পাঁচমারির জঙ্গলে
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
বহুদিন আগের কথা। তখন
আমি সবে স্কুল জয়েন করেছি। বেড়াতে বরাবর ভালোবাসি। তবে একটু অন্য রকমের। একদম নতুন কোনো জায়গা
আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়তাম। আমার সঙ্গে সব সময় বন্ধু কুশল
থাকত।...
এই পর্যন্ত বলে মেজকা
একটু থামলেন। মা চা নিয়ে এসেছে। চায়ের সঙ্গে মুড়ি আর টমেটোর চপ এসে গেছে। মা সব
নিজে বানিয়েছে। মায়ের কিচেনে বাইরের জিনিস প্রবেশ করে না বেশি একটা। বিশেষ করে
করোনার বাজারে তো একদমই নয়।
মেজকাকে তোমরা জানো
নিশ্চয়! যারা প্রথমবার আমাদের গল্প পড়ছ, তাদের জন্য পরিচয়টা আবার দিয়ে দিলাম।
মেজকা আমার মায়ের মেজকাকা। থাকেন বিরাটি। আমার আর বোনের দাদু বলার কথা, কিন্তু মেজকা বলেন দাদু বলার মতো ওঁর বয়স এখনও হয়নি। পঞ্চাশ বছর বয়সে
দাদু শুনতে কারও ভালো লাগে না। অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন। সংসার করেননি। মাঝে
মাঝে আমাদের বাড়ি আসেন। তিন-চারদিন কাটিয়ে যান।
মেজকাকে যে জন্য
আমাদের ভালো লাগে সেটা হল মেজকা খুব সুন্দর গল্প বলতে পারেন। গল্পগুলো এত সুন্দর
যে বড়োরাও যোগ দেন। মেজকা অনেকবার ভূতের খপ্পরে পড়েছেন। আমরা কেউ গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে
প্রশ্ন তুলি না। আমাদের কাছে গল্প হলেও মেজকা বলেন এগুলো সব সত্যি। এই শীতের সন্ধেগুলো
খুব সুন্দর কেটে যাচ্ছে মেজকার দৌলতে। করোনার সময় দীর্ঘদিন কেউ আমাদের বাড়ি আসেনি।
তাই খুব ভালো লাগছে। মেজকা যথেষ্ট সাবধানী। অনেক আগেই ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছেন। সব
সময় স্যানিটাইজার সঙ্গে থাকে।
যাই হোক, আসল গল্পে
আসি। মেজকা চা শেষ করে আবার শুরু করেন –
যা বলছিলাম, আমার স্কুল জীবনের
বন্ধু ছিল কুশল। ওর সঙ্গে আমার ঘুরতে খুব ভালো লাগত। স্বভাবে ও আমার মতোই ছিল। তখন
সবে আমাদের গ্রামের স্কুল জয়েন করেছি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আর্মিতে যাই, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। সব সময় মনে হত নতুন কিছু করি। কুশল একদিন একটা
খবর নিয়ে এল। কুশল কলকাতায় একটা কাগজের অফিসে কাজ করত। ও অনেক রকম খবর রাখত।
প্যারানরমাল বা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারে ওর খুব আগ্রহ ছিল। যদিও
তেমন বিশ্বাস করত না। ও বলত, প্যারানরমাল বা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার আসলে তেমন
কিছু নয়। খুব সহজ সরল ঘটনাকেও অনেক সময় অলৌকিক আখ্যা দেওয়া হয়। এ সবের পেছনে কিছু
কারণ থাকে। তাই কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলে ও সেখানে চলে যেত। নানা ভাবে চেষ্টা করত
লৌকিক ব্যাখা দেওয়ার। একদিন এমন একটা খবর নিয়ে এল যেটা শুনে আমি প্রথমে খুব
হেসেছিলাম। মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারি পাহাড়ের এক দুর্গম অঞ্চলে আছে একটা বহু প্রাচীন
শিব মন্দির। সেখানে স্থানীয় লোক ছাড়া কেউ যায় না। ওই গুহা মন্দিরে থাকেন এক বহু
প্রাচীন মহাসর্প। শেষনাগ। তিনি এই মন্দির পাহারা দেন। স্থানীয় লোকেদের কেউ কেউ একে
দেখেছে। শেষনাগের দর্শন পাওয়া নাকি খুব পুণ্যের ব্যাপার। ইচ্ছাধারী নাগেরাও এই
মন্দিরে আসে পুজো দিতে। এখান থেকে নাগলোক খুব কাছে। কুশলের কথা শুনে আমি প্রথমে
খুব হাসলাম। তারপর বললাম,
“শেষনাগ তো নারায়ণের মাথায় থাকে। মানে নারায়ণ শুয়ে থাকেন
শেষনাগের ওপর। শিবের শেষনাগ নেই।”
কুশল বলল, “সেটা আমিও জানি। তবে
যে শিব, সেই নারায়ণ। তাই শেষনাগ দু’জনকেই দেখভাল করতে
পারেন।”
“ঠিক কথা। আমরা
তবে কবে যাচ্ছি?”
“এই মাসেই চল।
আমার ওদিকে কাজ আছে। ভ্রমণ কাহিনি লিখব। ছবি-টবি তুলব।”
“আমারও স্কুলে
শীতের ছুটি পড়বে।”
কুশলের সঙ্গে কথা হয়ে
গেল। খুব তাড়াতাড়ি আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। সময় বাঁচাতে সেবার প্লেনের টিকিট কাটা হল।
সেই আমার প্রথম প্লেনে যাওয়া। এক রবিবার খুব ভোরের ফ্লাইট ধরে আমি আর কুশল
জব্বলপুর বিমানবন্দরে নামলাম। আমাদের সঙ্গে একটা করে ব্যাকপ্যাক। দুটো করে জামা
প্যান্ট। ব্রাশ পেস্ট চিরুনি। খুব
দরকারি ছাড়া কিছু নিইনি। কুশলের ব্যাগে খাতা পেন আর ক্যামেরা। তখন মোবাইল ছিল না। ১৯৯৩-এর ঘটনা।
জব্বলপুরে এসেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আমরা একটা জিপ ভাড়া করলাম। ভালো করে লাঞ্চ সেরে
গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। পথে কোথায় কী পাব না পাব তার ঠিক নেই। আমাদের গন্তব্যস্থান
পাঁচমারি। পথের শোভা খুব সুন্দর। এখানে প্রচুর টিয়া আর নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে পাচ্ছি।
অরণ্যের মধ্যে পাহাড় দেখলে বুকটা কেমন দুরদুর করে। আমি জানি এটা আনন্দের ধ্বনি। অনেক
আমলকী গাছ এখানে। গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। অরণ্যের মধ্যে নানা
জায়গায় আদিবাসীদের বসতি, চাষাবাদের জায়গা, স্কুল, কবরখানা, পঞ্চায়েত
অফিস অনেক কিছুই আছে। খেতে চাষ করছিল যারা তাদের দেখে মনে বেশ হিংসে হচ্ছিল। এরা
কত সুখী। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ক’জন বোঝে কে জানে! আমাদের সঙ্গে নর্মদাও চলেছেন। কুশল অনেক ফোটো তুলল।
ড্রাইভার ছেলেটিও বেশ ভালো। সরল
হাসিখুশি। শহরটা
বেশ ভালো
চেনে। অনেক কিছু ও নিজেও বলল শহর সম্পর্কে। ওর খুব ইচ্ছা ছিল আমাদের ভেড়াঘাট দেখানোর।
আমরা বললাম ফেরার পথে এসে ক’দিন থাকব, তখন দেখব। কুশল
ওকে জিজ্ঞাসা করল সেই শিব মন্দিরের কথা। বরুণ মানে ড্রাইভার ছেলেটি বলল, “আমি সেই মন্দির চিনি। কয়েকবার গেছিও।”
আমি ও কুশল দু’জনেই লাফিয়ে
উঠলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি ওই মন্দিরে গিয়েছ যখন
তখন একটু ডিটেলস-এ বলো।”
বরুণ বলল, “ওই ইচ্ছাধারী
নাগ নাগিন এসে রক্ষা করে এই মন্দির। আপনারা সবটাই জানেন। আমি বেশ কয়েকবার এই
মন্দিরে গেছি নিজের পরিবারের সঙ্গে। এখানে ঢোকা
খুব শক্ত। আমরা ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। ভেতরে খুব অন্ধকার। একটা গুহার ভেতর
ছোটো
একটা শিব লিঙ্গ।”
“তুমি কি অনন্ত নাগকে দেখেছ?”
“কী যে বলেন
স্যার! অনন্ত নাগের দর্শন পাওয়া কি এতই সোজা?”
আমাদের কথাবার্তা সব
হিন্দিতেই হচ্ছিল।
কুশল বলল, “কিন্তু অনেকে নাকি তাকে দেখেছে।”
বরুণ বলল, “একটা মোটা
খুব বড়ো সাপকে অনেকে পড়ে থাকতে দেখেছে মন্দিরে, কিন্তু
ওটা অনন্ত নাগ, তার তো কোনো প্রমাণ নেই। আপনারা খবরের কাগজের
লোক হয়ে এত দূর ছুটে এলেন কি এই প্রাচীন মহাসর্পকে দর্শনের আশায়? আপনারা বিশ্বাস করেন এই গল্প?”
কুশল হেসে ফেলল। ও যে
বিশ্বাস করে না তা বুঝিয়ে দিল। আমার মনেও তেমন বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছুই ছিল না, তবু বলে
ফেললাম, “ঈশ্বর ইচ্ছা করলে একটা ছুঁচের ভেতর দিয়ে হাতিকে
গলাতে পারেন আর ইচ্ছাধারী নাগ নাগিন তৈরি করতে পারবেন না? তিনি ইচ্ছা
করলে সব পারেন। এই বিশ্বের কতটুকুই বা আমরা জানি।” আজও
জানি না কথাটা কেন বললাম।
বরুণ অবাক হয়ে আমাকে
একবার দেখে নিল। মুখে কিছু বলল না। কুশল আবার জোরে হেসে উঠল। বলল, “একটা
ইচ্ছাধারী নাগ নাগিন পেলে তাকে ধরে কলকাতায় নিয়ে যাব। আগে তার ইন্টারভিউ নেব। ফোটোও নেব। তবে
এই সময় নিশ্চয় সব শীতঘুমে।”
কুশল বাংলায় বলছিল আর
হাসছিল। আমি ওর হাসিতে যোগ দিতে পারলাম না। সামনের মিরর-এর দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ
চমকে উঠলাম, বরুণের মুখে কেমন পৈশাচিক হাসি। একটু আগেও ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগছিল।
এখন জানি না কেমন যেন লাগছে। ওর চোখ দুটো
কী
ভয়ানক! আমার আর কিছু মনে নেই। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
কুশলের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে
গেল। “চল আজ হোটেলে বিশ্রাম। কাল ভোরে বেরিয়ে পড়ব।”
হোটেলে রুম ঠিক করে
ব্যাগপত্র রেখে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পায়ে হেঁটে আমরা একটু বেরোলাম। বরুণ আর ফিরে
যায়নি। ও ওর জানাশোনা একটা ছোটো হোটেলে উঠেছে। এখন রেস্ট নিচ্ছে।
আমি কুশলকে বললাম, “আমি বরুণকে খুব অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। খুব তীব্র এবং ভয়ানক
সেই চাউনি!”
কুশল আমার দিকে
ক্যামেরা তাক করে বলল,
“ওদের মন্দিরের সেই ইচ্ছাধারী নাগ নাগিনকে নিয়ে মজা করছিলাম, তাই হয়তো একটু রেগে গেছে। তুই অত সিরিয়াসভাবে নিস না।”
“কী জানি বাপু
আমার তো ভয় লাগছে। গুণ্ডা বদমাশ নয়তো?”
“দুর। একদম
চিন্তা করিস না। থিঙ্ক পজিটিভ।”
আমরা পায়ে হেঁটে কিছু
মন্দির দর্শন করলাম। তারপর একেবারে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরলাম। ডিসেম্বর মাসে খুব
ঠান্ডা এখানে। হোটেলে ফিরেই শুয়ে পড়লাম। পরের দিন খুব ভোরে বেরোতে হবে।
পরের দিন খুব ভোর হতেই
বেরিয়ে পড়লাম। বরুণ ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে এসে গেল। প্রথম দিকে ভালো লাগলেও ক্রমশই
বোঝা যাচ্ছিল রাস্তা খুব খারাপ এখানে। এদিকে মানুষও খুব কম আসে। দু-একটি যা লোক
চোখে পড়ল সবই আদিবাসী শ্রেণীর। তারাও খুব কৌতূহলের সঙ্গে আমাদের দেখছে। শহুরে লোক
তারা রোজ দেখতে পায় না। এরপর এক সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। পায়ে চলা পথও কিছু নেই
তেমন। খুব কষ্ট করে আমরা এগোতে লাগলাম গাছের ডাল ধরে ধরে। কখনও আবার শুয়ে শুয়ে। ডিসেম্বর
মাস, তাই সাপের বা বর্ষার ভয় নেই। আমরা ট্রেকিং জানি বলেই
যেতে পেরেছিলাম। সাধারণ লোক হলে পারত না। একটু হিসেবে ভুল হলেই খাদে গিয়ে পড়ব।
নাগলোকের বদলে সোজা যমলোকে পৌঁছে যাব। চারদিকের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মতো
মানসিকতা আর নেই। বাবা মহাদেবকে স্মরণ করতে করতে চলেছি। কুশলটা অবিশ্বাসী হলেও আমি
বিপদে পড়লে তাঁকে ডাকি। বরুণ দেখলাম খুব সুন্দরভাবে এগোচ্ছে। এক সময় সেই মন্দির
এসে গেল। মন্দির না বলে গুহা বলাই ভালো। ভেতরে
আবার ছোট্ট একটা
জলাশয়। এই কুণ্ডের জল নাকি খুব পবিত্র। বরুণ নেমে দু’হাতে করে জল
নিয়ে আমাদের মাথায় ছিটিয়ে দিল। কুশল চিৎকার করে উঠল, “উফ, এই ঠান্ডার মধ্যে গায়ে জল দিও না।” আমি দেখলাম জলের মধ্যে লিলি জাতীয় ফুল ফুটে আছে। নরম একটা আলো কোথা
থেকে আসছে কে জানে?
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “এই কুশল, কী সুন্দর ওয়াটার লিলি হয়েছে দেখ।”
কুশলও দেখল। “সত্যি, কীভাবে ফুল ফুটেছে বল তো! এখানে তো সূর্যের আলোই প্রবেশ করে না। এই
বরুণ, এই নরম আলো কীসের আসছে?”
“প্লিজ আপনারা
একটু আস্তে কথা বলুন। আমি ঠিক জানি না কীসের আলো। এই জায়গাটায় অনেক আশ্চর্যজনক
ব্যাপার ঘটে। বাবার এখানে আমরা শব্দ করি না। তাই চুপ করে থাকবেন বা খুব আস্তে কথা
বলবেন।”
আরেকটু এগিয়ে শিবের
ঘর। এখানেও হালকা একটা আলো আসছে। ধূপের মিষ্টি গন্ধ আসছে। প্রদীপ জ্বলছে। শিবের
মাথায় পঞ্চমুখী সাপ। সাপের চোখগুলো চুনির মনে হয়। আসল বলে আমিও ভুল
করেছিলাম। এই মন্দিরে কোনো পুরোহিত নেই। শিবের মাথায় ফুল বেলপাতা পড়ে গেছে। বরুণ
বলল, “এখানে শেষনাগ সবার প্রথমে পুজো করেন।”
আমি কিছু বেলপাতা আর
জংলি ফুল তুলেছিলাম। বাবার মাথায় দিয়ে বললাম, “হর হর মহাদেব। আমাদের সবাইকে দেখো
তুমি।” শহরে বা গ্রামে বসে যা অবাস্তব বলে মনে হয় এই জঙ্গলের
রাজ্যে তাই চরম বাস্তব বলে মনে হতে লাগল।
কুশল হেসে ফেলল। “এত ভক্ত কবে
থেকে হলি!” বলে ও একটা বাজে কাজ করল। ফস করে একটা সিগারেট
ধরাল। আমি আর বরুণ হাঁ হাঁ করে উঠলাম, কিন্তু কোনো কাজ হল
না। কুশল বলল, “আমি দেখতে চাই
মহাদেব-এর কত ক্ষমতা!”
“দেখ কুশল, তুই নাস্তিক, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু
এটা তুই ঠিক করছিস না।”
“আর তোরা এই সব
গুল বিশ্বাস করছিস। এই করেই দেশটা কুসংস্কারে ভরে গেছে।”
হঠাৎ ঝুম ঝুম নূপুরের
শব্দ। একটি মেয়ে পুজো দিতে এল। লাল পাড়
সাদা শাড়ি, চুল এলো। হাতে পুজোর থালা। ঢং করে ঘণ্টা বাজাতেই মন্দিরে হঠাৎ আলো এসে
পড়ল। হালকা স্বচ্ছ নীল রং-এর আলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম না আলোর উৎস কোথায়। বরুণ আমাদের দু’জনকে তাড়া দিল।
কুশল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটিও চোখ ফেরাল কুশলের দিকে। কুশলের কী হল জানি না, ও তীব্র গতিতে বাইরে চলে এল। আমি
ভালো করে
মেয়েটির মুখ দেখতে পাইনি, কারণ আমি বরুণের সঙ্গে বাইরে এসে পড়েছিলাম। কুশল একটু পেছনে ছিল। কী
দেখে এত ভয় পেল জানি না।
ব্যস, এরপর আমরা কীভাবে
গাড়ির কাছে এসেছি নিজেরাই জানি না। এখন বিকেল চারটে। গাড়িতে শরীর এলিয়ে
দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন গ্লুকোজ বিস্কুট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয়নি। হোটেলে ফিরে
দেখি কুশলের জ্বর এসে গেছে। আমি ওকে ধরে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। কুশল আমার একটা
হাত ধরে বলল, “তুই কি নূপুরের শব্দ পাচ্ছিস?”
“কই না তো!”
“আর সাপের ফোঁসফোঁসানির?”
কুশল দু’দিন জ্বরে
ভুগল। আমি হোটেলে বলে ডাক্তার এনে দেখালাম। ওষুধ আনলাম। বরুণও খুব হেল্প করেছে। দু’দিন পর কুশল সেরে উঠল। ও ফেরার জন্য জেদ করতে লাগল। জব্বলপুর ফিরে আবার
ফ্লাইট। কুশল তারপর অন্য মানুষ হয়ে গেল। একদিন ওকে চেপে ধরলাম কেন এত চেঞ্জ হয়ে
গেল ওর। এর আগে অনেক জিজ্ঞাসা করেও কোনো লাভ হয়নি। ও ঠিক এড়িয়ে যেত। তা সেদিন কুশল
নিজের অভিজ্ঞতা খুলে বলল।
“সেদিন তুই আর
বরুণ তো আমার একটু আগে বাইরে বেরিয়ে এলি। ওই মেয়েটার মুখ থেকে জিভ বেরিয়ে এল। একদম
সাপের মতো চেরা জিভ। তাই দেখে ভয় পেয়ে যাই।”
“কী বলছিস!”
“জানতাম বিশ্বাস
হবে না তোর।”
কুশলের কথায় বিশ্বাস
হচ্ছিল না। সেই রাতেই একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। তিন মাস হয়ে গেছে আমরা জব্বলপুর
থেকে ফিরেছি। গরমের জন্য ঘুম হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে একটু তন্দ্রা এসেছে। একটা খস
খস শব্দে তন্দ্রা উধাও। বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই যা দেখলাম ভয়ে আমার... এই দেখ আজও
লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে...
“কী দেখলে বলো
না!” মা জিজ্ঞাসা করল।
“উফ, ভয়ে আমার হার্ট ফেল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।”
“তখন যখন হয়নি
এখন আর হবে না। প্লিজ বলো তাড়াতাড়ি। আমি আর পারছি না।”
মাকে মাঝে মাঝে আমাদের বয়সি মনে হয়।
“দেখলাম একটা বড়ো
কালো পাঁচমাথাওয়ালা সাপের ছায়া খুব তাড়াতাড়ি গায়েব হয়ে গেল। চক্ষের নিমেষে ওটা
ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না রে এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটে গেল।
কী দেখেছি এখনও একটা ধাঁধা লাগে।
“কিন্তু ভুল তো
দেখিনি। কুশলও দেখেছিল হোটেলের ঘরে। ও আমাকে বলেছিল। সে এক সাংঘাতিক পরিস্থিতি।”
মেজকা একটু থামলেন।
“তারপর কী হল?” আমি আর বোন একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করি।
“তারপর আর কী।
আবার ছন্দে ফিরি।”
“তোমার সেই কুশল
এখন কোথায়?” মা জিজ্ঞাসা করল।
“কুশল পরে
সন্ন্যাসী হয়ে যায়। রামকৃষ্ণ মিশনের।”
“বোঝো!”
“আর বরুণ? ও কি সাপ ছিল?”
“ওটা তো তোরা
বলবি। এত গল্প শুনিস আর এটা বুঝতে পারলি না, ও মানুষ না
অন্য কিছু। দে এক কাপ কফি দে। গলা শুকিয়ে গেছে।”
মা কফি করতে উঠে গেল।
মেজকা খবরের কাগজে মন দিলেন। আমাদের আবার অনলাইন ক্লাসে বসতে হবে। দূর ভাল্লাগে না!
----------
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment