কাঠপুতলির দেশে
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
আমার ছোটোবেলার খেলনাগুলোর কথা আমার এখনও মনে আছে। আমার জন্মদিনে বাবা একটা বড়ো বাক্স এনে দিয়েছিল। যার মধ্যে ছিল কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল বুড়োবুড়ি, বর-বৌ, একটা ছাগল চরানো রাখাল ছেলে আরও কত্ত কী। ওদের দেখলেই মনে হত, ওরা আমার সঙ্গে কথা বলবে এক্ষুনি। ওদের অনেক গল্প আছে। ওরা হাঁটাচলাও করত না, কথাও বলত না, কিন্তু ব্যাটারি দেওয়া বা চাবি দেওয়া খেলনার থেকে ওরা আমার কাছে অনেক প্রিয় ছিল। সুতো বাঁধা কাঠপুতলি, কাঠের গরুর গাড়ি, নৌকো এসবও আমার খুব প্রিয় ছিল। আমাদের বাড়িতে যখন মিস্ত্রি কাজ করছিল তখন তাদের বললাম, দাও না বাপু আমার পুতুলের জন্য কাঠের চেয়ার-টেবিল তৈরি করে। তা তারা আমার কথা শুনেছিল। ছোট্ট ছোট্ট কাঠের চেয়ার-টেবিল তৈরি করে দিয়েছিল। তুলসীবাড়ির মেলা থেকে ৫ টাকায় পুতুলের কাঠের খাট, কাঠের পাল্লা দেওয়া আলমারি, ড্রেসিং টেবিল কিনেছিলাম।
গঙ্গার ধার থেকে একতাল মাটি তুলে এনে মা আমাকে একবার ছোট্ট ছোট্ট থালা, গেলাস, বাটি, পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল। মিনুমাসি আমাকে মাটির বৌ-পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল। যার কপালে কাঠি দিয়ে ফুটকি ফুটকি চন্দন আর টিকলি আঁকা ছিল। মাথায় ছিল মস্ত খোঁপা। কাজল-কালো চোখ। তাকে লাল শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল মিনুমাসি। আমাদের রথের মেলায় মাটির বিভিন্নরকম পাখির জোড়া, মাটির থালা ভরা সিঙ্গাড়া, মিষ্টি, নানারকম ফল পাওয়া যেত। কী যে আনন্দ হত ওগুলো কেনার সময়!
এই তো সেদিন মহীশূর যাওয়ার পথে চন্নাপাটনা গেলাম। তোমরা কি জানো, এই শহরকে কর্ণাটকের খেলনা শহর বলা হয়, কারণ এখানে দুরন্ত সব কাঠের খেলনা পাওয়া যায়। রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ল অজস্র কাঠের খেলনার দোকান। এত্ত রংচঙে আর মিষ্টি সে সব খেলনা যে দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আবার ছোটোবেলার দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। শোনা যায়, টিপু সুলতান নাকি পারস্য থেকে শিল্পী আনিয়ে স্থানীয় কারিগরদের এই কাঠের কাজ শেখার ব্যবস্থা করেন। বাভাস মিঞাকে এই কাঠপুতলির জনক বলা হয়। কাঠপুতলি তৈরিতে তিনি জাপানি প্রযুক্তি ও শিল্পশৈলী ব্যবহার করেন। বহুদিনের এই শিল্প আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু এখন আবার সরকারি উদ্যোগে নতুন করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।
পুতুলের দোকানের
দিকে যেতেই পুতুলেরা তাই খুশি খুশি হয়ে হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল আর বলল, “আমাদের কথা ম্যাজিক ল্যাম্পে লিখো। জান তো, আমাদের খুব দুঃখ। ছোট্ট বন্ধুরা এখন বড্ড বেশি ইলেকট্রনিক খেলনা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চব্বিশ ঘন্টা তাদের মোবাইল আর কম্পিউটার, ভিডিও গেমসে সময় কাটে। নড়াচড়া করা, কথা বলা পুতুল ছাড়া তাদের পছন্দ হয় না। আমরাও নড়াচড়া করি। একটু নাড়িয়ে দিলেই কেমন সুন্দর মাথা নড়ে আমাদের। আর হাওয়া দিলে কেমন মুন্ডু ঘুরে যায়। আমরা কথাও বলতে পারি, তবে কারও কারও সঙ্গে বলি। যাদের খুব পছন্দ হয়। এই যেমন ধর তোমাকে।”
কাঠপুতলির মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে আমি গদগদভাবে বললাম, “নিশ্চয়ই লিখব গো, নিশ্চয়ই লিখব।”
তখন ওপাশ থেকে একটা বৌ-পুতুল মুখঝামটা দিয়ে বলল, “ইলেকট্রনিক খেলনা তো দু’দিনেই ভেঙে যায়। আর আমরা যতই মারো, যতই মেঝের ওপর ঝপাঝপ ফেল একদম শক্তপোক্ত। কিচ্ছুটি হবেনিকো।”
জাপানি বুড়োবুড়ি পুতুলও সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। সানাই আর ঢোল নিয়ে দেখি একদল পুতুল বসে আছে। চমত্কার পাগড়ি পরে। আমি সেই সানাইয়ের সুর শুনতে পেলাম। ভিডিও গেমস আর ব্যাটারি দেওয়া খেলনায় কল্পনাকে যেন অনেকটা বেঁধে দেয়। নতুন করে ভাবার কোনও জায়গা থাকে না। তাই বলি ছোট্ট বন্ধুরা, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুলদের বাড়ি নিয়ে যাও। দেখবে এরা কেমন চুপিচুপি তোমার সঙ্গে গল্প করবে। তোমার বন্ধু হবে।
_____
ছবিঃ দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
khub bhalo udyog. matir kacha kachi ....matir gondho mishiye lekha...
ReplyDeleteDhanyobad :)
ReplyDelete