তথ্যের অধিকার
আইন
পার্থ দে
।। ১।।
এবার আষাঢ়
মাসের বৃষ্টি অনেকটা
পিছিয়ে গেছে।
সকাল দশটায় অফিসে
ঢুকেও গলদঘর্ম হচ্ছি।
মাথার ওপর সিলিং
ফ্যানটাও বোধহয় তীব্র
গরমে কষ্ট পাচ্ছে।
যেন ঘুরতেই চায়
না। অফিসে এসেই
একটু চা-জল
খেয়ে জিরিয়ে নিতে
না পারলে আমার
কাজে মন বসে
না। আমার পোস্ট
অফিস লাগোয়া চায়ের
দোকান থেকে নিতাই
কাচের গ্লাসে চা
দিয়ে যায়, সেটুকু
চুমুক দিতে দিতে
খবরের কাগজের পাতা
ওলটাই। খেলার পাতাটা
চেটেপুটে না নিতে
পারলে আমার দিনটা
কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে।
আজ একটা দারুণ
খবর আছে -- খালিদ জামিল
আমার প্রিয় ক্লাব
ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে
আসছেন! গতবছর নতুন
ক্লাব আইজল একাদশকে
তিনি আই লিগ
এনে দিয়ে সংবাদের
শিরোনামে উঠে এসেছেন।
খবরটা জমিয়ে পড়তে
শুরু করেছি, হঠাৎ
পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল।
“একটু
শুনবেন। আমার নাম
ভবতোষ সান্যাল।”
চোখ তুলে
তাকিয়ে দেখি এক
বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
বয়স আন্দাজ সত্তর
বাহাত্তর হবে।
গায়ে বাদামি রঙের
খদ্দরের পাঞ্জাবি, মাথার
সামনের দিকের চুল
প্রায় ফাঁকা।
দু-চার গাছি
সাদা চুল ঘামে
কপালের সঙ্গে লেপটে
আছে।
খুব বিরক্ত
হয়ে তাকালাম।
খালিদ জামিলের ওপর
প্রতিবেদন পড়াটা অসমাপ্ত
রেখে কঠিন গলায়
বললাম, “তো আমি
কী করব? আপনার
নাম ভবতোষ সান্যাল।
আমার নাম প্রলয়
শিকদার। সবারই একটা
নাম থাকে!” ভদ্রলোকের
দিক থেকে চোখ
সরিয়ে ফের খবরের
কাগজে মন দিলাম।
“প্লিজ
শুনুন, আপনি বিরক্ত
হবেন না,” ভদ্রলোক
মিনমিনে গলায় বলেন, “আমি
না আসলে… আসলে
আর টি আই অ্যাক্টে একটা
আবেদন করতে চাই।”
এবার আমার
পিলে চমকানোর পালা। ‘আর টি
আই অ্যাক্ট’ মানে
‘রাইট টু
ইনফরমেশন অ্যাক্ট’ অর্থাৎ
কিনা তথ্যের অধিকার
আইন। সাংঘাতিক ব্যাপার! এই
আইনে কোনও প্রশ্নের
লিখিত সঠিক উত্তর
দিতে হয়, তাও
আবার মাত্র তিরিশ
দিনের মধ্যে! উত্তর
না দিতে পারলে
শো কজ। মানে আমার
চাকরি নিয়ে টানাটানি! ভাবতেই
আমার শিরদাঁড়া টানটান
হয়ে উঠল, বললাম, “আরে,
সে কথা তো আগে
বলতে হয়, মেসোমশাই। বলুন, আপনার
জন্য কী করতে
পারি?”
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের
মুখে এক স্মিত
হাসি ফুটে উঠল।
উনি হাত বাড়িয়ে
একটা আবেদনপত্র বাড়িয়ে
দিয়ে বললেন, “আমার
স্ত্রী আজ প্রায়
একবছর আগে গত
হয়েছেন। দীর্ঘ রোগভোগের
পর ওঁর মৃত্যু
হয়। উনি ছিলেন
অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মচারী, ওর
পেনশন একাউন্ট ছিল
এই নাকতলা পোস্ট
অফিসে, কিন্তু মৃত্যুর
আগে উনি পাঁচমাস
পেনশন তুলতে পারেননি।
আমার স্ত্রীর মৃত্যুর
পর আমি তার
ডেথ সার্টিফিকেট, আর
পেনশনের বই জমা
দিয়ে তার প্রাপ্য
পাঁচ মাসের পেনশন
তোলার জন্য আবেদন
করেছিলাম, তাও প্রায়
একবছর আগে।
কিন্তু আজও তার
কোনও সুরাহা হয়নি।”
মন দিয়ে
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা
শুনতে শুনতে বলি, “দেখুন, আমি
তো সেই সময়
এই পোস্ট অফিসে ছিলাম
না, মাস তিনেক
হল আমি এখানে
বদলি হয়ে এসেছি।
তবে আপনার আবেদনপত্রটা
আমি জনতথ্য আধিকারিক
হিসেবে গ্রহণ করে
নিচ্ছি।”
ভদ্রলোকের
মুখে এক টুকরো
আশার আলো ফুটে
উঠল। একটু বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে ভদ্রলোক ওর মুখ
আর নাকের ওপর একটা ক্লিনিক্যাল মাস্ক টেনে নিলেন। সাধারণত এই ধরনের কাপড়ের মাস্ক জীবাণুর
সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য অসুস্থ মানুষদের পরতে হয়। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, আমার সঙ্গে
কথা বলার সময় মাস্কটা সরিয়ে বুকের কাছে নামানো ছিল।
দিন সাতেক কেটে গেছে। ঘটনাটা আর
আমার মাথায় রাখিনি। ভদ্রলোক সেদিন চলে যাওয়ার পর-পরই ঠিক
করেছিলাম বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। যা হোক একটা উত্তর দিয়ে দেওয়া যাবে’খন। তথ্যের
অধিকার আইনের আবেদনপত্রের উত্তর লেখার অনেক রকমের
টেকনিক আছে। সেগুলো অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’
গোছের অর্থাৎ অন্তঃসারশূণ্য উত্তর। যেমন ভদ্রলোকের আবেদনের জবাবে দিব্যি লিখে দেওয়া
যায় -- ‘আপনার এক বছর পূর্বের পাঁচমাসের প্রাপ্য পেনশনের আবেদনের ফাইলটি খুঁজে পাওয়া
যায়নি, তবে খোঁজ চলছে, পেলেই আপনাকে জানানো হবে।’ এতে উত্তরও দেওয়া হল আবার বিষয়টাকে
সুকৌশলে এড়িয়েও যাওয়া হল। মিনিবাসে অফিস যেতে যেতে এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমার
বন্ধু অতীশের কথা মনে পড়ল। আমরা দু’জন একসময়ে বেলগাছিয়া পোস্ট অফিসে একসঙ্গে চাকরি
করতাম। আমি এখন টালিগঞ্জ পোস্ট অফিসে আর ও পাইকপাড়া পোস্ট অফিসে পোস্টেড। এইসব জটিল
পরিস্থিতি সামলাতে অতীশের জুড়ি নেই। ভাবলাম অতীশকে একবার ফোনে ধরি, এই ব্যাপারে ওর
একটা পরামর্শ নেওয়া যাক।
মিনিবাসের পিছনের দিকের সিটে বসেছিলাম। মোবাইলে অতীশের
নম্বরটা বের করে রিং করলাম। ওপাশে দুবার রিং হয়ে কেটে গেল। তারপর ফোনটা একদম নিস্তব্ধ
হয়ে গেল। ওপাশে কেউ কল রিসিভ করেনি, রিং টোনটাও আর শোনা যাচ্ছে না। যাব্বাবা, কী হল!
বার দু-তিনেক চেষ্টা করলাম, প্রত্যেকবার একই ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ মনে হল যেন আমার পাশের
যাত্রীটি ফিসফিস করে বলে উঠল, “বি এস এন এলে যোগাযোগ করুন।”
চমকে উঠলাম। কিন্তু আমার তো অন্য
নেটওয়ার্কের ফোন কানেকশন! পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি যাত্রীটি বাসের মৃদু দুলুনিতে আয়েশ
করে ঝিমোচ্ছে। যাব্বাবা, কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনলুম যেন কথাটা। ভদ্রলোককে
ঘুম থেকে তুলে
জিজ্ঞেস করা যায়
না -- আপনি
আমায় কিছু বললেন! খুবই
বোকা বোকা শোনাবে।
এবার বাড়ির নম্বরে ফোন করলুম। ওপাশ থেকে আমার স্ত্রী ফোন ধরে বলল, “অফিস পৌঁছে
গেছ তো? আচ্ছা শোন, মনে আছে তো, আজ ঝুনুমাসির মেয়ের বিয়ে। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরো,
যেতে হবে কিন্তু।”
ফোনটা কেটে দিলাম। দিব্যি তো চলছে
ফোনটা, নেটওয়ার্কে কোনও গণ্ডগোল নেই। তবে কি অতীশের
ফোনটাতেই গণ্ডগোল?
সন্ধেবেলা
একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি
ফিরলাম। আজ ঝুনুমাসির মেয়ের বিয়ে। সেখানে যেতে
হবে, আবার তাড়াতাড়ি ফিরতেও হবে। কাল সকালে আবার অফিস আছে, আমার ছেলে বুবুনের স্কুলও
আছে। বিয়েবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসার ঘরে টিভিটা চালিয়ে খবরটা দেখছিলাম। বুবুনের
মা তখনও বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজ করছিল। আমার পাশে সোফায় বসে বুবুন
আমার মোবাইলটা নিয়ে গেমস খেলছিল। আমি একটু বিরক্ত হয়ে ওকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, বড়োদের
মোবাইল নিয়ে ওর এই ঘাঁটাঘাঁটির অভ্যেসটা ছাড়ানো দরকার। হঠাৎ ভিতরের ঘর থেকে বুবুনের
মা’র আর্ত চিৎকার শুনে বুবুন আর আমি দু’জনেই হকচকিয়ে গেলাম। দৌড়ে ভেতরের শোবার ঘরে
যেতেই দেখি আমার স্ত্রী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে অঝোরে কাঁদছে। এক ছুটে বুবুন গিয়ে
ওর মা’কে জড়িয়ে ধরল। আমি কাছে এগিয়ে যেতেই বুবুনের মা আয়নার সামনে রাখা গয়নার বাক্সটা
দেখিয়ে বলল, “এই দেখ, সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
সামনে ঝুঁকে গয়নার বাক্সটার দিকে
তাকিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হল বাক্সটা একটু খালি খালি লাগছে, কিছু একটা
নেই। বুবুনের মা তখন কান্নাভেজা গলায় বলে উঠল, “আমার সবচেয়ে প্রিয় সোনার নেকলেসটা চুরি
হয়ে গেছে, এখানেই ছিল, বাক্স খুলে দেখতে পাচ্ছি না আর।”
“যাবে কোথায়! ভালো করে খুঁজে দেখ,
হয়তো অন্য কোথাও ভুল করে রেখেছ,” ওকে আশ্বাস দিয়ে বলি।
সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি
তিনজন। দুটো শোওয়ার ঘর, একটা বসার ঘর, গেস্টরুম, এমনকি বাথরুম -- কিচ্ছু বাদ দিই না।
অনেক সময় মানুষ বাথরুমেও অনেক কিছু ভুল করে রেখে আসে। সোনার নেকলেস অবশ্য ঘরের মধ্যে
কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এমন একটা দামী জিনিস হারিয়ে বাড়ির সবার মন খারাপ। আমার স্ত্রী
মল্লিকা অর্থাৎ বুবুনের মা সেই থেকে কাঁদতে বসে গেছে। এই রকম মনের
অবস্থা নিয়ে বিয়েবাড়ি যাওয়া যায় না। তাই ঝুনুমাসির মেয়ের বিয়েতে যাওয়াটা বাতিল করতে
হল। ভাবলাম সকাল হলে লোকাল থানায় গিয়ে নেকলেস হারানোর জন্য একটা জেনারেল ডায়েরি করে
আসব।
।। ২।।
আচমকা চেঁচামেচিতে সকালের ঘুমটা
ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতে দেখি ছ’টা বাজে। বাইরে কেউ ইনিয়ে-বিনিয়ে
নাকি কান্না কেঁদে চলেছে। গলার স্বর শুনে মল্লিকার বলে মনে হচ্ছে না। এই সক্কালবেলা
এ আবার কী উপদ্রব শুরু হল, দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা কী! বিছানা ছেড়ে বাইরের ঘরে আসতে
দেখি আমাদের কাজের মেয়ে কুন্তলা হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে, “ও বউদি গো, আমাকে মাফ করে
দাও, এমন আর হবেনি, আমাকে পুলিশে দিওনি বউদি।”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে মল্লিকার দিকে
তাকাই। সে চোখের ইশারায় তার হাতে ধরা সোনার নেকলেসটা দেখায়। কালকের সেই হারানো নেকলেসটা
না! চমকে উঠি, আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের পাঁচ বছরের পুরোনো পরিচারিকা কুন্তলা
এমন কাজ করতে পারে! মল্লিকা আলতো করে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় কুন্তলার মাথায়, “ও মা,
তোকে পুলিশে দেব কেন? তোর টাকা লাগলে তো আমার কাছে চাইবি, তোকে আমরা কত ভালোবাসি। কিন্তু
তুই হঠাৎ এমন কাজটা করতে গেলি কেন?”
“আমার মাথায় শয়তান ভর করেছিল গো
বউদি, তোমার কত দামি জিনিস চারদিকে ছড়িয়ে থাকে, কোনোদিন কিছু নিয়েছি বল বউদি? আমি চুরি
করতে চাইনি, এই তোমার বুবুনের দিব্যি কেটে বলছি।”
“থাক তোকে আর দিব্যি কাটতে হবে না,” মল্লিকা বলে।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, আমরা কখনও
কুন্তলাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিনি, কারণ সে গত পাঁচবছরে পাঁচটা টাকাও এ বাড়ি থেকে
সরায়নি। তবে যখন সে নেকলেস চুরিই করল, তা বাড়ি বয়ে এসে ফেরত দিতে এল কেন? আমার ভাবনাটা
কুন্তলা বুঝতে পারল কিনা জানি না, সে আমার দিকে তাকিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, “দাদাবাবু,
সে এক ঘটনা! বললে তুমি মোটে বিশ্বাস করবেনি!”
আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাতে
সে ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে শুরু করল, “বউদি গো, কাল তুমি যখন চানে গেলে তখন ঘর মুছতে গিয়ে
চোখে পড়ে আলমারিতে চাবিটা ঝুলছে, তুমিই ভুল করে ওটা ওখানে লাগিয়ে চান করতে গিয়েছিলে।
তখনই লোভে পড়ে আলমারি খুলে তোমার গয়নার বাক্স থেকে নেকলেসটা চুরি করি। কিন্তু তারপরের
ঘটনা সাংঘাতিক। দুপুরবেলা ডায়মন্ড হারবার লোকালে বাড়ি ফিরছিলাম। রোজকার মতো ট্রেনের
ভেন্ডারে চেপেছিলাম। ট্রেনটায় লোক গিজগিজ করছিল। আমি কোমরের
কাছে শাড়ির ভাঁজে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিলাম তোমার নেকলেসটা। চারদিকে লক্ষ্য রাখছিলাম
যাতে চট করে কেউ গায়ের কাছে ঘেঁষতে না পারে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে মনে হল আমাকে কেউ নজর
রাখছে। সামনে তাকাতে দেখি একটা বুড়ি ভিড়ের মধ্যে থেকে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
সে কী ঠান্ডা ভয়ঙ্কর চোখ গো বউদি, দেখে আমার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গিয়েছিল। আমি সেদিক
থেকে চোখ সরিয়ে নিতে যাব, দেখি বুড়িটা আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট মুচড়ে হেসে উঠল। হিসহিস
করে চাপা গলায় বলে উঠল, ‘লজ্জা করে না, যার ঘরে খাস তার ঘরে চুরি করিস।’ শুনে আমি চমকে
উঠেছিলাম গো বউদি, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নিচের দিকে বয়ে গিয়েছিল।
ভয়ে আমি চোখ নামিয়ে কোমরের কাছটা শক্ত করে চেপে ধরেছিলাম। পরের মুহূর্তে চোখ তুলতেই
দেখি বুড়ি মাসিটা আর ওখানে নেই। অনেক খুঁজলাম কিন্তু আর তাকে দেখতে পেলাম না। আগেও
কোনোদিন সেই বুড়িমাসিকে ট্রেনে দেখিনি। তখন বউদি, আমার তো দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা!
বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুমোতে পারিনি, তোমার সোনার হার আগলে বসে কাটিয়েছি, তারপর ভোর হতে
ট্রেন ধরে তড়িঘড়ি তোমার হার ফেরত দিতে এসেছি।” হাঁপাতে হাঁপাতে এতদূর বলে কুন্তলা একটু
থমকায়, তারপর মল্লিকার দিকে চেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে, “আচ্ছা বউদি, তুমি কি জলপড়া, তেলপড়া
কিছু জান?”
কুন্তলার কথায় মল্লিকা হাসে কিন্তু
আমার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে ঠোঁট কামড়ে ধরে। আমি বলি, “কুন্তলা, তুমি ট্রেনের দুলুনিতে
ঘুমিয়ে পড়নি তো? মানে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছ হয়তো, এরকম তো অনেক
সময় হয়।”
“কী বলছ, দাদাবাবু,” আহত চোখে
কুন্তলা তাকায়, “তোমরা কি ভাবছ আমি মিছে কথা বলছি? সেই ভয়ঙ্কর চোখদুটো আমি এখনও ভুলিনি,
বুড়িমাসির মাথায় উলোঝুলো সাদা চুল, ডানদিকের কপালে ভুরুর ওপর একটা আঁচিল।”
কয়েকদিন যাবৎ মাথার মধ্যে কুন্তলার
উদ্ভট গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছে। গল্পটা অফিসের কয়েকজন কলিগকে বলেছি। কেউ বিশ্বাস করেনি,
গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিয়েছে। অনেকে বলেছে, চুরি করে হজম করতে পারেনি, তাই মেয়েটি চুরির
মাল ফেরত দিয়ে গেছে। আমার তবুও মনে হচ্ছিল কোনও একটা ব্যাপার আছে যেটা ব্যাখ্যার অতীত।
হাতের অন্য কাজগুলো সেরে তথ্যের অধিকার আইনের ফাইলটা খুলে বসলাম। প্রায় কুড়িদিন হয়ে
গেছে, ভবতোষ সান্যালের আর টি আই আবেদনপত্রটা এখনও ফাইল চাপা পড়ে আছে। এবার যা হোক একটা
উত্তর দিতেই হবে বানিয়ে বানিয়ে, কিন্তু আমার চাকরির সব দিক বাঁচিয়ে দিতে হবে উত্তরটা।
এই প্রসঙ্গে আবার অতীশের কথা মনে পড়ল। হাতে মোবাইলটা নিয়ে ওকে রিং করতে গিয়ে চমকে উঠলাম,
ফোনবুকে অতীশের নম্বরটাই নেই। অথচ সেদিনও আমি মিনিবাসে বসে অতীশকে ফোন করেছিলাম! মানে
ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম। তার মানে অতীশের নম্বর আমার মোবাইলে সেভ করা ছিল, স্পষ্ট
মনে আছে। অথচ সেই নম্বর এখন আমার ফোনবুক থেকে গেল কোথায়! আরও আশ্চর্যের বিষয় হল অফিসে
আর কারও কাছে অতীশের নম্বরটা পাওয়া গেল না। অথচ অনেকেই দাবী করল অতীশের নম্বর তাদের
কাছে ছিল কিন্তু সম্ভবত ভুলক্রমে ডিলিট হয়ে গেছে নম্বরটা।
।। ৩।।
মিনিবাসটা আজ অনেকক্ষণ জ্যামে
আটকে ছিল। আজ কোনও একটা রাজনৈতিক দলের মিটিং রয়েছে ব্রিগেডে, সকাল থেকেই রাস্তাঘাটের
অবস্থা বেশ খারাপ। মিনিবাস থেকে নেমে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছিলাম অফিসের দিকে। প্রায় পৌনে
এগারোটা বেজে গেছে। জামার পকেটে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা বের করে
দেখি স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে -- আননোন নাম্বার! তাড়াহুড়োর সময়ে অচেনা লোক ফোন করলে কিছুটা
বিরক্তই লাগে, তবুও ফোনটা ধরে নিলাম। ওপাশ থেকে অপরিচিত পুরুষকন্ঠ বলে উঠল, “বুবুনের
স্কুলের কাছেই ওদের কারপুলের গাড়িটা একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তবে চিন্তা করবেন না,
বুবুন ভালো আছে।”
আমার মাথাটা হঠাৎ কেমন ফাঁকা হয়ে
গেল। মুহূর্তের বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে উঠে কিছু প্রশ্ন করার আগেই ফোনটা কেটে গেল। রিসিভড
কলের লিস্টে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নম্বরটায় ফের রিং করতে ওপাশ থেকে যান্ত্রিক গলায় ভেসে
এল -- দিস নাম্বার ডাজনট্ একজিস্ট। খুব মানসিক চাপে পড়ে গেলাম। উত্তেজনায় আমার দম
বন্ধ হয়ে আসছিল। ভুয়ো কল করে এরকম সাংঘাতিক খবর কেউ দেয় না। অফিসে না ঢুকে রাস্তা থেকেই
একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লাম। বুবুনের স্কুল সাদার্ন এভিনিউয়ে, ট্যাক্সিওয়ালাকে সেদিকেই
চালাতে বললাম। দরদর করে ঘামছি আর ভগবানকে ডাকছি, আমার বুবুনের যেন কিছু না হয়। কীসব
অশৈলী ঘটনা শুরু হয়েছে দিনকয়েক ধরে, আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সাদার্ন এভিনিউ আর শরৎ
বসু রোডের ক্রসিংটা পেরোতেই হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার ডিভাইডারের ধারে বুবুনদের পুলকারের
গাড়িটা উলটে পড়ে আছে। চারপাশে জনাপাঁচেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে, দুজন ট্রাফিক সার্জেন্ট
নোটবুকে কীসব লিখে চলেছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে ওদের জিজ্ঞেস করতেই একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট
বলে উঠল, “দেখুন, যে সব বাচ্চারা চোট পেয়েছে তাদের কাছেই একটা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়া হয়েছে। তবে চোট কারও তেমন গুরুতর নয়। আমাদের কাছে চোট পাওয়া বাচ্চাদের একটা লিস্ট
আছে, আপনার ছেলের নামটা বলুন।”
“অনুভব শিকদার,” কাঁপা কাঁপা গলায়
আমি ট্রাফিক পুলিসটাকে বলি।
হাতের লিস্টে চোখ বুলিয়ে ভদ্রলোক
বলেন, “কই আমার তালিকায় তো এই নামের কোনও বাচ্চা নেই। আচ্ছা, আপনি স্কুল কর্তৃপক্ষের
কাছ থেকে কোনও ফোন পাননি? ওরা তো প্রত্যেকটা বাচ্চার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।”
ফোনের কথা অবশ্য আমার মনে পড়ল,
তাহলে বুবুন গেল কোথায়! আমার ভেতরের কাঁপুনিটা ফিরে এল। দুর্ঘটনাস্থল থেকে স্কুল খুব
একটা দূরে নয়। আমি বুবুনদের স্কুলের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়তে থাকি। ওদের স্কুলগেটটার
সামনে এসে দৌড় থামে আমার। ভেতরে ঢুকে সটান প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে দেখি বুবুন বসে বসে
ফ্রুট জুস খাচ্ছে। ওকে দেখে যেন আমার ধড়ে প্রাণ আসে। প্রিন্সিপাল ছাড়াও আরও জনাতিনেক
শিক্ষক-শিক্ষিকা বুবুনকে ঘিরে বসেছিলেন। প্রিন্সিপাল
একটু গম্ভীর গলায় বলেন, “মিঃ শিকদার, আপনি বুবুনের বাবা, তাই আপনাকেই বলি কথাটা। আজকের
দুর্ঘটনায় বাচ্চাগুলোর সবারই অল্পবিস্তর চোট লেগেছে, কিন্তু অনুভবের গায়ে একটাও আঁচড়
লাগেনি। এটা খুব আনন্দের কথা যে অন্য বাচ্চাগুলোর মতো ওকে স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক
চিকিৎসার জন্যও নিয়ে যেতে হয়নি। তাছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনুভব একা একাই হেঁটে স্কুলে
ফিরে এসেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা দুর্ঘটনার কারণে ওর ভেতর একটা ট্রমা হয়েছে, তাই স্কুলে
এসে থেকেই ও একটা আজগুবি গল্প শোনাচ্ছে।”
“না বাবা, আমি সত্যি বলছি, ওই
দাদুটাই আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গেছে,” বুবুন মরিয়া হয়ে বলে উঠল, “আমাদের গাড়ির সামনে
হঠাৎ একটা সাইকেল এসে পড়ায় ড্রাইভারকাকু ব্রেক কষেছিল, কিন্তু গাড়িটা খুব জোরে ঝাঁকুনি
দিয়ে বাঁদিকে হেলে পড়ল। আমি জানালা দিয়ে ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ছিলাম, সেই সময় দাদুটা
আমাকে টপ করে লুফে নিল। তারপর সেই দাদুটাই আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গেল।”
প্রিন্সিপাল শান্ত গলায় আমাকে
বলল, “বুঝতে পারছেন ওর ট্রমাটা কী রকমের গভীর, ওকে ডাক্তার দেখানো উচিত। আমরা আঘাত
পাওয়া সব বাচ্চাদের বাড়িতে ফোন করেছি, অনুভবের কোনও চোট লাগেনি বলে আমরা আপনাকে ফোন
করিনি। তবে ওর আবোলতাবোল কথা শুনে এখুনি আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আপনি
চলে এসেছেন।”
“আপনারা আমাকে কোনও ফোন করেননি?
তাহলে কে ফোনটা...”, হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতে বললাম, “বুবুন, সেই দাদুটাকে
দেখতে কেমন ছিল বল তো!”
“কেমন আবার, লম্বা, ফরসা, মাথায়
সাদা চুল... দাদুদের যেমন দেখতে হয়,” বুবুন হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে উঠল, “কিন্তু দাদুটার
নাকে-মুখে একটা কাপড়ের মাস্ক লাগানো ছিল। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মাস্কটা বুকের কাছে
নামানো ছিল।”
চমকে উঠলাম, মাথার ভেতর কী যেন
চিড়িক করে উঠল, প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললাম, “অনুভবের মা একটু পরে এসে ওকে বাড়ি নিয়ে
যাবে। আমার অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ আছে, অফিসে ফিরতেই হবে।”
অফিসে ফেরার পথে সংক্ষেপে ঘটনাটা ফোনে মল্লিকাকে জানালাম।
বললাম ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে এসে যেন বুবুনকে বাড়ি
নিয়ে যায়। আমাকে খুব জরুরি কাজে অফিসে ফিরতেই হবে। একটা ট্যাক্সিতে উঠে অফিসের দিকে
চললাম। মাথার মধ্যে অনেক কিছু ভিড় করে আসছে। বুবুনকে উদ্ধার করা দাদুর মুখে ক্লিনিক্যাল
মাস্ক লাগানো, ঠিক যেমনটা ছিল তথ্যের অধিকার আইনে আবেদনকারী ভবতোষ সান্যালের মুখে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত এতটা নিচে নামতে পারলেন! আমাকে ওর বিরুদ্ধে এখুনি পুলিশে
খবর দিতে হবে, উনি আমার সন্তানের মৃত্যুভয় দেখিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন! কিন্তু
মুশকিল হল ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে থানায় এফ আই আর করতে হলে ওর ডিটেলটা দরকার। ওর নাম, বাড়ির
ঠিকানা সব। আর এই বিস্তারিত বিবরণ আছে ভবতোষ সান্যালের আবেদনপত্রে। আমার শরীরের রক্ত
যেন রাগে ফুটতে শুরু করেছে। আমার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে।
অফিসে পৌঁছে তাড়াতাড়ি তথ্যের অধিকার
আইনের ফাইলটা খুলে বসলাম। এই তো এখানে ভবতোষ সান্যালের ঠিকানা দেওয়া আছে -- ২৮বি/৩ নাকতলা
রোড, কলকাতা-৭০০০৪৭। আজ ওর আবেদনের ২৭তম দিন, আর তিনদিনের মধ্যে ওর প্রশ্নের উত্তর
লিখিত আকারে দিতে হবে। ঠিক করলাম একটা মনগড়া উত্তর তো দেবই, তার সঙ্গে এমন ব্যবস্থা
করব যাতে সারা জীবনে আর কখনও চাইলেও ভবতোষ সান্যাল তার প্রশ্নের উত্তর না পান! অবশ্য
তার জন্য লাগবে ওর স্ত্রীর পেনশনের পুরোনো ফাইলটা। ওটাকে খুঁজে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
পেনশন ক্লোজ হয়ে যাওয়া ফাইলগুলো রেকর্ড রুমের কোথাও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। ভবতোষ সান্যালের
আবেদনটা জমা পড়ার পর একদিনের জন্যও ভালো করে খুলে পড়িনি। আজ ভালো করে পড়তেই ওর স্ত্রীর
নামটা খুঁজে পেলাম -- নমিতা সান্যাল, অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী। তৎক্ষণাৎ রেকর্ড সাপ্লায়ার
দীনুদাকে ডেকে পাঠালাম। ইঁদুর, আরশোলা ভরা রেকর্ড রুমে সাধারণত অফিসের কোনও কর্মচারী
ঢুকতে চায় না। দীনুদার অবশ্য অসীম ধৈর্য, আমার অনুরোধে দীনুদা রেকর্ড রুমে ঢুকে প্রায়
ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর নমিতা সান্যালের ক্লোজড পেনশনের ফাইলটা হাতে করে বেরিয়ে
এল। আমি দীনুদাকে অসীম ধন্যবাদ দিয়ে ফাইলটা খুললাম। এবার
আমার কাজ প্রায় শেষের দিকে, এই ফাইলটা ব্যাগে করে অফিসের বাইরে নিয়ে গিয়ে কোথাও ফেলে
দিতে হবে কিংবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ব্যস, তাহলেই সারাজীবনের মতো ভবতোষ সান্যাল এই ফাইলের
আর নাগাল পাবে না। তবে ফাইলটা ফেলে দেওয়ার আগে ভেতরটা দেখে নেওয়া উচিত। ফাইলটা খুলতেই
চোখে পড়ল নমিতা সান্যালের পি পি ও বই মানে পেনশনের বইসমেত আরও কাগজপত্র। বইটা খুলে
চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এটা কার ছবি! মাথার সামনের দিকে উলোঝুলো সাদা চুলের ভদ্রমহিলার
ডানদিকের কপালে ভুরুর ওপর একটা আঁচিল। আমার মাথার মধ্যে কুন্তলার গল্পটা ঝিলিক দিয়ে
উঠল। তবুও গল্পের সঙ্গে
চেহারার মিল নেহাত
কাকতালীয় হতেই পারে।
ভদ্রমহিলা যেন ছবি থেকে
ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছেন আমারই দিকে। আমি ছবিটার
দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে হল সেই দৃষ্টি যেন ক্রমে বদলে বিপন্ন এক মায়ের চোখের দৃষ্টি
হয়ে গেল। আমি দ্রুত হাতে ফাইলের কাগজগুলো ঘাঁটতে লাগলাম। নমিতা সান্যালের মাসিক পেনশন
ছিল একত্রিশ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তার পাঁচমাসের ক্লেম হয় এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার
টাকা, বেশ বড়ো অঙ্কের টাকাই এটা। কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ আমার হাতে ঠেকল রেল থেকে
পাঠানো স্যাংশন অর্ডার। তার মানে এই কেসটা পেনশন স্যাংশনিং অথরিটি রেল কর্তৃপক্ষের
কাছে পাঠানো হয়েছিল এবং ওরা পাঁচ মাসের বকেয়া পেনশন দেওয়ার অর্ডারও দিয়েছিল! অর্থাৎ
আমাদেরই কোনও ভূতপূর্ব কর্মচারীর ভুলে বকেয়া পেনশনের অর্ডারটা না দেখেই এই ফাইলটা আবর্জনাপূর্ণ
রেকর্ড রুমের অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। আমার মনটা হঠাৎ ভবতোষ সান্যালের প্রতি তীব্র
অনুকম্পায় ভরে উঠল। এটার জন্যই ভদ্রলোক প্রায় একবছর হন্যে হয়ে ঘুরছেন। ভদ্রলোকের আবেদনপত্রের
প্রশ্নগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। আবেদনপত্রের শেষে ভদ্রলোকের সই -- বি সানিয়েল। সেদিকে
তাকিয়ে আবার মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল। সেদিন মিনিবাসে আমাকে সেই রহস্যময় কন্ঠ সম্ভবত
‘বি এস এন এল’ নয়, বলতে চেয়েছিল--- ‘বি সানিয়েল’। বি সানিয়েলকে
যোগাযোগ কর! অবশ্য এটাও কাকতালীয়
বা আমার শোনার
ভুল হতে পারে!
ভদ্রলোকের
ওপর রাগটা যেন অনেকটাই কমে এল, সত্যি বলতে ভদ্রলোকের জন্যই বুবুন বড়োসড়ো দুর্ঘটনার হাত
থেকে রক্ষা পেয়েছে। আমি ঠিক করলাম ভদ্রলোকের তথ্যের অধিকার আইনে আবেদন
করা প্রশ্নের উত্তর তো দেবই, সঙ্গে বকেয়া
পেনশনের স্যাংশন অর্ডারটাও
তার হাতে তুলে দেব। উনত্রিশতম
দিনে অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করে ভবতোষ
সান্যালের তথ্যের অধিকার আইন আওতাভুক্ত সমস্ত
প্রশ্নের লিখিত উত্তর আর নমিতা সান্যালের পাঁচ মাসের
বকেয়া পেনশনের স্যাংশন অর্ডার
ও সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাগজ একত্রিত করে একটা বড়ো
খামে ভরে বাড়ি
ফিরে এলাম।
।। ৪।।
নাকতলা লেন
অনেক বড়ো জায়গা।
তার ওপরে সমস্যা
হল বাড়ির নম্বরও
সব এদিক ওদিক
ছড়ানো। রিকশাওয়ালাও ঘুরে
ঘুরে নাকাল হল।
শেষ পর্যন্ত যখন
হাল ছেড়ে ফিরে
যাব ভাবছি, তখন
একটা দোতলা পুরোনো
বাড়ির সামনে এসে
দাঁড়ালাম, দেওয়ালের গায়ে
কাঠ কয়লা ঘষে
লেখা ‘২৮বি/৩’।
আশেপাশের সব পুরোনো
বাড়ি ভেঙে ঝকঝকে
চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, তাদের
মাঝে প্লাস্টারচটা বাড়িটাকে
বড়োই শ্রীহীন লাগছে।
রিকশা থেকে নেমে নিচের দরজায় অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পর দোতলার জানালা থেকে একটি
মুখ উঁকি দিল। মিনিটখানেক পর সেই মুখটিই নিচে এসে দরজা খুলে দিল। আমার সামনে বছর চল্লিশের
একটি মানুষ, মুখভর্তি দাড়ি, মাথার চুল উসকোখুসকো। গায়ে গেঞ্জি আর পরনে মলিন পাজামার
মানুষটি বলল, “কাকে চাই?”
“ভবতোষবাবু আছেন। ভবতোষ সান্যাল,”
আমি প্রশ্ন করি, “আসলে ওর কয়েকটা দরকারি কাগজ দিতে এসেছি।”
“না, বাবা তো এখন বাড়িতে নেই।
আপনি কোথা থেকে আসছেন? আপনি আমাকেও বলতে পারেন, বাবা ফিরলে আমি...”
আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করে বলি, “না
না, আমি আপনার
হাতেই দিয়ে যাব
কাগজপত্র, আসলে আপনার
বাবা আমাদের নাকতলা
পোস্ট অফিসে কিছুদিন
আগে তথ্যের অধিকার
আইনে একটা দরখাস্ত
করেছিলেন, সেটার
উত্তরটাই আমি নিয়ে
এসেছি। সঙ্গে আপনার
মায়ের পাঁচমাসের বকেয়া
পেনশনের স্যাংশন অর্ডারটাও
নিয়ে এসেছি।”
“আসুন
আসুন, আপনি ভেতরে
আসুন,” ভদ্রলোক বিহ্বল ভাবটা
কাটিয়ে উঠে বলে।
দোতলার ঘরে
দু’জনে এসে বসি।
অন্ধকার, অবিন্যস্ত ঘর।
আমি একটা ভাঙা
সোফায় বসে আছি, ভদ্রলোক
একটা তক্তাপোষের ওপর
বসে আছেন, একটু
জড়োসড়ো ভাব।
দু’জনে কিছুক্ষণ চুপচাপ
বসে আছি।
ভদ্রলোকের মুখে সেই
বিহ্বল ভাবটা ফিরে এসেছে, আমার
দিকে একদৃষ্টে চেয়ে
আছেন। অস্বস্তি কাটাতে
প্রশ্ন করি, “আপনার
নামটা যেন কী?”
“অরুনাভ
সান্যাল,” ভদ্রলোক ইতস্তত
করে বলেন, “আপনার বোধহয়
একটু অসুবিধা হচ্ছে।
আসলে ঘরদোর খুব
অগোছালো।”
“না না, অত
ভাববেন না, এই
নিন ভবতোষবাবুর আর টি
আই অ্যাপ্লিকেশনের উত্তর
আর এই খামটাতে
আপনার মা নমিতা
দেবীর মৃত্যুর আগের
পাঁচমাসের বকেয়া পেনশনের
স্যাংশন লেটার।
ভালো করে সব
দেখে নিন।
আশা করছি খুব
শিগগির ওনার প্রাপ্য
এক লক্ষ পঞ্চান্ন
হাজার টাকার চেকটাও
আপনাদের দিয়ে যেতে
পারব।”
আমার হাত
থেকে খামটা হাতে
নিয়ে অরুনাভবাবু এক
মুহূর্ত আমার দিকে
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
হু হু করে কান্নায়
ভেঙে পড়লেন, “জানেন,
আমি জীবনে একটা
ফেলিওর। পড়াশোনায় আমার
মাথা ছিল না
কোনোদিন। আমার বাবা-মা
আমার জন্য অনেক
চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু
হয়নি। বড়ো হওয়ার
পরও আমাকে নিয়ে
ওদের অনেক চিন্তা
ছিল। আমি অনেক
রকমের ব্যাবসা করতে
গেছি, কিন্তু কোনও
ব্যাবসাই দাঁড় করাতে
পারিনি। বাবা-মা
দু’জনেই বড়ো চাকরি
করতেন, দু’জনে আমার
জন্য যৎসামান্য টাকাও
জমান। মা বলতেন, তোর
জন্য যা টাকা
পয়সা রেখে যাচ্ছি
তা দিয়ে তোর
চলে যাবে।
কিন্তু বছর আড়াই
আগে চাকরি থেকে
অবসরের পর আমার
মায়ের বুকে ক্যানসার
ধরা পড়ে, রেল
হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা
হচ্ছিল না বলে
বড়ো বেসরকারি হাসপাতালে
ভর্তি করতে হয়।
মা খুব আপত্তি
করেছিলেন, কিন্তু বাবা
যেন মাকে বাঁচাতে
মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা
জলের মতো খরচ
হতে শুরু করল।
হাসপাতালে তখন মা
ভর্তি, বাবা সেদিন
আমার আগেই মায়ের
কাছে হাসপাতালে
গিয়েছিলেন, আমি দরজার আড়াল
থেকে শুনতে পাই
মা বাবাকে বলছেন, ‘সব জমা
টাকা নষ্ট করে
ফেললে, এবার আমাদের
অরুর কীভাবে চলবে?’ জানেন,
মা আর বাবা
বরাবর আমার ভবিষ্যতের
কথা ভেবে আকুল
হতেন, আর আমি
এমনই অপদার্থ সন্তান
যে তাদের জন্য
কিছু করতে পারিনি।”
“অরুনাভবাবু,
সেজন্যই বোধহয় আপনার
বাবা আপনার মায়ের
পাঁচ মাসের বকেয়া পেনশনের
টাকার জন্য আমাদের
পোস্ট অফিসে হন্যে
হয়ে ঘুরছেন, সেজন্যই
বোধহয় উনি এসে
সেদিন তথ্যের অধিকার
আইনে আবেদন করেছিলেন।”
“আমার
বাবা আপনাদের পোস্ট
অফিসে কবে গিয়েছিলেন?” কান্না
থামিয়ে অরুনাভ প্রশ্ন
করেন।
“আজ থেকে
ঠিক একমাস আগে।
তথ্যের অধিকার আইন
অনুযায়ী আজই তার
প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার
শেষ দিন।
তাই তো আমি
নিজে…”
“দাঁড়ান
দাঁড়ান, আপনার বোধহয়
কোথাও ভুল হচ্ছে,” আমাকে
থামিয়ে অরুনাভবাবু বলতে
শুরু করেছেন, “কিন্তু তা
কী করে হবে! বাবা তো
কেয়ার নার্সিং হোমে
ভর্তি, আর আজ
ঠিক একমাস ধরে
বাবা ভেন্টিলেশনে আছেন। ডাক্তার
অবশ্য বলেছে কোমা
থেকে ফিরতেও পারে।”
আমি সোফা
ছেড়ে উঠে দাঁড়াই, শিরদাঁড়া
দিয়ে নেমে যায়
একটা ঠান্ডা স্রোত।
চোখের জল মুছে
অরুনাভবাবু আমার দিকে
অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে
থাকেন। আমি ওর
চোখ থেকে চোখ
সরিয়ে নিই, নজরে
পড়ে দেয়ালে একটা
বাঁধানো ছবি ঝুলছে
-- ছোট্ট অরুনাভ
দাঁড়িয়ে আছে এক
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার
মাঝে, ভদ্রমহিলার কপালের ডানদিকে
ভুরুর ওপর একটা
আঁচিল জ্বলজ্বল করছে।
টের পাই লাল
সিমেন্টের মেঝের ওপর
আমার পা-দুটো
ঠকঠক করে কাঁপছে।
মাথা নিচু করে
দরজার দিকে এগোতে
গিয়ে শুনতে পাই
আমার পিছনদিকে কোথাও
একটা মোবাইল বাজছে।
আমি আর একবারও
পিছনে ফিরে তাকাই
না। বারদুয়েক মোবাইলটা
বাজার পর মোবাইলের কলটা অরুনাভ ধরেছেন। অরুনাভবাবু
কথা বলছেন নিচু
গলায়। আমার পিছন থেকে তার কান্নাভেজা গলা ভেসে আসে, “কী বললেন, ক’টায়? পনেরো
মিনিট আগে, এগারোটা
কুড়ি নাগাদ? আচ্ছা, আমি
আত্মীয়স্বজনদের খবর দিয়ে আসছি
এখুনি।”
পিছনে
না তাকিয়ে আমি সোজা এগিয়ে যাই, দোতলার সিঁড়ি
বেয়ে দ্রুত নামতে
থাকি, এখানে আর
এক মুহূর্তও নয়।
ঠিক তখনই সিঁড়ির
অন্ধকার থেকে
একটা চেনা কন্ঠস্বর
ভেসে আসে, “একটু
শুনবেন। আমার নাম
ভবতোষ সান্যাল।
আমি একটা আর টি
আই অ্যাপ্লিকেশন করতে
চাই।”
_____
অসাধারণ! এই বিষয়ের ওপর আজ অবধি বাংলা-ইংরেজি কোনো ভাষায় এমন গল্প পড়েছি বলে মনে হয় না। সিরিয়াসলি ভালো গল্প।
ReplyDeleteঅসাধারণ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ঋজু গাঙ্গুলি, রুমেলা দাস। জঁর সাহিত্যে আপনার মতামত অত্যন্ত মূল্যবান।
ReplyDeleteঅসাধারণ! পার্থ, মর্মস্পর্শী লেখা।
ReplyDeleteKhub sundor
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteBes bhalo
ReplyDeleteপার্থ দা, এই লেখা পড়ে আমি বাকরুদ্ধ হলাম, তোমার সব লেখাই খুব ভালো কিন্তু এটা অসামান্য..কতগুলো ইমোশন যে ভিড় করে এলো চোখে... অসাধারণ লেখা
ReplyDeletekhub bhalo..mon chuye gelo
ReplyDelete