গল্প:: অজানা বন্ধু - পাপিয়া গাঙ্গুলি


অজানা বন্ধু
পাপিয়া গাঙ্গুলি

(১)

শুঁয়োপোকাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছিল গোলাপ গাছের সবুজ সরু ডাল বেয়ে। একটা পাতা থেকে পুঁতির মতো একফোঁটা থেমে যাওয়া জল টুপ করে পড়ল ভেজা মাটিতে। পিঠটা একবার উঁচু একবার নিচুছাদের গোলাপ গাছটার দিকে একমনে তাকিয়ে শুঁয়াপোকার চলন দেখছিল লাট্টু।
বাড়ি ফেরার পথে ফুটপাথে থাকা ওই ছেলেটাকে এমনি করে মানে শুঁয়োপোকাটার মতো করে চলতে দেখেছে ও। পা টেনে টেনে, রাস্তায় ঘষটে ঘষটে। একটা নোংরা চট আলখাল্লার মতো গায়ে ফেলা থাকে। তবু বোঝা যায় কুঁকড়ে থাকা শরীরটা। কত আর বড়ো, তার থেকে বড়ো কিন্তু অনেক বড়ো না টাটুন দাদার মতোলাট্টু এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। টাটুন দাদা ইলেভেনে। না হলে রূপকদাদার মতোরূপক দাদা বড়ো কলেজে পড়ে। বয়সটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কয়েকমাস হল দেখছে ছেলেটাকে। আগে ছিল না। নিশ্চয়ই অলিভার ট্যুইস্টের গল্পের মতো কোনো খারাপ লোক ওর এমনি হাল করেছে। ও পালিয়ে এখানে চলে এসেছে। ওর বাবা মা আছে কি? তারা কি খুঁজছে? ও কি স্কুলে পড়ত? ওকে দেখে এমন অনেক ভাবনা মাথায় এসেছে লাট্টুর। ভাবনার আঁকিবুকি আঁকতে আঁকতে চমক ভাঙল কুর্চির ডাকে।
কী রে খেলার মাঠে আসবি তো আজ?” কুর্চি ওদের পাশের বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকে।
হ্যাঁ, আজ আসছি।
দিন আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে মোচড় লেগেছিল। ঠাম্মি অতটুকু ব্যাপার নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে দুদিন বিশ্রামের আদেশ দেয়।

স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রথম যেদিন দেখল ছেলেটাকে, সেদিন ছেলেটাকে ঘিরে কয়েকটা কুকুর পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। ছেলেটা ফুটপাথের ওপর ভয়ার্ত মুখে কুঁকড়ে বসে আছে। কয়েকটা ঢিল ছুড়ে কুকুরগুলো তাড়াবার চেষ্টা করছে। চাপা ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, “যাহ্, যাহ্
লাট্টু দাঁড়িয়ে দেখেছিল। কুকুরগুলোকে ওর নিজেরও খুব ভয় করে, কিন্তু তাও সেদিন ঢিল তুলে কুকুর তাড়িয়েছিল। ছেলেটা বড়ো বড়ো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল লাট্টু হাসি বিনিময় করে বাড়ি ফেরত এসেছিল
সেদিনের পর অনেকগুলো দিন কেটেছে। কদিনের মধ্যেই কুকুর আর ছেলেটার সহাবস্থান।
বুবিনদের পাঁচিল ঘেরা মস্ত বাড়ি। সেই বাড়ির পাঁচিল ঘেঁসে, ফুটপাথে থাকে ছেলেটা।
লাট্টু ওকে কোনোদিন দাঁড়াতে বা দুপায়ে হাঁটতে দেখেনি। মাটি ঘসে ঘসে চলে। একটা নীল প্লাস্টিক জোগাড় করেছে কোথা থেকে। প্লাস্টিক আর একটা নোংরা পুঁটলি হল তার সংসার। প্লাস্টিকটার ওপরই বসে থাকে ছেলেটা মাঝে মাঝে ওটার ওপর বসে নিজের মনে কথা বলে, হাসে খাবারও খায় ওখানে বসে। খাবার কোথা থেকে পায় জানে না লাট্টু হয়তো আশপাশের বাড়ি থেকে দেয়। ভোরবেলা স্কুল যাবার সময় দেখে নীল প্লাস্টিকের ওপর ছেলেটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মাথায় পুঁটুলিটা গুঁজে গুঁড়ি পাকিয়ে। গায়ে ওই আলখাল্লার মতো জিনিসটা জড়ানো। শীত করলে লাট্টু যেমন ঘুমোয় কুঁকড়েছেলেটার জন্য বেশ কষ্ট হয়। লাট্টু ভাবে বুবিনদের অত বড়ো বাগান। খালি পড়ে থাকে। সেখানেও যদি থাকতে দিত! লাট্টুদের ছাদেও নিয়ে রাখা যায়। মুশকিল হল বড়োরা অনুমতি দেবে না। বড়োরা সব কিছুতে 'একটা কিছু হবার' গন্ধ পায়। সব কিছুতেই না করে দেয়।

দুদিন ধরে সূর্য মুখ ঢেকেছে কালো মেঘে। একটানা খুব বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুল বন্ধ। আজ বাবা আর কাকুন অফিসেও যেতে পারেনি। একটা ভেজা কাক বারান্দার কোনায় বসেছে। সিঁড়ির নিচে চোর বেড়ালটা ঘাপটি মেরে বসে। রাস্তায় জল জমেছে। ওদের গাড়ির চাকা বেশ কিছুটা ডুবে গেছে। দাদু টিভি দেখছে। সেখানে বার বার বলা হচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। সতর্কবার্তা। টিভিতে জলে ডোবা রাস্তাঘাট দেখাচ্ছে। লাট্টুর হঠাৎ মনে এল সেই ছেলেটার কথা। এত বৃষ্টি জলে ছেলেটা আছে কোথায়? ও তো দাঁড়াতে পারে না! যদি ডুবে যায়! খুব একটা ভয় হল লাট্টুর। ওর সঙ্গে কোনোদিন কথা বলেনি ছেলেটা, কিন্তু স্কুলফেরতা লাট্টু দাঁড়ায় ছেলেটার কাছে। টিফিনের ভাগ দেয় ছেলেটাকে। প্রথমে দিত বেঁচে যাওয়া টিফিন। না খাওয়া টিফিন দেখে মা বকবে তাই। পরে দিত মনের ইচ্ছায়। বন্ধু হিসাবে। একদিন মা-কে বলেছিল, বেশি করে টিফিন দিও মা। বন্ধুরা ভাগ করে খাই। আমার খিদে থেকে যায়।
মা তো বেজায় খুশি। যে লাট্টু কিনা খাওয়া নিয়ে এত জ্বালাতন করে সে বেশি টিফিন চাইছে। ঠাম্মা সঙ্গে সঙ্গে মাকে বলেছিল, “কী, কইসিলাম না, পোলাডার খাওয়া লইয়া এত প্যাচাল পাইরো না। খিদা পাইলে আপনেই কইবো। দেখলা তো!
সেদিন থেকে বাক্স ভরে টিফিন দেয় মা। লাট্টু কিছুটা খায়, বাকিটা ফেরার পথে ছেলেটিকে দিয়ে আসে। কোনো কথা বলে না ছেলেটি, কিন্তু খাবার নেওয়ার সময় একবার সুন্দর করে তাকায়। যেন কত চেনা। অনেক কথা থাকে ওর চোখে। ওই তাকানোটায় ওকে বন্ধু মনে হয়। পাড়ার সবাই বলে ছেলেটা পাগল। লাট্টুর এমন মনে হয় না। ও অনেকসময় ছেলেটার দিকে তাকিয়ে অনেক মনের কথাও বলে দেয়। একতরফা কথা বলে। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে শোনে, কিন্তু কোনো কথা বলে না। পেটের কথা সব উজাড় করে লাট্টু। স্কুলের ঘটনা বেশিটাই রং চড়িয়ে গল্প করে।
দীপায়নকে চেনো তো? কাল যার কথা বলেছিলাম। ওই যে, যে ছেলেটা দারুণ ফুটবল খেলে। সে আজ তোমার জন্য রাখা টিফিনটা খেয়ে ফেলছিল প্রায়। আমি তো খুব রেগে গেলাম। বললাম, ‘দীপায়ন, টিফিন বাক্সটা রাখ। না হলে এমন একটা ঘুসি দেব না! যেই না বললাম, খুব ভয় পেয়ে গেল আর টিফিন বাক্স চুপ করে রেখে দিল। অনেক ঝামেলা করে রেখেছি টিফিনটা।
একদিন বলল, “জানো তো ফুটবল ম্যাচ ছিল আজ। আমি খুব ভালো খেলেছিতিনটে গোল দিয়ে হ্যাটট্রিক করতামই, কিন্তু শেষটা মিস হয়ে গেলতাই আমাদের টিমটা হেরে গেল
তার কাছে সব বলাটা লাট্টুর অভ্যেস হয়ে গেছে। লাট্টুর বলতে ভালো লাগে। বাড়িতে একনাগাড়ে ওর কথা শোনার মতো কেউ নেই। সবাই ব্যস্ত। কাজে অথবা টিভি নিয়ে। মাকে রান্নাঘরেই দেখে সবসময়। ঠাম্মা ঠাকুর, বই, সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। সপ্তাহে দুদিন পাড়ার লাইব্ররিতে কাজ করতে যায়। সাম্মানিক কাজ। দাদুর কাছে টিভির বাইরে কোনো জীবন নেই। তাও দাদু ওর সঙ্গে বসে ওর পছন্দের সিনেমা দেখে। বাবা তো অফিস নিয়ে খুবই ব্যস্ত। বাড়ি এসেও ল্যাপি নিয়ে বসে। ওই ছেলেটা বেশ একজন সাথিআর কাউকে নিজের কথা বলতে গেলেই বলে, “পরে শুনছি। এখন একটু চুপ কর।- এসব শুনতে হয় লাট্টুর সব কথা এতদিন শুধু ওর ডায়ারি জানত ঠাম্মা ডায়ারিটা দিয়ে বলেছিল, “এটা তোমার একটা বন্ধু। যা খুশি বলতে পারো একে। ও সব শুনবে, কিন্তু কাউকে বলবে না ডায়ারি ছাড়াও শোনার লোক ওই ছেলেটা।
এই বৃষ্টি জলে ছেলেটার কী হল! এটা লাট্টুর মাথায় ঘুরছে। সকালে একটা কাগজের নৌকো বানিয়ে নিচে গেছিল, যদি বেরোনো যায় ফাঁক বুঝে। দেখে আসা যাবে ছেলেটাকে। এক পা জলে দিয়েছে কি দেয়নি ওপর থেকে মায়ের গলা, “লাট্টু জলে নামবে না কিন্তু। ঠান্ডা লেগে যাবে।
মা সব কিছু কী করে টের পেয়ে যায় কে জানে! ওপরে রান্নাঘরে মা রান্না করছিল। কী করে দেখল কে জানে যে লাট্টু জলে নামছে বা লাট্টুর একটু লুকিয়ে বেরোনোর ইচ্ছা আছে! ম্যাজিক জানে মা। লাট্টুও ছাড়ার পাত্র নয়। তক্কে তক্কে আছে। আজ খিচুড়ি হয়েছে দুপুরে। সঙ্গে গোল চাকতির মতো আলুভাজা, বেগুন ভাজা আর পাঁপড়। স্যাঁতসেঁতে দুপুরে পেট পুরে খিচুড়ি খেয়ে সবাই ভাতঘুমে। লাট্টু ঘুমের ভান করে পড়েছিল। চোখ বুজে।
সবাই ঘুমোলে লাট্টু ঠিক করল সে এখন বেরোবে। কাছেই তো। এখুনি ফিরে আসবে। সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই। নিজের রেনকোটটা বার করে গায়ে চাপিয়ে সাবধানে সদর দরজা খুলে রাস্তায় নামল এখন তার হাঁটুর ওপরে জল। প্লাস্টিকে করে কিছু শুকনো খাবার, জুসের প্যাকেট আর স্কুলের পুরোনো একটা টিফিন বাক্সে করে কিছুটা খিচুড়ি নিয়েছে সঙ্গে করে। ছেলেটাকে দেবে প্যাকেটটা স্কুলের ব্যাগ খালি করে তার মধ্যে নিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে নিল। একটা জলের বোতলও বুদ্ধি করে নিয়েছে।
কোনোরকমে বুবিনদের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল চারিদিকে জল শুধু জল। ফুটপাথ দেখাও যাচ্ছে না। কেউ নেই। বুকটা ধড়াস্ করে উঠলকী হল? খারাপ লোকগুলো ওকে ধরে নিয়ে গেল? নাকি মরে গেল? সোজা হয়ে দাঁড়াতে তো পারে না। জলে ডুবে গেল না তো! আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। এই ভেবে পাঁচিল বরাবর বুবিনদের বাড়ির মেন গেটের দিকে বাঁক নিল বৃষ্টিটা কমেছে এখন। কিন্তু যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। দেখল বুবিনদের বাড়ির মস্ত গেটের পাশে লাল বাঁধানো রোয়াক আর রোয়াকে সে বসে। চারপাশে খানদুয়েক কুকুরছানা গা ঘেঁসে বসে। নীল প্লাস্টিকটা নিজের মাথায় একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে তাবুর মতো ছড়িয়ে রেখেছে। কুকুরছানাগুলোও ওই তাঁবুর নিচেছেলেটি নিজের মনে বিড়বিড় করছে না আজ। একটু জবুথুবু বসে। লাট্টুর মুখে ফুটে উঠল স্বস্তির হাসি। জলে ঝপাং ঝপাং আওয়াজ তুলে লাট্টু পৌঁছে গেল বুবিনদের রোয়াকে। ব্যাগ খুলে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, উফ, তুমি এখানে বসে। তোমাকে জায়গায় না দেখতে পেয়ে তো খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। নাও এটা তোমার জন্য এনেছি। খেয়ে নাও। তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। এত বৃষ্টি। তুমি খোলা আকাশের নিচেঅনেকক্ষণ ধরে আসার চেষ্টা করছি। মায়ের জন্য কিছুতেই বেরোতে পারছিলাম নাসত্যি বলতে কি বাড়িতে বসে বিরক্তও লাগছে। স্কুলে যেতে পারছি না। বাড়িতে আমার সঙ্গে কথা বলার কেউ নেই। বাবা কাকুন নিজেরা গল্প করছে। সবাই শুধু বলে পড়াশুনা কর। কত পড়ব বলো তো! আর পড়তে কাঁহাতক ভালো লাগে? তোমার একদিকে বেশ মজা। পড়তে হয় না। আচ্ছা তুমি কোনোদিন স্কুলে গেছিলে? তুমি কেন উত্তর দাও না? আমি একা কথা বলে যাই। বোঝো আমার সব কথা? তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।
ছেলেটা প্যাকেট খুলে সবার আগে টিফিন বাক্স বার করল খিচুড়ি খেতে শুরু করল আর চারপাশ দেখতে লাগল
কুকুরগুলো তার দিকে চেয়ে কেঁউকেঁউ করছে। খাবারের প্যাকেটটা হাতড়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করে কুকুরছানাগুলোকে বিস্কুট দিললাট্টু খানিক গল্প করে বাড়ির দিকে রওনা হল
আজ যাই। মা জেগে গেলে রক্ষে নেই। সাবধানে থেকো।

(২)

বুবিনদের বাড়িটা অনেক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। লাল রঙের পাঁচিল। এ পাড়ায় এতটা জায়গা নিয়ে অন্য কোনো বাড়ি নেইসামনে মস্ত লোহার গেট। গেটের ডান পাশে একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে এক দারোয়ান থাকে। কেউ এলে দারোয়ানের খাতায় নাম লিখিয়ে ঢোকার নিয়ম। অচেনা কেউ হলে একটা ফোনে বাড়িতে জিজ্ঞ্রেস করে তবে ঢুকতে দেয়।
বাবা কাকুনদের কাছে শুনেছে, বুবিনের দাদুর তৈরি এই মস্ত বাড়ি। বুবিনের দাদু, শশাঙ্ক দেব খুব মিশুকে মানুষ ছিলেন। তার সময় এই বাড়ি ছিল সবার কাছে অবারিত দ্বার। সবার বিপদে আপদে ছাতার মতো দাঁড়াতেন শশাঙ্ক দেব। পাড়ার ঠাকুর ভাসান দিয়ে এসে দল বেঁধে সকলে যেত ওই বাড়িতে। গিন্নিমা ছিলেন সকলের মাসিমা। ফরসা টুকটুকে, লাল সিঁদুরের টিপ পরা সকলের মা যেন। তিনি নিজে হাতে সকলের জন্য মিষ্টি নোনতা বানাতেন। সে সব খেতে খেতে চলত পুজোর গল্প, জলসার গল্প। তারপর সকলে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরত সে নাকি এক এলাহি ব্যবস্থা হত
দোল খেলা হত সবাইকে নিয়ে তাদের বাড়ির বাগানে।
শশাঙ্ক দেবের ওষুধের ব্যাবসা। তাদের দুই ছেলে। মৃগাঙ্ক ও দেবাঙ্ক। বুবিনের বাবা মৃগাঙ্ক।
মৃগাঙ্ক লাট্টুর বাবার বন্ধু ছিল ছোটোবেলায়। গোলগাল বেশ ভালোমানুষ দেখতে। তারপর চাকরি, সামাজিক পার্থক্য সব মিলিয়ে দূরত্ব বেড়েছে।
দেবাঙ্ককে দেখতে একেবারে নায়কদের মতো শরীরচর্চা করা পেটানো চেহারা। একটু অহংকারী গোছের। বিদেশের ডিগ্রির ছাপ তার বায়োডাটাতে। সে চিরাচরিত ব্যাবসার বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছু করতে চেয়েছিল। পশ্চিমের মাঠের পেছনে একসময়ে ছিল বিখ্যাত ডালডা কোম্পানি। লকআউট হয়ে আছে বহুদিন। বুনো গাছে ভর্তি। দিনের আলো না থাকলে এলাকাটায় যেতে ভয় করেদেবাঙ্ক চেষ্টাচরিত্র করে জমিটা কিনে নিলসেখানে তৈরি করল অত্যাধুনিক নার্সিংহোম। লোকাল পার্টির তহবিলেও এ জন্য অনেক টাকা দান করেছে বলে জনশ্রুতি আছে। সব মিলিয়ে দেবাঙ্ক পাড়ায় বেশ সমীহর পাত্র। মৃগাঙ্ক পারিবারিক ওষুধ ব্যাবসার হাল ধরল আর দেবাঙ্ক ব্যস্ত হল নিজের নার্সিংহোম নিয়ে। দেব পরিবারের উজ্জ্বলতা বাড়ল
এক বুদ্ধপূর্ণিমার সকালে পাড়ায় নেমে এল শোকের ছায়া। শশাঙ্ক দেব ঘুমের মধ্যে দেহত্যাগ করলেনছড়িয়ে পড়ল খবর। পুরো পাড়া জমায়েত হল দেব বাড়ির উঠোনে। সকলের চোখে জল। সঠিকভাবেই এক আত্মীয় বিয়োগের শোক। খুব ধুমধাম করে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল। দুই ছেলে নিজেরা দাঁড়িয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করল কাজ। তারপর থেকেই বদলে গেল দেব বাড়ির চালচলন। গেটে দারোয়ান বসল সাধারণ মানুষের থেকে দূরে চলে গেল দেব বাড়ি। দুই ভাইয়ের আলাদা আলাদা দামি গাড়ি। পাড়ায় থেকেও তারা আলাদা।
লাট্টুরা মানে লাট্টু, টুবলু, পুপুল, বুবিনের বন্ধু। এক সঙ্গে স্কুলে পড়ত ক্লাস ফাইভে উঠলে বুবিন দেরাদুনের এক বোর্ডিং স্কুলে চলে গেল। আগে বুবিনের জন্মদিনে ওরা যেত ওদের বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকলেই মনে হত কোনো রুপকথার রাজ্য। দোলনা, স্লিপ, সুন্দর বাগান। সেখানে টেবিল চেয়ার পাতা। খুব মজা হত। ম্যাজিশিয়ান আসত টুপি থেকে খরগোশ বার করত সুন্দর ইংরেজি গান হত নানা রকমের গেম খেলাত এক কোট প্যান্ট পড়া লোক। আসার সময় ওদের বাড়ির পুরোনো চাকর ভগতকাকা সকলকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত। আর বুবিনের মা সবার হাতে তুলে দিত ছোটো ছোটো খেলনার বাক্স। রিটার্ন গিফট সাদা দাড়িওয়ালা ভগতকাকাকে ঠিক সান্টাক্লজ মনে হত লাট্টুর। শশাঙ্ক দেবের সময়েই কাজে এসেছিল ভগতকাকা। বাড়ির একজনের মতো থাকে। বুবিন চলে যাবার পর আর কোনোদিন ডাক আসেনি ওদের বাড়ি থেকে। বুবিনের মা আর ভগতকাকা মাঝে মাঝে বাজারে আসত দেখা হলে কথা হত সবার সঙ্গেপ্রথম প্রথম ছুটিতে বুবিন এলে ওদের সঙ্গে দেখাও করত ক্রমশ সে সব বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন ভগতকাকাকে না দেখে খোঁজ নেয় লাট্টুর বাবা। খবর পায় শেষ সপ্তাহে ভগতকাকার হার্ট আ্যাটাক হয়। দেবাঙ্কর নার্সিহোমে ভর্তি করানো হয়, তারপর সেখানেই নাকি মারা যায়। নার্সিংহোম থেকেই গাড়ি করে শ্মশানে নিয়ে সৎকার করা হয়েছে। পাড়ায় তেমন কেউ জানে না ব্যাপারটা ভগতকাকার কাজ সব বুবিনের বাড়িই করেছিল গৌড়ীয় মঠে। তার বাড়িতেও নাকি খবর দেওয়া হয়নি। পরে অবিবাহিত ভগতকাকার ভাইয়ের ছেলেরা এসে ঝামেলা করেছিল তাদের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি বলে। তারা প্রশ্ন করেছিল তাদের না জানিয়ে দাহকাজ করা হল কেন। পাওনা টাকা আর কিছু বেশি পয়সা দিয়ে ওদের বিদায় করেছিল দেবাঙ্ক। ঝামেলা বাড়তে দেয়নি। পাড়ার লোকজনও কিছুটা বিরক্ত ও ধন্দে ছিল এ ব্যাপারে। এরপর ভগতকাকার জায়গায় একটা ছেলে কাজে বহাল হল পবন নাম তার। ছটফটে উগ্র স্বভাবের। উত্তরপ্রদেশের ছেলে। বাংলা তেমন জানে না। হিন্দি বাংলা মেশানো কথা। ভাবখানা এমন যেন ওই বাড়ির মালিক সে নিজে। বাজারে রোজই দোকানিদের সঙ্গে ঝগড়া নানা বিষয় নিয়ে।
এমনি করে অল্পদিনেই সবাই চিনে ফেলল তাকে। সকালে বাজারে সে এক মজার খোরাক হয়ে যায়। পবনই এখন দেব বাড়ির সঙ্গে পাড়ার লোকের যোগসূত্র।

(৩)

লাট্টুর নতুন ক্লাস, নতুন বই আর কিছু সেকশন বদলানো নতুন বন্ধু। মা এবারের পোকেমনের ছবিওয়ালা টিফিন বাক্সটা একটু বড়ো কিনেছে।
লাট্টুর সঙ্গে ছেলেটার দেখা হয়নি কদিন। ছেলেটার কাছে এখন একটা চাকা লাগানো কাঠের তক্তা।
বুবিনদের ওই দেহাতি কাজের লোক পবন বানিয়ে দিয়েছে ওকে। পুরোনো পেটির কাঠ দিয়ে। এর জন্য একপাড়া লোকের সামনে বকাও খেতে হয়েছে দেবাঙ্কর কাছে। ছেলেটি এখন চাকায় বসে এদিক ওদিক করে খানিক। বেশিদূর না, বুবিনদের বাড়ি থেকে ওদের নার্সিংহোম পর্যন্ত। এ দুদিন লাট্টু দেখল ছেলেটি নার্সিংহোম আর বুবিনদের বাড়ির মাঝামাঝি নীল প্লাসটিক বিছিয়ে বসে। নিজের মনে আঙুল গুনছে আর হেসে হেসে নিজেই বিড়বিড় করছে।
পাড়ায় বেশ ফিসফাস চলছে। দেবাঙ্কর নার্সিংহোম নিয়ে। কদিন আগে কয়েকজন গ্রামের গরিব লোক এসেছিল। বুবিনদের বাড়ির সামনে জমায়েত হয়ে দারোয়ানের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করছিল। পাড়ার বড়োরা এগিয়ে গেছিল ঝামেলা দেখে। বুবিনদের অবাঙালি সবজান্তা কাজের লোকও বেরিয়ে এসে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল। কিন্তু তার মধ্যেই নার্সিংহোমের কয়েকটি লোক এসে ওদের নিয়ে চলে যায় নার্সিংহোমের দিকে। তাদের কথা থেকে এটুকু বোঝা গেছিল যে তারা বুবিনদের মালি নরেশের বাড়ির লোক। বছর তিরিশের নরেশ মালির কাজে বহাল হয় চার বছর যাবৎনরেশের পেট ব্যথা করত প্রায়শই। তাকে ডাক্তার দেখাতে দেবাঙ্কর নার্সিংহোমে পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয় নরেশের অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করতে হবে। বিনা পয়সায় অপারেশন হয়। এরপর তাকে দুমাসের মাইনে, ওষুধ দিয়ে দেশে ফিরে যেতে বলা হয়। দেশে ফেরার পর আবার পেট ব্যথা চাগড় দেয়। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার বলে যে নরেশের অ্যাপেনডিক্স ঘটিত কোনো সমস্যাই নয়। অ্যাপেনডিক্সটিও বহাল তবিয়তে আছে। যে নার্সিংহোমে অপারেশন হয়েছিল সেখানকার প্রেসক্রিপশন, ডাক্তারের নাম ইত্যাদি নিয়ে আসতে বলেছে ডাক্তার না হলে চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাই তারা হাজির হয়েছে নরেশের পুরোনো কাজের বাড়িতে। নার্সিংহোম কোনো কাগজপত্র দিতে পারছে না। সেই সংক্রান্ত ঝামেলা। ভগতকাকার মৃত্যু, নরেশের অ্যাপেনডিক্স এসব নিয়ে জলঘোলা একটা হচ্ছে আন্দাজ করা যায়। পাড়ার লোকেরা নীল প্লাস্টিকে থাকা ছেলেটাকে নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে। হঠাৎ কোথা থেকে এসে আস্তানা তৈরি করল এটা বেশ রহস্যময়।
শীত আসছে মাকে বলে লাট্টু বাড়ির একটা কালো সোয়েটার ছেলেটাকে দিয়েছে। ছেলেটা আজকাল নার্সিংহোমের দিকে বেশি থাকে। লাট্টুকে ওর কাছে গিয়ে টিফিন দিয়ে চলে আসতে হয়। বেশি কথা হয় না। নার্সিংহোমের দিকে যাওয়া, আবার ফেরত আসা - অনেকটা সময় লাগে। মা বকে দেরি হলে। তবু নতুন ক্লাস নতুন বন্ধুদের কথা গল্প করা হয়ে গেছে ওর কাছেলাট্টুর জন্মদিন সেদিন। সকালে ঠাকুমা হলুদ ছুঁইয়ে সোনারুপোর জলে চান করিয়ে পায়েস খাইয়েছে।
রাতে নতুন শার্ট প্যান্ট পরবে। মামা ক্যুরিয়ারে লন্ডন থেকে একটা সুন্দর জ্যাকেট পাঠিয়েছে। গাঢ় চকোলেট রংয়ের। বন্ধুদের জন্য বাক্স ভরা চকোলেট নিয়ে লাট্টু রেডি। কাকুন বাজারে গেছে ওর জন্য ওর প্রিয় চিংড়ি কিনতে। মাংস লুচি পোলাও হবে। কেক আসবে। রাতে মহাভোজ আজ। বাজার থেকে হন্তদন্ত হয়ে একটু দেরি করে ফিরল কাকুন। খুব উত্তেজিত।
লাট্টু রেডি তো! চল বাসে তুলে দিয়ে আসি। কী গণ্ডগোল পাড়ায় আজ!
কেন কী হল? সেই বুবিনদের চাকর আবার লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাল নাকি?” মায়ের প্রশ্ন।
না বউদি। সে আজ চুপ। বলল সে দেশে ফেরত যাচ্ছে। এত বেশি কাজ সে সামলাতে পারছে না। দেবাঙ্কর ব্যবহার নাকি খুব খারাপ।
ও। তাহলে?”
আরে আর বোলো না, দেবাঙ্কর নার্সিংহোমে আজ ভোরে কিছু লোক চড়াও হয়ে ভাঙচুর করেছে। তাদের রোগী নাকি অপারেশন টেবিলে মারা গেছে। একটি কুড়ি বছরের ছেলে। কোনো এক গণ্ডগ্রাম থেকে এসেছে। ডাক্তার ভুল অপারেশন করেছে। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। দেবাঙ্ককে নিয়ে গেছে অ্যারেস্ট করে। হামলা করছিল যারা তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলেছে। আর কী জানি কী হল রাস্তার ওই বিকলাঙ্গ ছেলেটাকেও তুলে নিয়ে গেছে।
এটা শুনে লাট্টুর মন খারাপ হয়ে গেল। আজ তার জন্মদিন আর আজই তার বন্ধুর সঙ্গে এমনি হল। একটা বড়ো চকোলেট রেখেছিল ছেলেটার জন্য আর একটা উলের টুপি। একরকম দেখতে দুটো হয়ে গেছে তার। মাকে বলে নিয়েছিল ছেলেটাকে দেবে বলে। লাট্টুর খুব কান্না পাচ্ছিল। কাকুনকে বার বার বলছিল ওকে পুলিশকে বলে ছাড়িয়ে আনতে। কাকুন বলল দেখছে।
স্কুলে যাবার সময় দেখল নীল প্লাস্টিকটা হাওয়ায় উড়ছে। কুকুরগুলো কেমন মনখারাপ মুখ নিয়ে গুটিয়ে শুয়ে আছে। সকালের সব খুশি হঠাৎ উবে গেছে লাট্টুর ছেলেটাকে পুলিশে নিয়ে যাবার খবর শুনে। সিনেমায় দেখেছে পুলিশরা খুব মারে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না লাট্টুর। বাসে উঠতেই সকলে চিৎকার করে উঠল হ্যাপি বার্থডে বলে। কালই আগাম সকলকে বলে রেখেছিল যে আজ তার জন্মদিন। জোর করে হেসে সকলকে চকোলেট দিল স্কুলেও একই ছবি। অনেক বন্ধুরা কার্ড বানিয়ে এনেছে। কাছের বন্ধুরা ছোটোখাটো গিফটও এনেছে। মন দিতে পারছে না কিছুতেই। মুখটা শুকনো করে বাড়ি ফিরছিল আর নীল প্লাস্টিকটা দেখছিল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে লাট্টুর কাজ হল লেটার বক্স চেক করে আসা। এই কাজটা মা দিয়েছে। এর জন্য মাসে সে একটা অমরচিত্রকথা পায়। আজ লেটারবক্স খুলে একটা সাদা খাম পেল। কোনো স্ট্যাম্প নেই। শুধু ওর নাম লেখাওর নামে খাম দুবার আসে, নিউ ইয়ারে আর জন্মদিনে। মামা পাঠায়। জন্মদিনের কার্ড কাল পেয়ে গেছে। নিউ ইয়ারও এখন না। তাহলে? আর কোনো স্ট্যাম্প তো নেই। কেউ নিজে হাতে দিয়ে গেছে। রহস্য ঘন হল। সিঁড়ির তলায় দাঁড়িয়ে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল -

প্রিয় বন্ধু,
কাল বলেছিলে আজ তোমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। তুমি এ-কদিনে আমার খুব বন্ধু হয়ে গেছ। আমি তোমার থেকে যদিও বয়সে বড়ো তবু এমন বন্ধু আমার আর নেই। একটা নোংরা রাস্তার পাগল ছেলেকে তুমি যেভাবে ভালোবেসেছ তাতে বুঝেছি তুমি একজন ভালো মানুষ। হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছ। আমি সেই রাস্তার বিকলাঙ্গ ছেলে। আসলে আমি তোমার মতোই একজন সুস্থ মানুষ। ওটা ছিল আমার অভিনয়। আমিও পড়াশুনা করি। আর সঙ্গে পুলিশকে তাদের তদন্তে সাহায্য করি মাঝে মাঝে। বহুরূপী আমি। আমিও একদিন পুলিশে যোগ দেব। তোমার মনে প্রশ্ন থাকবে আমার কী ছিল। কেন আমি অমনি সেজে রাস্তায় থাকতাম। খুব গোপন ব্যাপার এসব। আমার বলা বারণ কিন্তু তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি জানি তুমি সব কথা নিজের কাছে রাখবে। কাউকে বলবে না। তাই বলছি তোমায় বন্ধুত্বের বিশ্বাসে। তুমিও তো তোমার গোপন কথা আমায় বলেছ আমিও অল্পই জানি ঘটনাটা আসলে তোমার বন্ধু বুবিনের কাকা খুব অসৎ মানুষ একজননার্সিংহোমের আড়ালে উনি অবৈধভাবে কিডনি বিক্রির ব্যাবসা করতেন। ওনাদের পুরোনো কাজের লোক ভগতকাকার বাড়ির লোক ওদের নামে আর নার্সিংহোমের নামে প্রথম অভিযোগ করে। পুলিশ সন্দেহ করে। তদন্ত শুরু হয়। তারপর ওদের মালি নরেশের বাড়ির থেকে অভিযোগ পায় পুলিশ। নরেশের চিকিৎসা যেহেতু নার্সিংহোমে হয়, তাই নার্সিহোমের নামে অভিযোগ হয়। নরেশের মামা এক পুলিশের বড়োকর্তার বাড়ি কাজ করে। তার সাহায্য নিয়ে এগোয় ওরা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার যখন তাদের জানায় নরেশের কিডনি বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে না জানিয়ে অ্যাপেনডিক্স অপারেশনের কথা বলে, তখন ওরা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবে। এসব অভিযোগের জন্য পুলিশ সাক্ষ্যপ্রমাণ, তথ্যের সন্ধানে ছিল। ওদের বাড়ির নতুন কাজের লোক পবনও পুলিশেরই লোক। সে বাড়ির ভেতরের খবর দিত। আর আমি বাইরে থেকে যা দেখতাম তার খবরদারি করার জন্য ভবঘুরে পাগল সেজে থাকতাম। রাতের অন্ধকার নামলে নার্সিংহোমে অনেক রকম লোক আসে এমন অনেক খারাপ কাজের জন্য। কাল নিউজপেপারে আরও জানতে পারবে। আমার নিজের নাম ঠিকানা জানাবার নিয়ম নেই। তাই জানাতে পারলাম না। কোথাও নিশ্চয়ই দেখা হবে কোনোদিন আবার। তুমি আমায় অনেক যত্ন করেছওই বৃষ্টিদিনের কথা আমি ভুলব না। একদিক থেকে দেখতে গেলে না জেনেই তুমি এই তদন্তে সামিল হয়েছ আমার দেখভাল করে। ভালো কাজে ভালো বন্ধুত্বে থেকো সবসময়।
সুযোগ পেলে তোমায় চিঠি দিয়ে যাবতোমার মায়ের হাতের রান্না খুব ভালো। ভালো থেকো। জন্মদিনে খুব মজা কোরো।
ভালোবাসা
তোমার ভবঘুরে বন্ধু।

লাট্টু চিঠি পড়ে পকেটে নিয়ে ওপরে গিয়ে নিজের সিক্রেট ড্রয়ারে রেখে দিল। মনটা একটু খুশি নিজেকে বড়ো মনে হচ্ছ। কেউ একজন এত ইম্পর্ট্যান্ট মানুষ ভেবেছে তাকে। তার বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে কত কথা বলেছেলাট্টুকে তো বড়োরা পাত্তাই দিতে চায় না। এখন কী মজা! যা সবাই কাল জানবে লাট্টু আজই জানে। ফুরফুরে লাগছে। রাতে আত্মীয়স্বজনরা এল কয়েকজন বন্ধু। ভাই বোন। নতুন জামা পরে মামার সঙ্গে নেটে ভিডিও চ্যাট করল তারপর হল্লা, গানবাজনা খাওয়া খুব হল। অনেক গিফট পেয়েছে।

(৪)

পরের দিন একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল লাট্টুর। রান্নাঘরে রোজকার মতো রেডিয়োতে এফ এম চালিয়েছে মা। দাঁত ব্রাশ করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলএফ এম-এর কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে লাট্টুর। একটা অন্যরকমভাবে কথা বলে ওরা। অনেক খবর দেয়, আবার গান শোনায়। মা ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। পরোটার গন্ধ আসছে। লাট্টুর পছন্দের ব্রেকফাস্ট। জলদি খেয়ে ম্যাথসের হোমওয়ার্কটা শেষ করতে হবে। কাল ভুলে গেছিল করতে। আজ থেকে কাগজে ফলাও করে বেরোতে থাকল নার্সিংহোমের লাট্টুর জানা সব খবর। ছোটোকাকা পেপারটা নিয়ে মোড়ায় বসে পড়ছে আর মায়ের সঙ্গে গল্প করছে।
বুঝলে বউদি, ভগবতকাকার কিডনিও নিয়ে বিক্রি করা হয়েছে বলে পুলিশ সন্দেহ করছে। নরেশেরটার তো প্রমাণও জোগাড় হয়েছে। গ্রামের কিছু হাতুড়ে ডাক্তারদের সঙ্গে দেবাঙ্ক ব্যবস্হা করছিল। তারা গরিব সরল মানুষদের ফুসলে এই নার্সিংহোমে পাঠাত, তারপর তাদের অঙ্গ বিক্রি করা হতএছাড়া অবৈধভাবে ঠিকমতো পরীক্ষা ছাড়া গরিব লোকদের থেকে রক্ত কেনা হত কম দামে। নার্সিংহোমের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে তা ডাবল দামে বিক্রি করা হত।
সে কী গো, দেবাঙ্ক এত পড়াশুনা করে শেষ পর্যন্ত এমন অসৎ পথে গেল! মা বেশ অবাক হয়ে বলল।
ঠাম্মি বলল, “শশাঙ্কবাবু বেঁচে থাকলে, এসব দেখে এমনিই মারা যেতেন। একজন সজ্জন মানুষের ছেলে বাবার নাম ডোবাল
আর বুঝলে বউদি, ওই বিকলাঙ্গ ছেলেটা নাকি আসলে পুলিশের লোক। খবর জানার জন্য অমন সেজে থাকতপবনও নাকি পুলিশ। চাকর সেজে ওদের বাড়ির ভেতরের খবর জোগাড় করেছিল।
দাদু টিভি চালিয়ে বসে আছে আর মাঝে মাঝেই সকলকে ডেকে বলছে, “দেখো দেখো দেবাঙ্ককে দেখাচ্ছে। কী বেহায়া! মুখে এতটুকু লজ্জার রেশও নেই।” আবার বলছে, “দেখো কত গরিব মানুষের সর্বনাশ করেছে
বাড়িতে জোর আলোচনা, শশাঙ্ক দেবের ছেলে এমন অমানুষ কী করে হয়! পাড়ায় নানা জায়গায় জটলা আর একই টপিক। লাট্টু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, “মিস ইউ, বন্ধু।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment