পাঁচমাড়ির কমলিলতা
পুষ্পেন মণ্ডল
রাস্তাটা ক্রমশ উঁচুতে উঠে কুয়াশার ভিতর দিয়ে শাল-মেহগনি জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেছে বাঁকের পরে। ক্রোক ক্রোক - করে বড়োকাও ধনেশের ডাক শুনে ঘুরে তাকালেন মণিবক মিত্র। তবে এদিক ওদিক চেয়েও
খুঁজে পেলেন না পাখিটাকে। মধ্যপ্রদেশের একটা নির্জন হিলস্টেশন পাঁচমাড়িতে এখন
সন্ধ্যা নামছে। চারিদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝুপসি জঙ্গল। আকাশ মেঘলা। এখন ভরা শ্রাবণ।
সারাদিনই প্রায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। গাছেদের পাতাগুলো চকচক করছে জল পড়ে। বাতাসে ভিজে
মাটির সোঁদা গন্ধ। পাশের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে উঠল। মণিবকবাবু চমকে উঠে তাকালেন সেদিকে।
সন্দেহজনক কিছু চোখে না পড়ায় বড়ো করে শ্বাস নিয়ে আবার পা চালালেন তিনি। এখানের
একটা নামী রিসর্টে উঠেছেন মণিবক মিত্র। বৃষ্টিটা একটু কমতে ছাতা হাতে গেট দিয়ে
বেরিয়ে কিছুটা নেমে ভেজা পিচ রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ভয়ে ভয়েই হাঁটছিলেন।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল পকেটে।
রণজয়ের ফোন। মণিবকবাবু কয়েকদিনের জন্য কাউকে কিছু না জানিয়েই পালিয়ে এসেছেন
এতদূরে, এই কথাটা একমাত্র ডাক্তার-বন্ধু রণজয় জানে। বলা
যায়, ওর পরামর্শেই এখানে
আসা। ফোনটা অন করলেন মণিবকবাবু, “হ্যালো!”
“কী হে! কেমন আছ? ঠিকঠাক পৌঁছেছ তো? ফোনে পাচ্ছি না যে!”
“আছি ভালোই। এখানে ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায় না সব জায়গাতে। এখন একটু হাঁটতে
বেরিয়েছি, তাই টাওয়ার পেলাম। তবে
সিগন্যাল খুবই লো!”
“পোড়ো বাড়িটা খুঁজে পেলে নাকি?”
“নাহ! হোটেলে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কিছুই বলতে পারল না। তবে এই জায়গাটা আমার খুব চেনা লাগছে।”
“আচ্ছা বেশ। তোমার খোঁজ চালিয়ে যাও। খাবার আর ওষুধগুলো ঠিক সময়ে খেয়ো। পরে আবার
ফোন করব।”
ছোটোবেলার বন্ধু রণজয় ডাক্তারি পাস করে এখন কলকাতার নামকরা মনোবিদ। উনি রণজয়ের
পেশেন্ট। ফোনটা কেটে যেতে সেটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার পা চালালেন মণিবকবাবু। গাছের
পাতা চুঁইয়ে জলের বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছে উপর থেকে মাঝে মাঝে। চারপাশটা নিঝুম হয়ে আসছে
ক্রমশ। আর কতটা এগোনো ঠিক হবে সেটাই ভাবছেন তিনি। মনের মধ্যে যে তোলপাড় চলছে
সেটাকে কিছুতেই চাপা দিতে পারছেন না।
পাঁচমাড়িতে তিনি নাকি আগেও একবার এসেছিলেন। প্রায় একুশ বছর আগে। কিন্তু অবাক
ব্যাপার হল, সেই স্মৃতি তাঁর মস্তিস্ক থেকে একেবারে বেমালুম
মুছে গেছে। মণিবক মিত্র হিসেব করে দেখলেন, তখন তাঁর বয়েস ছিল সাতাশ-আটাশ। মানে বিদেশ যাওয়ার ঠিক আগে। তখন তিনি চারিদিকে চাকরির পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ
দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে কখন যে মধ্য ভারতের এই পাঁচমাড়িতে এসেছিলেন, সেই ঘটনা কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ তিনি যে এসেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ আছে।
প্রমাণটা হল একটা চিঠি। কমলিলতা নামে একজনকে চিঠি লিখেছিলেন পাঁচমাড়ি থেকে। কে
এই কমলিলতা? তার কথাও মনে পড়ছে না একেবারে। পাঁচমাড়ির
স্মৃতিটাই বা মাথা থেকে মুছে গেল কী করে?
পুরোনো অসম্পূর্ণ চিঠিটা অদ্ভুতভাবে কয়েক মাস আগে তাঁর হাতে এসে পড়ে। দু-বছর
হল বিদেশের চাকরি ছেড়ে ঘরে ফিরেছেন মণিবকবাবু। মাস ছয়েক আগে একটা জরুরি দলিল
খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ একটা ডায়ারির মধ্যে থেকে এই চিঠিটা পেলেন তিনি। সঙ্গে একটা ঝাপসা
হয়ে যাওয়া রঙিন ছবি। সেই সময়ে ক্যামেরায় নেগেটিভ রিল লাগিয়ে ছবি তোলার চল ছিল। এটা
সেই যুগের ছবি। ছবিটাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজন। পিছনে সবুজ পাহাড়। মাঝখানে
সব থেকে কম বয়সি যে ছেলেটিকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি হলেন একুশ বছর আগের মণিবক
মিত্র নিজে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে ছবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। নিজেকে ছাড়া কাউকেই
চিনতে পারলেন না। অথচ ছবিতে তিনি পাশের ব্যক্তির কাঁধে হাত দিয়ে আছেন এবং অন্য এক
ব্যক্তি ওনার কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্থাৎ এনারা মণিবকবাবুর নিশ্চয়ই বিশেষ
পরিচিত ছিলেন। তাহলে এনাদের নামটা মনে পড়ছে না কেন? মুখগুলোও তো সবই অচেনা লাগছে।
পকেটে করে ছবিটা নিয়েই হাঁটতে বেরিয়েছিলেন মণিবকবাবু। বাঁকটায় এসে দূরের
পাহাড়গুলোর দিকে চোখ যেতে পকেট থেকে ছবিটা বের করে মিলিয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, দূরে ওই পাহাড়ের চূড়াগুলো ছবির
সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তার মানে এরকমই কোনো একটা জায়গা থেকে ছবিটা তোলা হয়েছিল। ছবিতে
যাঁরা আছেন, মণিবকবাবু তাঁদের নাম জানতে পেরেছেন কমলিলতাকে
লেখা চিঠিটা থেকে। মিঃ রামিয়া, কারাণ্ডিকার, সিং, আগরওয়াল। তবে কে কোনজন, সেটা বুঝতে পারেননি। একটা কোম্পনির গেস্ট হাউসের কথা উল্লেখ আছে। যেখানে ওনারা
সবাই উঠেছিলেন। কিন্তু কোম্পানির নাম লেখা নেই চিঠিতে। তাই সেই গেস্ট হাউস খুঁজে
পাওয়া দুষ্কর। মণিবকবাবুর মনে হচ্ছে
চিঠিটা নিশ্চয়ই কোনো কারণে তিনি পোস্ট করতে পারেননি। যদি পোস্ট করতেন তাহলে এটা
কমলিলতার কাছে থাকত, তাঁর কাছে নয়। একুশ বছর
আগের কথা জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে তিনি খুঁজে পেলেন না। ওনার মা-বাবা দু’জনেই গত হয়েছেন। পুরোনো
বন্ধুদের সঙ্গেও তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। কী হয়েছিল? কেন এসেছিলেন এখানে? কী ঘটেছিল? কারা এই চারজন লোক? এসব কিছুই মনে
করতে পারছেন না মণিবকবাবু।
চিঠির হাতের লেখাটা যে তাঁর নিজের, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন। তিন পাতার চিঠি। প্রথম দু-পাতা মোটামুটি পড়া
যাচ্ছে। সেখানে পাঁচমাড়িতে যাওয়া, গেস্ট হাউসে থাকা, জঙ্গলে ঘোরা, এই সব কথাই লেখা রয়েছে। ওই
চারজন লোকের সঙ্গে সম্ভবত কোনো কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। তাদের সঙ্গে মণিবক
মিত্র এসেছিলেন এই পাঁচমাড়িতে। শেষের পাতায় জল পড়ে লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। অনেক
কষ্ট করে সেই পাতা থেকে দু-একটা শব্দ উদ্ধার হল। “পোড়ো দুর্গ”, “সাপ”, “কমলিলতা” ইত্যাদি। এগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন
না তিনি।
কিন্তু সমস্যাটা আরও ঘোরালো হল যখন ওই চিঠি আর ছবিটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই বার
বার মণিবকবাবু একটা স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। বড়ো অস্বস্তিকর গা শিরশিরানি সেই স্বপ্ন।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল প্রায়ই।
সেদিনকেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মণিবক মিত্রের। মোরগের ডাক আর পাখিদের
কিচিরমিচির কানে আসতে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিয়ে হোটেলের বাইরে এলেন। খুব সুন্দর করে
সাজানো ছবির মতো লন, বাহারি গাছের সারি।
কিন্তু গত রাতের স্বপ্নটা খুব বাজে ছিল। সেই কথা চিন্তা করতে করতেই হোটেল থেকে
বেরিয়ে ডান হাতের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বেশ কিছু দূর গিয়ে একটা মোটা মেহগনি
গাছের নিচে গুমটি চায়ের দোকান খোলা পেলেন মণিবকবাবু। কয়লার উনুনে সবে আগুন দিয়েছে
চায়ের দোকানি। সাদা ধোঁয়া পাক দিয়ে উঠে আকাশ ভরিয়ে দিচ্ছে। মণিবকবাবু এগিয়ে গিয়ে
হিন্দিতে জানতে চাইলেন, “চা তৈরি হতে আর
কত দেরি ভাই?”
মধ্যবয়স্ক এক স্থানীয় মানুষ মুখ তুলে বললেন, “সবে আগুন জ্বেলেছি বাবু। কিছুক্ষণ সময় লাগবে। একটু বসুন।”
হোটেলের টি-ব্যাগের চা আর স্থানীয় দোকানের ফোটানো দুধ-চায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। “বেশ তবে অপেক্ষা করছি
এখানে।” বলে কাঠের বেঞ্চিতে বসে পড়লেন মণিবকবাবু। পকেট
থেকে ফোনটা বের করে দেখলেন নেট খুব স্লো। কিছুক্ষণ আঙুল ঘুরিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে
রাখলেন।
ততক্ষণে তাঁর পাশে আর একজন সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা ষাটোর্ধ মানুষ এসে বসেছেন। “কী হে বলরাম, তোমার মেয়ের শরীর কেমন?” বেশ মোলায়েম গম্ভীর গলা শুনে তাঁর দিকে ঘুরে তাকালেন মণিবকবাবু।
চায়ের দোকানি বিনয়ী গলায় উত্তর দিল, “আজ্ঞে আগের থেকে ভালো ডাক্তারবাবু। জ্বর ছেড়ে গেছে। তবে একটু দুর্বল।”
“কাঁচা পেয়ারা কেটে দেবে সকাল বিকাল। আর বাতাবি লেবুর রস। ক’দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মণিবকবাবু বুঝলেন ইনি এলাকার প্রবীণ ডাক্তার। একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে তিনি প্রশ্ন
করলেন, “একটা কথা ছিল, আপনি কি এখানের স্থায়ী বাসিন্দা?”
তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এখন আমি এখানেই থাকি। আদি বাড়ি ইন্দোর। নাম শঙ্করপ্রসাদ শর্মা। পেশায় ডাক্তার। কেন বলুন তো?”
“নমস্কার, আমি মণিবক মিত্র। বাড়ি কলকাতায়। আসলে আমি একটা
সমস্যা নিয়ে এসেছি।”
“পেটের গোলযোগ, না শ্বাসকষ্ট?”
“না ডাক্তারবাবু, ওসব কিছু নয়। সমস্যাটা
মনের।”
“আচ্ছা, তাহলে তো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে। আমি
জেনারেল ফিজিশিয়ান।”
“হ্যাঁ, সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শেই আমি এসেছি এখানে।
কিন্তু এখানে এসে তেমন কিছু লাভ হল না, উলটে সমস্যা আরও বেড়ে গেল।”
“আপনার সমস্যাটা কীরকম একটু শুনি?”
ডাক্তারবাবুর আগ্রহ দেখে মনে মনে খুশি হলেন মণিবক মিত্র। তিনি প্রথম থেকে
ঘটনাটা গুছিয়ে বললেন তাঁকে। ডঃ শর্মাও মন দিয়ে শুনলেন তাঁর কথা। মণিবক মিত্র শেষে
বললেন, “আমি এই জায়গাতে এসেছিলাম বলেই মনে হচ্ছে। যেন
আবছা চিনতেও পারছি জায়গাটাকে। কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছুই মনে নেই। আর আমার সঙ্গে আরও
চারজন লোক ছিলেন, এই যে ছবি আছে তাঁদের।
দেখুন। এদেরকেও একদম মনে পড়ছে না। কেন এসেছিলাম? কী ঘটেছিল এখানে? যতক্ষণ না মনে করতে
পারছি, স্বস্তি হচ্ছে না।” তিনি বুক পকেট থেকে ছবিটা বের করে দেখালেন ডঃ শর্মাকে।
বেশ কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে ডঃ শর্মা জানতে চাইলেন, “পুরোনো কথা মনে পড়ছে না, এটাই কি একমাত্র
সমস্যা?”
“না না ডঃ শর্মা। সমস্যাটা হল একটা ভয়ানক স্বপ্ন।”
“স্বপ্ন?”
“হ্যাঁ। আমি যখনই ঘুমাতে যাই ওই স্বপ্নটা ঘুরে ফিরে আসে। জঙ্গলে ভরা পাহাড়ের
মাথায় একটা পোড়ো বাড়ি। বেশ বড়ো। সেখানে আমি আটকে গেছি কোনোভাবে। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেন
আকাশ ভেঙে জল নামছে উপর থেকে। তার মধ্যে শত শত সাপ ধসে পড়া দেয়ালের ফাঁকফোঁকর দিয়ে
বেরিয়ে কিলবিল করছে। আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এক কোণে। ভয়ে শ্বাস বন্ধ হওয়ার
অবস্থা। গায়ের উপর দিয়ে, পায়ের উপর দিয়ে
বেয়ে যাচ্ছে হিলহিলে সাপ। দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ।”
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর?”
“তারপর ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘেমে নেয়ে একশা। ভয়ে আধমরা অবস্থা। অথচ যখন স্বপ্নটা দেখি, তখন বেশ বুঝতে পারি যে এটা স্বপ্ন, কিন্তু কিছুতেই ভয়ের থেকে মুক্তি পাই না। আমার সাইকিয়াট্রিস্টও বেশ কিছু ওষুধ
দিয়ে দেখেছেন। কোনো লাভ হয়নি। তখন উনিই বললেন, যান একবার পাঁচমাড়িতে
ঘুরেই আসুন। যদি কিছু পুরোনো কথা মনে পড়ে!” একটু থেমে মণিবক মিত্র দম নিয়ে আবার বললেন, “এখন এমন অবস্থা হয়েছে, রজ্জুতে সর্পভ্রম
যাকে বলে। একটু অন্ধকার হলেই মনে হয় ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেন সাপ বের হয়ে আসছে।
রাত্রিবেলা বাথরুম যেতে গেলে মনে হয় খাটের নিচে সব বিষধর সাপেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে
শুয়ে আছে। মেঝেতে পা রাখলেই, পায়ে ছোবল মারবে।
বাগানে যেতে ভয়, সকালে হাঁটতে যেতে ভয়।”
“স্নেক ফোবিয়া!” মন্তব্য করলেন ডাক্তারবাবু।
“রণজয়ও তাই বলল।”
“এটা কবে থেকে শুরু হয়েছে আপনার?”
“ওই চিঠি আর ছবিটা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে। তা ধরুন মাস ছয়েক হল।”
ততক্ষণে চা এসে গেছে। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন ডঃ শর্মা। “হুম! যতদূর জানি একটা পোড়ো দুর্গ আছে এখানে। পাহাড়ের
মাথায়। পাঁচ-ছ কিলোমিটার হাঁটা পথ। সেদিকে তো কেউ যায় না।
এদিকে বিষাক্ত সাপের সঠিক অ্যান্টিভেনামও পাওয়া যায় না। তাই বিষধর সাপের কামড়ে
এখানে আকছার লোক মারা যায়। আমি প্রায় পঁচিশ বছর আগে এসেছিলাম সাতপুরা
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তারপর ভালোবেসে ফেলি জায়গাটাকে। চাকরি জীবনের শুরুতে একটা
অদ্ভুত ঘটনার কথা মনে পড়ছে, ওই বড়ো পাহাড়টার
ওপারে ঝরনার ধারে একদিন এক সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলেকে পাওয়া গিয়েছিল অজ্ঞান অবস্থায়।
তবে তার গায়ে সাপে কামড়ানোর কোনো চিহ্ন ছিল না। হাত পায়ে আঘাত ছিল। মাথাতে চোট
লেগেছিল। আমি প্রাথমিক চিকিৎসা করে ভোপাল স্টেট জেনারেল হসপিটালে রেফার করেছিলাম।
ছেলেটি সম্ভবত পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে গিয়েছিল কোনোভাবে। তা সে ছেলেটি যদি আপনি হন
তাহলে আপনার মাথার পিছনে সেলাইয়ের দাগ থাকবে।”
“আছে, আছে তো!” বলেই চেঁচিয়ে উঠলেন মণিবক মিত্র। চোখ দুটো তাঁর চকচক করে উঠল। মাথার পিছনের
চুল সরাতে দেখা গেল সেখানে পুরোনো কাটার দাগ। ডাক্তারবাবু বললেন, “এই তো সেই দাগ!”
“বেশ! তাহলে আপনিই সেই ব্যক্তি।” মাথা নেড়ে বললেন ডঃ শর্মা।
মণিবকবাবু প্রশ্ন করলেন, “কোন গেস্ট হাউসে
আমরা ছিলাম আপনার মনে আছে?”
প্রশ্নটা শুনে ডঃ শর্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেবে নিয়ে উত্তর দিলেন, “আমার যতদূর মনে পড়ছে, কুড়ি-একুশ বছর আগে পাঁচমাড়িতে মোট তিনটে
গেস্ট হাউস ছিল। আর গোটাকতক ছোটো আর মাঝারি হোটেল। একটা স্টেট ব্যাঙ্কের গেস্ট হাউস, একটা সরকারি বন দপ্তরের আর একটা প্রাইভেট, কোনো একটা ভোপালের ফিন্যান্স কোম্পানির গেস্ট হাউস। মনে হচ্ছে তোমরা ওই
ফিন্যান্স কোম্পানির গেস্ট হাউসেই উঠেছিলে। তবে নিশ্চিত বলতে পারব না।”
মণিবকবাবু আরও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চায়ের দোকানি আগ বাড়িয়ে বললেন, “ফিন্যান্স কোম্পানির গেস্ট হাউস তো অনেক বছর আগেই বিক্রি হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু।
দু-বার হাত ফিরি হওয়ার পর একজন মাড়োয়ারি কিনে সেটাকে রিসর্ট বানিয়েছে। এম. টি. পি. রিসর্ট।”
‘আমি তো ওখানেই উঠেছি। ওই জন্যই আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল হোটেলের ঘরগুলো।’ স্বগতোক্তি করলেন মণিবকবাবু।
ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে আরও কিছুক্ষণ বসে রইলেন মণিবক মিত্র।
আকাশের মেঘগুলো পাতলা হয়ে পূর্ব দিক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। ডাক্তারবাবু উঠে বললেন, “আমার বাড়িটা পাশেই। ওই টিলার গায়ে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে। বাড়ির
সঙ্গেই চেম্বার। সকাল বিকাল রোগী দেখি। দরকার পড়লে আসবেন।”
মণিবক মিত্র মাথা নেড়ে জানালেন, “ওই পাহাড়ের মাথায়
যে পোড়ো বাড়িটার কথা বলছিলেন, সেখানে কি একবার
যাওয়া যায়?”
“বাপ রে! সে তো খুব ধকলের রাস্তা। অনেকটা খাড়াই। পারবেন
আপনি?”
“চেষ্টা করব। খুব তো দূর নয়।”
“না, তা নয়। আসলে পোড়ো জায়গা বলে কেউ যায় না। লোকে
বলে শিবাজির এক নায়েবের নাচঘর ছিল ওটা। তাকে নাকি জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি গিয়ে কী করবেন? তাছাড়া আপনার স্নেক
ফোবিয়া। ওখানে গিয়ে যদি আবার বিপদ হয়।”
“বিপদ তো জীবনের পদে পদে ডাক্তারবাবু। ভয়কে জয় করতে গেলে একবার তো সেটার সামনে
গিয়ে দাঁড়াতে হবে।” একগাল হেসে তিনি আবার
বললেন, “কিছু না, জাস্ট কৌতূহল। এতদূর থেকে একটা স্বপ্ন টেনে নিয়ে এসেছে আমাকে। যদি সমস্যা থেকে
মুক্তি পাওয়া যায়, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
“আচ্ছা বেশ। আমি একটা ছেলেকে চিনি যে আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারে। যদি সে রাজি
হয় বিকালের দিকে পাঠাব আপনার হোটেলে। কী নাম বললেন যেন আপনার?”
“মণিবক মিত্র।”
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে মণিবকবাবু বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ করে
পাহাড়ের মাথায় ওই পোড়ো বাড়ি নিয়ে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করলেন। বাজারের
এক সবজি বিক্রেতা জানাল, “উও খণ্ডহর মে এক চুড়েল
র্যাহতি হ্যায় বাবু। উঁহাপে জো ভি গ্যায়া, কোই বাপাস নেহি আয়া।”
কেউ বলল চুড়েল, কেউ বলল ডাইনি, একজন আবার বলল – এক বেদেনি থাকে ওখানে।
একা। সাপগুলো নাকি সব ওর পোষা। মণিবকবাবু বুঝলেন যে কারণেই হোক পাহাড়ের মাথায় ওই
পোড়ো বাড়িটা নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে একটা আতঙ্ক রয়েছে। সেই জন্যই ওখানে কেউ
যেতে চায় না।
রিসর্টে ফিরে মণিবকবাবু ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের এখানে সব থেকে পুরোনো স্টাফ কে আছেন?”
তিনি অবাক হয়ে জানালেন, “রিসর্টের মালি
প্রসাদ সব থেকে পুরোনো। ওঁর বয়স প্রায় সত্তর বছর। কেন বলুন তো?”
“তেমন কিছু নয়। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে একটু খোঁজখবর করছিলাম। উনি এখন কোথায়?”
“পিছনের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে আছেন নিশ্চয়ই। আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনি লাউঞ্জে
বসুন।”
সাজানো লাউঞ্জের কোণে একটা সোফায় গিয়ে বসলেন মণিবকবাবু। ভিতরটা আর একবার ভালো
করে লক্ষ করলেন। এই অংশটা সম্ভবত পুরো নতুন করে বানানো হয়েছে। ডিজাইন আর আর্কিটেকচার
একদম হালফিলের। পু্রোনো বাংলোটা এর পাশে রয়েছে। সেখানেই তাঁর রুম। রুমের বাইরে লন।
লনে সাজানো সোফাসেট। এগুলো যেন তাঁর পূর্বজন্মের স্মৃতি। রণজয় তাঁর সিটি স্ক্যান
করিয়ে বলেছিল, “মাথায় পিছনে যে চোটটা আছে, তার নিচেই তো স্মৃতিগুলো জমা হয়ে থাকে। ওখানে আঘাত লাগার ফলে হয়তো তোমার
কিছুটা সময়ের মেমরি মুছে গেছে। এরকম নাকি হয় অনেক সময়ে। সেই স্মৃতি আবার ফিরে আসবে
কিনা তার কোনো স্থিরতা নেই।”
তাহলে কি মণিবক মিত্রের কাছে এটা একটা বিদঘুটে রহস্য হয়েই থেকে যাবে? আর এই অদ্ভুত স্নেক ফোবিয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে চিরটা কাল? কিছুতেই মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছেন না তিনি।
“বাবু, আপনি আমাকে ডাকছিলেন?”
আওয়াজটা কানে যেতে ঘুরে তাকালেন, “হ্যাঁ, বসুন।”
বয়স্ক মানুষটি বসলেন না। দাঁড়িয়েই রইলেন। ম্যানেজার আড়চোখে লক্ষ করছে ওনাকে
দূর থেকে। হয়তো গেস্টদের সামনে দামি সোফায় বসার অনুমতি নেই ওনার। ব্যাপারটা বুঝে
মণিবকবাবু উঠে পড়লেন সোফা ছেড়ে। “চলুন আমরা বাগানে গিয়ে
কথা বলি।”
তিনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আচ্ছা, এখানে তো আপনি অনেক বছর হল কাজ করছেন?”
“জি হুজুর! তিরিশ সাল।”
“আরে আমি হুজুর-টুজুর নয়। আগে তো এটা
একটা গেস্ট হাউস ছিল?”
“হাঁ জি।”
“কী নাম ছিল গেস্ট হাউসটার?”
মাথা চুলকে একটু চিন্তা করে প্রসাদ মালি বললেন, “এ. জি. কর্পোরেশন গেস্ট হাউস।”
“সেটা বিক্রি করে দিয়েছিল?”
“কোম্পানি তো উঠে গেল। তারপর ব্যাঙ্ক থেকে গেস্ট হাউসটা নিলাম করে দেয়। যিনি
কিনেছিলেন কয়েক বছর পরে আবার এই কোম্পানিকে বিক্রি করে দিলেন। এনারা নতুন করে সাজিয়ে
রিসর্ট তৈরি করেন।”
“আপনার চাকরি রয়ে গেল?”
“আমি তো গাছপালা, বাগান নিয়ে থাকি বাবু।
যে পয়সা দেবে তাঁর কাছেই…”
“আচ্ছা, একটা কথা মনে আছে আপনার? প্রায় একুশ বছর আগে ওই গেস্ট হাউসে পাঁচজন লোক এসে উঠেছিল। ওনারা সবাই
কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। মিঃ রামিয়া, কারাণ্ডিকার, সিং, আগরওয়াল আর একটি অল্পবয়সি ছেলে।”
নামগুলো শুনেই প্রসাদ চমকে উঠলেন। “আপনি এদের চিনলেন কী করে?”
“সেটা পরে বলছি, আগে বলুন এদেরকে আপনি
চেনেন কিনা?”
প্রসাদ মাথা নেড়ে জানালেন, “এরা কর্মচারী নন, কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন।”
“তাই নাকি? এবার এই ছবিটা দেখুন ভালো করে।” পকেট থেকে সেই পুরোনো গ্রুপ ছবিটা বের করে প্রসাদের হাতে দিলেন মণিবক মিত্র।
ছবিটা হাতে নিয়ে মোটা কাচের চশমাটা চোখে লাগালেন প্রসাদ মালি। তাঁর চোখগুলো বিস্ফারিত
হল।
“এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন বাবু?”
“ওই মাঝের অল্পবয়সি ছেলেটি ছিলাম আমি।”
কথাটা কানে যেতে অবাক চোখে মণিবকের দিকে তাকালেন প্রসাদ। গলাটা কেঁপে গেল তাঁর, “আপনি বেঁচে আছেন?”
“মানে? আমার কী হয়েছিল?”
একটা গাছের নিচে ধপাস করে বসে পড়লেন প্রসাদ মালি। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, “ওরা সবাই মিলে প্ল্যান করেছিল আপনাকে মেরে ফেলার।”
কথাটা শুনে রীতিমতো অবাক হলেন মণিবকবাবু। “আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিল ওরা? কেন?”
“তা তো বলতে পারব না বাবু। আমি তো সামান্য কর্মচারী। ওনারা ছিলেন আমার মালিক।
তবে…” কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন প্রসাদ
মালি।
“তবে কী?” মণিবকবাবুও প্রসাদের পাশে গাছের নিচে বসে
পড়েছেন ততক্ষণে।
প্রসাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কিছু মনে নেই?”
মণিবক মাথার পিছনে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “না, মাথার পিছনে আমার একটা আঘাত লেগেছিল। ফলে সেই
স্মৃতি মুছে গেছে। কিছুই মনে নেই। আপনিই বলুন কী হয়েছিল?”
প্রসাদ বললেন, “ওই কোম্পানির অফিস ছিল
ভোপালে। আমি যতদূর শুনেছিলাম এই কোম্পানিতে লোকে টাকা জমা রাখত দ্বিগুণ বা চারগুণ
সুদের লোভে। এই চারজন ছিল কোম্পানির পার্টনার। এখানে মাঝে মাঝেই ফুর্তি করতে আসতেন
ওনারা। একদিন বিকালে একটা বড়ো গাড়ি করে আপনাকে নিয়ে ওরা এসেছিলেন এখানে। দু-তিনদিন ধরে খুব হইহুল্লোড় করলেন।
আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল সবার থেকে আলাদা। আগরওয়াল একদিন আমাকে ডেকে বলল, ওই পাহাড়ের মাথায় পোড়ো ভূতুড়ে বাড়িটার কথা আপনাকে বলতে। আমি তাই বলেছিলাম। আপনি হঠাৎ এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলেন ওখানে যাওয়ার
জন্য। আমি অনেক করে বারণ করেছিলাম আপনাকে। আমি জানতাম ওটা বিষধর সাপের আড্ডা, কিন্তু আপনি আমার কথায় কান না দিয়ে
গ্রামের একটি ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন। চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও যখন ফিরে
এলেন না, তখন আমি খোঁজ করে জানলাম বিশু নামে সেই ছেলেটি
দূর থেকে ওই পোড়ো বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। সে কাছে যায়নি। আগরওয়ালদের বললাম
পুলিশকে জানাতে। ওনারা আমার হাতে দশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে পুরো ঘটনাটা চেপে যেতে
বলল। সঙ্গে প্রাণে মারার হুমকিও দিয়েছিল। আমি বউবাচ্চা নিয়ে ঘর করি। ভয় পেয়ে কাউকে
কিছু জানাইনি। তারপরে ওনারা গেস্ট হাউস ছেড়ে চলে গেলেন। আর কোনোদিন ফিরে আসেননি।”
“আচ্ছা!” একটা অস্ফুট অভিব্যক্তি বের হল মণিবক মিত্রের
মুখ দিয়ে। সেই মুহূর্তে আর কিছুই বলতে পারলেন না তিনি। নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ
করে দিলেন।
সন্ধের সময় রিসেপশন থেকে ফোন করে জানাল একটা ছেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
ছেলেটাকে ঘরেই পাঠিয়ে দিতে বললেন মণিবকবাবু। দরজা খুলে দেখলেন পেটানো চেহারার এক
যুবক দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামলা গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল, সপ্রতিভ চোখ। ছেলেটা
হিন্দিতে বলল, “নমস্কার, আমি বিশ্বনাথ মান্টি। ডাক্তারবাবু পাঠালেন
আপনার কাছে।”
“এসো, বোসো।”
চেয়ারে বসতে দিয়ে মণিবকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কাজটা কী তোমাকে বলেছেন ডঃ শর্মা?”
সে মাথা নেড়ে জানাল, “হ্যাঁ, আমি আপনাকে পাহাড়ের মাথায় ওই পোড়ো বাড়িতে নিয়ে যাব। আগের বারের মতো মাঝ
রাস্তায় ছেড়ে দেব না।”
ছেলেটার কথা শুনে চমকে উঠে মণিবকবাবু বললেন, “মানে আগের বারে তুমিই গিয়েছিলে আমার সঙ্গে? তোমার ডাক নাম বিশু?”
“হ্যাঁ, আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে। আর দু’দিন পরে আপনাকে আহত অবস্থায় পাহাড়ের
পিছনে ঝরনার ধার থেকে আমি উদ্ধার করেছিলাম। তারপর গ্রামের লোকেদের সঙ্গে সাতপুরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম
ডাক্তারবাবুর কাছে।”
“তার মানে তোমার জন্যই আমি প্রাণ ফিরে পেয়েছি। থ্যাঙ্ক ইউ। এত বছর পরে তোমাকে
ধন্যবাদ জানাতে পেরে খুব ভালো লাগছে।”
“কিন্তু আবার আপনি ওই পোড়ো বাড়িতে যেতে চাইছেন কেন?”
মণিবক মিত্র বললেন, “কিছু রহস্য এখনও
রয়ে গেছে ওখানে। আর একবার যাওয়া দরকার। তোমার যথাযথ পারিশ্রমিক তুমি পাবে।
কার্বলিক অ্যাসিড আর নুনের বস্তা নিতে ভুলো না।”
বিশু মাথা নেড়ে জানাল, “কালকে সকাল ছ’টা, গেটের বাইরে অপেক্ষা করব আমি।”
পরেরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে গেল মণিবকবাবুর। ফ্রেশ হয়ে বেড টি খেয়ে
বেরিয়ে পড়লেন। যথারীতি গেটের বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিশু। বাইকের পিছনে বসে
কিছুটা রাস্তা গেলেন। জঙ্গলের পাশে একটা গাছের নিচে বাইকটা রেখে শুরু হল হাঁটা।
সামনে বিশু হাতে একটা লম্বা ধারালো ড্যাগার নিয়ে হাঁটছে। সেটার এক কোপে পরিষ্কার
হয়ে যাচ্ছে ঝোপঝাড়। কোমরে নুনের বস্তা। ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। বর্ষাকালে জোঁকের খুব
উপদ্রব। টুপ করে গাছের উপর থেকে
কিংবা ঝোপের ভিতর থেকে জামার মধ্যে ঢুকে গিয়ে নিঃসাড়ে রক্ত চুষে নেয় ওরা। নুনে
একমাত্র জব্দ। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন পাখির ডাক। তার সঙ্গে অনবরত বনজ
পোকার শব্দ কানে আসছে। কিটকিট কিটকিট… রিরিরিরি… আকাশে আজও কালো মেঘ। দৈবাৎ মেঘ ফুটো করে
সূর্যের আলো এসে পৌঁছোচ্ছে সবুজ গাছেদের ভিড়ে। সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য। মণিবকবাবু
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন বার বার সে দিকে তাকিয়ে। বিশু তাড়া দিচ্ছে, “চলুন, দাঁড়াবেন না।” জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাকদণ্ডি পথ নেমে গেছে অনেকটা। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর
সামনে একটু ফাঁকা জায়গা দেখতে পেলেন মণিবকবাবু। ছোটো ছোটো পাথর আর নুড়ি বিছানো
প্রান্তরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে একটা জলের স্রোত। বর্ষার ঘোলাটে জল নামছে পাহাড়ের
উপর থেকে। জায়গাটা দুটো পাহাড়ের মাঝে নিম্নভূমি। একটা বড়ো পাথরের উপরে বসে দম
নিচ্ছিলেন মণিবক মিত্র।
বিশু কাছে এসে বলল, “চলুন স্যার। এই
জল পেরিয়ে ওই পাহাড়ের উপরে উঠতে হবে।”
মণিবকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আগের বারেও
কি এই রাস্তাতে এনেছিলে?”
“না স্যার, কুড়ি বছর আগের সেই রাস্তা তো এখন আর নেই। বহু
বছরের পুরোনো একটা সাঁকো ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।
তাই একটু ঘুরে যেতে হচ্ছে।” একটু থেমে বিশু
আবার বলল, “আকাশের দিকটা দেখেছেন স্যার?”
উপরের দিকে তাকালেন মণিবকবাবু। মেঘ ক্রমশ ঘন হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। বড়ো করে শ্বাস নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন
তিনি। তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে হবে উপরে। এতদূর এসে পিছনে ফিরে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। পাহাড়ের ঢালে নামার থেকে ওঠা ঢের বেশি কঠিন।
আরও ঘণ্টা দেড়েকের চেষ্টায় বন-বাদাড় পেরিয়ে দু’জনে শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলেন সেই
পাহাড়ের মাথায়। উপর থেকে দিগন্তবিস্তৃত ঢেউখেলানো বনভূমি চোখে পড়ল। দূর থেকেই দেখা
যাচ্ছিল সেই পোড়ো বাড়িটা। অজস্র আগাছা আর লতাপাতা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে
ভেঙে ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া বাড়িটাকে। বড়ো ড্যাগার দিয়ে জঙ্গল কেটে কিছুটা যাওয়ার মতো
রাস্তা করে দিল বিশু। মণিবকবাবু বাড়িটার সিংহদুয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিশু
চারিদিকে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিতে তীব্র ঝাঁঝালো একটা গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে।
রুমালে নাক ঢেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পুরোনো স্মৃতি হাতড়ানোর
চেষ্টা করছিলেন। মনে হল এই বাড়ি যেন তাঁর কত জন্মের চেনা!
হঠাৎ মেঘের বজ্রগম্ভীর আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে তাকালেন মণিবকবাবু। কালো
মেঘেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিদ্যুতের রেখা ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে কানফাটা
শব্দের সঙ্গে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আকাশ ভেঙে নেমে আসতে শুরু করল বড়ো বড়ো জলের
ফোঁটা।
বিশু চেঁচিয়ে বলল, “আসুন স্যার, ভিতরে একটা মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজতে হবে। রেনকোট বা ছাতায় এ বৃষ্টি আটকাবে
বলে মনে হয় না।”
কথাটা ঠিক। দু’জনে দৌড়ে গিয়ে কোনোমতে ঢুকে পড়লেন বাড়িটার ভিতরে। ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের নোনা ধরা
সিঁড়ি। তার উপর সবুজ শ্যাওলা আর ফার্ন গাছের প্রলেপ। তার উপর বছরের পর বছর জমা
হওয়া পচা পাতার স্তর। বট অশ্বত্থ আর আগাছাদের ঝুরি নেমে জালের মতো আঁকড়ে ধরেছে
পাথরের দেয়াল আর পিলারগুলোকে। সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকে ফাঁকা জায়গার মাঝখানে একটা গোল
বেদি। মনে হয় সেখানে আগে একটা
মূর্তি ছিল। এখন একটা কালো মৃত শুকনো গাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে
একটা গভীর কুয়া। ওনারা এক কোণে দালানে উঠে দাঁড়ালেন। পাশেই সার দিয়ে বড়ো বড়ো
অন্ধকার ঘর। দরজা জানালা নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো সব বন্যজন্তুদের দখলে।
মণিবকবাবু জানতে চাইলেন, “পাহাড়ের মাথায়
এরকম দুর্গম জায়গাতে কে এত বড়ো বাড়ি বানাল?”
“শুনেছিলাম এটা দুর্গ ছিল। কোনো এক সময়ে শিবাজির এক নায়েব থাকত এখানে। পরে দুর্গটা মারাঠা অধিপতি রঘু্জিরাজ ভোঁসলের
অধীনে যায়। তার হাত থেকে দুর্গ দখল করেন গোন্ডদের রাজা ভগবত সিং। তারপর ১৮৫৭-তে সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে তারা ইংরেজ
সৈন্যর কাছে হেরে যায়। ক্যাপটেন জেমস ফোরসেথ এই দুর্গ দখল করে সুবেদার নাথু রামজি
পাওয়ারকে এই অঞ্চলের শাসনভার দেন। কিন্তু তিনিও অপঘাতে মারা যান। ধীরে ধীরে এই
জায়গাটা জনশূন্য হয়ে পরিত্যক্ত হয়।”
মণিবকবাবু বিশুর কথা শুনে মন্তব্য করলেন, “বাপ রে! তুমি তো দেখছি সব মুখস্থ করে এসেছ!”
সে হেসে জানাল, “না স্যার, হিস্ট্রি তো আমার সাবজেক্ট। আমি তো স্কুলে পড়াই।”
“বলো কী হে! ডাক্তারবাবু তো বলেননি যে, আমার সঙ্গে একজন শিক্ষক যাবেন।”
“আমার সবটাই তো ওনার থেকে পাওয়া। উনি না থাকলে আমি হয়তো জঙ্গলে কাঠ কেটে খেতাম। তা আপনি বার বার এই পু্রোনো দুর্গে কী খুঁজতে
আসছেন? কোনো গুপ্তধনের ব্যাপার আছে নাকি?”
মণিবকবাবু পিঠের ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বার করে দু’ঢোঁক জল গলায় ঢেলে হেসে বললেন, “গুপ্তধন নয় হে! তবে গুপ্তস্বপ্ন বলতে
পারো। আগের বারে আমি যে এখানে এসেছিলাম সেটা বেমালুম ভুলে গেছি। তার কারণ অবশ্য
মাথার পিছনে একটা চোট। কিন্তু একটা স্বপ্ন গত ছ-মাস ধরে আমাকে খুব বিরক্ত করছে।
কালো সাপের স্বপ্ন। আর অদ্ভুত একটা মায়াবী জগৎ। কুয়াশার মধ্যে এক স্বপ্নচারিণী
বারবার এসে আমাকে ওই বিষধর সাপেদের হাত থেকে বাঁচায়।”
বিশু বলল, “বিষধর সাপের কথা বলতে মনে পড়ল, এ অঞ্চলে শঙ্খচূড়, কালাচ, গোখরো বা চন্দ্রবোড়া সবই দেখা যায়। তবে আপনি যে ধরনের কালো সাপের বর্ণনা
দিচ্ছেন তাতে কালাচ মানে ক্রেইতের কথাই মনে হয়। এরা একসঙ্গে দল বেঁধেও থাকে। অন্য বিষধর সাপেরা সেটা করে না।”
মণিবকবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, “আগের বারে আমি
যখন এসেছিলাম, এখানে কিছু একটা হয়েছিল।”
“কী হয়েছিল?”
মণিবকবাবু চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করলেন, “কেউ বা কারা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল।”
বিশু জানতে চাইল, “হঠাৎ এরকম মনে হল কেন? আপনাকে মেরে ফেলে কার লাভ হত।”
“ঘুমের মধ্যে আমরা যে স্বপ্ন দেখি, তার সবটাই যে মনে থাকে এমনটা নয়। যেগুলো মনে থাকে না, সেগুলোও যে মাথা থেকে একদম মুছে যায়, তাও নয়। আমার মনে হচ্ছে আগের বারেও এরকম ভারী বৃষ্টির মধ্যে আটকে পড়েছিলাম এই
পোড়ো দুর্গে। তারপর কিছু একটা ঘটেছিল। মেরে ফেলার কারণটা এত দিন বুঝে উঠতে পারিনি।
কিন্তু কালকে রিসর্টের পু্রোনো মালি প্রসাদের সঙ্গে কথা বলে একটা আন্দাজ পেলাম।
চলো একবার ভিতরটা ঘুরে দেখি।” বলে ব্যাগ থেকে
টর্চ বের করে জ্বাললেন মণিবকবাবু। এক পা এক পা করে এগোলেন বাড়ির ভিতর দিকে। বিশু
পিঠের বড়ো ব্যাগটা খুলে রেখে সাবধানে পা ফেলে মণিবকবাবুকে অনুসরণ করল। বাইরে
বৃষ্টির শব্দ। ভিতরে ঝিঁঝিঁর ডাক। এক একটা ঘরে ঢুকে ঘুরে দেখছেন ওনারা। বেশিরভাগ
ঘরই ফাঁকা। বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের মল, বিষ্ঠার গন্ধ। কড়িবর্গা থেকে কয়েকটা বাদুড়ও ঝুলতে দেখা গেল। সাপের খোলস। বিশু জানাল, “এ ক্রেইতের খোলস। সাবধানে চারিদিকে চোখ রেখে পা ফেলবেন।” মণিবকবাবু মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত সাহস পাচ্ছেন এখন। স্বপ্নের মধ্যে সাপকে
যতটা ভয় লাগত, আজকে সাপের শয়নকক্ষে ঢুকে সেই ভয় কেটে গেছে।
বিশু মাঝে মাঝেই পা দিয়ে পাথরের মেঝেতে ঠোকা দিচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে নিচের তলার
সব ক’টা ঘর ঘোরাঘুরি করে
কিছুই তেমন খুঁজে পেলেন না ওনারা। বাড়ির পিছন দিকে নিচে নামার একটা সিঁড়ি আছে। টর্চ ফেলে বোঝার চেষ্টা করলেন, সরু খাড়াই সিঁড়িটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গেছে? উঁকিঝুঁকি মেরেও খুব
একটা লাভ
হল না। মণিবকবাবু বললেন, “চলো নিচেটা একবার দেখেই আসি।”
একটু থতোমতো খেয়ে বিশু বলল, “যদি কোনো বিপদ হয়?”
“এত বিপদের ভয় করলে আর রহস্য উদ্ধার হবে না ছোকরা।” কথাটা বলে মণিবক মিত্র আগে পা বাড়ালেন সিঁড়িতে। অন্ধকারের মধ্যে দশ-বারোটা ধাপ নামার পর একটা বাঁক নিল।
আরও কিছু ধাপ পেরিয়ে ওনারা পৌঁছোলেন মাটির নিচে একটা বড়ো ঘরে। টর্চের আলোয় দেখা
গেল সে ঘরটিও প্রায় ফাঁকা। শুধু সিঁড়ির উলটো দিকে প্রায় তিরিশ মিটার দূরে মেঝেতে
সাদা সাদা কাঠের ডালপালার মতো কিছু পড়ে আছে।
“কী ওগুলো?”
এবার বিশু সামনে এগোল। মণিবকবাবু পিছনে। একটু কাছে গিয়ে দু’জনেই থমকে দাঁড়ালেন। চোখগুলো বড়ো বড়ো
হয়ে গেল। সামনে পড়ে আছে চারটে পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল। মণিবকবাবু টর্চের আলোয়
খুঁটিয়ে দেখলেন কঙ্কালগুলো। জীর্ণ পোশাকের নিচে যে লোকগুলো শুয়ে আছে তারাই কি একুশ
বছর আগের এ. জি. কর্পোরেশনের ডিরেক্টর রামিয়া, কারাণ্ডিকার, সিং আর আগরওয়াল? সেরকমই তো মনে হচ্ছে।
কিন্তু এরা কী করে মারা গেল এখানে? সাপের কামড়ে, না অন্য কিছু? আশেপাশে খুঁজে একটা
অক্ষত অ্যাটাচি পেলেন মণিবকবাবু। মোটা প্লাস্টিকের অ্যাটাচির কবজাগুলোতে জং ধরেছে।
কিন্তু জিনিসটা এখনও অক্ষত আছে। সেটাকে চাগাতে গিয়ে দেখলেন বেশ ভারী। বিশুকে ইশারা করতে সে বলল, “অ্যাটাচিটাকে চাগিয়ে উপরে নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর হবে। উপরে আমার পিঠে ব্যাগে
এক গোছা নাইলনের দড়ি আছে। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”
মণিবকবাবু মাথা নাড়তে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল বিশু। কিছুক্ষণের জন্য মণিবক
মিত্র একা হয়ে পড়লেন সেখানে। উপরে সিঁড়ির ঘর থেকে আলো আসছে আবছা। গা-টা কীরকম ছমছম
করে উঠল মণিবকবাবুর। থমথমে পরিবেশের মধ্যে মনে হল তাঁর ঘাড়ের কাছে কেউ যেন
নিঃশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ রাশি রাশি সাদা ধোঁয়া এসে হাজির হল। একটা আবছা ছায়ামূর্তি
যেন সরে গেল সিঁড়ির মুখ থেকে। বুকটা ধড়াস করে উঠল তাঁর। ব্যপারটা কী হল! ওঁরা দু’জন ছাড়া আরও কি কেউ আছে
এখানে? মণিবকবাবু গলা ছেড়ে ডাকলেন, “কে উপরে? বিশু নাকি?”
কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দিল না। বেশ অবাক হলেন তিনি। স্পষ্ট দেখলেন একটা মানুষের
লম্বা ছায়া সরে গেল। তারপর কতক্ষণ তিনি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন জানেন না। যেন
মনে হচ্ছে সময়টা আর কাটতে চাইছে না। মিষ্টি ফুলের গন্ধ, দূর থেকে আসা নূপুরের শব্দ! মাথাটা ঝিমঝিম করছে তাঁর। ধপাস করে বসে পড়লেন পাথরের সিঁড়ির এক কোণে।
“চলুন স্যার। অ্যাটাচিটা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছি। আমি উপর থেকে টানব। আর আপনি একটু
ঠেলে দেবেন।”
নড়ে উঠলেন বিশুর কথা শুনে। অ্যাটাচিটা উঠে এল উপরে। বারান্দায় টেনে এনে পাথরের
মেঝেতে রেখে ড্যাগার দিয়ে জোরে চাপ দিতে খুলে গেল সেটা। ভিতরের জিনিস দেখে দু’জনেরই চক্ষু ছানাবড়া! পুরোনো পাঁচশো আর হাজার টাকার তাড়া তাড়া নোট। সঙ্গে সোনার বার। ওই জন্যই এত ভারী
লাগছিল এটাকে।
“এ তো অনেক টাকা!” বিশুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
মণিবকবাবু বললেন, “হ্যাঁ, তবে টাকাগুলো এখন অচল। সোনাগুলো হয়তো কাজে লাগবে। আরও কিছু কাগজপত্র আছে।”
একটা বন্ড পেপার হাতে নিয়ে দেখলেন উপরে লেখা আছে ‘এ. জি. কর্পোরেশন প্রাইভেট লিমটেড’। তার মানে মৃতদেহগুলো সত্যিই ওই চারজনের। ওনারা
কীভাবে মারা গেলেন, একমাত্র ফরেনসিক টেস্টে
ধরা পড়তে পারে।
বিশু জানতে চাইল, “কিন্তু এগুলো এখানে এল
কীভাবে?”
মণিবকবাবু মাথা নেড়ে মন্তব্য করলেন, “এ কথার কোনো সঠিক উত্তর এত দিন পরে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।”
পাথরের মেঝেতে বসে পড়েছিলেন ক্লান্ত মণিবক মিত্র। কিছুতেই মনে করতে পারছেন না
কী হয়েছিল কুড়ি বছর আগে। আর কিছুক্ষণ আগে নিচের ঘরে ওই অদ্ভুত অনুভূতিটার কোনো
ব্যাখ্যা তিনি পাচ্ছেন না। এটাও কি তাঁর মনের ভুল? তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। বৃষ্টির প্রবল তোড়ে মনে হচ্ছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে
পুরো এলাকাটাকে। হঠাৎ কানফাটা শব্দে একটা বজ্রপাত হল খুব কাছে। আওয়াজ আর আলোর
তীব্রতায় চমকে উঠলেন দু’জনে। থরথর করে কেঁপে উঠল ভগ্নপ্রায় দুর্গের পাথরগুলো। উলটো দিকে কিছুটা অংশ
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। সামনেই মৃত গাছটাতে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে সেটা।
তারপরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। চারিদিকে পাথরের ফাঁকফোঁকর দিয়ে হিলহিল করে কালো
কালো সাপ বেরিয়ে আসতে লাগল। ছোটো বড়ো মাঝারি অগুনতি সাপ। যে যেদিকে পারছে ছুটছে।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে কার্বলিক অ্যাসিড বের করে ছড়িয়ে দিল ওদের চারপাশে।
ফলে সাপেরা এই দিকে আর এল না। সাপগুলো এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল সেই গোল বেদিটার দিকে।
বেদিটার কোল দিয়ে ওরা ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। মুষলধারার বৃষ্টিতে আগুন বেশিক্ষণ জ্বলল
না অবশ্য। ধোঁয়ায় ভরে গেল জায়গাটা।
আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে বৃষ্টি কমে এল ধীরে ধীরে।
মণিবকবাবুকে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে বিশু গায়ে হাত দিয়ে নাড়া
দিল। “স্যার, ঠিক আছেন আপনি?”
বজ্রপাতের তীব্রতায় মাথা ভোম হয়ে গিয়েছিল মণিবকবাবুর। বিশুর কথা শুনে সংবিৎ
ফিরল। বললেন, “হ্যাঁ, বৃষ্টি কমেছে? চলো এবার ফেরা যাক। অ্যাটাচিটা
সঙ্গে নিতে পারবে? পুলিশের কাছে জমা দিতে
হবে। ওর মধ্যে অনেক এভিডেন্স আছে।”
গাছের ডালপালা খামচে ধরে হাঁচোড়পাঁচোড় করে পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে ফাঁকা
জায়াগাতে সেই জলের রেখার সামনে এসে আঁতকে উঠল দু’জনে। সরু জলের স্রোতের চেহারাটা এখন ভয়ংকর হয়ে
গেছে। সে যেন রাগে ফুঁসছে। ভারী বৃষ্টির পরে পাহাড়ের জল নামছে তীব্র গতিতে। মণিবকবাবু
অস্ফুট স্বরে বললেন, “সব মনে পড়ে গেছে বিশু।
ছবির মতো সব মনে করতে পারছি আমি।”
“বাহ! এ তো মিরাকেল।”
তিনি বলে চললেন, “এ. জি. কর্পোরেশন ছিল ভোপালের একটা নাম করা চিট ফান্ড
সংস্থা। এরা শিক্ষিত ছেলেদের অন্য শহর থেকে মোটা টাকা মাইনের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসত।
আমার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল কলকাতায়। তারপর আমি ভোপালের অফিসে জয়েন করি। সাধারণ
মানুষের টাকা আত্মসাৎ করে এরা দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। আমি প্ল্যানটা ধরে
ফেলেছিলাম। ওরা আমাকেও দলে টানার চেষ্টা করেছিল। প্রচুর টাকার অফার দেয় আমাকে।
কিন্তু গরিব মানুষের টাকা চুরি করে বড়োলোক হওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। তখন আমাকে
রাস্তা থেকে সরানোর জন্য পাঁচমাড়িতে নিয়ে এল। এই পোড়ো দুর্গের কাহিনি স্থানীয়রা
সবাই জানে। ওরা শুনেছিল যারা ওই দুর্গে গেছে, আর জীবিত ফেরেনি। ভেবেছিল আমাকে একবার ওখানে
পাঠাতে পারলে সাপের কামড়ে মৃত্যু নিশ্চিত। তারপর রটিয়ে দিত, সব টাকা চুরি করে আমি পালিয়ে গেছি।”
মণিবকবাবু চুপ করে যেতে বিশু অধৈর্য হয়ে উঠল, “তারপর?”
“আমি একদিন পরেও যখন ফিরলাম না, এরা কনফার্ম হওয়ার জন্য নিজেরাই গিয়ে হাজির হল পুরোনো দুর্গে। এদিকে শ্যাওলায়
পা পিছলে আমি পড়ে গিয়েছিলাম ওই কুয়ার মধ্যে। মাথার পিছনে আঘাত লাগায় জ্ঞান হারিয়েছিলাম
আমি।”
বিশু জানতে চাইল, “কিন্তু সেখান থেকে আপনি পাহাড়ের নিচে ঝরনার কাছে কীভাবে পৌঁছোলেন?”
মণিবকবাবু বললেন, “হয়তো কুয়ার মধ্য দিয়ে কোনো
গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে ঝরনা পর্যন্ত। আগেকার দিনে দুর্গ থেকে লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য
এরকম রাস্তা থাকত।”
“তার মানে, ওরা আপনাকে খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই কি সাপের কামড়ে
মারা পড়েছে?”
“কালাচ বা ক্রেইতের একটা ছোবলই যথেষ্ট যে কোনো মানুষের পঞ্চত্বপ্রাপ্তির জন্য।
আর এখানে শয়ে শয়ে সাপের বাসা।”
বিশু মাথা নেড়ে বলল, “তা ঠিক। শুধু
আপনাকেই ওরা কেউ কিছু করল না! এটা ভারী আশ্চর্য!”
কথাটা শুনে চুপ করে গেলেন মণিবকবাবু। মাঝে মাঝেই নিজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলেন
তিনি। কিছুক্ষণ আগে দেখা দুর্গের নিচের ঘরে সেই ছায়ামূর্তিটা ভেসে উঠল চোখের
সামনে। কে এই কমলিলতা? সে কি শুধুই তার কল্পনা? নাকি পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি? এ প্রশ্নের উত্তর
কি তিনি পাবেন কোনোদিন?
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল বিশু, “ওই দেখুন স্যার, এক দল বেদে আসছে এদিকে। নদী পেরোনোর ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”
----------
ছবি - লেখক
No comments:
Post a Comment