কাব্যনাট্য:: মহাযুদ্ধশেষে - কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


মহাযুদ্ধশেষে
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
------------------------------------------
চরিত্র: যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী
সূত্র: মহাভারত (স্ত্রী পর্ব)

     [কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ আঠারো দিন ধরে অবিরাম সেই মহারণ চলার পর সব শান্ত যুদ্ধক্ষেত্র শ্মশানে পরিণত হয়েছে সঞ্জয়ের মুখে সব শুনে ধৃতরাষ্ট্র সকল নারী-পুরুষদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র অভিমুখে যাত্রা করেছেন হাহাকার করতে করতে এমন অবস্থায় কুরুক্ষেত্র-প্রাঙ্গণে এই কাব্যনাট্যের সূচনা]

যুধিষ্ঠির      এ কী দেখি!
চারিদিকে এ কী দেখি অমাবস্যা ঘোর!!
সারি সারি আত্মজন চিরনিদ্রামগ্ন
সখা কৃষ্ণ! এ কী এল অশান্তির লগ্ন!
মরুভূমি-সম এই শ্মশান-প্রান্তরে
কেন এত অশ্রু জমে আমার অন্তরে?
 
কৃষ্ণ         মহারাজ যুধিষ্ঠির! স্থির হোন, স্থির
আপনাকে মানায় না বিচলিত হওয়া
এই শোক, এই দুঃখ বওয়া
আপনার ভাগ্যে ছিল ভাগ্যে ছিল সবার
রাজন! আপনি কে দোষের ভাগী হবার?
ক্ষমা যদি করেন তো, রাজা,
আসলে আমারই ছিল পাওনা ও-সাজা
 
যুধিষ্ঠির      কেন কৃষ্ণ! তুমি কেন হবে ভাগীদার?
সমস্ত শাস্তি যে পাওনা আমার!
আমারই অবোধ দম্ভে এত হাহাকার
আমি ছাড়া আর বলো দোষ তবে কার?
মনে করো, সেই দিন, পাশাখেলাঘরে
কিছু কি ছিল না ভয় আমার অন্তরে?
তবুও রাজার গর্বে দিশেহারা আমি
রাজ্যপাট পণ রাখি তাতেও না থামি,
একে একে ভাইদের, অবশেষে স্ত্রী-ও!
সেদিন ভুলেছিলাম নিজগর্বে, প্রিয়,
প্রিয়া কৃষ্ণা, আমাদের দ্রুপদতনয়া
আমার একার নয়, ও যে পঞ্চজায়া!
সেই পাপে, সখা কৃষ্ণ, শুধু সেই পাপে
ধরিত্রী শ্মশান হল দারুণ সন্তাপে
ওই দ্যাখো কেঁদে চলে শকুন-শৃগাল,
পৃথিবীতে এল আজ এ কী মহাকাল!
 
কৃষ্ণ         হে রাজন! আমি জানি আপনি নির্দোষ
কালের বিচারে কোনো ক্ষোভ, আপশোশ
থাকে না করারতবু ক্ষোভ কেন জাগে?
বলেছি তো আগে
সমস্ত দোষের ভাগী যদি কেউ হয়
 
যুধিষ্ঠির      সে আমি, সে আমি কৃষ্ণ, আর কেউ নয়
 
কৃষ্ণ         না রাজন! আপনার হয়তো জানা নেই
যুদ্ধের প্রথম দিন শুরু হল যেই
শৃঙ্গার-দামামা-ভেরি বেজে উঠল সব,
সহসা সখা আমার তৃতীয় পাণ্ডব
ধনুক-তূণীর সব ফেলে
বিস্ফারিত চক্ষুদুটি মেলে
বসে রইল রথে শুনি তার পণ
হত্যা সে করবে না আত্মীয়-স্বজন
আরে মূর্খ! তখন তাকে হলই দেখাতে
সকলেই পূর্বে মৃত কালের আঘাতে
সেইদিন বিশ্বরূপ দেখালাম তাকে;
দেখালাম, পাকে পাকে
গর্জে উঠে ছুটে যায় মহাকাল
যেখানে বিলীন সব রাত্রি-সকাল
লক্ষ লক্ষ নরনারী জন্মাচ্ছে, মরছে, ছুটছে,
দাঁড়াচ্ছে, বসছে, উঠছে
নিমেষে নিমেষে তারা মহাস্রোতে বিলীন
সকলেই এসে হল আমাতেই লীন!
 
যুধিষ্ঠির      তোমাতে!! কী বলছ কৃষ্ণ!
 
কৃষ্ণ         হ্যাঁ রাজা যুধিষ্ঠির আমাতে
আমিই সে সোঅহম্‌
আমি এক আমি সত্য
আমি জ্ঞান আমি ব্রহ্ম
আমি প্রাচী আমি সব আমিই সব
 
যুধিষ্ঠির      হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু, বলো তবে বলো
সকলই কি তোমার লীলা? এই রক্তপাত,
যুদ্ধ, ক্ষয়, হিংসা, লয়, এসবে তোমারই হাত!
 
কৃষ্ণ         মহারাজ যুধিষ্ঠির! জ্যেষ্ঠপাণ্ডব!
সমস্ত ঘটনামূলে আমারই বৈভব
আমারই কল্পনামতো
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে এত ক্ষত্রিয় নিহত
পাণ্ডব-কৌরব দ্বন্দ্ব আমারি পাশার চাল,
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে আমি ছড়িয়েছি জাল,
ধীরে ধীরে বিস্তার করেছি মহামায়া
ছড়িয়েছি কালের প্রচ্ছায়া
এবার তা গুটোবার হয়েছে সময়
যতখানি হানাহানি, হিংসা, লোকক্ষয়
প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে গেছে শেষ
এবার শান্তি আসবে, শান্ত হবে দেশ
সমগ্র ভারত জুড়ে এবার শান্তির কাল;
সকলেই সুখী হবে, শুধু
যদুপতি কৃষ্ণের ভাগ্যে এল মহাকাল
 
যুধিষ্ঠির      এমন অশুভ বাক্য কেন তব মুখে
সখা মোর? এ কি দুঃখে, না কোনো কৌতুকে?
 
কৃষ্ণ         আমার সকল কাজ সমাপ্ত রাজন
নেই আর দুঃখ কিছু এই অভাজন
পেয়েছে অনেক সুখ, অনেক আহ্লাদ,
মিটে গেছে সাধ;
ওই দূরে অন্ধকার ঘোর,
অগ্রসর হচ্ছে ক্রমে ভবিতব্য মোর
 
যুধিষ্ঠির      না প্রিয় কৃষ্ণসখা, দ্যাখো চোখ মেলে
এ-শ্মশানমাঝে কারা রথে চড়ে এলে
জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, জননী গান্ধারী,
মহামতি বিদুর ও যত পুরনারী
সকলেই অশ্রুজলে নয়ন ভাসিয়ে
বুকভরা আর্তনাদ, হাহাকার নিয়ে
এদিকেই চলে আসে দ্যাখো যদুপতি
 
কৃষ্ণ         ওই সঙ্গে চলে আসে আমার নিয়তি
জননী গান্ধারী ওই, ধর্মস্বরূপিনী,
আমি তাঁকে চিনি
চোখের আড়ালে তাঁর যায় না কিছুই,
সাধ্য কি পাপহস্তে ও-চরণ ছুঁই?
আমি জানি নিয়তি আমার
গান্ধারীর অভিশাপে আর্ত হাহাকার
ও নিয়ে ভাববেন না রাজা, অগ্রসর হোন,
ধৃতরাষ্ট্র ভূমিতে পদ করেছেন অর্পণ
 
ধৃতরাষ্ট্র      এ কী হল, এ কী হল ঈশ্বর আমার,
সকলি নিয়ে কি তুমি দিলে হাহাকার?
কোথা গেল, কোথা গেল শতপুত্র মোর,
চারিদিকে শুধু আজ অন্ধকার ঘোর
দুর্যোধন, পুত্র মোর, কোথা গেলি ওরে
অষ্টাদশ দিন ব্যাপী দেখি নাই তোরে
আমার সর্বাঙ্গ জুড়ি প্রবল আহ্বান
ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয় প্রাণ
কে? কে তুমি? প্রণাম করিলে অকস্মাৎ
ওঠো, ওঠো, কাছে এসো, ধরি তব হাত
একবার দেখি, যদি দুর্যোধন হও...
না না, তুমি যেই হও, দুর্যোধন নও
 
যুধিষ্ঠির      জ্যেষ্ঠতাত, যুধিষ্ঠির আমি
 
ধৃতরাষ্ট্র      না, না, যাও, চলে যাও পাণ্ডবসন্তান
দূরে চলে যাও তুমি (নীরবতা)
দাঁড়াও ক্ষণেক তুমি সুখী হও
কোথায় তোমার ভ্রাতা দ্বিতীয় পাণ্ডব?
কোথা ভীম? আনো তারে বুকে লই
অপূর্ব অসীম শক্তি ভীমের শরীরে
একবার আশীর্বাদ দিই তার শিরে
 
যুধিষ্ঠির      যাও ভীম, জ্যেষ্ঠতাত করেন আহ্বান
              করিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণাম
ফিরে এসো আশীর্বাদ নিয়ে
 
কৃষ্ণ        (নিম্ন স্বরে) সাবধান, সাবধান ভীম যেয়ো না এগিয়ে
              যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, থাকো ওখানেই
              দারুণ বিপদ তোমার একটু এগোলেই
 
যুধিষ্ঠির      কী বলছ সখা কৃষ্ণ?
আমাদের মধ্যমভ্রাতা ভীম,
জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র-কাছে
ও যাবে আশীর্বাদ মাথা পেতে নিতে,
এখানে বিপদভয় আসে কোথা হতে?
 
কৃষ্ণ         আমি জানি রাজা যুধিষ্ঠির,
দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম বলশালী, বীর
তবু বলি, এ মুহূর্তে মাথায় যে তার
দারুণ নিষ্ঠুর মৃত্যু নাচে অনিবার
 
যুধিষ্ঠির      মৃত্যু? মৃত্যু কেন?
কী বলছ সখা? তবে গোপন কী কোনো
 
কৃষ্ণ         ঐ দেখুন মহারাজ,
কী দারুণ প্রতিশোধস্পৃহা
জ্বেলেছে আগুন যেন ধৃতরাষ্ট্র-অঙ্গে
মেলেছে লেলিহান জিহ্বা
দশটি হাতির শক্তি এখন করেছে ভর
ধৃতরাষ্ট্রের উপর
পুত্রহারা জনকের অব্যক্ত হাহাকার
গোপনে মেলেছে থাবা সব ধ্বংস করিবার
ঠিক এই মুহূর্তের তরে
যদুপতি কৃষ্ণ ছিল প্রতীক্ষা করে
দ্যাখো তবে ধৃতরাষ্ট্র মহারাজাধিরাজ
কত কূটবুদ্ধি ধরে যদুপতি আজ
কই রাজা যুধিষ্ঠির,
ভীমের সে’ লোহার মূর্তি কই?
এ মুহূর্ত একদিন আসবেই জেনে
বহু পূর্বে যাকে আমি রাখিয়েছি এনে?
প্রস্তুত রাখুন একে যখনই ভীমের শোকে
আকুল-ব্যাকুল হয়ে ধৃতরাষ্ট্র কাঁদবেন,
তখনই এগিয়ে দিতে হবে
ঐ দেখুন, ধৃতরাষ্ট্র কেমন সরবে
করছেন সোহাগের ভান
 
ধৃতরাষ্ট্র      কই, কই, ভীম কই, ভীম?
মহাবলী, শক্তি যার প্রচণ্ড, অসীম?
একা হাতে হত্যা করে শত কৌরবেরে,
শতেক ভ্রাতার প্রাণ একা নেয় কেড়ে,
কই সেই মহাবলী? সারা কুরুরাজ্যে
অন্ধকার, হাহাকার এনে দিল আজ যে,
সেই মহাশক্তিশালী ভীম কই? আয়,
আয় বৎস বুকে মোর, লয়ে চ সেথায়,
যেথা মোর শতপুত্র হাহাকার করে,
অগণিত আত্মজন তৃষ্ণা লয়ে মরে,
আজ সব স্তব্ধ যেথা, পুত্র দুর্যোধন
যেথা ছিল পড়ে, ভগ্ন-ঊরু, ভগ্ন-মন,
আমারে একটিবার সেথা লয়ে যাবি
আয় বৎস, আজ শুধু এইটুকু দাবি
কিছু নাই, আর কিছু নাই যে রে আজ
দেখে যা সকলে আসি, মহা-অধিরাজ
ধৃতরাষ্ট্র নিঃস্ব আজ, শূন্য কর তার
শূন্য গর্ব, শূন্য দম্ভ, শূন্য অধিকার
পাণ্ডবপুত্রেরা তার সব কেড়ে নিল
নিস্তব্ধ নীরব তাই তাহার নিখিল
প্রবল প্রচণ্ড দম্ভে পূর্ণ ধৃতরাষ্ট্র
আজ শুধু পড়ে আছে শুষ্ক দগ্ধ কাষ্ঠ
তাই বলি, আয় ভীম, বক্ষে আয় মোর
কাটিয়ে দে দুপাশের অন্ধকার ঘোর
ভ্রাতুষ্পুত্র তোরা সব পুত্র হয়ে আয়
প্রলেপ মাখিয়ে দে রে প্রবল ব্যথায়
 
কৃষ্ণ         দিন রাজা যুধিষ্ঠির, লৌহ-প্রতিকৃতি
এবার এগিয়ে দিন ধৃতরাষ্ট্র-হস্তে
 
(ক্ষণিক নীরবতা)
 
যুধিষ্ঠির      (চিৎকার)
এ কী দেখি, সখা কৃষ্ণ, অবিশ্বাস্য এ যে,
বৃদ্ধ জ্যেষ্ঠতাত এ কী অসম্ভব তেজে
চূর্ণ করে ফেললেন লোহার পুতুল
এখনও শরীরে তাঁর শক্তি কী অতুল!
 
ধৃতরাষ্ট্র      (আক্ষেপ) ও-ও-ও-ওহ্‌হ্‌!
এখনও ছলনা, কৃষ্ণ, এখনও ছলনা?
এত করি’ তবু তব সাধ মিটিল না?
ভেবেছিনু, ভীমটারে পিষ্ট করি’ হাতে
লব প্রতিশোধ, তুমি দিলে না তা হতে
 
কৃষ্ণ         মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, এ আমার কাজ
পাপের তরণী তব পূর্ণ হল আজ
অধার্মিক শত পুত্র তব
ধর্মের আগুনে আজ হয়ে গেছে ছাই
তাদের কারণে শোকপালন বৃথাই
পাণ্ডবপুত্রেরা আজ প্রার্থী তব দ্বারে,
তাহাদের স্থান দিন পুত্রের আকারে
 
ধৃতরাষ্ট্র      বেশ, তবে তাই হোক
পাপিষ্ঠের পূর্ণপাত্র চূর্ণ হোক আজি,
সর্ব গর্ব শূন্য করি পূর্ণ হোক সাজি
 
যুধিষ্ঠির      জয় কৃষ্ণ, জয় কৃষ্ণ, জয় চক্রধারী
 
কৃষ্ণ         ক্ষান্ত হোন যুধিষ্ঠির! জননী গান্ধারী
পাণ্ডবপুত্রদের স্পর্শ পেতে চান,
আশীর্বাদপ্রার্থী হোন, যান
 
যুধিষ্ঠির      দাও মাতা, পদধূলি দাও
পাপিষ্ঠ পুত্রেরে তব বক্ষে টেনে নাও
আশীর্বাদ করো, যেন সকল ভ্রাতার
সমগতি হয় মোর, যেন গো আবার
কখনও এমন পাপ করিতে না হয়,
যেন মোর চিরদিন থাকে পরাজয়
জয়ের সৌভাগ্য আমি চাই না তো আর
ভ্রাতৃকুলহত্যা থাকে আড়ালে যাহার
গুরুজন-পরিজন হত্যার যে পাপ
তা যেন লঙ্ঘিত হয়, দাও এই শাপ
 
গান্ধারী      স্তব্ধ হও পুত্র মোর
বাক্য এত সুকঠোর
কহিও না আর
হৃদয় আমার
অশান্ত হয়েছে আজি বিধির বিধানে,
এখনো এখানে
শতপুত্র আছে মোর শুয়ে;
তব শির ছুঁয়ে
এই বাক্য কহে যাই,
হেথা ভাই-ভাই
গুরুজন-পরিজন নাহি দেখো কিছু,
কেবল ধর্মের পিছু পিছু
ছুটিয়া বেড়াও
কেবল ধর্মের পানে ‘ভাই’ বলে ধাও
দ্যাখো তো এখানে
শতপুত্র রয়েছে কী নিশ্চিন্ত শয়ানে
আমি একা হতভাগ্য মাতা
ধর্মের পোশাক পরি’ স্তব্ধ হে বিধাতা!
অশ্রুজল নাহি মোর, নাহি অভিমান,
নাহি দুঃখ, নাহি শোক, সুকঠোর প্রাণ!
আমি যেথা স্তব্ধ এত,
তুমি কেন যুধিষ্ঠির শোকে অভিভূত?
 
যুধিষ্ঠির      পারিব না, পারিব না, ক্ষমা করো মাতঃ
যেইরূপ শোকাবেগে পূজ্য জ্যেষ্ঠতাত
বিহ্বল, তেমনি আজও আমার হৃদয়
কেমনে ভুলিব বলো এত জ্ঞাতিক্ষয়?
 
গান্ধারী      তবে শোন্‌ পুত্র মোর, যুদ্ধারম্ভ-প্রাতে
সঙ্গী লয়ে সাথে
আশীর্বাদ নিতে এল পুত্র দুর্যোধন,
নিমেষে এমন
করিয়া উঠিল সারা দেহে, মনে হল
কে যেন বলিছে, খোল, মায়াডোর খোল
সেইদিন মহাকাল আসি’
জিহ্বা নি গ্রাসি’,
সেই দিন কহি নাই, ‘তুই হবি জয়ী’,
কহিলাম, ‘ধর্মের হইবে বিজয়’
আজ মনে হয়
সে আমার দৈববাণী;
কেমনে না জানি
ফলিল তা নিষ্ঠুর কঠোর আঘাতে
তাই আজি প্রাতে
নাহি কিছু দুঃখ মোর, প্রার্থনা আমার
পূর্ণ আজি, তাই আর নাই হাহাকার
 
যুধিষ্ঠির      তুমি তো জননী
ধর্ম এক লক্ষ্য জেনে বাঁধিয়াছ বুক
শতপুত্র গেছে, তবু আছে তব সুখ,
আছি মোরা, তব পুত্র, হারায়নি কেহ
আমরা কেমনে বলো ফিরে যাই গেহ?
আমাদের শতভ্রাতা কোথা পাব ফিরে?
না জননী, ভিক্ষা দাও তব যুধিষ্ঠিরে
আর নাহি ফিরি যেন হস্তিনানগরে
প্রাণ বিসর্জন দিই কুরুক্ষেত্র-’পরে
 
গান্ধারী      যুধিষ্ঠির, পুত্র মোর, হয়ো না অধীর
শোনো পুত্র, কাল নহে স্থির
সকল বেদনা হৃদয়ের
একদিন মুছে যাবে ফের,
শান্তি পাবে অন্তরে তোমার
তার পূর্বে তুলে নাও নবকর্মভার
নবরাজ্য করো প্রতিষ্ঠিত,
পঞ্চভ্রাতা মিলে রাজ্য করো হে শাসিত
ভাগ্যবতী দ্রৌপদীকে লয়ে
স্বর্গরাজ্য হতে সুখ মর্ত্যে আনো বয়ে
আর কৃষ্ণ, সুদর্শনধারী!
 
কৃষ্ণ        জননী গান্ধারী!
 
গান্ধারী      তোমা প্রতি আছে মোর ক্ষুব্ধ অভিমান
বাক্য মোর করো অবধান
 
কৃষ্ণ         কহ হে গান্ধারী
আমি জানি, তুমি সেই নারী
ধর্মপথে কন্টক যে পারে না সহিতে;
আমি জানি, হবে মোরে গ্রহণ করিতে
তোমার মুখের অভিশাপ;
যদিও করিনি কোনো পাপ
 
গান্ধারী      পাপ নহে? পাপ নহে? পাণ্ডব কৌরব
সমচক্ষে দেখ বলি’ ছিল যে গৌরব,
কোথা গেল যুদ্ধকালে, কহ যদুপতি?
কে দিল দুর্মতি
একা পাণ্ডবের ধর্ম রক্ষা করিবার?
কুরু-পরিবার
কিছুই কি দেয় নাই চরণে তোমার?
শ্রদ্ধা, প্রেম, ভক্তিরাজি
নিমেষে ভুলিলে আজি
শিষ্য-সাথে করিলে ছলনা
কেহ ভুলিব না
শোন কৃষ্ণ, সে-ই পাপী, পাপ যার কর্ম,
পাপে যে সাহায্য করে, পাপ তারও ধর্ম,
আর পাপী সে,
ধর্মপথে চলতে গিয়ে পাপ করে যে
সেই পাপে পাপী তুমি, দেবকীনন্দন,
তব কূটচালে আজ আমার ক্রন্দন,
কাঁদে বসুন্ধরা,
কাঁদে দেখ লক্ষশত কুরুরমণীরা
শোন কৃষ্ণ মম অভিশাপ
যেমন শুনিছ হাহাকার, পরিতাপ,
যেমন কাঁদিছে আজ জননী গান্ধারী
সমগ্র যদুকুলনারী
এমনই দারুণ শোকে হবে মুহ্যমান,
তার পূর্বে কৃষ্ণ, তব নাই পরিত্রাণ
 
কৃষ্ণ         রাজমাতা, তবে তাই হোক
করিব না শোক
সমাপ্ত সকল কাজ মোর,
আসিছে দুর্দিন ঘোর
চলে যেতে হবে
তার আগে বলে যাই, সুখী হয়ো সবে
দুঃখ নিয়ে, শোক নিয়ে মর্ত্য-লীলাখেলা
পূর্ণ হোক, পূর্ণ হোক মিলনের বেলা।।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment