কলম ও
মৃত্যুফাঁদ
প্রতীক
কুমার মুখার্জী
এক
আমি তীর্থঙ্কর বসু। সবে ছেচল্লিশ পেরিয়েছি, একা মানুষ, লোকে বলে চলনসই
সুপুরুষ। পেশাগতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিখ্যাত। থাকি কলকাতার বেশ ওজনদার একটি জায়গায় - সল্টলেকে, ব্লক এফ
ডি, বাড়ির নম্বর ৭৭৭। ছোটোবেলা অবিশ্যি কেটেছে আমাদের শোভাবাজারের বাড়িতে, যা বসু নিকেতন হিসেবে লোকে চেনে। বর্তমানে
সেই ব্রিটিশ আমলের তৈরি বিশাল অট্টালিকায় দৈনিক হাজার মানুষের আনাগোনা। ওটি ভাড়া দেওয়া আছে একটি বহুজাতিক ব্যাঙ্ককে। সংসার বলতে আমার বাবার আমলের কাজের লোক নাড়ুকাকা, আর আমার
পুষ্যি বছর আড়াইয়ের সিম্বা।
জাতে ল্যাব্রাডর, পেডিগ্রীড।
ভবানীপুরে আমাদের পারিবারিক ডায়মন্ড জুয়েলারির ব্যাবসা। নিত্যনতুন ধরনের হিরের
অলঙ্কার বানাতে আমরা অননুকরণীয়। আমাদের তৈরি গয়না সারা দেশে
সরবরাহ করে থাকি এবং এতে আমরা যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছি। বিগত তিরিশ বছরের ইতিহাস তাই বলে। দেশের বাজারে আমাদের যথেষ্ট খ্যাতি তো
বলাই বাহুল্য, আমার বিজনেস পার্টনার প্রণবেশ সেন
আর আমার উদ্যোগ আর নিরলস পরিশ্রমে আমরা
গত তেরো বছর ধরে পশ্চিমেও বেশ পরিচিত একটি ব্র্যান্ড - Glitterati;
নিয়মিত রফতানির সুবাদে।
প্রণবেশকাকু আমার বাবার আমল থেকেই
আছেন কোম্পানিতে এবং সত্যি বলতে কী, উনি
আমার চেয়েও ব্যাবসা আর কোম্পানির ঘাঁতঘোঁত অনেক বেশি
বোঝেন। উনি বিপত্নীক, নিউ আলিপুরের
একটি সুপরিচিত আবাসনে একটি বড়োসড়ো ড্যুপ্লেক্সে থাকেন নিজের ভাইপো ও তার পরিবারের
সঙ্গে। ভাইপোর নাম সুবিমল।
প্রথমেই বলেছিলাম নিজের সম্বন্ধে - ‘বিখ্যাত’। প্রায়
সারা দেশের মানুষ আমায় আরেকটি পরিচয়ে চেনেন। আমি
দেশের পয়লা নম্বর পেন কালেক্টর। দেশবিদেশের
নামজাদা প্রায় সবরকমের রাইটিং ইনস্ট্রুমেন্টস অর্থাৎ কলম আমার সংগ্রহে। আর এই নিয়ে আমার একটা আত্ম-অহমিকা কাজ করে। Pilot, Parker, Waterman, Sheaffer, Cross,
S.T. DuPont, Visconti, মায় Mont Blanc অবধি তো অনেকের বাড়ি খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার সংগ্রহে আছে Aurora
Company-র Diamante - যা বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান পেন, দাম ১.৩ মিলিয়ন পাউন্ড। আছে Tebaldi R Crew 60TH White Gold, Caran dAche
La Modernista এবং আরও অনেক দুর্মূল্য ও রত্নখচিত পেনের সম্ভার। বলাই বাহুল্য, এইসব কোটি কোটি
টাকার ঐশ্বর্য আমায় বেশ সাবধানেই রাখতে হয়। বাড়িতেই
রাখি বিশেষভাবে বানানো লোহার সিন্দুকের মধ্যে। বাড়ির ভেতরে পাহারায় সিম্বা একটি বড়ো অংশগ্রহণ করে। বাড়ির বাইরে অবিশ্যি তাদের কাজ ভাগ করে নেয় বারো ঘণ্টার শিফটে আমার
চার গুর্খা বন্দুকবাজ।
বাড়িটি আমি দেশের অগ্রগণ্য আর্কিটেক্ট দিয়ে তৈরি করিয়েছিলাম বিশেষভাবে, দুর্গের মতো নিরাপত্তার বেষ্টনী তার চারপাশে। আমার জীবনের
একমাত্র স্বপ্ন আমি হব পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পেন কালেক্টর, আর আমার এই বাড়ি হবে সবথেকে বড়ো পেনের জাদুঘর। সারা পৃথিবী জানবে এই ঠিকানা, সবাই আসবে এ-বাড়িতে আমার সংগ্রহ দেখতে। আমিও দেখিয়ে দেব একজন ভারতীয় তথা বাঙালি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারে। দিন দিন আমি আরও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম। আমায় হতে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম। কিন্তু
কীভাবে?
দুই
বেশ চলছিল, সবদিক থেকেই সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছিলাম। কিন্তু সব ভালো সময়ের যেমন শেষ আছে, তেমনি ছন্দপতন ঘটল আমাদের এই মসৃণ পথচলার। বলা নেই,
কওয়া নেই, প্রণবেশকাকু চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কী করে সম্ভব? কাকুর গাড়ি সার্ভিসিংয়ে যাওয়ায় গতকাল রাতে আমি নিজে আমার গাড়ি করে কাকুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম।
এই বয়সে ওঁকে কখনও ট্যাক্সির ধকলও নিতে দিই না। আর আজ এ কী হল? ছুটে গেলাম নিউ আলিপুরে। শুকনো মুখে সুবিমল জানাল, “কাল রাতে
আপনি ছোটোকাকাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন, রাতে আর খাওয়াদাওয়া করেননি। বললেন, ভীষণ খাটনি গেছে, তাও তো তীর্থ পৌঁছে দিয়ে গেল। আজ
শুয়ে পড়ি। কাল উঠে ফ্রেশ হয়ে একেবারে খাওয়াদাওয়া
করে বেরোব। আর আমায় একটা পেন দেখালেন ছোটোকাকা। বললেন, তীর্থর কাছে তো
রেয়ার সব পেন আছে, আমায় এটা দিয়েছে। দেখো কেমন সোনায় মোড়া, আবার ডায়মন্ড স্টাডেডও বটে। আমি শোবার আগে সেলস ফিগারটা তৈরি করে রাখি, এটাতে মকশো করাও হয়ে যাবে। আমি পেনটা উলটেপালটে দেখে ফিরিয়ে
দিলাম ছোটোকাকাকে। অনেক রাতে কাকার কাশির আওয়াজ পাই দু-তিনবার। ভাবলাম সিজন চেঞ্জ হচ্ছে,
তাই আর আমল দিইনি। এই বয়সে ঘুশঘুশে কাশি অনেকেরই হয়। সকালে উঠে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি, মশারি-চাদর বিশ্রীভাবে জড়িয়ে গিয়ে খাটের ডান ধারে ঝুলে আছেন ছোটোকাকা। চোখ
বিস্ফারিত, হাত মুঠো করা, মুখটা হাঁ করা অবস্থায় রয়ে গেছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি যে
শরীর বরফ হয়ে গেছে। হাউস ফিজিশিয়ানকে কল
দিলাম, উনি এসে দেখে বললেন, রেসপিরেটরি ফেলিওর
থেকে ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।”
প্রণবেশকাকুর ঘরে গিয়ে দেখলাম সুবিমল
একেবারে সঠিক বর্ণনাই দিয়েছে। চলে আসার আগে সুবিমল আমায় পেনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা তো আপনি ছোটোকাকাকে দিয়েছিলেন, এটা আর আমি নিয়ে কী করব?”
আমি ওটা ফেরত নিতে পারলাম না। বললাম, “ওটা প্রণবেশকাকাকে
দিয়েছিলাম। উনি যখন চলেই গেলেন, আমি আর ওটা
নেব না। থাক ওটা তোমার কাছে।”
মন জুড়ে থেকে গেল শুধু কাকুর স্মৃতি। রাশভারী
মানুষটির সাবেকি মনন, সর্বক্ষণ ঠোঁটে পাইপ
ঝুলিয়ে গম্ভীর ও গভীরভাবে চিন্তা করে চলতেন ব্যাবসার। এয়ার কনডিশনার, মোবাইল ফোন, পারলে কম্পিউটার আর অন্যান্য ভোগবিলাসের যাবতীয় সামগ্রী সযত্নে এড়িয়ে চলতেন, একমাত্র নিজের
গাড়িটি ছাড়া। শীত, গ্রীষ্ম কি বর্ষা, ওঁর
স্ট্যান্ডার্ড ফিয়াটের
স্টিয়ারিং হুইলে কাকু ছাড়া আর কাউকে দেখা গেলে
বুঝতে হত যে হয় উনি অসুস্থ, নয়তো কলকাতার
বাইরে আছেন। উনি ছিলেন কর্মঠ, আপাতভাবে নীরোগ, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, ওঁকে দেখে এই সাতষট্টি বছর বয়সেও
অনায়াসেই ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেওয়া যেত। তেল খাওয়া মেশিনের মতো আমাদের এই সংস্থাটির চলা ও উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সিংহভাগ কাকুরই প্রাপ্য। ওঁর জন্যই ব্যাবসার বাইরে আমার ভালো লাগার ও ভালোবাসার জিনিসগুলোয় আমি
অনেকটা সময় দিতে পারতাম।
তারপর যা হয় গতানুগতিক, কাকুর পারলৌকিক কাজকর্মের ব্যবস্থাবিধি, পুলিশের
রুটিন আসা যাওয়া, ফরেনসিক ইত্যাদি
নিয়ে প্রণবেশকাকু ক্রমশ ফ্রেমে বন্দি হয়ে
গেলেন।
পুলিশ কেন? সুবিমলের সন্দেহ হয়েছিল যে তার
ছোটোকাকার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। মানুষটা প্রেশারের বড়ি অবধি খেতেন না, ওই বয়সে সুগার ছিল না, শরীরে কোনও রোগবালাই
ছিল না। হাউস
ফিজিশিয়ান প্রতিমাসে এসে যথার্থ হতাশই হতেন।
সেই লোক কী করে এভাবে চলে যেতে পারেন?
কিন্তু অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও সুবিমলের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হল। হয়তো তার ছোটোকাকার চেহারায় মৃত্যুকালীন
বাঁচার আর্তির ছাপগুলো তাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল।
তিন
সপ্তাহ তিনেক কেটে গেছে। আমার জীবনটা যেন গা ভাসিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ
হিমবাহের ধাক্কায় থেমে গেছে। এতদিন বুঝিনি কতটা দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা নিয়ে ওই
মানুষটা সারা ব্যাবসাটা ধরে রেখেছিলেন এবং উনি দেহ
রাখার পরেই যেন ছোটো ছোটো জিনিস হঠাৎ তিল থেকে তাল হয়ে
উঠতে লাগল। আরও অনেক দায়িত্ববান কর্মী আছেন আমাদের সংস্থাতে। তাঁরা হয়তো ধীরে ধীরে ব্যাপারগুলো নিজেদের
আয়ত্তে নিয়ে আসবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার দৌড়োদৌড়ি ভীষণ বেড়ে গেছে। সেই সকাল
থেকে বেরিয়ে পড়ে সমস্ত কাজ সামলাই সারাদিন ধরে; নিজেই সবকিছু দেখি, আর স্বভাবতই বাড়ি ফিরতে
অনেক অনেক রাত হয়ে যায়। বেচারা নাড়ুকাকা আমায় সেই ছোট্ট থেকে মানুষ করেছে। প্রথমে মিনতি, আকুতি, তারপর বকাঝকা করেও আমায় ঠিক সময়ে আর খাওয়াতে না পেরে
শেষটায় গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে।
“খোকা, বলি টাকাপয়সা ত সমুদ্দুরের ঢেউয়ের মতন অনেক করলে। তাও অত দৌড়োদৌড়ি করে শরীরটি খারাপ করলে কে দেখবে শুনি? আমি বাপু পারব না
এই বলে দিলুম। সেই ছোটো থেকে কোলেপিঠে করে এত বড়োটি
করলুম, এই বয়সে আমি আর পারবই না। আমায় ছুটি
দিয়ে দাও, আমি দেশে চলে যাই।”
তখন আবার কাকার রাগ ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে বসে একসঙ্গে খাওয়া। আসলে নাড়ুকাকা ছাড়া আমার তো
বিশেষ কেউ নেই এই পৃথিবীতে।
মানুষ শোক তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারে। কারণ, এটা রীতিমতো পরীক্ষিত সত্য ‘Time is
a Great Healer’। আমিও আস্তে আস্তে আমার ব্যাবসায়
জড়িয়ে পড়তে লাগলাম। খাটুনি হত
ঠিকই, কিন্তু দু-তিনমাস কেটে যেতে দেখা গেল সব
আবার ঠিকঠাক আগের রাস্তাতেই চলা শুরু করেছে। আমার
খাওয়াদাওয়া আর আমার পেনের সংগ্রহ বাড়াবার জন্য আবার আমি সময় দিতে পারতে লাগলাম।
চার
রবিবার, ছুটির দিন। ‘দ্য
টেলিগ্রাফ’-এর একটা বিশেষ ক্রোড়পত্রে নতুন
পেনের ক্যাটালগে মনঃসংযোগ করছি। নাড়ুকাকা চা দিয়ে
গেছে। পায়ের কাছে বসে বসে সিম্বা একটা
মাছির গতিবিধি লক্ষ করছে। মাঝে মাঝে সামনের পা নাড়িয়ে
মাছিটাকে ব্যস্ত রাখছে। বাইরে উজ্জ্বল রোদ। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঘড়িতে
প্রায় দশটা। এমন সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ আর দু’মিনিটের ভিতর আমার ডোর বেলে ‘টিং টং’। সিম্বা
তড়াক করে উঠে বসল, আর নাড়ুকাকা,
“কে? আসছি।” বলে
কাঁধের গামছাটায় হাত মুছতে মুছতে দরজার দিকে এগোল।
এক মিনিট পরেই হাতে একটা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে আমায় দিয়ে বলল, “দু’জন দেখা করতে এসেছেন।”
কার্ডটা
হাতে নিয়েই চমকে উঠলাম। P.C.M. নিচে লেখা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, আর ডান কোণে
একটা ফিঙ্গার প্রিন্ট। তার নিচে দেওয়া আছে দক্ষিণ কলকাতার ফোন নম্বর। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত
নেমে গেল। জানিয়ে রাখি, আমি শ্রী সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের লেখার ভীষণ ভক্ত, আর
স্বভাবতই, ফেলুদারও। তাই ওরকম একটা কার্ড দেখে শিহরণ তো হতে বাধ্য। ফেলুদা কি তবে সত্যিই আছেন? প্রায় লাফ দিয়ে স্লিপার পায়ে
গলিয়ে, হন্তদন্ত হয়ে দরজায় গেলাম নিজেই। কিন্তু যাকে দেখলাম, তাতে আর উৎসাহিত হবার কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না। বরং বেশ গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, “কী
ব্যাপার, কোত্থেকে আসছেন আপনারা?”
জবাব এল, তাও আবার কিস্তিতে। “ভি-ভিতরে আ-আসতে পা-পারি?”
একবার ভদ্রলোকটির দৌড় যাচাই করার লোভ সামলাতে না পেরে ফেলুদা নামক লোকটিকে
অগত্যা ভিতরে আসতে বললাম। সঙ্গে আবার একটি কিশোর। কে জানে, ওই বিচিত্র গ্রহের হয়তো এটি উপগ্রহ!
এই P.C.M.বাবু এসে সোফায় বসলেন। একটু বর্ণনা করার সুযোগ নিচ্ছি। ইনিও
প্রায় ছয় ফুটের ওপর লম্বা, গায়ের রঙ বেশ ময়লা, মাথার চুল তেল দিয়ে চেপে আঁচড়ানো,
চোখে মোটা ফ্রেমের মান্ধাতা আমলের মডেলের চশমা, মুখে দু-তিনদিনের না কামানো দাড়ি, পরনে একটি আধময়লা জিনস, একটি বিসদৃশ বেগুনি পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ, হাতে ঘড়ি। রাস্তায় বেরোলে
মোটামুটি এরকম চেহারার মানুষ আকছার দেখা যায়। আবার ফেলুদা স্টাইলে পায়ের উপর পা
চাপিয়ে বসা হয়েছে! Humbug যত। সঙ্গের ছেলেটি একেবারেই
সাধারণ, গতানুগতিক চেহারার, আর জামাকাপড়ও তথৈবচ। এদের দেখে আর এদের কার্ডটির কথা
মনে করে বেশ রাগই হয়ে গেল। মনে
পড়ে গেল সত্যজিৎবাবুর ছোটোগল্প ‘বহুরূপী’-র সেই নিকুঞ্জকে। গলা ঝেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার বলুন তো? আপনার নাম কী, আর আপনি এখানে কেন বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে?”
“ন-নমস্কার, আমি প-প্রভাত চন্দ্র ম-মাখাল, আর এ-এই আমার প-পিসির ছেলে,
ন-নন্দন।”
বাস্তবিক প্রথমে খেয়াল করিনি, লোকটির কণ্ঠস্বর যাকে বলে জলদগম্ভীর। জিভ হড়কালেও মোটা চশমার পিছনে চোখদুটি যেন বেশ অন্তর্ভেদী।
মজার ব্যাপার, সিম্বাকে দেখলে যে কেউ, বিশেষ করে কোনও নবাগত আগন্তুকের আত্মবিশ্বাস একটু টলেই
যায়। এঁর
ক্ষেত্রে দেখলাম, সিম্বা প্রভাতবাবুর পায়ের কাছে উঠে যেতেই লোকটি তার মাথায় হাত-টাত বুলিয়ে, গলার তলার নরম চামড়া পালিশ করে বেশ আপন বানিয়ে ফেললেন আমার বড়োসড়ো ল্যাব্রাডর হাউন্ডকে এবং
নন্দন ছোকরাটিরও যেন কোনও হেলদোল নেই। এরা কারা?
পাঁচ
“আ-আমরা সু-সুবিমল স-সেন বাবুর চ-ছোটোকাকা প্রয়াত প-প্রণবেশ সেনের ম-মৃত্যু, য-যাকে বলা যায় অ-
অকালমৃত্যু নিয়ে এ-একটু অ-অনুসন্ধান করছি। উ-উনি
তো আ-আপনার ক-কাছেই কাজ ক-করতেন, তাই না?”
রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করল। সুবিমলের সাহস কী করে হয়? পয়সা আছে,
গোয়েন্দা লাগাতেই পারে কাকার মৃত্যুর তদন্ত করতে, কিন্তু এরকম একটা লোক কী করে বাছল
সে? আমায় বললেই পারত, ভালো সংস্থা থেকে ভালো গোয়েন্দা লাগাতে পারতাম আমার পরিচিতি
ব্যবহার করে। আর এই লোকটা কি আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে? কীসের ভিত্তিতে? আমি একে জবাব
দেব কেন? ঝাঁ করে রাগ হয়ে গেল আবার। আমার টেলিফোনে স্থানীয় থানার ওসি সম্রাট
শাসমলের নম্বর টিপলাম। এই ক’দিনের
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের দরুন ওঁর সাথে
বেশ আলাপও হয়ে গেছে, আর উনি এই বিখ্যাত পেন
কালেক্টরের একজন ভক্ত হয়ে উঠেছেন।
“নমস্কার সম্রাটবাবু, আমি তীর্থ বোস বলছি সল্টলেক থেকে। ভালো আছেন তো?”
উত্তর এল, “ভালো আছি, স্যার। হঠাৎ মনে পড়ল কেন? সব ঠিক আছে
তো?”
“আমার কাছে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। প্রাইভেট
ইনভেস্টিগেটর। P.C.M. - পুরো নাম প্রভাত চন্দ্র মাখাল। ওই প্রণবেশ সেনের ব্যাপারে তদন্ত করতে। চেনেন
নাকি আপনি?”
“আরেব্বাস! ফেলুদা নাকি?” অট্টহাস্য ফোনের ওপার
থেকে, “না মশাই, এঁকে চেনার সৌভাগ্য হয়নি। দেখবেন
সাবধান, কোথাকার ভুঁইফোঁড় সব!”
খুক খুক করে হেসে প্রতি নমস্কার জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলাম।
এবার আওয়াজটা এল জানালার দিক থেকে আমার বইয়ের আলমারির সামনে থেকে। “আ-আপনার ব-বইয়ের সংগ্রহ তো ব-বেশ ভা-ভালোই, ত-তীর্থবাবু।”
ফোনে কথা বলার সময় প্রভাতবাবু কখন
জানি উঠে চলে গেছেন আমার বইয়ের আলমারির
সামনে। গা জ্বলে গেল। তাও বললাম, “সবরকমই রাখতে হয়। আমার আবার পড়ার নেশাটা বেশ প্রবল।”
“ব-বুঝলি ন-নন্দন, এমনি ম-মানুষ ব-বড়ো হয় না। দ-দেখ, উনি দ-দেশের এ-এক নম্বর পেন স-সংগ্রাহক, স-সফল ব্যবসায়ী, ত-তাও ব-বই পড়ার স-সময় হ-হাতে রাখেন। না তি-তীর্থবাবু, আপনি বা-বাঙালির মুখ উ-উজ্জ্বল করেছেন।”
প্রশংসা জিনিসটা যে কী ভীষণ
মারাত্মক সেটি আবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, “কিছু মনে করবেন না, আপনার এই পিসিএম ব্যাপারটা কি ফেলুদা অনুপ্রাণিত?”
আলমারির সামনে থেকে ফিরে এসে পুনরায় সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে খুব
উত্তেজিত হয়েই বললেন প্রভাত-প্রবর, “ঠ-ঠিক ধ-ধরেছেন, স্যার। বা-বাঙালির ভি-ভিতর আর ওরকমটি আ-আছে
না-নাকি? তা-তাই যখন না-নামের আ-আদ্যক্ষরটি
মিলেই গে-গেছে, ত-তখন এ-এভাবেই নিজেকে তু-তুলে ধ-ধরি - বেশ এ-একটা মা-মাইলেজও
পাওয়া যা-যায়, আর এ-এটিও রপ্ত করেছি,” বলে পকেট থেকে
সেই ট্রেডমার্ক কমলা
রঙের সিগারেটের প্যাকেট বার করে অনুমতি চাইলেন, “স-স্মোক করলে অসুবিধা নেই তো?”
ভালোই লাগতে শুরু করেছিল লোকটাকে। অন্তত
অসৎ নয় মানুষটা। নন্দন চুপ করে বসেই আছে।
ছয়
কী আর করি, নাড়ুকাকাকে চা দিতে বললাম। প্রণবেশকাকাকে নিয়ে কথোপকথন চলল। সমস্ত
ঘটনাই বললাম। আর এরই মধ্যে আবিষ্কার করলাম যে মানুষটির চেহারা যাই হোক না কেন, পড়াশুনা আছে আর অনুমানশক্তি বেশ
প্রখর। যখন আমার প্রিয় Mont Blancটি হাতে তুলে নিয়ে গড়গড় করে
এর ইতিহাস নিয়ে একটা প্রমাণ সাইজের
বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন, ও পেনটির ধরার জায়গায়
পালিশের কমতি দেখে ওটি যে বহু ব্যবহৃত বলে দিলেন অনায়াসেই, তখন আমি যেন সত্যি বলতে কী, বেশ তারিফের চোখেই দেখতে লাগলাম এই অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাধারী ব্যক্তিকে। বলে রাখি, নন্দন ছেলেটিও বেশ।
কখন দেখি চুপচাপ একটি রেকর্ডারে আমাদের কথাবার্তা তুলতে
শুরু করে দিয়েছে।
দু-আড়াই ঘণ্টা কেটে গেল। কথাবার্তাও হল। যখন প্রভাতবাবু আর নন্দন সেদিনের
মতো বিদায় নিলেন, ততক্ষণে আমার সকালের সেই খারাপ মেজাজটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেছে। বরং এঁদের বেশ ভালো লাগতেই আরম্ভ করল। ফেলুদা না হোক, এরকম ফেলুদায় উদ্বুদ্ধ মানুষজনও আছেন যারা স্রেফ গল্প পড়েই
গোয়েন্দা বা টিকটিকির পেশা বেছে নিয়ে দিব্যি করে
খাচ্ছেন। ধন্য সত্যজিৎ রায়বাবু!
তারপরেই এল ফোনটা। অর্ডারি হিরের গয়না
বানাবার জন্য আমদানি করা একটি অতি দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য নীল হিরে, যা পাওয়া গেছে অতি সম্প্রতি New
South Wales-এর Lightning
Ridge অঞ্চল থেকে, বাজারে যার মূল্য ৯.৬ কোটি ডলার, আমার দোকানের
সেফটি ভল্ট থেকে মিসিং! ওটা এক সপ্তাহ আগেই হাতে এসেছে। ইনস্যুরেন্সের কাগজও এই গতকাল লকারে পাঠিয়েছি। হতেই পারে না। আমি নিজে কাল ওটাকে ভল্টে ঢুকিয়ে
নিজের হাতে চাবি দিয়ে এসেছি। তাহলে এটা কী করে
সম্ভব? সিন্দুক যথারীতি বন্ধ, এদিকে হিরে নেই?
মাথায় রোখ চেপে গেল।
পৌঁছলাম ভবানীপুর। ইতিমধ্যেই পুলিশকে খবর দিয়েছি। আর বিশ্বাস করবেন? প্রভাতবাবুও এসে পড়েছেন অন
রিকোয়েস্ট, আমার তরফ থেকে। পুলিশ অফিসার তো যথারীতি রুটিন
জিজ্ঞাসাবাদ করেই আমায় সেই চিরন্তন প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনার
কাউকে সন্দেহ হয়?”
আমি মাথা নাড়তেই উনি প্রভাতবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইনি?”
আমি আর ভাঙলাম না ওঁর পরিচয়। কিন্তু একটু পরেই দেখি দারোগাবাবু আর প্রভাতবাবু
দিব্যি কথাবার্তা চালাচ্ছেন, আলোচনা করছেন বেশ পূর্বপরিচিতের মতোই। এর মধ্যে হঠাৎ আড়চোখে দেখি পিসিএম কী একখানা কাগজের টুকরো তুলে পকেটে ভরলেন। পরে আমায় দেখিয়েছিলেন, ওটি উলটোডাঙার একটি কেমিস্ট শপের বিল। কে জানে কার।
বেশ ক’দিন কেটে গেল। কোনও কিনারা হল না প্রণবেশকাকুর
আর হিরের ব্যাপারগুলোর। মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ক’দিন বাদেই মন ভালো করা একটা
ব্যাপার ঘটে গেল। একটু কষ্ট করেই ফিক্সড ডিপোজিট
ভাঙিয়ে কিনে ফেললাম আরেকখানা দুষ্প্রাপ্য পেন, Mystery Masterpiece – Mont Blanc & Van Cleef &
Arpels Limited Edition, ৭.৩ কোটি ডলার খরচ করে, আর ডেকে বসলাম
প্রভাতবাবুকে। উনি এর কদর বুঝবেন। ওঁকে আমি কী জানি কীভাবে বেশ মনে মনে ফেলুদা ভাবতে শুরু করে দিয়েছি এবং ওঁকে আমার কনফিডেন্সেও নিয়ে নিয়েছি।
সাত
এলেন প্রভাতবাবু। ঠিক ঘড়ি ধরে সকাল দশটাতেই এলেন। সেই না কামানো দাড়ি, হুবহু সেই পোশাকে, শুধু পাঞ্জাবিটি আজ গেরুয়া। সঙ্গে নন্দন সাকরেদ নেই আজ। পিছনে একজন নাদুসনুদুস
মধ্যবয়সী মানুষ। কিছু মানুষ আছেন না, দেখলে মনে হয় সবসময়েই হাসছেন, আর সব কথাতেই
হ্যাঁতে হ্যাঁ মেলানো, ইনি ঠিক সেরকম। পরিচয় করালেন পিসিএম, “ইনি হর্ষবর্ধন পারুই। আমাদের
পাড়ায় থাকেন, মিষ্টির দোকান এঁর।”
বলতেই মনে হল, আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও নিতান্ত
দূরছাই করার মতো নয়। ওঁর
ওই বেলুনসদৃশ চেহারাটা দেখে আমার প্রথমে ময়রাই মনে হয়েছিল
যে!
“উ-উনি আপনার ভ-ভীষণ ভ-ভক্ত।
আ-আমার সাথে আ-আলাপ আছে আ-আপনার শু-শুনে আসতে চাইলেন।
ন-নন্দনের ভাইরাল ফি-ফিভার, তাই নিয়ে এ-এলাম এঁকে। আ-আপনার অনুমতি ছা-ছাড়াই অবিশ্যি।”
অচেনা আগন্তুক। তিনি যতই নিরীহ হন না কেন, আমার
ঠিক পছন্দ না। আর বাড়িতে আমার কম ঐশ্বর্য নেই। কিন্তু
কী করা। একে তো
প্রভাতবাবু এনেছেন, তায় আবার ওঁর দিকে
তাকিয়ে কড়া করে কিছু বলতে গিয়ে দেখি উনি শ্যামলাল (সুকুমার রায় সাহেবের অমর কীর্তি
হ য ব র ল-এর চরিত্র)-এর মতন একগাল হেসে আমায় নমস্কার করেই বিশাল একটি মিষ্টির বাক্স আমার দিকে
বাড়িয়ে ধরেছেন।
“হর্ষবর্ধনের তরফ থেকে এক বাক্স হর্ষ গ্রহণ করুন স্যার,” সঙ্গে একটি দেঁতো হাসি।
চায়ে ডোবানো বিস্কুটের মতো মনে হল
নিজেকে। প্রতিশোধটা অবশ্য আমার হয়ে নিল সিম্বা। কোথা থেকে দুলকি চালে এসে
পারুইমশাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই হাসি-ফাসি মুহূর্তে উবে গেল। উনি
কাঠের মূর্তি হয়ে গেলেন, আর অক্লান্তভাবে হেঁচকি তুলে যেতে লাগলেন সিম্বা থাকা পর্যন্ত।
তারপর প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে আমার সমস্ত পেন দেখা হল।
প্রতিটা পেনের ইতিহাস
প্রভাতবাবু সংক্ষেপে বলে গেলেন। তারিফ
করতে হয় তার ক্ষমতার। আর কখনও কাষ্ঠ হেসে, কখনও হাঁ
করে, কখনও ভুরু কপালে তুলে, কখনও গম্ভীর মুখে পারুইমশাই তার বিস্ময় প্রকাশ করে
চললেন হেঁচকি সহযোগে। অবাক হলাম যখন আমার পুরনো Mont Blancটিও তুলে নিয়ে একইভাবে দেখালেন প্রভাতবাবু। এর মধ্যে বলি, প্রতিটা পেন
তুলে নিয়ে নানা কোণ থেকে নানাভাবে ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে, নেড়েচেড়ে, হাতে নিয়ে ওজন বোঝার মতো করে
দেখছিলেন প্রভাতবাবু। একটু বেশি সময় নিয়েই যেন
দেখছিলেন। আজ ওঁর ভুরুদুটো অমনি কুঁচকে আছে কেন কে
জানে। পেন দেখা হলে
ওঁদের বসতে বলে নাড়ুকাকা আর আমি সব পেন আবার যত্ন করে ভিতরের
ঘরের সিন্দুকে রেখে এলাম। এসে দেখি, আজ আমার বইয়ের আলমারি খুলে দেখছেন প্রভাতবাবু। হঠাৎ বলে উঠলেন, “য-যদি কি-কিছু মনে না ক-করেন, দু-দুটো ব-বই আমায় ক-ক’দিনের জন্য এ-একটু পড়তে দে-দেবেন,
তীর্থবাবু? বা-বাই দ্য ওয়ে, আ-আপনি কি র-রসায়নের ছা-ছাত্র?”
মাথা নাড়লাম। না বাচক। বই না দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না। তাই উনি
যাওয়ার সময় বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন দু’খানা বই - ‘The Universal Home Doctor’ আর ‘Chemical
Weapons।’ সঙ্গে হর্ষবাবুকেও, বেচারি ভদ্রলোক
সিম্বাকে দেখার পর থেকেই তাঁর স্বাভাবিক প্রফুল্লতা হারিয়েছিলেন।
আট
খারাপ সময় আমার পিছু ছাড়ছে না। আমি নিয়মিত সকাল সাড়ে ছ’টায় উঠি। হালকা যোগব্যায়াম আর একটু
সাঁতার কাটা আমার বহুকালের অভ্যাস। নাড়ুকাকা সেভাবেই আমার চা-জলখাবার তৈরি করে আর ভোরে উঠে। কিন্তু মঙ্গলবার ভোর সোয়া পাঁচটায় হঠাৎ
নাড়ুকাকা আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল। ভীষণ
বিরক্ত হয়ে কারণ জানতে চাওয়ার আগেই নাড়ুকাকার মুখের দিকে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম।
দু’চোখ বিস্ফারিত, ঘামে ফতুয়া জবজব
করছে ভিজে, গলার আর কপালের শিরা ফুলে উঠে দপদপ করছে, উৎকণ্ঠায় গলা দিয়ে আওয়াজ
বেরোচ্ছে না। “খোকা, সর্বনাশ হয়ে গেছে! সিম্বা
মরে গেছে!”
কীভাবে যে মুহূর্তের ভিতর সিম্বার কাছে পৌঁছলাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুখ ঈষৎ হাঁ করা, চোখদুটো খোলা, আর মুখের ঠিক নিচে দু-তিন ফোঁটা রক্ত আর লালা - এছাড়া
পিছন থেকে দেখে মনে হয় যে সিম্বা ঘুমোচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে আমার, মাথা
কাজ করছে না। কী করে, কেন আর কী জন্যে আমার জীবনে একের পর
এক আঘাত আসছে এইভাবে? কোনও সদুত্তর নেই এর। কিছুক্ষণ পরে ধাতস্থ হয়ে দুটো ফোন করলাম, পুলিশ আর প্রভাতবাবুকে। পুলিশ তার নিয়ম
মেনে এসে আমার প্রিয়তম সিম্বাকে নিয়ে চলে গেল। নাড়ুকাকা ডুকরে কেঁদে উঠল। আমারও
চোখের জল বাঁধ মানল না। প্রভাতবাবুকে ফোনে পেলাম না। দু-তিনবার চেষ্টা করেও না। কোথায়
গেলেন ভদ্রলোক?
আমার মনে এখন একটাই প্রশ্ন উঠছে। প্রথমে
প্রণবেশকাকা, তারপর হিরে খোয়া যাওয়া, এখন সিম্বা। ব্যাবসা করতে
গেলে অনেকরকম কাজ করতে হয়, যার মধ্যে কিছু কিছু কাজকে একেবারেই ভালো কাজের আখ্যা
দেওয়া যায় না। এসব কাজে শত্রু বাড়ে, কিন্তু আমার এভাবে ক্ষতি করার মতো শত্রু আছে কি? আবার প্রভাতবাবুর নম্বর টিপলাম ফোনে। এবার টের পেলাম আমার হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে, আতঙ্কে না
উত্তেজনায়? কিন্তু ফোন বেজেই গেল, কেউ ধরল না।
দু’দিন কীভাবে কাটল তা একমাত্র আমি জানি। বাড়ি থেকেই বেরোইনি; শুধু চুপচাপ বসে থেকেছি আর ভেবেছি। নাড়ুকাকা আমায় সময়ে সময়ে খেতে দিয়ে
গেছে। কখনও খেয়েছি, কখনও আবার ছুঁয়েও
দেখিনি। দোকান থেকে অজস্র ফোন এসেছে। ধরেছি,
অর্ধেক শুনেছি, তারপর বিরক্তি ও নিস্ফল আক্রোশ মিশিয়ে ধমক দিয়েছি আমার বিশ্বস্ত
কর্মচারীদেরও। “নিজেরা এটুকু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে এবার অবসর নিয়ে নিন। অনেক
হয়েছে, অনেক করেছেন আপনারা,” ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ফোন আছড়ে ফেলেছি ক্রেডেলের উপর।
দু’দিন পর ফোন বাজল আবার।
“নমস্কার তীর্থবাবু, শাসমল বলছি থানা থেকে। আপনার কুকুরকে বিষ দিয়েই মারা হয়েছে। আমরা তদন্ত চালাচ্ছি।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ কথাটার মানে যে ঠিক কী সেটা
আমায় তখন দেখলে আর ডিকশনারি দেখতে হত না। কী করব আমি
এখন? এবার প্রভাতবাবুকে ফোন করলাম। যথারীতি
কেউ ফোন ধরল না। কোথায় গেল লোকটা? সুবিধে না করতে পেরে রণে ভঙ্গ দিল নাকি? যতসব Humbug! নিজেকেই তিরস্কার করলাম মনে মনে। এই লোকের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম আমি? তীর্থঙ্কর বসু?
