গল্প:: চকোলেট নিখোঁজ - অনন্যা দাশ


চকোলেট নিখোঁজ
অনন্যা দাশ

()

বিগলার্সভিলের শপিং মলে সুলেখাদির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে রিয়ার খুব আনন্দ হল রিয়ারা যখন পাটনায় থাকত তখন সুলেখাদিরা ওদের প্রতিবেশী ছিলেন সুলেখাদি রিয়ার চেয়ে কিছুটা বড়ো, কিন্তু ছোটোবেলায় সুলেখাদির সঙ্গে অনেক খেলা করেছিল রিয়া টিচার টিচার খেলা, রান্নাবাটি, পুতুল বিয়ে আরও কত কী চিনতে পারার পর্বের পর সুলেখাদি বললেন, “কী যে ভালো লাগছে তোকে দেখে রিয়া একদিন আয় না আমাদের বাড়িতে মিহির আর আরিয়ার সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যাবে আচ্ছা, আগামী শুক্রবার কী করছিস? ফ্রি থাকলে বিকেলে চলে আয় বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না, কিন্তু আলাপটা হয়ে যাবে
রিয়া বলল, “হ্যাঁ, শুক্রবার ফ্রি আছি শনি রবি প্ল্যান আছে তবে শুক্রবার ফ্রি আর রান্নার কথা ভেবো না কেউ রেঁধে খাওয়ালেই আমি খুশি, তার মানে আমাকে তো রাঁধতে হল না
হ্যাঁ, শনিবার রবিবার সবারই কিছু না কিছু প্ল্যান থাকে, তাই শুক্রবার বললাম
তা তোমার মেয়ের বয়স কত?”
এই সবে সাতে পড়ল প্রচণ্ড পাকা, সব সময় বক বক করেই চলেছে কানের মাথা খেয়ে ফেলে তুই এলে দেখতে পাবি
বাহ, খুব মজা হবে ঠিক আছে শুক্রবার দেখা হবে তোমার নম্বরটা দিয়ে দাও আর পরে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিও
সুলেখাদি বুধবার দিন ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে দেখা হবে ইত্যাদি লিখে, তাই রিয়া শুক্রবার দিন কাজের পর ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হল সুলেখাদিদের বাড়িটা খুব সুন্দর সিঙ্গেল ফ্যামিলি হোম সুলেখাদি আর ওঁর স্বামী মিহিরদা দুজনেই দুটো কোম্পানিতে বড়ো পোস্টে চাকরি করেন তাই ওঁদের অবস্থা বেশ ভালো বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো তবে ওদের সাত বছরের কন্যা আরিয়ার সঙ্গে আলাপ করে রিয়ার খুব ভালো লাগল সে ভালোই বাংলা বলে রিয়ার সঙ্গে তার এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে সে তার যাবতীয় খেলনা রিয়াকে দেখাতে চায় নিজের দোতলার ঘর থেকে একের পর এক খেলনা নিয়ে এসে একতলার বাইরের ঘরে জড়ো করছে দেখে সুলেখাদি বললেন, “আরিয়া, এখানে সব খেলনা না এনে রিয়ামাসিকে তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে সব দেখাও আমি ততক্ষণ খাবারগুলোকে গরম করি মিহির একটা কাজে বেরিয়েছে একটু পরেই ফিরে আসবে
আরিয়া তাই শুনে খুব খুশি হয়ে বলল, “আমাদের নামটাও একই রকম তাই না? তুমি রিয়া আর আমি আরিয়া!”
আরিয়ার ঘরটাও খুব সুন্দর দেয়ালে গোলাপি রং ডিজনি রাজকন্যাদের বড়ো বড়ো স্টিকার পোস্টার ইত্যাদি লাগানো বিছানার চাদরে আর বালিশে অবশ্য সব কুকুরের ছবি আরিয়া তার খেলনা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল
কিছুক্ষণ পরই সুলেখাদি এসে বললেন, “চলো দুজনে খেতে চলো এবার আমার সব গরম করা হয়ে গেছে আর মিহিরও ফিরে এসেছে
সুলেখাদি মাটন বিরিয়ানি, চিকেন কারি আর স্যালাড করেছিলেন, বললেন, “অফিস থেকে এসে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারি না!”
রিয়া বলল, “দারুণ হয়েছে তোমার বিরিয়ানি অসাধারণ এখানকার দোকানের বিরিয়ানি আমার একদম ভালো লাগে না সব তেল আর ঝালে ভরতি!”
খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল মিহিরদা রিয়ার গোয়েন্দাগিরির কথা শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, “বাবা! তুমি তো দারুণ কাজ করেছ! প্রচণ্ড বুদ্ধির ব্যাপার তো
রিয়া বলল, “যত না বুদ্ধি তার থেকে বেশি লাক নিউ চেরিভেলের পুলিশ প্রধানের মেয়ে আমার সঙ্গে একই ল্যাবে কাজ করে সেই সূত্রে আমি অনেক কিছুই বাড়তি জানতে পারি, তাতেই প্রচুর সুবিধা হয়
কথা বলতে বলতে ওরা কেউ খেয়ালই করেনি যে আরিয়া মন দিয়ে ওদের কথা শুনছে সে এবার খাওয়া থামিয়ে দিয়ে রিয়াকে বলল, “তুমি গোয়েন্দা? গোয়েন্দা মানে তো ডিটেকটিভ, তাই না? তুমি তাহলে আমার চকোলেটকে খুঁজে দাও!”
রিয়া তাই শুনে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ বাবা চকোলেট হারিয়ে গেলে তো খোঁজা মুশকিল এতক্ষণে নিশ্চয়ই কেউ খেয়ে ফেলেছে!”
সুলেখাদি বললেন, “না, না, খাবার চকোলেটের কথা বলছে না…”
আরিয়া বলল, “চকোলেট আমার পাপি চকোলেট হারিয়ে গেছে!”
সুলেখাদি এবার ওকে ধমক দিয়ে বললেন, “আরিয়া তুমি খাও বাবা বলেছেন না তোমাকে আরেকটা কুকুরছানা কিনে দেবেন
আরিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমার আরেকটা কুকুরছানা চাই না আমার চকোলেটকেই চাই!”
কোনোরকমে কথা অন্য দিকে ঘোরানো হল তাও সে কিছুতেই শুনবে না ঘুমোতে যাওয়ার আগেও রিয়াকে বলে গেল,তোমার ক্লু লাগলে আমাকে বোলো আমার কাছে অনেক ক্লু আছে মিস্টির মতন আমিও ক্লু খুঁজে বার করেছি
সুলেখাদি বুঝিয়ে বললেন, “‘মিস্টি দা মিস্ট্রি সলভারবলে একটা ছোটোদের গল্পের সিরিজ পড়ছে এখন তাতে মিস্টি বলে মেয়েটা ক্লু খুঁজে খুঁজে সব রহস্যের সমাধান করে ফেলে সেই থেকেই ওর মাথায় ক্লু ঢুকেছে!”
আরিয়া টা নাগাদই ঘুমিয়ে পড়ল সুলেখাদি বললেন, “স্কুলের বাস খুব সকালে আসে, তাই ওকে তাড়াতাড়ি শোওয়ার অভ্যেস করিয়েছি নাহলে সকালে উঠতে খুব ঝামেলা হয় উইক-এন্ডেও একই রকম রাখার চেষ্টা করি
সে ঘুমিয়ে পড়ার পর রিয়া আবার চকোলেটের কথাটা পাড়ল
পাপির প্রশ্নের উত্তরে সুলেখাদি বললেন, “আর বলিস না আরিয়া পাপি পাপি করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল ওর প্রিয় বন্ধু রেচেলের পাপি আছে, তাই ওরও চাই তা আমরা পছন্দ করে একটা পুঁচকে ইয়র্কি মানে ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার নিয়ে এলাম খয়েরি রং দেখে ওর নাম রাখা হল চকোলেট আরিয়াই নামটা পছন্দ করল ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিল কুকুরছানাটাকে আর সেও ভীষণ মিষ্টি ওমা এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ সে হাওয়া! কোথায় গেল কিছুই বোঝা গেল না তিনটে নাগাদ আরিয়ার বাস আসে এখন আমাদের দুজনকেই দু-তিনদিন করে অফিসে যেতে হয় সেই কোভিডের সময়কার পুরোপুরি ওয়ার্ক ফ্রম হোম আর নেই যেদিন আমরা দুজনেই যাই সেদিন মিসেস বেল আসেন আরিয়াকে বাসস্টপ থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন ওর সঙ্গে থাকেন আমরা না আসা পর্যন্ত সেদিন উনি আর আরিয়া বাড়ি ফিরে দেখেন চকোলেট হাওয়া আরিয়া তো কেঁদে কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছিল নিজের কিছু খায়নি, জ্বর এসে গিয়েছিল
মিহিরদা বললেন, “আমি আরেকটা কুকুরছানা এনে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শুনবে না ওর চকোলেটকেই চাই!”
সুলেখাদি আবার বললেন, “ তো বাড়ির ভিতরই থাকত, সেখান থেকে কে ওকে নিল সেটাই আশ্চর্য এখানে ওরা চিপ বসিয়ে দেয় যাতে কুকুর হারালে ট্র্যাক করা যায় আমরাও সেটা করাব ভেবেছিলাম, কিন্তু হয়ে ওঠেনি সেটা হলে খুব সুবিধা হত
তোমরা পুলিশে খবর দাওনি?”
হ্যাঁ, দিয়েছিলাম ওরা কিছু বার করতে পারেনি কোনো তালা ভাঙা না কিছু না কিন্তু কুকুরছানা হাওয়া পাড়া প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করছিল, এদিক ওদিক খুঁজে দেখেছিল গাড়ি চাপা পড়েছে কিনা, কিন্তু দরজা তো বন্ধ ছিল, সে পালাবে কী করে?”
রিয়া এবার জিজ্ঞেস করল, “কতদিন হয়েছে ঘটনাটার?”
এই তো আজ তিন সপ্তাহ হবে খুব বেশিদিন হয়নি তো, তাই ক্ষতটা এখনও শুকায়নি আমাদের এত মিষ্টি ছিল
তোমাদের বাড়ির চাবি আর কার কার কাছে আছে?”
বাবা, তুই সত্যিই গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিলি নাকি?” সুলেখাদি বললেন আর মিহিরদা লাফিয়ে উঠে বললেন, “তুমি কী মনে করবে, তাই আমি কিছু বলছিলাম না, কিন্তু তুমি যদি একটু চেষ্টা করো তাহলে দারুণ হয় মনটা খুব খুঁতখুঁত করে এত মিষ্টি কুকুরছানাটা ছিল কী ভুল হল আমাদের বুঝতে পারি না
রিয়া হেসে বলল, “হ্যাঁ, ওই চেষ্টাটাই করতে পারি ওকে খুঁজে পাব কিনা জানি না
সুলেখাদি খুব গদগদ হয়ে বললেন, “তুই যে চেষ্টা করবি সেটাই অনেক রে আমাদের চাবি একটা মিসেস বেলকে দেওয়া হয়েছে, একটা পাশের বাড়ির মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আর্মিটেজকে যদি মিসেস বেল চাবি ভুলে যান সেই মনে করে, একটা যে বাড়ি পরিষ্কার করে সেই কেলি বলে মেয়েটা, একটা আমার আর একটা তোর মিহিরদার ব্যস এই
মিহিরদা বলে উঠলেন, “তুমি শিশিরের কথাটা বেমালুম ভুলে গেলে দেখছি
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শিশির আমার দেওর সে ফিলাডেলফিয়াতে থাকে তাকেও একটা চাবি দেওয়া আছে সে মাঝে মাঝে রাত তিনটের সময় এসে হাজির হয় তখন যাতে আমাদের উঠে না দরজা খুলতে হয় তাই তবে সে কুকুরকে দেখেনি সে এখন কলকাতায় এক মাসের জন্যে গেছে সামনের সোমবার ফিরবে
আচ্ছা তাহলে তো তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে,” রিয়া হেসে বলল
মিসেস বেল কতদিন কাজ করছেন? কী রকম বয়স?”
উনি প্রথম ২০১৯- আসেন তারপর প্যানডেমিক শুরু হয় সেই সময় কিছুদিন আসেননি, কারণ স্কুল তো ভার্চুয়াল ছিল আর আমরাও বাড়িতেই থাকতাম তারপর স্কুল খুলতে আবার আসা শুরু করেন খুব ভালো রেফারেন্স ছিল বয়স পঞ্চান্ন-ষাট হবে স্বামী অনেকদিন আগেই মৃত একটা ছেলে ছিল, সেও একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় ছেলের মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন নাকি ডিপ্রেশনে ছিলেন এখন অবশ্য সেরে উঠেছেন আরিয়া প্রচণ্ড ভালোবাসে ওঁকে উনিও আরিয়াকে খুব পছন্দ করেন মিস্টার আর মিসেস আর্মিটেজের বয়স হয়েছে অনেকদিন ধরে এই এলাকায় রয়েছেন ওঁদের আবার চারখানা বেড়াল আছে চকোলেট ওঁদের বেড়ালগুলোকে দেখতে পেলেই ভৌ ভৌ জুড়ে দিত সেই জন্যে কিছু করেছেন কিনা জানি না বেড়ালগুলো ওঁদের প্রাণ একেবারে কেলি বছরখানেক হল ঘর পরিষ্কার করছে আগের যিনি ছিলেন তাঁর বয়স হয়েছিল, তাই মেয়ের কাছে চলে যান উনিই কেলিকে দিয়ে গিয়েছিলেন সে সোমবার করে আসে আর চকোলেট হাওয়া হয়েছিল মঙ্গলবার কেলি এমনিতে অবশ্য বলেছিল সে কুকুর খুব ভালোবাসে ইত্যাদি
ঠিক আছে মিসেস বেল আর তোমাদের প্রতিবেশীদের বলে রেখো আমি কয়েকদিনের মধ্যেই এসে ওদের সঙ্গে একবার কথা বলে যাব আর আরিয়ার সঙ্গেও আরেকবার কথা বলতে হবে কী ক্লু পেয়েছে সেগুলো দেখতে হবে
সুলেখাদি আর মিহিরদা দুজনেই হেসে ফেললেন সেটা শুনে, বললেন, “দূর দূর! কোথাকার ভাঙা সেফটিপিন, এক ফালি কাগজ এই সব উদ্ভট জিনিস জড়ো করে রেখেছে ওতে তোমার কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না তাও যখন এদিকে আসবে তখন ওর সঙ্গেও কথা বলে নিও

()

সোমবার দিন ল্যাবে গিয়ে কিমকে ব্যাপারটা বলল রিয়া কিম শুনে ঠোঁট উলটে বলল, “পুলিশকে বলেছে ওরা ঠিকই, কিন্তু তারা কিছু করেছে বলে মনে হয় না একজন রাজনৈতিক নেতার ছেলে এক মাস ধরে হাওয়া, সেই নিয়েই বাবারা খুব ব্যস্ত অন্য সব কেস ধামা চাপা পড়ে আছে এমনিতেই বাবাদের লোকবল কম আর ওই কেসটার জন্যে ওপর মহল থেকে চাপ আসছে, তাই ডিপার্টমেন্টের প্রায় সব লোক ওই কেসটাতেও লেগে রয়েছে কুকুর খুঁজবে সেই সময় কারও নেই, তাই চকোলেটকে খোঁজা হয়েছে বলে তো আমার মনে হয় না যদিও এটা একেবারে ডিপার্টমেন্টের গোপন কথা, এটা তোমার দিদিদের বলা চলবে না তোমাকে তো সবই বলি তাই বললাম
রিয়া শুনে বলল, “ এই ব্যাপার আমি তাই ভাবছি পুলিশ কেন কুকুর খুঁজে পাবে না? নেহাতই সহজ ব্যাপার ওদের জন্যে তো
কিম এবার গলা নামিয়ে বলল, “সেই নেতার ছেলে আবার অকর্মার ধাড়ি! কোনো কাজের নয় হাই স্কুলও এক বারে পাশ করতে পারেনি, বেশ কয়েক বছর বাড়তি লেগেছে বাবা নেতা, তাই নিজেকে একেবারে কেউকেটা মনে করে বেশ কয়েকবার ঝামেলাতেও পড়েছে, কিন্তু বাবা অর্থ খরচ করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন
বাবা, এই ব্যাপার! ঠিক আছে আজ তিনটে নাগাদ যাব ভাবছি মিসেস বেল আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলতে তুমি যেতে পারবে?”
কিম তো এক কথায় রাজি তার আবার পশু পাখি ভয়ানক পছন্দ তাদের কেউ কষ্ট দিলে সে খুব রেগে যায়
বিকেল তিনটে নাগাদ রিয়া আর কিম সুলেখাদিদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল ওদের পৌঁছোতে পৌঁছোতে মিসেস বেল আরিয়াকে বাস স্টপ থেকে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে আসবেন, কিন্তু সুলেখাদি আর মিহিরদা থাকবেন না সেই রকমটাই রিয়া চাইছিল
রোগা, লম্বা, চোখে চশমা, মাথার চুল টেনে বাঁধা মিসেস বেল ওদের দেখে সেফটি ক্যাচ লাগিয়ে দরজা খুললেন, “কাকে চাই?”
রিয়া বলল, “আমি আপনার আর আরিয়ার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছিলাম আরিয়া আমাকে চেনে ওকে জিজ্ঞেস করুন একটা বিশেষ কারণে আমি এসেছি
মিসেস বেল ওদের ঢুকতে দিলেন বটে, কিন্তু কোথায় কাজ করে, কী করে ইত্যাদি সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
আরিয়া তো ওদের দুজনকে দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, “মাসি তুমি আর তোমার বন্ধু চকোলেটকে খুঁজবে বলে এসেছ, না?”
রিয়া হেসে ফেলল, “হ্যাঁ, অন্তত চেষ্টা তো করব এই হল কিম তুমি ঠিক বলেছ, এই মাসিও আমার সঙ্গে কাজ করে আচ্ছা বলো এবার কী ক্লু আছে তোমার কাছে
মিসেস বেল মুখ আঁধার করে বললেন, “আরিয়া তোমাকে খেতে হবে আগে, নাহলে তোমার মা খুব রাগ করবেন আর আমি বকুনি খাব
আরিয়া বলল, “তুমি খাবার দাও, আমি এখুনি আসছি ক্লুগুলোকে নিয়ে
মিসেস বেল যতক্ষণে খাবার নিয়ে এলেন ততক্ষণে আরিয়া একটা বাক্স নিয়ে হাজির সুলেখাদি, মিহিরদা যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনই বাক্সে কয়েকটা সেফটিপিন, একটা আধ খাওয়া পেনসিল, আরিয়ার কাঁচা হাতে কী সব লেখা এক ফালি একটা কাগজ, দুটো চিবিয়ে ফেলা রবারের লাল আর নীল বল আর চকোলেট লেখা একটা ছোটো লকেট
আরিয়া বলল, “ওই লকেটটা চকোলেটের গলার বকলসে লাগানো ছিল কী করে খুলে গেল কে জানে আর অন্য জিনিসগুলো সেদিন পেয়েছিলাম বল নিয়ে খেলতে খুব ভালোবাসত
যে জিনিসগুলোকে ক্লু বলা হচ্ছিল সেগুলো দিয়ে কোনো লাভ হবে না জেনেও রিয়া আরিয়ার কাছ থেকে বাক্সটা নিয়ে নিল
মিসেস বেলকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন, “সেদিন দরজার তালা খুলেই বুঝেছিলাম কিছু একটা গণ্ডগোল ওই কুকুরটা আসার পর থেকেই আরিয়া বাড়ি ফিরলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করত সেদিন বাড়ি চুপচাপ তারপর সারা বাড়ি খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না আরিয়া তো কেঁদে ভাসাল আমি ওর মা-বাবাকে ফোন করলাম ওঁরা এলেন পুলিশের লোকজন এল কিন্তু চকোলেটকে পাওয়া গেল না দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল তাই পালাতে পারেনি মনে হয় কী জানি কী হয়েছিল
তা আপনি এখান থেকে কতটা দূরে থাকেন?”
গাড়ি করে আসতে আমার আধ ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট মতন লাগে ট্রাফিকের ওপর নির্ভর করে
ঠিক আছে আমরা এবার আসি কোনো দরকার হলে আবার আসব প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে দেখি যদি ওঁরা কিছু দেখে থাকেন
মিসেস বেল বললেন, “পুলিশ মনে হয় কথা বলেছে ওদের সঙ্গে
আরিয়া আর মিসেস বেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাশের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল ওরা মিস্টার আর মিসেস আর্মিটেজ মনে হয় লক্ষ রাখছিলেন ওরা দরজার বেল দেওয়ার আগেই দরজা অল্প খুলে এক বয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কারা? কী চাও? আমরা কিছু কিনব না
রিয়া নিজেদের নাম-টাম জানিয়ে বলল, “আমি আপনার পাশের বাড়ির সুলেখার বন্ধু ওদের কুকুরটা কী ভাবে হারিয়ে গেল সেই নিয়ে আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করব যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে
এস, এস, ভিতরে এস আমরা তাই ভাবছিলাম যে পুলিশের লোকজন একবার এসে দায়সারা কয়েকটা প্রশ্ন করেই চলে গেল আর কিছুই হল না তোমরা বোসো, আমি ববকে ডেকে নিয়ে আসি আর ব্যানানা ব্রেড বানিয়েছি একটু খেয়ে দেখোমিসেস আর্মিটেজের চেহারা বেশ হাসিখুশি গোলগাল
ওরা ভিতরে ঢুকতেই চারটে বেড়াল ওদের দেখে নিয়ে আবার যে যার মতন এদিক ওদিক চলে গেল পরক্ষণেই এক লম্বা, একমাথা পাকাচুল ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বললেন, “মেরি বলল তোমরা চকোলেটকে খুঁজছ? তা খুব ভালো কথা আমরা অবশ্য খুব একটা কুকুরপ্রেমী নয়, কিন্তু পশুপ্রেমী তো বটেই এমনিতে খুব বাধ্য আর মিষ্টি কুকুরছানা ছিল সে আমাদের বেড়ালগুলোকে দেখলে বা আমাদের দেখলে কিন্তু কিছু করত না তাছাড়া অবলা জীবের কোনো ক্ষতি হোক আমরা চাই না পুলিশ যখন এসেছিল তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না মেরির সঙ্গে যা বলার বলে ওরা চলে যায় আর ফিরেও আসেনি ফোন করলেও আর আসেনি আমি একটা কথা ওদের বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওদের দেখলাম কুকুর খোঁজা নিয়ে কোনো আগ্রহই নেই
রিয়া বলল, “আপনি যা বলতে চাইছিলেন তা নিশ্চিন্তে আমাদের বলতে পারেন
বব আর্মিটেজ বললেন, “যেদিন ওই কুকুরটা হারিয়ে যায় সেদিন সকালে আমি একজন লোককে ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম লোকটার কাছে চাবি ছিল নিশ্চয়ই অনায়াসেই ঢুকে গেল আমি ভেবেছিলাম কোনো মিস্ত্রি-টিস্ত্রি হবে কিন্তু পরে ওদের জিজ্ঞেস করতে ওরা বলেছিল ওরা কাউকে ডাকেনি তাহলে লোকটা কে? জোয়ান লোক, ভালো চেহারা সারা হাত জুড়ে উলকি ওর ওই চেহারা দেখেই আমি ভেবেছিলাম হয়তো বাড়ির কোনো কাজের জন্য এসেছে, কিন্তু তা যখন নয় তাহলে সে কে?”
অনেক ধন্যবাদ দেখি খোঁজ নিয়ে আর কাউকে দেখেছিলেন?”
না, তারপর তো আমি কাজে বেরিয়ে পড়েছিলাম আর মেরি তো দুপুরে ঘুমোয়, তাই দেখেনি কিছুই সপ্তায় দুদিন করে আমি পার্ট টাইম কাজ করি নাহলে বাড়িতে বসে বসে খুব বোর হই
মিসেস আর্মিটেজের তৈরি দুর্ধর্ষ ব্যানানা ব্রেড খেয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল গাড়িতে বসে কেলিকে ফোন করল রিয়া সুলেখাদির কাছ থেকে ওর নম্বর নিয়েছিল
কেলির কাছ থেকে ঠিকানা পেতে বেশ কষ্ট হল সে কিছুতেই ঠিকানা দিতে চায় না শেষে পুলিশের ভয় দেখাতে ঠিকানা দিল বটে, কিন্তু বলল, “এখন আমি কাজে আছি কাল যখন বাড়িতে থাকব তখন এস
রিয়া ঠিকানা নোট করে নিয়ে কিমকে বলল, “ভালোই হয়েছে এবার ল্যাবে গিয়ে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যাই
কিম বলল, “হ্যাঁ, সে আর বলতে! ভাগ্যিস মিসেস আর্মিটেজ ব্যানানা ব্রেড খেতে দিলেন ওই মিসেস বেল তো কিছু দিতে পারতেন, কিন্তু দিলেন না
আরে বাবা ওটা তো আর ওঁর নিজের বাড়ি নয়, সুলেখাদির বাড়ি তাই…”
হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ভুলে গিয়েছিলাম তবে বন্ধ ঘর থেকে কুকুর হাওয়া, খুব অদ্ভুত ব্যাপার উলকি দেওয়া লোকটা কে জানতে পারলে হয়তো কিছু বোঝা যাবে
বাড়ি ফিরে আরিয়ার বাক্স খুলে ওর হাতে লেখা এক ফালি সাদা কাগজটা বার করে দেখল রিয়া তাতে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, “আমি স্কুল থেকে ফিরলেই চকোলেট অত চেঁচায় কেন? অন্য কোথাও থেকে ফিরলে তো অমন করে চেঁচায় নারিয়া ভাবল, মনের আনন্দে চেঁচায়, আবার কী! নাহ, আরিয়ার ক্লু কোনো কাজে লাগবে না দেখে রিয়া সব কিছু বাক্সে পুরে দিল আবার আবার যেদিন ওদের ওখানে যাবে তখন ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে

()

পরদিন রিয়া ল্যাবে কাজ করছিল, এমন সময় ওদের ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি মেলানি ফোন করে বলল, “রিয়া, তোমার নামে এক বাক্স চকোলেট এসেছে মনে হয় কোনো কোম্পানি থেকে প্রোমোশনাল আইটেম আমি প্যাকেটটা খুলে ফেলেছি তুমি এসে নিয়ে যাও
কোনো কোম্পানি থেকে বেশি কেমিক্যাল বা অন্য গবেষণার জিনিস কিনলে তারা প্রায়ই চকোলেট বা এটা সেটা গিফট পাঠায় সেটা নতুন কিছু নয়
রিয়া শুনে আঁতকে উঠে বলল, “না, না মেলানি ওই চকোলেটের বাক্স অফিসেই রেখে দাও, তাহলে সবাই খেতে পারবে আমি ওজন কমানোর চেষ্টা করছি বাড়িতে চকোলেট নিয়ে গেলেই খিদে পেলে হাঁউ হাঁউ করে খেয়ে ফেলব আর তখন ডায়েটিং মাঠে মারা যাবে সেই জন্যেই বলছি বাক্সটা খুলে অফিসে রেখে দাও
শুনে মেলানি খুশি হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ রিয়া!”
সেই সময় ওদের ল্যাবে জোয়েল বলে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট কাজ করছিল, মেডিকেল স্টুডেন্টদের একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট করতে হয় বলে সে শুনতে পেয়ে বলল, “তোমরা কি চকোলেট নিয়ে কথা বলছ? মনে হল শুনলাম অফিসে চকোলেট রাখা হচ্ছে
রিয়া ওর কথা শুনে হেসে ফেলে বলল, “হ্যাঁ, মেলানি অফিসে রেখেছে, গিয়ে নিয়ে নাও
জোয়েল কাজ থামিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেল
মেডিকেল স্টুডেন্টরা যেন সব সময় ক্ষুধার্ত!” কিম মন্তব্য করল
রিয়া বলল, “হ্যাঁ, সে আর বলতে! মাঝপথে কাজ থামিয়ে দিয়ে চলে গেল!”
জোয়েল ফিরে এসে বলল, “লিন্ডটের চকোলেট, একেবারে স্বর্গীয় স্বাদ! আমি তো বেশ কয়েকটা নিয়ে এসেছি
মিনিট দশেক পরেই জোয়েল চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে পড়ল আর কাতরাতে লাগল রিয়া আর কিম দুজনেই ছুটে গেল ওর কাছে
আমার ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে, ভীষণ…” কোনোমতে বলল জোয়েল
রিয়া আর কিম সমস্বরে বলে উঠল, “চকোলেট!”
সঙ্গে সঙ্গে ৯১১ নম্বরে ফোন করা হলমানে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স ওদের কাজের জায়গাতেই হাসপাতাল বলে সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এসে জোয়েলকে এমারজেন্সিতে নিয়ে চলে গেল পুলিশ এসে পৌঁছোবার আগেই
রিয়া গ্লাভস পরে ছুটে গিয়ে অফিস ঘর থেকে চকোলেটের বাক্সটা তুলে নিল পুলিশকে দেবে বলে মেলানি সব শুনে বলল, “ভাগ্যিস আর কেউ খায়নি! আমি ভেবেছিলাম লাঞ্চের পরে ডেজার্ট হিসেবে খাব
পুলিশের লোকজন ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করে চকোলেট নিয়ে চলে যাওয়ার পর রিয়া আবার কেলিকে ফোন করল এবার তাকে ভয় দেখাল, বলল, “শোনো কেলি, তোমার কী সমস্যা আমি জানি না, কিন্তু ব্যাপারটা এবার নিছক একটা কুকুরের হারিয়ে যাওয়ার রহস্য নেই আমাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছে এবং আমার বদলে অন্য একজন ওই চক্রান্তের শিকার হয়েছে পুলিশ এবার তোমার কাছে আসবে বিষ মাখানো চকোলেট তুমি পাঠিয়েছিলে কিনা জানতে চাইবে
কেলি হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, “আমি তোমার পরিচয়ই জানি না ঠিক মতন, তাহলে বিষ মাখানো চকোলেট পাঠাবার তো প্রশ্নই নেই! তবে আমি এখন বাড়িতে আছি এস তুমি
কিম শুনে বলল, “ভালোই হয়েছে যা সব ঘটল এর পর আর কাজে মন বসছে না মৃত্যুর খুব কাছাকাছি গেলে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয় এমনি তো আমরা ভুলেই থাকি মৃত্যুর কথা ল্যাবে বসে বসে মন খারাপ করার চেয়ে বরং কেলির ওখান থেকে ঘুরে আসি ঠিকানাটা কী?”
ঠিকানাটা এক ঝলক দেখে নিয়ে কিম বলল, “ওরে বাবা, ওখানে তো গাড়ি নিয়ে না যাওয়াই ভালো একেবারে ঘিঞ্জি এলাকা আর গাড়ি পার্ক করার কোনো জায়গাই পাওয়া যায় না গোল গোল চক্কর মারতে থাকতে হবে শুধু তার থেকে বাস নিয়ে গেলেই সুবিধা বাস থেকে নেমে একটু হয়তো হাঁটতে হতে পারে, কিন্তু সেটা কিছুই না
রিয়া শুনে বলল, “হ্যাঁ, বাস তো ভালোই চলো যাওয়া যাক
আধ ঘন্টার মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল চেরি অ্যাভিনিউতে এই এলাকাটা সত্যিই একদম আলাদা নিম্ন মধ্যবিত্তদের আস্তানা এখানে ফ্ল্যাটবাড়িগুলো ছোটো ছোটো আর একদম গা ঘেঁসা ঘেঁসা রাস্তাটাও তেমন পরিষ্কার নয় এদিক ওদিক কিছু ছেলেপিলেদের জটলা
২১৮৯ নম্বর বাড়িটাকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না বাইরের দরজার লকটা ভাঙা নোংরা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে ফ্ল্যাট এফের দরজায় টোকা দিল রিয়া পচা খাবারের গন্ধ চারিদিকে আশপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকে বাচ্চার কান্না, লোকেদের চিৎকার ভেসে আসছে মিনিট কয়েক পরে দরজাটা খুলল বছর কুড়ি পঁচিশেকের একটা মেয়ে রোগা, খয়েরি চুল, নাকে আর কানে দুল
রিয়া জিজ্ঞেস করল, “কেলি?”
হ্যাঁ, তোমরা ভিতরে এস
রিয়া আর কিম ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকল ভিতরটা মন্দ নয়, তবে প্রচুর আসবাবপত্র ওরা দুজনে একটা সোফায় বসল
কেলি বলল, “আমি পড়াশোনা করছি বাড়ি ভাড়া আর কলেজের ফিজের জন্য ওই সব বাড়ি পরিষ্কারের কাজ করি আমাকে এই এলাকা থেকে বেরোতে হবে
রিয়া আর কিম ওর কথা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল
ওরা কথা বলছিল, এমন সময় হুড়মুড় করে একটা ছেলে ঘরে ঢুকে এসে বলল, “কেলি আমার নীল সাদা ডোরাকাটা জামাটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না
রিয়াদের দেখে থমকে দাঁড়াল সে ছেলেটার সারা হাতে উলকি রিয়া আর কিমের চোখাচোখি হল
ছেলেটা ওদের দেখে মিনমিন করে সরি বলল কেলি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “আমার ভাই জাস্টিন
তারপর ছেলেটাকে বলল, “ওই শার্টটা লন্ড্রি বাস্কেটে দেখলাম তো কাচতে নিয়ে যেতে হবে
ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে দেখে রিয়া বলল, “তোমার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো হল জাস্টিন এবার তুমি আমাদের বলতে পারবে যেদিন চকোলেট বলে কুকুরটা হাওয়া হয়েছিল সেদিন তুমি আরিয়াদের বাড়িতে কী করছিলে?”
দুই ভাইবোনের মুখে ভয়ের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল
কেলি ভয়ে ভয়ে বলল, “এই জন্যেই আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইনি পুলিশকেও বলিনি সত্যি কথাটা ওরা শুধু শুধু আমাদের বিরক্ত করবে আমরা গরিব বলে তবে আমরা গরিব হতে পারি কিন্তু চোর নই আমরা দুজনেই জীবনে উন্নতির জন্য পড়াশোনা করছি জাস্টিন পিজা হাটে কাজ করে পার্ট টাইম আর বাকি সময়টা কলেজে যায় আমার মতো
রিয়া বলল, “তোমরা যাই বলো না কেন প্রতিবেশীরা তো জাস্টিনকে দেখেছেন
কেলি মাথা নিচু করে বলল, “আমারই ভুল তার আগের দিন কাজ করতে গিয়ে আমি ফোনে কথা বলতে বলতে আমার পার্সটা ওখানেই ফেলে আসি আমার ক্লাস ছিল পরদিন, তাই আমি জাস্টিনকে পাঠিয়েছিলাম ব্যাগটা নিয়ে আসতে সেই জন্যেই ওই বাড়িতে গিয়েছিল, আর কোনো কারণে নয়
জাস্টিন বলল, “আমি যখন গিয়েছিলাম তখন চকোলেট দিব্যি ছিল আমি যেতে একটা লাল আর একটা নীল বল নিয়ে চলে এল খেলবে বলে আমি ভেবেছিলাম চেঁচাবে, কিন্তু সেরকম কিছুই করেনি আমি ওর সঙ্গে কয়েক মিনিট খেলে তারপর কেলির ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কেলি পই পই করে বলে দিয়েছিল দরজাটাকে ভালো করে টেনে বন্ধ করে দিতে, নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, তাই আমি তিনবার করে টেনে দেখেছিলাম দরজা বন্ধ হয়েছে কিনা আমি কিছুই করিনি, কিন্তু ওই যে কেলি বলল না, আমরা গরিব তাই দোষটা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে বলা হবে যে আমরা চকোলেটকে চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছি আর আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে এখানকার পুলিশের এই তো কাজ!”
কিমের বাবা পুলিশ প্রধান, তাই ওর মনে হয় কথাটা গায়ে লাগল, সে বলল, “না, নির্দোষ হলে কেন পুলিশ ধরবে?”
কেলি চুপ করে রইল, কিন্তু জাস্টিনের চোয়াল শক্ত হল, সে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “ওই যে নেভিলের অত খোঁজ চলছে তার কীর্তির কথা কি পুলিশ জানে না? হেন অপরাধ নেই সে করেনি, কিন্তু একটা দিনও জেলে কাটাতে হয়নি তাকে! ওর বাবা বড়ো পলিটিকাল নেতা বলে প্রতিবার সে ছাড়া পেয়ে যায়! সেটা সবাই জানে!”
আবহাওয়া বেশ গরম হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আরও দুয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করল রিয়া, কিন্তু বাড়তি আর কিছু জানা যাবে না বুঝে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিল
ওরা উঠে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কেলি বলল, “চকোলেট খুব মিষ্টি কুকুর ছিল আমার সঙ্গে খুব ভাব ছিল সব সময় খেলতে চাইত ওর ক্ষতি কে করতে চাইল জানি না আরিয়ার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি
ফেরার পথে বাসে বসে রিয়া কিমকে বলল, “তার মানে চকোলেট হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন কেলি ওদের বাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়েছিল ব্যাগ ফেলে আসে জাস্টিন পরদিন গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসে কিন্তু সুলেখাদি বা মিহিরদা কেউই ব্যাপারটা টের পায়নি আর ওরা পুলিশকেও কিছু বলেনি
ওরা ল্যাবে ফিরে অফিসে গেল জোয়েলের কোনো খবর পাওয়া গেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে মেলানি জানাল, সে খবর পেয়েছে যে বিপদ কিছুটা কেটেছে ডাক্তার বলেছেন প্রথম চব্বিশ ঘন্টা কেটে গেলে সে বিপন্মুক্ত হয়ে যাবে
পরে ল্যাবে কাজ করতে করতে রিয়া কিমকে জিজ্ঞেস করল, “ওই নেভিলের জন্যই তো সমস্ত পুলিশ ফোর্স ব্যস্ত, তাই তো?”
কিম মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, সবাই বলে নেভিল দা ডেভিল! একেবারে বিচ্ছু শিরোমণি যাকে বলে বড়োলোক বাপের ছেলে, আদরে একেবারে বাঁদর হয়ে উঠেছে

()

সেদিন রাতে বাড়িতে ফিরে রিয়া ম্যাগি করে নিল আগে ভেবেছিল কিছু একটা রান্না করবে, কিন্তু তারপর মনে হল একটু রিসার্চ করা দরকার নেভিল দা ডেভিলের নামটা বারবার এসে পড়ছে, তাই তার সম্বন্ধে আরেকটু বেশি জানা দরকার সব চেয়ে বড়ো ব্যাপার হল পুলিশের লোকজন ওকে খুঁজছে বলে আর কিছু তেমন করতে পারছে না ওকে নিয়ে অনেকেই কথা বলছে, কিন্তু নিয়মিত খবর শোনা হয় না বলে রিয়া ওর সম্পর্কে তত কিছু জানে না ম্যাগি আর ল্যাপটপ নিয়ে বসল রিয়া যেহেতু নেভিল রাজনৈতিক নেতার ছেলে, তাই তার সম্বন্ধে খারাপ কিছু চট করে ইন্টারনেটে খুঁজে পেল না সে সব কিছু মনে হয় সরিয়ে ফেলা হয়েছে শেষে কিছু না পেয়ে সে কিমকে ফোন করল কিম বলল সে আধঘন্টার মধ্যে পড়ার জন্য অনেক কিছু পাঠাচ্ছে, যদিও সে সব গোপনীয়, পুলিশের ফাইলের তথ্য ফাইল এসে পড়তেই রিয়া পড়তে শুরু করে দিল নেভিল যাকে বলে একেবারে গুণের খনি লোকে তাকে সাধে নেভিল দা ডেভিল বলে না স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সে বদমাইশ বুলি হিসেবে পরিচিত সবাইকে কষ্ট দিয়ে নাকি মজা পেত সে তিন-চার বারের চেষ্টায় কোনোরকমে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই পড়াশোনায় ইতি টেনেছিল তারপর থেকে তার জীবন এক অনন্ত পার্টি যেন! চুরি, শপলিফটিং, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো ইত্যাদির প্রচুর কেস আছে তার নামে যখন শিকার করার সময় নয় তখন গিয়ে জন্তু শিকার করেছে সে বিনা লাইসেন্সে মোটর সাইকেল চালিয়ে একজনের বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা মেরেছে বন্দুক দেখিয়ে ডাকাতিও করছে মানে হেন কুকাজ নেই যে সে করেনি সব চেয়ে মারাত্মক যেটা সেটা হল জনবহুল রাস্তায় প্রচণ্ড জোরে গাড়ি চালাতে গিয়ে একজন পথচারীকে পিষে ফেলেছে তবে ইদানীং নাকি সে নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করছিল, অথবা নির্বাচন আসছে বলে ওর বাবা ওকে শোধরাতে বাধ্য করছিলেন সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে ইলেকশন ক্যাম্পেন করছিল নাকি বাবার হয়ে ওর বাবা নাকি বলেছিলেন কাজ না করলে এক ডলারও পকেট মানি পাবে না বাধ্য হয়ে নেভিল ওই ইলেকশনের কাজ করছিল তারপরই সে হাওয়া হয়ে যায় ওর গাড়িটা সোমারভিল ওয়ালমার্টের পার্কিং লট থেকে পাওয়া গিয়েছিল বলা বাহুল্য কোনো হাতের ছাপ নেই ছেলেটার শত্রুর শেষ নেই, তাই কোথায় কী হয়েছে সেটা বোঝা মুশকিল, কিন্তু ওর বাবাও ছাড়বেন না ওপর মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন ক্রমাগত যাতে পুলিশের লোকজন কোনোরকম ঢিলে না দিতে পারে কাজে
ম্যাগি খাওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু তখনও খিদে রয়েছে বলে রিয়া আইসক্রিম বার করে খেল সেই আইসক্রিমের জন্যই নাকি ওই নেভিলের সম্পর্কে পড়ার জন্য কে জানে, মাঝরাতে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে রিয়ার ঘুম ভেঙে গেল মনে হল সে যেন গাড়িতে বসে রয়েছে আর আরেকটা গাড়ি এসে দুম করে ওদের গাড়িকে ধাক্কা মারল অন্য গাড়িটাতে জাস্টিন আর কেলি বসে রয়েছে তারা রিয়ার দুর্দশা দেখে হা হা করে হাসছে আর সে দোমড়ানো মোচড়ানো গাড়িটা থেকে বেরোতে পারছে না কিছুতেই ঠিক তখনই রিয়ার ঘুমটা ভেঙে গেল ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে তার
বিছানা ছেড়ে জল খেয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসল সে এবার নেভিল মেসন গাড়ির দুর্ঘটনা আর তারিখটা দিয়ে খুঁজতে কয়েকটা খবর উঠে এল মন দিয়ে খবরগুলোকে পড়ল রিয়া দুর্ঘটনায় যে ছেলেটা মারা গিয়েছিল তার নাম ল্যারি হোয়াইট

()

পরদিন ল্যাবে এসে কিম রিয়াকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ওই সাদা কাগজে আরিয়া কী লিখেছিল সেটা তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি তোমাকে কী লিখেছিল ?”
রিয়া বলল, “ওতে লেখা ছিলআমি স্কুল থেকে ফিরলে চকোলেট এত চেঁচায় কেন আমি অন্য কোথাও থেকে ফিরলে তো এত চেঁচায় না
কিম ভ্রূ কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড ভাবল, তারপর লাফিয়ে উঠে বলল, “মিসেস বেল! স্কুল থেকে যখন ফেরে তখন মিসেস বেলও ওর সঙ্গে থাকেন তার মানে চকোলেট মিসেস বেলকে দেখে চেঁচাত এমনি কিন্তু সে চেঁচানো টাইপের কুকুর নয় কারণ মিস্টার আর্মিটেজ, জাস্টিন আর কেলি সবাই বলেছে সে ওদের দেখে চেঁচাত না, শুধু খেলতে চাইত!”
রিয়া অবাক হয়ে বলল, “এটা দারুণ বলেছ তো! এটা আমার মাথাতেই আসেনি কিন্তু ওটাই ঠিক তার মানে কোনো কারণে চকোলেট মিসেস বেলকে পছন্দ করত না ওঁর বাড়িতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে আর একবার ভালো করে কথা বলতে হবে আরিয়া থাকলে হবে না দেখি সুলাখেদিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি মিসেস বেলের বাড়ির ঠিকানা আছে কিনা আরিয়ার সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই না
সুলেখাদিকে জিজ্ঞেস করতে বলল মিহিরদার কাছে আছে তার কাছ থেকে নিয়ে পাঠাবে কিছুক্ষণ পরেই হোয়াটসঅ্যাপে মিসেস বেলের ঠিকানা চলে এল
লাঞ্চের সময় রিয়া আর কিম বেরিয়ে পড়ল মিসেস বেলের বাড়ির উদ্দেশে এবারে গাড়ি করেই গেল এই এলাকাটা বেশ ফাঁকা বাস চলাচল তত বেশি নয় এদিকটায় মিসেস বেলের বাড়ির দুপাশে ফাঁকা জমি পড়ে রয়েছে ওঁর নিজের বাড়িটার সামনেও আগাছা ভরতি অনেকখানি বড়ো বাগান একটা বাগান পেরিয়ে দরজায় গিয়ে বেল দিল ওরা মিসেস বেল এসে দরজাটা অল্প খুললেন
ওদের দুজনকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বললেন, “কী ব্যাপার তোমরা এখানে?”
গুড আফটারনুন মিসেস বেল আসলে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল চকোলেটের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আরিয়ার সামনে তো আর সব কথা বলা যায় না, তাই সুলেখাদির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে চলে এলাম
মিসেস বেলের কপালে ভাঁজ পড়ল, “আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই আমাকে আরিয়াদের বাড়ি পৌঁছোতে হবে তিনটের আগে তিনটের সময় ওর বাস আসে
হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি তো আমরা একদম বেশি সময় নেব না আপনার
ঠিক আছে তাহলে ভিতরে এস
মিসেস বেলের বাড়িতে ঢুকে বাইরের ঘরটায় বসল ওরা কেমন যেন একটা অদ্ভুত লাগছিল ঘরটা প্রচুর জিনিসপত্রে ঠাসা বেশ কড়া একটা সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে মনে হয় সুগন্ধী মোমবাতি জ্বালিয়েছেন বাড়িতে দেয়ালে প্রচুর ছবি এক ফালি জায়গাও যেন ফাঁকা নেই সব ওঁর স্বামী আর ছেলের ছবি সেটা বোঝাই যাচ্ছে ছেলের শিশু অবস্থার প্রচুর ছবি মিসেস বেল তাকে কোলে নিয়ে আছেন
তোমরা কিছু খাবে? আমি গতকাল কেক বানিয়েছি একটা এক টুকরো করে খাও না হয়,” বলে উনি ভিতরে চলে গেলেন ওরা লাঞ্চ খেয়ে এসেছে বলতে কোনো ফল হল না
উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কিম উত্তেজিত হয়ে বলল, “ছবিগুলো দেখে চিনতে পারছ?”
রিয়া বলল, “না, মনে করতে পারছি না কয়েকটা ছবি দেখে অল্প চেনা চেনা লাগছে, তবে ঠিক কে বুঝতে পারছি না
আরে ল্যারি হোয়াইট ওঁর ছেলে!”
ল্যারি হোয়াইট, ল্যারি হোয়াইট মনে পড়েছে সেই ছেলেটা যাকে নেভিল দা ডেভিল গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিল! সর্বনাশ!”
ঠিক তাই! উনি বেল নামে পরিচয় দিয়েছেন বলে চিনতে পারিনি মনে হয় ওঁর বিয়ের আগের পদবি তবে পুলিশ নিশ্চয়ই এসে ওঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে নেভিলকে নিয়ে
মিসেস বেল প্লেটে করে কেক আর গেলাসে করে লেমোনেডসহ একটা ট্রে নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন রিয়া দুম করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, ল্যারি হোয়াইট কি আপনার ছেলে?”
মিসেস বেলের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, বললেন, “হ্যাঁ, লরেন্স আমার ছেলে ছিল ওর বন্ধুরা ওকে ল্যারি বলে ডাকত কিন্তু আমার লরেন্স নামটাই পছন্দ ওর মতন ছেলে হয় না একেবারে হিরের টুকরো ছেলে ওর বাবার মৃত্যুর পর আমাকে কী পরিমাণ সাহায্য করেছে, ভরসা দিয়েছে তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না তা রাক্ষসটা ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল! নাও, কেক আর লেমোনেড খেয়ে নাও
রিয়া কিমকে ইশারা করে বলতে চাইছিল যে কেক বা লেমোনেড খেয়ো না, কিন্তু কিম খেয়াল না করেই কেকের টুকরো মুখে পুরে লেমোনেডের গেলাসে চুমুক দিল রিয়া কেকের একটা টুকরো তুলে নিয়ে খাবার অভিনয় করে গেল আর সুযোগ পেতেই ব্যাগে কেকটা লুকিয়ে ফেলল
এবার এস আমার সঙ্গে,” বলে মিসেস বেল ওদের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন সেই ঘরে কম করে আটটা সুগন্ধী মোমবাতি জ্বলছে দেয়ালে আবার প্রচুর ছবি এটা মনে হয় ল্যারির ঘর ছিল দেয়ালে মিউজিক গ্রুপ, ফুটবল প্লেয়ার, বেসবল প্লেয়ারদের পোস্টার রিয়া ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে খুটখাট করছে দেখে মিসেস বেল কটমট করে ওর দিকে তাকালেন রিয়া তাই দেখে চট করে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল আবার
মিসেস বেল এবার বললেন, “সব কিছু একইরকম রয়েছে রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে যখন উঠি তখন মনে হয় ল্যারি আজ ফিরে আসবে ওর জন্য ক্রিসমাস আর জন্মদিনের উপহার কিনি এখনও আগের মতন
ঘরটাকে ছেলের জন্য স্মৃতিসৌধ করে ফেলেছেন মহিলা ঘুরে ঘুরে প্রতিটা জিনিস তুলে তুলে চুমু খাচ্ছিলেন তিনি, এটা লরেন্সের খুব প্রিয় ছিল, এটা নিয়ে এই করত, ওটা নিয়ে ওই করত ইত্যাদি বিড়বিড় করতে করতে রিয়া আর কিম মুখ চাওয়াচাওয়ি করল মহিলা বদ্ধ পাগল, ছেলের মৃত্যুর শোক ওঁকে পাগল করে দিয়েছে
কিম হঠাৎ বলে উঠল, “আমার শরীরটা খারাপ লাগছে, একটু বাইরে যেতে চাই
মহিলা হা হা করে হাসলেন, তাঁর হাতে একটা বিশ্রী কালো বেঁটে মতন রিভলভার চলে এসেছেএকদম নড়বে না,” তিনি ওদের বললেন, “কেক আর লেমোনেড সব সময় কাজে দেয় নেভিলও সেই জালে পড়েছিল ইলেকশনের জন্য ক্যাম্পেন করতে করতে আমার দরজায় এসে হাজির যাকে পাওয়ার জন্য এত দিন ধরে আমি ব্যাকুল হয়ে ছিলাম কিন্তু সে ধরা দেয়নি আর আমিও তাকে খুঁজে বার করার সাহস পাইনি, সেই কিনা আমার দোরগোড়ায় এসে হাজির ব্যাটা আমার ছেলেকে খুন করল, কিন্তু তার কোনো শাস্তি হল না দিব্যি ছাড়া পেয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে পুলিশের লোক আর কোর্টের লোকগুলো ওর বাবার অর্থের কেনা গোলাম বলে তাই সেদিন আমি ঠিক করলাম যে আমিই ওকে শাস্তি দেব সে ব্যাটা আমাকে চিনতেই পারেনি আমি তাকে বললাম, ‘খুব রোদ, এস ভিতরে এস একটু কেক আর লেমোনেড খেয়ে যাওসে কোনোরকম কিছু সন্দেহ না করে চলে এল ব্যস, আমার কাজ শেষ করলাম আমি একটু রাত হতেই গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গিয়ে ওয়ালমার্টের পার্কিং লটে রেখে দিয়ে এলাম সব কিছু ঠিকই চলছিল, কিন্তু ওই ব্যাটা কুকুরছানা চকোলেট কীভাবে জানি না বুঝতে পেরেছিল আমি কিছু একটা করেছি কুকুরদের মনে হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে আমাকে দেখলেই ব্যাটা ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিত কী জ্বালা! তাই তাকেও যেতে হল না তাকে মারিনি অবলা জীবকে হত্যা করব এমন নৃশংস আমি নই সেদিন জাস্টিন বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমের ওষুধ মেশানো মাংসের টুকরো ওকে খাইয়ে দিলাম তারপর সে ঘুমিয়ে পড়তেই তাকে সফট টয়ের মতন তুলে নিয়ে ব্যাগে পুরে পাইনগ্রোভে নিয়ে চলে গেলাম পাশের প্রতিবেশীরা যাতে কিছু না দেখতে পায় সেই খেয়াল রেখেছিলাম ওরা সব সময় নজর রাখে! তোমাদের আমি সাবধান করার চেষ্টা করেছিলাম চকোলেটে বিষ দিয়ে পাঠিয়ে মারাত্মক কিছু বিষ নয়, সেরে উঠতে কিন্তু তোমরা মনে হয় সে সব খাওনি, তাহলে এখানে আসতে পারতে না যাক সাবধান করার বার্তা যখন শোনোনি তখন এবার তোমাদের ফোন, হাতঘড়ি, ব্যাগ ইত্যাদি সব আমাকে দিয়ে দাও আর চলো আমার সঙ্গে,” বলে ওদের কাছ থেকে সব কিছু নিয়ে ওদের বন্দুক দেখিয়ে একটা ছোটো ঘরে নিয়ে গিয়ে তুললেন ঘরটা একটা স্টোর রুম মতন এখানে মেঝে থেকে একটা বাক্স সরাতেই একটা দরজা বেরিয়ে পড়ল বেসমেন্টে যাওয়ার দরজা ওদের দুজনকে ঠেলে সেই গর্তে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন মহিলা কিম হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল ঘুমের ঠেলায় দরজার ওপাশ থেকে মিসেস বেল বললেন, “এখন আমাকে কাজে যেতে হবে এখন আর সময় নেই ফিরে এসে তোমাদের গতি করব
রিয়া দুমদুম করে দরজাটার গায়ে কিল মারতে লাগল দরজাটা শক্ত কাঠের আর বাইরের ছিটকিনিও মজবুত, তাই কিছুই করা গেল না এক চুলও নড়ল না দরজাটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরটা দেখতে লাগল সে কোনো জানালা নেই, কিছু না, একেবারে চাপা একটা ঘর সিলিংয়ে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে
কেক আর লেমোনেডে ঘুমের ওষুধ ছিল বলে কিম আর জেগে থাকতে পারছিল না সে ধুলোভরা মাটিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল রিয়া ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখার চেষ্টা করছিল ঘরে পিচবোর্ডের কয়েকটা বাক্স, তাকে কিছু বই আর ছোটোদের খেলনা সবই ধুলো পড়া এক কোণে একটা লম্বা শোওয়ানো চেস্ট ফ্রিজার ফ্রিজারটাকে খুলতে ভয় পাচ্ছিল রিয়া কারণ সে মনে মনে জানে সেখানে কী আছে নেভিলের মৃতদেহ এখন ওদের প্রধান সমস্যা হল ওখান থেকে বেরোনো কিমের ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ওকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে তোলার মতন শক্তি রিয়ার নেই ওপর থেকে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না মিসেস বেল কাজে চলে গেছেন মনে হয়
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ওপরে দুম দুম পায়ের শব্দ শোনা গেল রিয়া প্রাণপণে চিৎকার করতে শুরু করল, “আমরা এখানে, আমরা এখানে বেসমেন্টে ঢুকতে গেলে একটা বাক্স সরাতে হবে, নাহলে বেসমেন্টের দরজা দেখতে পাওয়া যাবে নাএইভাবে এক নাগাড়ে প্রায় মিনিট কুড়ি চেঁচানোর পর ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হল আর দরজা খুলে দুজন পুলিশ উঁকি দিয়ে নিচে দেখল তাদের মধ্যে একজন কিমের বাবা
রিয়া যা ভেবেছিল তাই বেসমেন্টের চেস্ট ফ্রিজারটা থেকে নেভিলের দেহ উদ্ধার হল
অ্যাম্বুলেন্স এসে ঘুমন্ত কিমকে যখন নিয়ে যাচ্ছে তখন কিমের বাবা রিয়াকে বললেন, “তুমি মেলানিকে ঠিকানা দিয়ে এস এম এস করে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ!”
রিয়া বলল, “হ্যাঁ, মিসেস বেলের বাড়িতে ঢুকেই আমার কেমন জানি লাগছিল তারপর যখন ল্যারির ঘরে নিয়ে গেলেন তখন বুঝতে পারছিলাম মহিলা বদ্ধ পাগল, তাই তখনই মেলানিকে লিখেছিলাম যে যদি আধ ঘন্টার মধ্যে আমার ফোন বা টেক্সট না পায় তাহলে যেন পুলিশে ফোন করে এই ঠিকানাটা দেয় মেলানি অক্ষরে অক্ষরে আমার কথা শুনেছে ভাগ্যিস ওর নম্বর আমার কাছে ছিল

()

সুলেখাদিদের বাড়িতে গিয়েই মিসেস বেলকে অ্যারেস্ট করেছিল পুলিশের লোকজন কিম পনেরো ঘন্টা টানা ঘুমিয়েছিল উঠে অবশ্য বলেছিল শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে
পাইনগ্রোভের হিউমেন সোসাইটিতেই চকোলেটকে খুঁজে পাওয়া গেল ভাগ্য ভালো এই দিনে কেউ তাকে পছন্দ করে বাড়ি নিয়ে চলে যায়নি
আরিয়া খুব খুশি চকোলেটকে পেয়ে, আরও খুশি কারণ রিয়া আর কিম ওকে বলেছে যে রহস্য সমাধানের জন্য সব চেয়ে বড়ো ক্লুটা ওই দিয়েছিল ওর ওই কাগজের লেখাতে – ‘আমি স্কুল থেকে ফিরলেই চকোলেট অত চেঁচায় কেন? অন্য কোথাও থেকে ফিরলে তো অমন করে চেঁচায় না
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment