি না, ও হাজারটা প্রশ্ন করবে
যেগুলোর সঠিক উত্তর জানি না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে পেছনে, আজ
বড্ড অন্ধকার ওদিকটায়। কী মনে করে দূরবিনটা শুধু আরশিকে দেখালাম। ও নেড়েচেড়ে ফেরত
দিল। বলল বড্ড ঝাপসা। আমি দু’বার চোখে দিয়ে পেছনটা দেখলাম। অন্ধকারে কিছুই বোঝা
গেল না। জোরে বৃষ্টি নামবে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসে
গুমোট ভাব। আরশির সঙ্গেই বেরিয়ে এলাম বাড়ির পথে। মনটা উশখুশ করতেই থাকল।
পরদিন অফিসে গিয়ে দেখি পুলিশ আর লেবারদের
জটলা। পাশের কল-সেন্টারের একটা মেয়েকে অপহরণ করে খুন করেছে
কারা!! কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে পিছন দিয়ে শর্টকাটে ওধারের
বড়ো রাস্তায় যাচ্ছিল মেয়েটা।
শরীর খারাপ লাগছিল। এসব কী শুরু হয়েছে!! আমি কেন সব জেনেও বাঁচাতে পারছি না কাউকে!!
বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে।
দূরবিনটা দেখেই ভয় পাচ্ছি।
একটু পরেই আরশি চলে এল। খুব উত্তেজিত। বলল,
কাল সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটেছে বৃষ্টি নামার আগেই। ও যখন আমার অফিসে ছিল। ও আপাতত কভার
করছে ঘটনাটা। ও বেরিয়ে যেতেই আমি দূরবিনটা নিয়ে ঐ দোকানে ছুটলাম। যে মেয়েটা বিক্রি করেছিল
তাকে দেখতে পেলাম না কোথাও। বাকি যে তিনজন ছিল কিছুই বলতে পারল না দূরবীনের ব্যাপারে। মেয়েটার খোঁজ
করতেই ওরা বলল ওদের দোকানে কোনও মেয়ে স্টাফ নেই। রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেল আমার সঙ্গে।
ভাবলাম বেচেই দেব ঐ আপদ। কিন্তু দুটো দোকানে দেখাতেই এক কথা বলল, ঝাপসা
কাচ, কিছুই নাকি দেখা যায় না ও দিয়ে। অথচ আমি পরিস্কার দেখতে
পাচ্ছি সব। এরপর ভয়ে আমি দূরবিনটা ধরতাম না বেশ কিছুদিন। কিন্তু একটা অপরাধবোধ আমায় কুরে কুরে
খেত। ব্যাবসা লাটে ওঠার জোগাড়। পার্টনাররা সব খাপ্পা। আমিও কেমন হয়ে গেছি। মাঝে
মাঝে স্বপ্নে মেয়েটাকে দেখি, করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কখনও
মনে হয় রেগে যাচ্ছে আমার উপর।
একটা ব্যাবসার কাজে সিকিম যাওয়ার কথা ছিল।
দূরবিনটা বের করে সঙ্গে নিয়েছিলাম কী মনে করে। চোখে লাগিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে
তাকিয়েছি। দেখলাম রাজু মস্তান আর দুটো ছেলের মধ্যে হাতাহাতি হচ্ছে। হঠাৎ রাজুর হাতে উঠে এল
অটোমেটিক পিস্তল। ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। পরিষ্কার চারপাশ। রাস্তায় কেউ নেই, শুনশান
রাত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ নিয়ে বার হলাম। মাঝ রাতে আমার স্পেশাল ট্রেন
কলকাতা স্টেশন থেকে। দু’দিন পর টিভিতে দেখলাম খবরটা। দুটো ছেলে খুন হয়েছে আমাদের
পাড়ায়। মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার। ফেলেই দেব ভেবেছি দূরবিনটা। কিছুই যদি করতে না
পারি, ওটা রেখে কী লাভ!! একের পর এক অন্যায় হবে আর
আমি দেখেও বসে থাকব!! নিজের বিবেকের কাছে কী
কৈফিয়ত দেব?
হোটেলটা গ্ৰামের শেষ মাথায়। ঘুরে ঘুরে
দেখছিলাম জায়গাটা। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। গলায় আমার সেই অভিশপ্ত দূরবিন।
দু’বার চোখে দিয়ে পাহাড়ের মাথায় কী একটা রয়েছে মনে হল। এগিয়ে চলেছি চড়াই ধরে। একটা
গ্ৰামের বুড়ো লোক আমায় অবাক হয়ে দেখছিল। পথে লোকজন নেই। এই বুড়োটার বয়স যদি তিনশো
বছর বলে আমি অবাক হব না। চামড়া কুঁচকে শিলালিপি হয়ে গেছে। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে
মাথা।
পাহাড়ের মাথায় এমন একটা পাথুরে দুর্গ আছে
বুড়োটা না বললে জানতেই পারতাম না কখনও। বেশ লাগছিল ঘুরে ঘুরে দেখতে। পাথর আর কাঠ
দিয়ে তৈরি রাজবাড়ির ভগ্নাবশেষ। আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ চারপাশ। একটা পাখিও চোখে পড়ে
না। ট্যুরিস্টও নেই তেমন। অবশ্য সিকিমের এই গ্ৰাম এখনও পর্যটকদের মানচিত্রে জায়গা
করে নেয়নি। আমিও এসেছি একটা রিসর্টের জন্য প্রপার্টির খোঁজে। কিন্তু এই জায়গাটা
কেমন যেন গুমোট, শ্মশানের নিস্তব্ধতাকে মনে করায়। ও ধারে একটা
পায়ে চলা পথ নেমে গেছে খাদের গভীরে। উলটোদিকের পাহাড়টা দেখতে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া।
একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল, এই পাহাড়ে একটাও রডোডেনড্রন
বা প্রিমুলা ফোটেনি কোথাও। কোনও জংলী ফুলও চোখে পড়ল না। এই মে মাসে পাহাড়ে যখন
ফুলের বন্যা, এই জায়গাটা কেন ব্যতিক্রম বুঝতে পারলাম না। সবুজ ঘাসজমি আছে অথচ কোনও
মেষপালক চোখে পড়ল না। দূর দূর অবধি বরফের চূড়া অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে
এই পরিত্যক্ত রাজ্যপাট, বরফশীতল বাতাসে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ।
শতাব্দীপ্রাচীন গাছের ফাঁক দিয়ে বয়ে যেতে যেতে সে বাতাস ফিসফিস করে যেন কত গুপ্ত
কথা বলছে। ঘড়িতে বিকেল তিনটে, অথচ মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে
আমি এখানেই রয়েছি। সময় যেন থমকে গেছে এখানে। দূরবিনটা চোখে দিয়ে আশপাশটা দেখছিলাম।
পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা মতো চোখে পড়ল। একটা লামা দেখতে পেলাম। গুহার ভেতরটা আবছা
চোখে পড়ছে। একটা ভয়ালদর্শন মূর্তির সামনের বেদিতে কাউকে শুইয়ে লামাটা কিছু করছে।
সারা গুহার গায়ে ভয়ঙ্কর সব মূর্তির ছবি। তথাগত বা কোনও গুরুর ছবি নেই কোথাও। হঠাৎ
দেখি লামাটা লোকটাকে কী খাওয়াচ্ছে। চমকে উঠলাম। ওটা তো আমি!! শরীরের কয়েক জায়গা কাটা, রক্ত ঝরছে। দূরবিনটা ছেড়ে
দিয়েছি ভয়ে। গলায় ঝুলানো না থাকলে পড়েই যেত।
হঠাৎ আকাশে কালো চাদরের মতো মেঘ এসে গেল কোথা
থেকে। আমি কিছু বোঝার আগেই শুরু হল মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি। কনকনে হাওয়া আর বড়ো বড়ো বরফগলা
জলের ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে নিচের দিকে ছুটলাম। কিন্তু বৃষ্টিতে চারপাশ ঝাপসা আর
মেঘের মধ্যে বোধহয় দিক ভুল করেছিলাম। একটু পরেই মনে হল আমি অন্য দিকে চলে এসেছি। এ
বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে! পাহাড়ে এমন বৃষ্টি কয়েকদিন ধরেও চলে। কড়কড় করে বাজ পড়ল
কাছেই, সেই আলোর ঝলকানিতে পথ দেখতে পেলাম একটা। দাঁড়িয়ে ভেজার থেকে
এগিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। হাওয়ার ঝাপটায় ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। জল-ঝড়
মাথায় নিয়ে আমিও চলেছি আশ্রয়ের খোঁজে। হঠাৎ পা পিছলে গড়িয়ে গেলাম। এটা ওটা ধরার
চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না নিজেকে। ঠোক্কর খেতে খেতে কয়েকশো ফিট নেমে একটা
গাছের গায়ে আটকালাম। জ্ঞান হারাবার আগে দেখলাম একপাশে খাড়াই পাথরের দেওয়াল, অন্য
দিকে গভীর খাদ। প্রবল বৃষ্টিতে দিনের আলো মরে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না।
চোখ যখন খুললাম, ধূপের গন্ধ আর একটা হালকা
মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ কানে এল। চারপাশে ভয়ঙ্কর সব মূর্তি। একটা বড়ো সিংহ, ড্রাগন, আর
কিম্ভূত দেখতে সব ছবি চারপাশে। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। উঠে বসতে গিয়ে দেখি সারা
শরীর ব্যথায় অবসন্ন। হাত-পা ভার ভার। কেটে-ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো দিয়ে হালকা রক্ত
ঝরছে। পাশের পাথরের বেদিতে একটা লামা বসে ধ্যান করছে। সব কষ্ট তুচ্ছ করে লাফ দিয়ে
উঠে পড়লাম। একটা পাথরের উপর আমার দূরবিনটা চোখ পড়ল। সেদিকে যেতেই হিন্দিতে নির্দেশ
ভেসে এল শান্ত হয়ে বসার। সেই নির্দেশ অমান্য করার শক্তি কারও নেই। বাইরে থেকে
আরেকটা লামা ঢুকল। আমায় কিছু একটা খাওয়াল জোর করে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম ধীরে ধীরে।
ওদের পূজাপর্ব চলল অনেকক্ষণ। বাইরের আলো মরে
গেছে আগেই। এবার ভেতরের আলোআঁধারিতে দেখলাম দুই লামা আমার কাছে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ
লামা আমার মাথায় হাত রেখে মন্ত্রোচ্চারণ করে আমায় বলল যে আর কোনও ভয় নেই। এবার
থেকে আমি অসীম শক্তির অধিকারী। ন্যায়ের স্বার্থে আমি সব করতে পারব। ছোটো লামা আমার
হাতে ধরিয়ে দিল এক অদ্ভুতদর্শন পাথরের মূর্তি। বলল এ ন্যায়ের দেবতা। অন্যায় দেখলেই
ওই মূর্তিকে বলতে। ওই বিধান দেবে শাস্তির। কোনও আপস চলবে না।
ওদের কথায় যা বুঝলাম, মহান
আত্মারা আমায় পছন্দ করে এ ভার দিয়েছে। আমি ওদের আজ্ঞাবাহী মাত্র। এরপর কিছু মনে
নেই। যখন ফিরলাম, নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। শরীরের কোথাও কোনও ব্যথা নেই। মনটাও
বেশ স্নিগ্ধ। বড়ো রাস্তায় পৌঁছে দিয়েছিল একজন লামা। কলকাতায় ফেরার আগে ঐ গুহার
খোঁজে গেছিলাম আবার। কিন্তু পথ খুঁজে পাইনি আর। পাহাড়ের মাথায় ঐ দুর্গটাও পাইনি।
এক বৃদ্ধ মেষপালকের দেখা পেয়েছিলাম পাহাড়ে। আগেরজনকে দেখিনি আর। এই বৃদ্ধ দুর্গের
কথা শুনে বলেছিল, সেও ছোটোবেলায় শুনেছিল ঐ পাহাড়ের মাথায় দুর্গ ছিল। সেখানে ন্যায়
বিচার হত। অপরাধীদের খাদের ভেতর ফেলে শাস্তি দেওয়া হত বহু যুগ আগে। কিন্তু ওখানে
যাওয়ার রাস্তা নেই। খাড়া পাথুরে দেওয়াল। দূরের এক গুহায় কিছু লামা তন্ত্রসাধনা
করত। তবে ভূমিকম্পে সব নষ্ট হয়ে গেছে। গুহাটাও ভেঙ্গে গেছে। অথচ আমি নিজে ওগুলো সব
দেখেছি। দূরবিনটা দিয়েও সব অস্পষ্ট,
ঝাপসা।
রাতে হোটেলে বসে মূর্তিটা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম,
আমি তো রাজু মস্তানকে শাস্তি দিতে চাই,
ডুয়ার্সের খুনি জঙ্গিগুলোকে
ধরিয়ে দিতে চাই, অপহরণকারী দুটোকে... সবাইকে শাস্তি দিতে চাই। কিন্তু কীভাবে?
হঠাৎ মনে হল ঘরের ভেতর ঝড় উঠেছে। পাথরের
মূর্তির চোখ দুটো জ্বলছে। মূর্তিটা বড্ড গরম লাগছে। হাত জ্বলে যাচ্ছে যেন। ওটাকে
টেবিলে রেখে দেখি আমার দু’হাতে রক্ত। চমকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম। একটু পরেই
মূর্তিটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাতে ঘুমের মধ্যে দেখলাম, যে মেয়েটি আমায় দূরবিনটা
বিক্রি করেছিল, ওর চোখে কৃতজ্ঞতা, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ও
মিলিয়ে যেতেই আমার প্রতিবেশী বৃদ্ধ লোকটা আমায় দেখে হাসল, একটা
মিষ্টি দেখতে মেয়ে দু’হাত জোড় করে আমায় নমস্কার করছে, ওকে
কি আমি চিনি! মনে পড়ল না। হঠাৎ দেখলাম সেই চার্চের
ফাদার আমায় আশীর্বাদ দিচ্ছেন। রাজু যে ছেলে দুটোকে মেরেছিল ওরাও রয়েছে। ওদের চোখে
কৃতজ্ঞতার ছাপ। একটা সুন্দর ঝকঝকে সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গল আমার। কিন্তু
কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিলাম না তখনও!!
হয়তো সময় জানাবে বাকিটা।
আমার সেদিন ফেরার পালা।
চেক আউটের সময় রিসেপশনে একটা মেয়ের ছবি দেখে
চমকে গেছিলাম। নাম লেখা মৈনি চামলিং। একটা ফুলের মালা ফটোটায়। মেয়েটা হাসছে আমার দিকে
চেয়ে। আমি রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, আগের মালিকের একমাত্র মেয়ে, ল'ইয়ার
ছিল, কলকাতায় প্র্যাকটিস করত। একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছিল। খুব
পাখির ফটো তুলত। এখানে এলেই প্রকৃতির টানে বেরিয়ে পড়ত একাই। ওঁর মৃত্যুর পর ওঁর বাবা
তন্ত্র-সাধক হয়ে পাহাড়ে চলে গেছে। ওনার ছোটোভাই এখন ব্যাবসা দেখে। আমি আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস
করিনি। আমি চিনতে পেরেছিলাম, ফটোর মেয়েটার গলায় আমার
চেনা দূরবিনটা ঝুলছিল।
একটা ভালো লাগার রেশ নিয়ে কলকাতা ফিরলাম।
অনেক প্রশ্নের উত্তর জেনেছি, খুঁজে পেয়েছি অনেক কিছু।
অঙ্কটা এবার সহজেই মিলে যাবে মন বলছে।
পাড়ায় ঢুকেই শুনি রাজুকে কে বা কারা খুন
করেছে আগেরদিন রাতে। ওর মাথাটা থেঁৎলে দিয়েছে ভারী কিছু দিয়ে। বেটা বড্ড বেড়েছিল
কিছুদিন ধরে। এবার এলাকায় শান্তি ফিরবে সবাই বলছে। মুচকি হেসে ঘরে ঢুকলাম আমি।
একটু পরেই খবর পেলাম অফিসের পেছনে দুটো সিকিউরিটির ছেলে মারা গেছে। ভারি কিছু পিষে
দিয়েছে ওদের। তবে ঐ ঝোপের মধ্যে ওরা কি করতে ঢুকেছিল এটাই সবার প্রশ্ন!!
সন্ধ্যায় টিভিতে দেখলাম উত্তরবঙ্গে তিনজন জঙ্গী খুন হয়েছে
অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে আগের দিন রাতের বেলায়। এরাই ছিল এলাকার ত্রাস। এবার ডুয়ার্সেও
শান্তি ফিরবে।
দূরবিন আর মূর্তিটা বেশ যত্নে রয়েছে আমার
কাছে। অবসর সময় দূরবিনটায় চোখ রাখি আজকাল। মূর্তিটা মাঝে মাঝে জীবন্ত হয়ে ওঠে আমি
জানি।
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ
asadharon
ReplyDeleteSotti e onoboddyo!!
ReplyDeleteSotti e onoboddyo!!
ReplyDeleteবাঃ
ReplyDeleteDarun
ReplyDeletekhub bhalo...
ReplyDelete