খোলা জানালাটা
মূল গল্পঃ সাকি-র ‘দ্য ওপেন উইনডো’
অনুবাদঃ
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
‘চিন্তা
করবেন না, মিঃ নাটেল, পিসি এক্ষুণি ওপর থেকে নামবে। ততক্ষণ
বরং আমারই বকবকানি একটু সহ্য করুন, কী বলেন?’
উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল মেয়েটা। ওর
বয়েস কত হবে? বড়োজোর পনেরো। কিন্তু কী
চটপটে আর সপ্রতিভ। চোখমুখ যেন কথা বলছে।
বিব্রত
ফ্র্যামটন নাটেল কী বলবে ভেবে পেল না। এমনিতেই ও একটু
ভীতুগোছের মানুষ। তার ওপর তরুণীর এই কথায় প্রাণপণে
চেষ্টা করছিল এমন কিছু বলার, যা মেয়েটাকে খুশি করতে পারে। আসলে
হঠাৎ এই গায়ে পড়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসাটা ঠিক হল কিনা,
সেই নিয়ে ওর নিজের মনেই একটা সংশয় কাজ করছিল।
কিন্তু কী করবে ও? স্নায়ুর রোগে বিপর্যস্ত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শে একটা দীর্ঘকালীন
বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল ওর। তা ফ্র্যামটন
যখন তার জন্য শেষমেষ এই নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট গ্রামটাকেই বেছে নিল, তখনই ওর দিদি পইপই করে বলেছিল, ‘আরে ওখানে কী
করতে যাচ্ছিস তুই? নিজের কবর খুঁড়ে রাখতে? ও গ্রামে তো
কিছুই নেই। একটা মরা পচা গ্রাম। ওখানে
ক’দিন থাকলে তুই তো
ভালো হবার বদলে আরও ঝিমিয়ে পড়বি। শোন্,
আমি ওখানে যাদের চিনি, তাদের কথা তোকে বলছি, তাহলেই তুই বুঝতে পারবি, কী অসহ্য ঐ
লোকগুলো। শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন আছে, যারা
ওর মধ্যে তবু একটু চলনসই, যাদের সঙ্গে কথা বলা যায়।’
তা দিদির
হিসেবে সেই হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই হলেন এই মিসেস স্যাপলটন, যার সঙ্গে আজ
ফ্র্যামটন দেখা করতে এসেছে। কিন্তু ও তো
এখনও বুঝতেই পারছে না, ভদ্রমহিলা সধবা না বিধবা। এমন
কি এই বসার ঘরের চেহারা দেখেও বোঝার উপায় নেই, এ ঘরে কোনও পুরুষের বাস আছে কিনা।
‘কী
ব্যাপার? কী ভাবছেন?’ জিজ্ঞেস করে তরুণী। এতক্ষণের
নীরবতা সে আর সহ্য করতে পারছে না।
‘না,
কিছু না,’ অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় ফ্র্যামটন।
তরুণী
আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, এখানে কি আপনার চেনাজানা অনেক লোকজন আছে?’
‘খুবই
কম,’ ফ্র্যামটন জবাব দিল, ‘আসলে আমার দিদি বছর চারেক আগে এখানে থাকত, ঐ গির্জাতে। ও-ই
আমায় এখানকার দু-একজনের কথা বলেছে আর কী!’
কেমন
একটা দুঃখের স্বরে শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করল ফ্র্যানটম।
চকিতে
একবার ফ্র্যামটনের দিকে তাকিয়ে তরুণী বলে, ‘তার মানে আপনি আমার পিসির সম্পর্কে
প্রায় কিছুই জানেন না?’
ফ্র্যামটন
ঘাড় নাড়ে, ‘না। শুধুমাত্র নাম আর ঠিকানা। আর কিছুই না।’
‘খুব
স্বাভাবিক,’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে তরুণী বলল, ‘পিসির জীবনের সবথেকে দুঃখের ঘটনাটা
ঘটেছিল ঠিক তিন বছর আগে। সেটা হয়তো আপনার দিদি
চলে যাবার পরেই। তাই . . .’
‘দুঃখের
ঘটনা?’ ফ্র্যামটন ভাবতে পারছিল না যে এমন শান্ত নিরূপদ্রব গ্রামেও কোনও দুঃখজনক
ঘটনা ঘটতে পারে।
‘আচ্ছা,
আপনার মনে একবারও প্রশ্ন জাগেনি যে, এই অক্টোবরের বরফপড়া বিকেলেও আমরা ঐ জানলাটা
হাট করে খুলে রেখেছি কেন?’ ফ্র্যামটনের পিছনদিকের একটা মস্তবড়ো শিকবিহীন জানলার
দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল মেয়েটা, যেটা খোলা ছিল পেছনের উঠোনের দিকে।
ফ্র্যামটন
ঘাড় ঘুরিয়ে একবার জানলাটা দেখল, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, বছরের এই সময়ের
তুলনায় আজ ততটা ঠান্ডা নেই। কিন্তু ওটা খোলা
থাকার সঙ্গে কী ওই ঘটনার কোনও সম্পর্ক আছে?’
‘ওই
জানলাটা দিয়ে, হ্যাঁ, ওই জানলাটা দিয়েই আজ থেকে তিন বছর আগে আমার পিসেমশাই আর দুই
কাকা শিকারে বেরিয়েছিল। তারা আর ফিরে আসেনি। দিনটা
ছিল গ্রীষ্মকালের এক সাংঘাতিক বৃষ্টির দিন, আর আপনি তো জানেনই, এই সময়ে জানাশোনা
নিরাপদ জায়গাও আচম্বিতে কীরকম বিপজ্জনক হয়ে যায়।
ঠিক সেটাই হয়েছিল সেদিন। ওদিকের
বাদাজমি পেরিয়ে ওদের প্রিয় পাখির
আস্তানায় গিয়ে শিকার করার সময় ওরা তিনজনেই একটা কাদার বিলে আপাদমস্তক পুঁতে
গিয়েছিল, একজনও উঠতে পারেনি। আর সবচেয়ে
মর্মান্তিক ব্যাপারটা হল, তিন তিনটে মৃতদেহের একটাও উদ্ধার করা যায়নি।’
কথাগুলো
বলতে বলতে ক্রমশই তরুণীর গলা বুজে আসছিল, ওর ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
ফ্র্যামটন
কোনও কথা বলতে পারে না। এই মর্মন্তুদ ঘটনা শোনার পর ও আর কী
বলবে?
একটুক্ষণ
চুপ করে থেকে তরুণী ধীরে ধীরে ভাঙা গলায় বলতে থাকে, ‘বেচারি পিসি সবসময় ভাবে,
একদিন না একদিন ওরা ফিরে আসবেই। আর ফিরে
আসবে আমাদের সেই বাদামী স্প্যানিয়েল কুকুরটা, যে ওদের সঙ্গেই সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল
চিরতরে। আবার ওরা ফিরে আসবে, উঠোনের দিকের ওই
খোলা জানলা ডিঙিয়েই ওরা এসে ঢুকবে এই ঘরে, ঠিক যেখান দিয়ে তিন বছর আগে ওরা হারিয়ে
গিয়েছিল। আর সেই কারণেই বছরের প্রত্যেকটা দিন
সন্ধে পর্যন্ত ওই জানলাটা খুলে রেখে দেওয়া হয়, ওদের ফিরে আসবার আশায়। বেচারি
পিসি, সে তো প্রায় প্রতিদিনই একবার করে আমাকে শোনায়, ঠিক কেমন করে জানলা ডিঙিয়ে
ওরা একের পর এক বেরিয়ে গিয়ে ঢুকেছিল ওই
জলাজমির ভেতর, পিসেমশাইয়ের হাতে ঝুলিয়ে রাখা তার সাদা রঙের বর্ষাতিটা, আর রনি, আমার
ছোটোকাকা, তার গলায় সেই একঘেয়ে গানটা, যা সে পিসিকে রাগানোর জন্যেই গাইত — ‘রাগ কোরোনা খুকুমণি,’ যেটা শুনলেই পিসি তেলেবেগুনে
জ্বলে উঠত। জানেন মিঃ নাটেল, পিসির কথা শুনতে
শুনতে এরকমই কোনও শান্ত বিকেলে আমার যেন কীরকম একটা অনুভূতি হয় মাঝে মাঝে। মনে
হয়, সত্যি হয়তো কোনদিন দেখব, ওরা তিনজন একে একে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে
এগিয়ে আসছে আমাদের এই খোলা জানলার দিকে —’
বলতে বলতে শিউরে উঠে চুপ করে যায় সে। ফ্র্যামটনও
যেন মনের মধ্যে সেই শিহরণটা অনুভব করে।
ঠিক সেই সময় পিসি এসে ঘরে ঢুকতে ফ্র্যামটন বেঁচে গেল। প্রথমেই দেরির
জন্য ক্ষমা-টমা চেয়ে মিসেস স্যাপলটন বললেন, ‘আশা করি আমার অভাবটা ভেরা আপনাকে
বুঝতে দেয়নি ?’
‘না না, একেবারেই না। ও তো দারুণ মিশুকে মেয়ে। ভারি সুন্দর
কথা বলে,’ বলল ফ্র্যামটন।
‘আর আশা করি ঐ খোলা জানলাটার জন্যেও আপনি কিছু মনে করবেন
না, মিঃ নাটেল,’ মিসেস স্যাপলটন তড়বড় করে অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করেন, ‘আসলে কী
জানেন, আমার স্বামী আর দুই ভাই শিকারে গেছে। খুব শিগগিরই ওরা বাড়ি ফিরবে। আর ওদের জন্যেই
জানলাটা খুলে রাখতে হয়েছে। কারণ সবসময় ঐ জানলা দিয়ে যাতায়াতটাই ওদের পছন্দ। বেশ মজার ব্যাপার না? ওরা আজ জলায়
গেছে পাখি শিকার করতে, অতএব ফিরে এসেই, ব্যস্, খানাপিনা হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দেবে। আপনাদের
পুরুষদের তো ওইসবই পছন্দ, তাই না?’
অতঃপর শিকার করার নানা খুঁটিনাটি, আর ইদানীং জলাতে পাখি
কেমন কমে গেছে, আর শীতের সময় হাঁস শিকারের সম্ভাবনা, এইসব নিয়ে মিসেস স্যাপলটন
একটানা বকবক করে চললেন বেশ আনন্দের সঙ্গে। ফ্র্যামটনের কিছু ভালো লাগছিল না, বিশেষ করে এই শিকারের
প্রসঙ্গ। সে চাইছিল আলোচনা অন্যদিকে টেনে নিয়ে যেতে। কারণ সে
লক্ষ্য করছিল, ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে কথা বললে কী হবে, বারবারই তাকে টপকে তাঁর চোখ
চলে যাচ্ছিল পেছনের খোলা জানলা আর তার বাইরে ঘাসজমির প্রান্তে। এরকম একটা হৃদয়বিদারক
পরিস্থিতিতে এসে পড়াটাই একটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, ফ্র্যামটন ভাবছিল। যদিও মহিলার
প্রতি একটা সহানুভূতির ভাব বিরাজ করছিল তার মনে। অগত্যা প্রসঙ্গ
পালটানোর চেষ্টা করল সে।
‘জানেন তো? ডাক্তার আমাকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছেন,’ মহিলার মনোযোগ
আকর্ষণের চেষ্টা করল ফ্র্যামটন, ‘কোনোরকম মানসিক উত্তেজনা বা কোনও শক্ত কাজ আমার সইবে
না। আর সেই হিসেবে এই শান্ত আর নিরিবিলি জায়গাটা বেশ ভালোই। আসলে বহুদিন ধরে একটানা কাজ করতে করতে শরীরটা বোধহয় বিকল
হয়ে পড়েছিল। তবে হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু কোনও বিধিনিষেধ
নেই।’
‘তাই
নাকি?’ নিতান্ত বিরসমুখে কথাটা বলে বড়ো
করে হাই তুললেন মিসেস স্যাপলটন। কিন্তু তার
পরক্ষণেই তাঁর চোখমুখ যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিন্তু সেটা ফ্র্যামটনের কথা শুনে
নয়।
‘আরে! ওরা এসে পড়েছে!’ আনন্দে চেঁচিয়ে
উঠলেন মিসেস স্যাপলটন, ‘যাক। একদম
চায়ের সময়
এসে গেছে। আর দেখ, ওদের দেখে মনেই হচ্ছে না যে
সারাদিন ধরে জলকাদায় হুটোপাটি করে এল ওরা!’
আচমকা
কথাটা শুনে সামান্য কেঁপে উঠল ফ্র্যামটন। তারপরেই
সমবেদনার দৃষ্টি নিয়ে দেখল তরুণীর দিকে। কিন্তু
মেয়েটা? সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফ্র্যামটনের পেছনের খোলা জানলাটার দিকে।
তার দু’চোখে ভয়ার্ত এক দৃষ্টি। মুহূর্তের
মধ্যে কেমন অজানা একটা ভয়ে শিউরে উঠে
ফ্র্যামটন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে তাকাল।
ছায়াচ্ছন্ন
গোধূলির আলোয় দূরের জঙ্গল থেকে ঘাসজমি পেরিয়ে তিনটে ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে এই
জানলা লক্ষ্য করে; তাদের প্রত্যেকের বগলে বন্দুক, আর সেইসঙ্গে ওদের মধ্যে একজনের
কাঁধে আলগোছে ফেলা রয়েছে একটা সাদা বর্ষাতি। ক্লান্ত
একটা বাদামী রঙের স্প্যানিয়েলও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে ওদের সঙ্গে। খুব
ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে ওরা এগিয়ে আসছে বাড়ির কাছাকাছি। আর
তারপর... হঠাৎ কুয়াশার
মধ্যে থেকে ভেসে এল একটা কর্কশ গলার গান — “রাগ কোরোনা খুকুমণি”...
ফ্র্যামটন বিদ্যুৎগতিতে উঠে দৌড়ে গেল তার ছড়ি আর টুপির দিকে। সেগুলো হাতে
নিয়েই খোলা দরজা দিয়ে বারান্দা, সেখান থেকে নুড়ি-বিছোনো পথ, তারপর সামনের দরজা
পেরিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল রাস্তায়। একটা লোক সাইকেল চালিয়ে আসছিল সেই রাস্তা ধরে, ধাক্কা
সামলাতে সে হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল পাশের ঝোপের মধ্যে।
‘আমরা এসে গেছি, ডিয়ার,’ জানলা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে
উঠল সাদা বর্ষাতির মালিক, ‘খানিকটা জলকাদা ছিল বটে, তবে বেশির ভাগ জায়গাই শুকনো। শিকারটা ভালোভাবেই
উপভোগ করা গেছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলো তো, ও লোকটা কে, যে আমাদের আসতে
দেখেই ছিটকে পালিয়ে গেল?’
‘আরে
কে এক মিঃ নাটেল। সদ্য এসেছে এখানে,’ মিসেস স্যাপলটন
বললেন, ‘মনে হয় মাথার একটু গন্ডগোল আছে। যতক্ষণ
এখানে ছিল, সারাক্ষণ শুধু ওর রোগের কথাই বলে গেল। আর
অদ্ভুত ব্যাপার, যেই তোমাদের আসতে দেখল, অমনি
দুদ্দাড় করে ছুটে পালিয়ে গেল। যে
কেউ দেখলে ভাববে, লোকটা বোধহয় চোখের সামনে ভূত দেখেছে।’
‘আমার
মনে হয় ও পালিয়ে গেল আমাদের কুকুরটাকে দেখে,’ ভেরা শান্ত স্বরে বলল, ‘লোকটা আমায়
বলছিল, ওর কুকুরের প্রতি একটা মারাত্মক ভয় আছে। অনেকদিন
আগে নাকি একবার, কোন একটা নদীর ধারের কবরখানায় ওকে একপাল কুকুরে তাড়া করেছিল। কোনোরকমে
ছুটে গিয়ে একটা সদ্য খোঁড়া কবরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল লোকটা। তারপর
সারারাত ধরে মাথার ওপর একপাল হিংস্র কুকুরের চিৎকার, গর্জন আর দাঁতখিঁচুনি। ওঃ!
একটা লোকের সারাজীবনের আতঙ্ক হয়ে থাকার পক্ষে যথেষ্ট।’
ভেরার
কথা শুনে ঘরের সবাই বেশ বিচক্ষণভাবে ঘাড় নাড়লেন।
মুখ টিপে হাসল ভেরা।
চটজলদি
রোমাঞ্চকর গপ্পো বানাতে ওর মতো আর কে আছে!
_____
ছবিঃ পুষ্পেন মন্ডল
দারুন
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete