আজগুবে
অপর্ণা গাঙ্গুলী
অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার মাঝে মধ্যে ঘটে বই কী! সত্যি সত্যি সে সব খুব ভূতুড়ে নয়, অদ্ভুতুড়েও নয় বলতে পার, তবে খানিকটা অলৌকিক বটে। মানে আমাদের এই মনুষ্যলোকের ঘটনা সে সব যে নয়, তা তোমাদের হলফ করেই বলতে পারি। তো এই রিমঝিম বৃষ্টির সন্ধ্যেবেলাতে চলো না চপ মুড়ি খেতে খেতে বেশ সেই সব গপ্পই করা যাক না হয়।
তবে বলি,
শোনো অনেক অনেক একলা-জাগা রাতে আমাকে নিশিতে ডাকে। বড়ো দূর থেকে শুনতে পাই সেই ডাক। ছোটোবেলাতে সাবি মাসি নিশির কথা বলে বলে আমায় ঘুম পাড়াত। এদিকে মামার বাড়িতে নিশি দরকারে-অদরকারে আমাদের গঙ্গাজল এনে দিত। সাবি মাসি নিশির কথা বললেই আমার সেই ঝাঁকড়া মাথার তাল শিড়িঙ্গে মানুষটির কথা মনে পড়ত আর ভয় বেমালুম উবে যেত। সাবি মাসি শেষ কালে বিরক্ত হত, বলত, কী মেয়ে রে বাবা! কিছুতে ভয় নেই। অথচ জান,
যত ভয় এখন আমাকে ধরতে আসে। যখন রাত নামে, আর এক এক সময় আমার বন্ধু তারা কুচিরা, চাঁদটা কোথায় যে হারিয়ে থাকে, তখন আমার বড়ো ভয় করে। আসলে নিশি আর কেউ নয়, এই অদ্ভুত নিশুতি থম মারা রাতগুলো, যারা আমাকে ডাকে, আয় আয়, ভয় কী?
আমি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে খুব অন্ধকারের কথাই ভাবতে থাকি। সেই কালিঢালা নদীর দুই ধারের কথা, যেখানে ‘কাগজের নৌকা’ একা একা ভেসে চলেছে । আর ঘুম পাড়ানিয়া মাসিরা তাতে চেপে বসে দুলে দুলে চলেছেন কোন নিরুদ্দেশে। বড়ো অদ্ভুত লাগে এই সব ঘুম-না-আসা রাতগুলো। হঠাৎ গলির মোড় থেকে ভেসে আসে ‘রামনাম সত হ্যায়।’ আমি চোখ বুজে দেখি সেই খাটিয়ার চড়নদার নড়ে নড়ে চলেছে দুলকি চালে। আহা, বেঁচে থাকতে যদি কেউ অমন করে দোলায় কত আরাম লাগে। তার পা দুটিও নড়ছে আর যারা সেই খাট বয়ে নিয়ে চলেছে,
কই তাদের পা তো মাটিতে পড়ছে না! কেমন উলটো পায়ে চলেছে তারা পথ বেয়ে। ভয়ের একটা অমোঘ টান থাকে জানি। কখনও মনে হয় উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখি, ঠিক কী ঘটছে। না, আমার অত্যন্ত চিন্তাপ্রবণ মন ভেবে নেয়, কিন্তু জানলাতে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যদি খাটিয়া বওয়া মানুষগুলো উপরদিকে তাকায়? তবে তাদের দৃষ্টি কেমন হবে, যদি সে চোখের মণি না থাকে,
যদি মরা মানুষ খাটে শুয়ে আমাকে টা টা করে দেয়? উফ কী ভয়ানক! ভাবতেই হাড় হিম হয়ে আসে! আমি আর ভাবতে পারি না। চোখ খুলব, জল খাব, আলো জ্বালব, সে সাহস নেই। শুধু শুয়ে শুয়ে এই ভয় পাওয়া আর নিজেকে এই ভয় পাওয়ানোর খেলাতে মেতে উঠি।
এমন সময় আবার সেই ডাক। ঠিক বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ডাকছে আমার নাম ধরে। নিশ্চুপ, নিভৃত এক ডাক, কুমু,
এই কুমু, এইইই কুমুউউউউউউ! আমাদের পুরোনো বাড়িটার ইঁট-পাথরে সেই ডাক ছড়িয়ে যাচ্ছে
চাপা কান্নার মতো। আমার পাগল পাগল লাগতে থাকে। আস্তে আস্তে কখন যেন উঠে পড়ি, হাঁটতে থাকি দরজার দিকে, দরজা পেরিয়ে নিচে, বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছি, এমন সময় মা ধরে ফেলেন। আবার রাতে হাঁটা শুরু হল তোর? কুমু, এই কুমু, চোখ বন্ধ ঘুমুচ্ছে দেখো, ঘোড়া নাকি রে... মা আমাকে ঘরে এনে শুইয়ে দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, বলেন, আমি এখেনে থাকি...
এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না। আমি মাকে জড়িয়ে ধরি। মায়ের বুকে মুখটি গুঁজে আরও বেশি করে ভয় পেয়ে দেখেছ কখনও? খুউব ভালো লাগে।
যা হোক, কে
জানে কেন, এই সব
অলৌকিক ঘটনারা আমাকে
জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকে। বলেছি না, পূর্ণ
চাঁদের মায়ায় আমার
উপর হুরি-পরিরা ভর
করে? কী করে
জানলাম? কী করে
আবার, সেই
যে বেশ ছোটোবেলাতে
ঠাম্মির আয়নায় দেখতে
পেতাম পরিদের আর
ঠাম্মি তাড়াতাড়ি ক্রুশের
তৈরি সাদা ফুলেল
ঢাকনা দিয়ে ঢেকে
ফেলতেন সেই বেলজিয়াম
কাচের আয়না, বিয়ের সময়ে
তাঁর বাবার দেওয়া।
ঠাম্মি বলতেন, ওরে ভাবন
রাখ রে মেয়ে, এই
রাতের বেলাতে আয়নাতে
কক্ষনও মুখ দেখিসনি
যেন। পরিতে পাবে
তোকে। ওমা পরিতে
পাওয়া! সে আবার
কী? সে তো
সাবি মাসি আমাদের ছুটির
দিনে কোম্পানির বাগান
পেরিয়ে নিয়ে যেত
গোন্দলপাড়ার দিকে এক
জঙ্গলে। সেখানে এইটুকু
ছোট্ট মতো এক সরোবর। কী
যে সুন্দর! তাতে
অনেক পদ্ম শাপলা
শালুক ফুটত। আর
চাঁদ এসে পড়ত
যখন সেই জলে
ঠিক সন্ধ্যাবেলাতে, মাগো, সে
জলে কী যে
শলমা চুমকি খেলে
যেত কী আর
বলব! আর গাছের
আড়াল থেকে সাবি মাসি আমাদের
চুপ করে উঁকি
দিয়ে দেখতে বলত।
ঝুমঝুম করে নামত
যারা ওই উপর
থেকে তাদের সব
হালকা গোলাপি নীল
সাদা জামা পরনে।
আর পিঠে স্কুল
কনসার্টে আমরা যেমন
লাগাতাম, তেমনি
পাখা সব, তবে আসল।
ইয়া বড়ো বড়ো পাখা।
তারা ওই পুকুর
ঘিরে ঘিরে নাচত
আর গাইত, আর
কী যে মধুর
বাজনা বাজাত কেউ
কেউ তাদের মধ্যে, আমরা
অবাক হয়ে দেখতাম
কেবল। তাই দেখতে
দেখতে কখন যে
ঘুমিয়ে পড়তাম। যেই
বাজনা বাজত, শুনতাম মা আর
সাবি মাসি
বলাবলি করছে, ওই
দেখো এই মেয়ে
ঘুমের মধ্যেও হাসে, কথা
বলে। পরে ওরা
কেবল বলত আমি
সে সব স্বপ্নে
দেখেছি, আর আমার
মনে হত সত্যি। না
দেখলে, অমন পরিষ্কার
করে পরিদের মনে
থাকে?
তা সে
যাই হোক, সেই সময়তে
আমি ঢের রূপকথা
পড়তুম কিনা, তাই হয়তো
অমন। ঢের ঢের রাশিয়ান রূপকথা, গ্রিমভাইদের
গল্প, এন্ডারসনের
রূপকথা, ঠাকুরমার
ঝুলি এই সব। তা
বড়ো হয়ে একবার
অমন এক রাতে হঠাৎ
ঘুম ভেঙে জেগে
দেখি, ওমা আমার
পিঠে বেশ ডানা
গজিয়েছে যেন।
এমনিতে পিঠটা মাঝেসাঝে
কুড়কুড় করে বটে,
তবে একেবারে ডানা
গজাবে ভাবিনি তো। আমিও
পরিদের মতো আলতো
পায়ে বিছানা থেকে
নেমে সটান ছাদে। ডানা
মেলে ঘুরে ঘুরে
নাচ করছি, এমন
সময় কোথা থেকে
যেন একটা বড়ো
মতো কুকুর এসে
হাজির। ওতো আমার
ট্রফি বা টাইফুন
নয়। ওর চোখ
ভাঁটার মতো জ্বলছে।
খুব হেঁড়ে গলায়
সে বলল, কী গো মেয়ে, বেড়াতে
যাবে আমার পিঠে
চড়ে? দেখলাম
তার রোঁয়াগুলো কুকুরের
থেকে ঢের বড়ো
বড়ো আর চোখ
দুটো ভাঁটার মতো
জ্বলছে। আমার মনে
পড়ল, ও, হরি এ
তো কুকুর নয়, এ
যে নেকড়ে! আমার পিঠ
দিয়ে শীতল স্রোত
বয়ে গেল, তবু সাহসে
ভর করে বললাম, ও
ভাই নেকড়ে, যাব, তবে
আজ নয়, আজ
আমার জ্বর কিনা, এর
পরের বার ঠিক
যাব দেখো। নেকড়ে
বাঘটা মনে হয়
খুব দয়ালু। আমায়
বললে, ওহহো, ভয়
পেলে বুঝি, আচ্ছা
থাক না হয়, জ্বর
যখন। বলেই ছাদ
টপকে, পাশে
বাবলুদের বাড়ির ছাদ
বেয়ে কোথায় যে
নিমেষের মধ্যে চলে
গেল, আর
দেখতেই পেলাম না।
খুব চাঁদনি রাতে
শুনেছি নেকড়ে আসে, পরিদের
কাছে। আমার মনে
মনে বেশ আনন্দ
হল। তবে বুঝি
আমি সত্যি সত্যি
পরি বনে গেলাম। কখন
যে ঘরে গিয়ে
শুয়ে পড়েছি মনে
পড়ে না। সক্কাল সক্কাল
ঘুম ভাঙতেই দেখি, ডানা
নেই তো, তবে কি
স্বপ্ন দেখলাম আমি? এক
দৌড়ে ছাদে গিয়ে
দেখি, নেকড়ের
পায়ের দাগ ছাদময়। ভোগলু
জমাদার অবিশ্যি বললে,
ও আমাদের টাইফুনের
পায়ের ছাপ। কিন্তু
আমি একটু হাসলাম। আমি
তো তাকে সদ্য
দেখেছি কিনা। কথাও
বলেছি। এখন কেবল
অপেক্ষায় আছি পরের
পূর্ণিমার। জানি, ডানা আমার
গজাবেই। আর এবার
দেখা যাক নেকড়ের
পিঠে চড়ে বেড়াতে
যাওয়া আমার কে আটকায়।
পরে
শুনেছি, মাঝে মাঝে
আমরা সময় কালের
বেড়া ডিঙিয়ে কোথায়
যেন হারিয়ে যাই। তিনটে
চারটে ডাইমেনশনের খবর
তোমরা তো জানই, কিন্তু
পঞ্চম বা ‘ফিফথ
ডাইমেনশন’-এ
যে সব অলৌকিক
ব্যাপারস্যাপার ঘটে, তার খবর
রাখ? পারলে
গুগল-এ দেখে নিতে
পারো সেই সব – মানে
বলছি কী, আরও আরও
অলৌকিক কিছুমিছু জানতে
হলে...
তবে কিনা
এসব ঘটনা মাঝেমধ্যে
ঘটে। কী জানি
আমরা কোনও ভাবে কোনও
‘ওয়র্মহোল’ বেয়ে
তখন অন্য কোনও ডাইমেনশনে পৌঁছে
যাই কিনা!
_____
ছবিঃ সুজাতা চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment