অলৌকিক
সৈকত - সৈকত মুখোপাধ্যায়
আলোচনাঃ
সৌগত সেনগুপ্ত
অলৌকিক
রহস্য রোমাঞ্চ সংখ্যার জন্য ছোটো সম্পাদিকা যখন আমাকে লিখতে বললেন তখন ফোন রেখে
বইয়ের তাকের দিকে তাকাতেই প্রথম যে বইটার দিকে চোখ গেল সেটা হল এইটা। অলৌকিক সৈকত।
লেখকের নামও বইয়ের মলাটে জ্বলজ্বল করছে। তিনি হলেন এমন একজন লেখক যার লেখা
সূচিপত্রে থাকলেই সবারই,
বিশেষ করে ছোটোদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে।
লেখকের নাম
এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছ,
তাই তাঁর প্রসঙ্গ ছেড়ে এবারে অন্য প্রসঙ্গে আসি। বইয়ের তাকে এত বই থাকতে এই
বইটাই চোখে কেন পড়ল?
তার কারণ হল বইটার আকার। তাকের বাকি বইগুলোর থেকে অনেকটাই বড়ো। ছোটোবেলায় ঠিক
যেমন বই হাতে নিয়ে উপুড় বা চিৎ হয়ে শুয়ে, টেবিল চেয়ারে বসে অঙ্কের খাতার কিংবা
ডেস্কের আড়ালে রেখে পড়তে ভালোবাসতাম ঠিক সেইরকম। শক্ত মলাটের আড়ালে পাতলা ক্ষীণকায়
শ’খানেক
পাতা। পাতার হরফগুলো বড়ো বড়ো, আর সঙ্গে অনেক ছবি। চাই কি একটু বুক ক্রিকেটও খেলে নেওয়া
যায়। একেবারে ৩৬০° বিনোদন।
ছোটোবেলায়
পড়া সেই সব সিনদোবাদ,
আলাদিন, বহুরূপী
কিংবা টুনটুনির গল্পের বইয়ের মতো এই বইয়েরও প্রকাশক নির্মল বুক এজেন্সি। প্রকাশককে
প্রথমেই ধন্যবাদ দিতে চাই বইটাকে ছোটোদের মনের মতো করে প্রকাশ করার জন্য। যে বই
হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছে করবে। ডিসেম্বর ২০১৭ অর্থাৎ গত বইমেলার ঠিক আগে প্রকাশিত এই
বইটার দাম ১০০ টাকা।
ছোট্ট একটা
ভূমিকার পরে ১০৪ পাতার এই বইটায় আছে বারোটা অলৌকিক গল্প। লেখক সৈকত মুখোপাধ্যায়ের
ভূমিকা ধার করে বলি,
“...এই ভয়ের
বারোটা গল্প এমনই অলৌকিক। চেনা জীবনের মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে এই বইয়ের চরিত্রেরা হঠাৎই
মৃত্যুর পরের জগতের একঝলক দেখতে পেয়ে অবশ হয়ে যায়...”
সেই হিমশীতল
মৃত্যুপরবর্তী দুনিয়ার ঝলক পেতে গেলে কী কী লেখা পড়তে হবে এসো দেখে নিই।
·
বিরামগড়ের বন্দী
·
চলে গেছি তবু আছি
·
খেলাঘর
·
কুয়াশার আড়ালে ওরা আসে
·
নীল চিতার হিম আগুন
·
প্রেত উলকি
·
রাতের নৌকা
·
সেই নদীটার নাম
·
বোষ্টমবুড়ির বাগান
·
নরকের চলচ্চিত্র
·
উইলিয়াম ব্রিজের প্রহরীরা
·
লাল বল
এই
গল্পগুলোর পটভূমি বিভিন্ন জায়গায়। কখনও কলকাতা শহরে, কখনও বাংলার গ্রামে, পুরুলিয়া
কিংবা উত্তরবঙ্গের চা বাগানে, ওড়িশা দিল্লি বা মহারাষ্ট্রের কোনও জায়গাতে। একাধিক ভূতুড়ে
বাড়ি, দুর্গ, মন্দির, জলাভূমি, নদী আর
অলৌকিক ঘটনার ডিপো যে জায়গা অর্থাৎ শ্মশানও উঠে এসেছে গল্পের পাতায় পাতায়।
প্রথম গল্প বিরামগড়ের
বন্দী-তে ফেরারি গ্রুপ অফ হোটেলস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি কে ঘোষাল বিরামগড়ের
দুর্গ কিনে নিয়ে একটা হেরিটেজ হোটেল বানাতে চান। হতে চাওয়া হোটেল সেই দুর্গে
রাত্রিবাস করে ঘোষালবাবুর কী অলৌকিক অভিজ্ঞতা হল?
দ্বিতীয়
গল্প চলে গেছি তবু আছি গল্পের পটভূমি পুরুলিয়া। নিশিডাক নামের ভৌতিক অলৌকিক
পত্রিকার নিয়মিত লেখক শিবুদা এক ভূতুড়ে বাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে অপঘাতে মারা যান।
তার মৃত্যুর পরে পত্রিকার সম্পাদক অনীকের সেই বাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা
হয়?
তৃতীয় গল্প
খেলাঘরের মূল চরিত্র নির্মাল্য বসু। নামজাদা ইন্টিরিয়র ডেকরেটর। ওড়িশার এক
রাজপরিবারের বাড়ির ইন্টিরিয়রের কাজ করতে গিয়ে একটা কাঠ খোদাই করা মঞ্চ নিয়ে
এসেছিলেন কলকাতার বাড়ির ছাদে একটা চামেলি কুঞ্জ তৈরি করার জন্য। ছাদের ওপর সেই
গাছঘরের নিচেই হল নির্মাল্যবাবুর মেয়ে রুম্পার খেলাঘর। কিন্তু সেখানে খেলতে
খেলতে কী ঘটল রুম্পার সঙ্গে?
এর পরের
গল্প কুয়াশার আড়ালে ওরা আসে সুমন্ত দুবে নামের একজন পাকা ক্রিমিনালের।
নয়ডার মথুরানাথ শর্মার কুকুরটাকে খুন করে মথুরানাথের বাড়ি ডাকাতি করতে বেশি বেগ
পেতে হয়নি সুমন্তকে। মথুরানাথ শর্মা ছিলেন দৃষ্টিহীন। পুরো অপারেশন শেষ করে
নিসান্ত রিসর্টে লুকিয়ে থাকার সময় কিসের আওয়াজ শুনল সুমন্ত?
নীল
চিতার হিম আগুন গল্পটা পড়লে বোঝা যায় কেন সৈকত মুখোপাধ্যায়কে
শ্মশান স্পেশালিষ্ট বলা যায়। এই বইতেও শ্মশানকেন্দ্রিক একাধিক গল্প আছে। শিবাইকালী
শ্মশানের ঘাটবাবু নিতাই নস্কর। শ্মশানের চুল্লি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সারাতে আসেন
ডুসেলডর্ফের ডঃ সিদ্ধকাম মিত্র। চুল্লি সারানোর পরে কী দেখতে পায় নিতাই?
প্রেত
উল্কি গল্পের পটভূমি বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার বিধনিতে। পার্থ তার
বন্ধু সাগ্নিকের আমন্ত্রণে গিয়ে জড়িয়ে পরে এক আজব ঘটনায়। থানার ওসি সাগ্নিক
টেররিস্টদের সন্ধানে গিয়ে খবর পায় শিবসাধু নামের এক সাধুর খুন হয়ে যাওয়ার। যিনি
আবার খুব ভালো উল্কি আঁকতে পারেন। সেই উল্কি থেকেই কোন রহস্যের সমাধান হল?
আহিরনের
বিলের ধারে তান্ত্রিক দুর্লভ চক্রবর্তীর মন্দিরের গয়না চুরি করতে ঢুকেছিল ভজন।
তান্ত্রিকের সম্মোহন শক্তির হাত থেকে বাঁচতে চোখ বেঁধে দেয় ভজন। নৌকা করে গয়না
নিয়ে পালাতে যায় সে। শেষরক্ষা হয় কি? পড়তে হবে গল্প রাতের নৌকা।
আই টি
সেক্টরের সৌগত কুসুমপুরের ফরেস্ট বাংলোয় ছুটি কাটাতে এসে জঙ্গলের মধ্যে একটা নদী
আবিষ্কার করে। সেই নদীর ধারে একটা ছেলের দেখা পায় সে। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করেও
নদীটার নাম জানতে পারে না। কিছুদূর হেঁটে একটা শ্মশানের কাছে পৌঁছায়। সেখানে
গ্রামের কিছু মানুষ শবদাহ করতে এসেছেন। সৌগত কি জানতে পারে সেই নদীটার নাম?
শিল্পপতি
শঙ্কর মণ্ডল প্রতিদিন রাত বারোটায় তাঁর নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সম্ভারে ঘুরে
যান। যে জমির উপরে সেই সম্ভার তা আগে ছিল এক বুড়ির জমি, সবাই জানত বোষ্টমবুড়ির
বাগান বলে। বুড়ি মারা যাওয়ার পরে ছেলের থেকে জমিটা কিনে নিয়ে শঙ্কর মণ্ডল গড়ে
তুলেছেন এই দোকান। গতবছর এই দিনেই বুড়ি মরেছিল। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে তারিখটা দেখে
চমকে উঠলেন শঙ্করবাবু। কী হল তারপর?
হরর ফিল্মের
ডিরেক্টর রাজশেখর সেন তাঁর নতুন ছবি নরকের চলচ্চিত্র-র কিছু অংশ কম্পিউটার
গ্রাফিক্স করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরসকে। তার কর্ণধার
সুধাময় প্রধান একটা অ্যানিমেশন ফাইল পাঠানোর সঙ্গে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন
রাজশেখরবাবুকে। সেই ফাইলটার নাম নরকের চলচ্চিত্র। কম্পিউটারে সেই ফাইলটা ওপেন করলে
কী হল রাজশেখরবাবুর?
এই বইয়ের
একাদশ গল্প উইলিয়াম ব্রিজের প্রহরীরা। উনিশশো তিরানব্বইয়ের বন্যায়
উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে হড়কা বানে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। রুদ্রদেব তখন মধুঝোরা চা
বাগানের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। এমনই বর্ষার রাতে জলস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
শিলিগুড়ি থেকে ফেরার সময় মধুঝোরার মুখে জুনালি নদীর উপর উইলিয়াম ব্রিজের রাস্তায়
কাদের দেখল রুদ্র? কিভাবে
সে বানভাসি ব্রিজ পার করল?
বইয়ের শেষ
গল্প লাল বল আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক গায়ে কাঁটা দেওয়া ঘটনার মুখোমুখি।
কুড়ি বছর আগে নবমীর দুপুরে পল্লবের মাসতুতো ভাই বিলাস মনিপুকুরের জলে ডুবে মারা
যায়। একটা লাল বল জলে পড়ে গেলে সেটা তুলতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে। কুড়ি বছর পরে সেই নবমীর
দুপুরে সেই মনিপুকুরেই একটা লাল বল ভাসতে দেখে পল্লব। তারপর কী হয়?
এই বারোটা
গল্পের বারোটা প্রশ্নের উত্তর পেতে পড়তেই হবে অলৌকিক সৈকত। উৎসর্গ করা হয়েছে এই
সময়ের অন্যতম সেরা কথাশিল্পী হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তকে। বইয়ের প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ
করেছেন অনিকেত রায়। রাতের নৌকা গল্পের তান্ত্রিক দুর্লভ চক্রবর্তীর সম্মোহনী
দৃষ্টিকে শিল্পী প্রচ্ছদে এমন ভাবে সাজিয়েছেন যে সেই সম্মোহনে বইটা তাড়াতাড়ি পড়ে
না ফেলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
অলৌকিক
সৈকতে পদচারনা করে তোমাদের কেমন লাগল আমাদের জানাতে ভুলো না। আমাদের ইমেল ঠিকানা
হল - editor.desks@gmail.com
_____
দারুণ লাগল!সৌগতদা তোমার বুক রিভিউ।বইটা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
ReplyDeleteচমৎকার আলোচনা। বইয়ের গল্পগুলো পত্রিকায় প্রকাশের সময় পড়েছিলাম। এবার গোটা বইটাই পড়ে ফেলতে হবে।
ReplyDeleteথ্যাঙ্ক ইউ ঋজুদা, বইটা হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছে করবে
Deleteচমৎকার হয়েছে সৌগত। বইটা এবার সংগ্রহ না করলেই নয়।
ReplyDeleteহ্যাঁ সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন, সৈকতদার unputdownable লেখা
Deleteপ্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ শিল্পীর নাম বইটিতে ভুলবশত "অনিকেত রায়" ছাপা হয়েছে !অনুগ্রহ করে সাহিত্যমের কর্ণধার প্রদীপদার কাছ থেকে একটু জেনে নেবেন।প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ শিল্পীর নাম " সুদীপ্ত মণ্ডল" আশা করি প্রকাশক পরবর্তী ছাপার সময় ভুলটি সংশোধন করে দেবেন।
ReplyDeleteমিসটেক... মিসটেক...
Deleteঅসাধারণ
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ সুদীপ
Delete