শুধুই রহস্য?
প্রতিম দাস
গতবছরের এক শীতের সন্ধ্যায় ডিনার সেরে
হাতে কফির মগ আর
মুখে সিগার জ্বালিয়ে মেজরের আরামদায়ক লাইব্রেরিতে জমিয়ে বসেছিলাম। বুঝতে
পারছিলাম, আজ মেজরের মেজাজ ভালোই আছে। অনেকদিন ধরে যে প্রশ্নটা
আমার মাথায় জমে আছে সেটা করে ফেলার এটাই সুযোগ।
প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই উনি হাসলেন এবং
উত্তর দেওয়ার আগে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন।
“হুম, তুমি যা জানতে চাইছ সেরকম অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল আঙ্কেল স্যামের চাকরিতে
যোগ দেওয়ার পর। সেসবগুলো একেকটা অ্যাডভঞ্চার বলতে পার। একাধিক
অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে একটা ঘটনা আমি কোনও দিনই
ভুলতে পারব না। আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!
“যুদ্ধ শেষের কিছুদিন
পরেই সরকারের বিরুদ্ধে
একটি বড়ো পরিমাণ অর্থ কারচুপির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য আমাকে দক্ষিণের এক দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। উপসাগরীয়
উপকূল থেকে খুব একটা দূরে নয়
জায়গাটা। বেশ কয়েকটি কারণের জন্য আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়, কাজটা
করতে হবে গোপনে। অর্থাৎ, আমার
নিজের পরিচয় ওখানে দেওয়া যাবে না। ফলে আমি এক আগন্তুকের ভেক ধরলাম যে নিজের ভাগ্য
পরিবর্তনের আশায় এসেছে। একটা খালি জমির
সন্ধান পেয়ে কিনে নিলাম সেটা। দু’কামরার
একটা কেবিন বানিয়ে শুরু হল আমার নতুন জীবন। এক নিগ্রো চাকর বহাল করলাম কাজকর্মের
জন্য। তারপর নতুন এই দেশ এবং আমার প্রতিবেশীদের
সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বাসনা দেখিয়ে শুরু করলাম আমার আসল অন্বেষণ।
“যে স্থানে আমি ছিলাম সেটা
সাধারণ রাস্তা
বা রেলপথের থেকে ভালোই দূরে। বন্য এবং সামাজিক অনাচার কাকে বলে সেটা জানতে হলে এরকম
জেলা নিজের চোখে দেখা দরকার। মিসিসিপির পূর্বদিকে এধরনের এলাকা অনেক ছিল সে সময়ে। চুনাপাথরের
দেশ। চারদিকে ছড়িয়ে ছিল অনেক সংকীর্ণ গর্ত, গুহা এবং ভূগর্ভস্থ নদী। সঙ্গে
ছিল বিশাল বিশাল সব গাছের জঙ্গল। এরই মাঝে মাঝে এমন অনেক জায়গাও ছিল যেখানে মানুষ জঙ্গল কেটে জমি বার করে
নিজেদের আস্তানা বানিয়েছে। সেইসব মানুষরা ছিল আদিম প্রকৃতির সন্তান। এধরনের মানুষ আমি এর আগে দেখিনি।
“যুদ্ধের সময় এই এলাকা সরগরম ছিল ঝটিকা আক্রমণের কারণে। খুব
সামান্য কারণে এখানে লেগে যেত মারামারি। দক্ষিণাঞ্চলের পক্ষপাতিত্ব বজায় রাখা এবং ইয়াঙ্কিদের প্রতি তিক্ত ঘৃণা ছিল এইসব সংঘর্ষগুলোর প্রধান কারণ। উভয়পক্ষেই
অনেক মানুষের জীবন হানি ঘটেছে এর কারণে।
“সেনাবাহিনীর
সঙ্গে আমার যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা অতি সাবধানে গোপন করে রেখেছিলাম। সবচেয়ে সতর্ক
থাকতে হত যুদ্ধ-বিষয়ক যে কোনওরকম মন্তব্যের সময়। তবে আমি যে আসলে উত্তরপ্রান্তের
মানুষ এই
সত্যটা একদমই লুকাতে পারিনি। এই কারণেই প্রথম থেকেই আমার প্রতিবেশীরা আমাকে অতিমাত্রায়
সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। আমি নিজে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া ছিল অতিমাত্রায় নিরুৎসাহজনক।
প্রায় একঘরে হয়ে থাকার মতোই বলতে পার।
“আমার কেবিনের সবচেয়ে কাছে যার বাড়ি ছিল তাকে ছোটোখাটো দৈত্য বলা যেতে পারে। নাম কেস হাফনার। ওয়াশিংটন ছেড়ে আসার আগেই জেনে গিয়েছিলাম, মানুষটা
ওই এলাকার নেতা-বিশেষ এবং নানানরকম বেআইনি পথ
ভালো করেই চেনেন। যে কোনও
ব্যক্তির
তুলনায়
যে কোনওরকম খবর বা তথ্য হাফনার আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে। আর এই কারণেই
আমি আমার
বাসস্থানটা ওই মানুষটার যতটা কাছে সম্ভব বানিয়েছিলাম। এলাকার অস্থায়ী আইন অনুসারে প্রতিবেশীদের থেকে অন্তত এক মাইল দূরে নিজের বাসস্থান নির্মাণ করতে হত। আমি
চেষ্টা চালচ্ছিলাম ওর নজরে আসার। ওদিক থেকে সামান্যতম উৎসাহ দেখা যায়নি। কিছু একটা
কৌশল খাটাতে হবে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য এটা
বুঝেছিলাম। একটা সুযোগও পেলাম কথা বলার, কিন্তু
হাফনার আমার উপস্থিতি উপেক্ষা করে কোনও কথা না বলেই চলে গেল। হাফনারের সঙ্গে থাকত ওর ছেলে অ্যাবনের। বয়স
বছর পনেরো। তরতাজা
চনমনে যুবক। হাফনারের সমস্ত গর্ব আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ছেলে অ্যাবনের। ছেলেটির সঙ্গেও চেষ্টা করেছিলাম বন্ধুত্ব করার, যদি সেই সূত্রে ওর
বাবার আস্থা অর্জন করা যায়। কিন্তু সেটাও কাজে লাগেনি। ছেলেটি ওর
বাবার মতোই একদম পাত্তা দিত না আমার উপস্থিতিকে। আর কখনও-সখনও সামনাসামনি দেখা হলেই অ্যাবনের দ্রুত সরে যেত ওখান থেকে। আশেপাশের অন্য প্রতিবেশীরা আমার এবং আমার বাড়ির বিষয়ে কৌতূহল দেখালেও কেস হাফনার আর ওর ছেলের সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ ঘটছিল না।
“সুযোগ এসে গেল ঘটনাচক্রে। ওখানে
বসবাসের প্রথম মাস শেষ
হতে আর দুয়েকদিন বাকি। এরকম একটা দিনে ঘোড়ায় চেপে দূরের নানা এলাকায় বেশ কিছু কাজ সেরে ফিরতে
ফিরতে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছিল। সহসাই আকাশ-বাতাস
কাঁপিয়ে শুরু হল ঝড়। সঙ্গে একের পর এক বজ্রপাত। আমার কেবিনে পৌঁছাতে অনেকটাই
পথ বাকি। সঙ্গে ছিল আমার নিগ্রো পরিচারক
সিজার। ঝড়ের দাপটে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ফলে পথ হারিয়ে ফেললাম। প্রায় আধঘণ্টা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে যখন একরাশ হতাশা এবং অস্বস্তি আমাকে ঘিরে
ধরেছে ঠিক তখনই দূরে একটা জানালা দিয়ে
বেরিয়ে আসা ক্ষীণ আলোর ঝলক চোখে পড়ল। একটা লগ কেবিন।
“কেবিনের দরজায় বারকতক নক করেও যখন কোনও সাড়াশব্দ
পেলাম না তখন ধাক্কা মারলাম। খুলে গেল দরজাটা। ঢুকলাম ভেতরে। এ কেবিনের মালিক কে সে বিষয়ে আমার কোনও আইডিয়াই ছিল না। কাদামাটি দিয়ে বানানো ফায়ার প্লেসটার সামনের একটা টুলের ওপর বসে থাকা কেস
হাফনারকে দেখতে পেয়ে অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না। দু’হাতে মুখটা চেপে ধরে হাঁটুর ওপর
কনুইয়ের ভর রেখে বসে ছিল মানুষটা। আমি যে ঢুকেছি সেটাও দেখেনি। বুঝতে
পারছিলাম না আদপেই ও অনুভব করতে পেরেছে কিনা আমাদের ঘরে প্রবেশ
করাটা। মোটামুটিভাবে সাজানো ঘরটার এদিকে
ওদিকে তাকাচ্ছিলাম। যদি অ্যাবনেরকে দেখা যায়। দেখতেও পেলাম। শুয়ে আছে বিছানায়।
নিস্পন্দভাবে। ঘরের আলো নিস্তেজ হয়ে জ্বলছিল। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকলাম ওর নাম ধরে।
“অ্যাবনেরকে
ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই দৈত্যাকার হাফনার ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তাকাল আমার দিকে। ফায়ার
প্লেসের আগুনের আলোয় ওর চোখদুটো বুনো জন্তুর মতো জ্বলজ্বল
করছিল। হৃদয় বিদারক এক চিৎকার করে বলল, ওর ছেলে মারা গেছে। সঙ্গে জানাল, এই মুহূর্তে ওখান থেকে যদি আমি না চলে যাই তাহলে সে আমাকে খুন করবে। ওর
কথা শুনে আমি অবশ্য ভয় পেলাম না। বরং এগিয়ে গেলাম বিছানার দিকে। ছেলেটা মরার মতোই পড়ে ছিল। হাফনারের প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই আমি ঝুঁকে ছেলেটার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, দেখতে মরার মতো লাগলেও ছেলেটি এখনও বেঁচে
আছে। ওই এলাকায় একধরনের হঠাৎ জ্বরের প্রাদুর্ভাব আছে। আর সেটাতেই আক্রান্ত হয়ে
অ্যাবনের অজ্ঞান হয়ে গেছে।
“সেনাবাহিনীতে থাকার সময় চিকিৎসাবিদ্যাসংক্রান্ত
সামান্য কিছু জ্ঞান আমার হয়েছিল। অ্যাবনেরের
যা হাল তাতে ওকে বাঁচানোর এখনও সুযোগ আছে। সিজারকে বললাম ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে আসতে। ওর
ভেতরে আমার ভ্রমণকালীন
মেডিসিন বক্সটা আছে। কাছেই একটা কেটলি দেখতে পেলাম।
বসিয়ে দিলাম
জল গরম করতে। কেস হাফনার উদাসীনতার সঙ্গে আমার গতিবিধি দেখে যাচ্ছিল।
“এ বিষয়ে আর বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শুধু শুনে রাখো, পরের দিন
সকাল হওয়ার আগেই
অ্যাবনের জ্বরমুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আরও এক সপ্তাহ যেতেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল। ওই দিনগুলোতে আমি রোজ ওকে গিয়ে দেখে
এসেছিলাম।
“বিড়াল যেভাবে
তার শিকারের গতিবিধির দিকে নজর রাখে ঠিক সেভাবে এই সময়টায় হাফনার আমার প্রতিটা কাজের দিকে নজর রেখে
দিয়েছিল। যদিও একটা শব্দও খরচ করেনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতার খাতিরে বা কিছু সাহায্য করতে চেয়ে। ফলে বুঝেই গিয়েছিলাম, ছেলেটিকে
সুস্থ করে তোলার পরেও ওদের বন্ধুত্ব বা আস্থা অর্জনের বিষয়টা সেদিন ঝড়ের রাতের আগে যেমন ছিল প্রায় তেমনই রয়ে গেল।
“আরও
তিনমাস কেটে গেল। হাফনারদের সঙ্গে তখনও আমার সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন
হয়নি। যে কাজে আমাকে পাঠানো হয়েছিল তা
প্রায় গুছিয়ে ফেলেছিলাম। তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েও গেছি, যে দাবি এই অঞ্চল থেকে করা
হয়েছিল তা বৈধ। রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলাম ওপরমহলে। সঙ্গে
জানিয়ে দিলাম বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তা যেন
আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে আমার মাথায় একটা ভাবনা জন্ম নেয়। আজ অবধি তদন্তের কাজটি দারুণ গোপনীয়তার সঙ্গেই সম্পন্ন করা গেছে। আমি
এবং ওপরমহল ছাড়া কাকপক্ষীতেও টের পায়নি
আমার উদ্দেশ্য। সুতরাং, কারও সাহায্য না নিয়ে আমি একাই বাকি কাজটা শেষ করব। অতিরিক্ত
কোনও নিরাপত্তার আমার দরকার নেই। পরিকল্পনামতো নির্দিষ্ট
দিনে কাছের রেলস্টেশনে গেলাম। ওখানেই
আসবে ওপরমহলের পাঠানো অর্থ। সেদিন এল না। বদলে এল গোপন খবর, এক সপ্তাহ পরে পাঠানো হবে। কী আর করা যাবে। যেমন পরিস্থিতি তেমন কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দরকার লাগে এমন কিছু সামগ্রী কিনলাম দোকান থেকে। ঢুকিয়ে নিলাম সেই ক্যানভাস ব্যাগটায় যা সঙ্গে করে এনেছিলাম আগত অর্থ ভরে নিয়ে
যাওয়ার জন্য। তারপর ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী বাসস্থানে।
“ওই দিন
রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায় দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দে। জানতে চাই, কে? কে ওখানে?
“উত্তরে
আমার নিগ্রো পরিচারকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ও জানায়, হুজুর অনুগ্রহ করে সেই ওষুধটা
একটু দিলে ভালো হয়। খুব কষ্ট পাচ্ছি।
“বেচারা
মাঝে মাঝেই পেটের বেদনায় ভোগে। এর আগেও বেশ কয়েকবার রাতবিরেতে ওকে ওষুধ দিয়েছিলাম
আমি। ফলে কিছু না
ভেবেই দরজা খুলে দিলাম।
“দরজা
খোলার আগে যে মোমবাতিটা জ্বালিয়েছিলাম তার আলোয় দেখতে পেলাম সিজারের ফ্যাকাসে ভয়ার্ত মুখটা। ওর মাথার পাশে ঠেকানো
আছে রিভলভারের নল। একইসঙ্গে
একটা পিস্তল আমার নিজের মুখের দিকেও তাক করা। কিছু করার আগেই দুই মুখোশধারী আমাকে জাপটে ধরল। এসবের কী মানে, আমি জানতে চাইলাম। কেউ কোনও উত্তর দিল না। ঠেলে বাইরে নিয়ে গেল আমাকে। একজন থাকল আমার পাহারায় আর
অন্যজন দ্রুত কেবিনের প্রতিটি অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করে দেখল। যা খুঁজছিল সেটা না পেয়ে বেরিয়েও এল কিছুক্ষণের ভেতরে।
“এবার ওদের মধ্যে একজন আমাকে বলল, আপনি কী ভেবেছেন জানি না, মেজর। তবে যে অর্থ নিয়ে এসেছেন সেটা আমাদের দিয়ে দিন। ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিলে ভালো, না হলে আমাদের অন্য পথ দেখতে হবে।
“মুখোশ
পরে থাকলেও কথার টোনেই আমি
ওই লোকটাকে চিনতে পেরেছিলাম। কেস হাফনার।
“আমি উত্তর দিলাম,
আমার কাছে কোনও অর্থ নেই। এখনও
আসেইনি।
“ওরা বলল,
ওরা আমার কাজকর্মের বিষয়ে সবকিছু জানে। ভালো করেই দেখেছে যে অর্থ আসার কথা ছিল সেটা নিয়েই আমি সন্ধ্যার
আগে রেল
স্টেশন থেকে কেবিনে ফিরে এসেছি।
“আমার কাছ
থেকে পুনরায় নেতিবাচক উত্তর পেয়ে ওদের নেতা বলল, বেশ তাহলে তাই হোক! মেজর, নিজে থেকে আপনি যখন কিছুই বলবেন না তখন আমাদের জোর খাটাতেই হবে। ব্ল্যাক হোলের ডোজ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু কী আর করা যাবে। আশা করছি এর ফলে আপনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন কী করবেন
আর কী না করবেন সে বিষয়ে।
“আমি আগে এই ব্ল্যাক হোলের কথা শুনেছিলাম। ভয়াবহ এক
শিউরানি আমাকে কাঁপিয়ে দিল। ব্ল্যাক হোল আসলে একটা চুনাপাথরের গর্ত বা খাদ। যথেষ্ট গভীর। আমার কেবিন থেকে কিছুটা দূরেই ওটা। জঙ্গলের ভেতরে প্রায় অগম্য এক জায়গা। স্থানীয়
নিগ্রো বাসিন্দারা আমাকে জানিয়েছিল, ওই খাদের
ভেতর থেকে নাকি অপার্থিব অশরীরীদের কান্না এবং আর্তনাদ শোনা যায়। ওগুলো
নাকি সেইসব স্থানীয় আদিম অধিবাসীদের প্রেতাত্মাদের চিৎকার। যাদের
এই এলাকা দখল করতে গিয়ে একসময় বহিরাগতরা হত্যা করে বা আধমরা
করে ওই খাদে ফেলে দিয়েছিল।
“আমি ওদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম, এমনকি এটাও বলেছিলাম, অর্থ
হাতে পেলেই ওদের দেব। তবুও
কোনও লাভ হয়নি। হয়
অর্থ দাও নচেৎ ব্ল্যাক হোল! এই ছিল ওদের মনোভাব। এরপর ওরা আমাকে
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে চলল টেনে-হিঁচড়ে। কেউ
কোনও কথাই বলছিল না। শুধুমাত্র
যন্ত্রণার কিছু শব্দ যা আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল সেটা
প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চরাচরে। বুঝতেও
পারছিলাম না কোন পথে ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ এভাবে চলার পর থামল ওরা। নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে শুনতে পেলাম আমার পায়ের তলার জমির ভেতর থেকে একটা গুমরানো
কান্নার মতো শব্দ যেন উঠে আসছে।
“আরও একবার জিজ্ঞেস করা হল আমাকে, মেজর, শেষবারের মতো ভেবে দেখুন অর্থ দেবেন কি না। বলুন কোথায় আছে ওগুলো। না হলে এই জাহান্নামের গর্তের ভেতরে ফেলে আমরা চলে যাব।
“আমার
কাছে একটাই জবাব ছিল, ঈশ্বরের দোহাই, বিশ্বাস
কর আমার কাছে সত্যিই কোনও অর্থ আসেনি। যদি
সত্যিই এসে থাকত নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমি সেটা তোমাদের হাতেই তুলে দিতাম।
“শুনে ওরা
উপহাসের ভঙ্গিতে হেসে
উঠল। তারপর একটা সরু দড়ি দিয়ে দুই হাতের নিচ দিয়ে পিঠ-বুক জুড়ে
বাঁধল আমাকে এবং এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিল খাদের ভেতরে। অসহায়ভাবে আমি ঝুলে থাকলাম ভয়াবহ খাদটার
ভেতরে। ভেসে এল হাফনারের
কণ্ঠস্বর, আমরা এখানে মাত্র একঘন্টা
অপেক্ষা
করব, মেজর। এর মধ্যে যদি আপনার সিদ্ধান্ত বদলায় জানাবেন। তা না হলে... গুডবাই।
“এরপর ওরা আমাকে ধীরে ধীরে ঘন কালো
অন্ধকারের ভেতরে নিচে নামিয়ে দিতে শুরু করল।
নিচে, অনেক নিচে। এত ধীরে যে মনে হচ্ছিল আমি একঘণ্টার অনেক বেশি সময় ধরে এভাবে ঝুলে আছি। নেমে
যাচ্ছি আদিম পৃথিবীর হৃদকন্দরে। অসহ্য
যন্ত্রণা হচ্ছিল দু’হাতের
তলায়। সরু দড়ি চামড়া কেটে বসে যাচ্ছিল
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেই কাটা দাগের চিহ্ন আজও আমার
শরীরে রয়েছে। যত নিচে নামছিলাম আমার প্রতিটি রোমকূপের শিহরণ শতগুণে বেড়ে যাচ্ছিল অপার্থিব সেই গুমরানো কষ্ট
মেশানো ঘরঘরে কান্নার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে। ক্রমশই বাড়ছিল ওই শব্দের তীব্রতা।
“হঠাৎই
ওপর থেকে দড়িটা ছেড়ে দিল ওরা। প্রচন্ডরকমভাবে চমকে গিয়ে আমি পড়তে শুরু করলাম নিচে এবং পড়লাম গিয়ে ঝপাস করে জলের ওপর। ডুবে গেলাম
অনেকটা। হাঁচরপাঁচর করে চেষ্টা করতে থাকলাম জলের ওপর উঠে আসার। বুঝতে
পারছিলাম, দারুণ একটা
স্রোত আমাকে টানছে। আর সে টানে
কিছুটা যেতেই আমার পা গিয়ে ঠেকল জলের নিচের মাটিতে। সঙ্গে
সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, আমি আর ডুবছি না। দাঁড়াতে পারছি। জল এখন আমার কাঁধ পর্যন্ত। বেশ
কিছুটা সময় আমি বিভ্রান্ত অবস্থায় ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। অন্ধকারে কালো জলের স্রোত আমার পাশ দিয়ে কলকল শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছিল। ফাঁকা
খনি গুহার ভেতরে সে শব্দ-লহরী বড়োই আতঙ্কজনক। মনে হচ্ছিল, চারদিক
থেকে অবয়বহীন অশরীরী দানবের দল দাঁত-নখ
বাগিয়ে এগিয়ে আসছে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, এখনও আমি সেই ভয়াবহ মুহূর্তের স্বপ্ন দেখে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসি।
“চরম স্রোতের মধ্যে দিয়ে
এগিয়ে যাওয়াটা খুবই অসুবিধাজনক। কতক্ষণ পারব
বুঝতে পারছিলাম না। কেন যে চেষ্টা করছি সেটাই মনে হচ্ছিল ওই মুহূর্তে। এখান থেকে
বেঁচে ফেরার আশা যে নেই সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম। কাতরভাবে প্রার্থনা করার চেষ্টা করেছি, ওহ্, প্রভু যীশু, আমার আত্মা গ্রহণ করে আমাকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে
মুক্তি দাও। মরতে হবে এটা বুঝেই বোধহয়, জানি না, এরপরেই আমার ভেতরে একটা ইচ্ছেশক্তির জন্ম হল। হঠাৎই জোর ফিরে পেলাম যেন শরীরে। অসহ্য সেই মুহূর্ত থেকে বাঁচার জন্য আমি
এর শেষ দেখেই ছাড়ব ঠিক করলাম। শুরু করলাম ভেসে থাকতে। বয়ে চললাম স্রোতের সঙ্গে।
“জানি না ঠিক কতক্ষণ ভেসে যাওয়ার পর আমি পায়ে আবার জল-তলের
ছোঁয়া পেয়েছিলাম। তবে এবার
জল আরও কম। কোমর অবধি। এতক্ষণ আমার
চোখ বন্ধ
ছিল। এবার খুললাম। আন্দাজ একশো ফুট দূর থেকে একটা উজ্জ্বল আলোর
ঝলকানি আমার চোখে এসে ধাক্কা মারল। মাথা কাজ করছিল না সেই মুহূর্তে। তাকালাম আলোটার দিকে। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এই পাতাল-জগতে ওটা কী হতে পারে। হতবুদ্ধিজনক ভাবটা
কেটে গেল যখন চিৎকারটা কানে এসে ধাক্কা মারল।
মানুষের কণ্ঠস্বর! দীর্ঘ টানা ‘হ্যালো-ও-ও!’ শব্দ। মাটির তলার এই গভীরতায় প্রতিধ্বনিত হতে হতে আমার কাছে এসে পৌঁছল। আমি সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। অগত্যা ধীরে ধীরে জল ঠেলে এগোতে থাকলাম আলো লক্ষ্য করে।
“কয়েক মিনিটের ভেতরেই আমি সেই ছেলেটার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, যার জীবন বাঁচিয়েছিলাম দু’মাস আগে। ও
আমার বাঁধনটা কেটে দিল সবার আগে। তারপর বলল, আপনি ঠিক আছেন তো, মেজর? প্রথম থেকেই আমি আপনাদের অনুসরণ করেছি। আশা করেছিলাম, এইখানেই আপনার দেখা
পাব। সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চলে আসুন এই অন্ধকারের জগত থেকে।
“ছেলেটি জলস্রোতের
পাশে একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল যেটা ডানদিকে ঘুরে চলে গেছে এই ভূগর্ভস্থ নদীকে পাশ কাটিয়ে। ছেলেটার
পিছু পিছু ওই পথ ধরে খানিকটা হেঁটে যাওয়ার পর একটা কুয়োর মতো গর্তের কাছে এসে
পৌঁছলাম। একটা হাতে বানানো মই রাখা ছিল
দেওয়ালে ভর দিয়ে। ওটা ধরে উঠে উপস্থিত হলাম সেই কেবিন ঘরটায় যে ঘরে অ্যাবনের একদিন
অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ঘরের কাঠের মেঝেতেই কুয়োর গোপন রাস্তাটা ঢাকা থাকে।”
মেজর থামলেন এবং একটা নতুন
সিগারে অগ্নিসংযোগ করলেন। আমি জানতে চাইলাম, “কাহিনি খতম?”
“হ্যাঁ, এ-গল্প এখানেই শেষ। সবকিছু বুঝতে পেরেও আমি কাউকেই গ্রেফতার করতে পারিনি। সবকিছু
বুঝতে পেরেও আমি কেস হাফনারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিইনি। বা বলতে পার নেওয়ার সুযোগ পাইনি। পাতালের অন্ধকারে যে আলো কেউ আমাকে দেখিয়েছিল সেই আলোর মালিক আমাকে কিছু
করার সুযোগই দেয়নি। পরের দিন সকালেই
আমি ওই এলাকা পরিত্যাগ করি এবং আর কোনওদিন ফিরে
যাইনি সেখানে।”
“আপনি পরে
আর ওই ছেলেটির খোঁজ নেননি?”
“অ্যাবনেরের? হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। ওকে কী করে ভুলব? আমিই তো পরে ওর কলেজে পড়ার
ব্যবস্থা করে দিই। এই মুহূর্তে সে কংগ্রেসের এক গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার। আমি যদি
তোমাকে তার আসল নামটা জানাই তাহলে তুমি সহজেই বুঝতে পারবে দক্ষিণপ্রদেশ
থেকে যারা ওয়াশিংটনে এসেছে
তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা মানুষ আমার অ্যাবনের।”
_____
[১৮৯১ সালে “ELEVEN POSSIBLE CASES”
নামের বইতে KIRKE MUNROE লিখিত THE BUSHWHACKER'S
GRATITUDE গল্পের ভাবানুবাদ। ]
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment