সুইট ব্লাড কটেজের বাগানবুড়ো
সম্বিতা
১
“সরি রেমকো, এখন আমাদের হোটেলে জায়গা নেই। তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা কর।”
বার
ম্যানেজারের কাছে একথা শোনার পর আর কী বাকি থাকে? রেমকো সোজা বার থেকে বেরিয়ে এল। বারের বাইরেটা পামকিন লাইট দিয়ে সাজানো
হয়েছে। সামনেই
হ্যালোউইনের উৎসব। শরৎকালের
এই সময় হল্যান্ডে ঝোড়ো হাওয়া হয়। কত জমজমাট রাতের আমস্টারডাম। কত লোক চারিদিকে। ক্যানেলের পাশের রেস্তোরাঁগুলোতে আলো
জ্বলজ্বল করছে। তবুও
খুব একা লাগছে তার আজ। সে হতাশ মনে আকাশের দিকে তাকাল। কত তারা আকাশে। সে শুনেছে মানুষ মারা গেলে তারা আকাশের
তারা হয়ে যায়। আজ
তার বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবাও কি তাহলে ওই তারাদের মধ্যে একটা তারা? মৃত্যুশয্যায় শুয়ে
তার বাবা বলেছিলেন, “রেমকো তুই জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমি
খুব খুশি হব। আমি নিশ্চিন্তে পরপারে চলে যেতে পারব।” বাবার এই একটা ইচ্ছা
তাকে পূরণ করতেই হবে। সে কি এটুকু পারবে না? ক্যানেলের পাশ থেকে
তার সাইকেলটা নিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার বেগ
বাড়ছে। মনে
হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।
সে
জোরে সাইকেল চালাতে লাগল। সাইকেলের রাস্তা ধরে সে সাবধানেই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একটা খবরের
কাগজের টুকরো এসে পড়ল তার মুখের উপর। সে তাল সামলাতে না পেরে সাইকেলসহ পড়ে
গেল মাটিতে। খুব
বিরক্ত লাগল। পায়ে
সাইকেলের চাকার ঘষায় কিছুটা কেটে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে অল্প। ধুর আজ দিনটাই খারাপ। একটা কাজও জুটল না। তার উপর থেকে... সে থমকে গেল, হঠাৎ তার চোখ পড়ল সেই কাগজের টুকরোটার উপর। জলে ভিজে গেছে কাগজটা। তবুও পড়া যাচ্ছে। সে কাগজটা তুলে নিল। তার চোখে পড়ল একটা বিজ্ঞাপন, একটা চাকরির বিজ্ঞাপন। সুইট ব্লাড কটেজের দেখাশুনোর জন্য
যোগাযোগ করুন। থাকা
খাওয়া ফ্রি। সঙ্গে
২০০০ ইউরো মাইনে। আরে
এ যে মেঘ না চাইতেই জল! ২০০০ ইউরো... এটা হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এই তো ফোন নম্বর। সে সঙ্গে সঙ্গে নম্বর ডায়াল করল। রিংটা অনেকক্ষণ বেজে চলেছে। কেউ ফোন ধরল না। রেমকো আবার নম্বরটা ডায়াল করল। এবার একজন ভারী মহিলা কন্ঠস্বর বলল, “হ্যালো!”
“হ্যালো? এটা কি সুইট ব্লাড কটেজের মিসেস মনিকার নম্বর?”
“বলছি।”
“আমি
রেমকো। আমস্টারডামে থাকি। আমি কেয়ারটেকারের কাজের জন্য বিজ্ঞাপন
দেখে ফোন করছি।”
“তাহলে কালই চলে এস। আমার বাড়ির ঠিকানা পেপারে তো দেওয়াই
আছে।”
“কালই?”
“হ্যাঁ, কেন তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
কথাগুলো
এবার একটু ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেল, যেন ফোন থেকে নয়। তার কানের পাশ থেকে হাওয়ায় ভেসে এল। রেমকোর শরীরের মধ্যে দিয়ে খেলে গেল
একটা শীতল রক্তস্রোত। সে কাঁপা গলায় নিজের অবস্থা প্রকাশ না করে উত্তর দিল, “না না, ভয় কীসের? কাজটা আমার খুব দরকার এই মুহূর্তে।”
“আসলে আমার বাড়ি তো গ্রামে। তুমি পারবে তো সেখানে কাজ করতে? তুমি তো আমস্টারডামে
থাকো। কটেজটা
এলসপেট নামক গ্রামে। শহরের মানুষ গ্রামে থাকতে পারবে?”
“হ্যাঁ পারব।”
“তাহলে চলে এস।”
পরদিন
এলসপেটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ট্রেনে করে রেমকো ওর সাইকেলটা নিয়ে
এসেছিল। সাইকেলটা নিয়ে সে সুইট ব্লাড কটেজের দিকে চালাতে লাগল।
বাড়িটার
সামনে এসে কলিং বেল বাজাল রেমকো। বাড়িটা খুব পুরোনো। বাড়ির গায়ে শ্যাওলা গজিয়েছে। দু-মিনিট পর দরজাটা খুলে দিল একটা অল্পবয়সি
মেয়ে, বলল, “আপনি?”
“আমি রেমকো, সুইট...” কথাটা শেষ
হল না। মেয়েটি
বলল, “আসুন।” তার পেছন পেছন চলল রেমকো। তাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল মেয়েটা। ঘরটার মধ্যে একটা স্যাঁতসেঁতে
গন্ধ। অদ্ভুতভাবেই
বেশি ঠান্ডা এই ঘরটা। যেন রাস্তার থেকেও বেশি ঠান্ডা লাগছে তার। ঘরে কি হিটার চলে না? কে জানে? একটা আঁশটে গন্ধতে ভরে আছে। ঘরের নীলচে আলোতে এক অজানা রহস্য যেন
মিশে আছে। যেটা
বাইরের লোকেরা জানতে পারে না।
রেমকো
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল এসব ভাবতে ভাবতে। মেয়েটির কথায় তার সংবিৎ ফিরল।
রেমকোর
দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল,
“এই যে মিসেস মনিকা।” মনিকাকে বলল, “সুইট ব্লাড কটেজের
দেখাশোনার জন্য ইনি এসেছেন।” মনিকার দিকে তাকিয়ে রেমকো দেখল মহিলা
একটা খুব পুরোনো কিন্তু পালিশ করা কাঠের বিছানায় শুয়ে আছেন। তার গায়ে কালো চাদর। দেখে মনে হল, তার শরীর ভালো নেই। বয়স আন্দাজ আশি। মুখটা অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাসে। যেন তিনি রক্তশূন্য রোগে ভুগছেন। কিন্ত তার নীল চোখের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত
একটা উজ্জ্বল দৃষ্টি। শত বলিরেখা থাকলেও যেন তাকে ক্ষমতাহীন মনে হয় না।
মনিকা
বলল, “তুমিই
রেমকো?”
রেমকো
উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
মনিকা
বলল, “কটেজের দেখাশোনার জন্য এসেছ? খুব ভালো। কত দিন ধরে লোক খুঁজছি। বয়স হয়েছে তো। নিজেরই খেয়াল রাখতে পারি না। আর কটেজ। কটেজটা খুব শখ করে কিনেছিলাম আমি আর
ইয়ান। মানে
আমার স্বামী। এ
মা! দাঁড়িয়ে কেন, বোসো সোফাতে।”
রেমকো
বসল তার পাশের সোফাতে।
“আসলে আমার কাজের খুব দরকার।”
“আমারও তোমার মতো কাউকে দরকার।”
“এই
নাও চাবি।”
রেমকো
এগিয়ে গেল মিসেস মনিকার দিকে। মনিকা শীর্ণকায় হাতটা এগিয়ে দিল রেমকোর
দিকে। তার
হাতে কটেজের চাবি। রেমকো
চাবিটা ওর হাত থেকে নেবার সময় দেখল মহিলার হাতটা অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা। সে যেন বরফে হাত দিয়েছে। তাড়াতাড়ি চাবিটা নিয়ে ধন্যবাদ জানাল।
মনিকার
চোখে অদ্ভুত রকমের একটা আলোর ঝিলিক খেলে গেল। মুখে একটা হালকা পৈশাচিক হাসি। রেমকোর মন আবার এসব ভাবনাতে চলে গেছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, “কত দূর কটেজটা?”
“এই বেশি দূর না। সাইকেল আছে সঙ্গে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে পাঁচ মিনিট লাগবে, ও আচ্ছা ঘরটা একটু পরিষ্কার
করে নিও। ওগুলো
করতে পারিনি।”
“সে ঠিক আছে।”
গুগল
ম্যাপ দেখে সাইকেলে করে রেমকো যখন এসে পড়ল কটেজটার কাছে, তখন পশ্চিম আকাশ আবির
রঙে ছেয়ে গেছে। কটেজটা গ্রামের শেষ প্রান্তে। খুব বেশি বড়ো নয়। ছোট্ট কটেজ। কটেজের সামনে বিশাল ল্যাভেনডার বাগান। বাগানের মাঝে একটা কাকতাড়ুয়া। বাগানের মুখে চিনামাটির একটা
বাগানবুড়োর মূর্তি। তার দু’দিকের দাঁত দুটো একটু বড়ো। কান দুটো লম্বা। হঠাৎ করে দেখলে গা শিউরে ওঠে। বাগানবুড়ো হল কাকতাডুয়ার মতোই বাগান
পাহারা দেয়। যাতে
পাখিরা বাগানের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। রেমকো ঘরের চাবি খুলে ঢুকতে যাবে ভেতরে, তার মনে হল বাগানবুড়োটা
যেন একটু নড়ে উঠল। অন্যমনস্ক হয়ে ঘরে যেই ঢুকতে গেল, দুটো বাদুড় উড়ে
পালিয়ে গেল। সে
আঁতকে উঠল। ঘরটা
দেখে মনে হচ্ছে সেখানে বহুদিন কেউ থাকে না। রেমকো ওর ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকল। দরজার একপাশে ব্যাগ রেখে, মোবাইলের টর্চের আলো
জ্বালিয়ে সে সুইচ অন করল ঘরের। উফ, ঘরগুলো একদম নোংরা হয়ে আছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করতে
হবে। না
হলে থাকা যাবে না। ঘরের
এক কোণে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা দিয়ে সে ঘর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। তারপর সব কাজ যখন শেষ হল তখন কটেজের
পাশে হয়ে থাকা কেমোমাইল ফুল তুলে সে রান্নাঘরে গেল, জল ফুটিয়ে, তাতে
কিছু কেমোমাইল ফুল দিয়ে ফুটিয়ে নিল। তারপর একটা কাপে ঢেলে সেই কেমোমাইল
চা খেতে খেতে কটেজের বাইরে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে এসে বসল।
২
চা
খেতে খেতে রেমকো গ্রামের পরিবেশটা উপভোগ করছিল। আর বার বার তার বাবার কথা মনে পড়ছিল। বাবা যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে কত খুশি হত!
আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে দেখলে কত আনন্দ পেতেন। তার চোখে জল চলে এল। হয়তো কটেজের একলা পরিবেশে তার বাবার
কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বার বার। তবে তার এই একাকিত্বময় জীবনে একটা
বন্ধু আছে। সে
হল হান্স। তাকে
যে সে কতভাবে সাহায্য করেছে। আচ্ছা তারও তো কিছুক্ষণের মধ্যে ফোন
করার কথা। কিন্ত
এখনও ও ফোন করছে না। ও না করলে ওকেই রেমকো ফোন করবে। এতসব কথা ভাবছিল।
হঠাৎ
সে কট্ কট্ কট্ করে একটা শব্দ পেল। কটেজটার সামনে মস্ত বড়ো ল্যাভেনডার
খেত। সেখান
থেকে একঘেয়ে ঝিঁঝির শব্দ উপেক্ষা করে একটা কট্ কট্ শব্দ ভেসে আসছে। হাওয়ায় কাকতাডুয়া দোলার শব্দ
নয় তো? ল্যাভেনডার ফুলের মিষ্টি গন্ধটা যেন আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেছে। এ যেন এক মোহময়ী গন্ধ। কিছুক্ষণ আগেও এতটা বেশি গন্ধ ছিল
না। অন্ধকারে
খেতের মধ্যে কিছু জোনাকি জ্বলছে। রেমকো নিজেকে ধরে রাখতে পরল না। আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদের
আলোতে যেটুকু দেখা যায় এই আশায় ওটা কীসের আওয়াজ তা দেখার অদম্য ইচ্ছায় সে চায়ের কাপটা
চেয়ারের উপর রেখে এগিয়ে গেল খেতের মধ্যে। এগোতে এগোতে সে অনুভব করল ল্যাভেনডারের
গন্ধটা যেন কেমন বদলে যাচ্ছে। সেটা কেমন যেন রক্তের হালকা গন্ধে
পরিণত হয়েছে। খেতের আল ধরে সে তবু এগিয়ে গেল। দেখল হ্যাঁ, আওয়াজটা কাকতাড়ুয়াটার
কাছ থেকেই আসছে। আরে, কাকতাড়ুয়াটার হাঁড়ির মুখে কিছুটা ভাঙা অংশ দিয়ে কি বেরিয়ে
আছে! আরে ওটা বিড়ালের লেজ না? রেমকোর হাত কাঁপছে, তবুও সে হাত এগিয়ে দিল কাকতাড়ুয়াটার মুখে। লেজটা হাত দিয়ে টানতেই বেরিয়ে এল একটা
আধখাওয়া বেড়াল। বেড়ালটার
শরীরের অর্ধেকটা মাংস,
অর্ধেকটা কঙ্কাল। সে চমকে উঠে পিছিয়ে গেল দু-পা। তার হাতে লেগে আছে মরা কালো বেড়ালের
রক্ত। সে
ভীষণ ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। এলোমেলো পা ফেলে সে দৌড়োতে লাগল কটেজের দিকে। সে বুঝল, এ কোনো সাধারণ কাকতাড়ুয়া
নয়। এ
কোনো অলৌকিক প্রেতের মতো,
কটেজের ঘরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল। নিজের জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল
খেয়ে সে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। কটেজটায় মাত্র একটা ঘর। রান্নার ঘর, বাথরুম। আসবাবপত্র বলতে একটা ছোট্ট
সোফা, আর শোবার খাট। শহরের কোলাহল থেকে একেবারে শান্ত জায়গায়
এসে হয়তো এরকম হয়েছে তার। কই তার হাতে তো রক্ত লেগে নেই। সকালে ট্রেনে ওঠার সময় সে
একটা পাউরুটির প্যাকেট আর চিজ কিনে এনেছিল। পাউরুটিতে চিজ লাগিয়ে সে রান্না ঘরে
গেল একটা প্লেট নিতে। সেখানে আলো না জ্বালানোর জন্য অন্ধকারে দুটো হলুদ চোখ সে দেখল। চমকে উঠল সে। হাত থেকে প্লেটটা পড়ে বিকট শব্দ করে
চুরমার হয়ে ভেঙে গেল সেটা। আরে ওটা সেই কালো বেড়ালটা না? যেটাকে কাকতাড়ুয়াটা
খেয়েছিল। বেড়ালটা মিয়াঁও মিয়াঁও করে ডাকল দু-বার। সে ডাকের মধ্যে রয়েছে একটা অদ্ভুত
ভয়। রান্নাঘরের
জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বেড়ালটা চলে গেল বাইরে। চলে যাবার সময় রেমকো যা দেখল তার জন্য
সে প্রস্তুত ছিল না। জানালা দিয়ে যতটুকু চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেখানে তাতে সে দেখল
বেড়ালটার মাথা থেকে পেট পর্যন্ত কোনো মাংস নেই, শুধু কঙ্কাল। এটা তো সেই বেড়ালটা যেটাকে কাকতাডুয়াটা... সে আর ভাবতে পারল
না। তার
গলার কাছে সকালের খাবারটা দলা পাকিয়ে উঠে আসার উপক্রম। সে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল। মুখে চোখে জল দিল। তারপর ঘরে যত জানালা ছিল সেগুলো বন্ধ
করে দিল। তারপর
বিছানায় এসে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ একভাবে বসে ছিল সে। কিন্ত বেশিক্ষণ সে এভাবে থাকতে পারল
না। শুয়ে
পড়ল, শুয়ে পড়তেই শরীরে সারাদিনের ক্লান্তি নেমে এল। তার চোখে ঘুম নেমে এল।
হঠাৎ
করে মাঝরাতে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। খুব ঠান্ডা লাগছে। কী হল, হিটারটা কাজ করছে
না নাকি? সে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। ঘরের লাইট জ্বালাল, সে দেখল ঘরের জানালাটা
খোলা। জানালাটা
কে খুলল? শোবার আগে সে তো সব বন্ধ করেছিল। তাহলে?
বাইরে
বৃষ্টি পড়ছে, তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। সেই হাওয়াই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ঘরের
আবহাওয়া ঠান্ডা করে দিয়েছে। সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। মোবাইলে দেখল, খুব একটা রাত হয়নি। সবে রাত দশটা। হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ
পাওয়া গেল। সে
মোবাইলের আলো ফেলে দেখল কেউ নেই। আলোর সুইচবোর্ডটা কিছু দূরে। কিছুপর কট্ করে আবার একটা আওয়াজ পাওয়া
গেল। রেমকো
ভাবল হয়তো ইঁদুর হবে। সে আবার শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করল। কী একটা চেনা গন্ধ ঘরটার মধ্যে ঘুরপাক
খাচ্ছে। এই
গন্ধ বেশ চেনা। মনিকার
ঘরে ছিল, সেই পচা গন্ধ। হঠাৎ সে অনুভব করল কেউ একটা তার বিছানার
উপর উঠে বসেছে। সে
হুমড়ি খেয়ে তাকেই দেখছে। কে সেটা? সে স্পষ্ট দেখল একটা কালোমতো কিছু... তার ঠান্ডা নিশ্বাস পড়ছে তার মুখে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। রেমকো ভয়ে তার সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা
দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল সেটাকে। আর সেটা ঝনঝন আওয়াজ করে চুর চুর করে
ভেঙে পড়ল মাটিতে। রেমকো
ঘরের লাইট জ্বালাল। সে
দেখে অবাক হয়ে গেল। আরে
এই তো সেই বাগানবুড়োটা যেটা বাগানের সামনে রাখা ছিল। সেটা একদম ভেঙে গেছে। ভাঙা টুকরোগুলোর মধ্যে থেকে লালচে
ওটা কী বেরিয়ে আসছে?
ওটা রক্তস্রোত। রেমকো এক পা এক পা করে পেছনে সরতে
লাগল। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দরজার দিকে যেতে লাগল। দরজাটা ধাক্কা দিল, কিছুতেই সেটা খুলছে
না। সে
আতঙ্কে ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ছে। সে কি আর বাঁচবে না? আজই কি তার শেষ দিন?
এই জীবনের শেষ? হে ভগবান। এই অবস্থায় সে দেখল, বাগানবুড়োটার সমস্ত
ভাঙা অংশগুলো একে একে জোড়া লেগে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে যেন আবার প্রাণ পাচ্ছে।
রেমকোর
সকল চেতনাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। সে তার চেতনা হারিয়ে ফেলছে, সে যেন অতল গহ্বরে
তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার হাত টেনে ধরল একজন লোক। তার শরীর থেকে অদ্ভুত আলোর জ্যোতি
বেরোচ্ছে। তাকিয়ে
দেখল তার বাবা। তার হাতে একটা সাদা গোলাপ।
রেমকো
বলল, “তুমি?”
বাবা
কিছু বলল না। তার
মুখে নরম হাসি।
রেমকো
বলল, “আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না এখানে কী হচ্ছে?”
বাবা
এবার বলল, “শোন, তোর থেকে বড়ো জিনিস আমার কাছে কিছু নয়। কাজ বড়ো কথা নয়, একজন বাবার কাছে তার
সন্তানের থেকে বড়ো আর কিছু হতে পারে না।”
রেমকো
একটা পায়ের শব্দ পেল। কোনো একটা ছায়া তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে, খানিকটা বাগানবুড়োর
মতো দেখতে। কিন্ত
সে তার কিছু করতে পারছে না।
রেমকো
পেছন ফিরল, কিন্ত কাউকে দেখতে পেল না।
সামনে
তাকিয়ে দেখল বাবা নেই। তার জায়গায় একটা সাদা গোলাপ পড়ে রয়েছে। তার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে?
হঠাৎ
করে চার্চের বারোটা বাজার ঘণ্টা কানে ভেসে এল। তার মানে কাছে কোথাও চার্চ আছে। এবার তার শরীর অচেতন হয়ে পড়ল, এমন সময় তার ফোনটা
বেজে উঠল। ফোনের
স্ক্রিনে তার বন্ধু হান্সের নাম। ফোনটা ধরার আগেই সে তার চেতনা হারিয়ে
ফেলল।
ছয় মাস পর
রেমকো
আজ প্যারিসে এসেছে একটা কনসার্টে ভায়োলিন বাজাতে। আজ সে খুব খুশি। কিন্তু সেই অভিশপ্ত রাতের কথা আজও
ভাবলে তার গা শিউরে ওঠে। অনুষ্ঠানের পর দর্শকদের বসার জায়গা দিয়ে বাইরে বার হওয়ার সময়
তার চোখে পড়ল একটা সাদা গোলাপ পড়ে রয়েছে একটা খালি বসার সিটে। রেমকোর চোখে মুখে একটা পরিতৃপ্তির
হাসি দেখা দিল।
----------
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment