ইয়াকতেনের আগন্তুক
রম্যাণী গোস্বামী
(১)
আমাকে দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল
মধ্যবয়সি সিকিমিজ ভদ্রলোকের। আগেভাগে কোনও খবর না দিয়ে এত বেলায় কোত্থেকে, কীভাবে
উদয় হলাম আমি এখানে - এই প্রশ্নগুলো মুখে না করলেও মনে মনে তিনি যে এসবই ভাবছিলেন
তা আমি আঁচ করতে পারলাম। সেটাকে খুব বেশি আমল না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, “রুম মিলেগা?” তারপরই ওঁর
চোখের সামনে মেলে ধরলাম আমার আইডেন্টিটি কার্ড।
যেন ভীষণ অনিচ্ছা। তবুও
হাত বাড়িয়ে কাউন্টারের উপর থেকে খাতাটা টেনে নিলেন উনি। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি
পড়ছে। একে শীত তায় কুয়াশা তার ওপর এই বৃষ্টি। গাড়িটা লক করে রেখে এসেছি নিচে।
পাহাড়ের ঢালে। তারপর এতটা পথ চড়াই ঠেলে এসেছি। রেইনকোট সঙ্গেই থাকে সবসময়। পাহাড়ি
জায়গায় আচমকা বৃষ্টি পড়াটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। সেজন্য সাবধান থাকতে হয়। গ্যাংটক থেকে বেরিয়েছিলাম লাঞ্চ করে। খিদেয় পেট
চুঁইচুঁই করছে। তাড়াতাড়ি ডিনার করেই লেপের তলায় ডাইভ
দিতে পারলে ভালো হত এমন ওয়েদারে, কিন্তু অত আরাম কপালে নেই আমার। যে কাজে এসেছি তা
অনেক জরুরি।
এটা একটা প্রাইভেট হোমস্টে।
রুমটা ছোটো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। লাগেজ রেখে ডাইনিং হলে এসে এক কাপ চা আর কিছু
খাবারের অর্ডার করলাম। একটি হাসিখুশি মেয়ে ঢাকনিওয়ালা ড্রাগন আঁকা ফিনফিনে রঙিন
কাপে চা দিয়ে গেল টেবিলে। হয়তো মালিকেরই মেয়ে। সঙ্গে কাচের প্লেটে ধোঁয়া ওঠা মোমো।
কাচের বাটিতে ডাল্লের গাঢ় লাল চাটনির ভিতরে ছোট্ট হলুদ চামচ ডুবে আছে। ওটা দেখেই
পেটের খিদেটা আরও চাগিয়ে উঠল আমার।
চটপট খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে
পড়লাম। বাইরে সিকিমের এই নির্জন পাহাড়ি গ্রাম ইয়াকতেন ভ্যালিতে গাঢ় সন্ধে নামছে।
এখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু কনকনে শীত পুরু জ্যাকেট ভেদ করে সোজা ভিতরে ঢুকে পড়ে আমার
হাড়ে মজ্জায় শিরশিরানি ধরিয়ে দিচ্ছে। অনেকবার বুঝিয়ে দেওয়া ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
শেষমেশ প্রকাশ দাজুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। আধো অন্ধকারে বাংলো প্যাটার্নের
বাড়িটা ঘিরে পাক খাচ্ছে ঘন কুয়াশা। বাড়ির ঠিক পিছনটায় থমকে আছে প্রায় একশো বছরের
পুরনো সেই পাইন বন। বনে ঢোকার পায়ে চলা রাস্তাটা যেন সেই কুয়াশার বুকে শূন্যে
মিলিয়ে গেছে। প্রকাশ দাজুর কাছে কত গল্প যে শুনেছি এই রহস্যময় পাইন বনের। কলকাতায়
আমার ফ্ল্যাটে ল্যাপটপ স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ফুটে ওঠা সেইসব শব্দগুলো যদি সত্যি
হয় তবে এই বনের গভীরেই আছে সেই প্রাচীন গুহা। আর সেই অতি প্রাচীন যোগী পুরুষ যিনি দুশো
বছর পরও বেঁচে ছিলেন এই এলাকায়। প্রত্যেক বছর তাঁর প্রয়াণের দিনে মানে আজ
রাত্রিবেলা তাঁর আত্মার দর্শন পাওয়া যায় ওই পাইন বনের ভিতরে গুহার সামনে।
স্থানীয় মানুষেরা আসে তাদের নানা সমস্যা, বিভিন্ন রোগভোগ নিয়ে। উনি নাকি জড়িবুটি
দেন। গাছের বাকল, পাতা-টাতা এসব। যা খেয়ে রোগ
সেরে যায় অনেকেরই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাইরের লোকের সামনে তিনি কি নিজের দেখা দেবেন?
প্রকাশ আমাকে জানিয়েছে যে হ্যাঁ। ইচ্ছে হলে দিতেও
পারেন। বাকিটা আমার ভাগ্য।
আমি
কিন্তু সত্যি-মিথ্যেটাই যাচাই করতে এসেছি এখানে। যে প্যারানর্মাল সোসাইটিতে আমি
কাজ করি সেখানে এসব মনগড়া গল্পকথার কোনও স্থান নেই। কত পুরনো মন্দিরের ভাঙা দেউলে
চাঁদের আলোয় রাত কাটিয়েছি আমি অশরীরীর খোঁজে। হাওয়ায় গাছের পাতা সরসর করে দুলে
উঠেছে। যেন কেউ আসছে। কিন্তু কোথায়? নাথিং। জঙ্গলের ভিতরে কত রাত গাড়ি দাঁড় করিয়ে
হেডলাইট নিভিয়ে চুপ করে বসে থেকে শুনেছি পাতার মচমচ আওয়াজ। খুব কাছ দিয়ে মটমট করে
ডাল ভাঙতে ভাঙতে চলে গেছে বুনো হাতির পাল। চোখ সরু করে অপেক্ষা করেছি অলৌকিক কিছুর। কাহাবত আছে যে ওই
জঙ্গলে রাতে ঘুরে বেড়ায় সাদা শাড়ি পরা নারীমূর্তি। কিন্তু তারও দেখা পাইনি। আমার
জ্যাকেটের পকেটে রয়েছে পেনের মতো দেখতে একটা ইনফ্রারেড ক্যামেরা। আবছা আলোতেও
পরিষ্কার ভিডিও রেকর্ডিং হয় ওতে। ইচ্ছে আছে আজ যদি সেই মায়াবী যোগী পুরুষের দেখা
পাই, সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়াব লোকটার। জিজ্ঞেস করব, আসল পরিচয়টা দিন তো মশাই। বয়স কত? ষাট
না সত্তর? ধাপ্পাবাজিটা ধরে ফেলব আর তারপর পুরো ব্যাপারটা নিয়ে একটা জম্পেশ করে
স্টোরি করব আমাদের চ্যানেলে।
আমার
পায়ের তলায় খচমচ শব্দ করে গড়িয়ে গেল নুড়ি-পাথর। দেখলাম, অন্ধকার কাঠের বাড়িটার
একটা ঘরে মৃদু আলো জ্বলে উঠেছে। জানালার কাচের পাল্লা দিয়ে অস্পষ্ট সেই মোমবাতির আলোটা এক
মুহূর্ত স্থির হয়েই সরে গেল বাঁদিকে। আমি কাঠের গেট খুলে সুঁড়িপথ ধরে এক পা এক পা করে এগিয়ে
গেলাম রেলিং ঘেরা বারান্দার দিকে। আরও কিছুক্ষণ পর খুলে গেল কাচের পাল্লা দেওয়া
দরজা। মোমবাতি হাতে যে শক্ত-সমর্থ পুরুষটি বেরিয়ে এল তাকে দেখে আমি একটু হকচকিয়েই
গেলাম। প্রকাশ দাজু! ই-মেইলের মাধ্যমে একবারই আমাকে নিজের যে সাদা-কালো ছবিটা
পাঠিয়েছিল প্রকাশ তার সঙ্গে মুখের আদল মিলে যাচ্ছে অনেকটাই। জলপাইরঙের লেদার
জ্যাকেট পরনে। মাথায় হ্যাট। পায়ে গামবুট। কিন্তু ফোনে গলা শুনে যতটা বয়স্ক মনে
হয়েছিল ভদ্রলোক তার চাইতে অনেক অনেক ইয়ং।
“আপনিই
প্রকাশ? ই-মেইলগুলো আপনিই করেছিলেন আমাকে? আমি সাত্যকি। সকালে ফোনটা আমিই করেছিলাম
গ্যাংটক থেকে।” এই বলে নিজের আইডেন্টিটি কার্ডটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে।
জবাবে
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল প্রকাশ। করমর্দনের পর সর্দি-বসা গলায় যা বলল তা হল, আমাকে
ঘরে ডাকার ইচ্ছে ছিল ওর। কিন্তু এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। বনের ভিতরে অনেকটা
পথ। কুয়াশা-ঢাকা অন্ধকার রাস্তা। আজ আবার সারাদিন ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়েছে। পিছল হয়ে
আছে পথ। যেতে হবে খুব সাবধানে। বহু সময়ের ব্যাপার। সেল ফোনে দেখলাম সাড়ে ছটা।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছে প্রকাশ। আর দেরি করা ঠিক নয়।
সিকিমিজরা
সাধারণত ভীষণ অতিথিপরায়ণ হয়। প্রকাশের কুণ্ঠাটা আমি বুঝতে পারছিলাম। কথা হিন্দিতেই
হচ্ছিল। ওকে সহজ করার জন্য বললাম, “ঠিক আছে। ফেরার সময় ঢুঁ মারব তোমার বাড়িতে। চা-ও
খাব এক কাপ। সে জিনিসটাও তো দেখাবে, তাই না? মনে আছে?”
প্রকাশ
ব্যস্তভাবে বলল, “আজ একটু তাড়া আছে। ফিরেই আমাকে একজায়গায় বেরোতে হবে। কাল দেখাব।”
তারপর
মোমবাতিটা এক ফুঁয়ে নিভিয়ে রেখে দিল বারান্দায় পেতে রাখা বাঁশের ফোল্ডিং টেবিলে। ওর
পকেট থেকে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট হাই পাওয়ারের টর্চ। আমরা পা ফেললাম পাইন বনের
রাস্তায়।
(২)
অদ্ভুত
ছমছমে বনের ভিতরটা। উঁচু উঁচু পাইনগাছের মধ্য দিয়ে সরু পথ। হিমে ভেজা নরম পুরু
ডালপালা আর পাতার আস্তরণে ঢেকে আছে সেটা। সাবধানে না চললে পা স্লিপ করে যাবে। স্যাঁতসেঁতে গাছের
গুঁড়িতে হাত ছোঁয়ালে হাতের পাতা ভিজে যায়। মেঘ কেটে গিয়ে আধখানা চাঁদের আবছা আলোয়
চারপাশ দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছি দু’জনে। প্রকাশ আমার আগে। ওর হাতের টর্চটা
জ্বলছে, নিভছে। মোবাইলটা বের করে দেখে নিয়েছি ইতিমধ্যে। হোমস্টেতে তবুও টিমটিম
করছিল সিগনাল। এই পাইন ফরেস্টে ঢোকা মাত্র সব উড়ে পালিয়েছে। থমথমে অরণ্যটা কেমন
টানছে আমাকে। মনে মনে বেশ একটু রোমাঞ্চ অনুভব করছি। মন বলছে এই যাত্রাটা আমার
বিফলে যাবে না।
এখন
পথটা আরও দুর্ভেদ্য হয়েছে। ধীরে ধীরে দু’জন প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে চলছি। সময় পেরিয়ে
যাচ্ছে। আমার অস্থিরতা বাড়ছে। এতক্ষণ ধরে হেঁটেও সেই গুহার চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
পথ ভুল করেনি তো প্রকাশ দাজু? ফরেস্টে ঢোকার পর একটাও কথা বলেনি লোকটা। প্রকাশের
দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা জিনিসে চোখ পড়তেই মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি। প্রকাশ
এগিয়ে গেল কয়েক হাত। আচমকাই যেন একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম আমরা। ধোঁয়ার মতো
কুয়াশা পাক খাচ্ছে চারদিকে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে ভালো
করে চারদিক লক্ষ করে বুঝলাম যে এটা একটা গ্রেভ ইয়ার্ড। কিন্তু গুহা? সেই কিংবদন্তী
যোগী? স্থানীয় ভক্তদের সমাগম? সব কোথায়? প্রকাশের হাঁটা থেমে গেছে। পথশ্রমের
ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছি দু’জনেই।
“এ
কোথায় নিয়ে এলে? পথ ভুল করেছ?” আমার এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না ও। ওর ঠোঁটের
কোনায় লেগে থাকা একটা ক্রূর হাসি আর ধকধক করতে থাকা চোখের শীতল দৃষ্টি আমার
স্নায়ুকে বিপদের সংকেত দিচ্ছিল। আমার মনে হল ও যেন কিছু একটার প্রস্তুতি নিচ্ছে
মনে মনে। ঠিক এই সময় যে বেয়াড়া প্রশ্নটা এতক্ষণ ধরে করব কি করব না ভাবছিলাম, সেটা
বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে। প্রকাশের উদ্দেশে বললাম, “তোমার ঘাড়ের পাশে ডানদিকে ওটা
কীসের উল্কি বলো তো? নোঙরের মতো দেখতে? তুমি কি জাহাজে চাকরি করতে কখনও?”
চমকে
আমার দিকে ঘুরে তাকাল ও। এই আবছা আলোতেও ঠিক লক্ষ করলাম যে ওর মুখ ছাইয়ের মতো
ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাঁ হাতটা পকেটের ভিতরে ঢোকানোই ছিল আগাগোড়া। খেয়াল করলাম, ওর
বাঁ হাতের পেশী শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে।
তারপর
নিমেষের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ও ওর বাঁ হাতের লিকলিকে ছুরিটা নিয়ে আমার ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই আমি সতর্ক হয়ে এক পা পিছিয়ে এসেছিলাম। তারপর শুরু হল আমাদের মধ্যে
প্রবল ধস্তাধস্তি। ঘাড়ের নিচে এক রদ্দা পড়তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। কিন্তু
ততক্ষণে ছুরির তীক্ষ্ণ প্রান্তের আঘাতে আমার কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। ওর জ্যাকেটের পকেট
হাতড়াতে হাতড়াতে ডান পকেটে আমি পেয়ে গেলাম একটা ভেলভেটের বটুয়া। যার মুখটা খুলতেই আমার
হাতের তালুর মধ্যে ঝলসে উঠল একটা অদ্ভুত জিনিস। সেটা হল সিকিমের রাজা চোগিয়ালের
উপহার, যা পেয়েছিলেন প্রকাশ দাজুর দাদুর বাবা, যিনি ছিলেন রাজার নায়েব এবং উত্তরাধিকারসূত্রে
হাতে আসে প্রকাশের। সেই বহুমূল্য ঐতিহ্যশালী দেড় আঙুল সমান সোনা-হিরে-রত্ন খচিত
জিনিসটা হল একটা প্রাচীন সিকিমিজ মাস্ক বা মুখোশ। এটার কথা বিগত দু’মাসে মেইল
চালাচালির সময় অনেকবার শুনেছি আমি প্রকাশের মুখে। আজ আমায় দেখাবে বলে কথাও দিয়েছিল
ও। তাহলে এই লোকটা কে?
এ
যেই হোক। এখন আমাকে যেমন করেই হোক বেরোতে হবে এই জঙ্গল থেকে। তারপর পুলিশ এসে যা
করার করবে। সারারাত এখানে পড়ে থাকলে ঠাণ্ডাতেই মরে যাবে লোকটা। আর প্রকাশ? সে কোথায়?
আমি কাঁধের কাছে ক্ষতটা চেপে ধরে ছুটতে শুরু করলাম পাইন বনের মধ্য দিয়ে। দম ফেটে
আসছে। পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কতক্ষণ এভাবে ছুটেছি জানি না। আর পারলাম না। অবশ হয়ে একটা
গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম। হঠাৎ একটা অদ্ভুত গন্ধ
নাকে এসে শিরা-উপশিরাকে উদ্দীপিত করে আমাকে জাগিয়ে তুলল। সামনেই দেখলাম এক
বৃদ্ধকে। অসংখ্য বলিরেখা পড়া মুখের চামড়া প্রবলভাবে কুঁচকে গেছে বয়সের ভারে। ট্র্যাডিশনাল
সিকিমিজ পোশাক পরনে। ঝুঁকে বসে আমার ক্ষতস্থানে কীসব লতাপাতার প্রলেপ লাগিয়ে
দিচ্ছেন। তার সমস্ত শরীর থেকে ভেসে আসছে এক মায়াময় সৌরভ। আমাকে ধড়ফড়
করে উঠতে দেখে তিনি স্মিত হেসে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করলেন একটা পথ। তারপর বাতাসে
মিলিয়ে গেলেন। হ্যালুসিনেশন? তাই হবে।
(৩)
সেদিন
রাত যখন সাড়ে দশটা তখন বহু লোকজন জড়ো হয়েছিল প্রকাশ দাজুর বাড়িতে। পেটের বাঁ পাশে
গভীর ক্ষত ছিল মধ্যবয়সী লোকটির। তিনি পড়ে ছিলেন তাঁর বসার ঘরের সোফার নিচে। আমি গিয়ে
প্রতিবেশীদের দিয়ে ডাক্তার না ডাকালে উনি বাঁচতেন না। ওই ছেলেটিকেও জীবিতই উদ্ধার
করা হয় পাইন বনের মাত্র চার কিলোমিটার ভিতরে। সে প্রকাশের গাঁজাখোর বখাটে ভাইপো
বিজেত। বহুদিন বাইরে ছিল নানা কাজের ধান্দায়। হয়তো খুনজখমেও হাত
পাকিয়েছিল। কিছুদিন জাহাজের খালাসির কাজও করেছিল সে। চারদিকে
দেনা নিয়ে পুলিশের কাছ থেকে তাড়া খেয়ে সেদিন সকালেই সে হাজির হয়েছিল বিপত্নীক
কাকার আশ্রয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার উদ্দেশ্যে। হয়তো আড়াল থেকে
প্রকাশের সঙ্গে আমার ফোনের কথোপকথন সে শুনে নিয়েছিল। শ্রীমান এখন হাজতে। আমার
কাঁধের ক্ষতটা কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই শুকিয়ে গেল। বোধহয় আঘাত অত গভীর ছিল না। মোটা
জ্যাকেটটা বাঁচিয়ে দিয়েছে।
প্রকাশের
হাতে যখন ওদের পারিবারিক মুখোশটা ফিরিয়ে দিলাম, কৃতজ্ঞতায় চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ওর।
বলছিল, “নেক্সট ইয়ারে এসো, সাত্যকি। সেই যে যোগীর স্পিরিট, জঙ্গলের ভিতরের গুহা - দেখানো হল না
তো! এতদূরে আসাটাই বৃথা হল তোমার।” হসপিটালের বেডে শুয়ে স্যালাইন নিতে নিতে আপশোশের ভঙ্গিতে
বলছিল কথাগুলো প্রকাশ বারবার।
গ্যাংটক
থেকে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় পাহাড়ের একদিকে গভীর খাদের নিচে বয়ে চলা
রুপোলি তিস্তার দিকে তাকিয়ে বারবার মনে পড়ছিল রহস্যময় সেই রাতের কথা। ইয়াকতেন
ভ্যালির কুয়াশামাখা গভীর পাইন বনে আঁধার রাতে কে ছিলেন ওই বৃদ্ধ? কেন গিয়েছিলেন অত
রাতে একা একা নির্জন বনের মধ্যে? তবে কি উনিই সেই অলৌকিক যোগীর আত্মা? দু’শো বছরের
বেশি ছিল যাঁর আয়ু? আমার পকেটে হিডেন ক্যামেরা ছিল। একটা ছবিও যদি তুলে নিতাম ওঁর। একটু যে আপশোশ
আমারও হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু তারপরই মনে হল, নাহ্, থাক। কিছু রহস্য তার মায়াভরা
স্পর্শ নিয়ে বেঁচে থাক চিরকাল। সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে জীবনটা যে খুব একঘেয়ে হয়ে যাবে। তাই না?
_____
অলঙ্করণঃ
পুষ্পেন মণ্ডল
আমার কন্যার তোমার গল্প পছন্দ হয়েছে
ReplyDelete