লিলি, পিঁপড়ে গলির ছোট্ট পরি
মানুয়েল পেনিঁয়া মুনিঁওথ (চিলি)
অনুবাদ - শর্বরী গরাই
প্রত্যেক গরমকালে, যখন বালপারাইসোর পাহাড়চূড়ায় সবেমাত্র
একটু একটু করে দাবানলে পোড়া ইউক্যালিপটাসের ছাই উড়তে শুরু করেছে, মা আমাকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে
বসতেন। আমরা
ছুটি কাটাতে যেতাম সান ফেলিপে শহরের ভেতরের দিকে বিওলেতা মাসির পুরোনো বাড়িতে। সেখানে, স্নেহময় পেদ্রো মাইথানির চালানো ছই
দেওয়া গাড়িতে যেতে যেতে, পাহাড়ে ঘেরা ধুলোমাখা পথের শেষে দেখা যেত পোড়া ইটের বাড়িটা, একতলা, যার করিডরটা ছোট্ট লো বালদেস
চার্চের লাগোয়া।
গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই বিয়োলেতা মাসি বেরিয়ে আসতেন
আমাদের স্বাগত জানাতে। এদিকে পেদ্রো মাইথানি সব মালপত্র নামিয়ে ফেলত। সেই বিকেলেই ফুলের তোড়া হাতে মা ফিরে
যেতেন স্টেশনে ওই একই গাড়িতে, আর আমরা পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতাম, গ্রামের আর সাম্প্রতিক ব্যাপটিজমগুলো
নিয়ে। পাদ্রির
বাসস্থান আর গির্জার অফিসের দেখাশোনার ভার পেয়ে গর্বিতা বিয়োলেতা মাসি জানালেন যে পাদ্রি
সোলোরথানো রবিবার এসেছিলেন, প্রার্থনা পরিচালনা করতে, তারপর মাসির ওপর সবকিছুর দায়িত্ব দিয়ে
ফিরে গেছেন সান ফেলিপেতে।
“এবার আমরা গতবছরের দ্বিগুণ ফার্স্ট
কমিয়ুনিওন পেয়েছি। সব
অঞ্চল থেকে বাচ্চারা এসেছিল।”
পরদিন, পেদ্রো দেখা করতে এল দুপুরের খাওয়ার সময়, জানাল, আমার মা সোনার সাপ কোম্পানির
রেলগাড়িতে চড়ে নির্বিঘ্নে বালপারাইসোতে পৌঁছে গেছেন।
“রোদোলফো,” একটু খ্যারখ্যারে গলায় পেদ্রো মাইথিয়ানি
আমাকে বলল,
“আজ বিকেলে আমাকে
একটা খেত দেখতে যেতে হবে পিঁপড়ে গলিতে। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও?”
আমি অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বিয়োলেতা মাসির দিকে তাকালাম, মাসি আবার একটু অসহায়ভাবে
তাকালেন পেদ্রো মাইথিয়ানির দিকে।
“না, পিঁপড়ে গলিতে নয়।”
“না কেন, বিয়োলেতা মাসি? আমি তো এখন ভালোই ঘোড়ায় চড়তে
জানি।”
“ঠিক আছে, কিন্তু তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে
আসবে। আমি
তোমাদের জন্য ছাগলের দুধের মাতে (চা এর মতো পানীয়) নিয়ে বসে থাকব।”
পেদ্রো মাইথিয়ানি আর আমি ঘোড়ায় চড়ে চললাম আকোনগঙ্গা
উপত্যকার দিকে,
ছোটো গ্রাম্য
গির্জা আর সবুজ প্রান্তরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোকে পেছনে ফেলে। “এটাই হল পিঁপড়ে গলি,” পেদ্রো মাইথিয়ানি বলল, যখন আমরা ক্যাকটাস আর ছুঁচোলো
পাথরে ভরা পাহাড়ি পথে চলা শুরু করলাম। “লোকে বলে এখানে নাকি আত্মারা দেখা
দেয়। এও
বলে যে, পূর্ণিমা রাতে একটা বাচ্চা
মেয়ে আসে যার চোখগুলো চকচকে আর মুখটা চিনেমাটির পুতুলের মতো, সবসময়ই পরনে সাদা জামা। সবাই বলে, ওর নাম নাকি লিলি।”
“লিলি?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, চারিপাশে দুলতে থাকা বুড়ো
পাতাগুয়া গাছগুলো দেখতে দেখতে।
“হ্যাঁ। বুড়ো আন্সেলমো, যে ওই ছাগলের খাদ নামের এলাকায়
থাকে, ওই প্রথম তাকে দেখেছিল। কয়েক বছর আগে, তখন ও খচ্চরের পিঠে মাল বওয়ার
কাজ করত। একদিন, ঘোড়ায় চড়ে নিচে নামার সময়
আলুবখরা গাছের নিচে একটা ছোট্ট আলোকে নাচতে দেখেছিল। মনে হচ্ছিল যেন একটা জোনাকি, কিন্তু আলোটা আরও বেশি উজ্জ্বল। ঘোড়াটাকে বেঁধে, ও ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে
গিয়েছিল। অবাক
হয়ে দেখল,
চাঁদের আলোয়
সোনালি চুলের এক ছোট্ট সুন্দর মেয়ে, পুরোনো আমলের পোশাকে, পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে নাচছে, মাটি না ছুঁয়ে।”
“উনি ঠিক দেখেছিলেন?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“চাইলে তুমি নিজেই বুড়ো আন্সেলমোকে
জিজ্ঞাসা করতে পারো। আমরা ঠিক ওদিকেই যাচ্ছি।”
বরফঢাকা পাহাড়চূড়াগুলো চোখের সামনে রেখেই আমরা
পৌঁছে গেলাম বোন্দো ঝোপের মাঝখানে একটেরে বাড়িটাতে।
“অনেক কিছু বলার আছে পেদ্রো,” বুড়ো আন্সেলমো তার
ক্লান্ত গলায় বললেন। আমাদের আঙুরখেতের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। লোকদুটো বীজবোনা খেতের
মধ্যে দিয়ে চলে গেল,
আর আমি বসে বসে ভাবছিলাম, এইসব বিশাল বিশাল পুরোনো আপ্রিকট গাছগুলোর নিচে কোনো
একদিন নেচেছিল এক ছোট্ট পরি, লিলি। কোথা থেকে এসেছিল ও? কেন ঠিক ওইখানেই নাচছিল, ওই সরু পিঁপড়ে গলিতে, যেখানে বাতাস নেমে আসে
শিস দিতে দিতে?
“দন আন্সেলমো,” আঙুরচাষি দু’জন ফিরে এলে বললাম, “পেদ্রো মাইথিয়ানি আমাকে
বলেছে যে, আপনি একবার ছোট্ট পরি
লিলিকে দেখেছেন। এটা কি সত্যি?”
দন আন্সেলমো গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, যেন মাপতে চাইছেন আমাকে, আমার বোধবুদ্ধি এইসব
সংবেদনশীল সত্য জানবার জন্য তৈরি কিনা।
“হ্যাঁ। তাই। এখনও তাকে দেখতে পাই।
ছোট্ট পরি লিলিকে... প্রত্যেক পূর্ণিমা রাতে ও আসে গাছগুলোর নিচে, ওর মিষ্টি হাসি নিয়ে। এমনকি
এক রাতে আমি অসুস্থ ছিলাম, বাগানে যেতে পারিনি। লিলি বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। জানি না
কীভাবে, কারণ গেটটা তো হুড়কো
দিয়ে আটকানো ছিল। কিন্তু ওইখানটায় ও নাচতে আরম্ভ করল, শুধু তাই নয়, এক ট্রে কেকও এনে
দিয়েছিল। রোদোলফো সোনা, পরিরা খুব ভালো। আর শুধুমাত্র ভালো মানুষদেরই ওরা
দেখা দেয়। একথা ভুলো না।”
“আচ্ছা দন আন্সেলমো, লিলি আপনাকে কিছু বলেছিল? কখনও কথা বলেছে আপনার
সঙ্গে?”
“ওঃ, হ্যাঁ। আমাকে ওর পুরো নামটাও
বলেছিল। ওর নাম লিলি এসিখা কাস্তেনিঁয়েদা। বাচ্চা মেয়েটা জন্মেছিল এখানেই, এই খাদগুলোর কাছাকাছি, পিকুঞ্চে ইন্ডিয়ানদের
আমলে, সর্দার মাকেউয়ার শাসনকালে। অবশ্য এই মেয়েটি
পিকুঞ্চে ইন্ডিয়ান ছিল না, ও ছিল স্প্যানিশ বাবা-মায়ের সন্তান... যদিও ওর ঠাকুমার মা
ছিলেন ইংরেজ,
তাই ওর নাম
রাখা হয়েছিল লিলি।”
“রোদোলফো, রোদোলফো, আমাদের ফিরতে হবে।”
“আর একদিন যখন আসবে, তোমাকে সান ফেলিপের
মাঠঘাটের পরিদের কথা শোনাব... দেখাব লিলির লাল রিবন। রংটা খুবই অন্যরকম।”
“লাল রিবন?”
“হ্যাঁ, যখন লিলি একজন ভালো মানুষ খুঁজে
পায়, যখন দেখে যে, সেই মানুষটার হৃদয়
স্বচ্ছ, যখন ও আর সেই মানুষটার
মধ্যে তৈরি হয় একটা সুন্দর বন্ধুত্বের বলয়, তখন ও লাল রিবনগুলোর একটাকে বার
করে আনে, রংটা খুব অন্যরকম, আর সেটা রেখে যায় স্মারক
হিসাবে।”
গল্পটা শুনে অবাক হয়ে ঘোড়ায় চাপলাম, ফিরে চললাম পেদ্রো মাইথিয়ানির
সঙ্গে, নেমে এলাম পাহাড়ের উতরাই পথে, পিছনে ফেলে রহস্যময় পিঁপড়ে
গলি।
বাড়িতে ঢুকতেই খেয়াল করলাম, বিয়োলেতা মাসি পেদ্রো মাইথিয়ানির
চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন কোনো কিছু শোনার অপেক্ষা করছেন। পেদ্রো মাইথিয়ানি, একটু উদ্ধতভাবে, ঘোড়া থেকে না নেমেই, সুন্দর একটা চতুর হাসি
হাসল।
সেই সন্ধ্যায় লো বালদেস গির্জার তারাগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে
ছোট্ট পরি লিলির ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বিয়োলেতা মাসি একভাবে
তাকিয়ে ছিলেন, যেন পূর্ণিমার চাঁদের
আলোয় গির্জার মিনারটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছেন...
রাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারলাম না। স্বপ্নে দেখতে
পেলাম ছোট্ট পরি লিলিকে, তার সাদা পোশাক, লাল রিবনগুলো, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নাচছে, হাতদুটো ওপরে তুলে আলতো নরম ভঙ্গিতে, যেন ও মহড়া দিচ্ছে কোনো
অদৃশ্য ব্যালের।
হঠাৎ যেন আমি জেগে উঠলাম। ছোট্ট পরি লিলিই কি ঘরের
পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়েছে? বাইরে আপেল গাছের নিচে কেউ যেন সরে গেল। সে কি ছোট্ট পরি
লিলি? না ওটা বিয়োলেতা মাসি।
ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন গাছগুলোর মধ্যে, ঠিক যেন কারোর সঙ্গে কথা বলছেন। অশান্ত মনে আমি বিছানায়
পড়ে রইলাম,
যতক্ষণ না
বিয়োলেতা মাসির পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম তার শোবার ঘরে।
“না,” পরদিন সকালেই আমাকে পরিষ্কার বলে
দিলেন, “তুমি স্বপ্ন দেখেছ। রাতে
আমি একবারও উঠিনি।”
আমি কিন্তু এতটা নিশ্চিত ছিলাম না। মনে হচ্ছিল মাসি
যেন আমার কাছে কিছু একটা লুকোচ্ছেন। লিলির সঙ্গে যোগ আছে এমন কিছু?
পরদিন সকালে, নিজের মনকে শান্ত করতে আমি
গির্জার অফিসঘরে গেলাম, যেখানে কাচের আলমারিতে রাখা থাকত ব্যাপটিজমের নথিপত্র।
ভারী ভারী বই, পার্চমেন্টে মোড়া, হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায়
কালো কালিতে লেখা। হ্যাঁ নামটা খুব ভালোভাবেই মনে ছিল, লিলি এসিখা কাস্তানিঁয়েদা।
এখানেই পেতে পারি ছোট্ট পরিটির কিছু তথ্য।
তিন ঘণ্টারও বেশি আমি চুপচাপ খুঁজেছি, এক সময় বুকটা ধক করে উঠল
তার ব্যাপটিজমের সঠিক তারিখটা দেখে। “লিলি এসিখা কাস্তানিঁয়েদা, জন্ম পিঁপড়ে গলি। ব্যাপটিজম – লো বালদেস গির্জা, ১৭ই মে, ১৫৮৭”।
বইটা হাতে করে দৌড়ে গেলাম বিয়োলেতা মাসির কাছে।
তাকে পেলাম রকিং চেয়ারে, এমব্রয়ডারি করছেন গির্জার বেদি ঢাকার কাপড়ে।
“হ্যাঁ,” সস্নেহে আমাকে বললেন, “হ্যাঁ, এটা আছে, কিন্তু তোমাকে বেশি কিছু
জানাতে চাই না... তোমার মতো কৌতূহলী, পর্যবেক্ষক বাচ্চার সঙ্গ আমার ভালো লাগে। ভয় হয়, তোমার মা যদি জানতে পারেন
যে আমি তোমাকে এইসব পরিদের গল্প বলে ভয় দেখাচ্ছি, তাহলে হয়তো তোমাকে আর এখানে নিয়ে
আসবেন না। কিন্তু আমি তোমার চোখে সেই অভ্রান্ত জ্যোতিটা দেখতে পেয়েছি, তাই আমি তোমাকে লিলির
ব্যাপারে আরও কয়েকটা কথা বলব।”
বিয়োলেতা মাসি স্মৃতিমেদুর চোখে বড়ো বড়ো জানলাগুলোর
অন্য পারে তাকিয়ে বলে চললেন, “লিলি এসিখা কাস্তানিঁয়েদার জন্ম হয়েছিল এখানে, পিকুঞ্চে ইন্ডিয়ানদের
আমলে, যখন এদিকে ঘুরে বেড়াত
রাজকুমারী ওরোলোঙ্কো। এই সময়েই বালিতে সোনার গুঁড়োর খোঁজ পাওয়ার পর, স্পেন থেকে সপরিবারে
মানুষজনের আসা শুরু হয়েছিল। অনেক কাস্তেইয়ান সৈন্যরা সোনার খনির খোঁজে ঢুকে পড়েছিল
ভেতরের দিকে, কিন্তু মারগা নদীর
মোহনায় সোনার বালির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। এসিখা কাস্তানিঁয়েদা পরিবার
স্থির করল তারা এই উপত্যকার মাটিতে সোনার খোঁজ করবে। ফ্রান্সিস্কো এসিখা ও তেরেসা
কাস্তানিঁয়েদার ছিল একটি মাত্র মেয়ে, তার নাম রেখেছিল লিলি, ওদের কোনো পূর্বনারীর স্মরণে, যার জন্ম হয়েছিল উইট
দ্বীপে... বাচ্চাটা এই উপত্যকায় খুব আনন্দে ছিল অন্য স্প্যানিশ বা ইন্ডিয়ান
মেয়েদের সঙ্গে খেলা করে, হাওয়ার শব্দ, কিংবা হাতদুটো দু’দিকে ছড়িয়ে পিঁপড়ে গলির উঁচু উঁচু
পাহাড়চূড়ার ওপর উড়তে থাকা কালো ঈগলকে নকল করে। সোনার বাহক সেই আশ্চর্য খনিজের খোঁজ
না পেয়ে, একদিন তারা ঠিক করল দেশে
ফিরে যাবে। কিন্তু ছোট্ট মিষ্টি লিলি, যে এখান থেকে চলে যেতে চায়নি, মনে মনে ফিরে আসত তার ভালোবাসার
পরিবেশে,
তার বুনো চেরিগাছগুলোর
কাছে, বনের মাঝে ফাঁকা
জায়গাগুলোয়, যেখানে সে খেলা করত। তাই
লিলি থেকে গেল এখানেই,
কারণ সে এখান থেকে কখনও যায়নি। যদিও বাকি জীবনটা সে কাটিয়েছে স্পেনে, থামোরা অঞ্চলের
ফেরমোসেইয়ে গ্রামে, আর
মারা গেছে সবার প্রিয় এক দিদিমা হয়ে। কিন্তু তার আত্মা থেকে গেছে এখানেই, বাচ্চা মেয়ের রূপে। রয়ে
গেছে আমাদের সঙ্গেই, যারা
মেনে নিয়েছে ওর অস্তিত্বকে। ও তাদের খেয়াল রাখে। এটাই পরিদের স্বভাব...
সেইজন্যই বুড়ো আন্সেলমো একা হয়ে যায় লিলিকে হ্যাজেলনাটের মাথার ওপর নাচতে না
দেখলে... লোকে বলে,
কখনও কখনও লিলিকে গোল বানিয়ে খেলতে দেখা যায় অন্য ছোট্ট পরিদের সঙ্গে, লিলির মতোই যারা স্পেনে
চলে গিয়েছিল তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে, কিন্তু আসলে তারা ফিরে যেতে চায়নি কারণ এই অঞ্চল তাদের
ভালো লেগেছিল। সেইজন্যই ওরা এখানে ফিরে আসে আবার পিঁপড়ে গলিতে খেলা করতে, এমনকি মৃত্যুর পরও, কারণ ওরা মনে করত, আকাশটা ওদের জন্যই।”
“বিয়োলেতা মাসি, তুমি এসব কী করে জানলে?”
“হুঁ, তা তো জানি না... হয়তো তোমার
মতোই গির্জার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে।”
সেই রাতে ছোট্ট জঙ্গলটাতে গিয়েছিলাম, যদি লিলি আসে স্প্যানিশ
বা ছোটো ছোটো পিকুঞ্চে ইন্ডিয়ান মেয়েদের সঙ্গে খেলা করতে। কিন্তু আসল কথাটা হল, আমি কিছু দেখিওনি, শুনিওনি।
“ওদের খুঁজে বেড়ালে ওরা কখনও দেখা দেয়
না,” বললেন বিয়োলেতা মাসি, “ওরা দেখা দেয় বা মিলিয়ে
যায় একদমই অপ্রত্যাশিতভাবে, আর সবসময়ই রেখে যায় একটা ছোট্ট লাল রিবন, গভীর ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ।”
আরও কয়েক দিন পর আমার মা আমাকে খুঁজতে এলেন লো
বালদেসে,
আমাকে বাড়ি
ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন। ওখানেই ফেলে এলাম আমার শৈশবের একটা টুকরো, আর খোলা প্রান্তরের মধ্যে
দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়া একটা পথ যার সঙ্গে জুড়ে আছে এক কাহিনি, যে কথা বলত আমার হৃদয়ের
সঙ্গে।
“ওঠো রোদোলফো।”
শেষবারের মতো চেয়ে দেখলাম আর মায়ের সঙ্গে চড়ে বসলাম
ঘোড়ায় টানা ছোটো গাড়িটিতে।
“আসি, বিয়োলেতা মাসি।”
“এসো, রোদোলফো, আমাকে কথা দাও, পিঁপড়ে গলিতে যা যা
শুনেছ সে সব কখনও কাউকে বলবে না।”
মায়ের সঙ্গে বাসে চড়ে বালপারাইসোয় ফিরে এলাম।
কিন্তু হাসিখুশি থাকার বদলে আমি বিষণ্ণ হয়ে ছিলাম।
“কী হয়েছে তোর রোদোলফো? গরমের ছুটি ভালো কাটেনি?”
কয়েকমাস পর যখন জানতে পারলাম বিয়োলেতা মাসি মারা
গেছেন, আমি গভীর শোকে আচ্ছন্ন
হয়ে পড়লাম। কিন্তু যখন মা ফিরে এলেন সান ফেলিপে থেকে, পুরোনো ঘটনাগুলো নতুনভাবে দেখতে
পেলাম। হ্যাঁ, তাই। কারণ মা আমার জন্য
নিয়ে এসেছিলেন একটা খাম, যেটা বিয়োলেতা মাসি রেখে গিয়েছিলেন আমার জন্য।
তার ভেতরে, আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে মোড়া একটা
কাগজ। লো বালদেস গির্জার কাজকর্মের ভারপ্রাপ্তার নিখুঁত হস্তাক্ষরে লেখা কয়েকটি
শব্দ, ‘আমার প্রিয় বোনপো
রোদোলফোর জন্য, যে ছোট্ট পরি লিলিকে
বিশ্বাস করে।’ একদম ভেতরের দিকে ভাঁজ
করা একটা লাল রিবন,
খুব পুরোনো, রংটা একদম অন্যরকম। তখনই
মনে পড়ল পরিদের সম্পর্কে তাঁর কথাগুলো – ‘ওরা মিলিয়ে যায় একদম অপ্রত্যাশিতভাবে। আর সবসময়, সবসময়ই রেখে যায় একটা লাল
রিবন, গভীর ভালোবাসার
চিহ্নস্বরূপ’।
রিবনটা আর খামটা রেখে দিয়েছি আমার গোপন জিনিসপত্রের
বাক্সে, এবং এসব কথা কাউকে বলিনি।
----------
মূল গল্প – Lily, el pequeño duende del Callejón de las hormigas
লেখক - Manuel Peña Muñoz
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment