নীলাঙ্গুরীয়
কথা
তাপসকিরণ
রায়
মনোতোষবাবু
কলকাতায় বাস করেন। ঘাটশিলায় তিন একর জমির ওপর তাঁর একটা বাংলোবাড়ি আছে। পৈতৃক
বাড়ি। বলতে গেলে মাসের পর মাস খালিই পড়ে থাকে। কালেভদ্রে মনোতোষবাবু সপরিবারে
সেখানে ঘুরতে যান। বাংলোবাড়ি দেখাশোনার জন্যে কেয়ারটেকার দামোদর আছে। দামোদর
সস্ত্রীক বাংলোর বাইরের দিকের এক কোনার ঘরে বাস করে।
মনোতোষবাবুর
একমাত্র সন্তান নীলেশ। সেবার ঠিক হল, নীলেশ ও তার বন্ধু অশেষ, অমল, দমন ও সৈকত
মিলে ঘাটশিলার বাংলোবাড়িতে ঘুরতে যাবে। ওরা এমনি প্রতিবছর বন্ধুরা মিলে কোথাও না
কোথাও ঘুরতে যায়। ওরা একই স্কুলের ক্লাস টেনে পড়ে। ঘাটশিলা? সে তো
অনেকদূর! অশেষের মা-বাবা আপত্তি তুলেছিলেন। অন্য বন্ধুদের ঘর থেকেও এমনই বাধা
এসেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও বাধাই টেকেনি। মনোতোষবাবু নীলেশের বন্ধুদের
মা-বাবা সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন, “ভয় নেই, সেখানে আমার বাংলোবাড়ি আছে। আর সেখানকার কেয়ারটেকার দামোদর
আমাদের বহুদিনের বিশ্বস্ত লোক।”
অগত্যা ঠিক
হয়েছিল ছেলের দলের এবারের ট্যুর হবে ঘাটশিলায়। ঘাটশিলা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে পড়ে। কলকাতা
থেকে ঘাটশিলার দূরত্ব প্রায় ২২৫ কিলোমিটার। ট্রেনে পাঁচ-ছ’ঘণ্টার
রাস্তা।
অফুরান
আনন্দ ও রোমাঞ্চ নিয়ে ছেলেরা পৌঁছল ঘাটশিলার বাংলোবাড়িতে। আনন্দ ঘুরতে যাবার, রোমাঞ্চ
নির্জন বাংলোবাড়িতে রাত কাটাবার। শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে মনোতোষবাবুর এই
বাংলোবাড়ি। দেখেই বোঝা যায়,
অনেককাল আগের বাড়ি। অনেকটা পোড়ো বাড়ি বলেই মনে হবে। সামনের দিকে বড়ো বড়ো দুটো
সাবেকি দরজা। একটা খোলা,
অন্যটায় ঢাউস এক তালা ঝুলছে। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা নিয়ে পরিত্যক্ত বাগান।
বাগানের চারদিকের পাকা প্রাচীর এখনও টিকে আছে। বাগানে মাঝে মাঝে গাছগাছড়ার ঝোপঝাড়।
দুয়েকটা মরসুমি ফুলের গাছে অযত্নের মাঝেও ফুল ফুটে আছে। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেরা আসবে
বলে বাগানের জঙ্গল পরিষ্কার করার চেষ্টা চলেছে। বাংলোবাড়িটার কিছুটা ঘষামাজা বলে
মনে হচ্ছে।
বাইরের গেট
পার হলে বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে বাংলোর বড়ো প্রবেশের দরজার দিকে।
সারাদিনটা ঘর-বার, আশেপাশে
ঘুরেফিরে পার হয়ে গেল। সন্ধে নামল। বাংলোবাড়ির নির্জনতা আরও যেন বেড়ে গেল। বাংলো
থেকে লোকালয় একটু দূরে। আশেপাশে কোনও বাড়িঘর নেই।
অশেষের
অনুসন্ধিৎসু মন। সে সন্ধেবেলায় ঘুরে ঘুরে বাংলোর আশপাশ দেখেছে। তার সঙ্গে অমল ছিল
বটে। তারও কৌতূহলী মন আছে। দামোদরদাদুর পরিবার এখানে বাংলোর বাগানের এক কোণের ঘরে
থাকে। মনে হয়, শুরু
থেকে বাংলোর কেয়ারটেকারের থাকার জন্যেই এই ঘরটা বানানো হয়েছিল। ওঁদের বিশেষ সচ্ছল
অবস্থা নয়। দাদুর স্ত্রী,
মানে দিদিমা আর দাদু দু’জনে মাত্র থাকেন এখানে। তখন দিদিমা লাল পেড়ে শাড়ি পরে
দাঁড়িয়ে ছিল। হেসে অশেষের সঙ্গে কথা বলল, “কী নাম তুমার?”
অশেষ তার
নাম বলেছিল, “অশেষ
সরকার।”
এবার দিদা
অমলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর তুমার?”
“অমল রায়,” অমল বলল।
“সইন্ধেবেলায়
এখানে কী করতাছ তুমরা?”
দিদিমা ওদের প্রশ্ন করেছিল। “রাইতে বাইরে থাইক্কো না।”
অশেষ বলল, “কেন?”
দিদা বলেছিল, “জানো তো, এই বাগানে
ভূত আছে।”
ঠিক এমনি
সময় দাদু এসে হাজির হয়েছিল। আর ভূতের প্রসঙ্গ এখানেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। তারপর অমল
ও অশেষ বাংলোর দিকে হাঁটা দিয়েছিল।
এ ছিল
সন্ধেবেলার ঘটনা। সেদিন রাত ন’টায় ওরা খাওয়াদাওয়া সেরে নিল। পালঙ্কে ওরা কেউ শুল না।
মেঝেতে ঢালাও বিছানা করে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে দমন জিজ্ঞেস করল, “নীলেশ, তোদের
বাংলোয় ভূত-টুত নেই তো?”
