ঝাপান পাহাড়ের দানো
দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
(১)
সাল ১৯৫৫
প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে উত্তাল প্রকৃতি। আকাশ চিরে একের পর এক রুপোলি
আলোর ঝলকানি। ভালু গাঁওয়ের অধিবাসীরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি এই
অঞ্চলে মাঝেমধ্যে হলেও তার এমন রুদ্ররূপ ওরা বহু বছর বাদেই দেখল। ওদের দরমার বেড়া আর ধুপিকাঠের পলকা
ঘরগুলো যে কোনো মুহূর্তে উড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। গাঁওবুড়া মাকালু আর ওদের সামান (পুরোহিত) সূরিয়া গ্ৰামের মুখে বড়ো পাথরটার নিচে আশ্রয় নিয়ে এই
দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজছিল। হঠাৎ যেন একটা আগুনের গোলা আছড়ে পড়ল
ঝাপান পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়চুড়োর কিছুটা অংশ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। বড়ো বড়ো পাথর
গড়িয়ে নামছিল উপর থেকে। মাটিও যেন এই অভিঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। পাহাড়ের গায়ে যে
সরু ঝরনাটা বয়ে চলে হঠাৎ গুরগুর শব্দে এক প্রবল জলোচ্ছ্বাসে পিচবোর্ডের টুকরোর মতো
ওদের বাড়িঘরগুলোকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আবার একটা সবুজ আলোর ঝলকানি দেখা গেল পাহাড়ের মাথায়।
তারপরেই পাহাড় ভেঙে নেমে এল জলের ধারা, সেই জলরাশির তোড়ে ভেসে গেল মাকালু, সূরিয়া সহ অসহায় গ্ৰামবাসীরা।
পরদিন সকালে আরেকটু নিচের ফাদং বস্তির
লোকেরা দেখল ঝাপান পাহাড়ের মাথাটা কেমন যেন একটা অর্ধচন্দ্রর মতো আকার হয়ে গেছে।
কাল রাতের দুর্যোগ ওরাও প্রত্যক্ষ করেছে। হড়পা বানে ভেসে গিয়েছিল ভালুগাঁও। বিশাল বড়ো বড়ো
পাথর গড়িয়ে নেমেছিল পাহাড় থেকে। সকালে নরম রোদ উঠলেও রাতের বিধ্বংসী তাণ্ডবের
চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। পূজারিজির কথায় ওরা সবাই মঙ্গল গান গাইতে গ্ৰামের
শেষের সবচেয়ে পুরোনো পাকুড় গাছটার কাছে জড়ো হয়।
(২)
সাল ২০২২
ফাদং বস্তির থেকে ভেড়া আর ছাগল চড়াতে পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ
কিছুটা উঠে এসেছিল শিবা। সামনের পাহাড়টা পার হলেই ওই ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়ালে যে
সবচেয়ে বড়ো নীলচে পাহাড়টা, ওর নাম ঝাপান পাহাড়। ওদের ওদিকে যাওয়া
বারণ। কিন্তু গাছদাদু ওকে নিয়ে একবার ওই ঝাপান পাহাড়ে যেতে চায়। গাছদাদু লোকটা যে
কে, কেন এই ঘন জঙ্গলে এসে বাসা
বেঁধেছে, ওরা কেউ জানে না। বুড়োলোকটা ওই পরিত্যক্ত শিকারবাড়িটা সারিয়ে নিয়ে এই
জঙ্গলে রয়েছে আজ দু’বছর। তবে লোকটা খুব ভালো। অনেক জড়িবুটি
জানে, ওষুধ দেয়
ওদের। এর আগে নীল কুরুচ ফুল আনতে দিয়েছিল শিবাকে। এই পাহাড়ের অনেকটা ওপরে হয় ওই
ফুল। আর এবার বলেছে সাপুইলতা আনতে। কিন্তু ওই লতা এ পাহাড়ে কোথায়? খুব কম চোখে পড়ে সাপুইলতা। থাকতে পারে ওই সবুজ নীল
মেঘের আড়ালে ঝাপান পাহাড়ে। কিন্তু ওই পাহাড়ে যাওয়া যে ওদের বারণ! ওই পাহাড়ে
নাকি আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। তবে একবার ওর দুটো ভেড়া চড়তে চড়তে ঝাপান
পাহাড়ে চলে গেছিল বলে বাধ্য হয়ে ওদের খুঁজে আনতে গেছিল ও। মেঘের আড়ালে সব সময়
লুকিয়ে থাকে এ পাহাড়টা। বড়ো বড়ো পাইনগাছে ছাওয়া পাহাড়ের মাথাটা প্রায় নেড়া, এক খাবলা যেন কে কামড়ে খেয়েছে মনে হয়।
গাঁয়ে ফিরে ও ভয়ে কাউকে বলেনি
যে ও ওখানে গিয়েছিল। ওদের গাঁয়ে মন্ত্র পড়ে বাঁধন দিয়েছে পূজারিজি। তাই দুষ্টু
আত্মা প্রবেশ করবে না কখনও। কিন্তু... ঝাপান পাহাড়ে গেলে নাকি সবাই আত্মার কোপে পড়ে।
বহু বছর আগে শিবার বাবা ধানুকা
শিকার খেলতে চলে গেছিল ওই ঝাপান পাহাড়ে। ধানুকার তাকত ছিল, একাই একটা বুনো শুয়োর বা নীলগাই মারতে পারত। বকনা
হরিণ এমনকি ভালুও মেরেছে ওর বাবা। সেই ধানুকা আত্মার কোপে পড়েছিল ঝাপান পাহাড়ে
গিয়ে। দাদাজি বলত ঝাপান পাহাড়ে অভিশাপ আছে, ওই পাহাড়ে যারা যায় তারা সবাই অভিশাপের কবলে পড়ে। বছরের
বেশিরভাগ সময় ওই পাহাড় ঢাকা থাকে মেঘের আড়ালে। ছাগল ভেড়া যাতে ওদিকে চলে না যায় তা
লক্ষ রাখাই শিবার কাজ।
তবে মেঘের আড়ালে ওই নীল পাহাড়
ওকে ভীষণভাবে টানে।
পশ্চিম আকাশে একটা বড়ো কালো মেঘ
আস্তে আস্তে আকারে বড়ো হচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে ছাগল আর ভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে
বাড়ির পথ ধরে শিবা। ধানুকা মারা যাওয়ার সময় ও ছিল মাত্র পাঁচ বছরের। ধানুকা চলে
যেতেই ওদের উপর দুর্যোগ নেমে এসেছিল। ওর দাদাজি বিছানা নিয়েছিল। এক টুকরো চাষের খেতে
যেটুকু ভুট্টা আর সবজি হত, তা দিয়ে তিনটে মাসও চলত না। দুটো ভেড়া
তিনটে ছাগল আর গোটা চারেক মুরগি ছিল ওদের শেষ সম্বল। ও সাতে পড়তেই মা ওকে এই ভেড়া
চড়াবার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল মুখিয়াজিকে বলে। ওদের বস্তির বেশিরভাগ ভেড়া আর ছাগল ও
চড়ায়। শীতের জন্য ঘাস জোগাড় করে রাখে। শিবার ভালো লাগে এভাবে পশুর পাল নিয়ে
পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে। এখন ওর বয়স দশ পেরিয়েছে। যবে থেকে গাছদাদু ওই বাড়িতে আছে, ওকে দিয়ে বস্তি থেকে টুকটাক জিনিস আনায়। দু’বার ওকে
নিয়ে নিচের টাউনেও গেছে। ওরও দু-পাঁচ টাকা রোজগার হয়।
ফেরার পথে ও গাছদাদুর বাড়িতে
একবার ঢুঁ মারে। পাথর আর কাঠের তৈরি এই বাড়িটা যে কত বছরের পুরোনো
ও নিজেও জানে না। দাদাজি বলেছিল এক সময় এই পাহাড়ে শিকার খেলতে আসত অংরেজরা। তাদের
খুশি করার জন্য সিকিম আর ভুটানের রাজারা জঙ্গলের ভেতর এমন সব পাথরের ঘর বানিয়ে
দিত। ওদের এই জায়গাটার পূবে ভুটান, পশ্চিমে সিকিমের পাহাড়। জায়গা দুটোর
ও নাম শুনেছে, কখনও যায়নি।
এর ভেতরেই বড়ো বড়ো ফোঁটায়
বৃষ্টি নামল। ও ভেড়ার পাল নিয়ে জোরে পা চালাতেই ছোটো ছোটো সাদা বরফের টুকরো খসে
পড়তে শুরু করল আকাশ থেকে। তাড়াতাড়ি ভেড়ার পালকে নিয়ে ও গাছদাদুর বাংলোর নিচে আশ্রয়
নেয়। বড়ো বড়ো ছ’টা পাথরের পিলারের উপর কাঠ আর পাথরের
বাংলোটা। পিলারের নিচে অনেকটা জায়গা। বন্য প্রাণীর হাত থেকে বাঁচতে এভাবে
শিকারবাড়িগুলো তৈরি হত।
ছাগল ভেড়ার গলায় ঘন্টির টুংটাং
শব্দে গাছদাদু বারান্দায় বেরিয়ে আসে। শিবাকে দেখে উপরে ডেকে নেয়। তীক্ষ্ম বৃষ্টির ছাঁট
আর কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার থেকে বাঁচতে শিবা উপরে উঠে আসে।
“ভিজে গেছিস তো, এই তোয়ালেটা দিয়ে মাথাটা মুছে নে। কী দেই তোকে পরতে বল তো? দাঁড়া দেখছি।” বৃদ্ধ লোকটা ভেতরের ঘরে ঢুকে যায়। নীল তোয়ালেটা দিয়ে
মাথাটা শুকনো করে মুছে নেয় শিবা। একটু পরেই বৃদ্ধ একটা পুরোনো গেঞ্জি কাপড়ের
পায়জামা আর ফুলহাতা একটা মোটা জামা এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, “বেশ বড়ো হবে। তবুও এটাই পরে নে এখন। কোমরে এই দড়িটা
বেঁধে নে। ভেজা কাপড় মেলে দে ওই বারান্দার দড়িতে। আমি ফায়ার প্লেসটা জ্বালিয়ে
দিচ্ছি।”
শিবা একটু হেসে বলে, “আমার ইতে কিছু হবেক লাই দাদু। কত্ত ভিজি আমি পাহাড়ে।”
“যা বলছি তাই কর। আমি চা বানিয়ে আনছি।” বৃদ্ধ ফায়ার প্লেসে আগুন দিয়ে ভেতরে চলে যায়।
শিবার খুব ভালো লাগে গাছদাদুর
এই ভালোবাসাটুকু।
পোশাক বদলে ও ফায়ার প্লেসের
পাশে এসে বসে। আগুনটা উসকে দেয়। সত্যি আরাম লাগছে।
একটু পরেই কাচের গ্লাসে গরম
কালচে পানীয় নিয়ে আসেন বৃদ্ধ। শিবা এর আগেও দু’বার এই ‘চা’
খেয়েছে। নিচের
দিকের পাহাড়ে নাকি এই গাছ হয়। শহরের লোক এটা খুব খায়।
“তারপর...
তুই তো লতাটা
আনলি না। কবে আনবি?” বৃদ্ধ
প্রশ্ন করে।
গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে শিবা
বলে, “উ লতা তো ইখানে খুব কম হয়, ঝাপান পাহাড়ে উ গাছ আছে। আমাদের যে উথে যাওয়াটা মানা, দানো আছে।”
“তাহলে আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চল। তুই দূর থেকে দেখিয়ে দিবি।
আমি চলে যাব।”
“কিন্তু উ পাহাড় বহুত উঁচা তো। পথটাও চড়াই আছে, তুমি একা...”
“এক কালে হিমালয়ের কত উপরে একা একা গেছি জানিস। পাহাড়ে চড়া
আমার নেশা রে। এখন বয়স হলেও যেতে পারব। তুই শুধু পথটা দেখিয়ে দিলেই হবে।”
শিবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, “উ পাহাড়ে পিশাচ আত্মারা থাকে, দানো থাকে। তোমার যদি কুন ক্ষতি টো হয়...”
“আমার কিছু হবে না। আমি মন্ত্র জানি। এই দেখ এই পাহাড়ের এত
উপরে এতদিন ধরে রয়েছি, কিছুই হয়নি।”
শিবা সেটাও ভেবে দেখেছে। এই
জঙ্গলে কেউ রাত কাটায় না, কত রকম দুষ্টু
আত্মা রয়েছে এই জঙ্গলে। অথচ বুড়ো তো দু’বছর পার করে ফেলল। একাই থাকে, লাল বস্তির একটা বউ সকালে এসে টুকটাক ঘর পরিষ্কার করে রান্না করে দেয়। বুড়োর সাহস আছে।
বৃষ্টিটা প্রায় দু’ঘন্টা পর থামতেই
শিবা ওর ভেড়া ছাগল নিয়ে বেরিয়ে এল। পরদিন ও দাদুকে পথ চিনিয়ে দেবে বলে এসেছিল।
(৩)
তিরতির করে বয়ে চলা ঝরনাটা পার
করে ওরা এসে দাঁড়িয়েছিল একটা পাহাড়ের মাথায়। সামনের গিরিখাতটা পার করলেই ঝাপান
পাহাড়। প্রায় এক ঘন্টা একটানা উঠে হাঁপিয়ে গেছিল বৃদ্ধ।
শিবা বলে, “এখনও অনেকটা উঠতে হবে দাদু। সাপুইলতা এত্ত নিচে হয়
না। উই যে পাহাড়ের মাথাটা, ঠিক দেখো আধা
চাঁদের মতো। ওর গায়ে হয়। আমি এই পাহাড়ের মাথায় নীল কুরুচ ফুল আনতে গিয়েই দেখেছি।
আগে এদিকেও দু-একটা হত। অনেক উঁচুতে পাথরের গায়ে যেখানে বড়ো গাছ হয় না, সেখানে হয় সাপুইলতা।”
“আমি পারব। তবে সময় লাগবে। ওই লতা থেকে একটা দারুণ ওষুধ তৈরি
হবে। যেটা প্রচুর মানুষের কাজে লাগবে, মানুষ অনেকদিন বাঁচবে।”
একটু ইতস্তত করে শিবা বলে, “সাবধানে যেও। ওই পাহাড়ে দানো আছে কিন্তু।”
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী দীপ্তময় হাজরা
মৃদু হাসেন শুধু। এদের মনে গেঁথে বসা ভয়কে দূর করার এটাই উপায়। এই পাহাড়ের
মানুষগুলো বড়ো সরল। তাই অনেকেই এদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠকায়। বৃদ্ধ ইংরেজিতে
কিটসের দু-লাইন কবিতা আউড়ে শিবাকে বলে, “এই যে মন্ত্র পড়লাম। কোনো দুষ্টু আত্মা আর কিছু করবে না।
এবার যাই।”
ঝরনাটা পার করে মেঘের আড়ালে
হারিয়ে যায় বৃদ্ধ।
অনেকক্ষণ ভেড়া, ছাগলগুলো একা রয়েছে। শিবা নেমে আসে নিচের দিকে।
গাছদাদু কি একা সাপুইলতা চিনে নিতে পারবে! কে জানে। একের পর এক মেঘের দল উড়ে আসে নীল ঝাপান পাহাড়ের
দিকে। মাঝে মাঝে মেঘ সরে গেলে ঘন পাইন বনের ফাঁকে ধোঁয়াশা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
দুপুরে ভুট্টার খই আর পাহাড়ি
কলা খেয়ে ঝরনায় জল খেতে আসে শিবা। বোতলে জল নিতে নিতে ও ঝাপান পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে
ভাবে এবার তো গাছদাদুর নেমে আসার কথা! সবাই বলে ওই পাহাড়ে দানো আছে!
সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করতেই
ওর ভেড়া ছাগলরা ঘরে ফেরার জন্য ছটফট করে ওঠে। কিন্তু শিবা বার বার ঝাপান পাহাড়ের
দিকে তাকায়। টাইগার আর টমি ওর হয়ে পশুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় নিচের দিকে।
তখনি চিৎকারটা ভেসে আসে। একছুটে
ঝরনাটার কাছে চলে আসে শিবা। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না।
“গাছদাদু” বলে জোরে
চিৎকার করে ওঠে ও। চিৎকারের ধ্বনিটা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিফলিত হয়। আস্তে
আস্তে তা মিলিয়েও যায়। পাখিদের ঘরে ফেরার কলকাকলি, পাইনবনের ফাঁকে হাওয়ার সরসর শব্দ, ঝরনার কুলুকুলু ধ্বনি ছাড়া কিছুই কানে আসে না।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ফেরার পথ
ধরে শিবা। তখনই দ্বিতীয়বার চিৎকারটা শুনতে পায়, শিবা বলেই ডাকছে তো গাছদাদু। ঝরনাটার ওধারে একটা বড়ো পাথরের
পাশে রক্তাক্ত দাদুকে দেখে ছুটে যায় শিবা। ভুলে যায় সব বারণ।
সারাটা শরীর দিয়েই যেন রক্ত
ঝরছে, বন্য নখের আঁচড়ে শরীরটা
ফালাফালা। হাঁপাতে হাঁপাতে অস্ফুটে জল চায় বৃদ্ধ। নিজের রংচটা বোতল থেকে জল খাইয়ে
দেয় শিবা। কষ বেয়ে গড়িয়ে যায় জল। গলার ক্যামেরাটা খুলে শিবার হাতে দিয়ে অনেক
কষ্টে বৃদ্ধ বলে, “পু...লি...শ, চেক...পো..স..ট...” দু’বার থরথর করে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে যায় পাঁচ
ফুট নয় ইঞ্চির ঋজু শরীরটা।
আবার একরাশ মেঘ এসে ঢেকে দেয়
ঝাপান পাহাড়কে।
শিবা যখন চেকপোস্টের কাছে এসে
পৌঁছায়, আকাশে একটা দুটো তারা জ্বলে
উঠেছে। ওদের বস্তি থেকে তিন মাইল দূরে এই চেকপোস্ট। কিন্তু এর আগে কখনও শিবা এখানে
আসেনি।
একটা খাকি পোশাক পরা লোক বসে
একটা খাতায় কিছু লিখছিল। শিবাকে দেখে লোকটা বলে, “কী চাই এখানে?”
“গাছদাদু...”
“কে? কী গাছ?”
“শিকার বাড়িতে থাকত বুড়াটা, গাছদাদু... উকে ঝাপান পাহাড়ের দানো...”
“ঝাপান পাহাড়! দানো!
ওই পাহাড় তো
ভুটানের অংশ। তোর ছাগল হারিয়ে গেছে?”
“না, উই যে বুড়াটা... গাছদাদু শিকারবাড়িতে থাকত সে উই পাহাড়ে গেছিল আজ... বিকেলে ঝরনার ধারে মরে গেছে।”
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে হাঁপাতে
থাকে শিবা।
তখনই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে
আরেকজন পুলিশ অফিসার। বলে,
“কী হয়েছে? আমায় খুলে বলো?”
“গাছ নিয়ে কাজ করত বুড়া লোকটা, সাপুইলতা আনতে ঝাপান পাহাড়ে গেছিল আজ। মরে গেছে।”
“শিকারবাড়িতে তো দীপ্তময় হাজরা থাকতেন। ফরেস্ট
ডিপার্টমেন্টের পারমিশন নিয়ে কী সব পরীক্ষা করছিলেন... মরে গেলেন কীভাবে?” ভদ্রলোক বলেন।
“ঝাপান পাহাড়ের দানো মেরেছে। সারা শরীরে রক্ত। পড়ে আছে ঝরনার
ধারে।” শিবা বলে।
“এই ভর সন্ধ্যায় কে ওই পাহাড়ে চড়বে! কালিম্পং থেকে ফোর্স
আনতে হবে। ফরেস্টকে ইনফর্ম করতে হবে। তবে ঝাপান পাহাড়ের একটা অংশ তো আবার ভুটানের। দেখছি, তোমার নাম কী? তুমি কী করছিলে?”
“ভেড়া চড়াই আমি পাহাড়ে। চিৎকার শুনে ঝরনার ধারে গিয়ে দেখি
রক্তে মাখামাখি...” শিবা আর
বলতে পারে না।
“আচ্ছা,
দেখছি আমরা।
তুমি কোথায় থাকো?”
“ফাদং বস্তিতে।”
“এখন বাড়ি যাও, তোমায় নিয়ে আমরা কাল যাব ওই পাহাড়ে, জায়গাটা চিনিয়ে দিতে পারবে তো?”
মাথা ঝাঁকায় শিবা।
(৪)
পুলিশে পুলিশে ছেয়ে গেছে পাহাড়। লোকটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিন মাইল
চেকপোস্টের অফিসার ইনচার্জ অলোক কামি জানত না।
কালিম্পং থেকে স্পেশাল ফোর্স
এসে গেছে সেই ভোরবেলায়। শিবাকে নিয়ে ঝরনার ধারে এসে ক্ষতবিক্ষত বডিটা উদ্ধার করে
পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েছে পুলিশ। ভাগ্য ভালো কোনো চিতা বা ভালু টেনে নেয়নি। কিন্তু এত বছর এই পাহাড়ে জঙ্গলে
ডিউটি করেও অলোক এমন কোনো হিংস্র প্রাণীর খবর আগে পায়নি, যে এভাবে একটা শরীরকে ফালাফালা করতে পারে। চিতা ঘাড়ে
ধরে টেনে নেয় শিকার। বুনো শুয়োর পেটে শিং ঢুকিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে। ভালুর থাবায়
মাংস তুলে নেওয়া বডিও দেখেছে এই পাহাড়ে। কিন্তু এ কেমন আক্রমণ?
“এই জঙ্গলে কী কী হিংস্র প্রাণী আছে?”
ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের অফিসার
বিজন দত্তর কথায় সংবিৎ ফেরে অলোকের। পাশেই ফরেস্টের বন্যপ্রাণী বিভাগের রেঞ্জার
রামানুজ প্রধান দাঁড়িয়েছিলেন। উনি বললেন, “চিতা,
ভালু, আর দু-একটা শুয়োর।”
“কিন্তু এ তো তাদের আক্রমণের ধরন নয়।”
“এই পাহাড়টা সব সময় মেঘ বৃষ্টি কুয়াশায় মোড়া বলে এই পাহাড়ে
বিট পাহারায় কেউ আসতে চায় না। আর ওই খাড়াই বেয়ে কে উঠবে! কাঠ চুরি করতেও কেউ আসে
না।” রামানুজ বলেন।
“স্যার,
এই ক্যামেরাটা
ওই ছেলেটা জমা করেছে। এটা নাকি ওই বৃদ্ধর ক্যামেরা।” অলোক একটা ছোটো ক্যামেরা
এগিয়ে দেয় বিজন দত্তকে।
বিজন শিবার থেকে পুরো ঘটনাটা
আবার শোনে। তারপর ক্যামেরাটা অন করতে চেষ্টা করে, কিন্তু চার্জ নেই।
প্রায় দুপুর দুটোর পর দলটা
থানায় নেমে আসে। যাবতীয় কাজকর্ম মিটিয়ে ক্যামেরার থেকে মেমরি চিপটা বার করে নিজের
ল্যাপটপে লাগান বিজন দত্ত। পাহাড়ের লতাগুল্মর ছবি, ফুল,
প্রজাপতি, মেঘের আড়ালে পাইনবন। ঝাপান পাহাড়ের নাম শুনলেও এই
প্রথম পাহাড়টার ছবি চোখে পড়ল।
একটা গুহার ছবি, তারপর দুটো ছবি সম্পূর্ণ অন্ধকার। কেঁপে গেছে ক্যামেরা, একটা হলদেটে হনুমান জাতীয় প্রাণী মনে হয়, অথবা বেবুন। কেশরটা কমলা। কিন্তু ক্যামেরাটা কেঁপে
গেছে বলে কিছুই পরিষ্কার নয়। লেজটা আবার ময়াল সাপের মতো মোটা বা ড্রাগনের মতো।
ছবিটা বড়ো করে দেখে বিজন দত্ত। প্রাণীটা ঠিক কী বুঝতে পারে না। অলোককে ডেকে দেখায়।
অলোক বলে, “স্যার, রামানুজকে দেখাব ছবিটা? আফটার অল ওর এলাকা।”
“পাঠিয়ে দিন, তবে যে ভাবে কেঁপেছে ছবিটা... কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বড়ো রেড পান্ডা বা বেবুন হতে পারে।”
আধঘন্টা পর রামানুজ প্রধান
জানায় ছবিতে কিছু ডিসপিউট রয়েছে, এমন কোনো প্রাণী ওদের রেকর্ডে নেই।
“মনে হচ্ছে ঝাপান হিলটা একবার চষে দেখতে হবে। পোস্ট মর্টেম
রিপোর্টটা এলে বাকিটা বুঝতে পারব।”
কিন্তু দু’দিন পর
পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এসেছে যে হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু। ডঃ হাজরার এক
ছাত্র ডঃ দর্শন রাঠোর খবর পেয়ে ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছিলেন। ছেলেটি জেনেটিক্স
বিজ্ঞানের একজন গবেষক। উনি একবার ডঃ বসুর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন।
নিজের চেম্বারে অলোকবাবু ফোনটা
তুলে ফরেনসিকের ডক্টর বসুকে ফোনে ধরেন। “পোশাক বা আর কিছু পরীক্ষা করে কোনো সূত্র পেলেন আপনি?”
“হিংস্র প্রাণী, নখের আঁচড়ের গভীরতা বলছে আকারে একটা পূর্ণবয়স্ক চিতার থেকেও
বড়ো কিছু। অথচ শরীরে যে লোমগুলো পাওয়া গেছে তা...”
“কী বলছেন,
ঠিক শুনতে পেলাম
না। হ্যালো, হ্যালো। মিঃ
বসু।”
ফোনটা কেটে যায়।
অলোক বিরক্ত হয়, তবে পাহাড়ে এটা রোজকার ঘটনা। দর্শন রাঠোর জানে এখানে
নেটওয়ার্ক-এর খুব সমস্যা। দীপ্ত স্যারকে ফোন করলেও এমন হত। ক্যামেরার ছবিগুলো
গ্যালারিতে রাখা ছিল। দর্শন ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন, থাম্বনেইলে ছোট্ট ছোট্ট দুটো ছবি দেখে উনি চমকে
উঠলেন। ছবি দুটো বড়ো করলেই হেজি হয়ে ফেটে যাচ্ছে। তবে লেজটা দেখা যাচ্ছে, বেশ মোটা। ওঁর কথায় কিছুক্ষণ পরেই মিঃ বাসুকে আবার
ফোনে ধরতে চেষ্টা করলেন অলোক। না পেয়ে মেসেজ করলেন হোয়াটসঅ্যাপে, “ফরেনসিক রিপোর্টটা ইমিডিয়েট চাই।”
একটু পরেই ওঁর মেলে রিপোর্টটা
এল। রিপোর্টটার প্রিন্ট নিয়ে বিজন দত্তর ঘরে এসে ঢোকেন ওঁরা দু’জন। ফরেস্টের থেকে
রামানুজকেও ডেকে নেওয়া হয়।
মিটিং বসেছিল কালিম্পং পুলিশ
হেডকোয়ার্টারে। এসিপি মিত্তালের বক্তব্য, ডঃ দীপ্তময় হাজরা একজন বেশ বড়ো মাপের
বিজ্ঞানী ছিলেন। গোপনে তিনি একটা কিছু গবেষণা করছিলেন একা। মিঃ দর্শন রাঠোর
জানালেন গবেষণার বিষয় ছিল এক ধরনের উদ্ভিদ, যা থেকে উনি মানুষের আয়ু বাড়ানোর ওষুধ বানাতে
চাইছিলেন। ইমিউনিটি বেড়ে যেত যা খেলে। মানুষ বেশিদিন বাঁচত। কিছুদিন আগেই উনি
দর্শনকে জানিয়েছিলেন ঝাপান পাহাড়ের মাথায় একটা কিছু রয়েছে। কোনো প্রাণী, যা এখন আর পৃথিবীতে নেই, উনিও এর আগে দেখেননি। সেই ঝাপান পাহাড়ে গিয়ে তাঁর এই
মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।
“স্যার, ওঁর শরীরে
যে পশুর লোম পাওয়া গেছে তা বানর জাতীয় পশুর, শরীরের কিছু অংশে লালা রস পাওয়া গেছে। তাও বানরের মতো কোনো
প্রাণীর।” অলোকবাবু
রিপোর্টটা দেখান মিত্তাল স্যারকে।
“কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা এই প্রাণীর ডিএনএ-র গঠন। এর শরীরের ক্রোমোজম আ্যনালিসিস করে ডঃ বসু যে
রিপোর্ট দিয়েছেন তা দেখে আপনি চমকে যাবেন। আমি নিজে জিন নিয়ে গবেষণা করি, কিন্তু এমন জিন বা ক্রোমোজমের গঠন এর আগে দেখিনি, মানুষের সঙ্গে এর মিল রয়েছে যেমন আবার মিল রয়েছে পশুর
সঙ্গেও,” বলেন দর্শন।
ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের বিজন
দত্ত বলেন, “একটা বড়ো দল নিয়ে আমরা ওই ঝাপান
পাহাড়ে যেতে চাই। আপনি পারমিশন দিলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যৌথভাবে এ অভিযান
হবে।”
“আমিও সঙ্গে যেতে চাই,” দর্শন বলেন।
“গো আ্যহেড,
আমার পজিটিভ
রেজাল্ট চাই। মিডিয়া আমাদের তুলোধোনা করছে। তাই আমার সলিড কোনো যুক্তি চাই। কী এমন
বন্য প্রাণী ওটা যা এত ভয়ংকর, তা জানতেই হবে।”
“আমার ধারণা প্রাণীটা বানর বা হনুমানের মতো। তবে আকারে
বিশাল। আর মাংসাশী।” দর্শন বলেন।
“মাংসাশী বানর কখনও শুনেছেন?” ওঁর কথা শুনে মিত্তাল বলেন।
“শুনিনি,
তবে কত কিছুই
তো নতুন জানা যায়। এটাও বিজ্ঞানের একটা নতুন দিক খুলে দেবে...”
“কাল সকালেই আপনারা শুরু করুন। আমার দুপুরে রিপোর্ট চাই।”
(৫)
“যার সন্ধানে যাচ্ছি, তা একটা না একাধিক আমরা জানি না। তবে পশুটা হিংস্র। তাই
দেখলেই ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়বেন সকলেই। খুব প্রয়োজন না পড়লে আসল গুলির ব্যবহার
করবেন না।” ডঃ দর্শন রাঠোর ওঁদের অনুরোধ
করেন।
অলোক ডঃ হাজরার ঘর থেকে একটা ডায়ারি
পেয়েছিলেন সেটা পড়ে উনি বুঝতে পেরেছিলেন ডঃ হাজরা একটু আধটু জানতেন প্রাণীটার কথা।
কোথাও তিনি লিখেছেন, “এত বড়ো!!” কোথাও লিখেছেন, “ও পাহাড়ের মাথাতেই থাকে, নিচে নামে না।” আবার লিখেছেন, “ও কি হিংস্র?” সব শেষে লেখা, “ওটা কী আমায় জানতেই হবে।”
অলোক দর্শনকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনাকে উনি কখনও বলেননি প্রাণীটার কথা?”
দর্শন বলেন, “কিছু একটা উনি দেখেছিলেন, তবে কী সেটা বলেননি।”
অলোক মনে মনে বলেন, “আমাদেরকেও জানতেই হবে ওটা কী?”
মোট চার জন কনস্টেবল, অলোক, বিজন আর ডঃ দর্শন রাঠোর। ওদিকে রামানুজের সঙ্গে চারজন
গার্ড আর রেঞ্জার কৃষ্ণাভ বেরা। কয়েক ঘণ্টা টানা উঠে টিমটা পৌঁছে গেল গুহার কাছে।
পাহাড়ের ঠিক মাথার কাছে গুহাটা। এদিকের মাটির রংটা কেমন সবজে সবজে, শ্যাওলায় ঢাকা। পাইনবন পার করে ওঁরা নেড়া জায়গাটাতে
উঠে আসেন। ঝরনাটা এখানে বেশ উঁচু থেকে লাফিয়ে নেমেছে। গুহার পাশে নরম মাটিতে কয়েকটা
বিশাল বিশাল পায়ের ছাপ চোখে পড়ে। ঘুরে গুহার পেছনে যেতে গিয়ে কীসে যেন হোঁচট খেয়ে
গড়িয়ে পড়ে বিজন দত্ত। জিনিসটা কী দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে রামানুজ। অলোক নিজেও লতাগুলো
সরিয়ে হাত রাখে একটা জেগে থাকা অংশে, একটা ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ। একটা যন্ত্রর অংশ। দর্শন নীরব
দর্শক।
কনস্টেবল আর ফরেস্টের গার্ডরা
হাত লাগিয়ে লতা গুল্ম সরাতেই একটা বড়ো যন্ত্রাংশ নজরে আসে ওদের। তবে বহু পুরোনো।
মাটির ভেতর ঢুকে গেছে। প্যানেল বোর্ডে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, ঘড়ির মতো কাঁটা, লেজের দিকে একটা ছোটো তিন ব্লেডের প্রপেলারের ভাঙা অংশ!
“আকাশযান,
বা ইউএফও!” অস্ফুটে বলে ইনসপেক্টর বিজন দত্ত।
গুহার ভেতর ঢোকা ঠিক হবে কিনা
ওরা বুঝতে পারছিল না। বিজন দত্ত সবাইকে মাস্ক পরতে বলে কয়েকটা স্মোক স্টিক
জ্বালিয়ে গুহার ভেতর ছুড়ে দেন। গাঢ় ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গুহার ভেতর।
তখনি একটা মৃদু ঘররঘরর গর্জন
শোনা যায়। ওরা সাবধান হওয়ার আগেই একটা বিশাল কিছু বেরিয়ে আসে গুহার বাইরে। কৃষ্ণাভ
বেরা ছিলেন সবার সামনে। কিছু বোঝার আগেই প্রাণীটা তাঁকে টেনে নেয় চোখের নিমেষে।
রামানুজ পর পর দুটো স্লিপিং
ডার্ট ফায়ার করলেও প্রাণীটা ততক্ষণে ঢুকে গেছে পাশের বড়ো বড়ো পাথর আর ঝোপের আড়ালে।
বেরার আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। এক সঙ্গে আরও তিনটে ঘুমপাড়ানি বন্দুকের গুলি ছুটে যায়
ঝোপটা লক্ষ্য করে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে বাকি কনস্টেবল আর গার্ডরা কিছু
বুঝে উঠতে পারে না। কিছুক্ষণ পর সাহস সঞ্চয় করে ঝোপের একটা অংশ সরাতেই চোখে পড়ে
ওদিকেও একটা গুহামুখ রয়েছে।
সেই গুহার ভেতর কৃষ্ণাভ বেরার
আর্তনাদ আর এক জান্তব চিৎকার মিলেমিশে গেছে। কিছুক্ষণ পর তাও থেমে যায়। কিন্তু
গুহার ভেতর থেকে এক বিশালাকার প্রাণীর নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল।
বিজন দত্ত নিজের স্যাটেলাইট ফোন
বার করে কন্ট্রোল রুমে জানান যে সাহায্য চাই। স্পেশাল ফোর্স পাঠাতে হবে
হেলিকপ্টারে। আর চাই বড়ো মাপের শক্তপোক্ত খাঁচা। না, প্রাণীটা কী এখনও বোঝা যায়নি। তবে প্রাণীটা রেঞ্জার
বেরাসাহেবকে টেনে নিয়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি ফোর্স চাই। নয়তো আরও কাউকে হারাতে হতে
পারে।
স্যাটেলাইট ফোনটা রেখে ও রামানুজকে
বলে, “আপনি কী বুঝলেন?”
“দাদুর মুখে শুনেছি বহু বছর আগে এই পাহাড়ের মাথায় উল্কাপাত
হয়েছিল। উড়ে গেছিল পাহাড়ের মাথার একটা অংশ। এখন মনে হচ্ছে উল্কা নয়, কোনো আকাশযান ভেঙে পড়েছিল।”
“আর ঐ প্রাণীটা?”
“বুঝতে পারছি না। এত বছর আগে যদি কিছু ভেঙেও পড়ে... প্রাণীটা এতদিন বেঁচে রয়েছে?”
“থাকতেই পারে, যদি ভিনগ্রহী হয়… ওদের গড় আয়ু হয়তো বেশি। তবে পরীক্ষা না করে ওটাকে ভিনগ্রহী
বলা উচিত নয়। তেমন প্রমাণ কই?”
সবাই চুপ।
একজন গার্ড সাহস করে গুহাটায়
উঁকি দিতে যাচ্ছিল। বেশ কাছে যেতেই গুহার থেকে সাপের মতো একটা লেজ আছড়ে পড়ে, গার্ডটাকে পেঁচিয়ে টেনে নেয় ভেতরে। এবার আর গার্ডটা
চিৎকার করার সুযোগ পায়নি। আবার কিছু ঘুমের গুলি ছুটে যায় গুহার ভেতর।
“প্রাণীটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার আমরা গুহাটায় ঢুকে দেখব?” বেশ কিছুক্ষণ পর রামানুজ বলে।
“আর কিছুক্ষণ পর। ঘুমের গুলিগুলো কতক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখে?” দর্শন জানতে চান।
“একটা গন্ডার বা হাতিকে দুটো গুলি ছয় থেকে আট ঘন্টা ঘুম
পাড়িয়ে রাখে।” রামানুজ
বলে।
“এটা হাতির মতোই বড়ো, আর আধঘন্টা অপেক্ষা করি। ব্যাকআপ ফোর্স আসছে।”
একটু পরেই
হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা গেল। ঝরনার ধারে কিছুটা ঘাসজমি ছিল। সেখানেই নেমে এল
স্পেশাল ফোর্সের ছয়জন জওয়ান। সঙ্গে ফরেস্টের দু’জন অফিসার।
সব শুনে প্রথমে চারজন জওয়ান
গুহাটায় ঢুকবে ঠিক হল, সঙ্গে দু’জন ফরেস্টের লোক
আর রামানুজ।
রামানুজ ওদের বুঝিয়ে বলল, “প্রাণীটা হিংস্র। মাংসাশী। আক্রমণাত্মক। আমরা ঘুমের গুলি
চালিয়েছিলাম, ওর গায়ে
লেগেছে কিনা জানি না। আমাদের ওকে জীবন্ত ধরতে হবে। তবে প্রাণ বাঁচাতে গুলি চালাতেই
পারো।”
(৬)
গুহার ভেতর ঢুকেও প্রথমে ওরা
কিছুই দেখতে পেল না। ভালো করে ভেজা মাটি লক্ষ করলে দেখা যায় কিছু একটা ঘষটে টেনে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই দাগ ধরে কিছুটা গিয়ে গুহাটা অনেক বড়ো হয়ে গেল। হলঘরের মতো
অংশ। উলটোদিকে সরু গুহামুখ। কিন্তু প্রাণীটা কোথায়? খুব ভালো করে কান পেতে একটা গুহার ভেতর থেকে নিশ্বাস
প্রশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে সেদিকে প্রবেশ করতেই টর্চের আলো গিয়ে ধাক্কা খেল বাদামি ঘন
লোমে ঢাকা একটা শরীরে। লেজটা অজগরের মতো মোটা।
প্রাণীটাকে ওই গুহা থেকে বার
করতেই চার ঘন্টার উপর লেগে গেল,
শরীরটা
হনুমান বা বানরের মতো। কিন্তু মুখটা অনেকটাই মানুষের মতো। হাতে পায়ে ধারালো নখ।
রামানুজ বার বার ঘড়ি দেখছিল।
পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এই ঘুমের ওষুধের প্রভাব কতক্ষণ থাকবে ও নিজেও জানে না।
তিনটে ডার্ট প্রাণীটার শরীরে গেঁথে ছিল।
এত বড়ো প্রাণীকে হেলিকপ্টারের
দরজা দিয়ে ঢোকানো সম্ভব নয়। যে খাঁচা এসেছিল তাতেও ঢুকবে না। বাধ্য হয়ে বড়ো জাল
চেয়ে পাঠানো হয়েছে। জালে জড়িয়ে হেলিকপ্টারে ঝুলিয়ে নিতে হবে। এই মুহূর্তে
প্রাণীটার হাত পা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে।
কৃষ্ণাভ বেরা আর গার্ড-এর দেহ
পাওয়া গেছে গুহার ভেতরে।
প্রাণীটাকে নড়াচড়া করতে দেখে
ঘুমের গুলি রেডি করে রামানুজ। তবে বুঝতে পারে না এর উপর আর ঘুমের গুলি প্রয়োগ করা
উচিত হবে কিনা।
হঠাৎ একটা হুংকার দিয়ে লাফিয়ে
ওঠে প্রাণীটা। দুজন গার্ড ওর সামনে পড়ে গেছিল। প্রাণীটা লেজের আঘাতে ওদের ধরাশায়ী
করে একজনের একটা পা ছিঁড়ে নেয় মুখ দিয়ে। অন্য জনকে লেজ দিয়ে পেঁচিয়েই শেষ করে
ফেলে।
একসঙ্গে তিনটে বন্দুক গর্জে
উঠেছিল। রামানুজ কিছু বলার আগেই গুলিগুলো ছুটে যায়। কয়েকবার ছটফট করে ঝরনার দিকে
লাফিয়ে পড়ে ওটা। খরস্রোতা ঝরনাটা প্রায় দেড়শো ফুট নিচে লাফিয়ে নেমেছে, তারপর বড়ো বড়ো পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নিচের দিকে
নেমে গেছে। রামানুজ আর দর্শন দৌড়ে গিয়ে দেখে একটা ছোটো হলুদ বিন্দুর মতো কিছু একটা
মিলিয়ে গেল জলের তোড়ে।
বন্দুকের গুলির আওয়াজ ইকো হতে
হতে মিলিয়ে যায় বহু দূরে। আস্তে আস্তে নিস্তব্ধতা নেমে আসে পাহাড়ের বুকে।
বিজন দত্ত হাত রাখে রামানুজের
কাঁধে। বলে, “সরি, জীবন্ত ধরেও ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। আসলে ও
যেভাবে লেজ দিয়ে আক্রমণ করছিল...
হয়তো আরও
অনেকেই ওর বলি হত আজ। বেশ কিছু গুলি ওর গায়ে… এই ঝরনায় পাথরের ধাক্কায় ওঁর শরীরটাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে
হয়তো…”
“জানা গেল না ও কীভাবে এখানে এসেছিল। এতবছর এখানে কী করছিল।
যদি ও ভিনগ্ৰহী হয় ওর জীবনচক্র অনেক বড়ো মানতে হবে।”
“আপাতত ওর শরীরটা খুঁজতে নিচের দিকে যেতে হবে, ওটা নিয়ে যেতে হবে গবেষণার জন্য।” বিজন দত্ত বলে।
“আগে গুহার ভেতরটা দেখে আসি।” বলে অলোক আর রামানুজ তিনজনকে নিয়ে ঢুকে আসে।
দর্শনও যায় ওদের সঙ্গে।
একটু পরে বেরিয়ে এসে দর্শন বলে, “অনেক বড়ো ভুল করেছি আমরা। প্রাণীটা তৃণভোজী ছিল, ও ভয় পেয়ে আক্রমণ করত। আর আমরা…”
“কীভাবে বুঝলেন?” বিজন দত্ত জানতে চান।
“ওর গুহাতে কোনো হাড় বা জন্তুর দেহাবশেষ পড়ে নেই, আছে কিছু লতা পাতা। তাছাড়া সেদিন ডক্টর হাজরার বডিটা
সারা রাত ঝরনার ধারে পড়েছিল। প্রাণীটা ছুঁয়েও দেখেনি।” অলোক বলে।
“এই লতা খেয়েই ও এতদিন বেঁচে ছিল, আমার ধারণা এই লতা নিয়েই ডক্টর হাজরা গবেষণা করছিলেন, কারণ ওঁর গবেষণার বিষয় ছিল মানুষের গড় আয়ু।”
“হ্যাঁ,
শিবা… ঐ বাচ্চাটাও বলেছিল এক ধরনের লতার খোঁজেই ডক্টর হাজরা
এই পাহাড়ে এসেছিলেন।” বিজনবাবু
বলেন।
সবাই চুপ।
“গুহার ভেতরটায় এগুলো পেলাম। এই জিনিসটা ডায়ারির মতো, কাগজ নয়, কাপড় বা কিছুর তন্তু দিয়ে তৈরি। মনে হয় দিনপঞ্জি লিখত প্রাণীটা।
কিন্তু ওর ভাষাটা...” অলোক বলে।
“একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে প্রাণীটা হনুমান বা বাঁদরের মতো
দেখতে ও আমাদের আদিম মানুষের গোত্রীয় হতে পারে, তবে ও অনেক উন্নত। পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হল
কীভাবে আজও রহস্য। কিছু বিজ্ঞানী বলেন, ভিনগ্ৰহীরা এসে বসতি স্থাপন করেছিল। ও তেমন কোনো গ্রহের জীব
হতেই পারে, আবার কিছু বিজ্ঞানীর মতে এখান
থেকে কিছু মানুষ অন্য গ্ৰহে চলে গেছিল কোনো এক সময়। এই প্রাণীটা দেখতে এমন হলেও
শরীরের তুলনায় মাথাটা ছোটো, ও এতটাই
বুদ্ধিমান যে দিনপঞ্জি লিখতে জানে। ওর একটা আকাশযান ছিল। গবেষকরা অনেক উপাদান পাবে
গবেষণার। দুঃখ একটাই ও হারিয়ে গেল।” রামানুজ বলে।
“ওকেই তবে নিচের বস্তির লোকেরা ঝাপান পাহাড়ের দানো বলত। ও নিচে
নামত না। তবে এই এলাকায় কোনো বন্য প্রাণী এলে ও হয়তো আক্রমণ করত, সেটা আত্মরক্ষার জন্য। ও কিন্তু নিচে নেমে খাবার
সংগ্ৰহ করত না। হয়তো ভয় পেত সভ্য মানুষদের।” অলোক কামি বলেন।
“ও ভয় পেলে আত্মরক্ষা করার জন্য শুধু আক্রমণ করত… আমাদের অতিরিক্ত কৌতূহল ওঁর প্রাণ নিল। আসলে মানুষ
বোধহয় এই গ্রহের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী।” দর্শন রাঠোর বলেন। “মৃত্যুর পরেও আমরা ওকে শান্তিতে থাকতে দেব না, কাটাছেঁড়া করব...”
“যদি ওর শরীরটা পাওয়া না যায়! আমি যদি রিপোর্ট দিই যে একটা বড়ো বাদামি ভাল্লুক
জাতীয় প্রাণী ছিল। গুলি করার পর ও লাফিয়ে পরে ঝরনাতে, আর খুঁজে পাইনি। আমরা এখানে একটা আকাশযানের
ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছি, এই ডায়ারি
পেয়েছি, মিডিয়া এসব নিয়ে মেতে উঠবে। আশা
করি তোমরা সবাই একমত হবে আমার সঙ্গে।” বিজন দত্ত নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেন।
“আমি হয়তো গবেষণার একটা বড়ো সুযোগ হারালাম, তবুও আমি সহমত। শান্তিতে ঘুমাক প্রাণীটা।” ওঁদের হাতের উপর হাত রাখে রামানুজ।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment