গল্প:: দাদু ও নাতির গল্প - সুজন দাশগুপ্ত


দাদু নাতির গল্প
সুজন দাশগুপ্ত

সকাল থেকে ম্যাজিক ল্যাম্পের জন্য লিখতে বসেছি, মাথায় একটা প্লটও আসছে না এমন সময় আমার নাতি কিরু- কাছ থেকে ফোন পেলাম এখানে একটু বলে নিই, আমি মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা বহু বছর ধরে আমার মেয়ে জন্মেছে এদেশে, নাতি নাতনিরা তো বটেই কিরু এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, এক মাসের জন্য জার্মানি গেছে একটা কোর্স নিতে মাঝে মধ্যে এরকম কোর্স নিতে এদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে যায় জার্মানি থেকে কিরু মাঝে মাঝে ওর দিয়া, মানে আমার স্ত্রীকে ফোন করে, আজকে ওর দিয়া বাড়ি না থাকায় আমিই ফোনটা ধরলাম দু-একটা কথার পর জিজ্ঞেস করল, “কী করছিলে তুমি?”
একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছি রে, কিন্তু প্লট পাচ্ছি না ছোটোদের পত্রিকা তো, তাদের জন্য উপযুক্ত প্লট বাছতে হবে
প্লটের কী দরকার! আমাদের ছেলেবেলার গল্প লিখে দাও
সত্যিই তো, এটা মাথায় আসেনি কেন? বললাম, “মন্দ বলিসনি! ঠিক আছে, তোর গল্পই লিখছি, পরের বার লেখা চাইলে, তোর বোনের গল্প লিখব
তাই প্রথমেই বলে দিচ্ছি, এটা গল্প নয়, খাঁটি সত্যি

বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা, কিরু তখন ফিফ্ গ্রেডে পড়ে, ওর ধারণা হল আমি একজন ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেলর এর থেকে অসত্য আর কিছু হতে পারে না, আমি একেবারেই বেড়াতে ভালোবাসি না দুয়েক জায়গায় যে যাইনি তা নয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গিয়েছি চাকরির সূত্রে ওর দ্বিতীয় ভুল ধারণাটা আরও মারাত্মক, হয়তো আমার কন্যার কল্যাণে - সেটা হল আমি নাকি মিস্ট্রি রাইটার! মনের আনন্দে এক-আধটা রহস্যকাহিনি লিখেছি ঠিকই, কিন্তু লেখক কোনোদিনই হইনি
ঠিক আছে, বাচ্চাদের বহু ভুল ধারণা থাকে, তাতে ইতর-বিশেষ হয় না হঠাৎ কিরুর ফোনস্কুলের ফাংশনে একজনকে আনতে হবে, যার প্রভাব গভীরভাবে ওর জীবনে পড়েছে! ক্লাসের সবাই একজন করে আনছে, কিরুর ক্ষেত্রে সেই বিশেষ ব্যক্তি হলাম আমি, ওর দাদু! পাছে বিগড়ে বসি, তাই বলল, চিন্তার কিছু নেই, আমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না, যা বলার ওই বলবে ওর টপিক, ‘মাই গ্র্যান্ড-পা - দ্য ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেলর অ্যান্ড দ্য ফেমাস মিস্ট্রি রাইটার
এইফেমাসকথাটা আমার কন্যা কখনোই ওকে বলেনি ওটা বেরিয়েছে কিরুর মস্তিষ্ক থেকে যাতে বন্ধুদের টেক্কা দিতে পারে ক্লাস টিচারও বলেছেন টপিকটা দুর্ধর্ষ উনিও নাকি অপেক্ষা করে আছেন আমাকে দেখবেন বলে
আমার মাথায় বজ্রাঘাত ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পর বললাম, “এখুনি আমার নামটা ফিরিয়ে নে, তোরওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেলরআররাইটার’ - দুটো- কোনোটাই সত্যি নয়
দাদু!”
দাদু, আবার কী? ফিরিয়ে নে বলে দে ভুল লিখেছিলি
আগে তোমাকে ইন্টারভিউ তো করি?”
তার মানে?”
বাঃ, আমাকে বলতে হবে না, কোথায় কোথায় গেছ?”
ঠিক আছে, ভাবলাম সেটা শুনলে হয়তো আমাকে বাদ দেবে বা টাইটেলটা পালটাবে
শনিবার মা আর বোনের সঙ্গে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে কিরু এসে হাজির, ব্যাগে খাতা আর পেনসিল শুরু হল একেবারে রিপোর্টারের মতো প্রশ্ন
তুমি কোথায় কোথায় গেছ?”
কোথায় কোথায় আবার কী? এই দেশ আর ইন্ডিয়া
ইটালিতে তো গিয়েছিলে?”
কে বলেছে তোকে?”
মা
তাহলে তোর মাকেই জিজ্ঞেস কর না, আমাকে করছিস কেন!”
যাওনি?”
ঠিক আছে, লেখ ইটালি - কয়েকদিন তো ছিলাম
তিনটে হলখুদে খুদে অক্ষরে দেশের নামগুলো লিখল খাতায়
দেশ থেকে সোজা এখানে এসেছিলে?”
কোনবার, প্রথমবার?” আমি সতর্ককোনো বেফাঁস উত্তর নয়
হ্যাঁ
সোজা আসা যায় নাকি? ইউরোপে থেমেছিলাম
কোথায়?”
ব্যাপারটা এবার একটু বোঝাতে হলশোন, আমার এক বন্ধু ছিল এয়ার ইন্ডিয়াতে দেশভ্রমণ করাবে বলে এমনভাবে টিকিট করেছিল যাতে সুইজারল্যান্ড আর ফ্রান্সে থামতে পারি তবে প্যারিসে ছিলাম মাত্র এক রাত্রি, জুরিখে ঘণ্টা
তাহলে পাঁচটা হল
পাঁচটা কী রে? ওটা তো ভ্রমণই হল না!”
ওই হল
এটা কী বলছিস! তাহলে তো আমি পাকিস্তানেও গেছি পাইলটের পেট খারাপ হয়েছিল বলে লাহোরে এমার্জেন্সি ল্যান্ডিং! চার-ঘণ্টা আটকা পড়েছিলাম
তাহলে টা ...আর আর্জেন্টিনা?”
কোত্থেকে শুনলি এটা? হ্যাঁ, বুয়েনোসারিস গিয়েছিলাম একটা কাজে, ঝামেলায় পড়ে দুঘণ্টা দোকানে দোকানে ঘুরেছিলাম
কী ঝামেলা?”
আন্ডার-প্যান্ট নিতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে ঝামেলা তোকে শুনতে হবে না, বড়োদের ব্যাপার
ঠিক আছে, সাতটা
ব্যস, আর না
কেন, তুমি তো ক্রুজে যাবে কয়েকবার, একবার তো আমাদের সঙ্গে?”
“‘যাবেনা, ‘গেছজন্ম আর বড়ো হওয়া এদেশে, মাঝে মাঝে বাংলা ক্রিয়াপদের কাল নিয়ে ওর গোলমাল হয় ওর দাদুরই গুলিয়ে যায়, ওর আর কী দোষ!
হ্যাঁ, ‘গেছ’,” ধরতে পারল ভুলটা,সেগুলো?”
একটা তো তুই- জানিস, সেই জায়গাগুলো আগে লেখ
এইভাবে চলতে থাকল... চোদ্দ ষোলো... বাড়ছে তো বাড়ছেই
ইন্টারভিউয়ের শেষে মনে হল, সত্যিই আমি ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেলর - কিরুর হাস্যকর সংজ্ঞা অনুযায়ী
আমি ম্যাপ এঁকে জায়গাগুলো সব্বাইকে দেখিয়ে দেব,কিরু একটু গর্বিতভাবে বলল ছেলেটা ম্যাপ আঁকতে ভালোবাসে
দেখাস, কিন্তু ওইমিস্ট্রিআরফেমাসটাবাদ দিবি ওগুলো ঠিক নয়
মিস্ট্রি বাদ দেব না, তোমার বই তো মা- কাছে আছে
বেশ, তবেফেমাসবাদ দিবি, নইলে যাব না
ফেমাসবাদ দিতে প্রবল অনিচ্ছা কিন্তু আমাকে অনড় দেখে শেষ পর্যন্ত রাজি হল
ইতিমধ্যে ওর বোন কিয়া আমার কোলে গ্যাঁট হয়ে বসেছে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, তুই তো দাদার দু-ক্লাস পিছনেদুবছর বাদে তোর ক্লাসেও কি আমি যাব?”
মাথা ঝাঁকাল কিয়া, “না
কেনজিজ্ঞেস করে নিজের লজ্জা বাড়ালাম না, বোঝাই যাচ্ছে ওকে আমি ইমপ্রেস করতে পারিনি!

এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা, আমার নাতি নাতনি একটু বড়ো হয়েছে উইক এন্ডে নিউ জার্সিতে একটা বাংলা স্কুলে পড়তে যায় তার ওপর ওদের মায়ের তাড়া খেয়ে বাংলা মোটামুটি লিখতে-পড়তে পারে আমি তা দেখে খুবই উৎসাহিত, মাতৃভাষাটা হারিয়ে যাবে না আশি দশকের মাঝামাঝি যুক্তির ধাঁধার ওপর ভিত্তি করে একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলেছিলাম! তারপর অঙ্ক আর ধাঁধা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ এক বিখ্যাত প্রকাশকের কী খেয়াল যে হল, বই হিসেবে একের পর এক সেগুলো ছাপল তার থেকেও অবাক কাণ্ড, সেগুলো বিক্রিও হল কয়েক বছর আগে বইগুলো যখন আর পাওয়া যাচ্ছে না, সেই প্রকাশকই বইগুলোর একটা সঙ্কলন বার করল আমিও সুযোগ পেয়ে সেটা উৎসর্গ করলাম আমার নাতি-নাতনিকে বাংলা পড়ার আরও অভ্যাস হবে, যুক্তির ধাঁধা সমাধান করতে গিয়ে মাথাটাও একটু খুলবে
এর কিছুদিন পরে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছি, দেখি আমার বইটা হাতে নিয়ে ভাই-বোন মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে!
কী ব্যাপার?” কন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম
কন্যা নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত বলল, “কী জানি, তোমার বইয়ে কী দেখতে পেয়েছেদাদু অসভ্য কথা লিখেছে বলে সেই থেকে জ্বালাচ্ছে!”
কী অসভ্য কথা?” আমি সত্যিই বিস্মিত
আমি দেখিওনি এই লেখাটা আমাকে শেষ করতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেওদের জিজ্ঞেস কর
কী দেখলি তোরা বইয়ে?” বড়োটাকে জিজ্ঞেস করলাম ছোটোটাকে আমি কব্জা করতে পারি না, ফ্রি স্পিরিট
উত্তর দেবার অবস্থায় নেইখিল খিল করে হাসতে হাসতে পাতা-খোলা বইটা এগিয়ে দিল
দেখলাম, ‘পাঁজা- চন্দ্রবিন্দুটা ঠিক পড়েনি, আর -টাকে হয়তো ওরাবলে ভুল করেছে, কিন্তু হাসির ফাঁকেপাছু, পাছুশুনে মনে হল হয়তো পাঁজা-কে পাছা ভেবেছে, অথবা কোথাও পিছুপড়ে পাছুভাবছে - কে জানে!
যাই হোক, ভুলটা শুদ্ধ করা প্রয়োজনইটের পাঁজা জিনিসটা কী বিস্তারিত বোঝালামপিছনে যাওয়া বা পিছু যাওয়া কী সেটা আর বোঝাতে হল না, ওরা জানে আমার নিজের ধারণা বইটা না পড়াই ছিল ওদের উদ্দেশ্য মায়ের চাপে পড়ে পড়ছিল, এখন একটা অজুহাত পেয়ে পড়া থামিয়েছে

কিন্তু আমার সমস্যার শুরু তারপরে নাতি কিরু বলল, “দাদু, আমাকে খারাপ খারাপ বাংলা কথা শেখাও
দিন আগেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে এটা নিয়ে ওর কথা হয়ে গিয়েছে জানি কিরুর বক্তব্য ছিল, ওর দিয়া যদি ওকে এসব না শেখায়, তাহলে ওর আর কে আছে এদেশে... যে শেখাবে?
দিয়ার কাছে সুবিধা না করতে পেরে এখন দাদুকে ধরেছে সেই একই অস্ত্র... ইমোশনাল ব্ল্যাক-মেল
তোর মাকে জিজ্ঞেস করবলে লাভ নেই প্রথমত কিরু জানে ওর মা এদেশে জন্মেছে, তার বাংলা শব্দ-ভাণ্ডার সীমিত তার থেকেও বড়ো কথা, মা-কে একটু ভয়ও পায়
খারাপ কথা শিখতে চাচ্ছিস কেন?” জিজ্ঞেস করলাম
উত্তর নেই খানিক চাপাচাপির পর কারণটা জানলাম ইদানীং ওর ক্লাসের মনোজিৎ সিং হিন্দি আর পাঞ্জাবি গালাগাল শুনিয়ে কিরুকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে তার কোনো উপযুক্ত জবাব কিরু দিতে পারছে না
মনঃকষ্টর কারণটা বুঝলাম কিন্তু এখানে তো জয়ের সম্ভাবনা নেই!
ওকে বোঝালাম, “পাঞ্জাবিদের সঙ্গে পারবি নাপাঞ্জাবিরা প্রিমিয়ার লিগে খেলে বাঙালিরা বড়োজোর জুনিয়ার লিগে
কথাটা আবার মেয়ের কানে গেল ধমক খেলাম, “বাবা, কী-সব পেরোকিয়ালিজম বাচ্চাগুলোকে শেখাচ্ছ!”
আরে না, এটা তো সত্যভাষণ! প্রাদেশিকতার কোনো ব্যাপারই নয়
সত্যিই, আমাদের বাংলা ভাষা একদিক থেকে মনে হয় অনেক পিছিয়ে আছে
----------
ছবি - অতনু দেব

No comments:

Post a Comment