অশেষ জবাবে
বলল, “ভূত
বলে কিছু আছে নাকি? ওসব
মনের ভয়।”
সৈকত একটু
ভিতু প্রকৃতির। সে সরব হল। “না রে, অলৌকিক কিছু তো আছে।”
নীলেশ কিছু
সময় চুপ করে থেকে বলল,
“শুনেছি, বাংলোর
বাইরে যে বাগান আছে সেখানে নাকি ভূত আছে। রাতে সারা বাগান ঘুরে বেড়ায়।”
“বাংলোর
ভেতরে ঢোকে না?” অমল
জিজ্ঞেস করেছিল।
নীলেশ
বলেছিল, “না।
দামোদরদাদু বলেছে, বাংলোর
ভেতরে ভূত ঢোকে না। অবশ্য ভূতের ব্যাপারে বাবা বলেছেন, ওসব বাজে
কথা।”
গল্পের মাঝে
দমনের চোখেই প্রথম পড়ল। ও অবাক হয়ে বলে উঠল, “আরে নীলেশ, তোর হাতের
আংটিটা তো খুব জ্বলজ্বল করছে!”
তারপরই
ব্যাপারটা সবাই লক্ষ করল। সত্যি, নীলেশের হাতের আংটিটা আলোর আবডালে ছায়ার দিকে গেলেই কেমন
নীল আলো নিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠছিল! নীলেশ বলে উঠল, “আরে যাহ্, আমি ভুলেই
গেছি, এখানে
আসার আগে মা আমাকে আংটি খুলে রাখতে বলেছিল।”
অশেষ
কৌতূহলী হল। “কেন?”
হাতের আংটি
আবার নীল আলো হয়ে জ্বলে উঠল। নীলেশ বলল, “এই আংটিটা না অনেক দামি। এর মধ্যে যে
পাথর আছে তার নাম নীলম। তার দাম পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা।”
“ওরে বাবা!” অমল ও দমনের
গলা থেকে একই কথা একসঙ্গে বেরিয়ে এল।
দমন বলল, “যদি হারিয়ে
যায়?”
অমল হেসে
বলল, “আমরা
তো সত্যান্বেষী দল আছি রে!”
সবাই হেসে
উঠল। আসলে কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। পাড়ার কয়েকটা ছোটোখাটো চুরির ব্যাপার ওরাই সলভ
করেছে। স্থানীয় পুলিশ অন্য কাউকে চোর বলে ধরে রেখেছিল। সেক্ষেত্রে আসল চোরকে ওদের
দলই ধরে দিতে পেরেছে। স্থানীয় দারোগাবাবু অশেষের পিঠ চাপড়ে বলেছিল, “সাবাস!
তোমাদের প্রশংসা করতেই হয়। আশা করি ভবিষ্যতেও তোমাদের সাহায্য পাব। তবে হ্যাঁ, বিনা
হাতিয়ারে বেশিদূর এগিও না যেন। এতে লাইফের রিস্ক থাকে।”
বাংলোর
সামনের লনের দরজায় হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল। ওরা সবাই চমকে উঠল। দেখল কেউ
নেই। সবাই ভেবেছিল, বাংলোর
কেয়ারটেকার দামোদরদাদু হবে। কিন্তু না, কেউ এল না। দমন ভয় পেয়ে বলে উঠল, “বাগানের ভূত
এল না তো!” ও
ভয় পেয়ে অমলের একটা হাত চেপে ধরল।
অমল বলল, “ভয়ের কিছু
নেই রে, হাওয়া
হবে।”
একসঙ্গে
পাঁচ বন্ধুর জমায়েত ঘটেছে। ওদের গল্পের আর শেষ নেই। ইতিমধ্যে একঘণ্টা কেটে গেছে।
রাত আরও খানিকটা গভীর হল। ভূতের প্রসঙ্গ বাদ পড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। দমনের মাত্র
ঘুম ঘুম লাগছিল, এমনি
সময় আবার ক্যাঁচ শব্দ করে লনের দিকের দরজা খুলে গেল। নির্জন রাতের স্তব্ধতার মাঝে
সে শব্দ ভয়ংকর হয়ে ওদের কানে বেজে উঠল। পরক্ষণেই ওরা কেয়ারটেকার দাদুকে দেখতে পেল।
তাঁর হাতের ট্রেতে পাঁচ কাপ দুধ। সবার জন্যে তিনি দুধ এনেছেন।
“দাদাবাবুরা, তোমাদের
জন্যে দুধ। খেয়ে নাও।”
কেয়ারটেকার দাদু ওদের কাছে এসে বলে উঠল। দাদুর বয়েস সত্তর পার হয়েছে বোঝা যায়।
দমন অবাক হয়ে নীলেশের আংটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এক এক কাপ দুধ খেয়ে নিল ওরা।
কারও ঘুম
আসছিল না। ঘরের বাইরের দিকের জানালা বন্ধ করা আছে। রান্নাঘরের সামনের দিকের
জানালায় একটা পাট খোলা আছে। ঘরের বড়ো বড়ো দুটো দরজা। একটা ভেতরের ঘরে যাবার জন্যে, অন্যটা লনে
গিয়ে একদিকে রান্নাঘরে,
অন্যদিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাংলো থেকে বাইরে বেরোবার দরজা পর্যন্ত যাবার
জন্যে। কিচেনের ভেতর দিয়েও বাংলোর বাইরে বেরোবার একটা বড়ো দরজা আছে। সেটা সবসময়ের
জন্যে তালা দেওয়া থাকে।
দাদু বাংলো
থেকে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অমল ও অশেষ দু’জনে গিয়ে বাংলোর প্রধান দরজাটা
ভালোভাবে বন্ধ করে দিল। তারপর নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ করল। বাইরের বাতাস প্রবেশের
জন্যে লনের দিকের জানালার একটা পাট খোলাই রাখা হল। এমনিতে ভেতরদিকটা সেফ।
চোর-ডাকাত, ভূত-প্রেত
যা কিছুর উৎপাত ঘটতে পারে তা কেবল বাইরেই দরজা ও জানালা দিয়েই সম্ভব।
রাত এগারটা
বেজে গেল। বন্ধুরা সবাই জেগে আছে। একমাত্র নীলেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাকি
চারজন কথাবার্তায়, গল্পে
সময় কাটাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ ভেতরের জানালায় খুট খুট করে দু’বার শব্দ
হল। ওরা সবাই চকিত হয়ে জানালার দিকে তাকাল। ওদের সবার মনে হল, একটা মনুষ্য
আকৃতির কালো ছায়া যেন জানালার পাশ থেকে সরে গেল। অশেষ স্পষ্ট দেখেছে। অশেষ ও অমল
বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। পা টিপে টিপে ওরা জানালার ধারে
গিয়ে বাইরের দিকে উঁকি মারল। না, কিছু নেই। বাইরের, আশেপাশের যতটুকু জায়গা চোখে পড়ছে
হালকা পাওয়ারের লাইটের আলোয় দীর্ঘ লনের দু’দিকের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল মাত্র।
বেশ কিছু
সময় কেটে গেল। দমন বিছানার মাঝখানে গিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। সৈকত ভয় পেয়েছে। সে
চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে আছে। নীলেশের কোনও সাড়াশব্দ নেই। সে অসাড়ে ঘুমাচ্ছে। তার
কোনও নড়নচড়ন নেই।
পরদিন সকাল।
বেলা প্রায় ন’টা
বাজে। পাশের ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে সবাই। চা-নাস্তা খেতে ব্যস্ত। নীলেশ তার
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েই আঁতকে উঠল। চিৎকার করল, “আমার আংটি?”
বন্ধুরা
সবাই জানে, আংটির
শুধু পাথরটার দাম পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা! খবরটা হাওয়ার মতো করে ছড়িয়ে গেল যে নীলেশের
বহু মূল্যবান নীলাঙ্গুরীয় চুরি গেছে। এবার, এবার কী হবে? নীলেশ মাথায়
হাত দিল। বন্ধুদের ঘুরতে আসার আনন্দ মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল। এবার কী করণীয়?
নীলেশ লক্ষ
করল, তার
আংটি পরা আঙুলে কেমন তেল চিটচিটে ভাব। অশেষ নীলেশের আঙুল দেখল। সে গম্ভীর হয়ে বলল, “আংটি খোলার
জন্যে চোর তেল ব্যবহার করেছে।”
নীলেশের
আঙুল থেকে অশেষ সর্ষেতেলের গন্ধ পেল। ঘরের বিছানা, বালিশ, মেঝে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হল।
আংটি কোথাও পাওয়া গেল না। অশেষ আগেই বুঝেছিল, আংটি এভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নীলেশের আংটি নির্ঘাত চুরি গিয়েছে।
“পুলিশে খবর
দিতে হবে,” অশেষ
বলে উঠল।
সৈকত বলল, “তার আগে
নীলেশের বাবাকে জানাতে হবে।”
নীলেশ সঙ্গে
সঙ্গে বলে উঠল, “না
না, বাবাকে
বলা যাবে না।”
অমল বলল, “তাহলে
পুলিশকে?”
দামোদরদাদু
বলে উঠলেন, “না
না, দাদাবাবুকে
না জানিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া উচিত হবে না।”
নীলেশ
কান্না ভাব নিয়ে বলে উঠল,
“অশেষ, তুই
একবার দেখবি রে? আমরা
আগে সবাই মিলে অনেক কেসের ফয়সালা করেছি। এটাও তো এত বড়ো কিছু না।”
অশেষ
কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে নিল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, বিকেল
পর্যন্ত দেখা যাক তাহলে। তারপর না হয় কাকুকে জানিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া যাবে।”
কাল রাতের
কথা মনে এল অশেষের। নীলেশের নীলাঙ্গুরীয়র মূল্য শুনেই দমনের চোখদুটো অদ্ভুতভাবে
জ্বলে উঠতে দেখেছে অশেষ। দমন একটু লোভী প্রকৃতির বটে। সে তার বাবার পকেট প্রায়ই
মারে। বলে, “বাবার
টাকার হিসেব নেই রে!”
আজ সকাল
থেকে দমন ও সৈকত একটু আলাদা আলাদা থাকছে। সৈকত ভিতু প্রকৃতির। তবে অন্যের ভালো
কিছু দেখলে সে একটু ঈর্ষান্বিত হয় বটে। লোভে পড়ে সেও এ-কাজ করতে পারে। বাকি রইল
অমল আর ও স্বয়ং। না,
অমল সাধু প্রকৃতির ছেলে। ও সাহসীও বটে। কিছু ঘরোয়া চুরির ক্ষেত্রে
সত্যান্বেষীর মতো অমলও তার সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তাই অশেষের মনে হয়েছে, অমল এ-কাজ
করতে পারে না। বাকি থাকল দামোদরদাদু। সে তো রাতে ওদের সঙ্গে ছিলই না। তাই তার কথা
আপাতত ভাবা যাচ্ছে না। অশেষ তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে চলেছে।
আপাতত দমন ও সৈকতের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু ওরা কোথায়? ঘরে তো নেই!
তবে কোথায় চলে গেল? অশেষ
দেখল, নীলেশ
ও অমল চুপ করে বসে আকাশপাতাল ভেবে চলেছে। অশেষকে দাঁড়াতে দেখেই অমল বলে উঠল, “দমন আর
সৈকতের সঙ্গে কথা বলে দেখবি কি? ওরা হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে গেল।”
অশেষ বলল, “হ্যাঁ, তাই ভাবছি।
তুই আমার সঙ্গে আয়, ওদের
এখনই খোঁজ করতে হবে।”
এবার নীলেশের দিকে তাকিয়ে বলল, “নীলেশ, তুই একটু বস, আমরা ওদের
দেখে আসছি।”
অশেষ ও অমল
দু’জনে
বাইরে বেরিয়ে গেল।
বাংলোর
বাইরে বিরাট বাগান। বাগানের ধার ঘেঁষে বড়ো বড়ো মাথা ঝাপড়ানো আম, জাম, কাঁঠালগাছ।
তার মাঝে মাঝে একটা দুটো পেয়ারাগাছও আছে। মাঝখানে ফুলের গাছ - রজনীগন্ধা, জবা, একটা
চাঁপাগাছও আছে। মাঝে মাঝে কিছু জায়গা পরিষ্কার করা, কিছু কিছু ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় ছড়িয়ে
ছিটিয়ে হয়ে আছে। অশেষ ও অমল দেখল, দূরে একটা পেয়ারাগাছের নিচে সৈকত দাঁড়িয়ে আছে। আর দমন সেই
গাছের গোড়ায় বসে কিছু যেন করছে। অশেষ আর অমল তাড়াতাড়ি ওদের কাছে গেল। ওদের
দেখামাত্র দমন চট করে উঠে দাঁড়াল। সবচেয়ে বেশি সন্দেহভাজন দমনকেই মনে হচ্ছিল। অশেষ
গাছের গোড়ায় গিয়ে দেখল, একটা বেশ বড়ো গর্ত। দমনকে ও জিজ্ঞেস করল, “তুই ওখানে
বসে কী করছিলি?”
“এমনি
দেখছিলাম। ইঁদুরের গর্ত হবে।” দমন অনেকটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল।
অমল গর্তটা
দেখে বলল, “তুই
ওতে মাটিচাপা দিচ্ছিলি কেন?
যদি গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে আসত?”
সৈকত বলল, “আমিও ওকে
তাই বলছিলাম। কিন্তু ও আমার কথা শুনলে তো!”
অশেষ ভাবছিল, দমন আর সৈকত
দু’জনে
সাঁট করে এ-কাজটা করেনি তো?
আর ওই গর্তে কেন দমন মাটি চাপা দিচ্ছিল? অশেষ এবার স্বাভাবিক হয়ে হেসে বলে
উঠল, “অমল, দেখ তো ওই
গর্তে ইঁদুর আছে কি না।”
অমল
ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল। সে আর কথা না বলে গর্তের কাছে গিয়ে মাটি সরাতে লাগল। দমন
ও সৈকত উভয়ে বলে উঠল,
“সাবধান, সাপ
উঠে আসবে কিন্তু!”
অমল কিছুটা
ভয়ে ভয়ে মাটি উঠিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু না, গর্তের মাটি অনেকটা সরিয়েও সাপ, ইঁদুর বা
আংটি কিছুরই হদিস মিলল না। অশেষ এবার দমন ও সৈকতকে বলে উঠল, “তোরা এমন
নিশ্চিন্ত আছিস কী করে বল তো? জানিস তো, নীলেশের আংটি চুরি গেছে! তারপরেও তোরা খেলে বেড়াচ্ছিস!”
দমন বলল, “কোথায় খেলছি? আনন্দ তো সব
মাটি হল, বল?”
অশেষ এবার
গম্ভীর হয়ে বলল, “তোরা
এবার ঘরে আয়, কথা
আছে।”
পাঁচ বন্ধু
এবার একসঙ্গে বাংলোর ঘরে এল। অশেষ এবার কোনওরকম ভণিতা না করেই বলে উঠল, “দেখ, আমাদের
বন্ধু নীলেশের এত মূল্যবান একটা জিনিস চুরি গেছে। ঘরে আমরা ছাড়া তো আর কেউ ছিলাম
না। তাহলে আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ জিনিসটা নিয়েছে।”
মাঝখানে দমন
একটু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
“এত সন্দেহ করছ যখন তখন আমার সব জিনিস সার্চ করে দেখ।”
একটু দম
নিয়ে দমন প্রশ্ন করার মতো বলে উঠল, “বন্ধুদের মধ্যে এত অবিশ্বাস?”
“তবুও বন্ধুর
জিনিস দেখতে হবে, বন্ধুর
বাংলোতেই আমরা সবাই যখন উঠেছি,” বলল অমল।
অশেষ বলল, “দেখ, আমরা বন্ধুর
আতিথেয়তায় এখানে এসেছি। তাই বলছি, আয় আমরা সবাই মিলে সবার জিনিসপত্র সার্চ করে দেখি।”
এ সময়
কেয়ারটেকার দাদু ধীরে ধীরে ঘরে এসে প্রবেশ করল। বলল, “পাইলা তোমাগ জিনিস?”
অশেষের মনে
পড়ে গেল। হ্যাঁ, আমাদের
মধ্যে আর একজনের উপস্থিতি সামান্য সময়ের জন্যে হলেও তো ছিল। আর সে হল দামোদরদাদু।
অশেষ দাদুর মুখের দিকে তাকাল। বিমর্ষ মুখ। হতেই পারে, মালিকের
ছেলের মূল্যবান আংটি খোয়া গেছে! সে তবুও বলল, “আচ্ছা দাদু, এ-ব্যাপারে
তুমি কিছু কি বলতে পার?
বাইরে থেকে কোনও চোর কি ভেতরে আসতে পারে?”
“না না, তা কী কইরা
হইবো? বাইরের
দরোজা জালনা সব তো বন্ধ ছিল,” দাদু বলে উঠল।
অশেষের মনে
পড়ল রাতের ভূতের কথা। সে আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দাদু, তুমি কি
জানো, বাংলোবাড়িতে
কোনও ভূত আছে কি না?”
দাদু বলল, “না, আমি জানি না
বাংলোতে ভূত আছে বইল্লা।”
“তবে তোমার
স্ত্রী মানে দিদিমা যে বলল,
ভূত আছে বলে?” অশেষ
আবার প্রশ্ন করল।
“ও, তাই নাকি? দিদিমা
কৈছে!” অবাক
হয়ে প্রশ্ন করে দাদু। তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে, “তুমাগ খাবার তৈরি, তুমরা আস।” দাদু আর কথা
না বলে ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
অশেষ ঠিক
বুঝতে পারে না, দাদু
কি নীলেশের আংটি চুরির ব্যাপারেই এতটা আপসেট, নাকি অন্যকিছু আছে এর মধ্যে? সত্যান্বেষীদের
ধর্ম নাকি সন্দেহ করা। আর হতেই পারে অশেষ দাদুকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে।
আধঘণ্টা সময়
নিল। বন্ধুরা একে অন্যের সব জিনিসপত্র সার্চ করে নিল। না, আংটি নেই।
এমনকি সবার পরনের শার্ট-প্যান্ট, জুতো-মোজা সার্চ করেও কিছু পাওয়া গেল না। নীলেশ নিজের জিনিস
সবকিছু একবার খুঁজে দেখে নিয়েছে। তার মনে হয়েছে কে জানে সে নিজেই ভুলে আঙুল থেকে
আংটি খুলে কোথাও রেখে দিয়েছে কি না!
অশেষ বুঝতে
পারছে না, তবে
কি বন্ধুদের কেউ চুরি করে তা কোথাও সরিয়ে রেখেছে? এ প্রশ্ন থেকেই গেল। সে লক্ষ করেছে, বন্ধুদের
মাঝে কারও হাতেই চটচটে তেলের আভাস মেলেনি। তবে এটাও মনে হয়েছে যে দমন তার হাত যেন
সাবান দিয়ে স্বাভাবিকের থেকে বেশি ধুয়ে নিয়েছে। তার হাতে একটা রুক্ষ ভাব আছে।
স্বাভাবিকের থেকে হাত তার বেশি পরিষ্কার লাগছে। তার আঙুলগুলো বারবার জল-সাবান দিয়ে
ধোয়ার জন্যে কুঁচকানো কুঁচকানো ভাব এসে গেছে। আঙুল দেখাটা অবশ্য অশেষ চুপি চুপি
সেরে নিয়েছে।
দমন ও
সৈকতকে তাকে তাকে রাখা হল। ওরা যদি আংটি অন্য জায়গায় সরিয়ে থাকে তাহলে ওরা কোনও না
কোনও সময় সেটা নিতে বা দেখে আসতে সেখানে যাবে। অশেষ ও অমল এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে
কথা বলছিল।
অমল বলল, “এবার চুরিটা
নিয়ে কীভাবে চিন্তা করছিস?”
অশেষ জবাব
দিল, “অন্য
একটা দিক ভাবছি। আচ্ছা,
তুই লক্ষ করেছিস,
কাল রাতে নীলেশ অঘোরে ঘুমিয়ে ছিল? এর মধ্যে চোরের কি কোনও হাত ছিল?”
অমল বলল, “আমার মনে হয়, বন্ধুরা
এমনটা করতে পারবে না। নীলেশকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে...”
অশেষ বলল, “তাহলে
অন্যদিক দিয়েও ব্যাপারটা ভাবতে হচ্ছে।”
অমল বলল, “কেয়ারটেকার
দাদুকে নিয়ে?”
অশেষ বলল, “হ্যাঁ, ঠিক তাই।
একমাত্র সেই পারে ঘুমের ওষুধ মেশাতে। কাল রাতের দুধে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল না তো? রাতের ভৌতিক
ছায়ার ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছি।”
অমলকে নিয়ে
অশেষ এবার বাংলো-ঘরের বাইরের দরজা পরীক্ষা করতে গেল। ওরা যে ঘরে আছে তার দুটো
দরজা। সর্বসাকুল্যে বাংলোতে দশ-বারোটা ঘর। তাছাড়া আরও দুটো দুটো করে অতিরিক্ত
লেটব্যাথ ও কিচেন রয়েছে। তবে ভেতরের ঘরগুলো বন্ধুরা মিলে কালই দেখে নিয়েছে। ওদিকের
সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করা আছে। যাতায়াত চলছিল সবসময় বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের
দরজাটা দিয়ে। ওদের থাকার ঘর থেকে বাইরে বেরোলে লম্বা লন। তার একদিকে কিচেন আর
অন্যদিকে সোজা এগোলে তারপর দরজা যেটা দিয়ে সবসময় বাইরের যাতায়াত চলে। হ্যাঁ, বাইরে
বেরোবার আরও একটা দরজা আছে। সেটা হল কিচেনের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করার। রাতে দাদুর
দুধ দিয়ে যাবার পর বাইরের নিয়মিত যাতায়াতের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কিচেন দিয়ে বাইরে যাবার দরজাটাও ওরা বন্ধ দেখে নিয়েছিল। তাহলে রাতে চোর বাইরে থেকে
আসবে কীভাবে?
অমল ও অশেষ
চুরির রহস্যের কিনারা করে যাচ্ছিল বটে কিন্তু বুঝতে পারছিল না যে এবার কোন সূত্র
ধরে এগোবে। কেয়ারটেকার দাদুর কথা ভাবলে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে বন্ধুরা ছাড়া
এই আংটির কথা বাইরের লোক জানবে কী করে?
খেতে বসতে
একটু বেলাই হয়ে গেল। বেলা দুটো বেজে গেল। অশেষ দাদুকে লক্ষ করে যাচ্ছিল। ওকে বেশ
অন্যমনস্ক বলে মনে হচ্ছিল।
“দাদু, কী হয়েছে
তোমার?” অশেষ
প্রশ্ন করে বসল।
একটু চমকাল
কি দাদু? “না
না, কিছু
তো হয় নাই।” মনে
হল দাদু যেন নিজের অন্যমনস্কতার ভাবটুকু সামলে নিয়ে কথাগুলো বলল।
“আচ্ছা দাদু, বাইরে তালা
দেওয়া গেটের চাবি কি তোমার কাছে থাকে?”
দাদু একটু
আমতা আমতা করে বলল,
“হ, মানে
আমার কাছে...”
“কাল রাতে
তালা কি তুমি খুলেছিলে?”
প্রশ্ন করে অশেষ।
“না, তালা খুলতে
যামু ক্যান?” দাদু
বলল।
সন্দেহ
বাড়তে থাকে। দাদুর দিকেই সন্দেহের ভারটা কি বেশি বলে মনে হচ্ছে? অমলের মনে
হল, দাদু
কি তাহলে কালকে রাতে নীলেশের আংটির কথা আড়ি পেতে শুনছিল? আর যদি তা
না হয় তবে তার ওপর সন্দেহ করার কিছুই নেই।
এ ব্যাপারটা
অশেষও ভেবেছে। তার মনে হয়েছে, রাতে দুধ দেবার সময় যখন দাদু আসছিল তখন দরজা খোলার আগে
আংটির ব্যাপারে বলা নীলেশের কথাগুলো তার কানে গিয়েছিল। আরও একটা প্রশ্ন অশেষের মনে
এসেছে - আচ্ছা, রাতে
দিদিমাও কি এসেছিল বাংলোতে?
নতুবা রাতে দরজায় দ্বিতীয়বার, না তৃতীয়বার ক্যাঁচ করে শব্দ হয়েছিল কেন? যেখানে লনের
দিকের দরজায় আদৌ হাওয়া আসার কথা নয়! অশেষের সে সময়টা মনে হয়েছিল যেন দরজার ওপাশে
দ্বিতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে। সত্যি কি তাই ছিল?
অশেষ আর অমল
এবার বাংলোর বাইরে তালা দেওয়া দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পরীক্ষা করে যেটুকু বোঝা
গেল যে তালায় দুয়েকদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই চাবির ঘষা লেগেছে। কেয়ারটেকার দাদুর কথায়
জানা গেছে যে এ দরজা বহুদিন পর্যন্ত খোলা হয়নি। এখন তা হলে প্রশ্ন থেকে যায়, তবে?
অবশেষে
দাদুকে গিয়ে অশেষ আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা দাদু, তুমি কালকে
কি কিচেনের দরজা দিয়ে বাংলোতে ঢুকেছিলে?”
“না তো!
তুমরা যে দরজা দিয়া আস যাও,
সেইখান দিয়া আমি যাওয়া আসা করি। অন্য দরজা তো অনেকদিন হইল খুলাই হয় না।” একটু থেমে
দাদু আবার বলল, “ক্যান, দাদুরা? তুমরা কি
আমারে সন্দেহ করতাছ নাকি?”
এবার দাদু কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বলে উঠল, “আমি দাদু, গত পঁচিশ
বচ্ছর ধইরা এখানে কাজ করতাছি। কেউ কোনও দিন...”
দাদুর কথার
মাঝে অমল ফস করে বলে উঠল,
“দেখো দাদু, অভাবে
স্বভাব নষ্ট হতেই পারে।”
দাদু আর কথা
না বলে মাথা নিচু করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
বর্তমানে
সন্দেহের দিক দিয়ে দাদু প্রথম স্থানে আছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে দমন। হতে পারে সে
নীলেশের আঙুল থেকে আংটি খুলে নিয়ে রাতেই বাংলোর বাইরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ও ঘরে
ফেরার আগে সেটা বের করে নিয়ে যাবে। আর তৃতীয় সন্দেহের তালিকায় আছে সৈকত। তবে সৈকত
থাকলে মনে হয় না যে সে একা এই কাজ করেছে বলে। তার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে দমন।
দেখতে দেখতে
বেলা চারটা বেজে গেল। হঠাৎ অশেষের একটা কথা মনে এল। ও অমলকে বলল, “একটা কাজ
করতে হবে। দাদুকে বলে আসতে হবে যে পুলিশ আসার আগে পর্যন্ত কেউ যেন বাংলোবাড়ির
বাইরে না যায়।”
তার মানে
একরকম ঠিকই হয়ে গেল যে সন্ধে পর্যন্ত আংটি না পেলে নীলেশ তার বাবাকে আংটি চুরির
ব্যাপারটা জানিয়ে পুলিশে রিপোর্ট করবে।
অমলও নীলেশ, দমন ও
সৈকতকে বলেছিল, “আমরা
কিন্তু পুলিশ না আসা পর্যন্ত কেউ বাংলোর বাইরে বেরোব না।”
কথাটা শুনে
দমন খুব রেগে গিয়েছিল। সে বাইরে যাবেই এমনি যেন প্রতিজ্ঞা করেছিল। ও অশেষ ও অমলের
সঙ্গে একরকম ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিল। শেষে ঝগড়া, মারামারি করেই ও বাংলোর বাইরে বেরিয়ে
গিয়েছিল। অশেষ একটু কঠিন হয়ে বলেছিল, “না, তুই যাবি না!”
“কেন যাব না? আমি চোর নই।
এখানে ঘুরতে এসেছি, ঘুরতে
যাব।” তোড়ের
মাথায় কথাগুলো বলে দমন হনহন করে ঘরের বাইরে বেরোতে গেল।
“বেরোবি না
তুই।” অমলও
দমনকে বাধা দিয়েছিল।
সে এসে
দমনের কলার চেপে ধরেছিল। আর দমন আচমকা এক ঘুসি মেরে দিয়েছিল অমলের নাকে-মুখে। অমল
তার নাকমুখ চেপে ধরে থাকল। নাক থেকে তার রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। এমন পরিস্থিতি কেউ
আশা করেনি। দমন আর কোনও দিকে না তাকিয়ে একরকম ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল বাংলোর বাইরে।
অশেষ তাড়াতাড়ি তার ফার্স্ট-এড বক্স নিয়ে এল। অমলের বিশেষ একটা চোট আসেনি। নাক থেকে
একফোঁটা রক্ত পড়েছিল ঠিকই। অমল একটু সুস্থ হলে সৈকত বলল, “আমিও ঘুরতে
বের হচ্ছি।”
সেও কারও
কোনও কথা শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত পা চালিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। মনে হল, সে দমনকেই
অনুসরণ করছে। নীলেশ,
অমল ও অশেষ হতবাক হয়ে সৈকতের যাবার পথের দিকে চেয়ে থাকল। হঠাৎই এমন অপ্রিয়
ঘটনা ঘটে যেতে পারে এটা কারও ধারণার মধ্যেই ছিল না। অমল, নীলেশ ও
অশেষের মধ্যে দমন ও সৈকতের প্রতি আরও সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকল। নীলেশের বদ্ধ-ধারণা
হয়ে গেল যে তার আংটি দমন ও সৈকতই চুরি করেছে।
অশেষ কোথাও
বের হয়নি। তাকে যে এখানে পাহারা দিতে হবে। কেয়ারটেকার দাদু ও দিদিমাকে বাংলোবাড়ির
সীমানার বাইরে যাওয়ায় বাধা দিতে হবে যে!
এখন করণীয়
কী? ভাবছিল
অশেষ। যত ভাবছিল ততই যেন ওর মনে হচ্ছিল, না দমন ও সৈকত বোধহয় এ-কাজ করেনি। আর
তাছাড়া ওরা ফিরে এলে ওদের সার্চ করে ওদের কাছ থেকে আংটি বের করে নেওয়া যেতেই পারে।
আর দেরি না
করে অশেষ অমলকে নিয়ে দ্রুত দাদুর ঘরের দিকে বেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে দাদু বা দিদিমা
কেউ যদি বাংলোর বাইরে চলে গিয়ে থাকে তবে, তবে অনেক কিছু মিস হয়ে যাবে।
অমল দাদুর
ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। ঘরের দরজা খুলে গেল। দাদু সামনেই দাঁড়িয়ে। অশেষ বলল, “দাদু, দিদিমা ঘরে
আছে তো? আজকে
আমরা কেউ বাংলোর বাইরে বের হব না। সন্ধেবেলায় পুলিশ আসবে।”
পুলিশের কথা
শুনেই হবে ঘরের ভেতর থেকে দিদিমা বলে উঠল, “ক্যান, তুমরা পুলিশ নাকি? আমরা
একশোবার বাইরে যামু।”
অমল বলে উঠল, “না দিদিমা, যে বাংলোর
বাইরে যাবে পুলিশ কিন্তু তাকেই সন্দেহ করবে।”
অমল দিদিমার
গলা শুনতে পেল। “অত
সহজ না!”
দাদুর ঘর
থেকে ওরা ফিরে এল। সন্ধে হতে আর বেশি দেরি নেই। দমন আর সৈকতের ওপর অমল ও অশেষ নজর
রাখছিল। ওরা বাইরে থেকে ফিরে এসেছে। ওদের হাবভাব দেখে কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না।
আর বেশি একটা সময় নেই। সন্ধে অবধি সত্যান্বেষী অশেষ ও তার সহায়ক অমলের সময়। তার
মধ্যে আংটি চোর ধরা না পড়লে অশেষের আর কিছু করার থাকবে না। তারপর পুলিশ আসবে। হঠাৎ
অশেষের কী যেন মনে হল,
সে অমলের একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলে উঠল, “চল, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।”
“কোথায়?” প্রশ্ন
করেছিল অমল। এখন উত্তর দেবার সময়টুকুও বুঝি নেই। ওরা দ্রুত কেয়ারটেকার দাদুর ঘরের
দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের কাছে গিয়েই ওরা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ওরা ঘরের বাইরে থেকেই দাদু
ও দিদিমার বাকযুদ্ধ শুনতে পাচ্ছিল।
দাদু বলছে, “আমি যামু
না।”
দিদিমা বলছে, “তোমায় যাইতে
হইবো। না হইলে পুলিশ তুমার কমরে দড়ি বাইন্ধা টানতে টানতে থানায় লইয়া যাইবো।”
দাদুর গলা
শোনা যায়, “এর
লাইগ্গা তুমি দায়ী। তুমার জন্যে বাধ্য হইয়া আমি...”
“চোরের লগে
তুমিও বড়ো চোর ছিলা,”
দিদিমা ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে।
অশেষ ও অমল
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আংটি চোর কে বা
কারা। দাদু-দিদিমার বচসার মাঝখানে ওরা হুড়মুড় করে ওদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। অশেষ
এবার দাদু ও দিদিমাকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, “আমরা জেনে গেছি চোর কারা।”
দাদু থমকে
গেল। দিদিমা তবুও বলে উঠল,
“কারা?”
“তোমরা। আমরা
তোমাদের সবকথা শুনে ফেলেছি। এখন পুলিশ আসবে, তোমাদের দু’জনকে ধরে
নিয়ে যাবে।” গম্ভীর
গলায় অশেষ কথাগুলো আওড়াল।
দিদিমা তবুও
চিৎকার করে উঠল, “আমরা
চুরি করি নাই!”
অমল কঠোর
গলায় বলে ওঠে, “চোরের
মায়ের বড়ো গলা? এটা
আমরা জানি।”
অমল
তাড়াতাড়ি বন্ধুদের সবাইকে ডেকে আনতে চলে যায়। আর মিনিট দুইয়ের মধ্যেই বন্ধুরা সবাই
এসে হাজির হয়। সবাই জেনে গেছে, বাংলোর কেয়ারটেকার দাদু আর তার স্ত্রী, মানে দিদিমা
নীলেশের নীলাঙ্গুরীয় চুরি করেছে। এবার অশেষ অনুরোধের সুরে বলে ওঠে, “দেখো দাদু, আমরা
ব্যাপারটা পুলিশকে জানাব না। আর আশেপাশের লোকেরা কেউ এ-কথা জানতে পারবে না যদি
তোমরা নীলেশের আংটিটা তাকে ফেরত দিয়ে দাও।”
অমল বলে উঠল, “তা না হলে
সবাই জেনে যাবে। এমনকি নীলেশের বাবা জানতে পারলে তোমার চাকরিটাও কিন্তু যাবে!”
দাদু নেতিয়ে
পড়েছিল। দিদিমা ধীরে ধীরে নত হয়ে গিয়েছিল। এবার দাদু ও দিদিমা ঘর থেকে বের করে
নিয়ে এল নীলেশের নীলাঙ্গুরীয়। সেটা নীলেশের হাতে তুলে দিয়ে দাদু ও দিদিমা উভয়ে
নীলেশের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সবার সামনে দাদু স্বীকার করল যে সে রাতে
কিচেনের তালা খুলেছিল। সে স্ত্রীর প্ররোচনায় নীলেশের দুধে রাতে ঘুমের ওষুধ
মিশিয়েছিল।
অশেষ
জিজ্ঞেস করল, “তুমি
অত রাতে ঘুমের ওষুধ কোথায় পেলে?”
দাদু জবাব
দিল, “তুমাগ
দিদিমারে মৈধ্যে মৈধ্যে এই ওষুধ খাইতে হয়।”
অশেষ প্রশ্ন
করে, “রাতে
দুধ দেবার সময় তোমার সঙ্গে দিদিমাও কি ছিল?”
“হ।” দাদু জবাব
দেয়।
“বুঝতে
পারলাম, দুধ
দেবার সময় দিদিমাও বাংলোয় এসেছিল। সে কারণেই বাংলোর ঘরের দরজায় তৃতীয়বার ক্যাঁচ
করে আওয়াজ হয়েছিল।” অশেষ
বলল। “আর
রাতে ভূতের ভয় তুমি,
না দিদিমা দেখিয়েছিল?”
দাদু জবাবে
বলল, “না, আমি না।
আসলে তুমার দিদিমা মাঝ রাইতে আরও একবার গেছিল। জানালা দিয়া উঁকি মাইরা দেখতে গেছিল
তুমরা ঘুমাইয়া পড়ছ কি না।”
“তবে কি পরে
আবার তুমি চুরি করতে এসেছিলে বাংলোয়?” এবার অমল প্রশ্ন করে।
দাদু বলল, “আমার ইচ্ছা
ছিল না। তোমাগ দিদিমা আমারে জোর কইরা...”
অশেষ প্রশ্ন
করল, “নীলেশের
আঙুলের আংটি খুলতে অসুবিধা হয়নি তোমার?”
“না। কারণ, তুমাগ
দিদিমা আগেই কৈছিল, আঙুলে
তেল লাগাইলে আংটি খুলতে সহজ হইবো।”
অমল জিজ্ঞেস
করল দাদুকে, “তোমরা
কীভাবে জেনেছিলে নীলেশের আঙুলে মূল্যবান আংটি আছে?”
দাদু বলল, “আসলে আমি
রাইতে তোমাদের দুধ দিমু কি না জানতে আইছিলাম। তখনও সঙ্গে তুমাগ দিদিমা ছিল। তার
ইচ্ছা ছিল তুমাগ লগে কথা কওয়ার। দরজা সামান্য খুইল্লা তোমাগ ঘরে ঢুকার আগেই আমাগ
কানে আইলো নীলেশের কথা। আমরা দরজার পিছনে খাড়াইয়া থাকলাম, নীলেশের কথা
শুনলাম। তোমাগ দিদিমার লোভ লাগল। তার কথায় আমরা আবার তুমাগর লাইগ্গা দুধ লইয়া
আইলাম। ব্যস, লোভে
পাপ আর সেই পাপে আমাগ মৃত্যুতুল্য অপমান হইল। তবু তুমরা বইলাই এ-যাত্রায় আমরা
বাঁইচা গেলাম, দাদাবাবুরা!”
তারপর পাঁচ
বন্ধু মিলে বাকি তিনদিন নির্বিবাদে বাংলোবাড়িতে কাটিয়ে নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল।
_____
অলঙ্করণঃ
সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment