সাইকেল
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
আবার নতুন ঝামেলা সেই ব্রজেনবাবু আর নীতিশবাবুকে
নিয়ে। ব্রজেনবাবু আর নীতিশবাবুকে নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঝামেলার শেষ নেই। বরং
বলা ভালো ব্রজেনবাবুর আর নীতিশবাবুর মধ্যে ঝামেলা না থাকলে আমাদের পাড়াটা কীরকম
ঝিমিয়ে থাকে। ম্যাজিক ল্যাম্পের পাতায় এই দুই বন্ধুর ঝামেলা নিয়ে তোমাদের আগেও
গল্প শুনিয়েছি। যারা ভুলে গিয়েছ তাদের একটু মনে করিয়ে দিই এই বন্ধুত্বের ইতিহাস।
দশাসই চেহারার ব্রজেনবাবু আর প্যাঁকাটি কাঠির মতো চেহারার
নীতিশবাবুর আমাদের পাড়ায় বসবাস তিন পুরুষ ধরে। দু’জনের বাড়ি মুখোমুখি, কিন্তু ব্রজেনবাবুর
সঙ্গে নীতিশবাবুর পাঁচ বছর বয়স থেকে ভয়ানক শত্রুতা। সেই শত্রুতার সূত্রপাত হয়েছিল ডাংগুলি
খেলা থেকে। এখন ইস্যু বাড়তে বাড়তে একশো বিরানব্বইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে রাখি, ব্রজেনবাবু নীতিশবাবুকে ‘ফড়িং‘ বলে ডাকেন আর নীতিশবাবু ব্রজেনবাবুকে
বলেন ‘হাতি।’
আমাদের পাড়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ডাক্তার হলেন
অবনী ডাক্তার। যার যা কিছু অসুখ-বিসুখ করে একবার অবনী ডাক্তারের কাছে যায়। তারপর অবস্থা বুঝে অবনী
ডাক্তার ব্যবস্থা নেন। অধিকাংশ সময়ে অবনী ডাক্তারের ওষুধে ছোটোখাটো সমস্যা মিটে
যায়। পাড়ার লোকজন অবনী ডাক্তারকে তাই সকলেই সম্ভ্রমের চোখে দেখে। কিন্তু অবনী ডাক্তার
পাড়ার মধ্যে দু’জনকে খুব ভয় পান। তাঁরা হচ্ছেন এই ব্রজেনবাবু আর
নীতিশবাবু। কতবার যে এরা দু’জনে অবনী ডাক্তারকে পুলিশ আর জেল হাজতের ভয়
দেখিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন সকালে ব্রজেনবাবু এসে হাজির হলেন অবনী ডাক্তারের
চেম্বারে। প্রত্যেক
মাসেই একবার করে আসেন। ব্লাড প্রেশার ঠিক আছে কিনা দেখিয়ে সেই সঙ্গে ওজনটাও একটু
মেপে যান। যা বিপত্তির শুরু হয় ওই ওজন মাপার থেকেই।
ব্লাড প্রেশার মাপিয়ে ব্রজেনবাবু ওজন যন্ত্রর দিকে
এগিয়ে গেলেন। আর তাই দেখে অবনী ডাক্তার ঘামতে শুরু করলেন। ব্রজেনবাবু ওজন যন্ত্রর
উপরে উঠলেন। বাঁই বাঁই করে সংখ্যাগুলো ঘুরতে আরম্ভ করে এক জায়গায় এসে
তিরতির করে কাঁপতে থাকল। ব্রজেনবাবু মাথা সোজা করে পিঠ টান করে দাঁড়িয়ে আছেন। ভুঁড়িটা এতই বড়ো যে মাথা নিচু
করলে ওজন দেখা যায় না। অবনী ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, “কত হল হে অবনী?”
ওজনটা জানাতে অবনী ডাক্তারের গলা শুকিয়ে যায়।
দুবার ঢোঁক গিলে ঠোঁট চেটে বললেন, “চল্লিশ।”
ব্রজেনবাবু মহা খুশি হলেন। খবর আছে নীতিশবাবুর গত
মাসে ওজন ছিল বিয়াল্লিশ। তার মানে বডি ফিটনেসে ফড়িং-কে হারিয়ে দিয়েছেন। পকেট
থেকে একটা লজেন্স বার করে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “মিষ্টিমুখ করো। আজকে বড়োই খুশির
দিন। এমনিতেই ক’দিন ধরে শরীরটা বেশ চাঙ্গা ঝরঝরে লাগছিল। তোমার কাছে ওজনটা
মাপিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।”
ডাক্তারকে সত্যি কথা বলতেই হবে। এই বয়সে ব্রজেনবাবুর
ওজনটা রীতিমতো চিন্তার কারণ। অনেক দোনামনা করে চোখ বুজে অবনী ডাক্তার
সত্যিটা বললেন,
“আগের মাসে
একশো পঁয়ত্রিশ ছিল। মানে আপনার ওজন গত মাসের চেয়ে উলটে আরও পাঁচ কেজি বেড়েছে।”
ব্রজেনবাবু স্থির দৃষ্টিতে অবনী ডাক্তারের মুখের
দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর টেবিলের ওপর দুম করে একটা কিল বসিয়ে, হুংকার দিয়ে উঠলেন, “তোমায় আমি চিটিংবাজি
করতে বারণ করে সাবধান করেছিলাম। এবার কিন্তু আমি ভয়ংকর অ্যাকশন নেব। জজসাহেবের মুখ থেকে দশ
মাসের জেল আর দশ হাজার টাকা জরিমানা না করালে তোমার শিক্ষা হবে না।”
টেবিলের ওপর কয়েকটা শিশি বোতল পড়ল। ব্রজেনবাবু লজেন্সটা ফেরত
নিয়ে পকেটে পুরে নিলেন। কাঁচুমাচু মুখ করে অবনী ডাক্তার বললেন, “আমার অপরাধ কী?”
“সেটা আবার নিজের মুখে জিজ্ঞেস করছ? লজ্জা করে না তোমার, ভুল রেজাল্ট দেওয়া ওজন যন্ত্র
দিয়ে ডিসপেন্সারি চালাচ্ছ, মধুকে মনে আছে বাজারে মাছ বিক্রি করত? ওজনে কম দিত। আমি ধরেছিলাম। একেবারে
বাজার ছাড়া করে দিয়েছি। তোমারও একই দশা করব।”
নিজেকে বাঁচাতে অবনী ডাক্তার বললেন, “কিন্তু মধু তো ওজনে কম
দিত। আমি তো আর কম বলছি না।”
যুক্তিটা ব্রজেনবাবুর মনে ধরল। কিন্তু ব্রজেনবাবু
ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। অবনী ডাক্তারকে বললেন, “ক্ষমা তোমাকে করে দিতে পারি।
একটাই শর্তে। আমার ওজন ওই শুধু চল্লিশ করে দিতে হবে। আর শোনো, ওই খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার
মতো আজেবাজে কথা যদি আরেকবার বলেছ, তোমার নামে ডবল কেস ঢুকে দেব। আমার ওজন যে একশো চল্লিশ
কেজি বলছ, এটা প্রমাণ সাপেক্ষ।
যতদিন না এটা প্রমাণ হয় ততদিন আমার ওজনটা আর যেন কাকপক্ষীতে টের না পায়। বিশেষত
তোমার জেঠিমা। মনে আছে নিশ্চয়ই একবার জেঠিমাকে বলে দিয়েছিলে আমার খাওয়া-দাওয়ার
ওপর নজর রাখতে। তারপর এক মাস আমার ওপর কী অত্যাচারটাই না হয়েছিল। আর এসবের জন্য তুমিই
দায়ী ছিলে।”
অবনী ডাক্তারের পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়াতে
বুকটা কেঁপে উঠল। ব্রজেনবাবুর স্ত্রী একবার অবনী ডাক্তারকে দেখাতে এসেছিলেন। তখন কথায়
কথায় ব্রজেনবাবুর ভালোর জন্যই ব্রজেনবাবুর স্ত্রীকে ওঁর খাওয়া-দাওয়ার দিকে একটু
নজর দিতে বলেছিলেন। তাতে অবশ্য ব্রজেনবাবুর স্ত্রী যা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, আপ্সে ভোজনরসিক
ব্রজনবাবুর ওজন কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রজেনবাবু বাজারে গিয়ে হরির দোকানে
কচুরি জিলিপি খেয়ে সেটুকু পুষিয়ে দিয়েছিলেন আর অবনী ডাক্তারকে প্রাণে মেরে
ফেলার হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন।
অবনী ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্রজেনবাবু আবার
হুংকার দিলেন,
“কী এত ভাবছ? কী যে ছাতার মাথা
ডাক্তার তুমি,
বুঝি না। এত ভেবে ভেবে ওষুধ দিতে
হয়? চট করে বলো। তুমি ভাববে
আর আমি বসে থাকব,
অত ফালতু সময় আমার হাতে নেই।”
ধমক খেয়ে অবনী ডাক্তার কোনোক্রমে বললেন, “হাঁটা।”
“উফ,” প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ব্রজেনবাবু
বললেন, “এটা একটা ডাক্তারের কথা হল? অত হাঁটাহাঁটির পরিশ্রমই
যদি করব, তাহলে তোমাকে ফিজ দেব
কেন? খাওয়া কমানো চলবে না, হাঁটাহাঁটির দাওয়াই
চলবে না। নতুন কিছু জানা থাকলে বলো। না হলে তোমার এই চিটিংবাজির ব্যাবসার
আমি কী হাল করি দেখতে পাবে।”
আর সাত পাঁচ ভাবার সময় নেই। অবনী ডাক্তার কোনোরকমে
বলে উঠলেন,
“সাইকেল।”
ব্রজেনবাবু এক দৃষ্টিতে আবার খানিকক্ষণ অবনী ডাক্তারের
মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। অবনী ডাক্তারের ভেতরটা ধুকপুক করছে। খুব মনে করার চেষ্টা
করছেন, সাইকেল যদি না হয় তাহলে
এবার কী বলে নিস্তার পাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রজেনবাবুর মুখে একটা হাসি খেলে
গেল, “সাইকেলে হবে বলছ?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন অবনী ডাক্তার। বললেন, “আলবাত হবে। নিশ্চয়ই হবে। একশোবার হবে। আপনি সাইকেল
চালাবেন আর আপনার ওজন কমবে। গ্যারান্টি।”
ব্রজেনবাবু পকেট থেকে আবার লজেন্সটা বার করে অবনী
ডাক্তারের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখেছ তো, আমার বকাঝকা না খেলে তোমার ডাক্তারি বুদ্ধিটা খোলে না।”
অবনী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ব্রজেনবাবু
ঠিক করলেন, শুভ কাজে একদম বিলম্ব
নয়। একেবারে একটা সাইকেল কিনে সেটা চালিয়েই বাড়িতে ফিরবেন। পাড়ায় একটাই
সাইকেলের দোকান। হুইল ব্রাদার্স। একটা রিকশা ধরে হুইল ব্রাদার্স-এর সামনে এসে খুব দমে
গেলেন। আজকে রবিবার। হুইল ব্রাদার্স বন্ধ। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করার
মতো ধৈর্য ধরছে না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছেন সাইকেল চালিয়ে গোটা পাড়ায়
প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছেন আর ওজনটা কমে যাচ্ছে। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবছেন, আর সেই সময়ে চোখে পড়ল
পাড়ার দুধওয়ালা রামপেয়ারীদা দুধের ক্যান ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।
“অ্যাই রামপেয়ারী,” ব্রজেনবাবুর বাজখাঁই
গলার ডাক শুনে রামপেয়ারীদা কেঁপে গেল। সাইকেলের উপর টলমল করে উঠল। ক্যান
থেকে খানিকটা দুধ ছলকে পড়ল। রামপেয়ারীদা রামনাম জপতে শুরু করল।
ব্রজেনবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ওদিকে দেখছিস কী? এদিকে আয়।”
রামপেয়ারীদা এগিয়ে আসতে ব্রজেনবাবু সাইকেলটার দিকে
দেখিয়ে বললেন,
“এইটা আমার
আজকের জন্য চাই। কালকে আমি নতুন সাইকেল কিনে তোকে তোর সাইকেল ফেরত দিয়ে দেব।”
একটাই সাইকেল রামপেয়ারীদার। এই সাইকেল করেই বাড়ি
বাড়ি দুধ দেয়। এখন
ব্রজেনবাবু এই সাইকেলে চাপলে সেই সাইকেলের কী দশা হবে ভেবে আতঙ্কিত হয়ে
রামপেয়ারীদা মুখ ফসকে বলে ফেলল, “আপনি সাইকেল চালাতে জানেন বাবু?”
ভয়ংকর রেগে উঠলেন ব্রজেনবাবু, “মর্কট, তুই কি জানিস সাইকেল
চালানোয় আমি চ্যাম্পিয়ন ছিলাম আর সাইকেল আর সাঁতার একবার কেউ শিখলে কোনোদিন ভোলে
না? বেশি কথা বলিস না। আমি এই রিকশায় বসে
রইলাম। তুই পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুধের ক্যানগুলো তোর বাড়িতে নামিয়ে সাইকেলটা
নিয়ে আয়। আজ আমি সাইকেল চালিয়ে গোটা পাড়া ঘুরে তবেই বাড়ি ফিরব।”
রামপেয়ারীদার কেঁদে ফেলার অবস্থা। তবে এই পাড়ায় থাকতে
গেলে ব্রজেনবাবুর কথা মানতেই হবে। তাই বাড়ি গিয়ে দুধের ক্যান
নামিয়ে দেয়ালে যত ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল প্রণাম করে সাইকেলটা নিয়ে এসে হাজির হল
ব্রজেনবাবুর সামনে।
রিকশা থেকে নেমে বহু কসরত করে সাইকেলের সিটে বসলেন
ব্রজেনবাবু। কিন্তু প্যাডেলে পা দিয়ে ব্যালেন্সটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারলেন না। সেই দোষটাও চাপালেন
রামপেয়ারীদার ওপর, “কী
আজেবাজে সাইকেল কিনেছিস? প্যাডেল হ্যান্ডেল কিছুই ঠিক নেই। শুধু ঘন্টিটাই ঠিকঠাক
বাজে। ধর পেছন থেকে ভালো করে। আমি যতক্ষণ চালাব, তুই পেছন থেকে ধরে সঙ্গে সঙ্গে
আসবি। দুধে অনেক জল মিশিয়েছিস, এটাই তোর শাস্তি।”
সকাল থেকে এতসব যে হচ্ছে, সব খেয়াল রেখেছেন নীতিশবাবু। ব্রজেনবাবু কখন কী করছেন
লুকিয়ে লুকিয়ে সব খবর রাখেন নীতিশবাবু। এবার ব্যবস্থা নিতে হয়। হাতি যদি পাড়া দাপিয়ে
সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাহলে নিজের আর কোনো মানসম্মান থাকবে না। অযথা সময় আর নষ্ট না
করে নীতিশবাবু প্রথমেই সোজা গেলেন অবনী ডাক্তারের চেম্বারে। গলার শির ফুলিয়ে খ্যানখ্যানে
গলায় জবাবদিহি চাইলেন, “বলি
ব্যাপারখানা কী অবনী?”
ব্যস, অবনী ডাক্তারকে এর বেশি আর কিছু বলতে হল না। যা বোঝার
বুঝে গেলেন। মিনমিনে গলায় শুধু বলতে পারলেন, “সাইকেল।”
“এই বদ মতলব তোমার মাথা থেকে
বেরিয়েছে বুঝি?”
অবনী ডাক্তার
তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “না
আপনাকেও বলতাম...”
“কিন্তু কোথায় আর বললে? তুমি কখন বলবে তার জন্য
আমি অপেক্ষা করে থাকব?
সাইকেল আমিও এখুনি জোগাড় করছি। ওই হাতির সামনে দিয়ে সাইকেল
চালিয়ে সোজা থানায় যাব আর বড়োবাবুকে পেছনের ক্যারিয়ারে চড়িয়ে তবেই এখানে ফেরত
আসব। তোমাকে হাতকড়া পরে জবাবদিহি করতে হবে, কেন হাতিকে সাইকেল
চালাতে বলেছ?”
“আজ্ঞে ওজন... এক্সারসাইজ...”
কথা শেষ করতে দিলেন না নীতিশবাবু, “এই ওজন বাড়ানোর জন্য
আমার কাছে তুমি প্রত্যেক মাসে ফিজ নিচ্ছ, ছাইপাঁশ বলছ, এক গ্রামও ওজন বাড়ছে না।”
ভয়ে ভয়ে অবনী ডাক্তার বললেন, “আপনার খিদে বাড়ানোর সব
রকম চেষ্টা তো করছি। কিন্তু আপনি যাই খান অম্বল হয়ে যায়।”
“সেটা আমার দোষ নয়, তোমার দোষ। এখন বলো
সাইকেল চালালে ওজন বাড়বে?”
একটা বাঁচার রাস্তা পেয়ে অবনী ডাক্তার বললেন, “নিশ্চয়ই বাড়বে। যত সাইকেল চালাবেন, তত এক্সারসাইজ হবে, তত চড়চড় করে খিদে বাড়বে। খিদে বাড়লে বেশি খাবেন। বেশি খেলেই ওজন বাড়বে।”
উৎফুল্ল হয়ে লাফিয়ে উঠলেন নীতিশবাবু, “তার মানে হাতিটার সাইকেল
চালিয়ে উলটে আরও ওজন বেড়ে যাবে? এতদিনে তুমি একটা কাজের কাজ করলে।” পকেট থেকে কয়েকটা হজমি
বার করে অবনী ডাক্তারের হাতে দিয়ে নীতিশবাবু বললেন, “এইবার দেখো আমার খেল!”
নীতিশবাবুরও আজকেই একটা সাইকেল চাই। কিন্তু সমস্যা সেই একই। আজকে হুইল ব্রাদার্স
বন্ধ। নীতিশবাবু এক ইঞ্চি বাড়তি জমি ছাড়তে চান না ব্রজেনবাবুকে। এই সমস্যার একটা
সমাধান চাই। আর আমাদের পাড়ার সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার জন্য রয়েছে আমাদের
ক্লাবের সেক্রেটারি মান্টুদা। মান্টুদা আবার এখন পাড়ার
কাউন্সিলরও। নীতিশবাবু সোজা চলে গেলেন মান্টুদার বাড়ি। মান্টুদা দরজা খুলতেই
নীতিশবাবু বলে উঠলেন, “একটা
সাইকেল চাই। এখুনি।”
আঁতকে উঠে মান্টুদা বলল, “এখন কোথায় সাইকেল পাব?”
“কোথায় পাবি মানে?” খ্যানখ্যানে গলায়
চিৎকার করতে থাকলেন নীতিশবাবু, “কোথায় পাবি সেটা আমাকে বলে দিতে হবে? ভোটের সময় যে বলেছিলি
আপদে বিপদে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যখন যা সেবা লাগবে বলবেন, আলোর গতিতে আপনার সেই সেবা করে
দেব। আজ তোর পরীক্ষা। যদি ফেল করিস তারপরের ফলাফলের জন্য আমি দায়ী থাকব না, আগের থেকে বলে দিলাম।”
মান্টুদার মতো লোকও ব্রজেনবাবু নীতিশবাবুকে রীতিমতো
সমঝে চলে। এদের কোনো বিশ্বাস নেই। কখন যে কী করে ফেলবে। হয়তো মুখ্যমন্ত্রীকেই
অভিযোগ জানিয়ে পাঁচ পাতার লম্বা একটা চিঠি পাঠিয়ে দেবে। তারপর ঠেলা কে সামলাবে? মান্টুদা মাথা চুলকোতে
থাকল। নীতিশবাবু মনে করিয়ে দিলেন, “তোর ছেলে একটা সাইকেল চালায় না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু ও তো সাইকেল চালিয়ে
স্কুলে গেছে। বাড়িতে ওই একটা মাত্রই সাইকেল আছে।”
“আহা, একটা মাত্র কোথায়?” বিরক্ত গলায় নীতিশবাবু
বললেন, “আরে ওই সাইকেলটা, তোর ছেলেকে আগে দেখতাম
পার্কে একটা লাল রঙের সাইকেল চালাত।”
“ও সেটা তো ছোটোবেলায় চালাত। ব্যালেন্স রাখার জন্য
পেছনের চাকার দুদিকে সাপোর্ট দেওয়া চাকা ছিল।”
নীতিশবাবুর চোখটা চকচক করে উঠল, “ওইটাই তো আমার চাই। সাপোর্ট রাখার চাকা আবার
কী? দুটো বড়ো বড়ো চাকা মানেই
সাইকেল। এখুনি বার কর।”
চিলেকোঠার ছাদে ছিল সাইকেলটা। তড়িঘড়ি ছাদ থেকে
সাইকেলটা নামিয়ে নিয়ে এল মান্টুদা। ধুলো ঝাড়ার সময় নেই। নীতিশবাবু সাইকেলটা
প্রায় কেড়ে নিলেন। শুধু একটাই দুঃখ। সাইকেলটায় কোনো বেল নেই। বিরক্ত বলায় নীতিশবাবু
বললেন, “কী যে করিস না তোরা! সব
জায়গায় খুঁত রেখে দিস। দে একটা রুলার দে। ওটা দিয়েই বেলের কাজটা সারব।”
পরিত্রাণ পেতে মান্টুদা ছেলের পড়ার টেবিল থেকে
একটা কাঠের স্কেল এনে নীতিশবাবুর হাতে দিয়ে দিল। ছোটোদের সাইকেল। কিন্তু নীতিশবাবু্র ছোটোখাটো
রোগাপাতলা চেহারাটা দিব্যি এঁটে গেল। নীতিশবাবু সাইকেল চালিয়ে চললেন ব্রজেনবাবু
রাস্তায়। মান্টুদা প্রথমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও পরক্ষণেই প্রমাদ গুনল। পাড়ার শান্তি রক্ষা করার
দায়িত্ব মান্টুদারও আছে। এখন প্রলয়ংকর কিছু না ঘটে যায়। তাড়াতাড়ি থানার বড়োবাবুকে
ফোন করল।
মান্টুদার ফোন পেয়ে বড়োবাবু বললেন, “আমিও এখুনি খবরটা পেয়েছি। আমার এক কনস্টেবলকে
পাঠিয়েছি ওই রাস্তার দু’দিকে নো এন্ট্রি বোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। আর খবর
পেয়েছি এসবের জন্য দায়ী নাকি অবনী ডাক্তার। আমি যাচ্ছি ওর চেম্বারে। আপনিও চলে আসুন।”
অবনী ডাক্তারের চেম্বারে মান্টুদা আর বড়োবাবু
পৌঁছিয়ে রীতিমতো ধমক দিলেন ডাক্তারবাবুকে। তারপর কারণটা জানলেন। মান্টুদা
আক্ষেপ করে বলে উঠল, “এই
সময়ই ওদের ভাইপো আর ভাগনে দুটো, টিটো আর বিল্টু বাইরে। নাহলে ওরাই সমস্যার
সমাধান করে দিত।”
বড়োবাবু কাতর গলায় বললেন, “আপনি কিছু একটা ব্যবস্থা করুন
মান্টুবাবু। খবরের চ্যানেলের রিপোর্টাররা এল বলে। এবার কিছু হয়ে গিয়ে লালবাজারে
রিপোর্ট চলে গেলে আমার সুন্দরবনে ট্রান্সফার কেউ আটকাতে পারবে না।”
মান্টুদা অনেক মাথা চুলকে একজনের কথাই মনে করতে
পারল। কার্তিক। এই পাড়ার ছেলে চিৎপুরে যাত্রা করে বেশ নাম ডাক
করেছে। আর দেরি না করে কার্তিককে মোবাইলে ফোন করে মান্টুদা বলল, “ভাই কার্তিক, পাড়ার জনস্বার্থে তোকে
একটা কাজ করে দিতেই হবে। তুই এখুনি ডাক্তারের মেকআপ নিয়ে অবনী ডাক্তারের
চেম্বারের সামনে চলে আয়। বাকি কথা ওখানে বলছি।”
পাড়ায় বারান্দায় বারান্দায় লোকজন উপচে পড়ছে। এমন অভাবনীয় দৃশ্য আগে
কখনও কেউ দেখেনি। ব্রজেনবাবু একটা সাইকেল চালানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু প্যাডেল ফসকে
ফসকে যাচ্ছে। ঘেমে নেয়ে পেছন থেকে ধরে আছে রামপেয়ারীদা আর ওদিকে ব্রজেনবাবুকে
ঘিরে একটা বাচ্চাদের সাইকেল নিয়ে গোল গোল করে ঘুরছেন নীতিশবাবু। তার হাতে একটা স্কেল। সেই স্কেলটা দিয়ে
সাইকেলের হ্যান্ডেলে মেরে মেরে এত আওয়াজ করে ‘পারে না, পারে না’ বলে চ্যাঁচাচ্ছেন যে কান পাতা
দায়। ব্রজেনবাবুও হিমশিম খেতে খেতে পালটা বলতে ভুলছেন না, ‘চিটিংবাজ, দু-চাকা পারেনা, চারচাকা চালায়।”
এমন সময় পুলিশের জিপ থেকে নামলেন বড়োবাবু, মান্টুদা এবং সাদা
অ্যাপ্রন পরা উলোঝুলো চুল দাড়ির এক ডাক্তার সাজা কার্তিক। কার্তিক এগিয়ে গিয়ে
স্টেথোস্কোপ ব্রজেনবাবুর বুকে পিঠে লাগাল। তারপর ব্রজেনবাবুর কানের কাছে
ফিসফিস করে বলল,
“আপনি তো
দেখছি দারুণ বুদ্ধিমান। হনলুলুর পরে এই প্রথম এরকম একটা
কেস দেখছি। আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি আপনি দারুণ সাইকেল চালাতে পারেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছে করে
চালাচ্ছেন না। আর তাতে বোকা বনে যাচ্ছেন ওই নীতিশবাবু। সাইকেল চালিয়ে
চালিয়ে উলটে আরও রোগা প্যাঁকাটি হয়ে যাচ্ছেন। শরীরে আর কোনো ফিটনেস
নেই দেখতেই পাচ্ছেন। যান, আজকের মতো বাড়ি যান। কাল আবার হবে। আর এবার একদম নতুন
সাইকেল কিনে করবেন।”
এরপর কার্তিক এগিয়ে গেল নীতিশবাবুর
কাছে। বুকে
পিঠে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে নীতিশবাবুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আপনি তো দেখছি দারুণ
বুদ্ধিমান। হংকং এর পর এই প্রথম এরকম একটা কেস দেখছি। আপনাকে দেখে
ব্রজেনবাবু তো পুরো হতাশ হয়ে পড়েছেন। যত হতাশা তত খিদে। সেই খিদেটা মরে যাওয়ার
আগে ওকে বাড়ি যেতে দিন। যত খাবেন তত উলটে আরও মোটা হবেন। আপনার মতো ফিট শরীর করার
জন্য সাধনা দরকার, সেটা
ওঁর কোনোদিন হবে না।”
কাজ হল। ব্রজেনবাবু আর নীতিশবাবু দু’জন
দু’জনের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন। বড়োবাবু গদগদ হয়ে
কার্তিক আর মান্টুদার হাত দুটো ধরে কৃতজ্ঞতায় বলে উঠলেন, “কী বলে যে আপনাদের ধন্যবাদ দেব।
আপনারা আমার সুন্দরবনের ট্রান্সফারটা আটকে দিলেন।”
মান্টুদা গম্ভীর মুখে বলল, “সমাজসেবাই আমার ব্রত। আর একটাই
কাজ বাকি আছে। দাঁড়ান সেটা সেরে ফেলি।” মান্টুদা পকেট থেকে মোবাইলটা বার
করে বাঁ হাতের পাঞ্জাবির আস্তিনটা নামিয়ে হাতে পরা তামার বালাটা ধরে অল্প মোচড়
দিয়ে হুইল ব্রাদার্সের মালিককে ফোন করে উলটে আরও গম্ভীর গলায় বলল, “মান্টু সামন্ত বলছি।
জনস্বার্থে আগামী একমাস আপনাদের দোকান যেন না খোলে।”
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
No comments:
Post a Comment