সিরাজের পানপাত্র
দেবদত্তা ব্যানার্জী
(ম্যাজিক ল্যাম্প শারদ সংখ্যায়
আমার লেখা ‘হিউয়েন সাংয়ের বাতিদান’ যারা পড়েছেন তারা আমার গল্পের মূল চরিত্রদুটির
সঙ্গে পরিচিত। বাকিদের গল্পটা পড়ে নিতে অনুরোধ করব।)
দুই বাংলার সাহিত্য
সম্মেলন উপলক্ষ্যে এপার
বাংলা ওপার বাংলার বিশিষ্ট সব লেখক ও কবিদের সঙ্গে দিঠির ভালোই কাটল দু’দিন। অনুষ্ঠান শেষে লেখক অচিন্ত্য সেন দিঠিকে পরদিন সন্ধ্যায় ওঁর উত্তরপাড়ার বাড়িতে এক সাহিত্যসভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দিঠির লেখা বই গতবার
শ্রেষ্ঠ নবাগত লেখিকার পুরস্কার পাওয়ার পর সাহিত্যজগতে ওর বেশ নামডাক হয়েছে। অচিন্ত্যবাবুর
সঙ্গে দিঠির লেখালেখির জগতে এসেই পরিচয়। ওঁর
সঙ্গে এমন এক সম্মেলনেই প্রথম
আলাপ হয়েছিল। অয়ন একটা বড়ো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত কয়েকদিন ধরে। বলেছিল চলে যেতে, ও রাতে নিয়ে আসবে।
পরদিন সন্ধ্যাটা দিঠির
ভালোই কাটল। বেশ ঘরোয়া আড্ডা, দিঠির মতো তরুণ লেখক ছিলেন দু’জন।
এছাড়া চারজন লেখকের মধ্যে দু’জন ওপার বাংলার নামকরা সাহিত্যিক। উঠতি লেখিকা ছিলেন আরও একজন, সবিতাদি।
দোতলায় লাইব্রেরিতে মজলিস বসেছিল। সবাই নিজেদের কিছু কিছু লেখা পাঠ করছিলেন, সেসব নিয়ে আলোচনাও হচ্ছিল। দিঠির একটা গল্পর উপর বিতর্ক চলল বেশ
কিছুক্ষণ।
ঢাকা থেকে এসেছিলেন লেখক
শামীম রেজা-উল করিম আর গোলাম আহমেদ। শামীম-ভাইয়ের
বাবার বন্ধু ছিলেন সাহিত্যিক বরুণ চৌধুরী যিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছিলেন। বাবার
ডায়েরি পড়ে এই বরুণবাবু সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য জেনেছিল শামীম-ভাই যা নিয়ে সেই পটভূমিকায় উনি পরের উপন্যাস লিখছিলেন। ওঁর বাবা আবদুল করিমও কবি ছিলেন। ওঁর তখনকার
বন্ধু ছিলেন অচিন্ত্য সেন ও মিলন মণ্ডল, প্রকাশক জয়ন্ত
শিকদার। আজ ওঁরা সবাই উপস্থিত ছিলেন।
অবশেষে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা নিচের ডাইনিংয়ে।
খাওয়াদাওয়া মিটতেই মুষলধারে
বৃষ্টি নেমে গেল। তরুণ লেখক দু’জন চলে গেলেন। অয়ন নিতে আসবে বলে দিঠি ওয়েট করছিল। নিচের
হলে সবাই এসে বসেছিল। শামীম-ভাই
অচিন্ত্যবাবুকে বললেন, “কাকুমণি, একবার কি জিনিসটা সবাইকে দেখাবেন? আমিও দেখিনি ওটা।”
আহমেদ-ভাই বললেন, “আমিও
গল্পটা শুনেছি। আজ কি দেখতে পাব?”
অচিন্ত্যবাবু বললেন,
“নিশ্চয়ই দেখাব, আমি আনছি।”
দিঠি অবাক হয়ে তাকিয়ে সব
শুনছিল। কী নিয়ে আলোচনা বোঝার চেষ্টা করছিল।
উনি উঠে ওপরে গেলেন।
সবিতাদি বললেন,
“সেই পানপাত্র! ওটা কি সত্যি সিরাজের ছিল? এমন কথা একটা শুনেছিলাম।”
জয়ন্তবাবু বললেন,
“আমি আগেও দেখেছি। সিরাজের কি না জানি না, তবে জিনিসটা নবাবের আমলের এবং দামি, এটুকু জানি।”
একটু পরেই একটা কাঠের
কারুকার্য করা বাক্স হাতে নেমে এলেন
উনি। বাক্সটা খুলতেই নীল ভেলভেটের খাঁজে একটা চ্যাপ্টা রূপার রত্নখচিত চারকোনা
পানপাত্র বেরিয়ে এল। পাত্রর গায়ে অপূর্ব কারুকার্য।
জিনিসটা বেশ পুরোনো বোঝা
যাচ্ছে। রূপার জৌলুস কমলেও রত্নগুলো থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছিল। সবাই অবাক হয়ে
দেখছিল পাত্রটা, গলার কাছে ছিপিটা সোনার। একটা বড়ো নীলা পেটের কাছে। আগেকার দিনে রাজা-মহারাজারা
নিজেদের জোব্বার পকেটে এমন পাত্রে সুরা রাখতেন।
সবাই যখন অবাক হয়ে ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে পাত্রটা দেখছেন, অচিন্ত্যবাবু বললেন,
“এটা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সুরাপাত্র। আমি এটা
সংগ্ৰহ করেছিলাম আমার এক বন্ধুর থেকে। বরুণ সাহায্য করেছিল খুব সে সময়। সেই বন্ধু এটা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। সিরাজের
মারাত্মক মদের নেশা ছিল সবাই জানো নিশ্চয়ই। নানারকম
পানপাত্রে নেশা করতেন নবাব। এই
পাত্রটা নাকি শেষ সময় পর্যন্ত তার কাছে ছিল। শুধু
জুতো নয়, এই পানপাত্র তাকে ধরিয়ে দিতে
সাহায্য করেছিল। বহু হাত ঘুরে এটা আমার কাছে আসে।”
দিঠি পানপাত্রটা ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে দেখছিল। এর অ্যান্টিক ভ্যালু সম্পর্কে ওর
কোনও ধারণাই নেই। শুধু বহুমূল্য রত্নর জন্যই এটার দাম প্রচুর
আশা করা যায়। সবাই ওটা হাতে মোবাইলে ফটো
তুলছিল।
দিঠি অচিন্ত্যবাবুকে
প্রশ্ন করে, “আচ্ছা, এটা কি বাড়িতেই থাকে? বাড়িতে এটা রাখা কি সেফ?”
“আমার
বাড়ি ব্যাঙ্কের লকারের থেকে বেশি সেফ। আমার দুটো পোষা জার্মান শেফার্ড দোতলা
পাহারা দেয়। ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যদি কেউ আমার ঘরে ঢুকেও পড়ে, সিন্ধুক খুঁজে পাবে না। যদি খুঁজেও পায়, খুলতে পারবে না। আমি ছাড়া কেউ ঐ ডিজিটাল লক খুলতে পারবে না।”
একটু পরেই তিনি ওটা রেখে
আসতে গেলেন। মিলনবাবু আক্ষেপ করে বললেন, “কার জিনিস কার হাতে! এটা আজ কোথায় থাকার কথা!”
শামীম-ভাই বললেন, “শুনেছিলাম
এটা সোজা পথে ওঁর হাতে আসেনি।”
এরপর নানারকম গল্প হচ্ছিল।
বরুণ চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎ করে শামীম-ভাই বললেন, “আপনারা
অনেকেই বরুণকাকাকে চিনতেন। মিলনকাকু, বরুণকাকা আর আমার আব্বুর আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ লাগোয়া বাংলাদেশে। পরে
১৯৭১-এ মিলনকাকু আর বরুণকাকারা এদেশে
কলকাতায় চলে আসেন। লেখার সূত্রে যোগাযোগ থেকেই গেছিল। বরুণকাকার জীবনে কোনও মহিলার
ব্যাপারে কেউ কিছু জানেন? উনি কি
বিয়ে করেছিলেন? ওঁর
মৃত্যুটা কি আত্মহত্যাই ছিল?”
এমন একটা কথা শুনে সবাই
অবাক। অচিন্ত্যবাবু বললেন, “বরুণের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো আলাপ ছিল। ও
হঠাৎ চলে গেল, বিয়ে ও করেনি। পরিবারে তেমন কেউ নেই। মিলন, তুমি কিছু জানো এ-ব্যাপারে? তোমরা তো ছোটোবেলার বন্ধু মনে হয়।”
মিলন মণ্ডল অনেকক্ষণ চুপ
করে থেকে বললেন, “এতদিন পর ওসব খোঁড়াখুঁড়ির কি
দরকার আছে?”
মিলন বাবুর গলায় বিরক্তি
ঝরে পড়ে। পরিস্থিতি একটু গম্ভীর হয়ে যায়।
বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সবিতাদি
বললেন, “ওঁকে হত্যা
করেছিল ওঁর পরিচিত কেউ। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে
তদন্ত হয়নি শুনেছি।”
“আমিও
আব্বুর ডায়েরিতে এমন কিছু পেয়েছি, সে ব্যাপারেই খোঁজ নিচ্ছি। এই পানপাত্রটা সম্পর্কে উনি একমাত্র সব
জানতেন। হয়তো তাই ওঁকে চলে যেতে হয়েছিল। আমি
পানপাত্রটা সম্পর্কে আরও খবর জোগাড় করেছিলাম। এটা বাংলাদেশ থেকে চুরি গেছিল মনে
হয়।”
সবিতাদির উবের ক্যাব এসে
গেছিল। উনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই জয়ন্তবাবু আর মিলনবাবুকে অচিন্ত্যবাবু
বললেন, “এত রাতে
এই বৃষ্টিতে তোমাদের আর ফেরা হবে না আজ। নিচের ঘরে আহমেদ আর শামীমরা থাকছে, তোমরাও আজ আমার বাড়ি থেকে যাও।”
আকাশের পরিস্থিতি দেখে
ওঁরাও রাজি হয়ে গেলেন। জয়ন্তবাবু বললেন,
“তোমার কুকুরদুটো বেঁধে রেখ ভাই!”
সবাই হেসে উঠেছিল
ওঁর কথায়।
এমন সময় দিঠির মোবাইল বেজে
উঠল। অয়ন এসে গেছে। দিঠিও সবার
থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল। আহমেদ-ভাইয়ের ভোরের ফ্লাইট, ও রাত থাকতেই বার হবে বলে তখনি ঘরে
চলে গেল।
পরদিন সকালে চা নিয়ে বসে
দিঠি অয়নকে ঐ পানপাত্রের গল্প করছিল। মোবাইলে ফটো দেখাচ্ছিল। তক্ষুনি অয়নের ফোনে
ওর অফিসের থেকে একটা ফোন আসে। জার্নালিস্টদের এটাই মুশকিল। যখন তখন অফিসের ডাক। দিঠি বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে। অয়নের
এক তরফা কথায় বুঝতে পারে কিছু ঘটেছে।
কিন্তু বিস্ময় তখনও বাকি ছিল। ফোনটা রেখে দশ সেকেন্ড অয়ন চুপ করে বসে ছিল। তারপর দিঠিকে
উদ্দেশ্য করে বলে, “পানপাত্র
খেল দেখাতে শুরু করেছে। তোমার অচিন্ত্যবাবু আর নেই। নিজের ঘরে ঘুমের ভেতর উনি শেষ। আমায় এখন যেতে হবে।”
দিঠি কেঁপে ওঠে। মাত্র
কয়েক ঘণ্টা আগেও ভদ্রলোক কত গল্প করলেন। পুরো সুস্থ লোকটার কী এমন হল!
তবে কি ঐ পানপাত্র ওঁর বিপদ ডেকে আনল!
দিঠিও রেডি হয়ে নিল ওর সঙ্গে যাবে বলে। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার উত্তরপাড়ায় অচিন্ত্যবাবুর বাড়ি এসে
পৌঁছে গেল। কাল মাঝরাতে দিঠিরা বেরিয়ে যাওয়ার
সময় বৃষ্টি একটু ধরেছিল। ভোর থেকে আবার শুরু হয়েছে। এখনও এখানে ওখানে জল জমে রয়েছে।
পুরনো দিনের বড়ো বাড়ি ছিল অচিন্ত্য সেনের। বিশাল বড়োলোক
ওঁরা, দেখলেই বোঝা যায়। বিশাল লাল রঙের দোতলা বাড়ি।
বাগান পেরিয়ে সামনে বড়ো লোহার গেট। দারোয়ান অয়নের গাড়িতে
প্রেসের স্টিকার দেখেই হয়তো দরজা
খুলে দিয়েছিল। আরও দুটো ওবি ভ্যান আর বাইক রয়েছে। দুটো পুলিশের জীপ এসে গেছে।
অয়ন আর দিঠি ড্রইং রুমে
ঢুকতেই মিলনবাবু, শামীম-ভাই, আর
জয়ন্তবাবুকে দেখতে পেল। একধারে রয়েছেন পুলিশের দুই
অফিসার মিঃ পাইন আর গদাধর দত্ত বসাক। অয়ন আর দিঠি দু’জনের সঙ্গেই পূর্বপরিচিত। এছাড়া কয়েকজন
টিভির লোক আর রিপোর্টার চোখে পড়ল।
অয়নদের দেখে জয়ন্তবাবু
আর মিলনবাবু এগিয়ে এলেন। কাল রাতের বৃষ্টিতে মিলনবাবু আর
জয়ন্তবাবু ফিরতে পারেননি। আহমেদ আর শামীমের এখানেই রাতে থাকার কথা ছিল। শামীমরা
ছিলেন নিচের গেস্ট রুমে। জয়ন্তবাবু আর
মিলনবাবু উপরে অচিন্ত্যবাবুর পাশের ঘরেই ছিলেন। রাত প্রায় একটায় সবাই শুতে গেছিলেন
কাল। মিলনবাবু আর জয়ন্তবাবু নাকি শুয়েই ঘুমিয়ে গেছিলেন। সকালে সাড়ে ছ’টায় ওঠেন জয়ন্তবাবু।
মিলনবাবু তখন নাক ডাকছেন। বারান্দায় এসে জয়ন্তবাবু
কিছুক্ষণ বসেন। বাড়িটা গাছপালায় ঘেরা, তাই নানারকম
পাখির আওয়াজ আসছিল। খোলা জানালা দিয়ে অচিন্ত্যবাবুর বেডরুম দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ
জয়ন্তবাবুর মনে হয় অচিন্ত্যবাবুর শোওয়াটা নর্মাল নয়। কেমন একটা বেঁকে-চুরে শুয়ে আছেন উনি, মুখের পাশ দিয়ে গ্যাঁজলা শুকিয়ে
আছে। সঙ্গে সঙ্গে উনি মিলনবাবুকে ডাকেন। দু’জনে মিলে গিয়ে ভেজানো দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন। ততক্ষণে
শরীর ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে গেছে। কাজের লোকেরা ডাক্তারকে খবর দিতেই
পারিবারিক ডাক্তার এসে বলেন, বিষক্রিয়ায়
মৃত্যু। তবে কী বিষ বোঝা যাচ্ছে না।
কুকুরের ডাক অনেকক্ষণ থেকেই
শোনা যাচ্ছিল। কাজের লোক হরিকাকা বলল, রাতেই
কুকুরদুটোকে বেঁধে রাখতে বলেছিলেন অচিন্ত্যবাবু। বাড়িতে অতিথি রয়েছে। ওরা খুব
হিংস্র, তাই।
অয়ন আর দিঠি দু’জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে
ওপরে গেল। ফরেনসিকের লোক কাজ করছে। ভেতরে ঢুকতে দেয়নি ওদের। দরজার বাইরে থেকেই
যতটুকু দেখা যায় ওরা দেখল। শামীম দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। দিঠিকে
দেখে বলল, “কী হয়ে গেল? আমরা সবাই এখানেই ছিলাম, অথচ...”
“আমি চলে
যাওয়ার পর ঠিক কী কী হয়েছিল?”
দিঠি জানতে চায়।
“তারপরেই
সভা ভঙ্গ হয়। আসলে আমার বরুণবাবুকে নিয়ে লেখালেখি ওঁদের কারও পছন্দ ছিল না। আমি নিচের ঘরে চলে
যাই আহমেদদার সাথে। ওঁরা উপরে চলে আসেন। আহমেদদার
ভোরের ফ্লাইট ছিল। সাড়ে চারটায় গাড়ি বলা ছিল। রাত
থাকতেই বেরিয়ে যান উনি।”
দিঠি চমকে উঠেছিল।
তাড়াতাড়ি বসাক আর পাইনদাকে গিয়ে বলল, “অচিন্ত্যবাবুর কাছে একটা আ্যন্টিক ঐতিহাসিক জিনিস ছিল। যেটা উনি কাল রাতেই
আমাদের দেখিয়েছিলেন। আমি চিন্তিত যে সেটার জন্য খুন হয়নি তো? ওটা ওঁর ঘরের কোনও গুপ্ত
সিন্দুকে ছিল। প্লিজ, একটু দেখুন।
আর একজন গেস্ট ভোর সাড়ে চারটায়
বেরিয়ে গেছেন। এয়ারপোর্টে খোঁজ নিন, ওঁর আটটার ফ্লাইট হয়তো টেক অফ হয়ে গেছে।”
পাইন আর বসাক একে অপরের
দিকে তাকায়। অয়ন আর দিঠির সঙ্গে দু’জনেরই পরিচয় আছে। পাইন এয়ারপোর্টে
ফোন লাগায়। বসাক ঐ দোতলার ঘরে গিয়ে ঢোকে আবার। সারা ঘরে সিন্দুকের খোঁজ চলছে। পুরোনো কাজের লোকেদের ডাকা হল। লফট, বাথরুম,
লাইব্রেরি, বুক-সেলফ সব
খোঁজা হল। কোথাও কোনও সিন্দুক নেই। বইয়ের আলমারিগুলোয় দামি ডিজিটাল লক বসানো। স্টিলের জামাকাপড়ের আলমারিতেও কিছু
নেই। বক্স খাটের ভেতর থেকে রিডিং টেবিল, কোথাও
কিছু নেই।
দিঠি ভাবে, জিনিসটা কি উড়ে গেল? থাকলে কোথায় আছে? অন্য ঘরগুলো তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। সবার ব্যাগ চেক করা হল। অবশ্য
সবাই সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু কোথাও নেই ওটা। হরিকাকা বহু পুরোনো লোক। উনিও সিন্দুকের খবর
দিতে পারলেন না। ওঁর বড়োছেলে বিদেশে আর ছোটোছেলে এই বাড়িতেই ছিল। মেয়ে
জামশেদপুর থেকে রওনা দিয়েছে খবর পেয়ে।
ছোটোছেলে
অনন্ত একটা মিউজিক ব্যান্ড চালায়। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়। সে ভোরে
ফিরেছে প্রোগ্ৰাম করে। সিন্দুকের কথা বলতে পারল না কিছু। বাবার
মৃত্যুতে ঘাবড়ে গেছে, তবে দুঃখ পায়নি। দিঠি ওর সঙ্গে কথা বলে হতাশ হয়। বাবা আর ছেলের মধ্যে যোগাযোগ কম ছিল।
দিঠি মন দিয়ে চিন্তা করছিল। এক খাবার সবাই খেয়েছিল রাতে। উনি আলাদা করে কিছুই খাননি। রাতে প্রেশারের
আর সুগারের ওষুধ খেতেন, হরিকাকা বলেছিল। দিঠি টেবিলের ওষুধগুলো ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখে টেবিলে
কালচে গুঁড়ো জাতীয় কিছু পড়ে রয়েছে। হরিকাকা
বলে, “বাবু সুগারের জন্য রোজ রাত্রে মেথি-গোলমরিচ
গুঁড়ো খেতেন।”
পাশেই একটা প্লাস্টিকে
সাদা মশলার কৌটায় রাখা ছিল সেই গুঁড়ো। সঙ্গে
সঙ্গে দিঠি বসাককে বলল ঐ কৌটা ফরেনসিকে পাঠাতে।
“কতদিন
ধরে এই গুঁড়ো খেতেন উনি?”
হরির দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করে দিঠি।
“তা চার বছর হবে। রোজ রাতে আর সকালে খেতেন ওটা। আমি
গুঁড়ো করে রাখতাম।”
“লাস্ট
কবে করেছিলে গুঁড়ো?” দিঠি আবার জিজ্ঞেস করে। কৌটায় অর্ধেকের বেশি গুঁড়ো রয়েছে তখনও।
“হবে পাঁচ-সাতদিন আগে। অত মনে নেই। মাসে দু’কৌটা
লাগত। এটা প্রথম কৌটা।” হরি বলেই বলে,
“কিন্তু... কৌটাটা একবার দেখি?”
বসাক রুমাল দিয়ে আলতো করে
ধরেছিল। হরি ধরতে যেতেই বলল,
“সাবধান, হাতের ছাপ থাকতে পারে।”
“এটা
বাবুর কৌটা না। সেটা এমন দেখতে হলেও পুরনো, আর ঢাকনাটার প্যাঁচ কেটে গেছিল। এটা নতুন, চকচকে। এটা ওঁরটা নয়।”
দিঠি, বসাক আর অয়ন একে অন্যের দিকে তাকায়। হরিকে বলে এসব কথা কাউকে না বলতে। দিঠি মনে করছিল, কাল কে কে এই ঘরে ঢুকেছিল।
অচিন্ত্যবাবুর খবরটা পেয়ে
ওঁর প্রকাশক, শুভানুধ্যায়ীরা
আসতে শুরু করেছিল। নিকট আত্মীয়রাও আসছিল। বডি পোস্ট মর্টেমের পর ওঁরা পিস হেভেনে রাখবে কি না সে নিয়ে জল্পনা চলছে। এর মধ্যেই মেয়ে-জামাই এল। তবে এবারেও কোনও কান্নাকাটি নেই।
দিঠি আস্তে আস্তে
লাইব্রেরিতে এসে বসল। বেডরুম থেকে বার হলেই বাথরুম আর
পাশেই লাইব্রেরি। উলটোদিকের ঘরে মিলনবাবুরা ছিলেন। বারান্দায় দুটো ঘর দিয়েই যাওয়া যায়। দিঠির মাথায় তখন একটাই চিন্তা, এই ঘরেই কাল খুনি ছিল। অর্থাৎ,
দিঠি তার সঙ্গে কথাও বলেছে। কিন্তু মুখোশের আড়ালে কার মুখ? জিনিসটাই বা কোথায় গেল? সিন্দুকটাই বা কোথায়? অনেকেই উঠে বারান্দায় বা বাথরুমে
গেছিল। দিঠি নিজেও বেডরুমের সঙ্গের
বাথরুমটাতেই গেছিল ডিনারের আগে। অনেকেই সুযোগ পেয়েছে কৌটোটা বদলানোর।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ও টেবিলের খাতা-বইগুলো
ঘাঁটছিল। হঠাৎ অচিন্ত্যবাবুর ডায়েরিটা ওর
হাতে আসে। অন্যের ডায়েরি এভাবে পড়া উচিত নয় দিঠি জানে। কিন্তু মানুষটাই যখন এভাবে চলে গেল আর
ওঁর মূল্যবান একটা
জিনিস যখন পাওয়া যাচ্ছে না, দিঠি ঐ
ডায়েরিটাই খুলে বসল।
রোজ নয়, মাঝে মাঝে লিখতেন উনি। বেশ কিছুটা অগোছালো কথা পড়তে পড়তে দিঠির চোখ
একটা জায়গায় আটকায়। উনি
পনেরো দিন আগে লিখেছিলেনঃ শামীম আসছে ওর এক বন্ধু লেখককে নিয়ে। ও কেন আসছে! পানপাত্রটা দেখতে চাইছে
কেন?
তার তিনদিন পর লিখেছিলেনঃ মিলনটা বড্ড বেড়েছে। ডানা ছাঁটতে হবে। সবার
চোখ পানপাত্রের দিকে।
গত সপ্তাহে লিখেছিলেনঃ পাপ চাপা থাকে না। জয়ন্তটাও কি একই দলে!
এছাড়া আরও হাবিজাবি কথা।
শেষ পাতায় লেখা ছিল একটা
কোটেড টেক্সট। তবে লেখাটায় কোনও ডেট নেই।
মনে হয় পুরনো লেখাঃ “বইয়ের মধ্যে জ্ঞান...!
মূল্যবান লেখাও চুরি যায়...! যদি বই করে রাখি... তবে আর নেই ভয়...।”
আর একটা হিজিবিজি কাটাকুটি।
মনে হয় ‘সিন্দুক’ কথাটা
লিখে কেটে দিয়েছেন। কাটাকুটিটাকেও সিন্দুকের মতো করে কেটেছেন।
হঠাৎ দিঠির মনে হয়, এই লাইব্রেরিতেই সিন্দুকটা লুকানো
আছে। যদিও পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি। কয়েকটা আলমারিতে ডিজিটাল লক
খুলতে পারেনি পুলিশ। কোম্পানির লোক আসবে আজকেই লক খুলতে। দিঠি পুরনো ডায়েরি খুঁজছিল, যদি কিছু পুরনো ডায়েরি পড়ে জানা যায়। একটা বন্ধ আলমারিতে পুরনো কয়েকটা ডায়েরি ছিল। মোট পাঁচটা। রোজ নয়, বিশেষ বিশেষ ঘটনা লিখতেন মনে হয়। দিঠি বেশ কয়েকটা খুলে দেখে। ডায়েরিগুলো সময় নিয়ে মন দিয়ে পড়ে দেখতে হবে। ডায়েরিগুলো চুপচাপ ব্যাগে ভরে দিঠি উঠে আসে বাইরে। অয়ন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
সবার বয়ান নেওয়া হচ্ছে।
শামীম-ভাই নিচের বারান্দায় বসেছিল। দিঠি গিয়ে ওর থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করে। বলে,
“আচ্ছা, এই পানপাত্রটা কীভাবে উনি পেয়েছিলেন, আপনি
কিছু জানেন?”
“আব্বুর
মুখেই শুনেছিলাম, রায়টের সময় জমিজমা হারিয়ে অনেকেই
খুব গরিব হয়ে যায়। সে সময় কেউ এটা খুব গোপনে বিক্রি করেছিল হয়তো। পারিবারিক
জিনিস, অনেক ওয়ারিশ। তাই হয়তো গোপনীয়তা। বরুণকাকা বাবাকে এটার
কথা বলেছিল।”
“বরুণবাবুর
মৃত্যুটা নিয়ে কাল বলছিলেন কিছু...”
“উনি
এদেশে এসে প্রথম জীবনে খুব কষ্ট করেছেন। বড়ো সংসার, অনেক ভাইবোন। বোনেদের বিয়ে, ভাইদের পড়াশোনা এসব
করতে গিয়ে লেখালেখি কমে গেছিল। কয়েকবছর আগে হঠাৎ ঘুমের ভেতর মারা যান। মৃত্যু
নিয়েও বিতর্ক ছিল প্রচুর, অস্বাভাবিক মৃত্যু।”
“আপনার কী মনে হয়?” দিঠি আরও কিছু জানতে চাইছিল।
“এসব
ব্যাপারে তথ্যসংগ্ৰহ করতেই এবার এসেছি। কাজটা আটকে গেল। তবে বরুণকাকাই এই পানপাত্রের
খবরটা প্রথম সবাইকে বলেছিল। আব্বুও ওটা কিনতে আগ্ৰহী ছিল। তবে অচিন্ত্য-কাকুমণি কোনওভাবে জিনিসটা আগেই কিনে নেয়।”
জয়ন্তবাবু এসে সেসময় ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন। বললেন,
“জিনিসটা কি তাহলে চুরি হয়ে গেল!”
“এখনও বলা যাচ্ছে না। আরেকটু খোঁজা হোক।” দিঠি
বলে।
“এখন? আমরা কখন বাড়ি ফিরব?” ওঁর গলায় বিরক্তি। কেউ উত্তর দেয় না।
মেয়ে-জামাই সবার সঙ্গেই কথা বলছিল। তবে মেয়েও
সিন্দুকের কথা জানত না। পানপাত্রর খবর ছেলেমেয়ে
কেউ জানত না। সন্তানদের সঙ্গে ওঁর একটা
দূরত্ব ছিল বোঝা যায়। ওঁর স্ত্রী মারা গেছিলেন
বহুদিন আগে। সন্তানরা হোস্টেলেই মানুষ হয়েছিল।
সব কাজ শেষ করে বডি চালান
করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিল। লক খুলিয়েও
সিন্দুক পাওয়া যায়নি। গোলাম আহমেদ ঢাকা চলে গেছিলেন। ওঁকে সন্দেহ করা হচ্ছিল।
কিন্তু শামীম-ভাই বলেছিলেন, রাতের বাকিটুকু ওঁরা গল্প করেই কাটিয়েছিলেন। উনি ঘরের
বাইরে যাননি। অবশ্য মাঝে শামীম বাথরুমে গেছিলেন কয়েক মিনিটের জন্য ফ্রেশ হতে।
অয়ন আর দিঠি রাতে খাওয়াদাওয়ার
পর মুখোমুখি বসেছিল কেসটা নিয়ে আলোচনায়। অয়ন বলছিল,
“মানুষটাকে খুন করা হয়েছে প্ল্যান করে। ঐ বাড়িতে রাতে
যারা গেছিল তাদের মধ্যে কেউ বিষ দিয়েছিল। তার মানে খুন করাই উদ্দেশ্য ছিল। চুরিটা
হয়েছে কি না এখনও শিওর নই আমরা। জিনিসটা বাড়িতেই ছিল বলছ
তোমরা, রাতে উনি দেখিয়েছিলেন সবাইকে। অথচ সিন্দুকটাই হাওয়া!”
“ওঁর কয়েকটা
ডায়েরি পেয়েছি।
জয়ন্তবাবুর কাছে প্রচুর টাকা পেতেন। ধার দিয়েছিলেন। মিলনবাবুকে
পছন্দ করতেন না। শামীম যে পানপাত্রের খোঁজ
করবে, জানতেন। ছোটোছেলেকে পছন্দ করতেন না। একটু অহংকার ছিল। এসব লোকের প্রচুর শত্রু থাকে।”
“তা চুরির
ডায়েরিগুলো দেখতে পারি?”
অয়ন হেসে বলে, “বসাক আর পাইনদা যদি জানতে পারে তোমার চুরির কথা...”
“চুরিটা
করলাম বলে কত কিছু জানলাম। এবার আরেকটা ডায়েরি ধরব, যদি বরুণবাবুর মৃত্যু-রহস্য
উদঘাটন হয়!”
দিঠি তিনটে ডাইরি টেবিলে
রাখে; আর দুটো নিয়ে বেডরুমে চলে
যায়।
পরদিন সকালে দিঠির উঠতে
দেরি হয়েছিল। অনেক রাত অবধি পড়েছিল এসব। শামীম-ভাই হোটেলে চলে গেছিল। পুলিশ ওকে আপাতত বাড়ি ফিরতে দেবে না। প্রয়োজনে
আহমেদকেও আবার ডেকে পাঠাবে ঢাকা থেকে। অবশ্য তাতে অনেক ঝামেলা আছে।
অয়ন চিন্তিত মুখে বেশ কিছু
ফোন করছিল। হঠাৎ ও উঠে পড়ল। ওর
এক কিউরিও আর আ্যন্টিক জিনিস বিক্রি করে বন্ধু আছে কাছেই। পানপাত্রের ফটোটা নিজের
ফোনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ও।
দিঠি অয়ন বেরিয়ে যাওয়ার পর
আবার ডায়েরি নিয়ে বসে। অচিন্ত্যবাবু
লোকটার জীবন সাদাকালোয় মোড়া ছিল। হেঁয়ালি করে সব লিখতে পছন্দ করতেন।
ওঁর লেখা উপন্যাস বা বই পড়ে ওঁকে সেভাবে চেনা যায় না। নিপাট ভালো মানুষ মনে হয়।
দিঠি যত পড়ছিল, অবাক হচ্ছিল।
সন্ধ্যায় অয়ন ফিরে দেখে
দিঠি ঘর অন্ধকার করে বসে রয়েছে। ও আলো জ্বালাতেই দিঠির সম্বিৎ ফেরে। অয়ন ফ্রেশ হয়ে এসে বসতেই দেখে দিঠি কিচেনে
চা করছে। দিঠির একটা নোটবুক আর অচিন্ত্যবাবুর
ডায়েরিগুলো সব ছড়িয়ে রয়েছে টেবিলে। ওর নোট বইয়ের খোলা পাতায় প্রচুর প্রশ্ন। অয়ন নোট
বইটা তুলে দেখতে থাকে। পাত্রটা আসলে কার ছিল?
“অনেক
পড়াশোনা করেছ সারাদিন। আমিও অনেক ঘুরেছি। এবার তোমায় খবরগুলো বলি। জয়ন্তবাবুর
ব্যাবসা ভালো চলছে না
বহুদিন। বাজারে প্রচুর দেনা। গলা অবধি ডুবে রয়েছেন। অচিন্ত্যবাবু একমাত্র লোক যিনি এখনও ধার দিচ্ছিলেন। উনি মারা যাওয়ায়
জয়ন্তবাবুর সোনার ডিম দেওয়া হাঁস চলে গেল। এবার বলো, যার বাজারে এত দেনা সে ওঁকে মারবে
কি?”
“যদি
পানপাত্র হাতে পায়, বিক্রি করে কিছুটা লাভ হতে পারে।
অচিন্ত্যবাবুর কাছে যত ধার সেটাও ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু উনি তো দেউলিয়া প্রায়। কয়জনকে মারবেন?”
দিঠি বলল।
“ঠিক, ছোটোছেলে চেয়ে টাকা পেত না। বাপ মরায় সম্পত্তি পাবে। যদিও ভাগে কম। উইল করে
মেয়েকে যাবতীয় গয়না দিয়েছেন। আর বড়োছেলেকে
ব্যাঙ্কের সব টাকা। ছোটোর ভাগে বাড়ি আর জমি-জায়গা। তা বেচলে ছোটোর ভালোই চলে যাবে, কিন্তু ভাগে কম পেল।
“মিলনবাবুরও
একটা চাপা রাগ ছিল। কিন্তু কেন? শামীম ঐ পানপাত্র আর বরুণবাবুর খোঁজে এসেছিল। এদের ভালো করে স্টাডি
করো। মেয়ে বা বড়োছেলে হরিকে দিয়ে মারিয়েছে
কি? এটাও প্রশ্ন। কাল সব রিপোর্ট পাব। খুনটা কীভাবে হল জানা যাবে।”
দিঠির মনে হচ্ছিল, জট খুলছে ধীরে ধীরে। পরদিন ও মিলনবাবু, শামীম-ভাই আর জয়ন্তবাবুর সঙ্গে
অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখল।
অয়ন থাকতে পারেনি। আরেকটা
মন্ত্রীর ডেঙ্গু হয়েছে, তাই কভার করতে ছুটতে হয়েছে। জয়ন্তবাবুর
প্রকাশনার অফিসে গিয়ে দিঠি প্রথমে নিজের একটা বইপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। একথা-সেকথার
পর দিঠি জানতে চাইল, “অচিন্ত্যবাবু হাতে লিখতেন, নাকি মেল করতেন লেখা?”
“ইদানীং
মেল করতেন। লাস্ট তিন বছরে আমরা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি নেই না আর।” জয়ন্তবাবু বললেন।
“তার আগের
পাণ্ডুলিপিগুলো কোথায়? আপনার কাছে থাকার কথা।”
“পুরোনোগুলো আছে ফাইলে। কেন বলুন তো?”
“উনি নিজে
লিখতেন তো? হাতের লেখাটা দেখতাম।”
“সবসময়
নয়। পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন। লিখিয়ে নিতেন। টাইপও নিজে করেন না। যখন লিখতেন, পরিচিত দুটো ছেলে রয়েছে, ওদের দিয়ে টাইপ করাতেন।”
“উনি
বলতেন আর তারা লিখত, তাই তো?”
“হ্যাঁ
মনে হয়... কেন বলুন তো?” জয়ন্তবাবু কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
“একটু
জানতে ইচ্ছা হল। আচ্ছা, নমস্কার।”
দিঠি ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে
আসে। কলেজ স্কোয়ারে শামীমের ওয়েট করার কথা। দিঠি
দ্রুত এগিয়ে যায়।
শামীমকে গেটের কাছেই দেখতে
পেল। একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে কথা বলছিল।
দিঠিকে দেখে এগিয়ে এল। পরিচয় করায়,
“বরুণকাকার ছোটোভাই তরুণ
চৌধুরী। উনি অবশ্য লেখেন না। স্কুলে পড়ান।”
“তাহলে
তোমার তথ্য জোগাড় চলছে।” দিঠি হেসে উত্তর দেয়।
ভদ্রলোক বিদায় নিতেই
বৃষ্টি নামল। দিঠি আর শামীম কফি হাউসের দিকে এগিয়ে যায়। ব্যালকনির একটা দু’সিটারে মুখোমুখি
বসে দিঠি বলে, “যদি অসুবিধা না থাকে বলবে, নতুন কী জানলে?”
“তেমন
কিছু না, উনিও মারা গেছিলেন বিষ প্রয়োগে। তবে আত্মহত্যা ভেবে ফ্যামেলির সবাই ধামাচাপা দিয়েছিল। কারণ, ওঁর নিজের
তেমন কেউ ছিল না, আর আত্মীয়রা ঝামেলা বাড়াতে চায়নি।
উনি অবসাদে ভুগছিলেন। তাই আত্মহত্যাটাই সবাই মেনে নিয়েছিল।”
“ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? যদিও অনেক পুরোনো ঘটনা...”
“উনি একাই
থাকতেন একতলায়। দোতলায় ভাই থাকতেন। ভাইয়ের স্ত্রী রান্না করে দিয়ে যেত। দুই বন্ধু
এসেছিল সন্ধ্যায়। তবে কারা কেউ খেয়াল করেনি। গলার আওয়াজ শুনেছিলেন, আর দু’জোড়া জুতো দেখেছিলেন উনি। সময়টা
শীতকাল ছিল। সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বরুণবাবুকে। বিষ
খেয়েছিলেন। ওঁর বোনের বর পুলিশ।
তাই আত্মহত্যা বলে সহজেই চালানো গেছিল। টানাটানি হলে তরুণবাবুরা জড়িয়ে যেতেন।”
“উফ্, তার মানে ওটাও...”
“বরুণবাবু
বিয়ে না করলেও ওঁর একজন প্রেমিকা ছিলেন বাংলাদেশে।
পরে তিনিও ভারতে চলে আসেন। আব্বু কথায় কথায় ওদের প্রেমের উদাহরণ দিত। কিন্তু এর
বেশি কিছু জানি না। এই ব্যাপারেই তরুণবাবুর সঙ্গে কথা বললাম। ওঁরাও এমন কিছু একটা সন্দেহ
করতেন। অথচ কেউ এই খবরটা দিতে পারছে না। এই খোঁজটা পাওয়া খুব দরকার।” শামীম বলল।
দিঠি এলোমেলো আরও অনেক
কিছু জানতে চাইছিল। যত জানছিল ততই অবাক হচ্ছিল। ডায়েরির হেঁয়ালিগুলো মিলে যাচ্ছিল একটা একটা করে।
ফেরার পথে ওর মিলনবাবুর সঙ্গে দেখা করার কথা শ্যামবাজার মেট্রোর গেটে। শামীমকে বিদায় জানিয়ে ও যখন
ট্রামে উঠল তখনই ফোনটা বেজে উঠল। অয়নের ফোন।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসেছে, বিষ পাওয়া গেছিল। ঐ গুঁড়োতেও বিষ
ছিল। জিনিসটা রেড়ীর বীজ। শুকনো বীজ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছিল
কেউ। অচিন্ত্যবাবু ছাড়া কারও হাতের ছাপ নেই। নতুন পরিষ্কার বোতল।
দিঠি ভাবতে বসে, হরি এতদিনের লোক। ও কেন মেশাবে? ছোটোছেলের সুযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল। বাকি সবাই সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে গেছিল।
সেখানেই সাহিত্যচর্চা হয়েছিল। পাশেই ছিল বেডরুম। খাওয়ার ঘর অবশ্য একতলায়। তারপর
আড্ডা বসেছিল একতলায়। রাতে মিলনবাবু আর জয়ন্তবাবু দোতলায় ছিলেন। শামীম আর আহমেদ
সবার নজর বাঁচিয়ে উঠতে পারবে না হয়তো। এখন খুনটা প্রতিহিংসায়, নাকি চুরির জন্য এটাই তো ক্লিয়ার হল না।
শ্যামবাজারে মেট্রো স্টেশনের
মুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মিলনবাবু। দিঠি ওঁকে নিয়ে
পাতালে নেমে যায়। একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে দিঠি বলে,
“সেই রাতে ঠিক কী হয়েছিল
বলুন তো?”
“তোমায়
কেন বলব? যা বলার পুলিশকে বলেছি।” একটু রেগেই উনি উত্তর দিলেন।
“আসলে আমি
একটু এসব নিয়ে চর্চা করি। অনুসন্ধিৎসা বলতে পারেন।” দিঠি ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দেয়।
“টিকটিকির
গল্প লিখে দু’পয়সা করছ, নাম হচ্ছে, ওতেই খুশি থাকো। এসবে আবার কেন?”
“দেখুন, আপনার ভালোর জন্যই...”
“আমার
ভালো আমি বুঝব। তুমি আমায় ঘাঁটিও না।”
“তাহলে
এলেন কেন?” দিঠি এবারে কড়া গলায় বলে।
“তোমায়
একটু টাইট দেব বলে। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। ওঁর ছেলেমেয়ে কি তোমায় ডেকেছেন এ-ব্যপারে? তাহলে অযথা নাক গলিও না।”
মিলন বাবু চলে যাচ্ছিলেন।
“বরুণবাবুর
মৃত্যুর সন্ধ্যায় ওঁর বাড়িতে কী করছিলেন আপনারা? মনে রাখবেন, এবার ওঁর কেসটাও রি-ওপেন হবে।” দিঠি হাওয়ায় একটা ঢিল ছোড়ে।
ঘুরে দাঁড়ান মিলনবাবু। একটু ভয় পেয়েছে যেন। দিঠি
সুযোগ খুঁজছে। বলে,
“তরুণবাবুর সঙ্গে কথা হল
আজ। বাকিটা ভাবছি পুলিশকেই বলব।”
“প্রমাণ
দিতে পারবে অত পুরোনো?”
ঢিলটা জায়গায় পড়েছে। ওষুধ ধরেছে মনে হয়। গলার স্বরটা
কেঁপে গেল।
দিঠি জানে কীভাবে কথা বার করতে হয়। বলে, “অচিন্ত্যবাবুর লেখালেখির ব্যাপারে কয়েকটা কথা জানার ছিল। আপনি না বললেও খবর
পাব। আর ঐ পানপাত্রটা উনি কীভাবে
পেয়েছিলেন সেটাও জানতে ইচ্ছা করছে।”
“আমি
তোমায় কেন বলব এত কিছু?” এবার গলার স্বর আরও নরম।
“বলবেন, কারণ নিজেকে বাঁচাতে সবাই চায়। অচিন্ত্যবাবু ডায়েরি লিখতেন। সেইসব ডায়েরি পুলিশ
তুলে নিয়েছে। সব এবার জানা যাবে। আপনি কি নিজেকে বাঁচাতে চান না?”
মিলনবাবুর চোয়াল ঝুলে
পড়ে। বলেন, “আমি কিছু করিনি, বিশ্বাস করো।”
“বরুণবাবুর
প্রেমিকার ব্যাপারে কী জানতেন?”
“এর সাথে
এই খুনের কী সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক
থাকতেই পারে।”
“ওরা
গোপনে বিয়ে করেছিল, কিন্তু বরুণকে ওর বাবা মেনে নেবে না
বলে সে সময় কাউকে জানায়নি। এরপর রায়টে বরুণরা চলে এল। আর
যোগাযোগ ছিল না শুনেছিলাম। বরুণের উপর এত চাপ ছিল, ও আর যোগাযোগ করেনি। এর বেশি জানতাম না।”
আর কিছুক্ষণ কথা বলে দিঠি
ফিরে এল।
বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে
গেছিল। রাতে অয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসল ও।
“তাহলে
তোমার সন্দেহের তালিকায় এখন জয়ন্তবাবু, ছোটোছেলে, শামীম, মিলনবাবু,
আহমেদ চারজন। কিন্তু সন্ধ্যায় যদি কেউ মিশিয়ে থাকে? তুমিও তো সুযোগ পেয়েছিলে সন্ধ্যায়!”
বলে হাসতে থাকে অয়ন।
“আবার
গুলিয়ে দিচ্ছ। ভালো হবে না বলছি।” দিঠি দুম দুম করে ওর পিঠে কিল বসায়। বলে,
“আমি জানব কী করে উনি
ঐসব চূর্ণ খান ঘুমের আগে?” বলেই চুপ করে যায়। অবাক হয়ে তাকায় অয়নের দিকে।
“দ্যা-টস
দ্য পয়েন্ট! কে কে জানত উনি ঐসব চূর্ণ খান - এটাই প্রশ্ন। শামীম কি বাংলাদেশ থেকে রেড়ীর বীজ গুঁড়ো করে এনেছিল, না আহমেদ জানত? ওরা খুন করেনি। মিলনবাবু, জয়ন্তবাবু, হরি, ছেলেমেয়ে
জানত। আর সন্ধ্যায় যারা এসেছিল তাদের মধ্যে খোঁজ নাও কে কে এটা জানত। চুরিটা আপাতত
ভুলে যাও। অপরাধী রাতে নাও থাকতে পারে ও-বাড়িতে। সেটাই বেশি ভালো অ্যালিবাই।
কৌটো বদলে চলে যেতে পারে। তবে মেয়ে করায়নি।
ওর মোটিভ নেই। বিশাল বড়োলোক ওরা। হরিকে আজ থানায়
তুলে দাওয়াই দিয়েছে। ও করেনি। একমাত্র ও ভালোবাসত
মনিবকে। ছেলেটা ভিতু, এত সাহস নেই। তবে এখনই ক্লিন চিট দেওয়া যাবে না। সাধারণত
বিষ দিয়ে মারে মহিলারা, তাই ঐ যে লেখিকা তার কথাও ভেবো
একবার।”
দিঠি আবার গোড়া থেকে ভাবতে
বসে। সেদিন যে দু’জন তরুণ কবি এসেছিল কমল জানা আর
শুভময় সরকার, তারা দিঠির মতো প্রথম গেছিল ঐ-বাড়ি। অল্প
সময় ছিল। ওদের পক্ষে এসব জানা সম্ভব নয়। সবিতাদি ওঁর পূর্বপরিচিত। আগেও কয়েকবার
গেছেন ওঁর বাড়ি। বেডরুমের টয়লেটে গেছিলেন একবার। তবে মহিলার মোটিভ কী হতে পারে? চুরি তো করেননি, সবাই
জানে।
সবিতাদির ফেসবুকটা খুলে
বসে দিঠি। মহিলা ফেসবুকে টুকটাক লেখেন। নিজের কোনও ইনফরমেশন নেই। মাত্র কয়েকমাস
লেখালেখির শুরু। সব লেখাতেই সমাজের উঁচু স্তরের
পুরুষদের প্রতি বিদ্বেষ ঝরে পড়ছে। ওঁর
নায়িকারা ট্র্যাজিক, নায়করা গরিব, হেরে যাওয়া সব পুরুষ। কেমন যেন একটা দুঃখ।
মিলনবাবুকে একটা ফোন করে
দিঠি। সবিতাদি ওঁর
সঙ্গে কতদিনের পরিচিত জানার জন্য। উনিও বললেন, মাস ছয়েক হবে। অচিন্ত্যবাবুর পাঠক ছিলেন।
সবিতা দেবীর বন্ধু খুব কম। আর তার মধ্যে লেখক আরও কম। দিঠির
যেমন প্রচুর লেখক বন্ধু, পাঠক তো আছেই। সারাটা রাত এসব চিন্তা করেই কাটল। ভোরের দিকে
ঘুমিয়ে পড়েছিল দিঠি।
কীসব উলটোপালটা স্বপ্ন দেখছিল দিঠি ভোর রাতে।
একটা সিন্দুক নিয়ে ছুটছেন মিলনবাবু। সবিতাদি ছিনিয়ে নিল। শামীমের গল্প লেখার খাতাটা অচিন্ত্যবাবু কেড়ে নিলেন। সিন্দুকে ভরে ফেললেন গল্প। তারপর সিন্দুকটাকে
বইয়ের আলমারিতে রেখে দিলেন। সিন্দুকটাও বই হয়ে গেল। দিঠির লেখা গল্পটা বই হয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে গেল। জয়ন্তবাবু
বইয়ের অ্যাডভান্স
করবে বলে দিঠিকে ডাকছেন। তখনি ঘুমটা
ভেঙে গেল।
আসলে অয়ন ডাকছে। অয়ন কাল
অনেক রাত অবধি ডায়েরি পড়েছে। দিঠি অয়নের ফ্রেশ হাসি
মুখটা দেখে বুঝল, অয়ন অনেকটাই এগিয়েছে। তাড়াতাড়ি
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল, অয়ন চা করে ফেলেছে। ওর নোটপ্যাডে
অয়ন কী লিখেছে! আর গোল করেছে!
“তোমার
সবিতাদির সম্পর্কে আমি কিছু খবর নিয়েছি। একাই থাকেন
একটা কাজের মহিলাকে নিয়ে। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ান। কোনও অজ্ঞাত কারণে বিয়ে করেননি। বাড়িতে
অচিন্ত্যবাবুর লেখা বই মোটে ছয়টা আর বরুণবাবুর লেখা প্রায় সব বই রয়েছে। উনি বরুণবাবুর
লেখার বড়ো ভক্ত সেটা তোমাদের বলেননি
কিন্তু। বসাকদা আগেই ইন্টারোগেট করার জন্য
গেছিল। সে জানাল।” অয়ন বলল।
“আমি
এদিকে ডায়েরি পড়ে আর মিলনবাবুর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি সেটা মারাত্মক ব্যাপার। অচিন্ত্য সেন লোকটা খুব উঁচু
দরের লেখা লিখতেন না। উনি স্ট্রাগল করছে এমন ভালো লেখকদের
লেখা কিনে নিজের লেখা বলে বই বার করতেন। নিজে যে দুয়েকটা লিখেছেন, চলেনি। যে ক’টা
উপন্যাসের জন্য লোকে ওঁকে চেনে তার বেশিরভাগটাই বরুণবাবুর লেখা। আসলে বরুণবাবু
ছিলেন গরিব। ঘাড়ে বড়ো সংসারের দায়িত্ব। পরিচিতি
তেমন নেই, টাকার চিন্তায় লেখালেখি মাথায় উঠেছে। সেই বরুণবাবুর
লেখা উনি কিনে নিতেন। এমন আরও কয়েকজনের লেখা উনি কিনতেন। পেটের দায়ে
ওঁরা দিয়ে দিতেন। সে
সময় ফেসবুক ছিল না। এসব লেখকরা নাম-যশ পেতেন না। টাকাটা পেতেন। ইদানীং উনি লোক দিয়ে টুকটাক লেখাতেন। অত বড়োলোক, টাকার চিন্তা তো ছিল না। বরুণবাবুর সঙ্গে শেষের দিকে এসব নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। শেষদিন উনি আর মিলনবাবু সেসব মিটমাটের
জন্য গেছিলেন। এসব মিলনবাবু বলেছেন। এত পুরোনো ঘটনা, প্রমাণ নেই।” দিঠি যা জেনেছিল বলল।
“আর ঐ
পানপাত্র? মিলনবাবু ওটার কথা কী বললেন?”
“ওটা কেউ
পেটের দায়ে বিক্রি করেছিল বরুণবাবুর মধ্যস্থতায়। নামটা উনি বলতে চাইছেন না। শামীমও
তাই জানে। বরুণবাবু আর অচিন্ত্যবাবু ছাড়া ওটার আগের মালিকের নাম কেউ জানত না।”
“দেখি, আজ একটা খবর পাব।”
“সবিতাদির
বাড়ি একবার আমি যাব? ঠিকানা?”
অয়ন বসাকদার থেকে ঠিকানা
আনিয়ে দেয়।
দুপুরে দিঠি একাই চলে যায়।
ছোটো একটা
দোতলাবাড়ির একতলায় ভাড়া থাকেন উনি। এক বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে ওকে দেখে একটু
অবাক হন।
“আমি
সবিতাদির বান্ধবী, একটু দরকার ছিল।” দিঠি বলে।
“উনি তো
স্কুলে, আরেকটু পরে আসবেন। ভেতরে এসে বসুন।”
মহিলা ওকে বসান।
ছোটো ছিমছাম সাজানো ঘর। একটা বড়ো বুক র্যাকে অনেক বই। দিঠি সব দেখছিল। দুটোই ঘর, ভেতরেরটা শোওয়ার ঘর। দিঠিকে বসিয়ে উনি ভেতরে গেলেন। শোওয়ার ঘরে উঁকি
দিয়ে দিঠি একটা বড়ো খাট, আলমারি আর একটা ছোটো টেবিল দেখল। একপাশে ঠাকুরের আসন। উপরে দুটো ফটোয় মালা পরানো।
ওঁর মা-বাবা
বোধহয়। ভদ্রলোক হাসছেন। দিঠি দু’মিনিট
ফটোটার দিকে তাকিয়ে মনে করতে চেষ্টা করে কোথায় দেখেছে। খুব চেনা মুখটা।
একটু পরে জল আর মিষ্টি
নিয়ে মহিলা এসে দেখলেন মেয়েটি নেই। অবাক হল। নামটাও জানা হল না। সবিতাদিদি জানলে
বকবে। তাই কিছুই বলল না আর দিদিকে।
পরেরদিন অচিন্ত্যবাবুর
কাজ। অপঘাতে মৃত্যু বলে ঐদিন শ্রাদ্ধ হবে। বড়োছেলে আসেনি। খুব ছোটো করেই সবাই কাজ করবে ঠিক
হয়েছে। কাজের পর বিকেলেই স্মরণসভা। দিঠি
সব পয়েন্টগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল। অয়ন ওকে খুব সাহায্য করেছে।
অয়ন দিঠিকে দুপুরে চলে
যেতে বলে গেল উত্তরপাড়া। ও বিকেলে যাবে স্মরণসভার আগে।
শ্রাদ্ধবাড়ি যেতে দিঠির
ভালো লাগে না, কিন্তু আজকের পরিস্থিতি
আলাদা। একবার লাইব্রেরিটাও ঘুরে দেখার ইচ্ছা আছে ওর। সামনের বাগানে শ্রাদ্ধের
আয়োজন। ছাদে খাওয়ার প্যান্ডেল। দিঠি অবশ্য
দেরি করেই এসেছে খাবে না বলে। হলঘরে কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধু আর জয়ন্তবাবু এসেছেন।
একটু পরেই একে একে সবাই
আসতে শুরু করল। এক ফাঁকে লাইব্রেরি ঘরে
ঢুকে পড়ল ও। আবার সব লক করে দিয়েছে
ওঁর মেয়ে। ভালো করে
দেখতে দেখতে সেদিনের স্বপ্নের কথাটা বারবার মাথায় আসছিল। অচিন্ত্যবাবুর
হেঁয়ালিটাও মনে পড়ছিল বারবার। কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি! সিন্দুক কি
আদৌ আছে? একটা
আলমারিতে রামায়ণ-মহাভারত-গীতা-কোরান-বাইবেল, আরও কত মোটা মোটা বই! কিছু
অভিধান, দেশিবিদেশি সংকলন। হঠাৎ
বইগুলো দেখতে দেখতে দিঠির একটা কথা মনে হয়। এত সহজ ব্যাপারটা
সেদিন ওর চোখে পড়েনি! বেশ বুদ্ধি ছিল ভদ্রলোকের।
দিঠি বাইরে বেরিয়ে আসে। সবিতাদিকে একা দেখে দিঠি দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
উনি অল্প হাসলেন। বললেন, “মনটা বিষণ্ণ। উনি এত
আনন্দ করলেন সেদিন। কী যে হয়ে গেল!”
“সত্যি, ভাবলেই খারাপ লাগছে। তা আপনিও তো লেখিকা।
কী মনে হয় আপনার? কে এই কাজটা
করল?” দিঠি হালকা একটা চাল দেয়।
“কী করে বলি!
সবাই বন্ধু। এর আগেও দু’বার এসেছি...”
“বরুণবাবুর
খুনটা কে করেছিল মনে হয়? আপনি তো ওঁর লেখারও ভক্ত ছিলেন।”
“জানি না।” একটু রেগেই গেলেন মনে হল দিঠির।
“পানপাত্রটাই
বা কে নিল?”
“ওটা কি
চুরি গেছে? শুনলাম, পাওয়া
যায়নি!”
“বাড়িতে
কোথাও নেই। চুরি ছাড়া কী বলব!” দিঠি বলে।
“রাতে
যারা বাড়িতে ছিল তাদের কেউ কি তাহলে করল এসব! ঐ যে ছেলেটি ঢাকা ফিরে গেছে সে...”
ওঁর চোখেমুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে।
“ওঁর যে
সুগার আর রাতে ঐ মেথি-গুঁড়ো খান সেটা আহমেদ জানত না।
যারা বহুদিন ধরে ওঁর বন্ধু তারাই এ খবর জানত।”
“তাহলে কি
মিলনবাবু বা জয়ন্তবাবু! ওঁরা রাতেও ছিলেন। বহুদিনের
বন্ধু। ঐ মেথি-গোলমরিচের গুঁড়োর কথা নিশ্চয়ই জানতেন।” সবিতা দেবী বলে ওঠেন।
দিঠির চোখদুটো জ্বলে ওঠে।
ও বলে, “আপনি কতদিন
ধরে জানতেন যে উনি ওটা খান?”
সবিতা দেবী একটু চমকে ওঠেন। একটু সামলে বলেন,
“আমি... মানে, ঠিক কবে... ঐ কোথাও শুনেছিলাম যেন। অচিন্ত্যদাই বলেছিলেন আগেরবার।
বলেছিলেন, এটা খেলে সুগার কমে।”
“হঠাৎ এমন
একটা জিনিস নিয়ে আলোচনা?”
“আমার সুগার আছে শুনে বলেছিলেন। এবার
যেতে হবে। একটা অন্য কাজ আছে। দেখি ওঁর মেয়ে কোথায় গেল।” বলেই দিঠি কিছু বলার আগেই উনি চলে যান।
দিঠি সঙ্গে
সঙ্গে অয়নকে ফোন করে। অয়ন বলে,
“ঘণ্টা খানেকের ভেতর আসছি।”
“সবিতাদি
চলে যেতে চাইছেন। আটকানো দরকার।” দিঠি
অসহায় গলায় বলে।
“তুমি
একটু একটা ঘণ্টা দেখো। পাইনদা আর বসাক যাচ্ছে এখনই।” অয়ন ফোন কেটে দেয়।
দিঠি আবার সবিতাদিকে
খুঁজতে থাকে। শামীমের সঙ্গে দেখা হয়। দিঠি বলে,
“সবিতাদিকে দেখতে পেলে একটু কথা বলে আটকে রাখতে হবে, ভাই। পরে সব বলছি। একটু সাহায্য করুন।”
শামীম যা বোঝার বুঝে
নিয়েছিল। বলল, “নিচে দেখছি আমি। আপনি এদিকটা দেখুন।”
দিঠি দোতলার সব ঘর খুঁজে
ফেলে। শেষ ঘরে কুকুরদুটো বাঁধা। থেকে থেকে ডাকছে। ছাদের সিঁড়িতে
ওঁকে পেয়ে যায় দিঠি। বলে,
“দিদি, আরেকবার একটু দরকার ছিল।
এখনই একটা খবর পেলাম।”
সবিতাদি বিরক্ত হয়েছেন
স্পষ্ট বোঝা গেল। দিঠি রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বললেন, “তাড়াতাড়ি
বলো। আমার কাজ আছে। দেরি হচ্ছে এবার।”
“না খেয়েই
চলে যাবেন?”
“শ্রাদ্ধবাড়ি
খাই না আমি।”
“আমিও খাই
না। খুব খারাপ লাগে। আসলে একজন চলে গেলেন, আর তার নাম করে আমরা তার পছন্দের খাবার খাব...”
দিঠি কথা বলতে বলতে ভাবতে
থাকে কী করে আটকাবে ওঁকে।
“আমার
জন্য একজন অপেক্ষা করছে। আমায় যেতে হবে এবার।”
“প্লিজ, বেশি সময় নেব না, একটু
লাইব্রেরিতে আসুন। বসে কথা বলা যাবে।”
“এখানেই বলো। অত
সময় নেই।” উনি রেগে যাচ্ছেন বোঝা যায়।
এমন সময় শামীম উঠে আসে।
দিঠি আর সবিতা দেবীকে দেখে এগিয়ে আসে ও। বলে,
“এই তো আপনারা, আপনাদের
খুঁজছি সেই কখন থেকে। একটু দরকার দু’জনকেই।”
“আমার
তাড়া আছে আজ। অন্যদিন বোলো। শুনব।” সবিতাদি এগোতে গিয়েও পারেন না। দু’জন এমন করে দাঁড়িয়ে আছে যে উনি জায়গা পাচ্ছেন না।
“দিদি, আমি ঢাকায় চলে যাব কালকেই। তাই আজ কথা বলব একটু।”
শামীমের গলায় অনুরোধের সুর।
দু’জনে প্রায় জোর করেই ওঁকে লাইব্রেরিতে নিয়ে ঢোকে। শামীম বলছিল, “আসলে বরুণবাবুর উপর যে বইটা লিখছি তার কয়েকটা পয়েন্ট... আপনি
ওঁর একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। তাই আপনার কাছে কিছু জানতে চাই।”
“আমি কী বলব! ওঁর বন্ধুরা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলো। আমি
ওঁকে সেভাবে চিনতাম না।”
“না, সেদিন ওঁর মৃত্যুর ব্যাপারে যেটা
বললেন...”
শামীমের কথার মধ্যে উনি
বলে ওঠেন, “আচ্ছা, আমি যা জানি তোমায় মেল করে দেব গুছিয়ে লিখে। আজ তাড়া আছে।”
উনি আবার উঠে পড়েন।
“আপনার
নিজের সম্বন্ধে একটু বলুন।” শামীম
আবার বলে।
“সেটাও
তোমার বইতে দরকার নাকি?” উনি রেগে গিয়েছেন বোঝা যাচ্ছিল।
“অচিন্ত্যবাবু
কীভাবে মারা গেছেন আপনি জানেন?”
দিঠির গলার স্বরে কাঠিন্য।
“বিষ
প্রয়োগে শুনেছি। সবাই জানে।” সবিতা দেবী বলেন।
“বিষটা
ঠিক কীসে ছিল? একই খাবার সবাই খেলাম অথচ উনি মরে গেলেন?”
দিঠি এক দৃষ্টিতে ওঁকে দেখছে।
“তা আমি কী করে বলব? তুমি শুনেছি রহস্য-টহস্য লেখো। তুমি ভাবো এটা নিয়ে।” সবিতা
দেবীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে।
“একটু আগে
যখন আপনাকে বলেছিলাম উনি ঘুমের আগে মেথির গুঁড়ো খেতেন, আপনি একবারও প্রশ্ন করেননি যে এই
কথাটা জানার সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক।” দিঠি
ঘড়িটা দেখে আড়চোখে। অয়নদের এসে যাওয়া উচিত এবার।
“আমি তো
বললাম যে আমি জানতাম। কিন্তু তাতে কী হল?”
বসে পড়েন সবিতা দেবী।
“সেটাই
প্রশ্ন! তাতে কী হল? আপনি জানতেন উনি ওটা খান, ওটা কী, কী দিয়ে তৈরি। অথচ ওটার সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক জানতেন না? কিন্তু অবাক হননি তো?”
শামীম অবাক হয়ে নাটকটা
দেখছে। এমন সময় মিলনবাবু এসে ঢোকেন। অসহায়ের
মতো সবিতা দেবী
বলেন, “দেখুন না, এরা আমায় যেতে দিচ্ছে না। আমি...”
“আপনার
বাবার নাম কী ছিল, দিদি? উনি কী করতেন?” দিঠি একের পর এক প্রশ্ন করে ওঁকে কোণঠাসা
করে ফেলছিল।
উনি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
মুখটা সাদাটে ফ্যাকাসে লাগছে। বললেন,
“এসব কেন জিজ্ঞেস করছ?”
“আপনি ধরা
পড়ে গেছেন। আপনার ঘরে বাবা-মার ছবি
আমি দেখে এসেছি।” মোবাইলে তোলা ফটোটা ওঁকে দেখায় দিঠি। “আসুন, নিচের হলে একটা সভার আয়োজন হয়েছে, সবাই সেখানে যাই।” দিঠি
গম্ভীর গলায় বলে।
শামীম, মিলনবাবু কী বুঝলেন কে জানে, ওঁকে নিয়ে নেমে এলেন নিচে। দিঠি পুলিশের সাইরেন
শুনতে পেয়েছিল। নিচে নেমে অয়নের সঙ্গে দেখা
হল। ওকে একপাশে ডেকে দিঠি ব্যাপারটা খুলে বলে।
সবাইকে হলে বসানো হয়েছে।
দিঠি আর অয়ন বসাক আর পাইনদার সঙ্গে কিছু
দরকারি আলোচনা সেরে নেয়। ঘরে একটা মৃদু গুঞ্জন।
অনেকেই নিচু গলায় কিছু আলোচনা করছেন। অয়নের সম্মতিতে দিঠি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বিশিষ্ট লেখক অচিন্ত্য সেনের শেষকৃত্য
অনুষ্ঠানে। খুব দুঃখের কথা যে উনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। প্রথমেই আমরা সবাই উঠে
দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে
ওঁর আত্মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাব।”
সবাই উঠে দাঁড়ায়। ঠিক এক
মিনিট পর সবাইকে আসন গ্রহণ করতে বলে দিঠি বলে,
“এবার জানাই, আপনারা
সবাই জানেন ওঁর মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি।
ওঁকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সেই হত্যাকারী এ-ঘরেই আছেন।”
ঘরে অপার নিস্তব্ধতা বিরাজ
করছে।
“ঠিক কীভাবে বিষ ওঁর শরীরে প্রবেশ করে সেটা হয়তো কেউ
জানেন না, একমাত্র যে বিষ দিয়েছিল সে ছাড়া।” দিঠি লক্ষ করে সবিতা দেবী মাথা নিচু করে বসে আছেন। “খুনি কে সেটা চিহ্নিত করার আগে আপনাদের এমন কিছু অপ্রিয় সত্য বলতে হবে যা অনেকের কাছেই অনভিপ্রেত, বিশেষত আজকের দিনে। কিন্তু সেটুকু না বললে কেন
ওঁকে চলে যেতে হল তা বোঝাতে পারব না। তাই প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে
নিচ্ছি সবার কাছে। তবে যা বলব, সব
প্রমাণ আছে বলেই বলছি।
“অচিন্ত্যবাবু
পৈতৃক সূত্রে বড়োলোক, কখনও ইনকামের জন্য ভাবতে হয়নি। লেখালেখির দিকে ঝোঁক ছিল। নিজের বই ছাপাবার
ক্ষমতা ছিল। ম্যাগাজিন চালাতেন। কিন্তু খুব একটা উঁচুদরের লেখক ছিলেন না, পাঠক পাচ্ছিলেন না তেমন। লেখালেখির সূত্রে প্রচুর উঠতি লেখকের সঙ্গে ওঁর পরিচয়
ছিল। ম্যাগাজিনের জন্য তারা লেখা দিত। অচিন্ত্যবাবু এধরনের লেখকের ভালো লেখা অনেক সময় কিনে নিজের নামে চালাতেন। লেখক গরিব, নামের থেকে টাকাটা বেশি প্রয়োজন।
অনামী লেখকের লেখা কেউ টাকা দিয়ে কিনবে না। লেখকদের কাছে এটা
বেশ ভালো সুযোগ। একটা দুটো লেখা বিক্রি করে যদি টাকা আসে ক্ষতি কি?”
একটা চাপা গুঞ্জন ওঠে
আবার।
“ওঁর লেখা
উপন্যাস ‘স্মৃতির আড়ালে’ যখন পুরস্কার পেল তখন আসল লেখকের চোখ খুলে যায়। লেখক এসে স্বীকৃতি চান, উনি আবার টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন। এমন চলতেই থাকে। প্রকাশকরাও হয়তো
ব্যাপারটা জানত। এক-দু’বার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু টাকা দিয়ে সব হয়। অচিন্ত্যবাবু শুধু নাম কিনতে
চাইতেন। যাই হোক, বছরে দু-চারটে ভালো লেখা উনি কিনে নিতেন
বরুণবাবুর থেকে। কিন্তু একটা সময় এল, বরুণবাবু
আর লেখা দিতে চাইছেন না। তার আগে বরুণবাবু ওঁকে একটা ঐতিহাসিক জিনিস কিনিয়ে দিয়েছিলেন। আরেক কবি-বন্ধু বিপদে পড়ে সেটা বিক্রি করেছিলেন। এদিকে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা চলছিল। বরুণবাবুও বলছেন লেখা
দেবেন না, প্রমাণ করে দেবেন অচিন্ত্যবাবুর অনেক লেখাই আসলে
ওঁর কলমের। বাধ্য হয়ে বরুণবাবুকে সরাতে হল। আলোচনার নামে
ওঁর বাড়ি গিয়ে খাবারে বিষ দিয়েছিলেন অচিন্ত্যবাবু। মিলনবাবু
পরে বুঝতে পেরেছিলেন হয়তো। বাড়ির লোক এসব নিয়ে
খোঁড়াখুঁড়ি করেনি।”
ঘর আবার নিস্তব্ধ। দিঠি
অয়নের দিকে তাকিয়ে ছিল। অয়ন উঠে দাঁড়ায়।
বলে, “হয়তো সেখানেও অচিন্ত্যবাবুর ভূমিকা ছিল। বরুণবাবু বিয়ে করেননি এটা ভুল।
বাংলাদেশেই উনি গোপনে একজনকে বিয়ে করেন। কিন্তু হঠাৎ পালিয়ে এদেশে আসা এবং প্রবল
সাংসারিক চাপে আর স্বীকৃতি দিতে পারেননি। এটা ওঁর ভাইয়ের থেকেই জেনেছি।
“ওদিকে
ওঁর একটা মেয়ে হয়। ওঁর স্ত্রী একাই মেয়েকে লড়াই করে মানুষ করেছিলেন। ওঁরাও এদেশে চলে আসেন একসময়। কিন্তু
বরুণবাবুর মাথায় এত বড়ো সংসারের দায়িত্ব,
ওঁর লড়াই এসব জেনেই সামনে আসেননি। লেখা বিক্রির ব্যাপারটাও
বুঝতে পেরেছিলেন ওঁর স্ত্রী। কারণ, অনেক লেখাই ওঁর পড়া ছিল। একটু খোঁজ নিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন উনি। মেয়েও
সব জেনেছিল বড়ো হয়ে। বরুণবাবুর মৃত্যুতে ওরা সব
বুঝেও কিছুই করতে পারেননি।
“মেয়ে
ভেতরে ভেতরে সব খোঁজ রাখতেন। বাবার খুনের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। আলাপ করলেন
অচিন্ত্য সেনের সঙ্গে। গুণমুগ্ধ পাঠিকার অভিনয় করে কাছাকাছি
এলেন। নিজেও টুকটাক লেখেন। সাহিত্য সম্মেলনে যাতায়াত
আছে। সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সুযোগ এল। অচিন্ত্যবাবু সুগারের জন্য মেথির
গুঁড়ো খান শুনেছিলেন যা ভীষণ তেতো। উনি
রেড়ীর বীজ গুঁড়ো করে সেই মিশ্রণে মিশিয়ে এনেছিলেন। কৌটাটা
বদলে দিলেন। কিন্তু কৌটাটা একরকম হলেও নতুন এবং চকচকে, যা পরে হরিকাকা দেখে বুঝতে পেরেছিল। আগের পুরোনো কৌটার ঢাকনাটা প্যাঁচ কেটে
গেছিল। তাড়াতাড়িতে ওটা খুলতে একটু
গুঁড়ো পড়ে যায় টেবিলে। সেই কৌটা উনি নিজের ব্যাগে ভরে নেন। অত
রাতে অচিন্ত্যবাবু ওসব খেয়াল করেননি। দু’চামচ
গুঁড়ো জল দিয়ে গিলে শুয়ে পড়েছিলেন। রেড়ীর একটা বীজেই প্রচুর
বিষ। ওঁর ঘুম আর ভাঙেনি। কী সবিতা দেবী, আমি ঠিক বললাম তো? অন্য কৌটার কিছুটা গুঁড়ো আপনার
ব্যাগে রয়েছে হয়তো, কারণ কৌটাটার প্যাঁচ কাটা ছিল।”
সবিতা দেবীর দু’চোখে জল। আস্তে আস্তে বললেন,
“আমি শুধু বাবার হয়ে শাস্তিটা দিয়েছি। সারা জীবন মা কষ্ট করেছে। বাবা লড়াই করেছে। অথচ কিছুই পায়নি। এবার আর কোনও তাড়া
নেই আমার। আমি ফাঁসিতে যেতেও প্রস্তুত।”
বসাকের ইশারায় দু’জন মহিলা কনস্টেবল ওঁর কাছে
গিয়ে দাঁড়াল।
“তাহলে
সেই পানপাত্র! সেটা কে চুরি করল? ওটা তো পাওয়া যায়নি শুনলাম।”
মিলনবাবু বলেন।
“আমিও
প্রথমে ভেবেছিলাম ওটার জন্য খুন হয়েছে। কারণ, ওটা একটা দামী জিনিস। তাই একটু ভুল পথে চলে গেছিলাম। পরে বুঝলাম, চুরিটা খুনির উদ্দেশ্য নয়। খুনি সেদিন খুন করবে বলে তৈরি হয়ে এসেছিলেন।
অথচ ঐ পানপাত্র বাড়িতে না লকারে তা জানতেন না। লকারে থাকার সুযোগ বেশি। তাই খুনির উদ্দেশ্য চুরি ছিল না। যাই হোক, আমি
এতকিছু জেনেছি অচিন্ত্যবাবুর ডায়েরি পড়ে। উনি
আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন বলেছিলেন, চুরি করতে হলে প্রথমে
সিন্দুক খুঁজে বার করতে হবে, তারপর সেটা
খুলতে হবে। আমরাও পাগলের মতো সিন্দুক খুঁজেছি, পাইনি। ছেলেমেয়ে, এমনকি
চাকরবাকরও জানত না সিন্দুকের কথা। আমি ডায়েরিতে একটা হেঁয়ালি পাইঃ
‘বইয়ের মধ্যে জ্ঞান...! মূল্যবান লেখাও চুরি যায়...! যদি বই করে রাখি... তবে আর নেই ভয়...’
“যেটা পড়ে
প্রথমে কিছু না বুঝলেও লাইব্রেরিতে ঘুরতে ঘুরতে একটা কথা আমার মাথায় আসে। বইয়ের
মধ্যে জ্ঞান সবাই জানি। মূল্যবান লেখাও চুরি যায় অর্থাৎ, উনি চুরি করতেন বা কিনে নিতেন। ভালো লেখা নয়,
মূল্যবান লেখা। কারণ, মূল্য
দিয়ে নাম কিনতেন উনি। যদি বই করে রাখি আর ভয় নেই। অর্থাৎ, বই করে রাখলে সেটা চুরি যাবে না। আমি সিন্দুকের সন্ধান এখানেই পাই। ওটা আসলে একটা মোটা বই, বই করে
রাখলে চুরি হবে না। কেউ বুঝবেই না দামী জিনিসটা বইয়ের মধ্যে।
“প্রচুর
মোটা মোটা বই আছে চার নম্বর আলমারিতে। একটা বেশ মোটা বই লাল রেক্সিনে বাঁধানো, নাম
সিন্দুক। আমি অনুরোধ করব ওঁর মেয়েকে, বইটা বার করে আনা হোক। ওটার মধ্যেই ঐ
জিনিসটা রয়েছে আমার ধারণা।” দিঠি
কথা শেষ করে ওঁর মেয়ের দিকে তাকায়।
বসাকবাবু,
ওঁর ছেলেমেয়ে আর দিঠি দোতলায় উঠে যায়। একটু পরেই একটা বেশ
মোটা বই হাতে দিঠি নেমে আসে। বইটা আসলে বই নয়, একটা বইয়ের মতো দেখতে বাক্স। ঠিক মাঝখানটা কেটে ঐ কাঠের কারুকার্য করা চ্যাপ্টা বাক্সটা
বসানো। খুলতেই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল রত্নখচিত পানপাত্র। সবাই অবাক হয়ে দেখছিল।
“আক্ষেপ, এটা কীভাবে উনি পেলেন সেই ইতিহাসটাই জানা
গেল না। আমার লেখায় এটার প্রয়োজন ছিল।” শামীম বলল।
“ক্রমশ
প্রকাশ্য, লেখকমশাই। এটাও জানা গেছে।
বাংলাদেশের রায়টে মিলনবাবু আর বরুণবাবুরা কয়েকজন পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে। প্রায়
কিছুই কেউ আনতে পারেননি। একজন এনেছিলেন, পরিবারের এক ঐতিহ্যপূর্ণ জিনিস। কিন্তু জানাজানি হলেই মুশকিল। ইনি ভারতে পালিয়ে এসেছেন তার
পরিবার জানুক, তিনি চাননি। শুধু মা’কে নিয়ে ফিরে এসেছেন। মামাবাড়িতে
আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু একটা সময় এমন এল যে ওটা বিক্রি করতেই হল মায়ের
চিকিৎসার জন্য। কী মিলনবাবু, ঠিক বলছি তো? আপনার বিধবা মাকে প্রচুর লাঞ্ছনা
গঞ্জনা সহ্য করতে হত কাফের বলে। মণ্ডল পদবী শুনে কেউ বুঝবে না আপনার
পরিচয়। মা হিন্দু হলেও বাবা ছিলেন মুসলিম। জোর করে আপনার মাকে বিয়ে করেছিলেন। রায়টের সুযোগে পালিয়ে এসেছিলেন মামাদের সঙ্গে। হিন্দু মামাদের পরিচয়ে এখানেই থেকে গেছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন, ঐ জিনিসটা আপনার জানলে হয়তো ঐ সূত্র ধরে আপনাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবে।
শামীমের বাবা আর বরুণবাবু সবটা জানতেন। উনি তাই ওটা বিক্রিতে সাহায্য করেছিলেন।
ব্যাপারটা গোপনীয় ছিল বলে শামীম ওর বাবার ডায়েরিতে আপনার নাম পায়নি।
“আমার এক আ্যন্টিক
ব্যবসায়ী বন্ধু খোঁজ নিয়ে বলেছিল বাংলাদেশে শেখ হাবিবুল মণ্ডলের কাছে এমন একটি
পাত্র ছিল। তবে সেটি চুরি যায়। ওঁরা বাংলার
নবাবের নায়েব ছিলেন একসময়। ওঁদের কাছে
এমন দুয়েকটা নিদর্শন আজও বিদ্যমান। মণ্ডল
শুনেই সন্দেহ হয়েছিল। একটু ভালো করে খোঁজ নিতেই বাকিটা
পরিষ্কার হয়ে গেল। তবে আপনি যেটা করেছেন সেটা ঠিক
চুরি নয়। নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। ঐ বংশে ছেলে আর একজনই ছিল। সে তো বাকি
সবকিছুই পেয়েছে।” অয়ন বলে।
মিলনবাবু মাথা নিচু করে
বসেছিলেন। বললেন, “আমি মনেপ্রাণে
হিন্দু। ঐ কয়েক বছরের কথা ভুলতে
চাই। আর যেটা বিক্রি করেছি সেটা এখন আমার নয়। এদের সম্পত্তি।”
“তাহলে
দেখা যাচ্ছে অচিন্ত্যবাবু বড়োছেলেকে
টাকা আর মেয়েকে যাবতীয় গয়না দিয়ে ছোটোছেলেকে
বঞ্চিত করেননি। বাড়ি আর সব সম্পত্তি যার
মধ্যে এই পানপাত্রটাও ছোটোছেলে পাচ্ছে।” অয়ন বলে উঠল।
ছোটোছেলের
মুখের অভিব্যক্তি বদলায় এই প্রথম।
ঘরে অচিন্ত্যবাবুর ফুলে ফুলে ঢাকা ছবির সামনে একগুচ্ছ ধূপ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। দিঠির
মনে হল, উনি হাসছেন। এক পরম শান্তির
হাসি। বেঁচে থাকতে এত অন্যায় করেছেন, কিন্তু
আজ সবাই সব জেনে যাওয়াতে ওঁর আত্মা চাপমুক্ত হয়েছে। উনি
নিজেও মুক্তি পেলেন।
_____
অলঙ্করণঃ পার্থ মুখার্জী
Good story
ReplyDelete