নয়
পরদিন সকালে বাড়ির ফোন বেজে উঠল আটটা নাগাদ। আমি এখনও কাজে বেরোই না, তাই লোকজন দরকারে বাড়ির ফোনে
কথা বলেন।
“সু-সুপ্রভাত,
তীর্থবাবু! আ-আজ একটু আ-আপনার কাছে যাওয়া
যাবে?” প্রভাতবাবুর গলা।
ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, “কী দরকার
আপনার, মশাই?”
“আ-আপনার ব-বইগুলো ফে-ফেরত দিতে যেতাম, আর তা ছা-ছাড়াও একটু দ-দরকার ছিল
আ-আর কী,” বললেন প্রভাতবাবু।
নিমরাজি হয়ে বললাম, “আসুন, তবে বেশি সময় দিতে
পারব না কিন্তু।”
আবার সেই
আলাপের সময়ের গা জ্বালা করা বিরক্তিটা ফিরে এসেছিল কেন কে জানে।
সকালে সোফায় গা এলিয়ে শুয়ে আছি, আর মনে মনে বিরক্ত হচ্ছি ওই ফেলুদা সাজা
লোকটার অপেক্ষায়, হঠাৎ গাড়ির শব্দ বাড়ির বাইরে। ঠিক
সকাল এগারোটায় আমার বাড়ির বেল বাজল। নাড়ুকাকা গিয়ে দরজা খুলতেই আমি আধশোয়া অবস্থা
থেকে ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতন ছিটকে উঠে বসলাম। ঘরে
ঢুকছেন একে একে শাসমল, নন্দন, হর্ষবর্ধন পারুই, সুবিমল আর শেষজনকে দেখে আঁতকে
উঠলাম। প্রভাতবাবু! কিন্তু আজ যেন ওঁকে চিনতে ভীষণ অসুবিধে
হচ্ছিল।
“ক-কী ব্যা-ব্যাপার?”
এই কথাগুলো পিসিএম বলেননি। ফ্যাসফেসে স্বরে আমার মুখ দিয়েই বেরিয়েছে।
“বলছি, বলছি তীর্থবাবু, সব বলছি। তবে প্রথমে আপনার বইগুলি ধরুন। ওগুলি বেশ কাজেই লেগেছে আমার। আর আপনারা
সবাই বসুন।”
কথায়
তোতলামির বংশ নেই, প্রভাতবাবুকে যেন আমি আজ চিনতেই পারছিলাম
না। পরনে সেই জিনস আর পাঞ্জাবি, কিন্তু চুলে তেলের
লেশমাত্রও নেই, চোখের চশমা আর দাড়ি উধাও, গায়ের রঙটাও কি দু’পোঁচ ফরসা লাগছে? কে ইনি? প্রভাতবাবু ঠিকই, কিন্তু এ কোন প্রভাতবাবু? আমি
যেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একে মনমেজাজ
ভালো নেই, তারপর এই এত লোকজনকে নিয়ে সটান আমার বাড়িতে চড়াও হবার মানে কী? কী চায় লোকটা?
ভীষণ রেগে উঠে চিৎকার করে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর আমায় মাঝপথেই থামিয়ে দিল। প্রভাতবাবু
বলতে শুরু করলেন, “আজ আমি আপনাদের
সবাইকে এই এফডি ৭৭৭-এ ডেকে এনেছি কেন জানেন? এখানে দেশের সবচেয়ে বড়ো পেন
কালেক্টর তীর্থঙ্কর বসু থাকেন সেটা তো এখানে উপস্থিত সকলে জানেন। কিন্তু এঁর আরেকটি পরিচয় আছে।”
“কী, মনে করেছেন কী আপনি? বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে
যাচ্ছে না কি এটা? একজন
রেস্পেক্টেবল সিটিজেনের বাড়ি বয়ে পুলিশ নিয়ে এসে এটা কী ধরনের রসিকতা আপনার?” নিষ্ফল আক্রোশে গলার শিরা ফুলিয়ে,
স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
দশ
প্রভাতবাবুর কোনও হেলদোলই নেই। “আপনাদের একটা গল্প বলব আজ। তীর্থবাবুর গল্প। একটা মানুষ যার একটা সুন্দর
জীবন ছিল, ছিল একটা সফল ব্যাবসা, আর ছিল
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পেন কালেক্টর হবার
অদম্য বাসনা। দিন দিন এই অভিলাষ তাঁকে এতটাই গ্রাস করে নিতে লাগল যে উনি তা অর্জন
করার জন্য কখন যে সৎপথ থেকে সরে গিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করলেন, তিনি নিজেই
জানেন না।”
এই পর্যন্ত শুনে আমি দাঁড়িয়ে উঠে হিংস্রভাবে প্রভাতবাবুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার
উপক্রম করতেই শাসমলের হাতে উঠে এল সার্ভিস রিভলভার আর একটি বজ্রকঠিন তর্জনীর শাসন। তীক্ষ্ণ
অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমায় আবার যন্ত্রচালিতের মতো বসে পড়তে বাধ্য করল।
“সুবিমল সেনের ছোটোবেলার
বন্ধু আমি। ও জানে আমি শখের গোয়েন্দাগিরি করি। আমি Sherlock Holmes, ফেলুদা, Hercule
Poirot, ব্যোমকেশ আরও অনেক অনেক বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দাদের অন্ধভক্তি
থেকেই এই পেশায় আসার সিদ্ধান্ত নিই। সুবিমলের
কাকা হঠাৎ মারা যেতেই ও একদিন আমায় ফোন করে। আমি ওর
কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানতে পারি। ও এও বলে, ছোটোকাকার মৃত্যু ওর কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, যদিও পুলিশ অনেক অনুসন্ধান করে
কিছু পায়নি। একে ছোটোবেলার বন্ধু, তারপর আমার হাতেও
বিশেষ কাজ নেই, তাই লেগে পড়লাম। যদি কিছু কিনারা করতে পারি।
“সুবিমল আমায় জানায় তীর্থবাবুর কথা, আর ঠিক কী
কী হয়েছিল ওর ছোটোকাকা
মারা যাওয়ার আগের দিন। আমায় একটা দুর্মূল্য পেনও দেখায়, যেটা মৃত্যুর আগের দিনই
তীর্থবাবু প্রণবেশকাকুকে উপহার দিয়েছিলেন। আমি
পরদিন নন্দনকে নিয়ে নিজের চেহারা একটু খোলতাই করে সোজা চলে আসি
তীর্থবাবুর বাড়িতে। চেহারার পরিবর্তনটা দরকারি ছিল, কারণ উনি বিখ্যাত মানুষ, তায় আবার পেন শিকারি। যদি সন্দেহের চোখে দেখেন প্রথমেই, তাহলে ওঁর কাছে আর আসতেই পারব না, তদন্ত করা তো দূর
অস্ত। এসে দেখি ওঁর বইয়ের সংগ্রহ। এত বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই আছে
এঁর কাছে যে দেখেই ভালো লেগেছিল। তাই মুক্তকণ্ঠে নন্দনকে সে কথা
বলেওছিলাম। ওইদিনই আবার উনি আমায় ফোন করে ডেকে নেন ভবানীপুরে, ওঁর অফিসে। একটা দুষ্প্রাপ্য হিরে চুরির
ব্যাপারে। ওখানে আমি বিশেষ কিছু পাইনি, তবে ইনস্পেক্টর
চাকলাদার আমায় ছদ্মবেশ সত্ত্বেও চিনে ফেলায়, ওঁকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে আমার পরিকল্পনা জানাই। আর সিন্দুকের সামনে কুড়িয়ে পাই
উলটোডাঙ্গার কাছে একটি কেমিস্ট শপের বিল।
“পরে ওই কেমিস্ট শপে গিয়ে ওই বিল দেখিয়ে জানতে পারি ওখান থেকেই কেনা হয়েছিল Ricinus
Communis অর্থাৎ Ricin। এটার
সম্পর্কে একটু বলি। Ricin হচ্ছে Castor
Bean থেকে পাওয়া এমন একটি প্রোটিন যার Scientific Name হল Ricinus Communis। এটি একটি মারাত্মক
বিষ এবং এটি আনডিটেক্টেবল। এতই
এর শক্তি যে US Centers for Disease Control
(CDC) বলে যে একদানা লবণের মাপে এই Ricin-এর নির্যাস প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ফুসফুসে গেলে শুরু হয় কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং
ফুসফুসে জল জমতে থাকে। জ্বর এসে যায়, রক্তচাপ কমে আসে আর শেষ হয়
হার্ট ব্লক দিয়ে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে
লাগে বড়োজোর চল্লিশ থেকে ষাট মিনিট। কিন্তু এই Ricin কে
কিনেছিল? বিলের উপর কোনও ঠিকানা
নেই। দোকানের রেকর্ডস চেক করতে খরচ হল তিনশো টাকা। ডুপ্লিকেট
কপিতে দেখলাম লেখা আছে ছোটো করে এককোণে - FD 777। চমকে উঠলাম। তবে কি...! আর হিরেটাই বা কীভাবে ভ্যানিশ হল?”
আমার মাথার শিরাগুলো যেন দপদপ করতে লাগল। মাথায় আগুন জ্বলছে। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ডাক্তারের ভুয়ো
সার্টিফিকেট বানিয়ে ওই Ricin আমি জোগাড় করি অত্যন্ত চড়া দামে শুধু আমি জানি।
আর এই লোকটা অবলীলায় আমার সযত্নে সাজানো
একেকটি নিখুঁত প্ল্যানকে সবার সামনে আছড়ে ফেলছে সজোরে!
“অন্ধকার হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম। কিছুতেই আর কোনও হদিশ পাই না। তীর্থবাবু আগের দিন প্রণবেশকাকুকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েছিলেন, আবার একটি পেনও উপহার দিয়েছিলেন। মাথার
ভিতরে চড়াৎ করে উঠল বিদ্যুৎ। সুবিমল বলেছিল,
ছোটোকাকার কাশির শব্দ শুনতে পেয়েছিল, আর কাকা মারা যান
রেসপিরেটরি ফেলিওরে। তৎক্ষণাৎ ওর কাছ থেকে পেনটা সংগ্রহ
করে ফরেনসিকে পাঠালাম। তিনদিন পর আমার গুরুদেব ফেলুদার চরণে
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার
কারণ ঘটে গেল। পেনের কালির ভিতর - Traces of Ricinus Communis present।
“এরপর একদিন সুযোগ এসে গেল। তীর্থবাবু নিজেই আমাকে ডেকে পাঠালেন কী একটা নতুন অমূল্য পেন কিনেছেন, দেখাবেন
বলে। গিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা পেন একটি একটি করে, যা সব দামি দামি রত্ন দিয়ে
সাজানো, আর কী একেকটার ওজন!
কিন্তু আমার মাথায় আসছিল না যে অত দামি একটা হিরে চুরি যাওয়ার মাত্র কিছুদিনের ভিতর এই ভদ্রলোক ফিক্সড
ডিপোজিট ভাঙিয়ে এত দামি একটা পেন কিনে
ফেললেন? খটকাটা রয়েই গেল। সেদিন ওঁর কাছ
থেকে দুটো বই নিয়ে গেছিলাম এবং The Universal Home Doctor আর
Chemical Weapons বইদুটিতে অজস্র পেনসিলের আন্ডারলাইন দেখেই
বুঝেছি, এই বইদুটি বেশ কাজে লাগে ওঁর। তাই
জিজ্ঞেস করি ওঁকে, উনি রসায়নের ছাত্র কিনা।
“এর মধ্যে আমায় তীর্থবাবু অনেকবার ফোন করেছিলেন, আমি ধরিনি। কারণ, সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে উঠতে আমায়
ভীষণ দৌড়োদৌড়ি করতে হচ্ছিল। তাই
দিনের শেষে যখন নন্দন আমায় সারাদিনের কল লিস্ট দেখাত, আমি বুঝতাম, তীর্থবাবু
অশান্তিতে রয়েছেন। আরও বুঝতাম, উনি আমায় ছাড়া বেশ অসহায় বোধ করছেন।
“এরপর একদিন যখন শাসমলবাবু আমায় ফোন করে জানালেন যে তীর্থবাবুর কুকুরকেও
বিষ দিয়ে মারা হয়েছে এবং ফরেনসিক রিপোর্টেও
সেই একই Ricin-এর কথা জানতে পারলাম তখন অস্পষ্ট ঝাপসা ছবিটা হঠাৎ করে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে গেল। এও বলে রাখা ভালো, ইনসিওরেন্স অফিসে খোঁজ নিয়ে
জেনেছিলাম, ওখানে হারানো হিরেটির
জন্য ইনসিওরেন্স ক্লেম হয়েছে, করেছেন বসু সাহেব। তীর্থবাবু, অবাক হচ্ছেন? আমায়
কিন্তু কলকাতার প্রতিটি থানার সঙ্গে যোগাযোগ
রেখে চলতে হয়। তাই শাসমলবাবু, চাকলাদারবাবু আরও
অনেকজনের সঙ্গেই আমার আলাপ আছে।
কী বলেন,
শাসমলবাবু?”
সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। আমার কপালে
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে। কিন্তু কীই বা বলতে পারি আমি? কীই বা
করতে পারি এখন? পিসিএম তো সবটুকুই ধরে ফেলেছেন।
প্রভাতবাবু আবার শুরু করলেন, “কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে, তীর্থবাবু খুন করতে যাবেন কেন? ওঁর মোটিভ
কী? তাও কিনা প্রণবেশকাকুকে,
যিনি একাই ব্যাবসার হাল ধরে রেখেছিলেন এত বছর? উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভ, বিখ্যাত হবার লালসা? তীর্থবাবুকে যে সবার উপরে যেতে হত বাই হুক অর ক্রুক। অনেকদিন ধরেই উনি সবার চোখের আড়ালে প্রণবেশকাকুর উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছিলেন যাতে উনি পুরো টাকাপয়সার উপর দখল
নিতে পারেন এবং ইচ্ছেমতো তাঁর অভীষ্ট
লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন। সেনবাবু রাজি হচ্ছিলেন না। ওঁর মতে পেনের পিছনে যথেচ্ছ টাকা ঢালা একান্তই মূল্যহীন। তিনি অনেকবার তীর্থবাবুকে বুঝিয়েও ফল না পেয়ে শেষটায় বেশ শক্তভাবেই বাধা দিতে শুরু করেন। তাই অদ্ভুতভাবে অনেক
বুদ্ধি খাটিয়ে একেবারে নতুন ধরনের
মোডাস অপারেন্ডি প্রয়োগ করে ওঁকে সরাতে চেয়েছিলেন ও সফলও
হয়েছিলেন উনি। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? পেনটা ফেরত দিতে চেয়েছিল সুবিমল, নিয়েই নিতে
পারতেন, বসু-সাহেব। তাহলে আর এদিন দেখতে হত না আপনাকে।
“তারপরের খটকা হল হিরে।
ওই মহামূল্য হিরে হারিয়েও একটা লোক কোন সাহসে ফিক্সড ডিপোজিট
ভাঙিয়ে পেন কেনে ৭.৩ কোটি ডলার খরচ করে? এখানে বলে রাখা
ভালো, এই একেকটি পেন হচ্ছে…”
হঠাৎ পারুইমশাই বলে উঠলেন, “যাকে বলে সাত
রাজার ধন এক মানিক। হে হে
হে।”
প্রভাতবাবু বলে চললেন, “এগুলির
রিসেইল ভ্যালু সাংঘাতিক। অসময়ে যদি বিক্রি করতেও হত, একটি বিক্রি করলেও তীর্থবাবুকে আর টাকাপয়সা
নিয়ে চিন্তা করতে হত না বহুদিন।”
এরপর হঠাৎ নাড়ুকাকার উদ্দেশ্যে প্রভাতবাবুর ডাক,
“নাড়ুকাকা, আমাদের চা খাওয়াবেন না? আর শুনুন, ভিতরের ঘরের
সিন্দুক থেকে সব পেনগুলো বার করে নিয়ে আসুন আস্তে আস্তে। শাসমলবাবু, আপনি একটু ওঁর সঙ্গে যান।”
নাড়ুকাকা
বিধ্বস্তভাবে চোখের জল মুছতে মুছতে ভিতরে চলে গেল। ওই বৃদ্ধ মানুষটাও বুঝে গেছে যে তার আদরের খোকা খারাপ লোক, বদমায়েশ লোক।
আমার মাথা নিচু হতে হতে প্রায় বুক
অবধি ঝুলে পড়ছে। কতগুলো
মানুষের জীবন নষ্ট করার দায় আমার উপর! কেন
করলাম এসব?
একে একে পেনগুলো সাজিয়ে ফেলা হল।
প্রত্যেকের বিস্ময়সূচক দৃষ্টির সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল আমার
প্রাণাধিক প্রিয় ঐশ্বর্যের সম্ভার। সম্ভত শেষবারের মতো। পিসিএম
তুলে নিলেন আমার কেনা সর্বশেষ পেন - Mystery Masterpiece -
Mont Blanc & Van Cleef & Arpels Limited Edition, ৭.৩
কোটি ডলার যার দাম।
প্রভাতবাবু বললেন, “এই পেনটি তীর্থবাবু কেনেন তাঁর হিরেটি হারাবার পর ওই পাহাড়প্রমাণ অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু হিরেটি কি সত্যি হারিয়েছে?”
সকলে চমকে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই কবজির মোচড়ে অত্যন্ত অভ্যস্ত ভঙ্গিতে
পেনটি খুলে ফেলে কালি ভরার প্রকোষ্ঠ থেকে বিস্তর টানাটানি করে কিছু একটা বার করে
আনতে আনতে বললেন, “হিরে
পৃথিবীর কঠিনতম রত্ন বলে এটাকে অ্যারালডাইট দিয়ে লাগিয়ে রেখেছিলেন তীর্থবাবু। শক্ত
করে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন এটাকে। সঙ্গে
উপরি পাওনা ইনসিওরেন্স কোম্পানির মোটা ক্ষতিপূরণ। দাবার চালগুলো বেশ চেলেছিলেন মশাই, কিন্তু মাত হতে হল।”
আমার দৃষ্টি
ঝাপসা হওয়া শুরু হল।
“আপনি বোধহয় শেষের দিকে আমায় সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন তীর্থবাবু, তাই
না?” পিসিএমের দৃষ্টি সটান আমার উপর, “সেদিন যখন আমি আপনার পেনগুলো নানাভাবে পরীক্ষা করছিলাম, তখন হয়তো আপনার চোখ এড়ায়নি আমার অভিব্যক্তি। আপনিও তো আমারই মতো ফেলুদা-ভক্ত। সবক’টি বই আছে আপনার সংগ্রহে। আর তাই নিজেকে আরও নির্দোষ প্রমাণ করতে নিজের কুকুরটাকেও মেরে ফেললেন আপনি। আপনি কী ধরনের মানুষ বলতে পারেন? প্রমাণ
করে ছাড়লেন মশাই, The Pen is Mightier than the Sword।”
ডুকরে কেঁদে উঠল নাড়ুকাকা। আমার সমস্ত শরীরটার উপর যেন মাধ্যাকর্ষণের টান
ভয়ংকর প্রবল বোধ হতে লাগল।
“He’s
all yours, শাসমলবাবু। আসি, তীর্থবাবু। চলুন পারুইমশাই, চল
নন্দন।” বলে ঘর থেকে
বেরিয়ে গেলেন প্রভাতবাবু। না পিসিএম, না ফেলুদা স্বয়ং?
জানালার বাইরে চোখ যেতে দেখলাম, পারুইমশাই, নন্দন আর প্রভাতবাবু তাঁদের
বাহন, একটি মার্ক টু অ্যাম্বাসেডরের দিকে
এগিয়ে যাচ্ছেন যার রঙ গাঢ় সবুজ। মাথাটা স্রেফ ঘুরে
উঠল।
আমার কান বলল, সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের ভ্যান
আমার বাড়ির সামনে এসে থেমে যাচ্ছে। আজ সবাই
ছুটে আসবেই তো। এফডি ৭৭৭ যে আজ সত্যিই খ্যাতনামা হয়ে উঠল, কুখ্যাত!
আমার বিশ্বস্ত চার বন্দুকবাজের ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আজ আর কোনও কাজ নেই। ঘরের ভিতরে আমার টেবিলের ড্রয়ারের ভিতর সযত্নে লালিত পিস্তলও সেভাবেই শুয়ে রইল অসহায়ভাবে। তার মালিককে সেও এ-জীবন
থেকে অব্যাহতি দিতে অক্ষম।
প্রভাতবাবু যে আমার ঠিক সামনে শাসমলবাবুকে বসিয়ে রেখে গেছেন - অনন্ত পাহারায়!
আমার দু’চোখের সামনে ধীরে ধীরে অন্ধকার
নেমে আসতে থাকে। রঙ্গের শেষে
যবনিকাপাতের মতন।
_____
অলঙ্করণঃ
শ্রীময় দাশ
No comments:
Post a Comment