![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiZpqiCG-kHZNomR_A9h-RbKBT1NrVkqHMrIQhI7dCcMjR-ozhLwYmf3DhJm60Ph2-0582IVNbrx0DBgri9GTB_PbXWwT1sQ72BfnwmnZ-36jC0FMY_B-i7WjabwZ2e_zzRvXVkHPU9De3_/s640/anilikha+1.jpg)
অনিলিখা এবং একটি আলোচনা
পার্থপ্রতিম
।। এক।।
সুনীল-শীর্ষেন্দুর
জাদুকলমের স্বাদ যখন একটু একটু করে নিরাশার জন্ম দিচ্ছে,
সমরেশ মজুমদার নামটা দেখলেই পত্রিকার পাতাগুলো উলটে পেরিয়ে যাচ্ছি,
অথচ শিশুকিশোর পত্রিকাগুলোতে পড়ার মতো বিকল্প কোনও উপাদান বা লেখকও পাচ্ছি
না, শুকতারার ফিরে দেখা বিভাগের লেখাগুলো অন্যান্য নতুন লেখার
চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভালো লাগছে, মনের ভেতর সন্দেহ একটা দানা বাঁধছে
বাংলা শিশুকিশোরসাহিত্য এইরকম থোড়-বড়ি-খাড়ার ভেতর একই বৃত্তে ঘুরে বেড়াবে কি না, ঠিক
এরকম সময়ে প্রথম শুকতারার পাতাতে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর কল্পবিজ্ঞানের গল্পটা পড়ি।
একটা মেয়ে মহাকাশযানে একা, পটভূমি মহাশূন্য, যানে আরেকটা বাচ্চা ছেলে কীভাবে যেন
উঠে বসেছে। এদিকে মহাকাশে ভ্রমণের সময়
সবকিছু হিসেব করে নেওয়া থাকে। ওই
ছেলের ওজন বইতে গেলে যে অতিরিক্ত রকেট জ্বালানী প্রয়োজন তা তো নেই।
অচেনা ছেলেটির প্রতি কেন কে জানে করুণার্দ্র হয়ে মেয়েটি তার হাত-পা
খুলে খুলে বাইরে অনন্ত শূন্যে ছুড়ে দেয়, আর তখনই বোঝা যায় ওই মানবিক কাজটি যে করল সে কোনও মানবী নয় - রোবট!
গল্পটি
এখনও ভাবলে মনখারাপের অনুভূতি হয়। তখন
ভাবি, প্রথম যখন পড়েছিলাম কী নিদারুণ অভিঘাতের সৃষ্টিই না করেছিল! যেমন ফ্রেশ লেখা, তেমনই ফ্রেশ জীবনদর্শন।
পাকসাট খেয়ে বেড়ানো ওই সময়কার সাহিত্যে ভিন্ন ধারার উচ্চারণ, জাত
চেনানো।
তারপর থেকেই
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী নামটা খুঁজতাম, চেতন বা অবচেতনে। অবচেতনে
বলছি কারণ, কিশোর ভারতীর পাতায় সংকেত রহস্য উপন্যাসের পাশে লেখক নামটা দেখেই অদ্ভুত
অনুভূতি হয়েছিল মনের ভেতর। কতটা
প্রত্যাশা ছিল এই লেখকের লেখা পড়ার জন্য সেটা ওই আকস্মিক অনুভূতি থেকেই সচেতনভাবে বুঝতে
পারি। আর সংকেত রহস্যেই প্রথম পরিচয়
অনিলিখার সঙ্গে। সংকেত রহস্যের হিরোইন নয় অনিলিখা,
সে অনেকগুলো চরিত্রের মধ্যে একজন। সংকেত
রহস্যের হিরো এই উপন্যাসের লেখক নিজে। তাঁর
সহজ সরল, বর্ণনাত্মক অথচ অননুকরণীয় নিজস্ব ভাষা,
প্লটবিন্যাস, দুর্ধর্ষ এবং সায়েন্টিফিক থিম এবং
তার সঙ্গে ফিকশনের যথাযথ মিশেল আর জীবন্ত চরিত্রায়ন এবং অনায়াস আন্তর্জাতিকতাবোধ সহযোগে
যে লেখাটি বাংলা সাহিত্যের পাঠক পেলেন নির্দ্বিধায় সেই অভিজ্ঞতাকে Never
Before বলা যেতেই পারে। আমি
নিজের কথা বলি। বাংলা ভাষায় এমন বিশ্বমানের
টেকনো থ্রিলার লেখা যায়, ভাবিওনি, আগে পড়িওনি। শুধু
হলিউডি সিনেমায় দেখেছি। ওই একটি উপন্যাসেই লেখক যে
বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিলেন নিজের জন্য আর এই সাহিত্যের অন্যান্য লেখকদের জন্যও তা অতিক্রম
করাটা সহজ নয় মোটেই। তাই আগ্রহ তো ছিলই লেখকের পরের
লেখাগুলোর প্রতি, দেখার ইচ্ছে ছিল নিজেকে
তিনি অতিক্রম করতে পারেন কি না। দ্বিধাহীনভাবে
স্বীকার করি, বাংলার তদানীন্তন মরা বাজারে এই লেখকের ফ্যান বা পাখা বা ভক্ত যাই বলুন
তা হয়ে গেছি আর দুর্দমনীয় কৌতূহলও জেগেছে লেখকের প্রতি। মনে
হয়েছে যে এমন বেগবান কাহিনির জনক নিজে ঘরকুনো বাঙালি হতে পারেন না।
তখন ফেসবুক ছিল না। বহু
বহু পরে আমার ধারণার সত্যতা উপলব্ধি করি।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhklzM4Ekk0LYBDZ4WReZx6F99hTV5f8-3gJKXMEn2wrthvFuC6JEiHd2pUIJYDYwqktvX8SNa2tI1VxG-yXnUsHhRO6QvmArYhvIXAlztQddzZuiNEN6w8xN9ZlvmQNOCsydcL_apqa2JT/s400/anilikha+2.jpg)
সংকেত রহস্যে
অনিলিখাকে যতটুকু বুঝেছিলাম মনে হয়েছিল অত্যন্ত স্মার্ট,
গ্লোবাল ভিলেজে সাবলীল, সৎ, সাহসী এবং তীক্ষ্ণধী, বিজ্ঞানমনস্ক, সুন্দরী এক বিশ্বমানের চরিত্র। ফাজলামি
স্পোরটিংলি নেয়, কিন্তু ফাজলামি করে না,
মেয়েসুলভ ব্যাপার-স্যাপার তার মধ্যে কম। কিছুটা
ফিমেল জেমস বন্ড আর ফিমেল ফেলুদা বললে যাঁরা অনিলিখা পড়েননি কিছুটা ধারণা করতে পারবেন।
মিতিনমাসি
বা গার্গীদিদির মতো গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অবিশ্রাম তথ্য বিতরণের সামাজিক দায়িত্বও ঘাড়ে
তুলে নেয় না সে। অত্যন্ত ডিটারমাইন্ড। ঘনাদার
মতো তার অভিযান-ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী ছড়ানো, বাঙালি পুতুপুতু ব্যাপার-স্যাপার নেই। অনিলিখাকে সাম
আপ করলে এমনই দাঁড়াবে।
যত দিন
গেছে অনিলিখার এইসব বেসিক ফিচারে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে দেখেছি।
একটি কাল্পনিক চরিত্রের ক্রম সাবালকত্বের বিভিন্ন ধাপ মনে হয়েছে।
কিশোর ভারতীতে প্রায় নিয়মিত আসে সে।
অনিলিখার
এই ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আর এক আইকনিক সাই-ফাই চরিত্র প্রোফেসর শঙ্কুর
তুলনা করলে 6 আর 9-এর মতো একটি উলটো বিন্যাস নজরে আসতে পারে। বিন্যাস
বিবর্তন কাহিনির আঙ্গিক বা টেকনিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ওপার বাংলার
বিখ্যাত তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান এক কথোপকথনে বলেছিলেন যে উপন্যাস বা গল্প লিখে
শেষ করাটা তেমন কঠিন কিছু ব্যাপার নয়। হয়তো
কিছুটা পরিশ্রমসাধ্য। বিষয় নির্বাচন করে সেই বিষয়ের
উপযুক্ত আঙ্গিক খুঁজে বের করে লেখাটা শুরু করাই সৃজনকর্মের আসল পরীক্ষা।
কথাটি কি ঠিক? সাহিত্যের ইতিহাস এই আঙ্গিকেরই ইতিহাস। একই
থিম অবলম্বনে হাজার হাজার বিভিন্ন প্লটের গল্প লেখা যেতে পারে এ আমরা এডগার এলান পোর
থেকেই জানি। সেটা প্রয়োগও করে আসছেন পৃথিবী-বিখ্যাত
লেখকেরা তাঁদের রচনায়।
এখন এসেছে
কোল্ড ওয়ার পরবর্তী, সমাজতন্ত্রের ছায়া বা
আদর্শপাতমুক্ত অতি আধুনিক সাহিত্যচিন্তা। আর
এ যুগের চিন্তাশীল সাহিত্যিকরা ঘোষণা করছেন শুধু থিম নয়,
একই প্লট থেকেও একাধিক গল্প উপন্যাস লেখা যায়, যদি আঙ্গিক হয় ভিন্ন ভিন্ন। আঙ্গিকই সাহিত্য,
সাহিত্যের ইতিহাস আঙ্গিকের ইতিহাস। সত্য।
শুধু আঙ্গিকের বিচারে একটি গল্প হয়ে যেতে পারে মজার,
ওই আঙ্গিকের পরিবর্তনে আবার সে সিরিয়াস সাহিত্যের রূপ ধরতে পারে।
ফ্যান্টাসি হয়ে যায় স্টার্ক রিয়ালিটি,
সবই আঙ্গিকের খেলা।
বিশ্ববিখ্যাত
চলচ্চিত্রকারদের রচনাতেও দেখি আঙ্গিক বা টেকনিককে তাঁরা কীরূপ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
রাখছেন। সেরগেই আইজেনস্টাইন থেকে শুরু
করে আমাদের সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পর্যন্ত।
শুধুমাত্র আঙ্গিকের আচার-বিচার নিয়েই গোটা শিল্পজীবন কাটিয়ে দিলেন
এমন উদাহরণও কম নেই। জাঁ লুক গোদার বা হাতের কাছেই
মৃণাল সেন। হবেই তো, চলচ্চিত্র আর সাহিত্য
যে এক শিল্প-মায়ের ছোটোছেলে আর বড়োছেলে। বিশ্বের
সব বড়ো ছবি-করিয়ে বিশাল মাপের সাহিত্যবোদ্ধা ছিলেন। গ্রিফিথ
থেকে পুডভকিন আইজেনস্টাইন - চলচ্চিত্রের বিভিন্ন
আঙ্গিক বা টেকনিক ও প্রয়োগকৌশল সাহিত্যপ্রকরণ থেকেই নিয়েছেন, যেমন ছোটোভাই শেখে লায়েক দাদার কাছ থেকে - শট বিভাজন,
মন্তাজ, ক্লোজ আপ থেকে ডিপ ফোকাস আর সিনেমাটোগ্রাফি
আর স্ক্রিপ্ট রাইটিং-এর নানা কৌশল।
প্রসঙ্গে
আসি। সংকেত রহস্য অত্যন্ত সিরিয়াস
মোড়কে লেখা। ক্রপ সারকলের রহস্যের পেছনে
ভিনগ্রহীর সংকেত নিখুঁত পেশাদারিত্বে উদঘাটন করা হয়েছে। পরের
দিকের লেখায় অনিলিখার পার্শ্বপরিবেশ, তার মেজাজ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। গল্প
বলা হয়েছে ঈষৎ হালকা চালে। তবে
বিষয় হিসেবে প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই এসেছে এমন কিছু যা বাংলা সাহিত্যে আগে ‘ট্রাই’ করা
হয়নি। একাধিক গল্পে বায়ো-থ্রিলারের
উপাদান বা নাম্বার থিওরির নানান পাজল নিয়ে পাঠককে নতুন রহস্য উপহার দিয়েছে অনিলিখা।
ধীরে ধীরে নানান লৌকিক বা অলৌকিক অভিযানের অভিজ্ঞতায় অনিলিখার
বিজ্ঞানমনস্কতায় কোনও ছাপ পড়েনি। একাধিকবার
ভূতের মুখোমুখিও হতে হয় তাকে, কিন্তু হুমায়ুনের
মিসির আলির মতোই যতই আধিভৌতিক ঘটনার সম্মুখীন হোক না কেন, অনিলিখা
প্রখর যুক্তিবাদীই থাকে, যুক্তি বিচার মানসিক সুস্থতায় কোনও বাধা
পড়ে না তার। আর এভাবেই এক আদর্শ কিন্তু ‘কাল্পনিক’ চরিত্র হিসেবে
অনিলিখা পাঠকের মননে নিজের জায়গা করে নেয়।
একটি চরিত্রকে
নিয়ে একাধিক মেজাজ এবং আঙ্গিকের কাহিনি লিখলে এই ঘটনাটি ঘটে থাকে।
তার সূচনার স্বাতন্ত্র্য থেকে কিছুটা সরে আসে,
পূর্বপরিচিতির প্রেডিক্টিবিলিটি ছাড়িয়ে তাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির
মুখোমুখি করান লেখক। একসাথে
পায়ে পা মিলিয়ে চলা পাঠক প্রথমে একটু হোঁচট খায় হয়তো,
তারপর মানিয়ে নেয়।
আমি আগে
ভাবতাম অনিলিখা মানে শুধুই বিজ্ঞান, কল্পনা আর বিজ্ঞান। এখন
মানিয়ে নিয়েছি। বুঝেছি, জীবন যেমন আগে থেকে
ভেবে নেওয়া যায় না তেমনি কল্পনার চরিত্রও তার একান্ত নিজস্ব জার্নিতে কোন কোন অভিজ্ঞতার
মুখোমুখি হবে তা তার সৃষ্টিকর্তার একান্ত নিজস্ব বোধ। পাঠক
তার সাক্ষী হতে পারে মাত্র, পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে
তুলনা করতে পারে।
সত্যজিৎ
রায় যখন হেসোরাম হুঁশিয়ারের মতো করে প্রোফেসর শঙ্কুকে এনেছিলেন, তাঁর মাথায় নিশ্চয়ই
সিরিয়াস কল্পবিজ্ঞান লেখার ভাবনা ছিল না। শঙ্কুর
প্রথম গল্পে আমরা পাই দারুণ একটি ফ্যান্টাসি গল্প, গল্পকথনের ভঙ্গী, ভাষা, আঙ্গিক,
চরিত্রায়ন সবকিছু মিলেমিশে ওই ফ্যান্টাস্টিক সায়েন্স ফ্যান্টাসির জন্ম
দিয়েছিল। কিন্তু পরের গল্পটি পড়তে গেলেই
হোঁচট খেতে হয়। সত্যজিৎ এই গল্পের ক্যারেকটারের
শেডস, টোন, টেকনিক আর ভাষা বদলে
ফেলেছেন সব। ধীরে ধীরে বোঝা যায়, তিনি শঙ্কুকে
একজন সিরিয়াস অলরাউন্ডার সায়েন্টিস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন।
এমনকি গল্পকথনের গুণে শঙ্কুর আজগুবি আবিষ্কারগুলোকেও
(মিরাকিউরল, নস্য পিস্তল) আর আজগুবি মনে হয় না। দেশে-বিদেশে
তিনি সম্মানিত হন সেসবের জন্য। অথচ
শঙ্কুর প্রথম গল্পটি পড়লে পরের গল্পের শঙ্কুকে (যদিও টাইমলাইন বিচার করলে প্রথম গল্পটাই শঙ্কুর শেষ গল্প।
কারণ, ওতেই শঙ্কুর শেষ অভিযানের কথা বলা আছে।
বোধকরি সত্যজিৎ ভাবেননি এই চরিত্রকে নিয়ে তাঁকে আনন্দমেলায় নিরন্তর
লিখে যেতে হবে। আমি প্রকাশের সময়কাল ভিত্তিতে
বলছি) ঠিক মেলানো যায় না।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই - গল্পের আঙ্গিক গল্পকে কতটা বদলে দিতে পারে, চরিত্রায়ন,
বর্ণনা, পরিবেশ, পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গী
- সবকিছু।
শঙ্কুর
সঙ্গে অনিলিখার গল্পের এই আঙ্গিকগত বিষয়টিতে যেটি আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করে তা হল শঙ্কুর
গল্পের এই আঙ্গিকগত পরিবর্তনকে যদি আমি ‘p’ ধরি তাহলে অনিলিখার ক্ষেত্রে ওটি হবে ‘q’ -
একরকম কিন্তু উলটো।
গতবছর ১৪২৩
শারদীয় কিশোর ভারতীতে প্রকাশিত ‘রহস্য যখন সংকেতে’ নভেলেটটা পড়ার পর ভাবতে বসলাম শেষ
কবে এমন ‘অল স্টার’ গোছের লেখা পড়েছি বাংলায়। লেখকের
সৃষ্ট মিস্টার পাই ও তার আমুদে চাকর (ঠিক শঙ্কুর সেই প্রথম গল্পের মতো মেজাজওয়ালা), সংকেত
রহস্যর জিল, ভিনগ্রহীদের সংকেত এবং পেরুনিবাসী উপজাতি,
আর চিরশত্রু স্টাইলে গিল হারভে। মারভেল
বা ডিসি সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের মতো প্রত্যেক চরিত্রকে এনে একটি রুদ্ধশ্বাস রহস্য
তৈরি করা হয়েছে। তবে এইধরনের অল স্টার কাহিনিগুলো
রিয়েলিস্টিক করতে গেলে ভয়ানক ডোবে। যেমন
ডুবেছে ডিসির ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান মুভিটি। লেখক
সেদিক দিয়েও যাননি, বরং মারভেল ক্যাপ্টেন
আমেরিকা সিভিল ওয়ারের মতো ঝকঝকে অ্যাকশন রহস্য অ্যাডভেঞ্চার আর বাস্তবতার নিগড়ে আটকে
না থাকা কাহিনি আমরা পেয়েছি।
শার্লক
হোমসের চিরশত্রু মরিয়ারটির মতো গিল হারভে নিজের আগমন জানায় সাতজন নিরীহ মানুষকে অদ্ভুতভাবে
খুন করে যাদের নাম পরপর সাজালে তার নিজের নামের অক্ষরগুলো পাওয়া যায়।
পেরুর রহস্যময় উপজাতির এক সদস্য কোলকাতায় চলে এসে উবের ট্যাক্সি
থেকে অনিলিখাকে হাতের আঙুলে বৃত্তাকার সংকেত দেখায়। আদর্শ
সিরিজ ভিলেনের মতো গিল হারভে শেষমেশ ধুলো উড়িয়ে উধাও হতে সক্ষম হয় এবং যাওয়ার আগে অনিলিখার
শুভাকাঙ্ক্ষীর হাতের আঙুল কেটে উপহার দিয়ে যেতে ভোলে না।
পড়তে পড়তে
দুয়েকটা জায়গায় খটকা লাগলেও শেষ করে সবকিছু Perfectly
Falls into Place - এমনই মনে হতে বাধ্য। কারণ,
ওই আঙ্গিক। ‘রহস্য যখন সংকেতে’ কোনওভাবেই
সিরিয়াস সায়েন্স ফিকশন নয়। এটিও
বায়োটেকনোলজি, মৌলিক সংখ্যার রহস্য
এবং বিজ্ঞান মিশিয়ে তৈরি আদ্যন্ত সুখপাঠ্য ফ্যান্টাসি। আর
অনিলিখা চরিত্র ও সিরিজের ক্রমবিবর্তন ওই সিরিয়াসনেস থেকে ফ্যান্টাসির দিকে,
যেটাকে শঙ্কুর সাথে তুলনা করে বললাম 6 এবং
9 বা p আর q।
তবে আমার
নিজের প্রেফারেন্স যদি জানতে চান, আমি BvS বা Avengers-এর থেকে The Dark Knight সবসময় এগিয়ে রাখি। তার
মানে অবশ্য এই নয়, Avengers আমি এনজয় করিনি।
কিন্তু নোলানের TDK ছিল মোর দ্যান এনজয়মেন্ট। ইট
ওয়াজ অ্যান্ড স্টিল ইজ আ মাইলস্টোন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অব সুপারহিরো মুভিজ।
সংকেত রহস্যও তাই। বাংলা
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে একটি মাইলস্টোন। অনিলিখা নিজেই নিজের সেই কৃতিত্ব এখনও
ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। পারবে নিশ্চয়,
অনিলিখাই পারবে।
।। দুই।।
অনিলিখাই পেরেছে!
যেরকমটি ভাবা গিয়েছিল।
অনিলিখা
সিরিজের ‘রহস্যের দশ আঙুল’ প্রকাশিত
হয়েছে এই বছরের কিশোর ভারতী শারদীয়া ১৪২৪-এ।
আমরা বিদেশি ক্রাইম
থ্রিলার নভেল বা মুভির আলোচনায় বার বারই ‘gritty’ শব্দটা
পেয়ে থাকি, বাংলায় ‘টানটান’ বহুল ও অযোগ্য ব্যবহারে আরও অনেক শব্দের মতোই ক্লিশে হয়ে গেছে। অনিলিখার এই সদ্য
প্রকাশিত উপন্যাস নিয়ে লিখতে বসে আমি ওই gritty বলা ছাড়া উপায় দেখছি না, তা সেটা কাহিনির জোরই হোক বা
গল্পের নিখুঁতরকম বিন্যাস এবং প্রকরণ। ভিনগ্রহী
সংকেত রহস্যের সমাধান দিয়ে যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার এক অন্য রূপ দেখলাম এই অভিযানে।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhA1EGDZ7QzQHnFp15k82Qfi8V-raXto0A4Nrw7t3gsxsoP6qMeKK3AG_N3D43Z4ODfWt-GtdWyoMxZcmytjs3S2j3QcUGowPYQayuvXCblDjVTYG_F6bci68Kim3cN7UXhB0IlRlsOZKAS/s400/anilikha+4.jpg)
সন্ত্রাস
বা টেররিজম বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভয় ধরানো বিষয়। প্রথম
বিশ্ব, যেখানে মানুষের ভোগ সুখ লাভের পক্ষে কোনও অন্তরায় নেই,
সেখানেই কীসের এক অজানা রহস্যময় নিরর্থকতায় বোমা বিস্ফোরণ, গাড়ি দুর্ঘটনা ও বন্দুকবাজিতে অনায়াসে প্রাণ ছিনিয়ে নেওয়ার এক নারকীয় খেলা
যেন শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণহীন,
যুক্তিবিচারহীন রক্তখেলা ও আত্মবিনাশেই যেন এই খেলার আনন্দ।
কোন বিশ্বাস, কোন শক্তিতে ভর করে ঘটানো হচ্ছে এই খেলা তা নিশ্চিতভাবেই
এখন এলডোরাডো বা ভিনগ্রহীদের চেয়েও বড়ো রহস্য। আর
সেই সমস্যার সমাধানেই এবার অনিলিখা।
অনিলিখাকে
কেন্দ্র করে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং জার্মানির
রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা করার চক্রান্ত কষে সন্ত্রাসীরা। পরিবেশ
সম্মেলনের বৈঠকে অনিলিখার মাধ্যমেই পুরো গেম প্ল্যান সাজায় তারা।
তাদের চক্রান্ত এতই ছককষা নিখুঁত যে দাবা খেলার সঙ্গে তার বিশেষ
পার্থক্য নেই। দাবাও রয়েছে এ চক্রান্তে এক
বিশেষ ভূমিকায়।
একদম শেষে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুতোগুলো নির্ভুল বন্ধনীতে যেভাবে বেঁধে দিয়েছেন লেখক তাতে তাঁর
কলমের জোর প্রমাণিত হয়েছে আরও একবার।
বেশ কয়েকটি
পয়েন্ট অফ ভিউ দিয়ে উপন্যাসটি সাজানো হয়েছে। তাতে
লেখা গতিমান হয়েছে। মোক্ষম মুহূর্তে তাদের ভূমিকা
শেষ করাতে সাসপেন্স হয়েছে আরও জোরদার। বিদেশি
থ্রিলারের সমস্ত প্রকরণ এই ছোট্ট রহস্য উপন্যাসে উপস্থিত, শুধু বাগাড়ম্বর বাদে।
জন এবং
হ্যানা যেভাবে সন্ত্রাসবাদীদের চক্রান্তে তিলে তিলে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের অজান্তেই,
যেভাবে বন্ধুতার মুখোশ খুলে দেন লেখক তা সত্যিই হাড়হিম করে দেওয়ার মতো।
এই নভেলার আরও একটি সার্থকতা এখানেই যে কোনও হররধর্মী লেখা না
হয়েও শিরদাঁড়ায় শিরশিরে ভাব জাগিয়ে দিতে এ লেখা সম্পূর্ণভাবে সফল।
যে বস্তু বা বিষয়কে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বোঝা যায় না,
কারণ সমাধান ব্যাখ্যা করা যায় না, সে বিষয়ই মানুষকে যুগে যুগে ভয় পাইয়ে
এসেছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে তা ছিল
অন্ধকার, মধ্যযুগে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস
এবং ডাইনি, আধুনিক যুগে তা-ই সন্ত্রাসবাদ।
আর সেজন্যই অনিলিখার এ যাবত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আশ্চর্যজনকভাবে
নিখুঁত (সংকেত রহস্য মাথায় রেখেই বলছি) এই অভিযান একটি শরীর হিম করে দেওয়া ভয়ের উপন্যাস।
তবে স্বস্তির বিষয়,
অনিলিখার কারণে শেষমেশ একটু উষ্ণতা পাঠক পাবেনই বাস্তব যতই দিন দিন শীতলতর
হোক না কেন!
পুনশ্চঃ আফসোসের কথা,
লেখাটি যেন বড়ো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। খেলা জমতেই হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়ে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে খেলার সমাপ্তি ঘটিয়ে দেওয়ার মতো। লেখককে
অনুরোধ, বই আকারে বেরোনোর সময় খেলা আরও জমানো যায় নাকি?
_____
গল্পের ছবিঃ
আন্তর্জাল
কোলাজ ছবিঃ রাজর্ষি
সরকারের সৌজন্যে
No comments:
Post a Comment