গল্প:: সাপের ভাষা সাপের শিস - রম্যাণী গোস্বামী


সাপের ভাষা সাপের শিস
রম্যাণী গোস্বামী


“এখানে বুঝলেন না দিদিমণি? মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে আর সাপের উপদ্রব বাড়ছে। তবে ভয় নেই। ওরা সচরাচর কাটে না। শুধু থাকে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। হুম, যার যেমন কর্মফল সে তাই ভোগ করবে এই তো প্রকৃতির নিয়ম
জগদীশবাবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে একটা শ্বাস ফেলে কড়ে আঙুল দিয়ে নিজের বাম কান খোঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু আমি কি ঠিক শুনলাম? সাপ? উনি সাপই বললেন? টের পেলাম ওঁর কথায় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা গলন্ত আইসক্রিমের মতো কী যেন সড়সড় করে নিচের দিকে নেমে চলে গেল। হাতের থিন অ্যারারুট হাতেই ধরা থাকল। ওটা চায়ে ডুবোতে ভুলে গিয়ে আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম জগদীশবাবুর ভাঙাচোরা মুখের দিকে। সেদিকে খেয়াল হতেই উনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
“আরে রে, এই দেখুন কাণ্ড! চা যে জুড়িয়ে গেল। নিন নিন। ভারী ব্যস্ত হাতে উনি কাপসমেত প্লেটটা তুলে ধরলেন আমার সামনে। বিগলিত মুখে বললেন, ফার্স্টক্লাস চা বুঝলেন? বিশুর দোকান থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনানো বিশেষ অতিথি-টতিথিদের জন্য। তা ইয়ে আপনারা হলেন গিয়ে শহরের মানুষ। পাড়াগাঁয়ের সামান্য যত্নআত্তিতে কি আপনাদের মন পাওয়া যায়? কী? দিদিমণির সাপে ভয় আছে মনে হচ্ছে?
ভাঙাচোরা মুখখানা আরও কিছুটা কুঁচকে ভদ্রলোক মিটিমিটি হাসলেন আমার বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের ঘন অন্ধকারের আড়াল থেকে নাম না জানা কোনো পাখির বিচিত্র এক ডাক আমার কানের পর্দা ভেদ করে বুলেটের মতো ঢুকে পড়ল মস্তিষ্কে। একটু কেঁপে উঠতেই হাতের বিস্কুট আলগা হয়ে খসে পড়ে মাটিতে।
প্রথমটা দারুণ লজ্জিত হলাম আমি। তারপর একটু ঝুঁকে ভাঙা টুকরোগুলো তুলতে যেতেই হাঁ হাঁ করে ওঠেন জগদীশবাবু।
“আহা করেন কী? এমন দুমদাম করে যখন তখন মেঝেতে হাত-ফাত দেবেন না যেন। আগে ভালো করে দেখে নেবেন। সকালে ঘুম ভাঙার পর বিছানা ছাড়ার সময় ফস করে মাটিতে পা দেবেন না। দেখে-টেখে নিয়ে তারপর। হ্যাঁ? খুউব সা-ব-ধা-ন!”
শেষের শব্দদুটোয় অস্বাভাবিক জোর এনে ভদ্রলোক বলেন, “সর্বত্র তেনাদের বাস। ঘরে দুয়ারে বাইরে পুকুরঘাটে বাজারহাটে, কোথাও গিয়ে একটু শান্তি নেই। সরু মোটা লম্বা বেঁটে কালো ধলা পাটকিলে, রংবেরং-এর সব। বুঝলেন না? যত দিন যাচ্ছে ওরা দলে খালি বাড়ছে
ঘন সর পড়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে টের পেলাম যে আমার জিভ কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। শাড়ির তলায় পা দুটো কাঁপছে তিরতির করে। ভয়ার্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে একবার মনে হল পা দুটো তুলে চেয়ারে বাবু হয়ে বসার কথা। তারপর সেটা এই পরিবেশে একেবারেই মানানসই হবে না ভেবে চুপ করে বসে থাকলাম। কিন্তু দু’পায়ের হাঁটুতে ডান হাতের তালু চেপে ধরেও ওই কাঁপুনিটাকে বাগে আনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে আমার কাছে।
“বাইরে ওটা কার ডাক ছিল?” জগদীশবাবুর ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল আর ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
“ওটা? ওহ,” উনি নড়েচড়ে বসলেন আর মুখটাকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “ও কিছু না। হুতোম প্যাঁচা ডাকছে। বটগাছের কোটরে বাস ওদের। নাহ, রাত অনেক হল। সাড়ে ন’টা। আমি বরং ভেতরে গিয়ে দেখি আপনার খাবারের ব্যবস্থা কতদূর কী হল। আমার স্ত্রী একা মানুষ। একটা মেয়ে হয়েছিল। বেঁচে থাকলে তা এই আপনার বয়সিই হত... টুকটাক রান্নাবান্না, ঘরের কাজে সে তার মাকে একটু সাহায্য করতে পারত। বসেন। আমি দেখে আসি। আপনি ইয়ে, পা-টা তুলেই বসেন দিদিমণি
শেষ বাক্যটার উপরে বেশ খানিকটা জোর দিয়ে জগদীশবাবু বসবার ঘরের দরজার পর্দা ঠেলে ভিতরে চলে যান। আমার চোখ তখন ঘোরাফেরা করে বেড়ায় ঘরের ভিতরের আসবাবগুলোর উপর। মলিন একটা তক্তপোশএককালে ধবধবে ছিল, চিকনের কাজ করা, একটা না-সাদা ঢাকনায় মোড়া নড়বড়ে সেন্টার টেবিল। দুটো ঘুণে ধরা চেয়ার। যার একটায় আমি বসে রয়েছি এখন হাঁটু মুড়ে। টেবিলের উপরে হ্যারিকেনটা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে ওটার তেল ফুরিয়েছে। ওর কাচে ময়লা জমেছে। পরিষ্কার করা হয়নি দীর্ঘদিন। আলোটা তাই অদ্ভুত গাঢ় এক বিষণ্ণতার জন্ম দিয়েছে গোটা ঘরটায়।
জগদীশবাবু এই অঞ্চলের একজন মাতব্বর স্থানীয়। আমি যে নিশিগঞ্জ জুনিয়র হাই স্কুলে ভূগোলের প্যারা টিচারের কাজ নিয়ে এসেছি, উনি সেই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার। স্কুলের মাঠের পাশেই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে ম্যানেজিং কমিটির লোকজন। সঙ্গে ক্লিকস স্টোভ, ব্যাগে চাল ডাল আলু আর খুদে প্রেশার কুকারটাও আছে। রাতে খিচুড়ি জাতীয় কিছু বানিয়ে ফেলাই যেত, কিন্তু এই জগদীশবাবুই জোরজার করে টেনে আনলেন আমাকে নিজের ডেরায়। একা একটি তরুণীকে পাড়াগাঁয়ে চাকরি করতে আসতে দেখে উনি হয়তো স্তম্ভিত। আসলে সত্যিই একা আসার কথা ছিল না আমার। মা আসবে সঙ্গে সব ঠিকঠাক লাস্ট মোমেন্টে বাবলুটার জ্বর এল। অমনি আটকে গেল মায়ের আসা। যদিও মায়ের পক্ষে বেশিদিন ভাইকে ফেলে আমার কাছে পড়ে থাকা সম্ভব নয়। ওর তো স্কুল পড়াশোনা খেলাধুলো আছে, তাই না? এই দুটো মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই তো মাস্টার্স করেই একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে...
হঠাৎ একটানা শোঁ শোঁ শব্দে আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি কেঁপে উঠল। অদ্ভুত ওই শব্দটা আসছে জানলার বাইরে ডোবার দিকটা থেকে। এ কেমন শব্দ? ঝড় উঠলে যেমন হয়। কিন্তু মাটির বুকে কি এমন ঝড় ওঠে? এ যে অসম্ভব!
“ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আরে ও কিছু না। জোড়া সাপের আনশান কাণ্ড আর কী!”
চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি জগদীশবাবু কখন এসে তাকিয়ে আছেন সটান আমারই দিকে। হ্যারিকেনের স্তিমিত আলোয় ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। কী যেন বলতে চায় তারা। বেশীক্ষণ সেই চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন অসোয়াস্তি হয়। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, “জেঠিমাকে একটু তাড়াতাড়ি দিতে বলুন না। এতটা পথ ফেরা আবার, সেই তো আপনাকে কষ্ট দেওয়া... আচ্ছা, এখানে কি সন্ধ্যায় প্রায়ই এমন পাওয়ার কাট হয়?”
জগদীশবাবু আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। দেখলাম যে তাঁর দৃষ্টি এখন ঘুরে গেছে জানলার দিকে। ডোবার আঁধারের দিকে তাকিয়ে উনি বিড়বিড় করছেন। বাইরের সেই ঝড় বলে ভ্রম হওয়া শব্দটা এখন কিছুটা ম্রিয়মাণ। সে আওয়াজ ছাপিয়ে আমার কানে ভেসে এল জগদীশবাবুর ভাঙা গলার স্বর, “সাপের ভাষা, সাপের শিস, ফিসফিস ফিসফিস... সাপের ভাষা, সাপের শিস, ফিসফিস ফিসফিস...”
কোথায় যেন শুনেছি না এই লাইনটা? ছোটোবেলায় পড়া কোনো গল্পে? হ্যাঁ ঠিক। ঠিক। আহ্‌, কোথায় যেন? আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে যত মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম ততই যেন গল্পটা হাত ফসকে আরও দূরে পালাতে থাকল আমার কাছ থেকেমাথার মধ্যে শুধু জেগে রইল ওই শোঁ শোঁ শব্দ। আর সব ফাঁকা।


গতরাতে খাওয়াটা নেহাত মন্দ হয়নি। জগদীশবাবুর স্ত্রী খুব যত্ন করে থালায় চার-পাঁচটা আইটেম সাজিয়ে এনেছিলেন। সব নিজে হাতে রেঁধে এনেছেন। বাইরের ফরমায়েশি রান্না নয়। পুকুরের মাছ। এ খাবারের স্বাদই আলাদা। তেল কই আর বাটা মাছের সর্ষে রসা দিয়ে ভাত মেখেই আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সমস্যা হল নিজের আস্তানায় ফিরে এসে রাতে ঘুমের। নতুন জায়গায় এটা হবে আমি জানতাম। তাই ব্যাগে করে দু-তিনটে গল্পের বই নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মোমের আলোতে বেশিক্ষণ বই পড়া যায় না এক। দুই, কেন যেন রাতে আমি কিছুতেই বইয়ের পাতায় মন দিতে পারছিলাম না। একটা বিজাতীয় শিসের শব্দ - কখনও ঘরের টালির চালে, কখনও বাইরে কুয়োপাড়ে। যা আমাকে এক মুহূর্ত স্বস্তি দেয়নি। সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিয়ে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল।
ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়িতে ন’টা কুড়ি। ইস, কী ভয়াবহ! আজ না আমার জয়েনিং? মা তো কাছে নেই যে ডেকে দেবে। তাড়াতাড়ি মাথায় জল ঢেলে তৈরি হয়ে নিলাম। স্টোভ জ্বেলে ইনস্ট্যান্ট নুডলস বানিয়ে কোনোমতে গিলে ফেলে এসে হাজির হলাম স্কুল চত্বরে।
ছোট্ট স্কুল। নির্ঝঞ্ঝাট। পাঁচ জন মাত্র মেল টিচার। দু’জন নন টিচিং। আমিই একমাত্র ফিমেল স্টাফ। তাই বেশ আলাদা রকমের খাতির। স্টুডেন্ট বলতে খুদে খুদে ক’টা ফুটফুটে শিউলি ফুল। হাঁ করে অবাক হয়ে দেখছে শহুরে দিদিমণিকে। ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে আমার লাগবে ঠিক পনেরো মিনিট। মেজাজটা বেশ ফুরফুরেই ছিল, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না একটা কারণে।
এমন এক বীভৎস দৃশ্য দেখলাম যা দেখার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ বাকিদের কোনো হেলদোল নেই। গা সওয়া কেমন। আশ্চর্য! কী দেখলাম সেটা বলি। ওই স্কুলবাড়ির পিছন দিকটায় একটা সরু নালা। তারপরেই জঙ্গল ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটা পতিত জমি। স্টাফরুমে আমি যেদিকটায় বসেছি সেই জানলা দিয়ে জমিটার বেশ কিছুটা ফাঁকা অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। ফাইভের সিলেবাসে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা শব্দে ঘাড় তুলে ওই অংশটার দিকে তাকিয়েই আমার শরীরে যেন লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল। দেখলাম চারটে মিশমিশে কালো দীর্ঘকায় সাপ দুটো দলে ভাগ হয়ে হাঁ করে পরস্পরকে আক্রমণ করেছে। প্রচণ্ড হিসহিস শব্দে মাথা তুলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ওরা বীভৎস কামড়াকামড়ি করছে। মাঝে মাঝে অবসন্ন হওয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে থপ করে বসে পড়ছে জমিতে। পর মুহূর্তে ফোঁস করে শরীর মুচড়িয়ে ছিটকে উঠছে। সে যে কী ভয়ানক গা গুলিয়ে ওঠা দৃশ্য! তার সঙ্গে চলছে তীব্র ফোঁসফোঁসানি। আমার পেটের ভিতরে সকালের নুডলসগুলোও মনে হল নড়াচড়া করছে। কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে টেবিলের উপরে মাথা রেখে আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়লাম। দিব্যি টের পেলাম যে স্টাফরুমে উপস্থিত দু-একজন শিক্ষকের কৌতূহলী দৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়। কিন্তু প্রথম আলাপের সংকোচ কাটিয়ে উঠে তাঁরাও কিছু বলতেও পারছেন না। যদিও তখন সে সব নিয়ে ভাবার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না।
তখনই মনে মনে স্থির বুঝেছিলাম যে এখানে চাকরি করা অসম্ভব আমার পক্ষে। নো, নেভার। ফের কঠিন সংগ্রাম লেখা আছে আমার ভাগ্যে।
ওভাবে কতটা সময় কেটে গিয়েছে জানি না। মাথায় কারোর নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন আমার পাশেশিশুর মতো সরল দৃষ্টি তাঁরপুরোনো কিন্তু পরিষ্কার সাদা থান পরনে। টেবিলের উপরে রাখা ছোট্ট এক চায়ের কেটলি, কয়েকটা মাটির খুরি। কাচের বয়ামে বিস্কুট। পরে জানতে পেরেছিলাম যে উনি এক সম্ভ্রান্ত বংশের গৃহবধূ। ওই সময়ের ম্যাট্রিক পাশ। অবস্থার ফেরে এখন নাতির সঙ্গে স্কুল বাড়িতে আর স্টেশন চত্বরে চা ফেরি করেন। সকলেই তাঁকে ভালোবাসে। আমিও এক দেখাতেই ভলোবেসে ফেললাম চা দিদাকে।
গ্রীষ্মের সেই দুপুরটা আজও আমার মনে আছে। উনি স্নেহের সুরে বললেন, “এই বোকা মেয়ে, ভয় কী? ওই যে জমিটা দেখছিস, ওখানে শরিকি বিবাদ চলছিল কাকাতো ভাইয়েদের মধ্যে। চার ভাইয়ের মধ্যে দুটো দলে ভাগ হয়ে লড়াই। সে কী কুচ্ছিত ঝগড়া ঝামেলা রোজ রোজ। অতিষ্ঠ হয়ে যেত পাড়ার সকলে। বিষ, ভয়ানক বিষে ভরে গেছল ওদের মন। তারপর এক মোরগ ডাকা ভোরে হঠাৎ চারজনই উধাওকেউ বলে বাইরের কোনো শত্রুর কাজ। জমির লোভ কার নেই বল তো? মেরে পদ্মদিঘির পাঁকে পুঁতে দিয়েছে। অত বড়ো দিঘি, কে যাবে খুঁজতে? আবার কেউ বলে, না, ওরা শহরে চলে গিয়েছে। কিন্তু আমি জানি আসল কারণটা” এবার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন চা দিদা, “চার-চারটে জ্বলজ্যান্ত ছেলে একসঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? হয় এটা?
“তাহলে?” আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল প্রশ্নটা। তারপরেই ধাঁ করে মনে পড়ে গেল গতকাল রাতে বৃদ্ধ জগদীশ মুখুজ্জের বলা কথাগুলো - সাপের ভাষা, সাপের শিস! খগম! হ্যাঁ পড়েছিলাম তো গল্পটা কোন ছোটোবেলায়।
হুড়মুড় করে আরও মনে পড়ে গেল - এই এলাকায় মানুষের সংখ্যা কমছে আর সাপের সংখ্যা বাড়ছে। কর্মফল। কীসের কর্মফলের কথা বলতে চাইছিলেন জগদীশবাবু?
উফ, কী অবাস্তব সব ভাবনা আসছে আমার মনে? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
চা দিদা তখনও বলে যাচ্ছেন নরম স্বরে, “সে কী রে পোড়ামুখী? তুই কালিয় নাগের গল্প জানিস না? সে তো আসলে মানুষ ছিল রে। এক মস্ত রাজা। উশী নগরের রাজা বিষদর্ব্বি দারুণ অহংকারী সেকুটিল বিষে ভরে গিয়েছিল ওর মনটা। এত বিষ কি মানুষ জন্ম ধারণ করতে পারে রে মা? তখন একজন পরম বৈষ্ণবঠাকুর ওকে শাপ দিলেন যে তুই পরের জন্মে নাগ হয়ে জন্মাবি। বিষের পুঁটুলি ভরা বিশাল নাগ
আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল চা দিদার কথা শুনতে শুনতে। বাইরে তখন নিস্তব্ধ এক গ্রাম্য দুপুরবেলা ঘুঘুপাখির বুকের মতো উষ্ণতা মেখে পড়ে আছে অলস হয়েচা দিদার মুখে জর্দা পানের মিষ্টি গন্ধে ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে আমার চেতনা। ছোটোবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা মহাভারতের, পুরাণের ঘুমিয়ে থাকা কাহিনিগুলো যেন আড়মোড়া ভেঙে ভেঙে সত্যি হয়ে জেগে উঠছিল ক্রমশ।
পরের মাসে বাড়ির কাছাকাছি একটা উঠতি নার্সিং হোমে ক্লারিকাল পোস্টে জব পেয়ে যাওয়ায় নিশিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসি। আর কখনও ফেরা হয়নি ওই সরল মানুষগুলির মধ্যে। বুকের ভিতরে পুরাণকথার প্রাসাদটাকে জিইয়ে রেখে ছোট্ট গঞ্জটা হয়তো এখনও তেমনিভাবেই পড়ে আছে। হয়তো সেখানে কমে এসেছে আরও কিছু মানুষের সংখ্যা। কে বলতে পারে? চারপাশে যেভাবে কিলবিলিয়ে উঠছে ক্ষমতা আর লোভের বিষ, কিছুই বলা যায় না।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment