উইকএন্ড ট্রিপ
ধূপছায়া মজুমদার
(১)
ট্রেন যে লেট করেছিল তা নয়, দু’ঘণ্টার রাস্তা মোটামুটি একঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটেই সেরে ফেলেছিল
চামুণ্ডি এক্সপ্রেস, রেল কোম্পানির বেঁধে দেওয়া
টাইমটেবিলের বাইরে কোত্থাও একটুও বাড়তি থামেনি ট্রেন। কিন্তু মুশকিল হল পৌঁছানোর সময়টাই
কিঞ্চিৎ বেয়াড়া, রাত ন’টা। হোটেল আগে থেকে ঠিক করা থাকলে অবশ্য রাত ন’টা হোক বা রাত একটা, যত রাতই হোক
তেমন যায় আসে না। কিন্তু আমাদের তো যে কোনো বেড়ানোই ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ গোত্রের! এ ক্ষেত্রে কটকের বদলে মাইসোর। এতগুলো ট্রেনের টিকিট পাওয়া
যাবে শেষ মুহূর্তে, সেটাই কেউ ভাবেনি। কনফার্মড
টিকিট পাওয়ার পর সবাই এত বেশি নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে হোটেল বুকিং-এর ব্যাপারটাকে পাত্তাই দেয়নি। ওরই মধ্যে আমি মৃদু আওয়াজ
তুলেছিলাম, “বাচ্চাদের নিয়ে অত রাতে একটা অচেনা
জায়গায় পৌঁছাব, থাকার জায়গা
আগে থেকে ঠিক করাটা বুদ্ধিমানের কাজ না?”
আমায় সবাই হইহই করে থামিয়ে দিয়েছিল।
ত্র্যম্বক ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল আমার কথা, “তুমি চুপ করো তো! ন’টা আবার রাত কোথায়?”
কিঞ্জল আমার মুখের সামনে হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, “আরে তুমি তো আগে এত ভয় পেতে না? এখন এত টেনশন নিচ্ছ কেন? রিল্যাক্স! আমাদের অফিসের দু-তিনজনের শ্বশুরবাড়ি
মাইসোরে। কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নো চাপ!”
“বেড়াতে গিয়ে লোকের শ্বশুরবাড়িতে উঠব!” কিঞ্জলের বউ দৃপ্তা গালে হাত দিয়ে বলে উঠেছিল, “বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে অন্তত রুম বুক করো আগে থেকে!”
যাক, কেউ একজন আমার মতে মত মিলিয়েছে! এইজন্যই মেয়েটাকে আমার এত ভালো লাগে!
যদিও আমাদের কথায় লাভ কিছুই হয়নি।
আগে থেকে ঘর ঠিক করে রাখলে নাকি অ্যাডভেঞ্চার
জমে না, বেড়ানোর হাফ মজা মাটি হয়। বাচ্চারা
এখন ছোটো ঠিকই, তা বলে পুরো মজা কেন পাবে না ওরা, এই হল ওদের বাবাদের যুক্তি। অগত্যা, আমি আর দৃপ্তা মনের কথা মনে রেখে ত্র্যম্বক আর কিঞ্জলের কথাতেই
সায় দিয়েছি।
কিঞ্জল আর আমি একসময় একই জায়গায় কাজ করতাম। তারপর বহু বছর কেটে গেছে, যোগাযোগের সুতো ক্ষীণ হয়ে এলেও একেবারে ছিঁড়ে যায়নি। সম্প্রতি
আবার সে সুতো নড়েচড়ে উঠে নিজেকে আরেকটু পোক্ত করেছে। তারই ফলশ্রুতি এই হঠাৎ বেরিয়ে
পড়া।
আমরা সপরিবারে এসেছিলাম ব্যাঙ্গালোর, দিন পনেরোর জন্য। ত্র্যম্বকের
কনফারেন্স, ঋতির মেডিক্যাল চেক-আপ, এসবের মাঝে একটা ফাঁকা উইকএন্ড। কিঞ্জলরাও
মাসছয়েক আগেই এখানে এসেছে চাকরিসূত্রে, থিতু হয়ে বসতে বসতে এর মধ্যে ওদেরও কোথাও বেরোনো হয়নি। ফাঁকা
উইকএন্ডের অ্যাডভেঞ্চার প্ল্যান হতে তাই বেশি
সময় লাগেনি।
এরপর আজকে আমাদের চামুণ্ডি এক্সপ্রেস নামিয়ে দিয়েছে মাইসোর স্টেশনে। ঘড়ি বলছে
এখন রাত ন’টা, কিন্তু আশেপাশের ভাব কেমন নিশুতি রাত মার্কা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে বলেই কি
এমন? বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়াও বইছে, বড়োদের কান মাথা ঢাকতে না হলেও বাচ্চাদের রেইনকোট টুপি সবই
লাগবে, অন্তত আমাদের তো তেমনই মনে হল। ঋজু
ঋতি দু’জনেরই প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দু’জনকেই ফুলহাতা জামা রেইনকোট টুপি সব পরিয়ে ফেললাম।
বৃষ্টি বলেই কিনা কে জানে, স্টেশন চত্বরে
একটাও গাড়ি নেই। অটো খানচারেক ছিল, কোত্থেকে
দুদ্দাড় করে লোকজন এসে সব অটোগুলো ভর্তি করে নিয়ে চলে গেল। আমরা নতুন লোক, পাঁচটা ব্যাগ আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম গাড়ির আশায়।
একটু দূরে একটা চায়ের দোকান, সেখান থেকে ত্র্যম্বক খবর নিয়ে এল,
এখানকার ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের কে এক মাথা নাকি আজ খুন হয়েছে,
তাই সারা শহরেই আজ ভাড়ার গাড়ির আকাল, ড্রাইভাররা সবাই থানা-পুলিশ-শ্মশান-বিক্ষোভ নিয়ে ব্যস্ত। অটোর জন্য
দাঁড়ানো, অথবা হোটেলে ফোন করে গাড়ি আনানো
ছাড়া গতি নেই।
আর হোটেলে ফোন!
আমি আর দৃপ্তা কটমট করে তাকালাম বাকি দু’জনের দিকে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাত্তিরবেলা এ কী আতান্তরে পড়া গেল
রে বাবা! কতক্ষণে দুটো অটো পাব, তারপর হোটেল খোঁজো রে, বাচ্চাদের খাওয়া ঘুম সারতে
মাঝরাত না গড়িয়ে যায়!
এদিকে ঋতি আর ঋজু দু’জনেই অতিরিক্ত হুল্লোড় শুরু করেছে। কোত্থেকে একটা কুকুরছানা এসে জুটেছে, সেটার পিছুপিছু দৌড়োচ্ছে দু’জনে, মায়েদের হাত ছাড়িয়ে। অজানা জায়গার অচেনা কুকুরছানা, নখ-টখ লেগে গেলে
কী হবে ভেবে অস্থির হচ্ছি, হঠাৎ চমকে গেলাম গাড়ির হর্নে। প্রায় ঘাড়ের ওপরে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে একটা আদ্যিকালের
মডেলের অ্যাম্বাসাডর। ত্র্যম্বক
আর কিঞ্জল দৌড়ে এল, দৃপ্তা বাচ্চাদের
জড়ো করে নিয়ে আসছে, গাড়ি থেকে গাড়িটার মতোই এক আদ্যিকালের
মানুষ বেরিয়ে এল। স্থানীয় ভাষায়
প্রাথমিক কথাবার্তা বলার পর আমাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ থমকাল, সেই সুযোগে কিঞ্জল বলে ফেলল,
“ইংলিশ প্লিজ!”
“সরি স্যার। লিটল ইংলিশ। নো হোটেল
স্যার?”
“নট বুকড। উইল ইউ টেক আস টু সাম গুড হোটেলস প্লিজ?”
“ওকে স্যার। কাম।”
অল্প স্বস্তির শ্বাস ফেলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে
তোলা হল। ঋজু ঋতি দু’জনেরই ইচ্ছে ছিল কুকুরছানাটাকেও সঙ্গে
নেওয়া হোক, দৃপ্তার কড়া চাউনিতে চুপ করে গেল দু’জনেই। দুগ্গা দুগ্গা
বলে বেরোনো হল হোটেলের উদ্দেশে। গাড়িতে মিউজিক
সিস্টেমে কী একটা গান বাজছে, ভাষা
জানি না, সুরটা বেশ। হোটেল খোঁজার দুশ্চিন্তা না থাকলে সুরের দিকে মন দেওয়া
যেত।
বিধি বাম। চারটে হোটেলে
ঘুরেও জায়গা পাওয়া গেল না। লং উইকএন্ড, তাই যেদিক থেকে যে পেরেছে বেড়াতে চলে
এসেছে বোধহয়, আর আমরা ছাড়া সব্বাই হোটেল বুক করে এসেছে।
এদিকে সবারই খিদে পেয়ে গেছে, বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করেছে,
তাই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া হল। এরপর আবার চিন্তা,
সত্যিই কোথাও জায়গা না পেলে কী করব?
হোটেল অভিযানে আমাদের সারথি দোনামনা করে জানালেন হোটেল
একটা আছে, একটু দূরে, একটু পুরোনো, অতটা চালু হোটেল নয় বলেই হয়তো জায়গা
পাওয়া যাবে। কিন্তু…
“কিন্তু কী গো? গোলমেলে ব্যাপার নাকি?” দৃপ্তা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস
করল আমায়।
আমিই কি ছাই বুঝছি নাকি কিছু? অ্যাডভেঞ্চারের শখ আশ মিটিয়ে মিটছে একেবারে!
রাতবিরেতে অচেনা জায়গায় বাচ্চাগুলোর ঘুমের একটা জায়গা কোনোমতে জুটলে
হয়!
সারথির কাছ থেকে ‘কিন্তু’-র বিশেষ ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না আর।
পাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না আমাদের কারও, উনি যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন চলুন, দু’খানা ঘর জুটলেই হল।
তা জুটল ঘর, মোটের ওপর রাজকীয়ই বটে, তবে একটাই, বিশাল বড়ো ঘর। ঘরের একদিকে
কথা বললে আরেকদিকে শোনা যাবে না, এতটাই বড়ো।
বিনা বুকিং-এ এতটা সত্যিই
আশা করিনি। বাড়িটা বহু বছরের পুরোনো।
খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে ওই অম্বা বিলাস প্যালেসের সমবয়সিই
হবে। হয়তো রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক
ছিল না বলেই মিউজিয়াম হয়নি, হোটেল হয়েছে।
সারথি ঠিকই বলেছিলেন। তেমন লোকজন আসে না বোধহয় এখানে। চাকচিক্যও তেমন নেই। প্রাচীন প্রাসাদের নিজের যে একটা জৌলুস হারানো গাম্ভীর্য থাকে, সেটুকুই আছে। তবে এটাও সত্যি, ওই গাম্ভীর্যটুকুই
চাকচিক্যের যাবতীয় অভাব ঢেকে দিয়েছে।
আমরা পৌঁছোলাম যখন, রিসেপশনে ছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। চেক-ইনের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ঘরের
দিকে এগোলাম। আদ্যিকালের অ্যাম্বাসাডর এবং
তার সারথি আগেই বিদায় নিয়েছিলেন, মালপত্র নামানো
এবং বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি সামলাতে গিয়ে তাঁর ফোন নম্বর চাইতে ভুলে গিয়েছিলাম সবাই।
যাক গে, হোটেলে বললে
সকালে গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
(২)
“চারিদিক বড্ড চুপচাপ, নিঝুম গোছের না?” দৃপ্তা ফিসফিস
করে আমার মনের কথাগুলোই বলে দিল যেন। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘরের সামনের ঝুলবারান্দায়।
বাচ্চারা ঘুমিয়েছে একটু আগে, তাদের বাবারা যে যার অফিসের কাজ নিয়ে বসেছে, আগামী দু’দিন ছুটির আগে আজকের বসাটা
খুব জরুরি, আধঘণ্টার মধ্যেই নাকি ঝাড়া হাত-পা হয়ে নিয়ে আড্ডা দিতে বসবে।
আমি আর দৃপ্তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের মাইসোরের সৌন্দর্য
খোঁজার চেষ্টা করছি। হোটেল চত্বরের
বন্ধ ফোয়ারা, নুড়ি ছড়ানো রাস্তা পেরিয়ে দৃষ্টিপথের
মধ্যে রয়েছে ঘুমন্ত রাজপথ, প্রহরী রাস্তার
আলো, আর নেপথ্যে চামুণ্ডি পাহাড়ের নিকষ
কালো অবয়ব। সব মিলিয়ে মন্দ না, কিন্তু বড়ো নিস্তব্ধ চারিপাশ।
পাহাড়ি গ্রামে যে নিস্তব্ধতা মানানসই, ব্যস্ত শহরে, হোক না রাত, ততটা নিস্তব্ধতা মানায় কি?
দৃপ্তার স্বরেও যেন সেই দ্বিধারই আঁচ পাওয়া গেল।
কিছুটা জোর করেই বললাম, “রাতও হয়েছে অনেক, তাছাড়া শুনলি
না, আজ সব গাড়ি বন্ধ, ওইজন্যই হয়তো আওয়াজ কম।
কাল সকালে দেখবি আওয়াজে অতিষ্ঠ লাগছে।”
“তবে যাই বলো, এসব পুরোনো হোটেলে কিন্তু নানারকম অলৌকিক ব্যাপার থাকে।
তেমন কিছু এক্সপিরিয়েন্স যদি
হয়ে যায়, জমে যাবে তাহলে!”
“থাক, আর জমিয়ে
কাজ নেই! একেই তো ত্র্যম্বক আর কিঞ্জল দু’জনেই বেজায় ভীতু, তায় আবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অজানা জায়গায়, কী দরকার ওসবের! যাঁরা যেখানে
আছেন থাকুন, এখানেও কেউ থাকলে ক্ষতি নেই, আমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ না হলেই ভালো।”
“এই, তোমরা এদিকে
শোনো একবার!”
কিঞ্জলের ব্যস্ত ডাক শুনে দু’জনেই ঘরে
চলে এলাম। এসে দেখি কিঞ্জল আর ত্র্যম্বক
দু’জনেই মুখ চুন করে বসে আছে।
“কী হয়েছে?”
“আওয়াজ। ওখানে।”
ঘরের এক কোণে একটা বড়ো আলমারি আছে, দেখে মনে হয় রাজারাজড়াদের আমলের, পায়াতে সিংহের থাবা, মাথায় পদ্মের
পাপড়ি, কিন্তু চাবি নেই, এসেই দেখে নিয়েছিলাম হাতল টেনেটুনে।
হোটেলের ঘরে তালাবন্ধ আলমারি রাখার যুক্তি বুঝিনি।
এখন সেখান থেকেই খুটুর খুটুর আওয়াজ আসছে।
সেই শুনে আমাদের দলের দুই বীরপুরুষের মুখ শুকিয়ে গেছে।
“হ্যাঁ, হবে ইঁদুর-টিদুর! প্রাগৈতিহাসিক
বাড়ি, তার ঐতিহাসিক ফার্নিচার, ইঁদুর তো থাকবেই।” আমি পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু কিঞ্জল ভোলার লোক নয়। সে ঘাড় বেঁকিয়ে শুধোল, “তালাবন্ধ
আলমারিতে ইঁদুর ঢোকে কোথা দিয়ে?”
“আহা সে আছে কোথাও কোনো গর্ত-টর্ত, পিছন দিকে নিশ্চয়ই কোনো ফাঁকটাক আছে!”
এবার ত্র্যম্বক রেগে গেল, “আমাদের কি
বাচ্চা পেয়েছ যে যা বোঝাবে আমরা বুঝে যাব? বলছি কিছু একটা গণ্ডগোল আছে, তখন থেকে
আজেবাজে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছ!”
“আহা কী মুশকিল! কী গণ্ডগোল থাকবে? আলমারিতে
কোনো গর্ত-টর্ত দিয়ে ইঁদুর ঢুকে আওয়াজ করছে।
ব্যস, মিটে গেল!”
“না মিটে গেল না। আওয়াজটা একটা রেগুলার ইন্টারভ্যালে হচ্ছে।
একবার ঝুমঝুম আওয়াজও শুনেছি।
কিঞ্জলও শুনেছে। তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমঝুম? পুরোনো বাড়িতে ঝুমঝুম? আমি আর দৃপ্তা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি।
দৃপ্তা হইহই করে ওঠে, “আরে ও তো শজারু! পড়োনি, শজারু হাঁটলে পিঠের কাঁটায় ঝুমঝুম আওয়াজ হয়!”
“এটা কি অভয়ারণ্য না চিড়িয়াখানা যে রাত্তিরে শজারু ঘুরে বেড়াবে?”
“আর শজারু কি টিকটিকি যে আলমারির ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকবে?”
তা-ও বটে! এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই।
“শোনো, আবার ওসব
আওয়াজ শোনার আগে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি চলো।”
“তোমরা ঘুমোও। আমার আর আজ ঘুম এল না! দেখি গান-টান শুনে
যদি...” ব্যাজার মুখে কিঞ্জল কথা শেষ করতে
না করতেই সবাই শুনলাম ‘খুটুর খুটুর
খুট’!
“গুড নাইট।” রাতবিরেতে ঘুমন্ত বাচ্চাদের নিয়ে ঠাঁইনাড়া হওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই, যেখানে যা আওয়াজ হচ্ছে হোক, দৃপ্তা আর আমি কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
(৩)
গাড়িটা যে খুব ছোটো, দেখে তো তা
মনে হয়নি! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কত কম জায়গা।
তিনজন বড়ো, আর দু’জন বাচ্চা, অ্যাম্বাসাডরের পিছনের সিটে
আরামেই বসা যায় মোটামুটি, ছোটোবেলায়
ছোটো বড়ো মিলিয়ে জনা আষ্টেক এঁটে যেতাম মনে আছে। তাহলে এখন কীসে সমস্যা হচ্ছে? ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ও বাবা! সবাই এত ভারী ভারী গরম জামা গায়ে দিয়েছি
কেন? রাতে এলাম যখন, ঠান্ডা লাগেনি তো একটুও! মাইসোরে এমন সময়ে ঠান্ডা হওয়ার কথাও তো নয়! গরম জামা কিচ্ছু আনিনি সঙ্গে করে। তাহলে সকালে এখন এরকম মেরু অভিযাত্রীদের মতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছি আমরা? তাছাড়া এইসব ভারী ভারী জ্যাকেট ওভারকোট, এসব কাদের? আমরা তো কস্মিনকালেও এসব কিনেছি বলে মনে পড়ছে না।
নিলামঘর ছাড়া অন্য কোথাও এসব পাওয়া যায় বলেও তো মনে হচ্ছে
না! ত্র্যম্বক সামনের সিটে বসেছে, ড্রাইভারের পাশে। ওর গায়ে যে ওভারকোটটা আছে সেটার বয়স ওর চেয়ে বেশি হলেও আশ্চর্য হব না।
কী যে হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছি, কিছুই বুঝছি না।
কাল রাতে যিনি আমাদের প্রাসাদে পৌঁছে দিয়েছিলেন, আজকেও তিনিই সারথি।
এঁকে কে কীভাবে খবর দিয়ে ডেকে আনল তাও মনে পড়ছে না।
ফোন নম্বর নেওয়া হয়নি বলে তো সবাই আপশোশ করছিলাম কাল।
হোটেল থেকে ডেকে দিয়েছে? তাই হবে হয়তো।
ঋজু ঋতি দু’জনেই ঘুমোচ্ছে।
দৃপ্তা আমায় কিছু বলছে।
পাশেই বসে আছি, তবু কী বলছে শুনতে পাচ্ছি না। কিঞ্জল ওদিকের জানলার ধারে বসেছে, আধচেনা একটা সুর গুনগুন করছে। কী আশ্চর্য, পাশে বসা দৃপ্তার কথা শুনতে
পাচ্ছি না, ওদিকে সুর শুনতে পাচ্ছি! সামনের সিটে ত্র্যম্বক সারথির সঙ্গে গল্প জুড়েছে।
আমার একটা অস্বস্তি হচ্ছে।
কেন অস্বস্তি সেটা ধরতে পারছি না।
বাইরের দৃশ্য কিন্তু আদৌ শহরের নয়। একদিকে ঘন সবুজ পাহাড়, আরেকদিকে
খাদ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আর কুয়াশার
চাদর সরিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে। মাঝেমাঝেই
পাহাড়ি রাস্তার বাঁক, পাকদণ্ডি
বেয়ে গাড়ি যখন উঠছে, এ ওর গায়ে হেলে পড়ছি, মেরুযাত্রীর
পোশাকে আরও হাঁসফাঁস দশা হচ্ছে তখন। পাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের ছিল কি?
হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ, প্রচণ্ড একটা
ধাক্কা, ঋতিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে, হে ঈশ্বর, রক্ষা করো! দৃপ্তা ঋজুকে ধরেছে তো ভালো করে? ত্র্যম্বক কিঞ্জল ওরা কোথায়? গাড়িটা প্রচণ্ড
দুলছে, মনে হচ্ছে শূন্যে
ভাসছি। অ্যাক্সিডেন্ট? চোখ পড়ল জানলার বাইরে, আতঙ্কে শরীর অসাড় হয়ে এল, গলা দিয়ে ছিটকে বেরোল একটা অস্ফুট আর্তনাদ, আর তখনই মনে পড়ল একটু আগের অস্বস্তির কারণ।
ত্র্যম্বক সারথির সঙ্গে দিব্যি স্থানীয় ভাষায় বাক্যালাপ চালাচ্ছিল।
ঘুম ভেঙে গেল। এমনি ভাঙেনি, কারও চিৎকারে ভেঙেছে ঘুম।
উফফ, ভাগ্যিস ভাঙল।
কী সাংঘাতিক স্বপ্ন রে বাবা! বাকিরাও দেখছি ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে, সবার মুখে চোখেই একটা হতভম্ব ভাব। ত্র্যম্বকই প্রথম মুখ খুলল, “কী সাংঘাতিক
স্বপ্ন রে বাবা!”
“স্বপ্ন?” প্রশ্নটা
বাকি তিনজনের মুখ দিয়ে ছিটকে বেরোল সঙ্গে সঙ্গে। বুঝতে পারছি
আমার নিজের হার্টবিট বেড়ে গেছে। বাকিদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওরাও খুব স্বস্তিতে নেই।
“কী স্বপ্ন দেখেছ তুমি?”
কিঞ্জলের প্রশ্নের উত্তরে ত্র্যম্বক আমার দেখা স্বপ্নটা হুবহু বলে গেল।
বলতে বলতে যেখানে ও থামছিল সেখানে শুরু করছিল কিঞ্জল আর দৃপ্তা।
বোঝাই যাচ্ছে আমরা চারজনেই একই স্বপ্ন দেখেছি।
বাচ্চা দুটো যেরকম নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমোচ্ছে, তাতে মনে হয় না ওরা অমন কিছু দেখেছে।
যাক, তবু ভালো! কিন্তু আমরা সবাই এরকম একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার যুক্তি কী? হাজার যুক্তি প্রতিযুক্তিতেও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা
পাওয়া গেল না। সব আলোচনারই নির্যাস হিসেবে
যে সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে, তা ঠিক বিজ্ঞানসম্মত
নয়, রাতের অন্ধকারে যদি বা সে সম্ভাবনা
মেনে নেওয়া যায়, পাখিডাকা ভোরে তো একেবারেই গ্রহণযোগ্য
হয় না।
বাচ্চারা ঘুমোচ্ছে। দরজাটা খোলা রেখে চারজনে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম।
রাতে বুঝিনি, হোটেলের লাগোয়া জায়গাটা বেশ বড়ো। একসময় সাজানো বাগান ছিল, কালের ফেরে
জৌলুস হারিয়েছে। এককালে সত্যিই হয়তো ছোটোখাটো
প্রাসাদ ছিল এটা, যত্ন না পেয়ে আজ এমন দশা! সব ঐতিহ্যেরই যত্নের অভাবে এমন অবস্থা হয় বোধহয়!
“হাঁটতে যাবে?”
“গেলে হয়, কিন্তু বাচ্চাদের
একা রেখে সবাই মিলে যাওয়া যাবে না যে!”
ঠিক হল আমি আর দৃপ্তা ঘুরে আসি, তারপর ত্র্যম্বক আর কিঞ্জল যাবে। ওরা আসার সময় চায়ের ব্যবস্থা করে আসবে।
রাতে ওরকম স্বপ্নের পর এক রাউণ্ড ভালো চা খুব দরকার।
রিসেপশনে এখনও কালকের ভদ্রলোকই আছেন। এত সকালে আমাদের দেখেই হয়তো একটু থমকালেন, সৌজন্যের হাসি হেসে প্রভাতি শুভেচ্ছা জানাতে ভুললেন না অবশ্য। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করলেন, প্রাসাদ-চত্বর ঘুরে দেখব বলতে সাবধান করলেন, একেবারে পিছনদিকের ঝোপের কাছটা যেন এড়িয়ে চলি, সাপখোপের দেখা পাওয়া যায় নাকি সেখানে।
“হোয়াই ডোন্ট ইউ স্পেণ্ড লিটল মোর ইন মেন্টেন্যান্স?” একটু খরচাপাতি করে জায়গাটাকে পরিচ্ছন্ন আর নিরাপদ তো রাখাই
যায় রে বাবা!
মৃদু হেসে ভদ্রলোক বললেন, “হেরিটেজ বিল্ডিং
ম্যাডাম!”
পর্যটকরা প্রাসাদের পাশাপাশি সাপখোপের আড্ডার থ্রিলও পেতে চান কিনা বুঝলাম না।
কথা না বাড়িয়ে পা বাড়াচ্ছিলাম বাইরের দিকে, দৃপ্তা আমার হাত টেনে ধরল। তাকালাম ওর দিকে, দেখি ফ্যাকাশে
মুখে দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
ছবি ঠিক নয়, একটা খবরের কাগজের কাটিং, বাঁধিয়ে রাখা
আছে রিসেপশনের পাশের দেয়ালে। খুদে অক্ষরে লেখা হলেও মোটামুটি পড়ে ফেলা যায়।
এই হোটেলেই আসা কোনো এক পর্যটক দলকে নিয়ে কুর্গ যাচ্ছিলেন
কোনো এক মি. পার্থসারথি, এই শহরের বড়োসড়ো এক গাড়ি রেন্টাল কোম্পানির মালিক, এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও তিনি একজন।
পাহাড়ি পথের বাঁকে দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণঘাতী। খবরের কাগজের কাটিং জানাচ্ছে
পর্যটক দলের সবার দেহ শনাক্ত করা গেলেও চালক মি. পার্থসারথির দেহের খোঁজ পাওয়া যায়নি। খবরের সঙ্গে রয়েছে একজনের ছবি, আমাদের চেনা লোক, কালকে রাতেই
দেখা হয়েছে, খুবই যত্ন করে ভদ্রলোক স্টেশন থেকে
এখানে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের। তারপর সারা রাত স্বপ্নেও ইনিই সঙ্গে ছিলেন, পাহাড়ি পথের বাঁকে অ্যাক্সিডেন্টের মুহূর্ত পর্যন্ত।
“হোয়েন দিস অ্যাক্সিডেন্ট হ্যাপেনড?”
“অ্যাবাউট টেন ইয়ারস এগো।” একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক, “ডু ইউ নো হিম? মি. পার্থসারথি!”
“ইয়েস। উই মেট হিম।”
“উই নো। এভরিওয়ান নোজ। হি কামস, হোয়েনএভার এনি ফ্যামিলি উইথ কিডস হ্যাভ ট্রাবল ইন দিস নিউ
সিটি, হি কামস।
উই নো।”
কোনো পরিবার শহরে নতুন এসে সমস্যায় পড়লে ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন দশ বছর আগে
গাড়ি দুর্ঘটনায় নিখোঁজ, সম্ভবত মৃত
মি. পার্থসারথি, যাঁর সঙ্গে কাল আমাদেরও পরিচয় হয়েছে!
“ডিড ইউ হ্যাভ এনি ট্রাবল অ্যাট নাইট? প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
ইউ ওক আপ সো আর্লি, উই ডাউট…” অন্য একজন কর্মচারী, ইনিও মধ্যবয়স্ক, এগিয়ে এলেন কথার মাঝে।
“নো নো, ইটস অ্যাবসোলিউটলি
ওকে। জাস্ট আ ড্রিম, নাথিং মোর, ইটস ওকে।”
“ওহ্, ড্রিম! সেম ড্রিম ইউ অল হ্যাড, না?”
ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাতেও হেসে ফেললাম দু’জনেই। একই স্বপ্ন সবাই মিলে দেখার অভিজ্ঞতা এঁরা এর আগেও শুনেছেন তার মানে!
“ইউ নো এভরিথিং স্যার!”
ভদ্রলোক দরাজ গলায় হেসে উঠলেন।
“নাউ ইউ হ্যাভ অল আনসারস, না? হোপ টুডে ইউ উইল হ্যাভ আ ট্রাবল-ফ্রি স্লিপ অ্যাট নাইট।
হ্যাভ আ গুড ডে ম্যা’ম!”
মি. পার্থসারথি যা জানাতে চেয়েছিলেন সবটাই
আমরা জেনে গিয়েছি। আর কেন মিছিমিছি তিনি স্বপ্নে
আসবেন?
“হোপ সো। থ্যাঙ্ক ইউ। মে উই হ্যাভ সাম টি প্লিজ?”
“ওহ্ শিওর! উই’ল সেন্ড শর্টলি।”
ওঁদের ধন্যবাদ দিয়ে ঘরের দিকে এগোলাম।
দু’জনের মনে
একটাই বিষয়ে দোলাচল চলছে জানি, সব শুনলে
ত্র্যম্বক আর কিঞ্জল কী করবে? বলব কি ওদের, নাকি যা শুনলাম, খুব বিজ্ঞানসম্মত না হলেও যা অবিশ্বাস করারও তেমন কোনো কারণ নেই, তা কেবল রেখে দেব আমার আর দৃপ্তার মধ্যেই?
“দৃপ্তা!”
“কী করব বলো তো? ওদের বলা হবে কি?”
“না বললেও তো নয়! এ অভিজ্ঞতা কেবল নিজেদের মধ্যে রাখব, তাই বা কেমন করে হয়!”
এতক্ষণ বোধহয় ঘোরের মধ্যে ছিলাম দু’জনেই, এবার দেখি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
হাত পা অসাড় হয়ে আসছে, যখনই কাল রাত থেকে আজ একটু আগে অবধি সব ঘটনা মনে পড়ছে।
নাহ্, আর দাঁড়িয়ে
থাকা সম্ভব নয়, ওদেরকেও সবটা জানানো দরকার।
দৃপ্তা আর আমি দু’জনে দু’জনকে শক্ত করে ধরে ঘর অবধি বাকি রাস্তাটা
পেরিয়ে গেলাম। ওই তো, ত্র্যম্বক আর কিঞ্জল, বাচ্চাদের কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়, সকালের রোদ ওদের মুখে এসে পড়ছে, ভারী উজ্জ্বল ছবিটা। মি. পার্থসারথিরও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে ছবিখানা, আপাতত বোধ করি তিনিও নিশ্চিন্ত, আবার কোনো পরিবার অচেনা শহরে এসে সমস্যায় পড়া অবধি আশা করি তিনি নিশিন্তেই থাকবেন!
----------
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment