গল্প:: পিপলিপাহাড়ির জঙ্গলে - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ


পিপলিপাহাড়ির জঙ্গলে
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

জানালা দিয়ে বাইরে বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল টিটো ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছটা মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে অলস দুপুরটা একলা একলা যেন কাটতেই চায় না তার কয়েক দিন আগেই সে তার কাকুর কাছে পিপলিপাহাড়িতে এসেছে কাকু অভয় দে এখানকার রেঞ্জার বছর তিনেক আগে কাকু এই চাকরিতে যোগ দিয়েছিল প্রথমে অন্য জায়গায় পোস্টিং ছিল মাস ছয়েক আগে এই পিপলিপাহাড়িতে বদলি হয়ে এসেছে এখানে আসার পর থেকেই কাকু তাকে আসতে বলছিল অবশেষে অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর টিটোকে কাকু এখানে নিয়ে এসেছে কাকু বলেছে জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর, কিন্তু এখানে আসার পর থেকে কাকুর কথার সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার সুযোগ ঘটেনি, কারণ কাকু তাঁর ডিউটি নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে টিটোকে একদমই সময় দিতে পারছে না টিটোর সঙ্গী বলতে এখন বলরামদা কাকুর কোয়ার্টারের সব কাজকর্মের দায়িত্ব বলরামদার এখন বাকি সবকিছুর সঙ্গে টিটোর দায়িত্বও বলরামদার ওপর অর্পণ করেছে কাকু বলরামদা অবশ্য সেই দায়িত্ব খুব মন দিয়ে পালন করছে সকাল থেকে শুধু টিটোকে বিভিন্ন রকম খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করে যায় আর এই জঙ্গল সম্বন্ধে বিভিন্ন রকম আজগুবি গল্প শোনায় তবে মানুষটা যে খুব ভালো তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু টিটোর হয়েছে মুশকিল সারাদিন কত আর বলরামদার অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনে সময় কাটানো যায়! অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাই পড়াশোনারও কিছু নেই নতুন জায়গায় এসে টিভি দেখতেও ভালো লাগে না তার বলরামদা আবার তাকে একলা বাইরে বেরোতেও দেবে না তাতে নাকি খারাপ বাতাস লেগে যাবে টিটোর খুব হাসি পায় এসব কথা শুনলে, কিন্তু উপায় নেই, বলরামদার নির্দেশ অমান্য করলেই কাকুকে বলে টিটোকে বকা খাইয়ে দেবে

টিটো পা টিপে টিপে বলরামদার দরজার সামনে এল বলরামদা নাক দিয়ে রীতিমতো মেল ট্রেন ছোটাচ্ছে রোজ দুপুরে তাকে খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজের খাওয়া আর কাজকর্ম সেরে বলরামদা পাক্কা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমোয় এতে নাকি তার শরীরে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হয় এমনটাই মত তার আজ টিটোর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি লাফালাফি করতে লাগল সে তো আর মোটেই ছোটো নেই ক্লাস সেভেনে উঠে যাবে এবার বলরামদার দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের সুযোগে একটু আশপাশ থেকে ঘুরে এলে ক্ষতি কি? এখানে এসে থেকে তো কাকুর কোয়ার্টার আর বাগান ছাড়া কিছুই চোখে দেখেনি সে কোনো শব্দ না করে খুব আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে এল টিটো বাগানের গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল সে একটা রাস্তা কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে বাজারের দিকে চলে গেছে আর একটু এগিয়েই ডানদিকে একটা রাস্তা ভেঙে গেছে এই রাস্তাটা কোথায় গেছে টিটো জানে না সে এই ডানহাতি রাস্তাটা ধরে এগোনোই ঠিক করল বাজারের দিকে গিয়ে তার কোনো লাভ নেই
নদী, জঙ্গল আর ছোটো ছোটো টিলা নিয়ে পিপলিপাহাড়ি সত্যিই অসাধারণ এখানে জনবসতি খুব কম দূরে দূরে ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রাম সেখানে থাকে সহজ সরল মানুষজন যাদের জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ পৃথিবীর সমস্ত কলুষতা মুক্ত তারা টিটোর খুব ভালো লাগছে হাঁটতে আজ আকাশে রোদও নেই বেশ ছায়া ছায়া হয়ে আছে দুপাশে বিভিন্ন রকম গাছ খুব সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে টিটো হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা চলে এসেছে পা-টা এবার একটু বিশ্রাম চাইছে একটা পরিষ্কার গাছের তলা দেখে টিটো বসে পড়ল ঠান্ডা হওয়ায় টিটোর একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল
এই তুয়ার নাম কী রে?”
চমকে উঠে টিটো দেখে তার সামনে প্রায় তারই বয়সি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে মুখের আদল দেখে স্থানীয় আদিবাসী বলেই মনে হল টিটো কিছু না বলে একটু চুপ করে গিয়েছিল
কী রে, কথা বলবি নি মোর সাথে?” ছেলেটার গলায় যেন অভিমানী সুর
না না, তা কেন আমার নাম তৃষিত দে সবাই টিটো বলে ডাকে আমাকে তোমার নাম কী?” টিটো জিজ্ঞেস করে
আমার নাম চন্দন গো তুই এখনে লোতন এসচু?” এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি
হুম, আসলে আমার কাকু এখানে বনদপ্তরে চাকরি করে আমি কাকুর কাছে বেড়াতে এসেছি আমার বাড়ি বর্ধমানে তোমার বাড়ি কোথায়?”
উই যে হেথাছেলেটা আঙুল তুলে দূরে একটা কুঁড়েঘরের দিকে দেখায় টিটো সেদিকে তাকিয়ে দেখে বাইরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে
উনি তোমার কে হন?”
উ তো মোর বাপটা
তুই এখনে একলা একলা কী কচ্চু?”
কী করব, আমার কোনো সঙ্গী নেই কাকুও সময় দিতে পারছে না, তাই বলরামদাকে লুকিয়ে একলাই একটু ঘুরতে বেরিয়েছি
বলরাম দাদা কে রে?”
টিটো হাসতে হাসতে বলরামদার কথা বলে কী করে চুপিচুপি বলরামদার ঘুমের সুযোগে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, সব বলে টিটোর কথা শুনে চন্দনও দাঁত বের করে হাসতে থাকে
তু মোর বন্দু হবি?”
তুমি হবে আমার বন্ধু?”
কেনে হব নি? তুকে আমি পুরা পিপলিপাহাড়ি ঘুরায়ে দেখাব
সত্যি?”
তিন সত্যিঝকঝকে হেসে জানায় চন্দন

চন্দনের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে দিনগুলো খুব ভালো কাটছে টিটোর সকাল থেকে সে অপেক্ষা করে কখন দুপুর হবে আর বলরামদা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোবে আজকাল সে একটু তাড়াতাড়িই দুপুরের খাওয়া সেরে নেয় যাতে বলরামদাও তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ঘুমোতে যায় টিটো চন্দনের কথা কাউকে বলেনি সে জানে বড়োদের অনেক রকম সমস্যা থাকে এর সঙ্গে মিশবে না, ওর সঙ্গে কথা বলবে না, ও মনে হচ্ছে দুষ্টু ছেলে - এরকম অনেক কিছু মতামত থাকে তাদের বলরামদা কিংবা কাকু যদি তার সঙ্গে চন্দনের বন্ধুত্ব না মেনে নেয় তাহলে আবার সেই একঘেয়ে জীবন শুরু হবে কাকু যা ব্যস্ত এখন তাকে বর্ধমানে ছাড়তে যেতেও পারবে না আর ওখান থেকেও কেউ আনতে আসতে পারবে না তাকে তার চেয়ে এই ভালো কী সুন্দর দুই বন্ধুতে পিপলিপাহাড়ির জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়! চন্দন তাকে গাছ চেনায়, বন, পাহাড়, নদী, পশু-পাখিদের গল্প বলে সে সব গল্প নাকি সে তার বাবার কাছে শুনেছে চন্দন কখনও স্কুলে যায়নি, কিন্তু তাও কত কিছু জানে ও বলে সবচেয়ে বড়ো স্কুল তো হল এই প্রকৃতি চন্দনের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে টিটোও কেমন যেন এই পাহাড়-জঙ্গলকে ভালোবেসে ফেলেছে সারা দুপুর চন্দনের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে ঠিক সময়ে বাড়ি ঢুকে যায় টিটো সে আসার বেশ খানিক পরে বলরামদা ঘুম থেকে ওঠে আজ পর্যন্ত কোনোদিন সে ধরা পড়েনি টিটো ঠিক করে রেখেছে যদি কোনোদিন বলরামদা ঘুম থেকে উঠে যায়, তাহলে সে বলবে বাজারের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, তাই সে একটু বেরিয়েছিল

চন্দন তোমার বাবার কথা বলো, কিন্তু তোমার মায়ের কথা তো বলো না কখনও?টিটো চন্দনকে জিজ্ঞেস করে
মোর মাটা তো কবেই মরে গেছে আমি তখন এইটুকুনি
ওহ, সরিটিটো একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়, কিন্তু চন্দনকে দেখে বিশেষ দুঃখিত বলে মনে হয় না
ই জঙ্গল, ইখনের লোক সব্বাই খুব ভালো, কিন্তু কতগুলা বাইরের লোক ইখনে ঢুকেছে তারা বহুত বদমাশ রে
কে তারা?”
উ গুলাব সিংয়ের সব লোকজন রে
গুলাব সিংটা কে?”
উ একটা খুব খারাপ লোক রেচন্দন উদাস হয়ে গেল টিটোর ফিরে যাবার সময় হয়ে গেছে চন্দনকে টা টা করে ফেরার পথ ধরে টিটো প্রায় কোয়ার্টারের কাছাকাছি এসে গেছে টিটো আর একটা বাঁক ঘুরলেই বড়ো রাস্তায় উঠে যাবে, এমন সময় টিটোর পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে একটা মারুতি ভ্যান পেরিয়ে গেল টিটো চমকে উঠল এমনিতে এই অঞ্চলে চার চাকা গাড়ি খুব একটা দেখা যায় না, তার ওপর টিটোর মনে হল গাড়ির ভেতর ওর বয়সি একটি মেয়ে যেন জানালার কাচে হাত চাপড়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে আর তাকে পেছন থেকে কেউ টেনে ধরছে টিটো দাঁড়িয়ে পড়ল এখন সবে দুপুর গড়িয়েছে চারিদিকে পরিষ্কার আলো সে ভুল দেখেনি নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে টিটো একবার ভাবল কোয়ার্টারে গিয়ে কাকুকে ফোন করবে, কিন্তু তাহলে তো সে যে বাইরে বেরোয় সেটা সবাই জেনে যাবে চন্দনের বাড়িও এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে চন্দনকে ডাকতে গেলে যদি গাড়িটা নাগালের বাইরে চলে যায় তার চেয়ে মোরাম রাস্তায় গাড়ির টায়ারের দাগ ধরে এগিয়ে দেখা যাক এই ভেবে টিটো এগোতে লাগল কিছুদূর গিয়ে টায়ারের দাগ ডানহাতি একটা রাস্তায় ঢুকে গেছে সেই রাস্তা ধরে একটু এগোতেই টিটো দেখল একটা টিনের ছাউনি দেওয়া স্কুল বাড়ির মতো টানা ঘরওয়ালা পাকা বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটার আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই পেছন থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল টিটো দোলাচলে পড়ে গেল একবার ভাবল ফিরে গিয়ে চন্দনকে আর ওর বাবাকে ডাকবে, কিন্তু তারপরেই মনে হল যদি তার চোখের ভুল হয় কাউকে জোর করে ধরে আনা না হয়, তাহলে অকারণে চন্দনের বাবাকে বিরক্ত করা হবে তাছাড়া এই গাড়িতে যারা এসেছে, মিথ্যে অভিযোগ করলে তারা ঝামেলা করতে পারে সর্বোপরি, যদি দেখা যায় কাউকে এখানে জোর করে ধরে আনা হয়নি অথচ এইসব করতে গিয়ে তার বাইরে বেরোনোর ব্যাপারটা কাকু আর বলরামদার কাছে ফাঁস হয়ে গেল, তাহলে আর আপশোশের সীমা থাকবে না আবার যদি সে ঠিক দেখে থাকে তাহলে তার বয়সি একটা মেয়ে ঘোর বিপদের মধ্যে রয়েছে তাকে অবশ্যই সাহায্য করা উচিত কয়েক মুহূর্ত ভাবল টিটো, তারপর নিজের কর্তব্য স্থির করে নিল বাড়িটার বাইরে এই মুহূর্তে কেউ নেই গাড়িটারও দরজা খোলা দেখাই যাচ্ছে টিটো বামদিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল তারপর প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বাড়িটার পেছন দিকে চলে এল এদিকটায় জঙ্গল শুরু হয়েছে পেছনে লোকজনও নেই টিটো খুব সন্তর্পণে একটা খোলা জানালার পাল্লার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল
গুরু, মেয়েটা বড্ড ছটফট করছে
আহ! তুই কি নতুন হলি নাকি? কি করতে হবে জানিস না? বসের আসতে দেরি আছে ততক্ষণ চুপ করিয়ে রাখ
ওকে, ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি
তাই দে যাওয়ার সময় যে কেন নিয়ে যাসনি! ফালতু সারাটা রাস্তা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জ্বালাতন করল মেয়েটা যাই হোক এখন ঘুম পাড়া
ঘরের মধ্যে তিনটে লোক দাঁড়িয়ে আছে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে মেয়েটাকে মেঝের ওপর মুখ, হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে খুব ছটফট করছে মেয়েটা নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে টিটোর বুক ঢিপঢিপ করছে সে ভুল দেখেনি ওরা মেয়েটাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিতেই আস্তে আস্তে মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে গেল টিটো বুঝল তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে যাই হয়ে যাক, কাকুকে সব বলে মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই টিটোর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল

হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝের ওপর পড়ে আছে টিটো মেয়েটা পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে দরজার দুপাশে দুটো লোক পাহারা দিচ্ছে বাকিরা সম্ভবত বাইরে গেছে টিটো আন্দাজে বুঝল অন্ধকার হয়ে গেছে নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে তার বাইরে বেরোনোর কথা লুকোতে গিয়ে আজ এত বড়ো বিপদ ডেকে আনল সে গাড়িটা দেখার পরই যদি সে ফিরে গিয়ে কাকুকে সব জানাত, তাহলে আজ আর এই বিপদ ঘটত না সে ভাবতেই পারেনি যে দুষ্টু লোকগুলোর মধ্যে কেউ বাড়ির পেছন দিকে চলে আসবে আর তাকে ধরে ফেলবে এতক্ষণে নিশ্চয় তার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ তো জানেই না যে সে রোজ দুপুরে কোয়ার্টারের বাইরে ঘুরতে যায় কাকু যদি বাড়িতে খবর দিয়ে দেয় তাহলে মা, ঠাম্মি তো কেঁদেই অস্থির হয়ে যাবে চন্দন কি জানতে পেরেছে যে টিটো নিখোঁজ? এরা কি তাকে মেরে ফেলবে? এমনি সাত-পাঁচ দুশ্চিন্তা করতে করতেই টিটো চমকে উঠল মেঘ গর্জন করছে দূরে কোথাও বাজ পড়ল
বস এসে গেছেএকটা লোক বলল
দরজা দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে একজন লম্বা-চওড়া লোক ঢুকল
এই ছেলেটা আবার কোথা থেকে এল রে?” লোকগুলোর বস জিজ্ঞেস করল
এ পেছনের জানালা দিয়ে উঁকি মারছিল বসএকটা লোক বলল
দেখে তো বেশ ভদ্র ঘরের বলেই মনে হচ্ছে এ অঞ্চলের নয় বলেই বোধ হচ্ছে
বস, আমি বাজারে শুনলাম রেঞ্জারের ভাইপোকে বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বর্ধমান থেকে এখানে কাকার কাছে ঘুরতে এসেছিল আমার মনে হচ্ছে এ রেঞ্জারের ভাইপো
তাহলে তো ভালোই হল রে এক ঢিলে দুই পাখি পবন বিশ্বাসের নাতনিকে কিডন্যাপ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আর রেঞ্জারের ভাইপোকে শেষ করে রেঞ্জারের উপর প্রতিশোধ রেঞ্জারটা আমাদের চোরাই কাঠের ট্রাক ধরে অনেক ক্ষতি করেছেদাঁতে দাঁত চিপে বলল বসটা
বস, ছেলেটাকে শেষ করে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসি?” একটা লোক বলল
হ্যাঁ, তাই কর ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে এই ভালো মওকা মেরে পুবের জঙ্গলে লাশটা ফেলে দিয়ে আয়
টিটোর বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে তার সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে ভালোই বুঝতে পারছে সে তার জল ভরা ঝাপসা চোখের সামনে বাড়ির সকলের মুখ ভেসে উঠছে তার মা তো জানতেও পারছে না একটু পরে তার সঙ্গে কী হতে চলেছে বাবা হয়তো কাকুকে ফোন করছে তার খবর জানার জন্য চন্দন হয়তো কাল দুপুরেও তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে একটা লোক এগিয়ে এসে টিটোকে টেনে তুলল
বস, একটা গুলি ঠুসে দিই?” লোকটা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল একটা
আর কত লোককে মারবি রে গুলাব সিং?”
চন্দন!” টিটো অবাক হয়ে দেখল দরজায় চন্দন আর তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে টিটোর মনে একটুখানি যেন আশার আলো দেখা দিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে চন্দন আর ওর বাবা একলা কী করবে উলটে টিটোর জন্য ওদের বিপদ হবে না তো? ওরা খবরই বা পেল কী করে?
বুরান!”
বু বু বুরান!”
টিটো অবাক হয়ে দেখল গুলাব সিং সহ সব লোকগুলোর মুখ সাদা হয়ে গেছে আতঙ্কে চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে
কী রে, আর কত লোককে মারবি? এইটুকুন ছ্যানাগুলানকেও ছাড়বি নি?” ফুঁসে উঠল চন্দনের বাবা বুরান টুডু
তুই! তুই কি করে...কথা শেষ করতে পারে না গুলাব সিং
কী ভেবেছিলি, মোকে মেরে তুই বেঁচে থাকবি? লোকের ক্ষতি করবি?” বুরানের চোখ যেন জ্বলছে
টিটো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না চন্দনের বাবা এসব কী বলছে!
বুরান চন্দনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে টিটো অবাক হয়ে দেখল, বুরানের গলা থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে চোখে যেন আগুন টিটোর কেমন একটা লাগছে
বুরান ছেড়ে দে আমাকে ভুল হয়ে গেছেপিছিয়ে যেতে যেতে গুলাব সিংয়ের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে
দেখ এবার মরণের ভয় কাকে বলে আমার গলায় কোপ বসানোর সময় মনে ছিল নি আমিও মানুষ? আমার চন্দনকে টুকরা করার সময় ওর কত কষ্ট হইছে জানু তুই?” রাগে কাঁপছে বুরান
এবার টিটো কেঁপে উঠল এসব কী বলছে চন্দনের বাবা!
বুরান এগিয়ে আসছে গুলাব সিংয়ের দিকে গুলাব সিং পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফায়ার করার ব্যর্থ চেষ্টা করল বুরানের হাতটা গুলাব সিংয়ের গলায় চেপে বসল গুলাব সিংয়ের সঙ্গীরা এই সময় পালানোর চেষ্টা করতে গেল এরপরই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটল টিটো বিস্ফারিত চোখে দেখল চন্দন দুটো হাত দুপাশে মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আর তার দেহটা আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে লাগল চন্দনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে লাগল আর তার হাতের জায়গা নিল অজস্র ডালপালা টিটোর বন্ধু চন্দনের জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা চন্দন গাছ যার ডালপালাগুলো ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে গুলাব সিংয়ের লোকদের গলাগুলো সে এক বীভৎস দৃশ্য! লোকগুলো সেই নাগপাশের মধ্যে ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আর ওদিকে বুরানের হাতের পাঞ্জার মধ্যে গুলাব সিংয়েরও দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে টিটোর মাথাটা কেমন করছে চোখের সামনে যা কিছু ঘটছে আর সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই ওর মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেল টিটো

আগামীকাল টিটো বর্ধমান ফিরে যাবে, তার আগে আজ কাকুর কাছে একটা আবদার করেছে সে কাকু তার আবদার মেনে নিয়েছে কাকুর জিপে চড়ে চলেছে সে, সঙ্গে বলরামদা একটা ভাঙা কুঁড়েঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জিপটা টিটো নেমে দাঁড়াল বলরামদা এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “এটাই বুরান টুডুর ঘর ছিল তুমি তো ওকে এখানে দেখেছ বুরানের বউ একটা চন্দন গাছ লাগিয়েছিল ঠিক ওইখানটায়
বলরামদা ভাঙা বেড়ার পাশে একটা জায়গায় আঙুল নির্দেশ করল
গাছটা লাগানোর পর অল্পদিন পরেই বুরানের বউ মারা যায় তখন থেকে বুরান বলত গাছটা ওর ছেলে খুব যত্ন করত গাছটার কথা বলত গাছটার সঙ্গে বলত গাছটাও নাকি ওর সঙ্গে কথা বলে ওর সুখ-দুঃখের কথা বোঝে গাছটা হয়েও ছিল বেশ বড়ো একলা মানুষ বুরান ওই গাছটাকেই যেন আঁকড়ে বেঁচে ছিল কাজকর্ম বাদে ওই গাছটাই যেন ওর জীবন ছিল
বলরামদা চুপ করতে কাকু বলতে আরম্ভ করল, “কয়েক বছর আগে থেকে এই অঞ্চলে গুলাব সিং আর তার দলবলের উপদ্রব শুরু হয় বিভিন্ন বেআইনি কাজকর্ম শুরু করে ওরা তার মধ্যে গোপনে জঙ্গলের গাছ চুরি করা অন্যতম ছিল বনবিভাগও ওর কিছু করতে পারছিল না বুরান এই জঙ্গলকে খুব ভালোবাসত কোনো ভয়ডর ছিল না মানুষটার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দুবার ভাবত না ওর সঙ্গে গুলাব সিংয়ের বিরোধ শুরু হয় একদিন গুলাব সিং আর ওর লোকেরা এই ঘরের মধ্যেই বীভৎসভাবে গলা কেটে বুরানকে খুন করে আর চন্দন গাছটাও কেটে নেয় খুব দামি চন্দনের গাছ ছিল ওটা পুলিশ চেষ্টা করেও গুলাব সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি আশেপাশে তো আর কোনো ঘরবাড়িও নেই তাই কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায়নি
টিটোর চোখ দুটো জলে ভরে আসে সেদিন অনেক রাতে কাকু আর পুলিশের লোকজন গিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে আর কিডন্যাপ হওয়া মেয়েটিকে উদ্ধার করে মেয়েটি বড়ো ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে, তাই মুক্তিপণের লোভে গুলাব সিং ওকে কিডন্যাপ করেছিল গুলাব সিং আর তার দলের প্রতিটি লোককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়
কাকু টিটোর কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোর সঙ্গে যা হয়েছে জানি না তার কী ব্যাখ্যা তোর কোনোরকম মনের ভুলও বলতে পারছি না, কারণ বুরান বা ওর গাছের কথা তোর জানার কথা নয় যেহেতু বুরানের এত ভয়ানক মৃত্যু হয়েছিল তাই বলরামও আগে ওর সম্বন্ধে কোনো কথা তোকে বলেনি
বাবু, গাছেরও তো প্রাণ আছে বুরানের ভালোবাসা চন্দন গাছটায় মানুষের মতো প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিল বুরানের মতো গাছটার আত্মাও শান্তি পায়নি টিটোকে ভালো মানুষ পেয়ে মানুষের রূপ ধরে ওর বন্ধু হইছিল ওকে জঙ্গলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে আবার টিটোর বিপদে ওকে বাঁচাতে এসেছিল গুলাব সিং আর ওর লোকগুলার উপর বুরানের মতো গাছটাও প্রতিশোধ লিইছে
বলরামদার কথা শুনে কাকু বলল, “হয়তো তুমিই ঠিক বলছ বলরাম টিটো, এবার ফিরতে হবে
জিপে উঠে চলে আসার সময় একবার পেছন ফিরল টিটো আবছাভাবে দেখল ভাঙা কুঁড়ের সামনে বুরান দাঁড়িয়ে আছে আর বেড়ার ধারে একটা চন্দন গাছ তার ডালপালা নাড়িয়ে বন্ধুকে বিদায় জানাচ্ছে টিটো মনে মনে বলল, “আসি চন্দন তোমার বন্ধুত্ব আমি সারাজীবনেও ভুলব না
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

No comments:

Post a Comment