গল্পের ম্যাজিক:: ভূতের গল্প - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ


ভূতের গল্প
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

বিনোদবাবু আর প্রবীরবাবু তুমুল আড্ডায় মেতেছিলেন ওঁদের সম্পর্কটা শুধুমাত্র লেখক আর প্রকাশকের নয়, অভিন্নহৃদয় বন্ধু ওঁরা এমন সময় সুবীর ঘরে ঢুকল প্রবীরবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বাবা কাকুকে আমাদের প্ল্যানটা বলেছ?”
না রে, এখনও বলা হয়নি
কীসের প্ল্যান?” জিজ্ঞাসা করলেন বিনোদবাবু
বিনোদ, তুমি তো জানো এ বছর আমাদের ‘রামধনু’ আর ‘উল্কা’ দুটো পত্রিকারই সুবর্ণজয়ন্তী তাই সুবীরের ইচ্ছে দুটো পত্রিকাতেই নামী লেখকদের ইউনিক কিছু লেখা ছাপা হবে আর নতুন লেখকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা হবে বুঝতেই পারছ, প্রতিযোগিতার একজন বিচারক তুমি, বাকিটা এবার সুবীর বলবে
সুবীর এবার বিনোদবাবুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কাকু, আমি ভেবেছি এ বছররামধনুআর ‘উল্কা’-র শারদ সংখ্যার মূল আকর্ষণ হবে বিখ্যাত লেখক বিনোদ গুপ্ত-র লেখা ভৌতিক উপন্যাস ‘রামধনু’-তে ছোটোদের জন্য আর ‘উল্কা’-তে বড়োদের
বিনোদবাবু চমকে উঠলেন এ কী বলছে সুবীর! তাঁর এই দীর্ঘ লেখক জীবনে তিনি ভূত নিয়ে একটা অণুগল্প পর্যন্ত লেখেননি সত্যি কথা বলতে কী, তিনি ভূতের গল্প লেখার চেষ্টা করেননি এমন নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এত নামি প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়া সত্ত্বেও তিনি বারে বারে ভূতের গল্প লিখতে ব্যর্থ হয়েছেন এ হল তাঁর জীবনের এমন এক গোপন সত্য যা শুধু নিজের মনেই লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর ছেলেমেয়েরা ছোটোবেলায় অনেকবার আবদার করেছে, এখন নাতি-নাতনিরা করে, কিন্তু প্রতিবারই তিনি কিছু না কিছু বলে এড়িয়ে যান আজ পর্যন্ত কাউকে বলে উঠতে পারেননি যে তাঁর মাথায় কিছুতেই ভূতের গল্পের প্লট আসে না যেহেতু তিনি একজন নামকরা লেখক, তাই কেউ কল্পনাও করতে পারে না যে তিনি ভূতের গল্প লিখতে পারেন না এখন তিনি সুবীরকে না বলবেন কীভাবে? দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এদের সঙ্গে তিনি হালকা করে বলার চেষ্টা করলেন, “ভৌতিক উপন্যাস কেন? অন্য কিছু….সুবীর বাধা দিয়ে বলে উঠল, “ওটাই তো আকর্ষণ আজ পর্যন্ত কেউ আপনার ভৌতিক গল্প, উপন্যাস পড়েনি এই প্রথমবার আমাদের পত্রিকায় ছাপা হবে

হতাশায় পেনটা ছুঁড়ে ফেললেন বিনোদবাবু লিখতে বসেছিলেন ভৌতিক উপন্যাস, কিন্তু ঘন্টা তিনেক পরে তাঁর ডায়েরি ভরে উঠেছে একটা টানটান গোয়েন্দা কাহিনিতে আগের দিন তো আরও যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে গেল বাড়ির সবাই সন্ধেবেলা মার্কেটিং করতে বেরিয়ে যাবার পর বিনোদবাবু সারা বাড়ির আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতে বসেছিলেন তাঁর ধারণা হয়েছিল এরকম পরিবেশে মাথায় প্লট আসবে, কিন্তু শেষমেশ হাওয়ায় মোমবাতি গেল নিভে আর অন্ধকারে সুইচ বোর্ডের কাছে যেতে গিয়ে খেলেন এক আছাড় কী যে করবেন ভেবে পাচ্ছেন না বিনোদবাবু সুবীরের কাছে বোধহয় মুখ দেখাতে পারবেন না সত্যি কথাটা এবার সবার কাছে স্বীকার করতেই হবে

বালেশ্বর স্টেশনে নেমে চারিদিকে চোখ বোলাতেই বিনোদবাবুর চোখে পড়ল তাঁর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একটি বছর সাতাশের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তিনি এগিয়ে গেলেন
হোটেল জলপরি?”
হ্যাঁ স্যার আপনি নিশ্চয়ই বিখ্যাত লেখক বিনোদ গুপ্ত?”
মাথা নাড়লেন বিনোদবাবু
আমি রূপক জলপরির ম্যানেজার আপনি আসছেন শুনে নিজে নিতে এলাম বাইরে গাড়ি আছে স্যার, চলুন
সাদা স্কর্পিওতে চড়ে বসলেন বিনোদবাবু রূপক নিজেই চালাচ্ছে
“তুমি বাঙালি?”
হ্যাঁ স্যার আমার বাড়ি খড়গপুরে ছোটোবেলায় আপনার লেখা গোয়েন্দা গোবিন্দসিরিজ গোগ্রাসে গিলতাম
রূপকের কথা শুনে বিনোদবাবু হাসলেন
বিনোদবাবুর এক লেখক বন্ধু একদিন কথায় কথায় জানান যে তিনি মাঝে মাঝে কোনও নির্জন হিল স্টেশন বা সমুদ্রের ধারে একলা একলা ঘুরতে চলে যান, তাতে নাকি মাথায় গল্পের প্লট আসে ভালো কথাটা বিনোদবাবুর বেশ মনে ধরে ভূতের গল্প লেখার শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি বাইরে যাবেন ঠিক করেন তিনি যখন ভাবছিলেন কোথায় যাওয়া যায় তখনই তাঁর ভাগনে সুকান্ত তাঁকে বলে, “মামা, তুমি চাঁদিপুর চলে যাও আমি এই মাস দেড়েক আগে ওখানে একটা হোটেল কিনেছি নিজের মতো করে রেনোভেট করাচ্ছি আর বিল্ডিংও কিছু বাড়াচ্ছি, তাই এখন বেশি বুকিং করা হচ্ছে না এমনিতে চাঁদিপুরে পর্যটকদের ভিড় খুব একটা বেশি থাকে না, তার ওপর আমার হোটেলে বোর্ডারের সংখ্যা এখন খুবই কম, তাই তুমি নিশ্চিন্তে লেখালিখি করতে পারবেভাগনের প্রস্তাব মনে ধরে বিনোদবাবুর

স্যার, এই আপনার রুম দেখুন পছন্দ হয়েছে কিনা,রূপক বলে
খুব পছন্দ হয়েছে জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, আর কী চাই? এখন এক কাপ চা পেলে ভালো হত
অবশ্যই স্যার, আপনার যখন যা দরকার হবে শুধু মুখে একবার বলবেন আপনি এত বড়ো লেখক, তার ওপর আমাদের স্যারের মামা, আপনার কোনও অসুবিধা হতে দেব না আমরা
হোটেলটা সত্যিই নির্জন বিভিন্ন জায়গায় কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে বিনোদবাবুর রুম দোতলায় এখানে আর কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না নিচের তলায় কয়েকটা রুমে লোক আছে বলে মনে হল

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বিনোদবাবু লিখতে বসলেন জানালার ধারেই টেবিল-চেয়ার দেওয়া আছে একটানা লিখে চললেন ভাবলেন প্রথমে ছোটোদের জন্য লিখবেন লেখা যখন শেষ করলেন দেখলেন সেটা কিশোর উপযোগী একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিতে পরিণত হয়েছে ভূতের নাম গন্ধ নেই তাতে বিনোদবাবুর চোখে জল এসে গেল প্রায় অদ্ভুত ব্যাপার! তিনি কত কত গল্প, উপন্যাস লিখেছেন ছোটোদের বড়োদের সবার জন্য, কিন্তু কিছুতেই আর একটাও ভূতের গল্প লিখতে পারছেন না! রুম ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন বিনোদবাবু খুব সুন্দর হওয়া দিচ্ছে
আপনি কি বাঙালি?”
অচেনা কণ্ঠস্বরের আহ্বানে পেছন ফিরে তাকালেন বিনোদবাবু পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন বয়স ওনার চেয়ে অল্প একটু বেশি মনে হচ্ছে
হ্যাঁ আপনি?”
আমি নীলকান্ত পারিদা কটকে বাড়ি আমার ওখানকার একটা স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলাম আপনি কি একলা এসেছেন?”
হ্যাঁ, আপনার কোন রুম?”
আপনার দুটো রুম পরেরটা আমার আমিও একলাই এসেছি
নীলকান্তবাবুর সঙ্গে বিনোদবাবুর আলাপ বেশ জমে উঠল কিছু পরে দুজনে বিনোদবাবুর রুমে এসে বসলেন ভারী অমায়িক ভদ্রলোক, আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানও আছে এমন আন্তরিকভাবে কথা বলছেন যেন বিনোদবাবুর কতদিনের চেনা বিনোদবাবু শেষমেশ মনের দুঃখ আর মনে চেপে রাখতে পারলেন না, নীলকান্তবাবুকে তাঁর ব্যর্থতার কথাটা বলেই ফেললেন নীলকান্তবাবু মন দিয়ে সব শুনলেন, তারপর বললেন, “আপনার সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে জানেন? আপনি ভূতের গল্প লিখতে বসলেই শুরুতেই ভেবে নিচ্ছেন ভয়ানক কিছু লিখতে হবে ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে মাথায় অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ফেলছেন আর পাঁচটা গল্প যেভাবে লেখেন সেইভাবে লেখার চেষ্টা করুন ধরে নিন না, আত্মাও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, মানুষের মতো তারাও আছে জগতে গল্পের প্লট মাথায় এমনিই চলে আসবে জোর করে ভাবার দরকার নেই বুঝলেন
এই পর্যন্ত বলে নীলকান্তবাবু পকেট থেকে একটা নীল পার্কার পেন বার করে বিনোদবাবুকে দিয়ে বললেন, “আমাদের এই নতুন বন্ধুত্বের চিহ্নস্বরূপ এই পেনটা আপনাকে উপহার দিলাম এবার এটা দিয়ে একটা ফাটাফাটি ভৌতিক উপন্যাস লিখে ফেলুন দেখি
নীলকান্তবাবু তাঁর রুমে ফিরে যাবার পর বিনোদবাবু একবার ভাবলেন সমুদ্রের দিক থেকে একবার ঘুরে আসবেন, কিন্তু তারপরই সিদ্ধান্ত বদল করে উপহার পাওয়া পেনটা নিয়ে আবার লিখতে বসলেন

স্যার, স্যার শুনছেন
রূপকের ডাকে সম্বিৎ ফিরল বিনোদবাবুর কাঁচুমাচু হয়ে সে বলল, “স্যার, জানি লেখার সময় আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক নয়, কিন্তু রাত এগারোটা বেজে গেছে, আমাদের স্টাফরা এবার কাজ গুছিয়ে শুয়ে পড়বেআবার তো ওদের ভোর থেকে উঠে পড়তে হয়, তাই বলছিলাম কী আপনি যদি রাতের খাবারটা খেয়ে নিতেন
বিনোদবাবু অবাক হয়ে বললেন, “রাত এগারোটা বেজে গেছে!”
হ্যাঁ স্যার আপনি খুব মন দিয়ে লিখছিলেন বলে খেয়াল করেননি বিকেলের চাও আপনি খাননি আমাদের রুম সার্ভিসের ছেলেদের ডাকে ফিরেও তাকাননি আপনি আমি নিজে এসেছিলাম রাতে কী খাবেন জানতে, কিন্তু আপনি মন দিয়ে লিখছিলেন, কিছুই বলেননি, তাই আমি নিজেই আপনার ডিনারের মেনু ঠিক করেছি বাধ্য হয়ে
বিনোদবাবু হতভম্ব হয়ে গেছেন
তোমরা এতবার আমাকে ডেকেছ?”
হ্যাঁ স্যার আমি তো আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আপনাকে ডেকেছি
ও আচ্ছা সরি, বুঝলে - লেখায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম,অপ্রস্তুত হয়ে বললেন বিনোদবাবু
না না স্যার, কী বলছেন আপনি! খাবার এনেছে, আপনি খেয়ে নিন
বিনোদবাবু গোগ্রাসে খেতে আরম্ভ করলেন এত খিদে পেয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি খাওয়া শেষ করে নিজের লেখার খাতার দিকে মনোনিবেশ করলেন পাতার পর পাতা উলটে যাচ্ছেন আর অবাক হয়ে যাচ্ছেন ছোটোদের জন্য ভারী মজাদার একখানা ভৌতিক উপন্যাস লিখে ফেলেছেন তিনি সেটা শেষ করে দ্বিতীয় উপন্যাসটায় চোখ বোলাবার সময় তাঁর নিজেরই ভয়ে গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল এটা ‘উল্কা’-র জন্য দিলে সুবীর তো লুফে নেবে বিনোদবাবুর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না যে উনি এই উপন্যাসদুটো লিখেছেন বিস্মিত বিনোদবাবু ভাবতে বসলেন যে এটা কী করে সম্ভব হল! তাঁর এতদিনের ব্যর্থতা মাত্র কয়েক ঘন্টায় সাফল্যে বদলে গেল! তবে কি নীলকান্তবাবুর পরামর্শ মাথায় রেখে লিখতে বসেছিলেন বলেই এমনটা ঘটল? কাল সকালেই নীলকান্তবাবুকে ধন্যবাদ জানাতে হবে

নীলকান্তবাবুর রুমের দরজায় তালা দেখে বিনোদবাবু হতাশ হয়ে পড়লেন ভদ্রলোক কি হোটেল ছেড়ে দিলেন? পরমুহূর্তেই বিনোদবাবুর মনে হল উনি তো সমুদ্রের ধারে ঘুরতেও যেতে পারেন আজ তিনি নিজেও যাবেন আর তো ভূতের গল্পের চাপ নেই বিনোদবাবু নিচে নেমে এসে ম্যানেজারের অফিসে গেলেন ছোটো ছিমছাম অফিস ম্যানেজারের চেয়ারে রূপক বসে আছে তার উলটো দিকের চেয়ারে এক ভদ্রলোক বসে কথা বলছেন বিনোদবাবুকে দেখে রূপক শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল
“স্যার, আপনি কষ্ট করে নামলেন কেন? ফোন করলেই যা দরকার সব পাঠিয়ে দিতাম
কষ্টের কী আছে? আমি এখনও এত বুড়ো হইনি যে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে পারব না আমি ভাবলাম তোমার সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে সমুদ্রের দিকে যাব
এ তো আমার সৌভাগ্য স্যার
তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে রূপক অন্য ভদ্রলোকটির উদ্দেশে বলল, “দেবেনবাবু, আমি এনার কথাই বলছিলাম, বিখ্যাত সাহিত্যিক বিনোদ গুপ্ত আর স্যার, ইনি দেবেন মোহান্তি, আগের মালিকের আমলে এই হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন।”
দেবেনবাবু নমস্কার করে বললেন, “এদিকে কাজে এসেছিলাম, তাই একবার ঢুকে গেলাম পুরোনো কাজের জায়গা
বিনোদবাবু একটু হাসলেন, তারপর রূপককে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, বারো নম্বর রুমের নীলকান্তবাবু কোথায় গেছেন বলতে পারবে? উনি বেড়াতে গেছেন কোথাও? না বাড়ি চলে গেলেন? যদি বাড়ি ফিরে গিয়ে থাকেন তাহলে তোমার রেজিস্টার থেকে ওনার ঠিকানাটা আমাকে দিও
রূপক অবাক হয়ে বলল, “স্যার, ওই রুমে তো কেউ নেই ইন ফ্যাক্ট ওই ফ্লোরে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই আপনার লেখালেখির সুবিধার জন্য সুকান্ত স্যার ওই ফ্লোরে আপনার রুম দিতে বলেছিলেন
কী যা তা বলছ তুমি! আমার সঙ্গে কত গল্প করলেন ভদ্রলোক ওনার নাম নীলকান্ত পারিদা কটকে বাড়ি
স্যার, ওই নামে কোনও বোর্ডার নেই এখানে আপনি চাইলে রেজিস্টার দেখুন
এতক্ষণে দেবেনবাবু মুখ খুললেন, “যদি কিছু মনে না করেন, কী হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবেন?
বিনোদবাবুর কাছে নীলকান্তবাবু সম্পর্কে সব শুনে দেবেনবাবু বললেন, “কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি আমি আপনাদের কিছু কথা বলছি বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার
একটু থেমে দেবেনবাবু শুরু করলেন, “নীলকান্ত পারিদাও একজন লেখক ছিলেন, তবে উনি শুধু ভূতের গল্প লিখতেন আর অল্পস্বল্প গোয়েন্দা কাহিনি সেই কারণেই বিনোদবাবু, আপনি লেখক হওয়া সত্ত্বেও ওনার নামের সঙ্গে পরিচিত নন, তবে ওড়িশাতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে উনি ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন ওনার লেখা একেকটা ভূতের গল্পের বই নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত আজ থেকে চার বছর আগে নীলকান্তবাবু একদিন এই হোটেলে এসে ওঠেন আপনার মতোই একটু নির্জনে লেখালিখির উদ্দেশ্যে ওই বারো নম্বর রুমে ছিলেন উনি, আর ওনার পাশে তেরো নম্বরে ছিল তিনটে কমবয়সি ছেলে সেদিন রাতে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল ওই তিনটে ছেলে বহু রাত পর্যন্ত তুমুল হৈ- হল্লা করছিল নীলকান্তবাবু না লেখালিখি করতে পারছিলেন, না ঘুমোতে পারছিলেন উনি আমাদের বলায় আমরা ছেলেগুলোকে বারণ করে আসি, কিন্তু তারা ছিল বেপরোয়া তারা না থামায় নীলকান্তবাবু নিজে তাদের রুমে যান আর সেখানেই বিপদ ঘটে একটা ছেলে ওনাকে এমন ধাক্কা মারে যে দেওয়ালে মাথা ঠুকে ছিটকে পড়েন মাথা ফেটে অজ্ঞান হয়ে যান তারপরও লাথি-ঘুসি মারতে থাকে ছেলেগুলোর যখন হুঁশ হয় তখন সব শেষ বয়স তো হয়েছিল, এত অত্যাচার সহ্য হয়নি পেছনের পাঁচিলটা তখন নিচু ছিল ছেলেগুলো ভয়ে ওই ঝড়-জলের মধ্যেই পাঁচিল টপকে পালায়, যদিও পরে সবাই ধরা পড়ে যায় ওই ফ্লোরে সেদিন শুধু ওই দুটো রুমই বুক ছিল আর ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজে আমরাও কিছু বুঝতে পারিনি তাই সমস্ত ঘটনাটা সকালে ধরা পড়ে পুলিশ আসে, ওনার বাড়িতে খবর দেওয়া হয় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে, ওনার ছেলেমেয়েরা অনেক খুঁজেও ওনার প্রিয় নীল রঙের পার্কার পেনটা খুঁজে পায় না উনি ওটা দিয়েই লেখালিখি করতেন বাকি সব জিনিসপত্র ঠিকঠাকই ছিল এর ঠিক একমাসের মাথায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে নীলকান্তবাবুকে চিনত এমন একজন ওড়িয়া লেখক এই হোটেলে ওঠেন তাঁকে বারান্দা থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয় নীলকান্তবাবুর আত্মাকে তিনি দেখেছেন বলে দাবি করেন তিনি নাকি তাঁর দিকে এগিয়ে আসছিলেন এই কথাটা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই লেখকের কথা শুনে এক দুঃসাহসী তরুণ লেখক আমাদের হোটেলে আসে, কিন্তু তারও একই অভিজ্ঞতা হয় সেও নীলকান্তবাবুর পূর্বপরিচিত ছিল তাকে নাকি নীলকান্তবাবু নাম ধরে ডেকেছেন ক্রমশ এই হোটেলটা ভূতের হোটেল নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠে ব্যাবসায় মন্দা দেখা দেয় মালিক ঠিক করেন হোটেলটা বিক্রি করে দেবেন, কিন্তু সেখানেও সমস্যা ভূতের বদনামের জন্য কেউ কিনতে চায় না শেষে হোটেলটা বন্ধই করে দেওয়া হয় আমিও কাজ ছেড়ে পুরীতে আমার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে নতুন লজ খুলেছি আমার মনে হয় এখনকার মালিক কিছু না জেনেই হোটেলটা কিনেছেন
রূপক সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে দেবেনবাবু আবার বলেন, “সত্যি বলতে কী হোটেলটা আবার চালু হয়েছে শুনে আমি কৌতূহলবশতই খোঁজ নিতে এসেছিলাম যতই হোক, নিজের পুরোনো কর্মক্ষেত্র তো আমার মনে হয় নীলকান্তবাবু তাঁর প্রিয় পেনটা কোনও লেখকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, কারণ ওই দুই লেখক আর বিনোদবাবু ছাড়া আজ পর্যন্ত আর কেউ ওনাকে দেখেনি আমার মনে হয় এবার ওনার আত্মা শান্তি পাবে আর কেউ কোনোদিন ওনাকে দেখতে পাবে না
বিনোদবাবুর মাথাটা যেন ঘুরছে ধীর পায়ে তিনি বেরিয়ে এলেন রূপক তাঁকে ডাকছে, কিন্তু তিনি সাড়া দিতে পারলেন না চুপচাপ নিজের রুমে ফিরে এসে খাটের ওপর বসে রইলেন হঠাৎ দমকা হাওয়ায় একটা কাগজ উড়ে এসে তাঁর কোলে পড়ল কাগজটায় চোখ পড়ল তাঁর,

স্নেহের বিনোদবাবু,

কাল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল এই পরিচয়টা যদি আমার জীবিত অবস্থায় হত তাহলে বোধহয় আমরা খুব ভালো বন্ধু হতাম আপনার মতো একজন লেখকের হাতে আমার প্রিয় কলমটি তুলে দিতে পেরে এতদিনে আমি শান্তি পেলাম আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা আমার কলমটি আমার স্মৃতি হিসেবে যত্ন করে তুলে রেখে দিত, কিন্তু আমি তা চাইনি আমার ইচ্ছে আমার কলম লিখে চলুক আমার শেষ দুটি উপন্যাস আপনাকে উপহার দিয়ে গেলাম দুর্ভাগ্য, এগুলির প্লট আমার মাথায় থাকলেও লিখতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জীবনদীপ নিভে যায়, কিন্তু আজ আর আমার কোনও আপশোশ নেই আমি আজ মুক্ত ভালো থাকবেন, আর আমি জানি আপনি নিজেই এবার খুব ভালো ভালো ভূতের গল্প লিখতে পারবেন

ইতি
আপনার হতভাগ্য বন্ধু

বিনোদবাবুর চোখের পাতা দুটো ভিজে এল টেবিলে রাখা নীল পেনটার দিকে তাকিয়ে মনটা ভারী হয়ে গেল তিনি ঠিক করলেন কটকে গিয়ে একবার নীলকান্তবাবুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন মানুষটাকে আরও ভালোভাবে জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে তাঁর

‘রামধনু’ আর ‘উল্কা’-র পূজাসংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ হল ওড়িয়া সাহিত্যের বিখ্যাত ভৌতিক লেখক নীলকান্ত পারিদার দুটি অপ্রকাশিত ভৌতিক উপন্যাস যা অনুবাদ করেছেন তাঁর বন্ধু লেখক বিনোদ গুপ্ত, আর বিনোদবাবুরও নিজের লেখা দুটি ভৌতিক উপন্যাস থাকছে হ্যাঁ, বিনোদবাবু এখন খুব সহজেই ভূতের গল্প লিখে ফেলছেন
-----
ছবিঃ রুমেলা দাশ

1 comment:

  1. চমৎকার লাগল গল্পটা। চেনা ছকের মধ্যেও বড়ো সুন্দর একটা মানবিক রঙ গল্পটাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete